আমার স্বপ্নটাকে ভেঙে দিলে
বেঁচে থাকবার অধিকার টুকু
কেড়ে নিলে কেন ওগো বন্ধু।
তারপর গাইলাম—
একদিন চলে যেতে হবে
জানি না সেদিন কবে
আমি অনেক প্রশ্ন করেও জানতে পারিনি
সেদিন আমার রবে কি না রবে।
আজ লাল মিয়ার বিয়ে। তাজহাটের বৌ নিয়ে সবেমাত্র ফেরা হলো। অবশ্য, আগেই ফেরার কথা ছিলো। লাল মিয়ার বন্ধুরা মিলে, হাড়ি ভরা তাড়ি খেয়ে বেশ বাড়াবাড়িই করছিলাম বিয়ে বাড়িতে। এ নিয়ে বিয়েটা যায়যায় অবস্থা। শেষে বয়সের কাঁধে দোষ চাপিয়ে কোনো রকমে বিয়ে রক্ষা। সুন্দরী বৌ পেয়ে বাড়ির সবাই মহাখুশি। দাদী বলে—
এ যে দেখি স্বপ্নপুরীর রাজকন্যা।
নানী বলে—
তার অঙ্গে যেনো রূপের বন্যা।
বাড়ি ভরা মানুষগুলোর এমন খুশির মূহুর্তে আমার দুঃখ ভরা বিরহী গানের শক্তি কতো টুকু যে এসব আনন্দে আহ্লাদিত মানুষদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে? মাইকে তবু গেয়ে যাই-
অনেক যত্ন করে মনের বাগান ভরে
ফুল ফোটালাম,
তোমার কাছে এসে নিবির ভালোবেসে
সব হারালাম।
শেষ রাতে সাধের মাউথপিচ রেখে বিয়েবাড়ির কোলাহল উপেক্ষা কোরে নিজের বাড়িতে ফিরলাম। ফিরে দেখি, মা অযু করার জন্যে বদনায় পানি ভরছেন। মা ডেকে বললেন ‘হ্যারে বাবা, বলি তোর মুখে এসব গান ছাড়া অন্যকোনো গান নাই?’
আচমকা মায়ের এমন কথায় লজ্জায় বিমূঢ় হয়ে গেলাম। ভাবলাম সত্যিইতো! আমার কন্ঠে এসব গান ছাড়া… লাল মিয়ার বন্ধুরা তো কতো রকমের গান গায়- টাংকি খালি, ডাবের পানি কিংবা পড়ে না চোখের পলক।
অগছালো বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে কেবল মায়ের বলা কথাগুলো ভাবছি। ভাবছি আমি কেনো আজ এমনটি হয়ে গেলাম! শুনেছি মনের মানুষ হারিয়ে গেলে মানুষের নাকি এমনটি হয়ে থাকে। সে জন্যই কি! কতোদিন তাকে দেখি নি। শৈশব দিনের মধুময় স্মৃতিচিহ্ন যখন আজ ন’বছরে ম্লান হতে চলেছে, তখন আবেগ আর কল্পনার তুলি দিয়ে আমার পবিত্র মনের সবুজ চত্তরে পরম যত্নে অঙ্কন করেছি সেই চাঁদমুখীর চটুল অবয়ব। ভুলে যাওয়া সরস পঙ্কতি যখন তার মুখে নেই তখন, বুকভাঙা বেদনার আত্নচিৎকার নয়, তোমাকে মহাভালোবাসি জাতীয় কিছু
কাব্যছন্দ তার নরম অধরে জোড়া লাগিয়েছি খানিক। যখন তাকে কথা বলাই, বেশ বলে সে।
যখন তাকে পথ হাঁটাই, বেশ হাঁটে সে। হাঁটবে না কেনো? সে যে আমার আবিস্কার। আমার অনন্তকালের সঙ্গী।
মা আমার বিষয়ে সবকিছু জানেন। একদিন বললেন- ‘এতোটুকুন মেয়ের স্পর্ধা দেখো? আমার হারাধন ছেলেটার কি দশাই না বানিয়ে গেলো! ভালো মেয়ে হলে, এমনটি কোরতে পারতো সে?’
মাকে বলি ‘না মা, ও আমার কোনো ক্ষতিই কোরতে পারে নি। এ—ই দেখো, ওর মতন কোরে আমার বুকের ভিতর একটি বেলুনের মূর্তি বানিয়েছি। আমি যখন বেলুনকে বলি, বলো তুমি কি চাও। বেলুন বলে, শুধু তোমাকে চাই। মা, তোমার বিশ্বাস না হলে আমার বুক চিরে দেখো?’
মা আমার আবিস্কৃত মূর্তিমুখ দেখতে পায় না।
‘মা, নাহয় আমার বুকে কান পেতে শোনো। কি, শুনতে পাচ্ছো না?’
