মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

লিখিত জগত এবং অলিখিত জগত

প্রমথ রায়

১২ আগস্ট, ২০২৩ , ৮:৫৪ অপরাহ্ণ

মূল : ইতালো ক্যালভিনো

ইংরেজি থেকে অনূদিত : প্রমথ রায়

আমি মানবতার সে অংশে রয়েছি, যা পৃথিবীর মাপে গৌণ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মূখ্য। আমি মনে করি আমার পাঠকদের অধিকাংশ তাদের জাগ্রত থাকার বেশিরভাগ সময় এক বিশেষ জগতে কাটায়, যে জগত কিছু অনুভূমিক রেখায় তৈরি, যেখানে একটি শব্দ অন্য শব্দকে অনুসরণ করে, যেখানে প্রতিটি বাক্য ও অনুচ্ছেদ নিজ নিজ অবস্থানে রয়েছে; যে জগত অনেক সমৃদ্ধ এবং অলিখিত জগতের চেয়ে অধিক সমৃদ্ধ ; আমাকে এ জগতের মধ্যে অবস্থান করতে বিশেষভাবে মানিয়ে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করায়। যখন আমি অন্য জগতে আমার স্থান খোঁজার জন্য লিখিত জগত ত্যাগ করি; যে জগতকে ‘বিশ্ব সংসার’ বলা হয়, যেটি ত্রিধারা ও পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা গঠিত, যা কোটি কোটি মানুষের কাছে জনপ্রিয়, যেটি আমার কাছে প্রতিবার সন্তান জন্মদানের কষ্টের পুনরাবৃত্তি, বিভ্রান্ত অনুভূতিতে বুদ্ধিদীপ্ত বাস্তবতার আকার ধারণ, ধ্বংস হওয়া ব্যতীত অপ্রত্যাশিত ঘটনা মোকাবিলা করার কৌশল বাছাই করার সমতুল্য।

এই নতুন জন্ম সর্বদা বিশেষ আচারের সাথে সংযুক্ত হয়ে একটি ভিন্ন জীবনে প্রবেশ করাকে নির্দেশ করে: উদাহরণস্বরূপ, আমার চশমা পরার স্বভাব রয়েছে, যেহেতু আমি নিকটদর্শী এবং পড়ার জন্য আমাকে চশমা ব্যবহার করতে হয় না, তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ দূরদর্শীদের জন্য বিপরীত আচার আরোপ করা হয়, অর্থাৎ তাদের ব্যবহৃত চশমা খুলে পড়তে হয়।

অনুচ্ছেদের প্রতিটি আচার মানসিক মনোভাব পরিবর্তনের সাথে মিলিত হয়। যখন আমি কোনোকিছু পড়ি, তখন প্রতিটি বাক্য অন্তত তার আক্ষরিক অর্থে সহজে বোঝা যায় এবং আমাকে একটি মতামত তৈরি করতে সক্ষম করে: আমি যা পড়ি তা হোক সত্য বা মিথ্যা, সঠিক বা ভুল, আনন্দদায়ক বা অপ্রীতিকর। অন্যদিকে সাধারণ জীবনে অগণিত পরিস্থিতি রয়েছে যেগুলো আমাকে বোঝার দরকার হয় না, সবচেয়ে সাধারণ থেকে সবচেয়ে তুচ্ছ: আমি প্রায়ই নিজেকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে দেখি যাতে আমি কোন মতামত প্রকাশ করতে পারি না, যেখানে আমি কোনো রায় দিতে পারি না।

যখন আমার চোখে স্পষ্ট হওয়ার জন্য আমি অলিখিত জগতের অপেক্ষা করি, তখন সবসময় একটি লিখিত পৃষ্ঠা নাগালে থাকে, যেখানে আমি পিছনে লাফ দিতে পারি: সেটা আমাকে সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি দিয়ে করতে হয়: অন্তত, আমি যদি পুরোটির একটি ছোট অংশ বুঝতে পারি তবে আমি সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখার কল্পনা চর্চা করতে পারি।

