সারাদিন চলে গেল… সারাটা দিন। আজ আমার খুব উচাটন লেগেছে দিনভর। সারাদিন নেট ঘেঁটে ঘেঁটে তাঁর অনেক কবিতা পড়লাম—এক শবার পড়া কবিতা, তবুও পড়লাম, ‘কবিতাতো মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার….’ এসব পড়তে পড়তে কত স্মৃতি মনে পড়ল! ফিরে দেখলাম, নিজের জীবনকে।
এই একটি মানুষ—আল মাহমুদ—বাংলা ভাষার এই একজন কবি—প্রথমবার যাঁর মুখোমুখি হয়ে আক্ষরিক অর্থেই আমি কেঁপে উঠেছিলাম। বারবার আমার মনে হয়েছিল, আমি কবি আল মাহমুদের সামনে বসে আছি, আল মাহমুদ!
কেন জানি না, সবসময় আমি তাঁর মতো হতে চেয়েছি। তাঁর কবিতা আমাকে আক্রান্ত করার ফলেই হয়তো। অথবা এমনও হতে পারে, মফস্বল থেকে ঢাকায় এসে তিনি যেভাবে যুদ্ধ করেছেন, বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সেসব পড়ে আমি ভেবেছি, আমিও তো মফস্বলের, আমাকেও এভাবে যুদ্ধ করতে হবে। ঢাকায় যেতে হবে। কারণ, আমি তো কবিই হতে চাই। একজন মফস্বলবাসী কবির অনুপ্রেরণা হিসেবে সে সময় আল মাহমুদই ছিলেন আমার একমাত্র ‘আইডল’।
এসএসসি পাশ করার পর কবিতা যখন আমাকে পুরোপুরি উন্মাদ করে দিয়েছে, তখন হঠাৎ মনে হলো, আরে, এত বিদ্যাশিক্ষা করে কী হবে! আল মাহমুদ ক্লাস এইট অব্দি লেখাপড়া করেছেন, সেই তুলনায় আমি তো দুই ক্লাশ বেশি পড়ে ফেলেছি। এমন ভাবনা থেকে একাডেমিক লেখাপড়ার পাট সিঁকেয় উঠল আমার এবং আমি ঘরছাড়া হয়ে গেলাম। যদিও আজ বুঝতে পারি, কত ছেলেমানুষী ছিল এসবের ভেতরে।
তখন আমার মনে হত, আল মাহমুদ স্কুলজীবনে যেভাবে কলকাতায় চলে দিয়েছিলেন (পড়ুন: ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’) আমিও চলে যাব সেভাবে। ঘর ছেড়ে বেরিয়েও পড়েছিলাম—ঝিনাইদহ থেকে প্রথমে ফরিদপুর তারপর ঢাকা—সেসব দিনই ছিল বটে।
নানা কাজের সূত্রে অনেকবার গিয়েছি মাহমুদ ভাইয়ের বাসায়। মনে আছে, ২০১৩ সালের Fatema Abedin Nazla কে নিয়ে মাহমুদ ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিলাম। তখন আমাদের মধ্যে কেবল বন্ধুত্বই ছিল, অন্য কিছু নয়। তো, ঘণ্টাখানেক কথাবার্তা শেষে কবি আমাদের বললেন, ‘তোমরা দুজন দুজনকে পছন্দ কর, না?’
নাজলার কথা জানি না। তবে আমি বেশ লজ্জা পেয়েছিলাম তাঁর এ কথায়; এবং এ কথা অস্বীকার করব না, তখনই আমার প্রথম মনে হয়েছিল, নাজলাকে কি আমি পছন্দ করি… নিজের কাছে নিজের উত্তর ছিল: করি হয়তো।
নাজলার সঙ্গে ভাবনাচিন্তায় আমার অনেক অমিল। কিন্তু প্রথম থেকে একটা জায়গাতেই মিল ছিল—সেটা হলো আল মাহমুদ। সে আল মাহমুদে অবসেসড, আমিও।
এই কবির অজস্র কবিতা—‘সোনালি কাবিন,’ ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’, ‘বাতাসের ফেনা’, ‘ফররুখের কবরে কালো শেয়াল’, কবিতা তো এমন’… এসব পড়লে আমি আমার আম্মাকে দেখতে পাই, আমার ফেলে আসা বাড়িঘর দেখতে পাই, আমার মফস্বলকে দেখতে পাই; সব মিলিয়ে বাংলাদেশকেই দেখতে পাই।
মাহমুদ ভাইকে আমার ‘আলাদিনের গ্রামে’ সনেটগুচ্ছের কয়েকটি সনেট শোনাতে পেরেছিলাম। তখন তিনি চোখে একেবারেই দেখেন না। তাই শোনাতে বললেন। পড়লাম। আবারও পড়তে বললেন। পুনরায় পড়লাম। পড়া শেষে দেখি, তাঁর চোখে পানি। আমাকে শুধু বললেন, ‘ছন্দে তোমার হাত ভালো। তোমার কবিতায় বাংলাদেশ আছে।’
বিনীতভাবে বলি, আমার কবিতার প্রশংসা বিভিন্ন সময়ে কেউ কেউ করেছেন। তবে সেই ২০১২ সালে আল মাহমুদ আমার কবিতা নিয়ে যা বলেছিলেন এবং তাতে আমি যতটা খুশি হয়েছিলাম, নানা পুরস্কার পেয়েও এত আনন্দিত হতে পারিনি।
হ্যাঁ, পারি–না–পারি, হোক–না–হোক, সব সময় আমি বাংলাদেশের কবিতাই লিখতে চেয়েছি।
তাই আজ সকাল থেকেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে গুগল করে করে আল মাহমুদের কবিতা পড়ছি। একেকটা কবিতা পড়ছি আর পেছনের স্মৃতিরা ঘিরে ধরছে! সবাই দেখছে, আমি অফিসের কাচঘেরা ঘরে বসে আছি, কিন্তু আমি জানি, ততক্ষণে আমি চলে গেছি ঝিনাইদহের সিটি কলেজ মাঠে অথবা পোড়াদাহ রেলস্টেশনে, কখনোবা শশ্মান ঘাটে। ফরিদপুরের আলিপুরেও কি বসে ছিলাম না?
