লিফটের অবস্থানের স্কিনের দিকে তাকিয়ে আছি। লিফট ৫নং ফ্লোরে স্থির হয়ে আছে। লিফটের স্কিন তাই বলছে। মানে ষষ্ঠ তলা। আমাদের অফিসে ষষ্ঠতলাতে নামাজের স্থান আছে। লিফটের গেটের সাথে পুরুষদের নামাজের স্থান। আর একবারে পূর্বদিকে বামের যে রুম সেই রুমে মেয়েদের নামাজের স্থান। অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের জন্য আলাদা ভাবে নামাজের জন্য স্থান বা নামাজ ঘর নির্ধারিত করা আছে কিনা আমার জানা নেই। এটা ভেবে আমার খুব ভালো লাগে। ষষ্ঠ তলায় আমি আমরা জোহর আর আসরের নামাজ আদায় করি। কখনো কখনো দেরি হয়ে গেলে মাগরিব এর নামাজও আদায় করি। এই একটা জায়গায় গেলে আমি বা ফারহা কেউ কাউকে নক করি না। তবুও মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায়। যেদিন অফিস থেকে বের হতে দুজনারই দেরি হয় সেদিন তো মাগরিবের নামাজের সময় দেখা হবেই।
ফারহা কি নামাজের জন্য ষষ্ঠ তলায় গেছে। ও আসরের নামাজ পড়ে নি এখনো। আমি নিচে দাঁড়িয়ে ফারহার আসার জন্য অপেক্ষা করছি। ফোনে টেক্সট করেছি। ওকে রিপ্লাইও এসেছে। ষষ্ঠতলা থেকে লিফট নামতে শুরু করেছে। লিফটের স্কিনে সংখ্যা দ্রæত গতিতে পরিবর্তন হচ্ছে। ৫,৪,৩,২,১ এবং জিএফ। লিফট গ্রান্ড ফ্লোরে এসে দাঁড়াতেই স্থির হয়ে গেলাম আমি। ফারহা কি আছে এবার লিফটে? নিজের কাছে নিজে প্রশ্ন করি। উত্তর সামনে ডিসপ্লে হচ্ছে। লিফটের দরজা খুলে গেল। স্বস্তি পেলাম। ফারহার চোখ আমার চোখে। চোখের ভাষায় একটু টেনশন টেনশন মনে হচ্ছে। ঠোঁটের ভাষা কী? আমি ওর ঠোঁটের দিকে তাকালাম। ওর ঠোঁটটা এদিক ওদিক ঘুরলো। আমি ঠোঁটের সে নড়াচড়া ফলো করলাম। ফারহা লিফট থেকে নেমে হন হন করে আমার সামনে দিয়ে বের হয়ে গেল। হায় হায় আমি যার জন্যে অপেক্ষা করছি সে কিনা আমাকে রেখেই চলে যাচ্ছে। আমার পাশ দিয়ে যাওয়ায় সময় ফারহা ফিসফিস করে বলল, গেটের বাইরে আসেন, গেটের বাইরে আসেন। ভাবলাম গেটের বাইরে যাবার জন্যেই তো বসে আছি। একসাথে গেলে সমস্যাটা কি। অফিস শেষে অনেকেই অফিস থেকে একসাথে বেড়াতে পারে। এতে তো দোষের কিছু নাই।
কী আর করা একটু অপেক্ষা করে বের হয়ে গেলাম। যেতে যেতে ফারহার ঠোঁট নিয়ে গবেষনার সাগরে ডুবে গেলাম। ফারহার ঠোঁটে ছোঁয়াচে টাইপের রোগ আছে। সেই ছোঁয়াচে রোগটা আমাকে ছুঁতে চায়। নইলে ওর সেই ঠোঁট কেন আমাকে বার বার টানে। কেন আমি ওর ঠোঁটের ভাষা পড়ার জন্য ব্যকুল হই। এইযে এখন যেমন ব্যাকুল হয়েছি। লিফট থেকে বের হওয়ার সময় ওর ঠোঁট কি বলল তা খোঁজার গবেষনায় বসে গেছি। ও ওহ ঠোঁট নিয়ে একটা লজ্জার ঘটনা আছে। এটা কাউকে বলা হয় নাই। এটা অবশ্য বলার মতো বিষয়ও না। ঘটনাটা স্বপ্নে। স্বপ্নটা ফারহাকে নিয়ে। সেই স্বপ্ন তো লজ্জায় ফারহাকেও বলা যাবে না। অন্য মানুষকে তো নয়ই।
আমি ফারহার ঠোঁটে বার বার আঙ্গুল ছোঁয়াচ্ছি। আমার আঙ্গুল গুলো কিলবিল কিলবিল করছে। বার বার ওর ঠোঁট নেড়ে দিচ্ছি।
ফারহা বলল, কী হচ্ছে?