আমি মনে করি আমার তরুন বেলায়ও জিনিসগুলি এভাবে চলছিলো, কিন্তু সেই সময়ে আমার ভুল ধারনা ছিলো যে, লিখিত জগৎ এবং অলিখিত জগৎ একে অপরকে আলোকিত করে; জীবনের অভিজ্ঞতা এবং পাঠের অভিজ্ঞতা কিছু ক্ষেত্রে পরিপূরক এবং একটি ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া মানে অন্যটিতেও এগিয়ে যাওয়া। আজ আমি বলতে পারি যে আমি লিখিত জগত সম্পর্কে আগে যা জানতাম, এখন আরও বেশি জানি : বইয়ের মধ্যে অভিজ্ঞতা অর্জন সম্ভব, তবে এর বিস্তৃতি পৃষ্ঠার ফাঁকা মার্জিনের বাইরে প্রসারিত হয় না। পরিবর্তে আমার চারপাশে পৃথিবীতে যা ঘটে, তা আমাকে অবিরত বিস্মিত করে, ভীত করে, রহস্যময় করে। আমি আমার জীবনে, এই বিশাল মহাবিশ্বে, সমাজে অনেক পরিবর্তন দেখেছি এবং এমনকি আমার মধ্যেও পরিবর্তন দেখেছি; আমি আমার এবং পরিচিত ব্যক্তিদের বিষয়ে ভবিষ্যতবানী করতে পারি না। আমি মানবজাতির ভবিষ্যত সম্পর্কে খুব সামান্যই জানি। আমি বিভিন্ন লিঙ্গ ও প্রজন্মের মধ্যে ভবিষ্যতের সম্পর্ক সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে পারিনি, সমাজ, শহর এবং দেশের ভবিষ্যত উন্নয়ন কেমন হবে, সেখানে কোন ধরনের শান্তি বা যুদ্ধ বিরাজ করবে, মুদ্রা কোন গুরুত্ব বহন করবে, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত কোন জিনিসগুলো হারিয়ে যাবে বা কোনগুলো নতুন সংযোজন হবে, কোন ধরণের যানবাহন এবং যন্ত্র ব্যবহার করা হবে, সমুদ্র, নদী, প্রাণী, গাছপালার ভবিষ্যৎ কি হবে কিছুই জানি না। আমি খুব ভালভাবেই জানি যে, আমি এই অজ্ঞতা তাদের সাথে সহভাগিতা করবো যারা আমার কাছে জানতে চায় : তারা হতে পারে অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ। কিন্তু আমি একা আমাকে কোন আরাম দিতে পারি না।

আমি মনে করি যে সাহিত্য সবসময় অন্যান্য বিভাগ থেকে বেশি কিছু বোঝায়, কিন্তু এটি আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে প্রাচীনরা চিঠিতে জ্ঞান দেখতেন, এবং আমি বুঝতে পারি যে আজকে জ্ঞানের প্রতিটি ধারণা কতটা অনর্জনযোগ্য।

এ ক্ষেত্রে আপনারা জিজ্ঞাসা করবেন: যদি আপনি বলেন যে, আপনার সত্যিকারের জগত লিখিত পৃষ্ঠা, যদি আপনি এটা সহজে অনুভব করেন, তবে আপনি কেন এটি ত্যাগ করতে চান, কেন আপনি বিশাল জগতে যেতে চান, যার কর্তৃত করতে আপনি অযোগ্য? সোজা উত্তর : লিখতে। কারণ আমি একজন লেখক। আমার কাছে যা প্রত্যাশা করা হয় তা হল আমি চারপাশ দেখি, কী ঘটছে তার একটি তরিৎ চিত্র ধারন করি,তারপর ফিরে আসি এবং আমার ডেস্কের উপর নিচু হই ,লেখা শুরু করি। আমার শব্দের কারখানাটি পুনরায় চালু করার জন্য আমাকে অলিখিত কূপ থেকে নতুন জ্বালানী পেতে হয়।

কিন্তু চলুন গভীরভাবে দেখি কীভাবে জিনিসগুলি দাঁড়ায়। এটা কি আসলেই সেটা যা ঘটে? সময়ের মূল দার্শনিক স্রোত বলে: না, এর কোনটি সত্য নয়। লেখকের মন দুটি বিপরীতমূখী দার্শনিক স্রোত দ্বারা প্রভাবিত হয়। প্রথমটি বলে: বিশ্ব সংসারের অস্তিত্ব নেই; কেবল ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। দ্বিতীয়টি বলে: সাধারণ ভাষার কোন অর্থ নেই; বিশ্ব অপ্রকাশিত।

