এতদিন পর নানিরে কেন দেখব? নানি মারা যাবার তাও তো প্রায় দশ বছর হতে চলল। এমনও না যে তাকে প্রায়শই মনে করি। ইদানীং মনেও পড়ে না তাকে। যদিও আমার ছেলেবেলা, এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনার সময়টা কেটেছে নানিবাড়িতেই। তারপরও কেন জানি তাকে মনে পড়ে না। আজ তবে কেন সে দেখা দিলো? বিষয়টা তবে খুলেই বলি। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর একটু ঘুমানো আমার ছোটবেলার অভ্যাস। নিয়ম করে বিছানায় শুয়ে মোবাইল টিপতে টিপতে চোখ সরু হয়ে আসার পর মোবাইল রাখার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম যথারীতি। তীব্র গরম পড়েছে এবার। মাথার কাছের পশ্চিমের জানালা দিয়ে গরম বাতাস ঢুকছে আর সেই বাতাসকে সারা রুমে ছড়িয়ে দিচ্ছে মাথার উপরের ফ্যান, সাথে ঘটঘট শব্দ। ঘুম ভেঙে চোখ মেলে দেখি নানি বসে আছে টুলে। টুলটা আয়নার পাশে। শুয়ে থেকে দেখছি আর বোঝার চেষ্টা করছি। ঘর অন্ধকার। তারপরও আমি স্পষ্ট দেখছি নানিকে। আমি বুঝতে পারছি আমি ঘুমে নাই এবং নানি মারা গেছে দশ বছর আগে। তারপরও নড়তে ইচ্ছে করছে না। ঝিম মেরে আছি, দেখি নানি কিছু বলে কি না? আবার নড়লে নানি যদি গায়েব হয়ে যায়! কয়েক সেকেন্ড পর চোখ বড়বড় করে দেখি নানি নাই। নাই মানে নাই। লাল টুলটা ঠিক আয়নার পাশেই। সবকিছু ঠিকঠাক। উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। ঘরের আলো জ্বালিয়ে ডাইনিং স্পেসে আসলাম। মাগরিবের নামাজের ওয়াক্ত শেষ। চুলায় এক কাপ চায়ের পানি চড়িয়ে চোখে মুখে পানি দিলাম। ভাবতে বসলাম। নানি কেন এসেছে? তিনি কি কিছু বলতে চান? আমার সাথে তার কী কথা? কথাটা মাথায় ঢুকে গেল। সারারাত ছটফট করলাম। মাঝেমাঝেই লাল টুলটার দিকে তাকিয়ে দেখি নানি আসলো কি না। অফিসে বসেও ভাবি বিষয়টা নিয়ে। বৌ সোমাকে বলে লাভ নাই। সে বিশ্বাস করবে না। আমার উপরই দোষ চাপিয়ে দিবে। বলবে,সারাদিন মোবাইলে হরর মুভি দেখ,তোমার তো এই দশা হবেই। গত কয়েকদিন কাশি হচ্ছিল, বলল তোমার তো কাশি হবেই, নদীতে গোসল করো, মাছ মারতে যাও। মানে যা কিছুই ঘটুক আমিই দায়ী। বন্ধু আলমকে বলা যায়। সে আবার সবকিছুকেই সিরিয়াসলি নেয়। যেমন গত বছর আমি বলছিলাম ছাতু খাই না অনেকদিন। ছেলেবেলায় দাদি ছাতু মাখায় দিত সে কি মজা! পরের সপ্তাহেই সে ছাতু নিয়ে হাজির। সে নাকি অনলাইনে দেখেছে,ছাতু বিক্রি হয়। সে ছাতু খেতে মোটেই ভালো না। ভুসভুসা ভুষির মতো শুধু গন্ধটা ছাড়া। ছাতুতে হরলিক্সের গন্ধ। আলমকে বলব বলে অফিসের পর সোজা চলে গেলাম লালবাগ। লালবাগ সন্ধ্যার পর বেশ জমে ওঠে। কলেজের ছেলেমেয়েরা আড্ডা দেয়। কে যেন বলেছে যত বড় বিশ্ববিদ্যালয় তত কম পড়া। এদের দেখে তাই মনে হয়। আনন্দ নিয়ে পড়া। রবীন্দ্রনাথ তো তাই চেয়েছিলেন। ছেলেমেয়েরা প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে পড়বে। হাতের বামে কাদেরের দোকানে এসে এক কাপ লাল চা আর একটা সিগারেটের অর্ডার করলাম। আলম ফোন করেছিল, সে পৌরবাজার জ্যামে আটকা পড়েছে। আমি আবারও ভাবতে বসলাম নানি কেন এসেছিল? কোনো কথা কি বাকি ছিলো যা বলা হয়নি? আর আমিও বা কেন এ বিষয়টা নিয়ে ভাবছি। কত কিছু নিয়ে ভাবার বিষয় আছে। গত কয়েকদিন ধরে অফিসের বস চাপে রেখেছে। হুদাই রুমে ডেকে নিয়ে বিভিন্ন হুমকি ধামকি দেয়। যেমন সেদিন বলল,অফিসের স্যালারি সিটটা সেই আদিকালের, সেটাই আপনি চালিয়ে যাচ্ছেন, নতুন কিছু করেন। খোঁজ খবর নেন বিভিন্ন কোম্পানির ওরা কেমন করে করে। আমি চুপ করেই ছিলাম। খোঁজ নেবার কী আছে? একই তো সব, এক্সেল শিটে ডাটা বসাও। আর আধুনিক