– ঠোঁট ছুঁইতেছি। তোমার ঠোঁটে ম্যাগনেট বসানো আছে।
– ম্যাগনেট!
– হুম। তা না হলে তোমার ঠোঁট আমাকে কেন এত আর্কষণ করে।
– ঠোঁটই তো আর্কষণ করবে। সেই আকর্ষন কি শুধু হাতের আঙ্গুলে গিয়ে ঠেকে যায়?
– মানে?
– মানে আপনার আঙ্গুলই তো আমার ঠোঁট ছুঁইতেছে। আর অন্য কিছুই তো আকর্ষণ করছে না।
– অন্য কী আর আকর্ষণ করবে?
– ঠোঁট ঠোঁটকে আকর্ষণ করবে। সেইরকম আকর্ষণ।
– যেমন?
– যেমন এইরকম – – – । কথা শেষ না করেই ফারহা আমার ঠোঁটে তার ঠোঁট লাগালো। এরপর দুই ঠোঁট তাদের আপন গতিতে নড়াচড়া শুরু করলো।
এরই মধ্যে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। চারিদিকে অন্ধকার। আমি অন্ধকারে আর ফারহাকে খুঁজে পাই না।
আমি খেয়াল করেছি এই স্বপ্নের পর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে আমি ফারহার ঠোঁট দেখি। না আমার ঠোঁটের সাথে মিলানোর জন্য নয়। আমি ফারহার ঠোঁট দেখি তার ঠোঁটের ভাষা বোঝার জন্য। আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি যে ফারহা যদি দূর থেকে কারো সাথে কথা বলে। আর সেই কথা আমার কানে না আসলেও তার ঠোঁটের দিকে তাকালে আমি বলে দিতে পারি ও কি বলতেছে।
লিফট থেকে নামার সময় শব্দ না করেও ঠোঁট দিয়ে গোপনে গোপন যে ভাষা প্রকাশ করেছে আমি তা খোঁজার চেষ্টা করছি। গভীর ভাবে ফারহার ঠোঁট গুলো নিয়ে ভাবছি। ভাবতে ভাবতে আমি ভাষা বের করে ফেললাম। মনে মনে নিজেকে শুনিয়ে নিজেই বললাম ইউরেকা।
ফারহা ঠোঁট নড়াচড়া করে গোপনে গোপনে যা বলেছে তা হলো এই, ‘পাগল নাকি! কোথায় দাঁড়ায় আছে! এখানে দাঁড়ায় থাকার কোন মানে হয়।’
আমি দ্রæত বাইরে বের হয়ে এলাম। দেখলাম ফারহা উত্তর দিকের মোড়ে টং চায়ের দোকানে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। দ্রæত পৌছেঁ গেলাম তার কাছে। কাছে যেতেই ও বলল, চলেন চলেন।
– কোথায় যাব?
– ক্যাপ্টেন ব্যাকোলজিতে। সেখানে গিয়ে আমরা কফি খাব। বলেই ফারহা হাঁটতে শুরু করলো।
আজ অবশ্য আমি বাইকটা নিয়ে আসা হয় নাই। তাই ফারহার পাশাপাশি আমিও হাঁটতে থাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে ফারহাকে কথা দিয়ে ধরে ফেললাম। বললাম, আমাকে পাগল বললেন কেন?
– কখন?
– লিফট থেকে বের হওয়র সময়।
– বলিনি তো।
– আমি তো স্পষ্ঠ শুনলাম। আপনি বললেন, ‘পাগল নাকি! কোথায় দাঁড়ায় আছে! এখানে দাঁড়ায় থাকার কোন মানে হয়।
– এগুলো আমি বলেছি?
আমি ভাবলাম আমার ঠোঁটের ভাষা পড়া মনে হয় সঠিক হয় নাই। তবুও জোড় গলায় বললাম, আপনি তো বললেন। আমি শুনলাম।
– বললে বলেছি। ওভাবে ওখানে দাঁড়ায় থাকার দরকার ছিল। আপনি তো আমার জন্য বাইরেও অপেক্ষা করতে পারতেন। পারতেন না?