প্রথমটির জন্য, ভাষার অস্তিত্বকে একটি ছায়ার বিশ্বের উপরে নেয়া হয়; দ্বিতীটির জন্য মরূভমির বাতাসে বালু উড়ার মতো এ বিশ্বই একটি শব্দের মরূভূমির ওপর যে নীরব পাথরের মূর্তি হিসাবে বুনন করে। প্রথম স্রোতটির প্রধান উৎস গত পঁচিশ বছর ধরে প্যারিস থেকে এসেছে; দ্বিতীয়টি এ শতাব্দীর শুরু থেকে ভিয়েনা হতে প্রবাহিত হচ্ছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ইতালিতেও সাধারণ স্বীকৃতি লাভ করে বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে। উভয় দর্শনে তাদের পক্ষে জোরালো যুক্তি রয়েছে। উভয়ই লেখকের জন্য বাধা: প্রথমটির জন্য এমন একটি ভাষা ব্যবহারের প্রয়োজন হয় যা কেবল তার নিজের এবং অভ্যন্তরীণ নিয়মগুলিতে প্রতিক্রিয়া জানায়; দ্বিতীয়টি এমন একটি ভাষা ব্যবহার করে যা বিশ্বের নীরবতার মুখোমুখি হতে পারে। উভয় তাদের আকর্ষণ এবং তাদের প্রভাব আমার উপর প্রয়োগ করে। এর মানে হল যে আমি কোনোটিকে অনুসরণ না করে শেষ করি না, কোনোটিকে বিশ্বাস করি না। তাহলে আমি কী বিশ্বাস করি?

এক মুহূর্তের জন্য যদি দেখি আমি এই কঠিন পরিস্থিতির সুবিধা নিতে পারি। প্রথমত, যদি আমরা লিখিত এবং অলিখিত এর মধ্যে অসঙ্গতি অনুভব করি, তবে এর কারণ আমরা লিখিত জগত কী, তা সম্পর্কে অনেক সচেতন: আমরা এক সেকেন্ডের জন্যও ভুলে যেতে পারি যে, এটি শব্দের তৈরি জগত, যা একটি ভাষার সঠিক কৌশল অনুসারে এবং একটি বিশেষ পদ্ধতি অনুসারে ব্যবহৃত হয় যাতে অর্থ এবং অর্থের মধ্যে সম্পর্কগুলি সংগঠিত হয়। আমরা সচেতন যে যখন একটি গল্প আমাদের কাছে বলা হয় (এবং প্রায় সব লিখিত পাঠ্য একটি গল্প তৈরি করে, এমনকি একটি দার্শনিক প্রবন্ধ, এমনকি একটি কর্পোরেশন ব্যালেন্স শীট, এমনকি একটি রন্ধন রেসিপি), এই গল্পটি অন্য গল্পের পদ্ধতির মতো একটি পদ্ধতির গতিতে করা হয়।

এটি একটি এগিয়ে যাওয়ার বড় পদক্ষেপ : আমরা এখন ভাষাগত কী এবং কী নয় তার মধ্যে অনেক বিভ্রান্তি এড়াতে সক্ষম হচ্ছি, এবং তাই আমরা দুটো জগতের মধ্যে সম্পর্ককে স্পষ্ট দেখতে পারি।

যে সব বাকি আছে তা ক্রস-চেক করা এবং যাচাই করতে হবে যে বাইরের জগত সর্বদা সেখানে আছে এবং শব্দগুলির উপর নির্ভর করে না, বরং শব্দে রূপান্তরিত নয়, এবং কোনো ভাষা, কোনো লেখা এটিকে গ্রাস করতে পারে না। আমাকে কেবল নিরব হৃদয়ে পৌঁছার আশা করে বইয়ে জমা করা শব্দগুলো ঘুরিয়ে দেখতে হয়, বাইরে জগতে নিমজ্জিত হতে হয়, সত্যিকারের নীরবতা অর্থপূর্ণ, কিন্তু সেখানে কীভাবে যেতে হয়।

