রিমি সমাপনী পরীক্ষায় পাস করার পর নতুন ইশকুলে ভর্তি হয়েছে। রিমির নতুন ইশকুলে এখন তার নতুন নতুন অনেক বন্ধু। নতুন এই বন্ধুত্ব শুরু হয় ইশকুলের নবীণ বরণ প্রবীণ বিদায় অনুষ্ঠানে। রিমির নতুন ইশকুলে রাফি নামের ছেলেটি সবার থেকে আলাদা। ছেলেটির ডান পা, বাম পায়ের থেকে ছোট। আর এই ছোট ডান পায়ের জন্য হাঁটতে তার সমস্যা হয়। সবার মত সে ঠিক করে হাঁটতে পারে না। ফর্সা গোলগাল গঠনের রাফি শারিরীক প্রতিবন্ধী হলেও সুন্দর মনের অধিকারী। তার মুখে সব সময় মায়াবী হাসির বন্যা। ছেলেটির চেহারা তার মনের মত সুন্দর। দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকা অবস্থায় রাফিকে দেখলে প্রতিবন্ধী বলে মনেই হয় না। আজ ইশকুলের প্রথম ক্লাসে এসে রিমি রাফির পাশে বসল। পরিচিতি পর্ব শেষে রিমি জানতে পারে, রাফি এখানকার স্থানীয় ছেলে । রিমির বাবার মতো রাফির বাবা সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নন, তিনি একজন চাষি । রিমি বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকা থেকে এসে ছোট শহরের এই ইশকুলে ভর্তি হয়েছে। নতুন ইশকুলের নতুন স্যার রোল কল করার পর রিমি এটাও জানল যে, ইশকুলের ভর্তি পরীক্ষায় যে ছেলেটি প্রথম হয়েছিল এই সেই রাফি। পুরো নাম সাব্বির খালেদ রাফি। দ্বিতীয় সানজিদা সুমা আর তৃতীয় সে নিজে। ফারজানা রিমি। একে একে সবার রোল জানার পর, প্রতিটি ক্লাসেই নতুন স্যার আর নতুন ম্যামদের সাথে পরিচয় আর গল্প আড্ডায় প্রতিটি ক্লাসই শেষ হয়ে গেল। ছুটির সময় যখন রিমি, রাফি, সুমা, নীলি আর রাইসার সাথে ইশকুলের গেইট অবধি আসছিল, রিমির মা তখন তাদের নতুন লাল গাড়ি নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সবাইকে বিদায় জানিয়ে রিমি মায়ের সাথে গাড়িতে চড়ে বাড়ি ফিরল। গাড়িতে বসে রিমি নতুন ইশকুলের গল্প বলার আগেই মা বললেন, রিমি, তোমার সাথে যে ছেলেটি নেচে নেচে হাঁটছিল তার সাথে মিশবে না। বুঝলে? রিমি মাকে তখন বলতে চেয়েছিল যে, ছেলেটির নাম রাফি। প্রতিবন্ধী হলেও ছেলেটি মেধাবী। কিন্তু মায়ের টগবগে রাগে লাল হয়ে যাওয়া চোখের দিকে চেয়ে সে থেমে গেল। মাথা ঝুঁকিয়ে হ্যাঁ বোধক ভঙ্গিতে মায়ের কথায় সায় জানাল। সে মন থেকে মায়ের এই কথা মানেনি। ইশকুলে প্রতি দিনই সে রাফির পাশে বসে। গ্রামের নদী, ঘন সবুজ মাঠ, সোনালি ধানক্ষেত, ছোট বিল সহ নানান কিছুর গল্প শুনে রাফির মুখে। রাফি মুখে হাসি নিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কী সুন্দর করে সেসব গল্প বলে যায়! শুনলে মনে হয় এই বুঝি চোখের সামনে কোন শিল্পী তুলির আছড়ে সেই ছবি এঁকেছেন। গল্প আর আড্ডায়, হাসি আর খুশিতে কাটছিল নতুন স্কুলের দিনগুলি। একদিন ক্লাসে বাংলা স্যার ঘোষণা করলেন, জানুয়ারির শেষে প্রতি বছরের মত এই বছরেও আমাদের ইশকুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। ইশকুলে যে কেউ এতে অংশ নিতে পারবে। স্থানীয় এবং শহর থেকেও অনেক অতিথি আসবেন। বিজয়ীদের পুরষ্কার দিবেন। ইত্যাদি। ইত্যাদি…
