মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

হাসি প্রশিক্ষণ

রেজাউল ইসলাম হাসু

৩ জুন, ২০২৩ , ১০:৩৬ অপরাহ্ণ

হাসি প্রশিক্ষণ

শেষ কবে হেসেছি—আমাদের মনে নেই।

মনে রাখবার মতো এমন কোনো ক্যালেন্ডারও ঘরে নেই। যার পাতায় লাল কালিতে সেই দিন তারিখটা দাগিয়ে রাখি। মনের ভেতর কেবল মেঘদূতের শব্দ খসে খসে মেঘ জমাট বাঁধে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি ঝরে যেন সেই জমাট-মেঘের জরায়ু ছিঁড়ে ছিঁড়ে। যেন হরপ্পা সভ্যতার কোনো এক অন্ধ বেহালার সুর তার সঙ্গে মিলেমিশে নির্বিকার গড়িয়ে আসে অন্তহীন আমাদের অভিমুখে। আমরা একটা হাসি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বসে বসে এইসব বৃষ্টিদৃশ্যে হারিয়ে ফেলি আমাদের হৃৎ ও ঋতু, সুখ ও সঙ্গম। কী ঝকঝকে আর পরিচ্ছন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটা! ফাইবার কাচ বেষ্টিত অ্যালুমিনিয়ামের জানালাগুলোয় লেগে আছে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির ছটা। টাইলস করা ফ্লোর। আমাদের নিষ্প্রভ প্রতিবিম্বগুলো তাতে বারবার প্রতিফলিত হয়ে ছুঁয়ে গেছে প্রাসাদের কার্নিশঅব্দি। পুরো প্রাসাদটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলেও আমরা ঘেমে জবজবে। যেন হাজার বছর ধরে আমরা ভেজার ঝমর।

এল অ্যালফাবেটে আসনগুলো সাজানো। প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা আসনের ব্যবস্থা আছে। একজনের আসন থেকে অন্যজনের আসনের দূরত্বও বেশখানিক। এর সুবিধাদি নিশ্চয় আছে। হয়তো পরে আমাদের এসব বিষয়ে অবগত করা হবে। আমার বাঁ পাশে একজন অসম্ভব সুন্দরী আসীনরত। অনেক স্টিচের দাগ তার ঠোঁট দুটো সাপের ন্যায় প্যাঁচিয়ে আছে মেয়েলি সৌন্দর্য খর্ব করে। ডান পাশে এক বৃদ্ধ। তার সারা মুখে ব্যান্ডেজ। আমার পেছনে একটা দশ-বারো বছরের কিশোর ছেলে। প্রাসাদে প্রবেশকালীন তার সঙ্গে আমার প্রাক-আলাপ হয়। সে একটা কফিশপে কাজ করত। তার পিঠে অসংখ্য ছড়ির দাগ। আর আমার সামনে সুসজ্জিত আলোকোজ্জ্বল একটা মঞ্চ মূর্খতায় ডুবে। ডিজিটাল ব্যানার দিয়ে ওয়েল্ডিং করা তার সমূহ শরীর। ‘হাসি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শুভ উদ্ধোধন’—বড় বড় বর্ণমালায় লেখাটা ঝলমল করে। ‘উদ্বোধন করবেন মাননীয় নগরপিতা’—আরো অতিরিক্ত একটা বাক্য আমাদের চোখে পড়ে। নগরপিতার আগমনের অপেক্ষায় ক্লাস শুরু হতে বিলম্ব হয়। দূরান্তর থেকে এখনো লোকজন আসছে। আমরা একে-অপরের দিকে কেবল নিরীহ মাছের মতো অনিমেষ তাকিয়ে থাকি। প্রাসাদের চারদিকে হাসির পোস্টার সাঁটানো। মুচকি হাসি, অট্টহাসি, মিহি হাসি, হিহি হাসি, টাসকি হাসি, ফাঁসকি হাসি—বিবিধ হাসির পোস্টারের মাঝখানে কেবল আমরা পড়ে আছি অনাথের মতো নিথর ও নিষ্প্রভ। প্রজেক্টরের স্ক্রিন ফেটে বেরিয়ে আসতে চায় মিস্টার বিনের হাস্যোজ্জ্বল মুখাবয়ব। ডায়াসে একজন লাস্যময়ী সুন্দরী দাঁড়িয়ে। একটু পরপর বিশ^খ্যাত জোকসগুলো পরিবেশন করে করে আমাদের হাসানোর কসরতে পারঙ্গম। তবু আমাদের মুখে হাসি নেই। শেষ কবে হেসেছি আমরা—তাও মনে নেই আমাদের।