কেউ কেউ বাইরে জগতের সাথে যোগাযোগ করাতে প্রতি সকালে সংবাদপত্র কিনে। আমি তেমন নই। আমি জানি যে পত্রিকাগুলোতে অন্যের তৈরি জগতকে পাঠ, বা একটি বেনামী মেশিনে অসংখ্য ঘটনার স্তুপ থেকে বাছাই করা যা “সংবাদ” হিসাবে স্থানান্তরিত করা যেতে পারে।

কেউ কেউ লিখিত জগতের গ্রাস থেকে মুক্ত হতে টেলিভিশন চালু করে। কিন্তু আমি জানি এ সকল চিত্র, এমনকি সেগুলো সরাসরি জীবন থেকে আনা হলেও , সংবাদপত্রের মতো একটি নির্মিত গল্পের অংশ। তাই আমি সংবাদপত্র কিনবো না, আমি টেলিভিশন চালু করবো না কিন্তু হাঁটার জন্য বাইরে যাব।

কিন্তু শহরের রাস্তায় আমি যা দেখি তার সবই ইতিমধ্যে সমজাতীয় তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে স্থান পেয়েছে। এ জগতে আমি যা দেখি, সাধারণত ‘বিশ্ব সংসার’ হিসাবে স্বীকৃত, যেগুলো কোনোভাবে আমার চোখে দেখা দেয় বেশিরভাগই ইতোমধ্যে লিখিত শব্দ জয় করেছে, উপনিবেশ করেছে, বক্তৃতার এক পুরু আবরণ দ্বারা আচ্ছাদিত এক জগত। আমাদের জীবনের ঘটনাগুলি ঘটার আগেই শ্রেণীকরণ, বিচার, মন্তব্য করা হয়েছে। আমরা এমন এক জগতে বাস করি যেখানে সবকিছু টিকতে শুরু হওয়ার আগেই পঠিত হয়ে যায়।

আমরা যা দেখি কেবলমাত্র তা সবকিছু নয়, আমাদের চোখও লিখিত ভাষা দ্বারা প্রভাবিত। শত শত বছর ধরে পড়ার অভ্যাস Homo sapiens (মানুষ) কে Homo legens (জ্ঞানী) তে রূপান্তরিত করেছে, কিন্তু এই Homo legens আগের তুলনায় প্রয়োজনীয় জ্ঞানী হতে পারেনি। আগে না পড়েও একজন জানত কীভাবে অনেক জিনিস দেখা ও শোনা যায়, যা আমরা এখন বুঝতেও পারি না; যেমন পশুদের শিকার করার পথ, বৃষ্টি বা বায়ুর অভিগমন হওয়ার লক্ষণ। আগে একজন একটি গাছের ছায়া থেকে দিনের সময় এবং আকাশে তারার দূরত্ব দেখে রাতের সময় নির্ধারণ করতেন। শোনা, গন্ধ নেয়া,স্বাদ নেয়া , স্পর্শ করায় আমাদের কাছে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব সন্দেহাতীত।

এটা বলার পর, আমার পরিষ্কার করা দরকার যে, আমি এখানে প্রস্তর যুগের উপজাতিদের জ্ঞান পুনরুদ্ধার করার জন্য নিরক্ষরতায় ফিরে আসার প্রস্তাব করতে আসিনি। আমরা যা কিছু হারিয়ে ফেলতে পারি তার জন্য আমি দুঃখিত, কিন্তু আমি কখনো ভুলি না যে, হারানোর চেয়ে প্রাপ্তি বড়। আমি যা বুঝতে চেষ্টা করছি আমরা আজ তা করতে পারি।

একজন ইতালীয় হিসেবে আমি ‘জগত সংসারের’ সাথে কিংবা ভাষার সাথে আমার সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে বিশেষ সমস্যাগুলি উল্লেখ করতে হবে, তাহলো একটি দেশের একজন লেখক হিসেবে তাদেরকে ক্রমাগত হতাশ করে যাচ্ছি, যারা এটা বোঝার চেষ্টা করে। ইতালি এমন একটি দেশ যেখানে অনেক রহস্যময় জিনিস ঘটে, যা প্রতিদিনই ব্যাপকভাবে আলোচনা করা হয় এবং মন্তব্য করা হয় কিন্তু কখনও সমাধান করা হয় না; যেখানে প্রতিটি ঘটনা একটি গোপন চক্রান্তে লুকায়, যা গোপন তা গোপন থেকে যায়; যেখানে কোনো গল্প শেষ হতে আসে না, কারণ শুরু জানা নেই। কিন্তু শুরু এবং শেষের মধ্যে আমরা অশেষ বর্ণনা উপভোগ করতে পারি। ইতালি এমন একটি দেশ যেখানে সমাজ খুব দ্রুত পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা লাভ করে, এমনকি অভ্যাসে ও আচরণে: এত দ্রুত পরিবর্তন হয় যে, আমরা বলতে পারি না যে আমরা কোন দিক থেকে চলছি, এবং প্রতিটি নতুন ঘটনা অদৃশ্য হয় ; অবনমন এবং বিপর্যয়ের অভিযোগ বা সতর্কতার তুষারপাত কিংবা আমাদের প্রাপ্তি ও বেঁচে থাকার ঐতিহ্যগত সামর্থ্যের সন্তুষ্টি ঘোষণার দ্বারা তা নিমজ্জিত হয়।

সুতরাং আমরা যে গল্পগুলি বলতে পারি তা একদিকে অজানা অনুভূতি এবং অন্যদিকে কাঠামো , রেখা , সাদৃশ্য এবং জ্যামিতির প্রয়োজনে চিহ্নিত করা হয়; আমাদের পায়ের নিচে অনুভূত বালু সরাতে এটি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপায়।

ভাষা হিসাবে এটি একটি ধরনের প্লেগ (মহামারী) দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। ইতালিয়ান একটি ক্রমবর্ধমান বিমূর্ত, কৃত্রিম, দ্বিধান্বিত ভাষা হয়ে উঠছে; সহজ জিনিসগুলো সরাসরি বলা হয় না, ইন্দ্রিয়লব্ধ বিশেষ্যগুলি খুব কমই ব্যবহৃত হয়। এই মহামারী প্রথম রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক , বুদ্ধিজীবীদের সংক্রমণ করে, তারপর আরো সাধারণ হয়ে ওঠে, কারণ বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা প্রভাবিত। লেখকের কাজ এই মহামারীর সাথে লড়াই করে সহজ,ইন্দ্রিয়লব্ধ ভাষা নিশ্চিত করা, কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের দৈনন্দিন ভাষা যা গতকাল পর্যন্ত ছিলো তা সংক্রমণ এড়াতে পারছে না।

অন্য অর্থে আমি বিশ্বাস করি আমরা ইতালিয়ানরা উপন্যাস লেখায় ভাষা এবং জগত সংসারের সাথে আমাদের সাম্প্রতিক সমস্যা সমন্বয় করতে আদর্শ অবস্থানে রয়েছি।

আমাদের শত শত বছরের সংস্কৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রবণতা হলো দর্শনে স্বতন্ত্রীকরণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাহিত্যে বিচ্ছিন্নতার প্রভাব, যা আমাদের শব্দ এবং ধারণার পর্দা ভেঙ্গে প্রথমবারের মতো আমাদের জগতকে এমনভাবে দেখায় যেন আমরা প্রথমবার দেখছি। এখন আমি আমার মনকে ফাঁকা করার চেষ্টা করব, এবং প্রতিটি সাংস্কৃতিক উদাহরণ এক নজরে আড়াআড়ি ভাবে দেখব। কি ঘটে? আমাদের জীবন পাঠের জন্য প্রকল্পিত হয়েছে এবং আমি উপলব্ধি করি যে আমি দিগন্ত, মাঠ , সমুদ্রের ঢেউ পড়ার চেষ্টা করছি। এই প্রকল্পের অর্থ এই নয় যে আমাদের চোখ বাম থেকে ডানে, তারপরে বামে একটু নিচে এভাবে একটি স্বাভাবিক অনুভূমিক আন্দোলন অনুসরণ করতে বাধ্য। (স্পষ্টতই আমি পশ্চিমা পৃষ্ঠাগুলি পড়ার জন্য প্রকল্পযুক্ত চোখ সম্পর্কে বলছি; উলম্ব প্রকল্পের জন্য জাপানী চোখ ব্যবহার করা হয়) একটি চোখের ব্যায়ামের চেয়ে বেশি পাঠ করা একটি প্রক্রিয়া যা মনকে এবং চোখকে একত্রিত করে, বিমূর্ত ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে মূ্র্ত নিষ্কাশন করে, ভিন্ন চিহ্নগুলি স্বীকৃতি দেওয়ার মতো, আমরা ক্ষুদ্র টুকরাগুলিতে যা দেখি তা চূর্ণ করা, তাদের অর্থপূর্ণ অংশে পুনর্বিন্যাস করা, আমাদের চারপাশে নিয়ম, পার্থক্য, পুনরাবৃত্তি, একক, প্রতিস্থাপন, অকার্যকর আবিষ্কার করা।

