মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

সত্য রে লও সহজে 

মুহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহ্

২৭ মে, ২০২৩ , ৯:১২ পূর্বাহ্ণ

পাঠ প্রতিক্রিয়া - সত্য রে লও সহজে 

সাহিত্য চর্চার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আলোচনা এবং সমালোচনা। আমি এসবের কোনটারই যোগ্য নই। তবে একটা দায় অনুভব করি। সেই দায় থেকে কিছু বলব। তবে গভীরে যাব না। 

বর্তমান সময়টা সাহিত্যের জন্য খুব একটা ভালো সময় নয়, তা একটু অনুমান করলেই বুঝতে পারা যায়। যে হারে সংগঠন খোলার পসরা খুলে বসেছেন আমাদের লেখক-অলেখক বন্ধুরা তাতে করে আমার ভয় হয়। আল্লাহ না করুক লেখকরা অভিমান করে কোনদিন বা নিজ নামে সংগঠন খুলে বসেন। যে সময়ে লেখকদের মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকবার কথা ছিলো সে সময়ে তারা অতিরঞ্জিত তোষামোদি, সংগঠনের পদ পদবির উপর লোভ-লালসা, প্রশাসনের পদলেহন করে সরকারি চেক আর প্রাইজবন্ডের জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যা পরবর্তী কয়েক যুগ সাহিত্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। 

শুরুতেই বলেছি আলোচনা সমালোচনার কথা। কিন্তু আসলেই কি হচ্ছে? হচ্ছে না। আমাদের বুদ্ধদেব বসুর মতো সাহিত্য সম্পাদক – সমালোচকের অভাব। তার সম্পাদিত পত্রিকা কবিতায় একটি কবিতা প্রকাশের স্বপ্ন দেখতেন তৎকালীন কবিরা। কারণ তারা জানতেন একটি কবিতা প্রকাশিত হওয়া মানেই কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করা। আল মাহমুদ তাদেরই একজন। তিনি লিখেছেন, ” আমাদের তখনকার আড্ডাটা ছিল বিউটি রেস্তোরাঁ, বাংলাবাজারে। সেখানে গেলে আমার বন্ধু শহীদ কাদরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তিনি আমাকে সদ্য প্রকাশিত কবিতা পত্রিকার চৈত্র সংখ্যাটি হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এই নাও তোমার কবিতা ছাপা হয়েছে। আমি এক ঝটকায় পত্রিকাটি হাতে তুলে নিয়ে দেখে নিলাম। জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসুর পরেই আমার কবিতা ছাপা হয়েছে। আমার তিনটি কবিতা ছাপা হওয়াতে আনন্দে আমার ফেটে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। সেদিন থেকেই আমি ভেবে নিয়েছিলাম আমি কবি হব। কবি ছাড়া আর কিছুই না। এভাবেই বসু আমাদের জীবনে এক মহান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন”।

ঠিক এরকমটাই হওয়া উচিত একজন সাহিত্য সম্পাদকের। অপরদিকে সে-সময়ে রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে এসে সাহিত্য চর্চা করাটা একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জীবনানন্দ দাশ যখন সাহিত্য সমালোচকদের কাছে কোনঠাসা তখন বুদ্ধদেব বসু আবিভূত হলেন ত্রাণকর্তা হিসেবে। বিশিষ্ট জীবনানন্দ দাশ গবেষক ক্লিনটন বি.সিলি বলেছেন, “প্রগতি কেবল জীবনানন্দ দাশের কবিতা ছাপেনি, বুদ্ধদেব নিজে দায়িত্ব নিয়েছিলেন জীবনানন্দের ওপর দুটি সম্পাদকীয় লেখার, যা ছিলো তাঁর ওপর লেখা প্রথম আলোচনা…”। মূলত এর পর থেকেই জীবনানন্দ জীবনানন্দ দাশ হয়ে উঠেন। আর সমকালে জীবনানন্দ দাশকে ছাড়া বাংলা কবিতা কল্পনা করা অসম্ভব।

আমিও সেরকমটা বিশ্বাস করি আর সেই দায়বদ্ধতা থেকে নিজেকে সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত রেখেছি। কিন্তু সংগঠন চর্চার নামে লেখকের ফ্রেমপ্রীতি আর কপি-পেস্ট সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকের সম্পাদনা বিরূপ প্রভাব হিসেবে কাজ করে। কিন্তু আশার কথা সাহিত্যমান ঠিক রেখে সাহিত্য চর্চা করার মতো অনেকেই রয়েছেন। মুগ্ধতা ডট কম এদেরই একজন। ভালো কিছু করার চেষ্টা তাদেরকে সবসময় তাগাদা দেয়। ‘শনিবারের চিঠি’ আয়োজন তারই বহিঃপ্রকাশ। 