উদ্বোধনী দিন

মাননীয় নগরপিতা হাস্যোজ্জ্বল মুখে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। আমরা করতালির বারুদ দিয়ে তাকে স্বাগত জানাই। নগরপিতা হাসি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শুভ উদ্বোধন করে বলেন, আমরা একটা নতুন মাইলফলক স্পর্শ করলাম। বাঁচতে হলে হাসির কোনো বিকল্প নেই। আপনারা প্রাণ খুলে হাসুন। আমরা হাসিহীন একটা মুখও দেখতে চাই না। প্রতিটি মুখের হাসি নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য। আর আমরা সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছি। হাসি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তারাই হাসির প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন যারা হাসতে না পারার উপযুক্ত প্রমাণ দাখিল করতে পেরেছেন। এই প্রশিক্ষণ অব্যাহত থাকবে। আশাকরি, আপনারা এখান থেকে প্রশিক্ষিত হয়ে আপনাদের হৃৎ ও ঋতুকে জাগাতে সক্ষম হবেন, সুখ ও সঙ্গমকে উপভোগ্য করতে উন্মুখ হবেন। এই বলে নগরপিতা হাস্যোজ্জ্বল মুখে মঞ্চ থেকে নেমে আমাদের আড়াল হলে একজন হাসির প্রশিক্ষক দৌড়ে মঞ্চে এলেন। তিনি এক ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ। আমি তার ভেতর সিসিফাসের ছায়া খুঁজে পাই। তিনি খুব মহত্ত্বের সঙ্গে উচ্চারণ করেন ‘হাসো’। আমরা হাসতে চেয়েও পারি না। তিনি তার সমস্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন।

প্রথমে তিনি আমাদের হাসির বেসিক ধারণাগুলো শিক্ষা দেন। তিনি বলেন, হাসার জন্য সর্বপ্রথম ও প্রধান যে উপাদানটা দরকার সেটা হলো আনন্দ। আর আনন্দ হলো হাওয়াই মিঠাইর মতো। এই আছে এই নেই। আপনারা কি কখনো সেই আনন্দ উপলব্ধি করতে পেরেছেন? আমরা সমবেতভাবে না বলি। তিনি খুব সুখী ভঙ্গিতে আমাদের মনের ভেতর আনন্দ উপলব্ধি করার উপদেশ দেন। আমরা কী কারণে আনন্দ উপলব্ধি করব তার কোনো যথার্থতা খুঁজে না পেয়ে নিশ্চুপ থাকি। বৃদ্ধ লোকটা তার প্রশিক্ষণ পরিচালানার সুবিধার্থে নিজেই কৃত্রিম আনন্দ উপলব্ধি করে অট্টহাসিতে অধীর ও উন্মুখ হয়ে পড়েন। তার অট্টহাসি কাচবেষ্টিত চৌহদ্দি ধাক্কা খেয়ে পুরো প্রাসাদে প্রকম্পিত হয়। আর আমরা কেবল নীরব দর্শকের ভূমিকাটুকু পালন করে যাই। এবার লোকটা আমাদের জং ধরা ঠোঁটের ব্যায়াম করতে উপদেশ দেন। তার ধারণা আমাদের ঠোঁটগুলো না-হাসতে হাসতে অলস ও অথর্ব হয়ে গেছে। কিংবা হাসার জন্য যে এনার্জিটি দরকার তা ক্ষয়ে ফেলেছে। আমরা আমাদের ঠোঁটগুলো রাবারের মতো এদিক-ওদিক ভঙ্গি করি। কখনো-সখনো শুয়োরের মুখের মতো কোঁচকাই। আমার বাঁ পাশের মেয়েটা ঠোঁটের ব্যায়াম করতে গিয়ে ককিয়ে ওঠে। তার ঠোঁটের স্টিচ ছিঁড়ে টুপটুপ রক্তক্ষরণ শুরু হয়। আমরা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আমাদের ঠোঁটের ব্যায়াম চালিয়ে যাই। তারপর মুখের ব্যায়াম। এভাবে আমরা হাসির বেসিক ধারণাগুলির দীক্ষা নিই।

