—আর সবার মত তুমিও যখন আমায় ঘৃণা করবে তখন আমার বেঁচে থাকা স্বার্থক হবে।
তিতলির বিয়ে ভেঙে গেছে অনেকদিন। পাড়ার চাচী-ফুফুরা তাকে নিয়ে কুৎসা গায়, ছেলে-বুড়োরা সুযোগের সন্ধান করে। তিতলি প্রথমে এসব খুব গায়ে মাখতো। এখন আর মাখে না। যেদিন তার নিজের জ্যেঠু তাকে বাজে ইঙ্গিত দিল সেদিন তার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। অনেক কষ্টে মনে শক্তির সঞ্চার করে বলেছিল, তুমি না আমার জ্যেঠু হও, আমি তোমার ভাতিজি। আমাকে এমন কথা বলতে পারলে!
চোখে-মুখে ঘৃণা উগড়ে দিয়ে তার জ্যেঠু বলেছিল— তোকে এসব কথা বলতে না পারার কি আছে? তুই তো একটা নষ্ট মেয়েছেলে। তোর কারণেই তো আমার ভাইটা মরলো। অত সতী সেজে কি লাভ। নাহলে চিকিৎসার অভাবে মাকেও হারাবে।
তিতলির ইচ্ছে করছিল বুড়োর মুখে একদলা থু থু ছিটিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। সেই সাহসটুকু সেদিন তার কুলোয়নি। অমাবস্যার অন্ধকারকে ভেদ করে স্কুলের পেছনের বটগাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। গ্রামের শেষ প্রান্তে জনমানবহীন জায়গাটায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কেঁদেছিল সে। কাঁদতে কাঁদতে গলা দিয়ে যখন আর কোন স্বর বের হচ্ছিল না, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল আর নিজের নিয়তিকে দোষ দিচ্ছিল তখন নিস্তবদ্ধতা ভেঙে কেউ একজন কথা বলে উঠল, কী চোখের পানি এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল? আমি তো ভেবেছিলাম বন্যা হয়ে যাবে। আর সেই বন্যায় আমিও ভেসে যাবো।
কথা শুনে চকিতে ফিরে তাকায় তিতলি। দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বলে, মুহিব ভাই? আপনি এখানে?
—কেন আমার আসা মানা নাকি এখানে? আসলে ভূত ধরতে এসেছিলাম, পেত্নীর দেখা পেরয় গেলাম।
উত্তরে কিছু বলে না তিতলি। কাছে এসে দাঁড়ায় মুহিব। তিতলিকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে বলে, কি, তোমার কাজে ব্যাগড়া দিলাম নাকি? তুমি যদি মরতে চাও আমার কাছে অনেক সহজ রাস্তা আছে। গলায় দড়ি দিয়ে মরা অত্যান্ত কষ্টদায়ক।
—মানুষের তৈরি নরকে বেঁচে থাকার চেয়েও কষ্টদায়ক? বাঁকা চোখে তাকায় তিতলি।
—দেখ, আমি হলাম ভূত-প্রেত নিয়ে খেলা করা মানুষ। মানুষ বললে ভূল হবে, সমাজের চোখে আমি তো শয়তান। তো এই শয়তানের পক্ষে জানা সম্ভব না যে মানুষের তৈরি নরক বেশি কষ্টদায়ক নাকি গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়া।
তিতলির চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরে পড়ছে।
—আমার সাথে মজা করছেন? এমন ভাব করছেন যেন কিছুই জানেন না?
—সব জানি। মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করবে না বলে প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গিয়েছিলে। প্রেমিক প্রতারণা করেছে। দুদিন পর ফিরে এসে মায়ের ঠিক করা ছেলেকেই বিয়ে করেছ। তারপর প্রেমিক বেচারা যখন দেখল স্বামীর সাথে সুখে সংসার করছো তখন সে তোমাদের কিছু অন্তরঙ্গ ছবি নেটে ছেড়ে দিয়েছিল। শেষমেষ তোমার স্বামীও তোমাকে ডিভোর্স দিয়েছে। এই তো!
—এই তো! (ভ্রু কুচকে তাকায় তিতলি) এমন ভাবে বলছেন যেন খুবই মামুলি ব্যাপার।
—মামুলি ব্যাপারই তো। এই সবে তোমার কোন হাত ছিল না। একটা বিরাট ভুল ছিল শুধু, তা হল অন্ধ বিশ্বাস।
—আজ কি হয়েছে জানেন?