কবিতা: শুরুতে যেমনটা বলেছিলাম। একজন কবির সবচেয়ে বড় গুণ হলো নিরীক্ষা করা। লেখালেখি যদি নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে না আসে তাহলে লেখাটা বেশিদিন টিকবে না। আমি কী লিখব আর কীভাবে লিখব এটা বুঝতে হবে।  একজন কবির জন্য এটা সুবিধা কারণ লিখতে বসার চেয়ে লেখা ধরা দেওয়ার বিষয়টা লক্ষ্য করা যায় বেশি। এখন লেখাকে আপনি কোন ফরম্যাট এ লিখবেন সেটা আপনাকে ভাবতে হবে। আপনি যদি ছড়া ছন্দ মিলিয়ে, অন্তমিল ঠিক রেখে লিখতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে ছন্দের মাত্রা, পর্ব এর সঠিক ব্যবহার করতে হবে এবং নির্ভুল অন্তমিল দিয়ে লিখতে হবে। কারণ পাঠক যখন পড়বে তখন তার কানে বাজবে লেখাগুলো। আর যিনি ছন্দটা বোঝেন তিনি পুরোটা পড়তে চাইলেও পারবেন না। এদিকে অনেকেই ভাবেন গদ্যকবিতায় কোনো ছন্দ নেই। তাদের কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলি, ছন্দ ছাড়া আমাদের জীবনে অবশিষ্ট কিছুই নেই। আমরা যে রিক্সা বা অটোয় করে যাতায়াত করি। সেই রিক্সার তিনটা চাকা যদি ছন্দ না মেনে আসত তাহলে রিক্সা মাঝরাস্তায় তার গতি বিচ্যুতি হয়ে যেত। সামনের চাকা যে বেগে চলবে পিছনের দুটি চাকাও নির্দিষ্ট একটা গতি মেনে চলবে। এই শিক্ষা আমাদের পদার্থবিজ্ঞানও দিয়েছে। আমরা সিঁড়িতে ওঠার সময় যদি দু’পায়ের ছন্দ না মিলে উঠি তাহলে পা পিছলে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তেমনিভাবেই কবিতা পড়ার সময় আমরা যদি বিচ্যুত হয়ে যাই তাহলে কবিতাটা পড়তে পারবো না এবং হৃদয়গ্রাহী হবে না। গদ্য কবিতা নিজেই  আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে। আর ছন্দের বাইরে কবিতার যে রস, অলংকার, স্যাটায়ায়, উপমা আছে এগুলো কবিতাকে পরিপূর্ণ করে তুলবে৷ আর ছড়ায় কখনো কঠিন শব্দ, যৌগিক শব্দ ব্যবহার হবে না। ছড়ার শব্দ হবে কোমল এবং নমনীয়।  তুলো ছুঁয়ে দেখলে বা কাশফুল শরীরে স্পর্শ করলে যেমন অনুভূতি হয়, ছড়াও সেরকম অনুভূতি দিবে পাঠককে। সেজন্য ছড়া খুব সহজেই আমরা মনে রাখতে পারি। 

আমাদের আর হলোই না গান শোনা শিরোনামে রওশন রুবী’র কবিতাটি সুন্দর সুন্দর উপমায় নির্মিত। রওশন রুবীর কবিতাযাপন অনেক দিনের। তার কবিতা ভালো লেগেছে আমার। কেউ নেই কেউই শিরোনামে অনন্যা জান্নাতের এরকম কবিতা প্রায়শই চোখের সামনে আসে। কবিতায় যে অনুভূতির প্রকাশ তুলে ধরেছেন তা আমাদের পরিচিত। এতটাই পরিচিত যে একবার পড়ার পর পাঠক মনে কোনো অনুভূতি সৃষ্টি হয় না। সম্পাদক চাইলে এর থেকেও ভালো কবিতা প্রকাশ করতে পারতেন। সরকার বাবলু তার কুল ভাঙা তরী কবিতাটি পড়ে আরাম পেলাম। সরকার বাবলুর কবিতা নিয়মিত পড়ি। তিনি তার লেখার মধ্যে নতুনত্ব কিছু নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। ছন্দ নিয়ে তার পড়াশোনা তাকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করবে। ছিন্ন হলো আশা, সকল ভালোবাসা শিরোনামে জয়িতা নাসরিন নাজ কবিতাটি যদিও কবিতার অংশে প্রকাশ পেয়েছে কিন্তু কোথাও ৮+৬, কোথাও ৮+৫ এর ব্যবহার আর অন্তমিল এর কারণে এটি ছড়া অংশে প্রকাশ করা যেত। ভালোই লাগছিলো কিন্তু ছেড়েছেন আর ছিঁড়েছে শব্দ গুলো ঝামেলা করছে। ছন্দের পাশাপাশি শব্দের ব্যবহারে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সেই সাথে শব্দ যত কোমল হবে ছড়া তত মসৃণ হবে। এজন্য চাই প্রচুর পড়াশোনা। আর লেখা শেষে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া। জৈষ্ঠ্যের বৃষ্টি শিরোনামে সাজিয়া ইসলাম দিবা কবিতাটি এই সংখ্যার সবচেয়ে দুর্বল লেখা। কবিতাটি প্রকাশের মাধ্যমে দুটি দিক উন্মোচিত হয়। একটি দিক নিয়ে যায় নতুন লেখকদের সুযোগ দিয়ে উৎসাহ প্রদান। আরেকটি দিক নিয়ে যায় একটি পত্রিকা বা লিটলম্যাগ এর ভাবমূর্তি। যারা ভালো লিখেন বা ভালো লেখার চেষ্টা করেন তারা এই কবিতাটি পড়ার পর লেখা পাঠাতে অনুৎসাহিত হবেন। পত্র পত্রিকায় এমন অনেক কবিতা প্রকাশিত হয় যা সম্পাদকের দুর্বলতা প্রকাশ করে। সম্পাদককে হতে হবে একরোখা, নির্দিষ্ট গন্ডির বাইরে লেখা প্রকাশের মানসিকতা এবং নতুন লেখকদের সুযোগ। অবশ্যই যারা ভালো লিখেন। যে লেখক পরা এবং পড়া এর ব্যবহার জানেন না তার আরও বেশী পড়াশোনা করা উচিত। লেখা প্রকাশের আনন্দ যেন মলিন না করে দেয় তার ভুলভাল লেখা। 