দ্বিতীয় দিন

এরপর দ্বিতীয় দিনে শুরু হলো মূল ধাপ। মিরাক্কেল থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসা একজন হাসি এক্সপার্ট লাফ দিয়ে আমাদের মাঝে উপস্থিত হলে আমরা সাময়িক বিস্মিত হই। এমন কোনো হাসি নেই যে তিনি জানেন না। হাসতে হাসতেই তার হাসির পারদর্শিতা সম্পর্কে আমাদের সম্যক অবগত করেন। মুচকি হাসি, ফুচকি হাসি, অট্টহাসি, খট্টহাসি, মিহি হাসি, হিহি হাসি, টাসকি হাসি, ফাঁসকি হাসি—কী অদ্ভুতুড়ে তার হাসির প্রকার! কী হাসবার ধরন! নানাভাবে, নানা প্রকরণে তিনি তার হাসির জাদু আমাদের মাঝে ছড়িয়ে দেন। আমরা কেবল নিবদ্ধ দৃষ্টিতে দেখে যাই সেসব দৃশ্যের উড়াল ও অন্তর্জাল। আর তাকে অনুসরণ করে হাসবার হাঁসফাঁস করি। আমার পেছনের দশ-বারো বছরের কিশোর ছেলেটা হাসতে গিয়ে ছড়ির ব্যথায় ধনুকের ন্যায় কুঁকড়ে যায়। মিরাক্কেল থেকে হেসে আসা হাসি এক্সপার্ট বিদায়কালে তার কদর্য হাসির কলা ও কসরতগুলো রপ্ত করতে বলেন। একদিন আমরা নানা প্রকরণের হাসি হাসতে পারব বলে তার বিশ্বাসে সেই ব্যঞ্জনা দেখেছেন। আর তিনিও অট্টহাসির অতলে ডুবতে ডুবতে আমাদের মাঝখান থেকে বিদায় নেন। যাবার আগে ভুলবশত তিনি তার রুমালটা আমাদের মাঝে ফেলে যান। যে রুমালে লেগে আছে অজস্র অশ্রুর দাগ। যার কোনো নাম নেই, ধাম নেই।