—না, আর জানতেও চাই না। আমি তোমাকে কোন লেকচার দেবো না। শুধু বলবো, আমার মত একটু শয়তান হয়ে দেখ মানুষের পৃথিবীতে বাঁচতে পারো কিনা।
অবাক দৃষ্টিতে মুহিবের দিকে তাকায় তিতলি। মুহিব মুচকি হেসে বলে, চল বালিকা, এখন থেকে তুমি আমার এ্যাসিস্ট্যান্ট। আমরা দুজন মিলে এখন মানুষের পৃথিবীকে নরক বানিয়ে দেবো। হা হা হা. ..
পরের কয়েকমাসে গ্রামের দু’মুখো পুরুষগুলোর জীবন তিতলি সত্যি সত্যিই নরক করে তুলেছিল। এরপর কেউ আর তাকে ঘাটতে আসে না। সেও মুহিবের সহকারী হিসেবে দিব্যি কাজ করে যাচ্ছে। মুহিব দূরে চরের একটা গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করে আর বাকিটা সময় তার নিজের পরীক্ষাগারে কি সব পরীক্ষা করে। তাকে এটা সেটা এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করে তিতলি। একদিন মুহিব দেখল তিতলির মন খারাপ। তাকে লক্ষ্য করে মুহিব বলল, কি রে, কার চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছিস, কাজে মন নেই কেন?
—একটা চিঠি এসেছে তোমার। পিওন বলল, তুমি নাকি বিদেশে চলে যাবে তার চিঠি ওটা।
—হ্যাঁ বিদেশে তো যাবোই কিন্তু এটা তার চিঠি না। এটা অন্য কাজের চিঠি।
—তুমি সত্যিই চলে যাবে? মন খারাপ করে প্রশ্ন করে তিতলি।
—হ্যাঁ। নয়তো এত কষ্ট কেন করছি। জমিজমাগুলো বিক্রি করতে পারলে আগেই চলে যেতাম। আর তোরও তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
—আমার জন্য তুমি ভেবো না। কোন না কোন ভাবে জীবন চলেই যাবে।
—এভাবে কারো জীবন চলে না, তিতলি। অন্যের ছায়ায় বাঁচা যায় না, ধার করা আলোয় জীবনের সার্থকতা আসে না।
—আর সবার মত তুমিও যেদিন আমায় ঘৃণা করবে সেদিন আমার বেঁচে থাকা স্বার্থক হবে।
—মানে?
—মানে আমাকে তুমি সত্যিই ভালোবাসো নাকি করুণা করো আমি তা বুঝি না।
—তোর কি মনে হয়?
—মাঝে মাঝে মনে হয় করুণা করছো, মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার মত করে আমি ভালোবাসতে পারি না কেন?
—তোর যখন যা মনে হবে তাই ঠিক। তোর ভাবনা আমি পরিবর্তন করতে পারবো না, আর আমার অনুভূতিও তোকে বোঝাতে পারবো না। সুতরাং যে যার মত থাকি, তাই ভালো না?
মুখ ভেঙচিয়ে চলে যান তিতলি। মুহিব একটু হেসে আবারও তার কাজে মন দেয়।
. ..
তিতলিকে মুহিব ভালোবেসেছিল নাকি করুণা করেছিল তা সে জানে না। কিন্তু অন্যদের মত তাকে কখনো ঘৃণা করেনি। মুহিব যেদিন দেশ ছেড়ে চলে যায় সেদিন রাতে স্কুলের পেছনের সেই বটগাছটার নিচে আবারও দাঁড়ায় তিতলি। চোখে তার শ্রাবণের ধারা, মনে কাল বৈশাখী ঝড়। সে রাতের মত সবই আছে; নিকষ কালো অন্ধকার আছে, ঝরাপাতার শব্দ আছে, তিতলির চোখে জলও আছে। শুধু মুহিব নেই।
আচমকা দমকা হাওয়ায় কারো যেন স্পর্শ পায় তিতলি। শশব্যস্ত হয়ে চারিদিকে তাকায়। নাহ্! কোথাও কেউ নেই। দীর্ঘশ্বাস টেনে নিতে নিতে চোখ বন্ধ করে তিতলি। পরিচিত একটা ঘ্রাণ তাকে বিমোহিত করে, কানে ভেসে আসে কোন মিহি সুর। ঠোটের কোণে তার ফুটে ওঠে এক চিলতে হাসি ।
আচ্ছা! সে রাতের মত আজও জোনাকিরা এত সুন্দর করে গান গাইছে কেন? তবে কি আজ অমাবস্যা?