জগত সংসার এবং একটি বইয়ের মধ্যে তুলনা মধ্যযুগ এবং রেনেসাঁ থেকে শুরু হওয়া এক দীর্ঘ ইতিহাস। জগত সংসারে কি ভাষা লেখা আছে? গ্যালিলিওর মতে, এটি গণিত এবং জ্যামিতিক ভাষা, পরম নির্ভুলতার একটি ভাষা। আমরা কি বর্তমান বিশ্ব এভাবে পড়তে পারি ? হয়তো পারি, যদি আমরা সুদূরবর্তী ছায়াপথ, কৃষ্ণ গহ্বর, উল্কার কথা বলি। কিন্তু যখন আমরা আমাদের দৈনন্দিন জগতের কথা বলি তখন সবকিছু লিখিত মনে হয়, ভাষা মোজাইকের মতো , গ্রাফিতি (চিত্র) দিয়ে দেয়াল আচ্ছাদনের মতো, লেখাগুলি একটি অন্যটির উপরে অনুসন্ধান করে, একটি পান্ডুলিপি যার চামড়ার পৃষ্টাগুলো কয়েকবার ঘষা হয়েছে এবং অনেকবার পুনঃলিখন করা হয়েছে, স্কিটারস (জার্মান শিল্পী) বর্ণমালার স্তর, বিভিন্ন উদ্ধৃতি, অকথ্য শব্দাবলি, ঝিকিমিকি অক্ষর যা কম্পিউটার পর্দায় প্রদর্শিত হয়, সেগুলো দিয়ে কোলাজ তৈরি করেন।

আমাদের কি জগত সংসারের এই ভাষার অনুকরণ করা উচিত? আমাদের শতাব্দীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখক এটি করেছেন: আমরা এজরা পাউন্ড বা জয়েসের ক্যান্টোস (এক ধরনের কবিতা) কিংবা গাড্ডা’র কিছু চমকপ্রদ অনুচ্ছেদে এরকম উদাহরণ খুঁজে পেতে পাই।

কিন্তু অনুকরণ কি সত্যিই সঠিক উপায়? আমি লিখিত জগতে এবং অলিখিত জগতের মধ্যে অপ্রতিরোধ্য পার্থক্য দিয়ে শুরু করেছি; দু জগতের ভাষা একত্রিত হলে, আমার যুক্তিগুলো ছিন্নভিন্ন হবে। একজন লেখকের জন্য সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ হলো এমন একটি ভাষা ব্যবহার করে আমাদের পরিস্থিতির জট পাকানো জটিলতার কথা বলে যাতে এটি হ্যালুসিনেসনের অনুভূতি সৃষ্টি করে, যেমন কাফকা করতেন।

সম্ভবত ভাষা এবং বিশ্বে সংসারের মধ্যে সম্পর্ক নবায়নের প্রথম পদক্ষেপটি সরলতম: একটি সাধারণ বস্তুর উপর মনোযোগ নির্দিষ্ট করুন; যেটি সবচেয়ে নির্যাতিত এবং পরিচিত, এবং এটি সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করুন, যেন এটি মহাবিশ্বে নতুন এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস ছিল।