এখনো যখন ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ কবিতাটা পড়ি, এবং ওই জায়গাটি পড়ি, ‘আসার সময় আব্বা তাড়া দিয়েছিলেন, গোছাতে গোছাতেই
তোর সময় বয়ে যাবে, তুই আবার গাড়ি পাবি।/ আম্মা বলেছিলেন, আজ রাত না হয় বই নিয়েই বসে থাক,/কত রাত তো অমনি থাকিস।’, লাইনগুলো পড়ি আর আম্মাকে মনে পড়ে আমার।
এখনো যখন বাড়ি থেকে ফিরে আসি, তার আগের দিন, আম্মা আমাকে বলেন, আরেকটা দিন থেকে যা, বই–টই পড়।’
ফলে আল মাহমুদের কবিতা পড়লে আমি যেন আমার কাছে, নিজের জীবনেই কাছেই ফিরি।
বড় কবিদের কবিতা পড়লে এমন হয়। মনটা কেন জানি উচাটন হয়ে ওঠে।
শুভ জন্মদিন, মাহমুদ ভাই। শুভ জন্মদিন আমার কবি!
আপনাকে দেখতে কোনো একদিন ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় যাব চুপিচুপি।
তবে ঢাকার ফেরার সময় কি আর ট্রেন মিস করতে পারব, করা হবে?—হা জীবন!
পড়ুন আল মাহমুদের ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ কবিতাটি। তাঁর সামনে এই কবিতাটি পড়লে মাহমুদ ভাই হাউ হাউ করে কাঁদতেন।
______________________________
শেষ ট্রেন ধরবো বলে এক রকম ছুটতে ছুটতে ষ্টেশনে পৌঁছে দেখি
নীলবর্ণ আলোর সংকেত। হতাশার মতোন হঠাৎ
দারুণ হুইসেল দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।
যাদের সাথে শহরে যাবার কথা ছিল তাদের উৎকণ্ঠিত মুখ
জানালায় উবুড় হয়ে আমাকে দেখছে। হাত নেড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
.
আসার সময় আব্বা তাড়া দিয়েছিলেন, গোছাতে গোছাতেই
তোর সময় বয়ে যাবে, তুই আবার গাড়ি পাবি।
আম্মা বলেছিলেন, আজ রাত না হয় বই নিয়েই বসে থাক,
কত রাত তো অমনি থাকিস।
আমার ঘুম পেলো। এক নিঃস্বপ্ন নিদ্রায় আমি নিহত হয়ে থাকলাম।
.
অথচ জাহানারা কোনদিন ট্রেন ফেল করে না। ফরহাদ
আধ ঘণ্টা আগেই ষ্টেশনে পৌঁছে যায়। লাইলী
মালপত্র তুলে দিয়ে আগেই চাকরকে টিকিট কিনতে পাঠায়।
নাহার কোথাও যাওয়ার কথা থাকলে আনন্দে ভাত পর্যন্ত খেতে পারে না।
আর আমি এদের ভাই
সাত মাইল হেঁটে এসে শেষ রাতের গাড়ি হারিয়ে
এক অখ্যাত ষ্টেশনে কুয়াশায় কাঁপছি।
কুয়াশার সাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে ফিরবো।
শিশিরে আমার পাজামা ভিজে যাবে। চোখের পাতায়
শীতের বিন্দু জমতে জমতে নির্লজ্জের মতোন হঠাৎ
লাল সূর্য উঠে আসবে। পরাজিতের মতো আমার মুখের ওপর রোদ
নামলে, সামনে দেখবো পরিচিত নদী। ছড়ানো ছিটানো
ঘরবাড়ি, গ্রাম। জলার দিকে বকের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। তারপর
দারুণ ভয়ের মতো ভেসে উঠবে আমাদের আটচালা।
কলার ছোট বাগান।
.
দীর্ঘ পাতাগুলো না না করে কাঁপছে। বৈঠকখানা থেকে আব্বা
একবার আমাকে দেখে নিয়ে মুখ নিচু করে পড়তে থাকবেন,
ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান…।
বাসি বাসন হাতে আম্মা আমাকে দেখে হেসে ফেলবেন।
ভালোই হলো তোর ফিরে আসা। তুই না থাকলে
ঘরবাড়ি একেবারে কেমন শূন্য হয়ে যায়। হাত মুখ
ধুয়ে আয়। নাস্তা পাঠাই।
আর আমি মাকে জড়িয়ে ধরে আমার প্রত্যাবর্তনের লজ্জাকে
ঘষে ঘষে
তুলে ফেলবো।
আল মাহমুদের ছবি: নাসির আলী মামুন