হন্তদন্ত হয়ে সুমনা একটানে ছিঁড়ে ফেললো খামটা। পিয়ন এসে খানিকক্ষণ আগেই দিয়ে গেল চিঠিটা। অন্য সময় চিঠি পেলে সুমনা টেবিলের উপর থেকে কাঁচি নিয়ে যত্ন সহকারে খামের মুখটা খুলে তারপর চিঠি পড়ে। একবার নয় কয়েকবার না পড়লে শান্তি পায় না সে। কি আছে ঐ চিঠিতে ওর চোখে—মুখে চাপা উত্তেজনা।
সুমনা,
তুমিতো জানো, তোমাকে নিয়ে আমার কত স্বপ্ন। স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—মনের ভিতর জেগে ওঠা বোধ থেকে তোমার কাছে দু’কথা লিখছি। আজ এই সময়ে তোমাকে জানানোর প্রয়োজনীয়তা সব থেকে বেশি বলে মনে করছি। তোমার জন্য আমি সারাজীবন পথ চেয়ে বসে থাকব।
শিহাব
শৈশবে বাবার চাকুরিসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় কাটাতে হয়েছে সুমনাকে। সুনামগঞ্জে খেলার মাঠে একজন সুঠামদেহী যুবকের মত দেখেছে শিহাবকে সে। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে পেশীগুলো যেমন ফোলা আর শক্ত থাকে তেমনি ছিল তার। শ্যামলা বর্ণের, মাথাভর্তি ঘনচুল, বুকের উঁচু পাঁজর, তামাটে চেহারায় পুরুষালি চলনে বলনে দারুণ ভালোলাগা কাজ করেছিল সে সময়। যখন সবে এসএসসি’র দোরগোড়ায় সুমনা। তারপর অনেক বছর। সুনামগঞ্জ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী এখন সে। টেবিল টেনিসের একজন সেই রকম খেলোয়াড়। মহাবিশ্বের এত মানুষ থাকতে চোখের মনিজুড়ে ছেয়ে আছে শিহাবের অবয়ব আর গগনবিদারী হাসি। প্রাকটিস করার এক ফাঁকে হঠাৎ থমকে যায় সুমনা। স্মৃতিতে ঝর ওঠে। যার কথা ওর মনে, নিঃসঙ্গ মনের খেলাঘরে যাকে ধরে রেখেছে এতদিন এইতো সে। একটু এগিয়ে, “আমি ভুল না করলে আপনি শিহাব ভাইয়া তো? কেমন আছেন?” চেনা যাচ্ছে কিনা ইত্যাকার নানা প্রশ্ন ওর মুখে ।
ঠিকই ধরেছেন। আমিই শিহাব। আপনি সুমনা।
সুমনা রীতিমতো অবাক। আর আজ. … !
সুমনাকে একরকম ঘৃণা করে চলে গেছে— যাকনা। তার উপেক্ষার ভাষা, তার আক্রোশ হঠাৎ—ই জলে ডুবে গেল কেন৷ একটা সময় শিহাবের প্রস্তাবে রাজী হয়নি বলে কত কথাই না শুনিয়েছে। আমরা থাকব একসাথে, কে জানবে আমরা স্বামী—স্ত্রী নই। বাড়ি থেকে আত্নীয় স্বজন সবাই জানবে আমরা যে যার মত হলে আছি, কখনো মেসে, কখনো আত্নীয় বাড়ি এভাবে যখন যেভাবে বলে কাটিয়ে দেব। চাকরির একটা বন্দোবস্ত হলে— বৈবাহিক সম্পর্ক পাকাপোক্ত করে নিতে আমাদের আর কালক্ষেপণ হবে না। তবুও আমাদের সাধনা, আমাদের ভালোবাসা টিকে থাক। তোমার নিবিড় সান্নিধ্য পেতে আমি আকুল সুমনা। তুমি অমত করোনা লক্ষীটি।
সুমনা শিহাবকে প্রচন্ড ভালোবাসে। কিন্তু তার মানে এই নয় লিভ টুগেদার করতে হবে। জীবন অনেক বড় পথ। সব প্রস্তাবে রাজী হলে জীবন জটিলতায় ভেসে যাবে। অনৈতিকতা চাপা থাকে না। ক্ষুধা মিটে গেলে ভরা পেটে অনেক ভালো খাবার বিস্বাদ লাগবে। এসব জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে শিখেছে সুমনা। ও জানে সবকিছু কিতাবে থাকে না। আত্নীয় স্বজন, বন্ধু, পরিবেশ থেকে শিখতে হয়। শেখার শেষ নেই। এইতো ক’ দিন আগে ওদের বন্ধু তন্ময়ের ভাবনায় লেখা ছাড়া কেউ ছিল না। তন্ময় লেখাকে বলেছিল— ‘তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন। তুমি আমার প্রথম ভালোবাসার ফুল। তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না। ‘ তন্ময় আবার নাজকেও পছন্দ করে। লেখা কয়েকদিন দেখেছে ওদেরকে একই সাথে রিকসায় ঘুরতে।
সুমনার কাছে সব অস্পষ্টতা আস্তে—আস্তে পরিষ্কার হতে লাগলো। গোটা—গোটা অক্ষরে লেখা কথা। হঠাৎ কী হলো শিহাবের। সুমনাদের গ্রামের বাড়ির চারপাশ খােলা চৌহদ্দির একদিকে দু’বিঘা জমি নিয়ে পুকুর। পুকুরের পাড় ঘেঁষে কলা, লেবু গাছ। থোকায় থোকায় লেবু ধরে আছে। লেবু গাছের মাথাটা লেবুর ভাড়ে যাতে নুইয়ে না পড়ে সেজন্য বাঁশের মাচা দিয়ে ঠ্যাকা দেয়া হয়েছে। বাবুই পাখি খেলা করে মাচায়। সেখানে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে, বাচ্চা দেয়।
সুমনা কিশোরী বালিকার মতো ঘাসের আঁচলে মুখ লুকিয়ে শান্তি খোঁজে। বাবুই পাখির সংসার দেখে। বাতাসের সাথে কথা সারে। দুপুরের নিঃসঙ্গ আবহে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি কপালে লাল টিপ ওষ্ঠে রাঙা হাসি শিহাবের ভীষন পছন্দের সাজ। বিশ্ববিদ্যালয় ছুটিতে সুমনা বাড়িতে এলে এমন সাজে নিজেকে হরহামেশাই সাজায় ও। আশ—পাশের ভগ্নিপতিরা এমন সাজে ওকে দেখলে নানা ভঙিতে টিপ্পুনি কাটা চাই।
—কী ব্যাপার কোনো খবর আছে নাকি সুমনা, আমরা কি আগামীতে খাওয়া দাওয়া পাচ্ছি কিছু?