আধুনিক কবিতা থেকে আমরা যে শিক্ষা নিতে পারি তার মধ্যে একটি হল আমাদের সমস্ত মনোযোগ, আমাদের সমস্ত ভালবাসা মানব চিত্র থেকে খুব দূরে এমন কিছুতে বিনিয়োগ করা: এমন একটি বস্তু বা উদ্ভিদ বা প্রাণী যেখানে আমরা আমাদের বাস্তবতা, আমাদের নৈতিকতার অনুভূতি সনাক্ত করতে পারি; উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস সাইক্ল্যামেনের (একধরনের বৃক্ষ) সাথে, মারিয়েন মুর নটিলাসের (প্রাণী) সাথে, ইউজেনিও মন্টাল একটি ঈলের (মাছ) সাথে করেছিলেন।

ফ্রান্সে ফ্রান্সিস পঙ্গে খুব সামান্য জিনিস নিয়ে গদ্য কবিতা লেখা শুরু করেন এক টুকরো সাবান, এক টুকরো কয়লা ; “নিজের মধ্যে জিনিস” এর সমস্যাটি সার্ত্রে এবং ক্যামাসের সাহিত্য প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রব্বে-গ্রিলেটের এক চতুর্থাংশ টমেটোর বর্ণনা দিয়ে এটি চুড়ান্ত অভিব্যক্তিতে পৌঁছায়। আমি মনে করি না শেষ শব্দটি এখনও বলা হয়েছে। সম্প্রতি জার্মানিতে পিটার হ্যান্ডকে সম্পূর্ণ দিগন্তের উপর একটি উপন্যাস লিখেন। ইতালিতেও কিছু লেখক দৃশ্যপটের ক্ষেত্রে সাধারণ হয়েছেন।

বর্ণনার প্রতি আমার আগ্রহের কারণে আমার সাম্প্রতিক বই ‘পালোমার’-এ অনেক বর্ণনা রয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত গল্পগুলির প্রতিটিতে একটি চরিত্র কেবলমাত্র সে যা দেখে তার ভিত্তিতে চিন্তা করে এবং অন্য পথে তার কাছে আসা যে কোনও চিন্তার বিষয়ে তার সন্দেহ হয়। এই বইটি লিখতে আমার সমস্যা ছিল যে আমি কখনই একজন পর্যবেক্ষক ছিলাম না; তাই প্রথম যে কাজটি আমাকে করতে হয়েছিল তা হল আমার মনোযোগ কোন কিছুর উপর ফোকাস করা এবং তারপরে তা বর্ণনা করা, বা একই সাথে দুটি জিনিস করা, উদাহরণস্বরূপ যদি আমি চিড়িয়াখানায় একটি গিরগিটি পর্যবেক্ষণ করি এবং আমি আমি যা দেখেছি তা দ্রুত লিখি না এবং আমি এটা ভুলে গেছি।

আমাকে বলতে হয় যে, আমি বেশিরভাগ বই লিখেছি এবং আমি এটি লিখতে মনের মধ্যে যে ধারণা উদ্ভূত হয়; এই ধরনের বইটি লেখা আমার পক্ষে অসম্ভব বলে মনে হয়েছিলো। যখন আমি উপলব্ধি করলাস যে একটি নির্দিষ্ট ধরণের বই আমার মেজাজ এবং আমার প্রযুক্তিগত দক্ষতার সম্পূর্ণ বাইরে, আমি আমার ডেস্কে বসে থাকি এবং এটি লিখতে শুরু করি।

আমার উপন্যাস ‘If on a winter’s night a traveler’ এর সাথে কি ঘটেছিল: আমি সব ধরনের উপন্যাসের কল্পনা করেছিলাম যা আমি কখনো লিখিনি ; তারপর আমি লিখতে চেষ্টা করলাম, নিজেকে দশটি ভিন্ন কাল্পনিক ঔপন্যাসিকের সৃজনশীল শক্তির মধ্যে প্রকাশ করার চেষ্টা করলাম।

