শুক্রবার দিনটাকে খুব ভয় পেতাম। এ দিন আসলেই কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত। লুকাবার আর পালাবার পথ খুঁজতাম। ছোট বেলায় দুষ্টু তো আর কম ছিলাম না। পুরো সপ্তাহে যত দুষ্টুমি আর অপকর্ম করতাম তার বিচারের নির্ধারিত দিন ছিল শুক্রবার। সেদনি বাবা বাড়িতে থাকতেন। পুরো সপ্তাহে কয়দিন স্কুল ফাঁকি দিয়েছি, কয়দিন প্রাইভেটে যাইনি, কয়দিন দুপুর রোদে ফুটবল খেলেছি, প্রতিদিন কত ঘন্টা পুকুরে গোসল করেছি, কারো গাছের আম পেড়েছি কি না, জাম খেয়েছি কিনা, কারো ছাগলের দড়ি খুলেছি কিনা, মা সব তালিকা করে রাখতেন। আর সপ্তাহ শেষে বাবার কাছে আমলনামা পেশ করতেন। তার পর শুরু হত বিচার। সেখানে উকিল, বিচারক, পুলিশ সবকিছুই বাবা। তিনি নিজেই জেরা করতেন, রায় দিতেন এবং শাস্তিও দিতেন। যখন আমার উপর বাবার শাস্তি বর্ষিত হতো তখন মা নিরবে কাঁদতেন। কিন্তু কখনো বাঁচাতে আসতেন না। এসেই বা কী লাভ ছিল , বাবা রাগলে তো আর কারো কথা শোনেন না। যতক্ষণ না তার হাউস মেটে। এই হলেন আমার বাবা। আর এ কারণেই শুক্রবারকে খুব ভয় পেতাম। মনে হতো সপ্তাহের এই একটা দিন না থাকলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো। বাবার অফিসও ছুটি থাকত না আর আমাকেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো না। কিন্তু আমি সংস্কারক ছিলাম না, সরকার প্রধানও ছিলাম না, তাই শুক্রবার তার জায়গাতেই বহাল তবিয়তে ছিল। আর আমিও সপ্তাহে সপ্তাহে মার খেয়েই চলছিলাম। পুরো স্কুল জীবন এভাবে কেটেছে। পড়াশুনার মতোই সপ্তাহে একদিন রুটিন মাফিক মার খাওয়া। যার কারণে শুক্রবারকে আমি ভীষণ ভয় পেতাম। এ দিনটা এলেই বুকটা দুরু দুরু করে কাঁপতো এই বুঝি বাবার কাঠগড়ায় ডাক পরে।
বাবাকে আমি সব সময় ভয় পেতাম । এখনো পাই। এখনো বাবার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারি না। শুক্রবারের সাথে আরও একদিন ছুটি যোগ হয়েছে। এখন সপ্তাহে দুদিন ছুটি। ভয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। সব সময় বাবাকে প্রচন্ড রাগি একটা মানুষ মনে হত। তিনি যা বলতেন, যা চাইতেন তাই করতে হবে। এর এক পা নড়চড় হলে রেহাই নেই। এতটা শাসনে রাখতেন যে জীবনকে একপেশে মনে হতো। মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে করত। স্বাধীনতা বলতে কিছু ছিল না জীবনে। সব সময় শুধু শাসন আর শাসন।
বাবা কখনও কিছু করে দিতেন না। সব সময় বলতেন দেখে শেখ। স্কুল জীবনে কোন দিন তিনি স্কুলের মাঠ মাড়াননি। মাঝে মাঝে গেটে নামিয়ে দিয়ে যেতেন। ভর্তি, রেজাল্ট, পরীক্ষা সব নিজে নিজেই দিতাম। এমনকি মাধ্যমিকের ফরম পূরণের সময়ও যখন বন্ধুদের বাবারা গিয়েছিলেন তখনও বাবা যাননি। উচ্চ মাধ্যমিকেও না। মোট কথা তিনি সব সময় পিছন থেতেই সহযোগিতা করতেন। কখনও সামনে আসতেন না। এভাবেই একলা চলতে শিখে গিয়েছিলাম। পরে আর কখনোই কারো সাহায্য লাগেনি। যেখানেই আটকে যেতাম সেখানেই কোনো না কোনো উপায় বের করে সমাধান করে নিতাম।
