পদ্মপুকুরে মধ্য দুপুর। পদ্ম আমার প্রিয় ফুল। হিরারও। সাত বছর আগে হিরাকে ছেড়ে এসেছি। হিরার হাতে একমুঠো ঘাসফুল ছিলো। তার শুকনো ডগাগুলো এখনো ডায়েরির ভাঁজে যত্ন করে রেখেছি। সপ্তম প্রহরে আমার বহর থেমেছে আকাশলীনায়। ‘আকাশলীনা’ আমার মেসের নাম। আমার মেসে রয়েছে একটি ছোট্ট উঠোন। সেই উঠোনে রয়েছে একটি বকুল গাছ। এই বকুল তলায় আমি নষ্ট দুপুরে অনেক কবিতা লিখেছি। আবার ছিঁড়েও ফেলেছি। সাদা কাগজের টুকরোগুলো সকালের শিশিরে সিক্ত বকুলফুলের মতো লাগত। তারই কিছু টুকরো দখিনের চৌবাচ্চায় কাগজের নৌকার মতো ভাসিয়ে দিতাম। চৌবাচ্চাকে তখন পদ্মপুকুরের মতো মনে হতো। হিরার কথা মনে পড়ত। কেঁদে ফেলতাম। বছর দুয়েক হলো হিরা নাকি আত্মহত্যা করে মারা গেছে। কোনো এক অজানা সন্ধ্যাবেলায় সে নাকি ধর্ষিত হয়েছিল। নিজের আত্মসম্মান রোধ করতে না পেরে আত্মহননের পথে হেঁটেছে। আমি এখনও হিরার আত্মার সাথে কথা বলি। সে আমার পাশে এসে বসে। আমাকে বলে, সেও এ শহরে থাকে। আমি অবাক হয়ে যাই। সে বলে, ‘কাল ডিসির মোড়ে আসিও, অপেক্ষায় থাকব।’
এ জীবন বড় দুর্বিষহ। জীবনে কখনো রং মাখলাম না। কত দুপুর কাটিয়েছি দুটো শিঙারা খেয়ে। আজও সেসব দুপুরের পুনরাবৃত্তি। চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। পৃথিবী ধূসর বর্ণের মনে হয়। কবে যেন বনলতা আমার চোখে এসেছিল। আমি মুখে একটি ডার্বি লাগিয়ে ডিসির মোড়ের দিকে হাঁটতে লাগলাম। চোখের সামনে অনেক বিরহের গল্প, তবু মুখে সুখটান। আলোর নিশানার মতো একটি সাদা গাড়ি চলে গেল। গাড়ির ভেতরের একটি সাদা মেয়ে কয়েকটি পদ্মফুল রেখে গেল। না, সে হিরা নয়। শুধু চোখগুলো হিরার মতো। আমি সীমানা ছেড়ে অসীমতার দিকে চেয়ে রইলাম। এভাবে চারদিন কেটে গেল। চারদিনে চারটি মেয়ে কয়েকটি পদ্মফুল রেখে গেল।
পঞ্চম দিনে ঘটে গেল এক ভয়ানক ঘটনা। আমি চোখের সামনে তারা দেখলাম। সাদা তারা। স্যাঁতস্যাঁতে জীবন। তারও। সমস্ত শরীর রক্তে ভেজা। রক্ত শুকিয়ে গেছে। শুকনো রক্ত ইতিহাস হয়। আমার আপন ইতিহাস। যেদিন আমি মারা যাব। তার মতো। দুটো ঝুলন্ত লাশ। প্রেমিক-প্রেমিকার। প্রেমিকা ধর্ষিত হয়েছে; প্রেমিক নির্যাতিত। অবশেষে দুজনের লাশ।
অপেক্ষায় রয়েছি পঞ্চম মেয়েটির। ঠোঁটে আমার জ্বলন্ত সিগারেট। আজ জীবন কেন জানি বিলাসবহুল মনে হচ্ছে। সতেরো দিন পর এক টুকরো মাংস খেতে পেরেছি। সাঁই করে একটি লাল গাড়ি চলে গেল। ভেতর থেকে একটি লাশ ফেলে দিয়ে গেল। হিরার নয়। মিরান্ডার। মিরান্ডাকে আমি এ শহরে ভালোবেসেছি। কফি হাউজে সে একদিন আমাকে কফি পান করিয়েছে। আমি তার জন্য কবিতা লিখেছিলাম। কবিতা তার প্রিয় নয়। তার প্রিয় চন্দ্রিমা রাতে বেহালার সুর। তার পাশের বাসায় আমি থাকতাম। আমার বন্ধু তেরানের বাসায়। মন খারাপের দিনে আমি ছাদে বসে বেহালা বাজাতাম। মিরান্ডাও তাদের ছাদে আসত। বেহালার সুর শুনত। গোপনে চোখের জল মুছত। তার চোখে আমি পদ্মফুল দেখি। তাকে ভালোবেসে ফেলি। সেও। সে নাকি তেরানের পুরনো প্রেমিকা। তেরান এক অদ্ভুত চরিত্র। গোপনে গোপন লীলা।
সে আমাকে ষষ্ঠ দিনে মৌবনে বিরানি খাওয়াল। হাতে দিলো এক বিষপত্র। যাতে লেখা, আমি আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ হেফাজতে যাচ্ছি। আমার বুকে লিখিত হয়েছে, আমি মিরান্ডার দাগী খুনি।