মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

সমান্তরাল

লিপিকা লিপি

১৯ আগস্ট, ২০২৩ , ১:১০ অপরাহ্ণ

পাশাপাশি চেয়ারে বসে অনেক পথ অতিক্রম করার পর অনিক জিজ্ঞেস করে, কোথায় নামবেন?
মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে মুনা জবাব দিয়ে সৌজন্যতা রক্ষার্থে বলে, চকলেট খাবেন?

: না।

: আমার কাছে অনেক খাবার রয়েছে। আপনি চাইলেই খেতে পারেন, দূরের পথ। জানাবেন।
ধন্যবাদের সুরে অনিক উৎসুক মন নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। মৃদু আলোয় সাদা ড্রেসে মুনাকে পরির মতো লাগছে। চুলগুলো এলোমেলো হলেও মন্দ লাগছে না। বকবক করা মুনা তার সম্পর্কে বলেই যাচ্ছে। কোনো প্রশ্ন করা ছাড়াই অনিক বিস্তারিত জানতে পারে মুনা সম্পর্কে। দুজনই ভাবতে থাকে, এত অল্প সময়ে দুজন মানুষ এতটা ঘনিষ্টতা অনুভব করে কী করে!

কিছুদূর যেতেই মুনার প্রশ্নের জবাবে অনিক জানিয়ে দেয় এখনও বিয়ে করেনি। অবিবাহিত মুনা কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে বসে পথ পাড়ি দেয় যেন স্পর্শ তো বাকি থাক!

চুলে হাত বুলিয়ে বুকের মাঝে মাথা রেখে পথ চলুক, এমন ভাবনা যে মুনা ভাবেনি তা কিন্তু নয়। সুযোগ এসেও মুনা তা গ্রহণ করেনি। কখনও চোখ মেলে দেখে স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে ট্রেন। বাদাম চাই, চকলেট চাই কিংবা চা-কফি যে শব্দই কানে আসুক আজ বিরক্ত লাগছে না। ঝিকঝিক শব্দে চলতে শুরু করছে ট্রেন। রাতের আঁধারে বাইরের সবকিছু স্পষ্ট নয়। তবুও উঁকি দিয়ে খানিক দেখার বাহানা। রাস্তার ধারে মাঝেমধ্যে লাইটের আলো ট্রেনে প্রবেশ করতে না পারলেও চাঁদের আলো যেন কাঁচের জানালা ভেদ করে আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। কখনও কখনও পাতায় আলোর নাচন আমাকে জাগিয়ে রাখছে। চাঁদ- রাত আর পাতার মিলন আমার ভীষণ পছন্দ। এ নিয়ে আমি নিজের মনেই লিখে যাই কোনো কাব্য।

বাকি কিছুটা পথ চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছিল মুনা। কিন্তু সে ঘুম অল্পই।

-উঠে পড়–ন মুনা! কিছুক্ষণ পরেই আমরা আমাদের কাঙ্খিত স্টেশনে নামব। প্রস্তুত হয়ে নিন।

চোখ খুলে মুনা দেখতে পায় অন্ধকার তখনও কাটেনি। লোকজন প্রস্তুত হচ্ছে নেমে যাবার। স্টেশনে সকালের অপেক্ষা করার মনোভাব নিয়েই নেমে যায় আর ভাবে, নিজের এলাকায় অনিককে একটি সুন্দর সকাল উপহার দিতে পারব। আশেপাশের হৈচৈ শব্দে মুনার জীবনে যেন নতুন সূর্যের উদয় হবে আজ। অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করে তার মনে। এর আগে মুনা কত সকাল উপভোগ করেছে। কই, এমন তো লাগেনি! আজ কেন তবে মুনা সূর্যের রশ্মিকে এত কাছ থেকে অনুভবের অপেক্ষা করছে?

হাতের আঙুলে গোনা কয়েক সেকেন্ড পরেই কথা ভেসে আসে, ‘‘ভালো থাকবেন, আসি।’’

মানুষের মনটাকে বাইরে থেকে দেখা যায় না ঠিকই। কিন্তু অনুভব ও অনুভূতি কতটা প্রখর হলে চকচকে আকাশ কিংবা ভোরের নির্জনতা বুঝতে পেরেছিল..মুনার মনে কি নাড়া দিয়ে গেল। সাত-আট ঘন্টা পাশাপাশি বসে, আন্তরিকতা মেশানো আলাপন শেষে কীভাবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অনিক অন্ধকারে মিশে গেল তা ভাবতেই সে হারিয়ে যায় স্টেশনের অন্ধকারে। ট্রেনের জ্বলজ্বলে আলোয় এত যতœ করা অনিক কীভাবে স্টেশনের অন্ধকারে তাকে রেখে চলে গেল তা ভাবতেই প্রকৃতির সকাল, সূর্য, পাখি কিছুই আর আটকায় না মুনার চোখে।

এরপর সময়ের নিয়মে কেটে যেতে থাকে সময়গুলো।

কয়েকবার মুছে দিতে চেয়েও মুছতে পারেনি অনিকের মোবাইল নম্বর। দিন-মাস অতিক্রম করা মুনা বুঝতে পারে না কীভাবে তার জীবনে কয়েক ঘন্টার জন্য প্রেম এসে উড়ে চলে গেল।

নিজেকে ব্যস্ততায় ডুবিয়ে রেখে প্রেম ভুলতে যাওয়া মুনা হঠাৎ বার্তায় দেখতে পায়, ‘‘কেমন আছ।’’

নিজেকে সামলে রাখা বড় কঠিন। অনিকের ডাকে সাড়া দিতেই নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে সে। যে প্রেম হারিয়ে যেতে বসেছিল, একটু একটু করে দুজনার মাঝে সেই প্রেম আবার গাঢ় হতে লাগল। কখনও লুকিয়ে লুকিয়ে হাত ধরে ফুচকার দোকানে পরস্পর কাছে এসেছে বহুবার। ছোট নদী, ঢেউ, উড়ে যাওয়া মেঘের কাছে মুনা ঋণী থাকার কথা ভুলতে পারে না। সবুজ দুর্বা ঘাসে পাশাপাশি ছুঁয়ে থাকা দুজন গোধূলির পাখিদের কিচিকিচি শব্দে জেগে ওঠে। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্নে কদিন পরপরেই অনিকের আসার প্রহর গোনে।

‘‘মুনা, আমি তোমাকে ভালোবাসি’’.. কথাটি বলেই প্রতিবারেই বুকে জড়িয়ে মুনার কপালে চুমু দেয় আর বলে, ‘‘আমাকে যেতে হবে দূর দেশে। কিছুটা আর্থিক স্বচ্ছলতায় ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে ঘর বাঁধব।’’
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মুনা কাঁদে আর ভাবে, মুনাকে সাথে নেওয়ার প্রতিজ্ঞায় অনিক কতই না দিন পার করে ফেলল।
একদিন ফিরে আসবে অনিক। নতুন ভোর দেখবে মুনা।

নিয়মমতো প্রকৃতিতে ভোর হয়। দিন শেষে আসে রাত্রি। কিন্তু মুনার জীবনে আসে না আর কোনো বার্তা।
প্রেমের টানে স্টেশনে স্টেশনে ঘুরে বেড়ায় সে। কত ট্রেন আসে আর যায়। হুইসেল শুনতে পেলেই ছুটে যায় ট্রেনের কাছে। মলিন মুখে ফিরে আসে।

এদিক সেদিক খুঁজে ফিরে রেল লাইনের ধারেই প্রহর গুনতে গুনতে আজ বড্ড ক্লান্ত শরীর। প্রাণহীন। পুলিশ সনাক্তকরণ শেষে মুনাকে স্বজনদের হাতে দিয়ে আসে। হাতের মুঠোয় পাওয়া যায় একটি কাগজের টুকরো। লেখা ছিল,‘‘প্রেম সমান্তরাল।’’

২৪ অক্টোবর, ২০২২