আমি বাবার কাছে থাকব বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে তয়ন। কোর্টের রুমটায় তখন গুমোট গরম। উঁচু ছাদে ঝোলানো ব্রিটিশ আমলের ফ্যানটা ঘুরে চলছে একমনে। তয়নের দাদি হিঁচকি দিয়ে কান্না চেপে রাখলেন। জজ সাহেব অস্বস্তি ঢাকতে নড়েচড়ে বসেন। কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। মনে হচ্ছে কয়েক যুগ। তয়নের মা কলি মুখ শক্ত করে বসে আছে। চোখে কালো সানগ্লাস থাকায় তার চোখ ঠিক কার দিকে বোঝা যাচ্ছে না। তয়নের বাবা তুষার ভাবলেশহীন হয়ে বসে আছে। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে তার কাঁধ। কয়েকদিন না ঘুম, না খাওয়ায় তাকে দেখাচ্ছে ঝরে পড়া একজন মানুষের মতো।
তুষারদের উকিল মোজাহিদ অস্বস্তি দূর করতে অকারণে কাশি দেয়, এদিক ওদিক তাকিয়ে বোকার মতো হাসে। মামলায় জিতেও কেন জানি ঠিক আনন্দ লাগছে না। একটা বিষণ্নতা ভর করেছে শরীরে। উহ্,আজ গরমও পড়েছে। গাউনের কলার ধরে ঝাঁকি দেয় কিছুক্ষণ। কিছু বাতাস ভিতরে ঢোকে। বড় দরজায় বাদামওয়ালা আলামিন দাঁড়িয়ে। বাদাম খেতে ইচ্ছে করছে। পেট মোচড় দিয়ে জানান দেয় আজ সকালে একটা টোস্ট আর এক কাপ চা খেয়ে বের হয়েছে সে। টি ব্যাগের চা। টি ব্যাগের চা হোটেলে ভালো লাগলেও বাসায় বিস্বাদ লাগে। মানসিক রোগী বৌ আলেয়া দেরি করে ওঠে। তার বাইপোলার ডিসওর্ডার। বিষণ্নতা কাটাতে তাকে কয়েক ধরনের ওষুধ দিয়েছে ডাক্তার। সেসব খেয়ে দিনদিন মোটা আর স্থবির হয়ে উঠছে আলেয়া। সকালে নাস্তা কোর্টের সামনে এসে করা হয়। রাজনের দোকানে। সে বিহারি। কথায় বোঝা না গেলেও চুল আর ত্বক দেখলে বোঝা যায়। কয়েক পুরুষ ধরে রংপুরে। তন্দুর রুটি আর সবজি। একটা খেলেই দুপুর পার। মাঝে বাদাম আর এককাপ লাল চা।
কোর্টে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় মনে হয় বাদাম আর চা। মানুষ টেনশন কমাতে বাদাম চিপে ভাঙে, মুখে দেয়। মোজাহিদ উকিলের তেমন একটা কেস নাই। মাঝেমধ্যে একটা দুটা কেস কেস পায়। এ নিয়ে তার খুব একটা আফসোস আছে বলেও মনে হয় না। নাহ্, আর পারা যাচ্ছে না। পেটের ব্যথাটা বাড়ছেই ক্রমশও। আলামিনকে ডেকে বাদাম নিয়ে বারান্দা থেকে কি একটু খেয়ে আসবে। ঠিক হবে কী? জজ রোকনুজ্জামান কিছুক্ষণ কলম নড়াচড়া করেন। হাতে কালি লেগে গেছে। টেবিলে টিস্যু বক্সটা নাই। পিওন রিপনকে ধমক দিতে গিয়েও থমকে যান। আজ তিনটার সময় বাড়ি ফিরতে হবে। বৌ নিশি বারবার বলে দিয়েছে। দুপুরে লাঞ্চ যেন বাসায় করে।
নিশির বোনজামাই কানাডায় থাকে। তার বাড়ি ডোমার। বাড়ি যাবার আগে আপা দুলাভাইয়ের সাথে দেখা করতে আসবে। তার এই ভায়রা ভাই একটু ন্যাকু। এসেই বৌকে ভিডিও কল দিবে। বৌকে ডাকে জান বলে। শিওর এসেই সে ভিডিও কল দিয়ে তার আপাকে দেখিয়ে বলবে, জান দেখো, দেখো বড়পা কেমন শুকিয়ে গেছে আর দুলাভাই বাসায় নাই। একটুও টেক কেয়ার করে না আপার। কালির দাগটা মোছা দরকার। আর এটাও এমন একটা কেস। সারাদেশ তাকিয়ে আছে, রায়ের দিকে।
লোকাল পত্রিকার সাংবাদিকগুলা হয়েছে আরেক কাঠি সরেস। সব ফেসবুক সাংবাদিক। একটু কিছু পেলেই হলো। সেদিন একজন এই মামলার বিষয়ে জানতে চেয়ে বলল, আপনি কি এই মামলায় কোনো কিছুতে প্রভাবিত? বারবার ডেট দিচ্ছেন। ঠাস করে একটা চড় মারার চেষ্টা দমন করে হাসিমুখে তাও বলতে হয়েছে, দেখুন চট করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। অনেক বিষয় মাথায় রেখে এগুতে হচ্ছে। এখানে প্রভাবিত হবার কোনও বিষয় নেই। তারপরও হারামজাদা লিখেছে, মামলা নিয়ে বিচারক বিভ্রান্ত। সেই পোস্টে লাইক পড়েছে বিশ হাজার, কমেন্ট সাড়ে সাত হাজার। আর উকিল মোজাহিদও আজ লড়েছে ভালো। ছেলেটার বয়স নয়। সে স্পষ্ট কন্ঠে বলেছে বাবার কাছে থাকতে চাই। বিষয় ডিসমিস। তারপরও রায় দিতে সময় নিতে হয়।
একটা পরিবার গড়া যত সহজ, ভাঙা তার চেয়েও কঠিন। অনেক সময় মাথা গরম হলে মানুষ ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। জজ রোকনুজ্জামান জানেন মা মারা যাবার পর তার কষ্ট। বাবা বিয়ে করে, সংসারে সৎমা। তারপর গল্পটা কমন বাংলা সিনেমার মতো। হাত পাথর হয়ে আসে তারপরও শুকনা গলায় রায় ঘোষণা করেন জজ সাহেব, জনাব তুষার, জনাবা কলি আপনারা আর একটু সময় নেন, নিজেদের মাঝে কথা বলুন।