শিক্ষা জীবনের শুধু একটা স্মৃতিই হৃদয়ে দাগ কেটে রেখেছে। অনার্স ভর্তির সময় বাবা তখন কারমাইকেল কলেজ পোস্ট অফিসে। আমি ব্যাংকে ভর্তির টাকা জমা দিয়ে বিভাগের দিকে যাচ্ছিলাম। বাবা সঙ্গে গেলেন। আমি অবশ্য আশা করিনি। কিন্তু সেই পাওয়াটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া হয়ে রইল। বাবাকে পেলাম। সেদিন যে আমার কী রকম আনন্দ হয়েছিল সেই ভাষা প্রকাশের মতো শব্দ আমার ভাণ্ডারে নাই। মনে হচ্ছিল যেন আমি পুরো পৃথিবী পেয়ে গিয়েছিলাম। ঐ একদিনই, তার আগেও না পরেও না। ।
উচ্চ মাধ্যমিকে ফেল করেছিলাম। পরীক্ষা শেষে বাবা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং এর টাকা দিয়েছিলেন । জানি রেজাল্ট ভলো হবে না তাই ও দিকে পা বাড়াইনি। সেই টাকা দিয়ে মোজ মাস্তি করেছি। রেজাল্ট যখন খারাপ হল, বাড়ি যেতে ভয় পাচ্ছিলাম। না জানি বাবা কী পরিমাণ ক্ষেপে আছেন পেলেই টুকরো টুকরো করে ফেলবেন। খুব ভয়ে ভয়ে রাত দশটার দিকে বাড়ি ঢুকলাম। বাড়ির সামনে কলেজ থাকায় রেজাল্ট পেতে সমস্যা হয়নি। বাবা জেনেছিলেন ফেল করেছি। বাড়িতে ঢুকে দেখি মৃত্যুশোক নেমে এসেছে। সবাই খুব মন খারাপ করে বসে আছে। অভাবের সংসারে খুব কষ্ট করে বাবা আমায় পড়ান। আমাকে নিয়ে তাদের কত স্বপ্ন। সেই আমি ফেল করেছি। খুব কষ্ট পেয়েছে সবাই। বাবার সামনে দাড়ানোর সাহস আমার নেই তাই তার সামনে গেলাম না। মা শুধু বললেন খেতে আয়। খেতে ইচ্ছে করছিল না তাও জোর করে খেলাম। আর ভয়ে ভয়ে থাকলাম কখন বাবার বকুনি শুরু হয়। তখনতো আর মার খাবার বয়স ছিল না। তাই একে বকুনি যুগ বলা যায়। কিন্তু এসবের কোনটাই ঘটল না। না মার না বকুনি না অন্য কিছু। পুরো এক বছর কাটলো বকুনি ছাড়াই। আমি অবাক হলাম বাবার এ পরিবর্তন দেখে। পরে বুঝেছি মানুষটা এত বেশি কষ্ট পেয়েছিল যে ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল। আবার পরীক্ষা দিলাম এবং পাশ করলাম। এবার বাবার মুখ খুলল। ঠেলে ঠুলে পাশ করাটা বাবা মেনে নিতে পারলেন না। আমার ভবিস্বৎ নিশ্চিত অন্ধকার তা তিনি টের পেলেন। এবং প্রায় এক বছর পর শুরু হলো বকুনি। সবাই সকালে নাস্তা খায় আর আমি বকুনি খাই। বাবা অফিসে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বকে যেতেন। অনার্সে সুযোগ পাওযার আগ পর্যন্ত চলল এই বকুনি। ভালো বিষয়ে ভর্তি হতে পারলাম না। বাবা মাইগ্রেশন করতে বললেন। তাও করলাম না। বাবা স্থায়ীভাবে হতাশ হলেন।
বাবা সব সময় চেয়েছিলেন আমি যেন মানুষের মতো মানুষ হই। সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি, সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারি। এ জন্য যা কছিু দরকার ছিল তিনি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমি সব সময় চলেছি তার উল্টো পথে। যার ফলে তার সকল চেষ্টা বৃথা গেছে। আমি তার ইচ্ছের মূল্য দিতে পারিনি। তার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারিনি বাবা অনেক কষ্ট করেছেন। আমাদের নিয়ে আপনাকে আর চিন্তা করতে হবে না। এখন থেকে সব চিন্তা আমার। বরং বাবা যখন প্রচণ্ড চাপে চাকরি ছাড়তে চেয়েছেন আমিই বাঁধা দিয়েছি। কারন আমার সংসারের হাল ধরার মতো সামর্থ হয়নি। ফলে বাবাকে শেষ দিন পর্যন্ত চাকরি করেই অবসর নিতে হয়েছে।
রাগী বাবার গল্পতো অনেক হলো। এবার আসি বাবার স্নেহ, মমতা আর ভালোবাসার কথায়। বাবার ভিতরেও একটা নরম মানুষ বাস করে। বাহিরের কঠোরতায় যাকে খুঁজে পাওয়া ভার। আমাকে আমাদেরকে মানুষ করার মহা দায়িত্বে তিনি নরম কোমল সুন্দরভাবে কথা বলা ভুলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আসলেই খুব নরম মানুষ। আমি শতভাগ গ্যারান্টি দিতে পারি বাবাকে দেখে কারও মনে হবে না তিনি এতটা রাগি মানুষ। বরং মনে হবে এতো সহয সরল মায়াবী মানুষ দ্বিতীয়টি নেই। তিনি শুধু নরমই নন খুব ধৈর্যশীলও। প্রচন্ড ঝড়ে আকাশ ভেঙে পড়তে দেখেও তিনি ধৈর্য ধরে আল্লাহর উপর ভরসা করতে পারেন। সংসারের অনটন, অভাবে দুর্যোগে আমি কখনোই তাকে ধৈর্যহীন হতে দেখিনি। খুব একটা সুখের দেখা আমরা পাইনি কখনও। কিন্তু বাবা আমাদের কীভাবে অল্পতে সন্তুষ্ট থাকতে হয় তা শিখিয়েছিলেন। ফলে আমাদের সংসারে শান্তি আছে, খেয়ে পড়ে বাঁচার সন্তুষ্টি আছে।
বাবা আমাকে কত স্নেহ করেন তার পরিচয় পাই যখন রাত করে বাড়ি ফিরি। বন্ধুদের আড্ডায় বা কখনো সাংগঠনিক কাজে মাঝে মাঝে রাত করে বাড়ি ফিরতাম। দেখা যেত দরজার সামনে দাঁড়াতেই মা ভিতর থেকে খুলে দিতেন। সব সময় ভাবতাম মা ই মনে হয় আমার জন্য জেগে জেগে অপেক্ষা করেন। না আমার অসুস্থ মা সব সময় তা পারেন না। রোগে শোকে ভোগা মা মাঝে মাঝেই ঘুমিয়ে পড়েন। আর বেয়ারা, অবাধ্য ছেলের জন্য প্রহরী হয়ে জেগে থাকেন বাবা। এই স্নেহ আবার তিনি বুঝতেও দেন না। মাকেই ডেকে দেন। অনেক পরে মায়ের কাছে জেনেছি আসলে বাবাই আমার জন্য বেশি অপেক্ষা করেন। একবার বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একটা গুরুতর অন্যায় করে ফেলেছিলাম। একেবারে সম্মানহানীকর ঘটনা। নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ হিসেবে বাবার এলাকায় ও অফিসে বেশ সুনাম রয়েছে। তার সেই সম্মানে বড় রকমের আঘাত দিয়ে ফেলেছিলাম। সেই বাবা সব ভুলে আমাকে বাঁচানোর জন্য স্থানীয় মাতব্বরদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। অনেকের অনেক বাঁকা কথা শুনেছেন। তবুও সমস্যা সমাধান করে ছেড়েছেন। এই হলেন আমার বাবা।
বাড়ির সামনেই কলেজ। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা, কবিতা আবৃত্তি করতাম। ছুটির দিন হলে বাবা অপেক্ষা করতেন কখন তার ছেলের কন্ঠ মাইকে ভেষে আসে। বেশি দেরি হলে মা কে বলতেন কই তোমার ছেলে নাকি কবিতা পড়বে, শোনা যায় না কেন। মা শুনে হাসতেন। বাবা অপেক্ষা করতেই থাকতেন। তারপর আমার কবিতা শোনা হলে অন্য কাজে মন দিতেন। এসব আমার কখনোই শোনা বা দেখা হয়নি। তাই বাবার ¯েœহ সম্পর্কে অজ্ঞই ছিলাম। অনেক পরে যখন মায়ের কাছে জেনেছিলাম খুব মায়া হয়েছিল। মনে হয়েছিল বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলি বাবা আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। আমি আর আপনাকে কোন কষ্ট দিব না। কেন জানি পারিনা। পারিনা বাবার সাথে স্বাভাবিক হতে।
অনার্সে পড়ার সময় অনেক বন্ধুর কম্পিউটার ছিলো। বাইকে চরে অনেকে ক্লাসে আসতো। দুটোর প্রতিই আমার খুব দুর্বলতা ছিলো। আবদারের শুরে মাকে বলতাম, বাবা শুনতেন। আমাদের চাষাবাদের জমি নাই। চালের জন্য মানুষের জমি বন্ধক নিয়ে আবাদ করি। একবার সেই জমির টাকা ফেরত দিল। বাবা টাকা দিয়ে বললেন যাও একটা কম্পিউটার নিয়ে এসো। আমার প্রতি বাবার গভীর ভালোবাসা দেখে সেদিন কেঁদেই ফেলেছিলাম । আমার জন্য তার কত চিন্তা। আর একটা জমি বন্ধক না নিলে ভাতের চাল জোগার করা কষ্ট হবে। বাবা সেই চিন্তা বাদ দিয়ে আমাকে কম্পিউটার কিনে দিতে চেয়েছেন। আমার তেমন প্রয়োজন ছিল না। তাই বাবাকে না বলে দিয়েছিলাম। এই হলেন আমার বাবা।
ভালো চাকরি পাইনি এজন্য বাবার চেয়ে আমারই বেশি কষ্ট। বাবার জন্যই। তিনি সব সময় যা চেয়েছেন আমি তার উল্টোটা করেছি। আমার স্বশিক্ষিত বাবা । তার শিক্ষা জীবনের কোন সার্টিফিকেট নেই। কিন্তু তিনি যে পরিমান পড়াশুনা করেন তাতে কয়েকটা বিসিএস অনায়াসেই পেয়ে যেতেন। সেই স্কুল জীবন থেকে দেখে এসেছি বাবার তেমন কোন বন্ধু নেই। খুব প্রয়োজন ছাড়া হাট বাজারেও যান না। অফিস শেষ করেই বাড়ি চলে আসেন। তার অবসর কাটে বই পড়ে । যখনেই সুযোগ পান পড়েন। যেন আল্লাহ কুরআনের প্রথম বাক্য ইকরা শুধু তার জন্যই নাজিল করেছেন। অফিস, নামায, খাওয়া, প্রাকৃতিক কাজ, ঘুম ছাড়া বাকি সময় তিনি বিভিন্ন বই নিয়ে পড়ে থাকেন। ফজর থেকে ইশা, ইশা থেকে ফজর তিনি শুধু পড়েন আর পড়েন। বাবার বেশ সমৃদ্ধ একটা লাইব্রেরি রয়েছে। যেখানে কোরআনের তাফসির হাদিসের বিভিন্ন বই সহ অসংখ্য মুল্যবান বই রয়েছে। জ্ঞান আহরনের তার যে অদম্য আগ্রহ তা যে দেখেনি তাকে বোঝানো যাবে না। আমার দুএকজন বন্ধু বলেন লোকটার কি দুনিয়ার উপর কোনো ইন্টারেস্ট নাই, শুধু পড়েন আর পড়েন। আমি হাসি । বাবার পড়া দেখে দেখে আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। কষ্ট আমার ওই জায়গাতেই। বাবার দশ ভাগের এক ভাগও যদি পড়তাম তাহলেও বিসিএস হয়ে যেত। কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না। বাবার দিকে তাকিয়ে তাই আমার খুব কষ্ট হয়। কেন তার মত হতে পারি না।
