মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

ভ্রমণ সাহিত্য

প্রমথ রায়

২৭ মে, ২০২৩ , ৯:০০ পূর্বাহ্ণ ;

ভ্রমণ সাহিত্য

ভ্রমণ প্রিয়তা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সুপ্রাচীনকাল থেকে মানুষ নতুনের সন্ধানে এক অঞ্চল থেকে অন্য ভ্রমণ করেছে। আমরা কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের কথা জানি। ভারতীয় উপমহাদেশ সম্পর্কে চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং ও মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা যেসব তথ্য লিখে গেছেন, তা এখনও আমাদের গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হয়। এভাবে মানুষ যুগে যুগে এক স্থান থেকে অন্য স্থান, এক দেশ থেকে অন্য দেশ, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে ভ্রমণ করেছে। ভ্রমণকালীন তাদের পরিলক্ষিত বিষয়গুলো যখন লেখা আকারে প্রকাশ পায়, তখন তা সাহিত্য মর্যাদা লাভ করে। ভ্রমণ সাহিত্য কখনো কখনো বাস্তবতার নিরিখে হুবহু একটি অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থান, জনসমষ্টি, ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে, আবার কখনো কল্পনার মিশেলে হয়ে ওঠে ফিকশনধর্মী রোমাঞ্চকর উপন্যাস।

বিশ্বে প্রথম ভ্রমণ কাহিনী লিখেন গ্রীক ভূগোলবিদ ও পর্যটক পসানিয়াস দ্বিতীয় শতকে। তারও আটশ বছর পূর্বে বিখ্যাত গ্রিক কবি ভ্রমণের ওপর মহাকাব্য ‘ওডিসি’ রচনা করেন। ইংরেজি সাহিত্যে ঔপন্যাসিক জোনাথন সুইফট  ভ্রমণের ওপর বিখ্যাত উপন্যাস ‘গালিভারস ট্রাভেলস’ লিখেন।

বাংলা সাহিত্যও ভ্রমণ সাহিত্যে বেশ সমৃদ্ধ। বাংলা সাহিত্যে যেসব ভ্রমণ কাহিনী বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে, তা হলো সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশ বিদেশে’ এবং অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘পথে প্রবাসে’, মুহাম্মদ আব্দুল হাইয়ের ‘বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’। বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত প্রথম ভ্রমণ কাহিনী লিখেন রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি হিমালয় ভ্রমণের উপর লিখেন। তবে এ বইটি পাঠক সমাজে ততটা সাড়া ফেলতে না পারলেও পরবর্তীতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বড়ভাই সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’ বেশ সাড়া জাগায়। ‘পালামৌ’কে বলা প্রথম সার্থক ভ্রমণ কাহিনী। সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যখন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, তখন একজন ইংরেজ মিলিটারি এক দৈনিকে ‘প্যারেড বৃত্তান্ত ‘ ‘ব্যান্ডের বাদ্যচর্চা’ প্রভৃতি শিরোনামে লিখতেন।

এসব লেখা থেকেই তিনি পালামৌ সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি ধারণা করেছিলেন পালামৌ একটি শহর। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারেন এটি একটি পরগণা মাত্র। তাঁর নান্দনিক কলাকৌশল, চিত্রময় এবং কাব্যিককতা পালামৌর পথঘাট, প্রকৃতি ও জনজীবনকে করেছে এক অনিন্দনীয় ছবি। এই বইয়েরই বিখ্যাত বাক্য, বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। এ সময়েরই আরও দুটি ভ্রমণকাহিনী হলো দুর্গাচরণ রায়ের ‘দেবগণের মর্ত্যে আগমন ‘ ও যোগেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যয়ের ‘পয়সার ডায়েরি ‘।

পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের হাতে ভ্রমণসাহিত্য পেয়েছে নতুন মাত্রা। তিনি পত্র আকারে এসব ভ্রমণ কাহিনী লিখেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য ভ্রমণ কাহিনী হলো ‘যাত্রী’ ‘রাশিয়ার চিঠি’ ‘জাভা যাত্রীর পত্র’ ‘য়ুরোপ প্রবাসী পত্র’ প্রভৃতি। পল্লীকবি জসীমউদ্দিনও বেশ কয়েকটি ভ্রমণ কাহিনী লিখেন। তিনি লিখেন ‘চলে মুসাফির’,  ‘হলদে পরীর দেশে’, ‘ জার্মানীর শহরে বন্দরে’ এবং ‘ যে দেশে মানুষ বড়’। রবীন্দ্রনাথের বড়ভাই অবনীন্দ্রনাথও ‘পথে বিপথে’ নামে একটি ভ্রমণ কাহিনী লিখেন। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে সৈয়দ মুজমবা আলীর ‘দেশ বিদেশে’ এবং অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘পথে প্রবাসে’। ‘দেশ বিদেশে’ বর্ণনা করা হয়েছে আফগানিস্তানের ইতিহাস ঐতিহ্য,  সমাজ-সংস্কৃতি, ধর্ম-রাজনীতি; এমনকি সেখানকার বিনোদন। কেউ আফগানিস্তান ভ্রমণ না করেও শুধুমাত্র ‘দেশ বিদেশে’ পাঠ করে আফগানিস্তান সম্পর্কে বিশদ ধারণা লাভ করতে পারবে। আর অন্নদাশঙ্কর পুরো ইউরোপকে বন্দি করেছেন এক মলাটে। ১৯২৬- ১৯২৯ আইসিএস পরীক্ষার জন্য অন্নদাশঙ্কর ইউরোপে ছিলেন। তখন তিনি চষে বেড়িয়েছেন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী, ইতালি, সুইজারল্যান্ড ও অষ্ট্রিয়া। এসব দেশের সমাজ ও সভ্যতাকে তুলে ধরা হয়েছে ‘পথে প্রবাসে’। তিনি এ বইয়ে তিনি ইউরোপীয় সভ্যতার সাথে ভারতীয় সভ্যতার তুলনাও করেছেন। ইংল্যান্ডের সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির তুলনা করে ধ্বনি বিজ্ঞানী মুহাম্মদ আব্দুল হাই লিখেন ‘বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন’।

মার্কিন আয়ওয়া শহরকে নিয়ে কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন ‘ ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম’। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার বন্ধু প্রতীম প্রেয়সী মার্গারেট ম্যাথিউর দেশ ফ্রান্স নিয়ে লিখেছেন ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’। এই ফ্রান্সকে নিয়েই কবি মোহাম্মদ রফিক লিখেছেন ‘দূরের দেশ নয়’।

এসব ভ্রমণ কাহিনী যেমন সাহিত্যকে করে সমৃদ্ধ, তেমনি পাঠককে করে পুলকিত। পাঠক যেন এসব গ্রন্থের সওয়ার হয়ে ঘুরে বেড়ায় তামাম বিশ্ব।

Latest posts by প্রমথ রায় (see all)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *