মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

মধ্যরাতের  ট্রেন

প্রমথ রায়

১৩ মে, ২০২৩ , ৪:১৭ অপরাহ্ণ ;

মধ্যরাতের ট্রেন

রাত প্রায় একটা। চারদিকে ঘন অন্ধকার। নিস্তব্ধতায় কীবোর্ডের খটখট শব্দ আর ঝিঁঝি পোকার মায়া কান্না ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। সীমাকে ইমেইল লিখছি। সম্পর্ক শেষ করার ইমেইল। ‘..তোমার সাথে সম্পর্ক রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না।’ শেষ করতে পারলাম না। বিদ্যুৎ চলে গেলো। সিগারেট ধরালাম। বাইরে বের হলাম। স্টেশনের কাছে। বহুদিন মধ্য রাতের ট্রেন দেখি না। মাঝে মাঝে রাত বারোটার ট্রেন রাত দুটোয় পৌঁছায়।  মধ্যরাতে মানুষের এ কোলাহল ভালোই লাগে। মাঝরাতের এ ট্রেনের অধিকাংশ যাত্রী নিম্নবিত্ত। তাঁরা শহরে তাঁদের ছোটো ছোটো ব্যবসাগুলো চুকিয়ে বাসায় ফেরে। কালেভদ্রে দু একজন ভদ্রলোকও থাকে। সীমার সাথে আমার পরিচয় একরকম একটি মাঝরাতের ট্রেনে পরিচয়। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে একেবারে বাসায় ফিরছিলাম। সীমা ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ফিরছিলো। দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম। আলাপকালে জানতে পারি তার বাসাও এ শহরের পশ্চিম প্রান্তে। বাবা কৃষি অফিসার। সদ্য তাঁর স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশন সমাপ্ত করা তাঁকে আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট ছিলো। আমাদের আলাপ বেশ জমেছিলো। কখনো প্রেম করতে না চাওয়া মানুষটা কখন যে প্রেমে পড়ে গেলাম। জীবনে অবশ্য কখনো প্রেম আসেনি। সে রাতে সীমা একা বাসা যেতে পারেনি। আমাদের বাসায় ছিলো। আমার মায়ের আতিথেয়তাও অবশ্য তাঁকে আকর্ষণ করেছিলো। হয়তোবা এ কারণেও সে আমার প্রেমে পড়তে পারে। পরে সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ভর্তি হয়। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! সাত বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কোনো প্রেম হলো না; অথচ যাকে ভালোবাসলাম, সে আমার ফেলে আসা স্মৃতিতে একাই উড়ে বেড়ায় নিঃসঙ্গ প্রজাপতির মতো। হয়তোবা সে আর নিঃসঙ্গ নেই। তাইতো আমার সাথে সব যোগাযোগ ছিন্ন করে দিয়েছে। সবচেয়ে খারাপ লেগেছে গত সপ্তাহে যখন ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছি, ও দেখা পর্যন্ত করেনি। এই এক সপ্তাহে মনকে অনেক বুঝিয়েছি। শেষ পর্যন্ত নিজেকে স্বান্তনা দেয়ার জন্য সম্পর্ক ভাঙ্গার ইমেইল লিখছিলাম। সেটাও শেষ করতে পারলাম না।

প্লাটফর্মের বেঞ্চে একা বসে আছি। আর একটি সিগারেট ধরালাম। দূরে দুজন মানুষের গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো। একটু পরে ফুলকী বলে উঠলো, ‘কাজের সময় ভালোই লাগছে, টাকার সময় যত কিপ্টেমি। ‘ লোকগুলো যে কী! সামান্য কটা টাকার জন্য সে এ নিকৃষ্ট পথ বেছে নিয়েছে। এ কটা টাকা দিতে ওদের এত কার্পণ্য। ফুলকীর সাথে আমার বেশ খাতির। ওকে আমি ‘ফুল’ বলে ডাকি। আমি তাকে মজা করে বলি, কীগো আমার বাগানের ফুল, মধু খাওয়াও সবারে!’ ও হেসে বলে, ‘আমি তো তোমার আজন্ম ধরে। তোমার জন্য আমার দরজা সর্বদা খোলা।’ আমার মাঝে মাঝে সত্যি যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু সীমার ভালোবাসা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু মাঝে মাঝে আমার সিগারেটের দামের কর্জদাতা ফুলকী। কর্জ কখনো শোধ করা হয় না। ফুলকী বলে, ‘তুমি তো আমার পরাণ! পরাণের কাছে কোনো কর্জ থাকে না।’ ফুলকীর জন্য আমার অনেক কষ্ট হয়। মেয়েটি নিজে থেকে এ পথে আসেনি। ওর স্বামী টাকার বিনিময়ে ওকে মানুষের কাছে লেলিয়ে দেয়। তারপর অনেকটা অভিমানে সে এ পথে নামে। পরে অবশ্য স্বামীকে তালাক দেয়। সে খদ্দের মনে করে আমার দিকে এগিয়ে এলো। চিনতে পেরে থতমত খেয়ে বললো, ‘কিরে মিয়া, তুমি এতো রাতে?’ আমি হেসে বললাম, ‘তোমার অপেক্ষায়। ‘ সেও হেসে বললো, ‘এতদিনে ভ্রমরের মধু খাওয়ার শখ হয়েছে!’ আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, সিরিয়াসলি বলছি।’ ফুলকি কেঁদে ফেললো। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, ‘তুমিও!’ আমি ওর চোখের জল মুছে দিয়ে বললাম, ‘না রে, আজ আমার মন ভালো নেই।’ মধ্যরাতের ট্রেনটি পৌঁছে গেছে। সকল ফেরিওয়ালা কোলাহল করে নামছে। তাঁদের কোলাহলে ঘুমন্ত শহরটি আবার জেগে উঠলো। আমাকে অবাক করে দিয়ে সীমা ট্রেন থেকে নামলো। সাথে তাঁর সমস্ত জিনিসপত্র। হিসাব মিলছে না। সে তো মাত্র সেকেন্ড ইয়ার শেষ করে থার্ড ইয়ারে। সমস্ত অভিমান ভেঙে তাঁর কাছে গেলাম। সে আমাকে দেখে কেঁদে ফেললো। তাঁর কান্নায় আমারও কান্না এসে গেলো। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? সে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলো না। তারপর অস্পষ্টভাবে বললো, ‘আমি আর তোমার নেই।’ আমার ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠলো। এটা আমি বেশ কিছুদিন ধরে বুঝতে পারছিলাম। তবু কারণ জিজ্ঞেস করলাম। সে কিছুতেই বলতে চাচ্ছিল না। আমার জেদে বললো, সে একজন ধর্ষিত নারী। আমার মাথাটা চক্কর দিলো। অনেকক্ষণ দুজন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদলাম। নিজেকে শান্ত করে বললাম, ভালোবাসা কখনো ধর্ষিত হয় না!

Latest posts by প্রমথ রায় (see all)

Comments are closed.