—গা নাড়িয়ে বেশ করে বললো আরেকজন, তাহলে তো আমাদের মূল্য কমলো বলে। নতুনকে, নিয়ে নাচা-গানা হবে আমরা তখন কে কোথায়? খবর—নেয়ার কেউ থাকবে না আমাদের। কপাল চাপড়ে আমাদের বাড়ি থেকে বিদায় নিতে হবে।
ধমকের সুরে থামিয়ে দিয়ে বললো কেন আপনারা কি খেতে পান না না কি অযত্ন করা হয় এত রসিয়ে বানিয়ে কথা বলছেন? আচ্ছা মানলাম এখন না হোক দুদিন বাদে তোমার খবর কে রক্ষা করে দেখা যাবে। কোথায় থাকে এই মহব্বত?
তা, তোমার ডুবে—ডুবে জল খাওয়া শরীর ভিজে সর্দি হয়নি তো। কথা বেশি হচ্ছে দুলাভাই। আকাশটা অনেক বড়। চাঁদ উঠলে সবাই জানবে। আপনারা আগেই জানবেন।
সুমনা কথা জানে। আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
শিহাব দ্রুত গতিতে হাঁটছে। বুকের ভেতর উতাল পাথাল যন্ত্রণার ঝর। তার বিশ্বাসের কপাট থেকে এক চুল নড়তে রাজি না। আত্মবিশ্বাসে দৃপ্ত বলীয়ান সে। সুমনাকে সাথে নিয়ে পা দু’ টোকে শক্ত মাটির বুকে স্থিরভাবে রাখবে ভেবে আজ এই মুহূর্তে সুমনাকে তার খুব প্রয়োজন। সে জানেনা সুমনা কোথায়। চিঠি লিখেও উত্তর মেলেনি। মোবাইল বন্ধ। আসলে ও প্রচন্ড মাইন্ড করেছে। ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওর পাশে থাকার কথা ছিল। শিহাবের পছন্দ অপছন্দ ইচ্ছা অনিচ্ছাকে সবসময় প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। শিহাবের শেষ খেলাটাই সে দেখতে চেয়েছিল। শিহাব তার কথা আসলে ওভাবে বলা মোটেই উচিত হয়নি। দেখা, হলে নাহয় সরি বলে নেবে। এক রাশ অভিমান আর লজ্জা এসে জমাট বেঁধেছে ওর বুকে।
তারপরেও শিহাব মনে করছে সুমনার সাথে তার দেখা হওয়া দরকার। বাড়ি পৌঁছে নিজ ঘরের খোলা জানালায় চোখ রাখে শিহাব। সোনালী আলোর পরশে বাগানের হলুদ ফুলগুলো যৌবনবতী। ফুলের মৌ মৌ গন্ধ হৃদয় নাড়া দেয়।
নির্মল শান্তির খোঁজে পিছনের দরজা দিয়ে বারান্দায় পায়চারী করছে সে। ফোনটা বেজে উঠে শিহাবের। কল লিস্টে সুমনার নাম। হাসবে, কাঁদবে নাকি আনন্দে চিৎকার দেবে জানেনা।
হ্যালো—বলার সুযোগ না দিয়েই ফোনটা ধরেই আমি সুমনা বলছি— তুমি কি একটু টি এস সি—তে আসবে?
হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই টি এস সি—র ভূত মাথায় নিয়ে ফোন! কারণ, জিজ্ঞেস না করেই উত্তর দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। আসছি, ওয়েট এ বিট।
চকিতে শিহাবের মনে পড়ে যায় আজ সুমনার জন্মদিন। ওতো বেমালুম ভুলে সারা। ওর স্মৃতির ভাঁজে—ভাঁজে অতীতের প্রথম উপলব্ধি ওর অন্তর জুড়ে। বুকের মাঝে নিস্তরঙ্গ শান্ত যন্ত্রণাগুলো সরিয়ে বিমুগ্ধ ভালোবাসাগুলো রমনীয় শিস তোলে। সুমনা আমি আমার ভুলের জন্য দুঃখিত। তুমি আমাকে ক্ষমা কর সুমনা। আমি শুধু চাই তোমার সুখ, তোমার শান্তি, তোমার আমার প্রেমময় জীবনের সার্থকতা।