ছড়া: তিনটি ছড়ায় সাজানো এই অংশটি। গরম নিয়ে দুইটি ছড়া। সমসাময়িক বিষয়কে ধারণ করে লেখা। গরম শিরোনাম এ নবীর হোসেনের ছড়ার প্রথম চার লাইনে গা এর সাথে না মেলানো অদ্ভুত লেগেছে। অনেকটা জোরপূর্বক ধর্ষণের মতো। আসবি ফিরে শিরোনামে শ্যামলী বিনতে আমজাদ এর ছড়াটি ভালো লেগেছে। সুন্দর দৃশ্যপট সুন্দর শব্দ চয়নে তুলে এনেছেন। তবে পড়ার সময় বারবার আনিসুল হক এর তুই কি আমার দুঃখ হবি কবিতাটি কানে বাজছিল।  

গল্প: শৈশবে রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের সংজ্ঞা পড়েছিলাম। এরপর সুযোগ হয়েছে অনুগল্প, পরমাণু গল্প, ১০০ শব্দের গল্প। সম্ভবত আরও রয়েছে। কথা সেটা নয়। কথা হচ্ছে গল্পকে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোতে ফেলতে গিয়ে গল্পের যে মেজাজ থাকবার কথা ছিলো সেটা হারিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা যায়। যা ছোট গল্পের জন্য ক্ষতিকর। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের ছোটগল্প সাহিত্যের সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো যে ছোটগল্প থেকে নাটক, চলচ্চিত্র তৈরি হতো। এখন সেসব উধাও। গল্পের যেমন অভাব তেমনি নাট্যকারেরও। শতকরা ১০০ জনের মধ্যে ৯০ জন লিখছেন কবিতা। ৫ জন ছড়া, ৩ জন গল্প, ২ জন উপন্যাস। ঐ ৯০ জনের মধ্যে আছে সবগুলো প্যাকেজ। মানে তাদের অনেকেই সবগুলো জায়গায় বিচরণ করছেন।

ছায়া রোদ শিরোনামে পড়েছি কামরুন নাহার রেণুর গল্প। স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা গল্পটিকে রাঙিয়ে তুলেছে। গল্পকারকে আলাদা করে বলতে হয়নি কিছু। চরিত্রগুলো এমন সুনিপুন ভাবে ফুটিয়ে তুলছেন যেন দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভাসছে। অসুস্থ স্বামীর প্রতি ভালোবাসা গল্পটাকে পাঠক মনে জায়গা করে নিবে বলে আমার বিশ্বাস।

আসহাদুজ্জান মিলন রচিত ‘এবং গল্পটি’ আকৃতি ছোট হলেও তিনি একটি বিষয়কে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। একজন পুরুষের হাঁটার গতি কিভাবে তার জীবনে প্রভাব ফেলে সেটি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। একজন দ্রুত গতিতে হাঁটা পুরুষের বিবাহপূর্ব জীবন এবং বিবাহের পরের জীবনের বৈচিত্র্য তুলে ধরতে চেয়েছেন। কিন্তু হাঁটার গতির মতো ঠুনকো বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি এই গল্পটিতে। বরং গল্পকারকে ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে। অথচ গল্পের কাহিনী, প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসতে পারত চরিত্রের দ্বন্দ্বের ফলাফল। 

এছাড়াও নন ফিকশন, নির্বাচিত স্টাটাস, নির্বাচিত ছবি ও চিরায়ত পাঠ এর মতো কিছু ভিন্নধর্মী অংশ রয়েছে যা শনিবারের চিঠি বিশেষ আয়োজনটিকে সমৃদ্ধ করেছে। 

মুগ্ধতা ডট কম এর জন্য শুভকামনা সবসময়। আশা করছি তারা এমন একটি ওয়েব ম্যাগ হিসেবে নিজেদেরকে পরিচিতি দেবে যেখানে লেখকরা লেখা প্রকাশের অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে আসবে। আর মানদণ্ড এমন হবে যেন লেখক লেখা প্রকাশ হওয়াকে স্বীকৃতি হিসেবে মেনে নিবে। 

– মুহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহ্

  কবি, সম্পাদক 

  তারুণ্যের পদাবলি

মুহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহ্
Latest posts by মুহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহ্ (see all)