দরদী মা, আমার পোড়াবুকে কান পেতে পড়ে থাকে। আমি লক্ষ্য করি, মায়ের চোখ থেকে ক’ফোটা অশ্রু আমার বুকের পাশ দিয়ে বিছানার মলিন চাদরে গড়িয়ে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর শাড়ীর আঁচলে তার চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন- ‘এতো শুনছি তোর বুকের জখমরক্তের ওঠানামা শব্দের হাহাকার বাছা! এবার বুঝি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাবি। সেই কবে থেকে তোর মুখে হাসি দেখি না। চোখের জলও বুঝি শুকিয়ে গেছে। যে অমন কোরে তোকে ভুলে যেতে পারলো, তুইও তাকে ভুলে যা বাবা।’
‘আমি তো তাকে ভুলেই গিয়েছি মা। সেই চিরচেনা মুখ আজ আমার স্মরণে শুধুই ধূসরতার ছায়ামাত্র। তার মিঠেল কন্ঠনালী হতে উদগিরিত মধুকথন অপরিচিত আজ অনেকদিন। তবু, পৌষের শুষ্কতায় বাঁশপাতা পতনের মড়মড় শব্দের কাছে কান পেতে সে যখন শুনতে চায় আমি কেমন আছি, বেগমবাড়ির ফুল চুরি অতঃপর বেগমধোলাই আমার স্মরণে আছে কি না। তখন আমি বলি-তুমি কেমন মেয়েগো, বেগমবাড়ির ফুল চুরি কোরে আমি তোমার হাতে তুলে দিলাম আর কি না তুমি আমাকে বেগমের হাতে তুলে দিলে! তখন সে কি বলে জানো মা? সে বলে- আমাকে ভালোবাসতে হলে আগে নিজের জমিতে চারা লাগাও, মনের বাগানে ফুল ফোটাও, তখন তোমার ফুল নিবো।
কি আর করা, নীরব অভিমানে প্রাণের ঊচ্ছ্বাসে বাঁধি সাহসী অবসর, বাউলের একতারার সুরের মূর্ছনায়, দুর্লভ প্রেমে ফেরে অন্তর। এখন আমার বাগান জুড়ে অসংখ্য ফুল।’ জানো মা, পাখীদের নীড়ে ফেরার সময়টাতে তিস্তার তীর ধোরে আমি সে ফুল নিয়ে বসে থাকি তাকে দিবো বলে। তিস্তার নীলজলে ছোট বড় কতো নৌকো ছলাৎ ছলাৎ শব্দ কোরে এলো গেলো, শুধু সে এলো না।
অতঃপর, সময়ের হাত ধোরে বাতাস উড়ছে। এবারের
গ্রীষ্মে পুড়েগেছে বাগানের সব গাছ। রৌদ্রের উৎকট গন্ধে সমস্ত পাপড়িগুলো ঝোরে গেছে বেদনার করুণ সুরে। নিঃসঙ্গতার আঁধারে পাপড়িগুলো পড়ে আছে পায়ের তলায় পিষ্টনের প্রতীক্ষায়। কেবল তার কাঁটাগুলোকে পুতে রাখা সম্ভব হলো।
মা, তুমি জানো? একদিন বসন্তের ফল্গুধারায় আমার বিন্দুবিন্দু স্বপ্নগুলো আবার জমাট হতে থাকে। তখন পুতে রাখা কাঁটা থেকে উঠে আসে, সবুজের অঙ্কুর। সে এবার এসে বলে-
তোমার বাগানে দেখি অনেক ফুল! হায়, এযে দেখি লালগোলাপ! এখানে গোলাপ এতো লাল! কোথা থেকে সে এতো রক্ত পেলো! আমার ইয়ের জন্যে কিছু গোলাপ হবে গো?
জানো মা, তাকে আমার আর গোলাপ দেয়া হয়নি। গোলাপ না পেয়ে, মনের ক্ষোভে সে আমার স্বপ্ন দেখার সিঁড়ি ভেঙে দেয়। এবং প্রতীজ্ঞা করে যে আমাকে আর কখনো তার দর্শন দিবে না।
‘মা, তাকে ভুলে থাকার অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু সে চেষ্টাগুলো যেনো বেগমবাড়ির প্রহারের গতি নিয়ে আঘাতে আঘাতে আমার বেঁচে থাকাটাকে কঠিন কোরে তুললো। তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করবার শক্তি নেই জেনে আমার মনের ঘরে তার মতন কোরে একটি বেলুনের মূর্তি বানালাম। তাতে আমার সমস্ত দীর্ঘশ্বাস ঢেলে জীবন্ত করার চেষ্টা হলো খানিক।
জানো মা, আমার বেলুনের সাথে কথা বললে, সে কবিতার মতন কথা বলে। কথা ফুড়লে নেমে আসে নিঃস্তব্ধতা। তখন অন্ধকারে হাতরে দেখি আমার বুকে কবিতা নেই! আমি হয়ে যাই একা, বড় একা। তখন, ফের খুঁজি কষ্ট, বাড়াই বুকে যন্ত্রণা আর বেলুনে ভরি দীর্ঘশ্বাস। এখন বেলুন কথা বলে। আমার বেলুন কবিতার মতন কথা বলে।