সফটওয়্যার কিনতে টাকা লাগবে। নতুন সফটওয়্যারের খোঁজ নিয়ে বলতে গেলাম, বলল এই একটা হুদাই স্যালারি শিটের জন্য আপনি আমারে বিশ হাজার টাকা খরচ করতে বলছেন? আশ্চর্য! তাহলে আপনাকে একাউন্ট পোস্টে রাখছি কেন? নিজে একটা তৈরি করুন। মুর্খের সাথেও তর্ক করা যায় কিন্তু টাকাওয়ালা মুর্খের সাথে তর্ক চলে না। আমি মুখ বুজে থাকি। বৌ সোমাও ইদানীং যন্ত্রণা শুরু করেছে। কোথা থেকে সে শুনেছে অনলাইনে কাপড়ের ব্যবসা করে একেকজন লাখের বাতি জ্বালাইছে তাই তাকেও লাখের বাতি জ্বালাতে হবে। সে জন্য সে আমাকে জ্বালাতে শুরু করেছে লাখের বাতি না জ্বালিয়ে। শুরু করেছে ঘ্যানঘ্যানানি, কাপড় কিনে দাও, ওয়াইফাই লাগাও, ভালো ভিডিও ক্যামেরা কিনে দাও। মাথা জ্যাম হয়ে যায় বাসায় এলে।
কাদেরের দোকানে আসলে আলগা খাতির করে। সেই ছাত্রকাল থেকে দেখে আসছি। রাজনীতি করতাম, ক্যাম্পাসে দাপটের সাথে চলতাম। আড্ডা জমে উঠতো সন্ধ্যার পর কাদেরের এই দোকানেই। আজ তার মনে হয় মন খারাপ। একজন জুটিরে চা দিচ্ছে, চায়ে চিনি দুই চামুচ দিলো একটা কাপে। আমি চোখ সরু করে দেখতেছি কারে দেয়। ছেলেটাকে নাকি মেয়েটাকে? ছেলেটার হাতে দিলো। হতাশ হলাম আমি শিওর ছেলেটা টের পাবে না। কাশির সিরাপ খাওয়া পোলাপান চা খায় মিষ্টি দিয়ে, এই দুই চামুচ চিনি সে টেরই পাবে না। ঠিকই সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে চা পান করছে। মেয়েটা চাপা গলায় বললো, এই শব্দ করে চা খাবে না, খবরদার। আমি গলা খ্যাঁকারি দিলাম। কাদের তাকালো তারপর বললো বস আর কিছু লাগবে?
না। তোমার মন খারাপ কেন কাদের?
আর বলিয়েন না বস। ছোট ছেলেটারে ভার্সিটির কোচিং করার জন্য টাকা দিছি পনেরো হাজার। স্বজন ভার্সিটি কোচিং। ভাবলাম কলেজের গেটেই যেহেতু দিছে ভালোই হলো। সবসময় নজরদারিতে রাখা যাবে। আর কোচিং মালিক ছেলেটাকেও চিনি, এই কলেজেরই ছাত্র ছিল। এখন কয়েকজন মিলে কোচিং দিয়েছে। এখন এখানে ক্লাস হয় না। হলেও একজনরে দিয়ে সব ক্লাস নেওয়ায়। ছেলে এদিকে জিদ ধরেছে আর একটা কোচিং এ ভর্তি করায় দেবার জন্য। টাকা কই পাই কন তো বস?
হু,বিরাট সমস্যা। তবে কাদের মিয়া তোমার এই স্বজন কোচিং সেন্টার নাম দেখেই পিছায় যাওয়া দরকার ছিল। স্বজনরাই বাঁশ দেয়। আমি বাঁশ খেয়ে বসে আছি সে বাঁশ পিছন দিয়ে বের হতে গিয়ে অর্ধেক বেরিয়ে আটকে গেছে।এখন না পারি বসতে না শুইতে।
হাসির শব্দে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা আমার কথা শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে।
আমিও তার দিকে তাকিয়ে হাসি। ছেলেটার মনে হয় সহ্য হচ্ছে না, সে বললো চলো উঠি। কাজ আছে।
মনে মনে বলি কচুর কাজ আছে বেটা সুড়ুৎ সুড়ুৎ।
আলম আসছে। এই গরমে সে ফুলহাতা একটা টাইট গেঞ্জি পরে আছে। ওকে দেখেই গরম লাগছে। আলম এমনই। বিপরীতে যাওয়া মানুষ। সবাই আমরা পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য হন্য হয়ে বেড়াতাম। সে তখন দুইটা গোরু দিয়ে শুরু করল খামার।আমরা বলতাম আলম রাখাল। সে হাসত। রাগ করা তাকে দেখি নাই। লেগে থাকতে পারত। আজ মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে তার খামার। সোমাকে নিয়ে গেছিলাম ওর খামারে। প্রায় সত্তুরটা গোরু, ছাগল প্রায় দেড়শোর কাছে। মুরগি,হাঁস,পুকরে মাছ, সব দেখে সোমা বাসায় এসে বলল,আলম ভাইয়ের মতো ধনী তোমার মতো ছাপোষা কেরানির সাথে কেমনে উঠাবসা করে বুঝি না। তার মতো হলেও পারতা। মনে মনে বলি, রাখাল হওয়া তো আমার এইম ইন লাইফের রচনায় লিখি নাই।
কি রে কেমন আছিস? হঠাৎ জরুরি তলব।
এই এমনি। কেন তোর তাড়া আছে?
আরে নাহ্,বল। কাদের মিয়া কেকে দুধ দিয়ে দুইটা কেক দাও।
এবার ঘটনাটা তাকে খুলে বলি।
কাদের বলে,আরে ধুর, তোর হ্যালোসিনেশন হইছে। বস, বৌ সব মিলে মানসিক চাপে আছিস তো তাই।
আরে না, তুই বুঝতে পারছিস না। আমি রীতিমতো দেখলাম বসে আছে। আর তার সেই বসার ভঙ্গিটা আমি চিনি। ডান পায়ের পাতার উপর, বাম পায়ের পাতা রাখতোআর দুই হাত রাখত দুই পায়ের উপরে। কোমর সোজা করে বসে থাকতো যেন ধ্যানে বসেছেন। আমি পড়তে বসলে আমার পাশে এসে বসত। আমি শিওর নানিই এসেছিল।
এসেছিল তো কী হইছে? দেখতে ইচ্ছা হইছে দেখতে আসছে। কেন মরে গেলে আর আসা যাবে না? কাদের দুইটা বেনসন দাও। নে চা খা, বলে হাসলো আলম। আলম হাসলে বাম গালে টোল পড়ে। খুব খ্যাপাতাম আমরা এটা নিয়ে। মেয়েদের গালের টোল নিয়ে কত কবিতা আছে, ছেলেদের গালের টোল নিয়ে কোনোই কবিতা নাই। আলম হাসতো,আর আরও স্পষ্ট হতো ওর গালের টোল। বাংলার শ্যামলীকে ওর পছন্দ ছিল। তবে রুচিশীল কবিতা পড়া শ্যামলী স্পষ্ট বলে দিয়েছিল তার সাথে রাখাল ঠিক যায় না। এজন্য আলমের কোনও কষ্ট আছে কি না জানি না। আচ্ছা শ্যামলী যদি জানতো ভবিষ্যতে আলম এতো উন্মতি করবে তাহলে কি সে রাজি হতো? কী জানি? ভবিষ্যৎ জানা গেলে দুনিয়া নিশ্চয়ই এমন হতো না।
নতুন করে চা বানাচ্ছে কাদের। আমি চামুচ দিয়ে তার চিনি ঢালা দেখছি। কাদের আবারও চিনির হিসাবে গন্ডগোল করলো। এক চামুচের জায়গায় দুই চামুচ চিনি ঢালল। বর্তমানে চিনির দাম দেড়শত টাকা কেজি, কাদেরের এমন ভুল করা কখনোই দেখি নাই। ঠিক তখনই আমার চোখে ভাসল আমার ছেলেবেলা। বন্ধু দিগন্ত, সুমি খালা। দিগন্তের সাথে সনেট মামাদের বাড়ির পিছনে গোপনে সিগারেটে টান দিচ্ছি। বুকে ধোঁয়া আটকে কাশি। কালাম ভাই আসলো, কালাম ভাই পাড়ার মাস্তান। হাতেনাতে ধরে ফেললো। কান ধরে দাঁড়িয়ে আছি। নানি রান্না ঘরে, গন্ধ পাচ্ছি ডালের বাগার দেবার গন্ধ। আমি পা টিপে টিপে নানির ঘরে ঢুকলাম। কাঠের আলমারি খুলছি, নানি চিনির বৈয়ামে মামার ভয়ে একটা সোনার বালা রাখছে। সোহেল মামা নেশার জন্য সব স্বর্ণালংকার বিক্রি করে দিছে। সব শেষ সম্বল এই একটা সোনার বালা। প্রায় আলমারি খুলে বালাটা দেখত নানি। আমি চিনির কৌটা খুলে বালাটা নিয়ে পকেটে ভরলাম। বেরিয়ে যাচ্ছি ঘর থেকে। বাতাসে তখন ডাল বাগাড়ের গন্ধ।
আমার কাছে পরিষ্কার হলো নানির ফিরে আসার কারণ। আমাকে ফেরত দিতে হবে নানির বালা। সব মুশকিল আসন করা, আমার জন্য ছাতু জোগাড় করে আনা আলমকে বললে সে কি পারবে নানির বালা নানিকে ফেরত দিতে?