আমার প্রতি বাবা কতটা নির্ভর করেন তার নমুনা পেলাম যেদিন তার অফিস থেকে একটা মোটা অংকের টাকা চুরি হয়ে গেল। সেদিন তিনি পাগলের মত বারবার আমাকে ফোন করে টাকা নিয়ে যেতে বলছিলেন। দুএক ঘন্টার মধ্যে এতোগুলো টাকা জোগাড় করা কঠিন ছিলো । আমি চেষ্টা করছিলাম। বাবা আর কোন দিকে চিন্তা না করে বারবার আমাকেই ফোন দিচ্ছিলেন। অথচ তার সাথেই তার এক বড় ভাই চাকরি করতেন। পরে তিনিই আমাকে বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে যেতে বললেন। টাকা জমার পর বাবা জেনেছিলেন সেটি তার বড় ভাই দিয়েছেনে। এই হলেন বাবা। যে দুনিয়াতে শুধু ছেলের উপরেই নির্ভর করতে চায়।
আমার প্রতি বাবার নির্ভরতা আরও বেড়ে গিয়েছে। তিনি এখন অবসরে। কিছু দিন আগে তার পায়ে টিউমার হয়েছিল। আমার জন্যই তার অপারেশন দুসপ্তাহ পিছিয়েছে। অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলাম ছুটি নিতে পারিনি ফলে বাবা সে অবস্থাতেই ছিলেন। ফ্রি হয়ে তার অপারেশন করিয়েছি। অপারেশন পরবর্তি সময়ে সামান্য প্রয়োজনেও আমাকে ডাকতেন। দুএকদিন অভিযোগও করেছেন। বাবা এখন সুস্থ।
বাবা সাধারনত মোবাইলে খুব একটা কথা বলেন না। সপ্তাহের পাঁচ দিন চাকরি সূত্রে বাইরে থাকি। এই পাঁচ দিন প্রয়োজন ছাড়া খবর নেন না। কিন্তু বৃহস্পতিবার এলেই বাবার ফোন পাই, কখন বাড়ি যাব। বাড়ি গিয়ে আসলে বাবার সাথে কোন কথাই হয় না, তাও বৃহস্পতিবার এলেই বাবার ফোন পাই। কখনো কোন কাজে ফিরতে দেরি হলে বার বার ফোন করেন। এখন আমি অনেকটা শুক্রবারের অপেক্ষাতেই থাকি। বাবা কখন কল করবেন। এভাবেই আমার আতঙ্কের শুক্রবার অপেক্ষার শুক্রবারে রুপ নিয়েছে। প্রায় শুক্রবারে ঢাকায় চাকরির কোন না কোন পরীক্ষা থাকে। বৃহস্পতিবার রাতে জার্নি করি। বাবা সারা রাত জেগে থাকেন। রাত দুইটা, তিনটা, চারটায় খবর নেন কতদুর গেলাম, কোন সমস্যা হলো কিনা। আবার ফেরার পথেও বাবা ঘুমান না। আমি হয়তো বাসে ঘুমিয়ে পরি কিন্তু বাবা ঠিকই জেগে জেগে পাহাড়া দেন। আমার পাহারাদার বাবা।
বাবা ইদানীং কোনো সমস্যা হলেই ফোন দেন। যেন শুধু আমিই সব সমস্যার সমাধান করতে পারি। আর কারো দারা সেটা সম্ভব নয়। বাবা যেন দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছেন। যেন আমিই তার বাবা । আগে যেমন আমি তার কাছে সব বিষয়ে আবদার করতাম এখন তিনিও ঠিক তাই করেন। অথচ চিরকাল আমি সব কিছুই তার উপরে চাপিয়ে দিতাম।
আমার প্রচন্ড রাগি বাবা, কঠোর শাসক বাবা, স্নেহের আধার বাবা, প্রহরী বাবা, পরামর্শদাতা বাবা যাকে কখনো বুঝতে চাইনি। সব সময় যার উপর বিরক্ত ছিলাম। সেই বাবাকে আজ বড় বলতে ইচ্ছে করে, বাবা আমার সকল অপরাধ ক্ষমা কর। তোমাকে সত্যি খুব ভালোবাসি বাবা।