আমি কোন জবাব দেই না। ফারহা আবার বলে অফিসের মানুষরা যাতে উল্টা পাল্টা কিছু না ভাবে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকাই ভালো।
আমি যেন শূন্যে উড়ছি। ঠোঁটের ভাষা আমি অনুবাদ করতে পেরেছি। এই ভেবে মনটা ফুরফরে লাগছে।
ক্যাপ্টেন ব্যাকোলজি ফাস্টফুডে ফারহাকে বসিয়ে অর্ডার করার জন্য ক্যাশ কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছি। অর্ডার করে ১০০০ টাকার নোট দিয়ে বাকি টাকা ফেরত নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। ম্যানেজারের দিকে না তাকিয়ে আমি ওখান থেকে ফারহার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছি। ফারহা বার্গারের অর্ডার দিতে বলেছিল। তাই দিয়েছি। হঠাৎ ফারহার ঠোঁট নড়ে উঠলো। আমি ফারহার ঠোঁটের ভাষা অনুবাদ করার চেষ্টা করলাম। ফারহা বলেছে, বার্গার বাদ দিয়ে স্যান্ডউইচ অর্ডার দেয়াই ভালো ছিলো। সাথে সাথে ম্যানেজারের দিকে তাকালাম। ম্যানেজার ব্যাচারা আমার বাকি টাকা হাতে নিয়ে আমাকে দেয়ার জন্য তৈরি হয়ে আছে। বললাম, মনে কিছু না নিলে অর্ডারটা একটু পরিবর্তন করতাম।
ফারহার কাছে ফিরে এসে সামনে বসলাম। বসে বসে কী আর করি ফারহার ঠোঁট দেখি। ফারহার ঠোঁট এত সুন্দর কেন। নিচের ঠোঁটের ডান কোনে ছোট্র একটা তিল আছে। তিলটা যেন ঠোঁটটাকে আরও সুন্দর করেছে। আর বাম গালে মুখের কাছে বড় তিলটা সেইরকম রুপবতী করে তুলেছে। ফারহার রুপের মধু গোপনে গোপনে পান করি।
খাবার রেডি। সেলফ সার্ভিস। তাই আমাকে গিয়ে আবার নিয়ে আসতে হলো। স্যান্ডউইচ দেখে সেই রকম অবাক হলো ফারহা। বলল, কি করে বুঝলেন আমি স্যান্ডউইচ চাচ্ছিলাম।
– আপনি না স্যান্ডউইচ নিয়ে আসতে বললেন।
– না, আমি বার্গার খেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছিলাম। সেটা তো আর জানানো হয় নাই।
– না, কেন জানি মনে হলো আপরি স্যান্ডউইচ পছন্দ করেন।
– যাই হোক। ভালোই হয়েছে। বলেই খেতে শুরু করলো ফারহা।
আর আমি তো সেই রকম খুশি। আমি ঠোঁটের ভাষা পড়ে ফেলতে পারছি। আচ্ছা আমি সবার ঠোঁটের ভাষা কী অনুবাদ করতে পারব? নিজেকে প্রশ্ন করি মনে মনে। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকি।
একটু দূর উঠতি বয়সের দুটো ছেলে মেয়ে বসে গল্প করছে। সেদিকে চোখ গেল আমার। ছেলে মেয়ে দুটো আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। আমার তাকানো দেখে মাথা নিচু করলো। ফিসফিস করে কী জানি বলল ওরা। আমি ওদের ঠোঁটের নড়াচড়া গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখলাম।
ওদের ঠোঁটের ভাষা অনুবাদ করে ফেললাম।
মেয়েটা বলছে,ওদের দেখে তোমার কী মনে হয়?
ছেলেটা বলল, প্রেমিক-প্রেমিকা।
– নাহ! ওরা প্রেম করছে ঠিকই। কিন্তু সেটা প্রেম না। পরকীয়া।
– কেমন করে বুঝলে?
– দেখছো না ছেলেটার মাথায় চুল নাই। টাকলু। আমি নিশ্চিত ও বিবাহিত।
– হতেও পারে। বলল ছেলেটা।
ওদের ঠোঁটের ভাষা অনুবাদ করতে পেরে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমার মাথায় চুল নাই বলে আমি বিবাহিত! এটা কোন কথা! ভাবলাম অন্যের ঠোঁটের ভাষা অনুবাদ করার চেয়ে আমি ফারহার ঠোঁটের অনুবাদ করি। ফারহার ঠোঁটের দিকে আমি তাকাই। কত সুন্দর করে ও ওর ঠোঁট দিয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছে।