প্রতিদিন ছেলেকে স্কুলে দিয়ে অফিসে যাই। সে ক্লাস টু তে পড়ে। বোধহয় ইউরোপের প্রায় সবকটি স্কুলের নিয়ম এমন— ক্লাসের প্রবেশ মুখে সুন্দরী এক ম্যাডাম দাঁড়িয়ে থাকবেন। তার পাশে থাকবে একটা বোর্ড, যে বোর্ডে দেওয়া থাকবে বিভিন্ন সংকেতের ছবি। বেশিরভাগ সংকেত হলো— ড্যান্স, হ্যান্ডশেক, হাগ, কিস, স্যালুট, আরও কত কী। বাচ্চারা যার যার পছন্দমতো একটা সংকেতে থাপ্পড় মারে। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাডামও সেই সংকেত অনুযায়ী সেটা করতে উদ্বুদ্ধ হোন। বাচ্চারাও আনন্দের সহিত সেই কাজটা করে ক্লাস রুমে প্রবেশ করে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি। বেশ মজাই লাগে। ইশ, এমন যদি আমাদের দেশেও হতো, কত না ভালো হতো। বাচ্চারা হেসে খেলে শিক্ষা নিতো।
আজ বউকে নিয়ে শপিংয়ে যাবার কথা। ভাবছি, বাচ্চাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে তারপর সোজা শপিংয়ে চলে যাবো। দেখতে পাচ্ছি সে রেডি হচ্ছে। তারপরও তাড়া দিচ্ছি। মেয়ে মানুষকে তাড়া দেয়া পুরুষের নৈতিক দায়িত্ব। নইলে কেয়ামত কাছাকাছি চলে আসবে, তাদের রেডি হওয়া আর হবে না।
ছেলেকে স্কুলের গেইটে নামিয়ে দিলাম। বউ উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে ছেলে কী করে? সে হাগ সংকেতে থাপ্পড় মারলো। হাগ করার সুবিধার্থে ম্যাডাম একটু নিচু হলেন। বিষয়টা দেখে আমিও উঁকি দিলাম। আসলে উঁকি দিইনি, উঁকি দিতে বাধ্য হয়েছি। এভাবে নিচু হবার কী দরকার! দেখলাম, ছেলেটা ম্যাডামকে জড়িয়ে ধরছে। ছাড়তে চাচ্ছে না। ওমা, কিসও দিয়ে দিছে। কিস দিয়ে দিছে দৌড়। এটাতো নিয়ম বিরোধী। যেকোনো একটা করা উচিত। বউ দেখি অবাক দৃষ্টিতে হা করে তাকিয়ে আছে। আমি তাকে বললাম, ‘দেখছো, তোমার পোলার কারবারটা?’
সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘দেখলাম। এ-ও বুঝলাম, সবি রক্তের দোষ।’
রক্তের দোষ বলে বউ আমাকে যত খোঁচা দিক, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি খোঁচাকে মধু দিয়ে হজম করা লোক। তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় তুর্কিশ এয়ারলাইনসে। তার মতো আগুন সুন্দরী আমার পাশে দীর্ঘ দশ ঘণ্টা বসে থাকবে, বিষয়টা মেনে নিতে পারছি না। এমন অসহ্য আগুন সুন্দরীর সঙ্গে কথা বলতে যেয়েও থেমে যাচ্ছি। কীভাবে কথা বলা উচিত তা-ও বুঝতেছি না। পেঁচার মতো বাঁকা চোখে তাকে মিটমিট করে দেখতেছি। বিষয়টা সে লক্ষ্য করছে। তারে যত দেখছি তত সত্তরটা হুরের আশা ছেড়ে দিচ্ছি। হুরের সঙ্গে তারে কল্পনা করার মধ্যেই হঠাৎ করে প্লেন ঝাঁকুনি দেওয়া শুরু করলো। এমন ঝাঁকুনি যে, মনে হচ্ছে ত্রিশ হাজার ফিট উপর থেকে এখুনি প্লেন মাটিতে আছড়ে পড়বে। প্রায় সবাই ভয় পেয়ে আল্লাহ, আল্লাহ শুরু করে দিয়েছে। আমি তাকিয়ে দেখলাম আমার হাতটা আর আমার দখলে নেই। পাশের সুন্দরী তুমুল ভয় পেয়ে আমার হাতটা শক্ত করে তার বুকে চেপে ধরেছে। আমি কী করবো বুঝতেছি না। ভাবলাম, বিমান জাহান্নামে যাক, এমন সুযোগ মিস করা যায় না। ঝাঁকুনির তাল বুঝে তারে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। মুখে আল্লাহ, আল্লাহ জঁপলাম আর মনে শান্তি, শান্তি বললাম। সে-ও জড়িয়ে ধরছে শক্ত করে। চিৎকার করে কাঁদতেছে। এই বুঝি শেষ। আমিও চিৎকার করছি কিন্তু কাঁদছি না, কান্নার ভং ধরছি। দীর্ঘদিনের প্লেন ভ্রমণের অবিজ্ঞতায় এতটুকু নিশ্চিত হয়েছি যে, টারবুল্যান্স বা ঝাঁকুনি হলো একটা সাধারণ ব্যাপার। এর ফলে বিমান দুর্ঘটনা হওয়ার সম্ভবনা নাই বললেই চলে। টারবুল্যান্স হলো বায়ুর এক অনিয়মিত প্রবাহ যা, বাতাসের ঘূর্ণমান এবং উল্লম্ব স্রোতের মিশ্রনে হঠাৎ তৈরি হতে পারে। এর ফলে হঠাৎই বিমানে এক বা একাধিকবার মারাত্মক ঝাঁকুনি লাগতে পারে।
ঝাঁকুনি থেমে গেছে। প্লেন তার আপন গতিতে ছুটছে। সে কানে কানে আস্তে আস্তে আমাকে ডাকছে, ‘এই যে, শুনছেন? আমাকে ছাড়ুন প্লিজ।’
আমি শুনেও না শোনার ভান করে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জোরেশোরে বলে উঠলাম, ‘আল্লাহ, আল্লাহ।’
সে অনেকটা বিরক্তি নিয়ে আমার মাথাটা ধরে সোজা করে সিটে বসালো। আমি বলে উঠলাম, ‘আমরা মরিনি?’
সে বললো, ‘না, আল্লাহর রহমতে এ যাত্রায় বেঁচে গেছি।’
আমি আবারও থ্যাংকস গড বলে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। পানিবিহীন কান্দনের সহিত বলতে লাগলাম, ‘তুমি দয়ালু, তুমি রহমান। আজ যদি মরে যেতাম আমার কী হতো? এখনো বিয়ে করিনি! আবার আমার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছো, তোমার শুকরিয়া কেমনে আদায় করি, হে মাবুদ।’
আগুন সুন্দরী এবার মহাবিরক্ত হয়ে বললো, ‘ছাড়ুন তো, কী শুরু করলেন! আমি কিন্তু সিনক্রিয়েট করবো।’
কোনো ধরণের কথা না বলে আলিফের মতো চুপচাপ সিটে বসে পড়লাম। সে বাঁকা চোখে কিছুক্ষণ পর পর আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি মাথা নিচু করে চুপিচুপি বললাম, ‘প্রথমবার তো প্লেন চড়তেছি। তাই একটু ভয় পেয়ে গেছিলাম। চাইলে আপনি আমার বুকে হাত দিয়ে দেখতে পারেন। এখনো বুকটা ধড়ফড় করে কাঁপতেছে।
সে বললো, ‘আপনার সমস্যা কোথায় আমি বুঝে গেছি। নেকামি আর করতে হবে না। আমার বাপ আসবেন আমাকে রিসিভ করতে। চাইলে আপনার সমস্যার কথা উনাকে বিনয়ের সহিত বলতে পারেন। আশা করি সঠিক সমাধান পাবেন।’