তৃতীয় দিন

তৃতীয় দিনে বৃদ্ধ প্রশিক্ষক আবারও হাসতে হাসতে আমাদের মাঝে এলেন। একটা মুচকি হাসির সম্ভাষণে ক্লাস শুরু করেন। এতদিনে আমরা যা শিখেছি আজ তার মূল্যায়ন হবে। প্রথমে কে আসবেন? তিনি খুব উৎফুল্লতার সঙ্গে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেন আমাদের মাঝে। মুহূর্তেই শাদা, কালো, চিকনা, মোটা, সুস্থ, অসুস্থ অজস্র হাত বন্দুকের নলের ন্যায় দাঁড়িয়ে ওঠে। তার মাঝখান থেকে একটা মেয়েলি হাতকে তিনি মঞ্চে আসার আহ্বান জানান। মেয়েলি হাতটা যার সে ছিল গর্ভবতী। তার পেটটা ছিল তরমুজের মতো গোল ও ওজনশীল। সে আস্তে আস্তে সেই ওজন বয়ে নিষ্প্রভ মুখে মঞ্চে ওঠে। আমরা গভীর অনুধ্যান ছুঁড়ে দিই মেয়েটির উপর। আর তাকে নিবদ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকি যে সে কীভাবে হাসে—অথবা আমাদের হাসায়। মেয়েটি নগ্ন পায়ে মঞ্চের মাঝখানে আসে। তারপর একটা দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাসে আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে। তারপর সে হাসবার চেষ্টা করে। প্রথমে সে তার ঠোঁট দুটো রাবারের মতো এদিক-ওদিক ভঙ্গি করে। কিন্তু একটা হাসির পোকাও বের হয় না তার ঠোঁট ফসকে। সে খুব বিব্রতবোধ করে। এবার সে তার মুখটা শুয়োরের মুখের মতো কোঁচকায়। আর সঙ্গে সঙ্গে বমি করে দেয়। পরিচ্ছন্নকর্মীরা বমি পরিষ্কার করলে আবার ক্লাস চালু হয়। এবার আমার ডান পাশের সেই বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ায়। যার সারা মুখে ব্যান্ডেজ। বাসের আগুনে তার মুখটা পুড়ে গেছে। প্রশিক্ষক তার পোড়া মুখ থেকে মুখ ফেরালে লোকটা তার আসনে আরো নিষ্প্রভ হয়ে ওঠে। আমরা তাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিই। বৃদ্ধ আমাদের মিথ্যে সান্ত্বনাকে মিথ ভেবে কোনো এক অনন্তর হাসির অপেক্ষায় থাকে। এবার আমাকে আহ্বান করা হয়। আমি জানি যে আমার হাসা খুব জরুরি। কারো জন্য না হলেও অন্তত অন্তর্গত আমির জন্য হাসাটা আমার দরকার। সন্ত্রাসীদের গুলিতে আমার ডান পা বিগত বসন্তে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। সে এক আদিম-গাথা। আমি এক পায়ে আমাকেই বয়ে বেড়াই। যেন কোনো এক ব্যালেরিনা নাচুক আমি। স্ট্রিচের উপর ভর দিয়ে মঞ্চে উঠি। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে। আমিই যেন তাদের শেষ ভরসার ভানু। যেন দূর থেকে নেমে আসা কোনো এক নক্ষত্রের ঝকমকি আমি। অথবা ভাঙা আস্তাবল থেকে হারিয়ে যাওয়া কোনো এক হ্রেষাধ্বনি। অনেক আস্থার সঙ্গে হাসবার কসরত করতেই নির্দয় নিয়তি আমাকে ধাক্কা মারে। আমার পতনদৃশ্য দেখতে দেখতে আমাদের শেষ ভরসার সমাধিস্থ হয়ে যায়।

এই মূল্যায়ন পরীক্ষায় আমরা অকৃতকার্য বিবেচিত হলে বৃদ্ধ রুমালে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে যান। সেই থেকে তিনি আমাদের হাসির মতোই নিরুদ্দেশ।

শেষ দিন

শেষ দিনে একজন মনিটর হাস্যোজ্জ্বল মুখে আমাদের মাঝে উপস্থিত হন। আমরা তাকে আমাদের বর্ণাঢ্য দুঃখে স্বাগত জানালে কঠোর আপত্তি করে বসেন। হতাশ্বাসের জটলা ঠেলে মনিটর আমাদের বিবিধ পরামর্শ-প্রবাহে ভাসান বানান। আমরা পরিব্রাজক জলের মতো ভাসতে থাকি নামহীন, ধামহীন। প্রথমে তিনি আমাদের একটা ক্ষুদে শুভেচ্ছাবার্তা ছড়িয়ে দেন নিষ্প্রভ দৃশ্যাবলির উপর। সিলিং হাওয়ায় ঘুরতে ঘুরতে সেটা ভাঙা সম্পর্কের মতো ডানা ঝাপ্টাতে থাকে। আমাদের হাসি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আপনাদের মতো প্রশিক্ষণার্থী পেয়ে আমরা আনন্দিত। আপনারা এই কয়দিনে যেভাবে হাসিটাকে রপ্ত করেছেন তাতে আমরা বিস্মিত ও গর্বিত। আজ আপনাদের উদ্দেশ্যে দুয়েকটা পরামর্শ ছাড়া আমার আর কোনো কলা ও কসরত দেখানোর শক্তি নেই। আপনারা সবসময় মনের ভেতর আনন্দ উপলব্ধি করুন। আনন্দ উপলব্ধ না হলে আনন্দ মার্কেট থেকে আনন্দ কিনে আনুন। আজকাল অনেক কোম্পানি আনন্দ উৎপাদন করছে। সুলভ মূল্যে সেসব কেনাও যাচ্ছে। আনন্দ না থাকলে কখনো হাসতে পারবেন না। হাসতে না পারলে আপনি বাঁচতে পারবেন না। বেঁচে থাকলেও আপনার অস্তিত্ব মৃত মৃত মনে হবে। আপনি যতটুকু দেখার ঠিক ততটুকুই দেখুন। যতটুকু শোনার কেবল ততটুকুই শুনুন। যতটুকু ভাবার ঠিক ততটুকুই ভাবুন। যতটুকু বলার ঠিক ততটুকুই বলুন। এর বেশি আপনি দেখবেনও না, শুনবেনও না, ভাববেনও না, বলবেনও না। প্রয়োজন হলে আপনারা সার্কাস পার্টিতে যান। কমেডি নাটক দেখুন। হাসির বিজ্ঞাপন দেখুন। জোকসের বই পড়–ন। কিংবা নিজেই ক্লাউনের ভূমিকায় নেমে পড়–ন। দেখবেন অটোমেটিক্যালি হাসি বেরিয়ে হাসছে। অথবা জাদুঘর ঘুরে আসুন। পূর্বপুরুষদের হাসি দেখে আসুন। তারা কীভাবে হাসত—সেসব হাসির কলা ও কসরত রপ্ত করুন। মনে রাখবেন, আপনি হাসলেই আমরা হাসব। আমরা হাসিময় একটা দুনিয়া চাই। বলেই মনিটর হাসতে হাসতে মঞ্চ থেকে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। না, কোনোভাবেই আমাদের হাসি পেল না। শেষ কবে হেসেছিলাম—মনে করতে করতে আমরা হাসির সনদ-সমেত হাসি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে বিজ্ঞপ্তিহীন হয়ে যাই।

অতঃপর

অতঃপর কোনো এক দুপুরে আমরা আমাদের অস্তিত্ব থিয়েটারে আবিষ্কার করি। একেকজন একেক চরিত্রে কমেডি নাটকে অভিনয় করি। কিন্তু আমাদের হাসি পায় না। চ্যানেলে চ্যানেলে হাসির বিজ্ঞাপন দেখি। তবু হাসি আমাদের অধরে ধরা দেয় না। কেবল হাসার রিহার্সেল করে যাই মেঘের ভেতর ধসে যাওয়া অনার্যকাল থেকে। পৃথিবীর ঠোঁট ফসকে একটা হাসির কয়েনও বুকপকেটে ঝনঝনিয়ে ওঠে না। পৃথিবীর ঠোঁট যেন জমে হিম হয়ে গেছে। বুকের ভেতরটা যেন অদৃশ্য হিমঘর আমাদের। রক্তের ধমনিতে কেবল তিমিরের তোপধ্বনি। আজন্ম অন্ধকারে আনন্দ হাতড়ে ফেরা।

আনন্দ কোথায় থাকে? কোন ধামে? কোন নামে? আহসান হাবীবের কবিতা থেকে তিরের মতো তেড়ে আসছে ‘আনন্দ রে আনন্দ তুই কোথায় থাকিস বল?’ আমরা মৃত ও ধ্বংসের সেতু পেরিয়ে আনন্দের অন্বেষা করি। স্মরণযোগ্য কোনো দিন তারিখ না পাওয়ায় ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো অন্তরে অনুরণন তোলে। কোনো এক অচেনা ছুরি মোচড় দিয়ে ওঠে অনারোগ্য হৃদয়ের ভেতর। আহ্নিকগতি কোন ম-লে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের? কোনো এক নিষ্প্রভ সকালে মেঘের খামে আশাহতদের চিঠি আসে। আমরা হাসতে চাই। আমরা চিঠির উত্তর দিই। আমরাও হাসতে চাই। ক্রমে চিঠির সংখ্যা বাড়তে থাকে আমাদের। ঘোষণাহীন কোনো এক বিকেলে আমরা হাসির হদিসে বেরিয়ে পড়ি। নরম ঘাসের হৃদয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা আনন্দ হাতড়ে বেড়াই। ঘাসের হৃদয়ে সবুজের আনন্দ নেই। এক মুঠো আনন্দের জন্য কী নির্লিপ্তের ন্যায় তাকিয়ে আছে জলাঙ্গীর ঢেউ! ধানসিঁড়ি ডিঙিয়ে নাগাল পাই কলমিলতা গ্রাম। কুমড়ো ফুলের জঠরে হলুদের আনন্দ নেই। শঙ্খচিল শালিকের পালকে আকাশের আনন্দ নেই। শিশিরের শব্দের মতো দিগন্তব্যাপী সন্ধ্যা নামে। ফের শহুরে হাওয়ায় ফিরি। ট্রাফিক জ্যামে আটকে যায় আমাদের অভিযাত্রা। লাল সিগন্যালে অপেক্ষা আরো দীর্ঘ হয়। নাতিদীর্ঘ স্বপ্নের বুদ্বুদে বুঁদ হয়ে থাকি। আশার ফানুস উড়াই। শহরের ফটক ফসকে একটা জাদুঘর লাফিয়ে পড়ে আমাদের ভিড়ে। আমরা হুড়মুড়িয়ে হারাতে থাকি ভিড়ের গর্ভাশয়ে। কোনো এক স্বাধীনতা দিবসের রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে পিতামহ বলেছিল, ‘আমরা কোনো একদিন আনন্দ হব জাদুঘরে।’

আমরা একটা উপায় পেয়ে অধীর ও উন্মুখ হয়ে পড়ি। জন্মান্ধ উন্মুখতায় মুখর হতে থাকে আমাদের স্বপ্ন ও আশা। এই তো পথ ও পালক—আমরা চিৎকার করতে করতে জাদুঘরে আসি। প্রাঙ্গণে অনন্তকাল ধরে নিষ্প্রভ এক ভাস্কর্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে কোনো এক প্রহরী। হয়তোবা সেও জানে না আরো কতকাল তাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আর আমরা বেদানার দানার মতো সমবেদনায় সংগোপনে লাল হতে হতে প্রতিটি কক্ষে প্রবেশ করি। পিতার হাসিটা হিম হয়ে তর্জনী তুলে আজও বুক পেতে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীর যাবতীয় বন্দুক এই বুকের জন্য যথেষ্ট নয়। স্বাধীনতার আনন্দে ঘুণপোকাদের কামড়ের হল্লা। কোনো বিভা নেই। কোনো আরোগ্য নেই। কেবল বিপুল বিভ্রম। কেবল পাথরে পাথর ঘষে অগ্নিগিরির ন্যায় উদ্্গত প্রস্তরকাল দেদীপ্যমান। আমরা মধ্যযুগীয় চাবুকের আঘাত পিঠে নিয়ে জাদুঘর থেকে বের হই। খঞ্জর ও ক্ষত বয়ে বেড়াই দিনের পর দিন। রাতের পর রাত কেটে যায় ল্যাম্পপোস্টের নিচে।

শেষ কবে হেসেছি? কোন সে কালে? হয়তো হরপ্পায়। হয়তো সেন শাসনামলে। হয়তোবা পাল যুগে। আমাদের পূর্বপুরুষদের হাসি কেমন ছিল? হয়তো মাতৃস্তন্যের ন্যায় গোলগাল। হয়তো প্রিয়তমার তিল পড়া চিবুকের মতো নোনতাময়। হয়তো মধ্যযুগীয় কোনো এক চাবুকের শব্দের মতো প্রবল প্রতিশোধপরায়ণ। হয়তোবা জন্মান্ধ শব্দগুচ্ছের মতো অপার আরাধ্যময়। অনেকগুলি অনুমানের উপর আমরা হাঁটছি। আর হাঁপরের ন্যায় কেউ আমাদের অভিযাত্রায় উসকে দিচ্ছে কতগুলো অন্ধ অনুমান।

শেষ কবে হেসেছি? আমাদের মনে পড়ে। মনে পড়ে না। আমরা মনের উপর মনে করবার জুলুম করি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের এই জুলুম জ্বলজ্বলে পৃথিবীর সমূহ আয়নায়।