বাঁধভাঙা উল্লাস আর খুশিতে সেই অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। আর শেষ হওয়ার পর রিমি যখন রাফি, রাইসা, সুমা আর নীলিদের সাথে মঞ্চের দক্ষিণ কোণে পুরস্কার নিয়ে গল্প করছিল— তখন রিমির মা এসে উপস্থিত। রাফির সাথে মিশতে রিমিকে নিষেধ করার পরও সে রাফির সাথে গল্প করছিল দেখে, রিমির মা মিসেস লায়লা রেগে দ্রুত রিমিকে নিয়ে মঞ্চ ত্যাগ করে গাড়িতে এসে উঠলেন। রিমি বন্ধুদের থেকে বিদায় নেওয়ার সময়টুকুও পায় নি। মিসেস লায়লার অদ্ভুত এই আচরণের রহস্য বুঝতে না পেরে রাফি, রাইসা তাকিয়ে রইল তাদের চলে যাওয়ার দিকে। সুমা আর নীলিও ঘটনার কিছুই যে বুঝেনি—তাদের নিশ্চুপ থাকাটাই তার প্রমাণ দেয়। গাড়িতে যখন রিমিকে মিসেস লায়লা ধমক দিয়ে বলছিলেন, ওই ছেলেটির সাথে তোমাকে মিশতে মানা করার পরও কেন ওর সাথে মিশেছ? তুমি কি দেখ না ছেলেটা প্রতিবন্ধী! তবে কেন… এতটুকু বলে যখন রিমির মা থেমে গেলেন, রিমি তখন মাকে বলতে চেয়েছিল; জানো মা, রাফি না জাদুকর—কথায় কথায় হাসায়। আর মজার মজার কথা বলে। আজ সাংস্কৃতিক পর্ব শুরুর আগে অনেক অনেক ম্যাজিক দেখিয়েছিল। ধবধবে সাদা কাগজ থেকে মন্ত্র বলে রঙিন ফুল বানিয়েছে। আর মুরগীর ডিম হাতে নিয়ে মন্ত্র বলার সাথে সাথেই সেটা হয়ে গেল—ছোট একটি কবুতর। কী সুন্দর আর ফুটফুটে! পুরো মঞ্চ জুড়ে সে কি হাত তালির শব্দ। যখন রাফি, অর্ধেক ইটের সমান দুই টুকরো পাথর মন্ত্র পড়ে ইয়াব্বড় দুইটা রাজহাঁস বানিয়ে ফেলল! আর ইশকুলে সে খেলার ছলে রাবার, পেনসিল কিংবা কলম কত কিছু যে ভেনিস করেছে তার হিসেবই নেই… অদ্ভুত এই চমৎকার জাদু দেখিয়ে রাফি অতিথিদের থেকে আজ পুরস্কার হিসেবে চার হাজার টাকার বই পেয়েছে। কিন্তু না, মায়ের রাগি রাগি লাল লাল বড় বড় চোখ রিমিকে থামিয়ে দিলো। মিসেস লায়লা এবারও রিমিকে রাফির সাথে মিশতে নিষেধ করলেন। রিমি মায়ের কথার সাথে নতুন কথা যোগ না করে মন খারাপ নিয়েই বাড়ি ফিরল। সারা পথ আর একটি কথাও সে বলেনি। তার মা যদিও বিড়বিড় করে বারবার রাফিকে অবহেলা করে যা তা বলছিলেন—রিমি তার সব কথাই শুনছিল, ঘুমের ভান করে চুপচাপ গাড়ির সিটে শরীর এলিয়ে।
কিছুদিন পর ক্লাসে গণিত স্যার বললেন, তোরা সবাই জানিস তো আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে বিভাগীয় গণিত অলিম্পিড অনুষ্ঠিত হচ্ছে? সেখানে কে কে অংশ নিবি? আমাকে বলবি আমি সেখানে তোদের তালিকা পাঠিয়ে দেব। স্যারের ঘোষণা শেষ না হতেই রিমি রাফিকে সেখানে অংশ নিতে বলল। স্যার ইশকুলের সপ্তম, অষ্টম, নবম আর দশম শ্রেণীর চারজনের নামের ভিড়ে রাফির নামও তালিকায় টুকে নিলেন। বিভাগীয় সেই গণিত অলিম্পিডে আড়াই হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে পিছনে ফেলে প্রথম হয় রাফি। টিভিতে সেই খবরটি দেখানোর সাথে দেশের প্রথম সারির পত্রিকায় তা ছাপা হয়। পরেরদিন সকালে যখন বেলকনিতে রিমির বাবা নায়েব আলি পত্রিকা পড়ছিলেন—মিসেস লায়লা তখন তাকে নাশতা দেবার সময় খবরটির সাথে রাফির ছবি দেখে চমকে উঠেন। পত্রিকার প্রথম পাতায় লেখা, প্রতিবন্ধী রাফি গণিত মাস্টার। আহা! খবরটি পড়ে মিসেস লায়লা আফসোস করলেন! রিমিকে ডেকে রাফির সব জানার পর ইশকুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। ইশকুলে সেদিন বাঁধভাঙা উল্লাস। সে কি হই হুল্লোড়… বাপ রে বাপ! রাফি বিভাগীয় গণিত অলিম্পিডে প্রথম হওয়ায় তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। মিসেস লায়লা রাফিকে ডেকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে অভিনন্দন জানালেন। মনে মনে নিজেকে বললেন, প্রতিবন্ধী হলেই কাউকে অবহেলা আর উপেক্ষা করা ঠিক নয়। মিসেস লায়লা সেই থেকে শপথ নিলেন অবহেলা নয় প্রতিবন্ধীদের জন্য নিজের মনে পোষতে হবে আন্তরিকতা আর গভীর ভালোবাসা। উনার সেই বোধোদয় তাকে জানিয়ে দিল মেধা কিংবা প্রতিভা মানুষের শরীরে নয়—মাথার মগজ জুড়ে। সেই দিনের পর থেকে নতুন করে জন্ম নেয় রিমি আর রাফির বন্ধুত্ব।