আধুনিক মানুষ পঞ্চইন্দ্রিয়ের ব্যবহার হারিয়ে ফেলছে তা দেখানোর জন্য পঞ্চইন্দ্রিয়ের কথা বলতে আমি আর একটি বই লিখছি । এই বইটি লেখার ক্ষেত্রে আমার সমস্যা হলো যে আমার গন্ধের অনুভূতি খুব বেশি নয়, আমার শ্রবণে মনোযোগের অভাব রয়েছে, আমি একজন ভোজন রসিক নই, আমার স্পর্শকাতর সংবেদনশীলতা আনুমানিক এবং আমি নিকটদর্শী। পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের প্রতিটির জন্য আমাকে এমন একটি প্রচেষ্টা করতে হয় যা আমাকে বিভিন্ন সংবেদন এবং সূক্ষ্মতা আয়ত্ত করায়। আমি জানি না আমি সফল হব কিনা, তবে এই ক্ষেত্রে অন্যদের মতো আমার লক্ষ্য নিজেকে পরিবর্তন করার বই তৈরি করা নয়, আমি মনে করি প্রতিটি মানুষের ‘উদ্যোগ গ্রহণ’ লক্ষ্য হওয়া উচিত।

আপনি অভিযোগ করতে পারেন যে, আপনি এমন বই পছন্দ করেন যা সত্য অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে, যা সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধ। ভালো, আমি তাই করি। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় আমার লেখার প্রেরণা সবসময় যা আমরা জানতে এবং ভোগ করতে চাই এমন কিছু অভাবের সাথে সংযুক্ত, যা আমাদের মুক্তি দেয়। যেহেতু আমি এই ধরনের প্রেরণার সাথে সুপরিচিত, তাই আমার মনে হয় যে আমি বড় বড় লেখকদের মধ্যে এই অভিজ্ঞতা চিহ্নিত করতে পারি যাদের কণ্ঠস্বর পরম অভিজ্ঞতার শিখর থেকে আমাদের কাছে পৌঁছায়। তারা যা প্রকাশ করে তা অভিজ্ঞতা অর্জনের অনুভূতির পরিবর্তে বরং অভিজ্ঞতার নিকট পৌঁছার অনুভূতি ; কীভাবে ইচ্ছাশক্তিকে অক্ষত রাখা যায়, তা জানার মধ্যেই তাদের রহস্য নিহিত রয়েছে।

নির্দিষ্ট অর্থে, আমি বিশ্বাস করি যে আমরা সবসময় এমন কিছু সম্পর্কে লিখি যা আমরা জানি না: অলিখিত জগতকে আমাদের মাধ্যমে প্রকাশ করার জন্য আমরা লিখি। এই মুহুর্তে আমার মনোযোগ লিখিত লাইনের নিয়মিত শৃঙ্খল থেকে সরে গেছে এবং গতিশীল জটিলতা অনুসরণ করে যেখানে কোন বাক্যে থাকতে পারে না বা ব্যবহার হতে পারে না, আমি বোধগম্যতার কাছাকাছি অনুভব করি যে, শব্দের অন্য দিক থেকে, নীরব দিক থেকে কারাগারের প্রাচীরে আঘাতের মতো ‘একটি কিছু’ ভাষার মাধ্যমে উদ্ভূত হওয়ার চেষ্টা করছে।

(এই প্রবন্ধটি ইতালো ক্যালভিনোর ‘The Written World and the Unwritten World’ প্রবন্ধের বইয়ের নাম প্রবন্ধ। Ann Goldstein এটি ইতালি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে ৫ জানুয়ারি, ২০২৩ ‘The Paris Review’ এ প্রকাশ করেন।

ইতালো ক্যালভিনো ১৫ অক্টোবর ১৯২৩ কিউবায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫ ইতালিতে মারা যান। তার বিখ্যাত গ্রন্থসমূহ Our Ancestors trilogy (1952–1959), the Cosmicomics collection of short stories (1965), and the novels Invisible Cities (1972) and If on a winter’s night a traveler (1979)

Ann Goldstein বিখ্যাত ইতালীয় সাহিত্যিক Elena Ferrante, Primo Levi, Alessandro Baricco অনেক লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।)

প্রমথ রায়
Latest posts by প্রমথ রায় (see all)