গল্প Archives - মুগ্ধতা.কম

গল্প Archives - মুগ্ধতা.কম

মুগ্ধতা.কম

২১ এপ্রিল, ২০২৩ , ১১:৪০ অপরাহ্ণ

ইমাম

দশ বারো জন হিংস্র ও হাস্যোজ্জল যুবক ঘিরে আছে এক ইমামকে। ইমাম সাহেব আসরের নামাজে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। যুবকদের বড়ো ভাই বিরক্ত। জিজ্ঞাসা করলেন, পলাইয়া যাবেন না তো?

বিব্রত ও অপমানিত ইমাম সাহেব দৃঢ় কন্ঠে বললেন, না। নামাজ শেষে আসছি। এক প্রকার বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ইমাম সাহেব মিনিট দশেক হাঁটা দূরত্বের মসজিদের দিকে চললেন। আসরের নামাজ শেষে পুলিশকে ফোনে জানালেন তার বিপদের কথা। ইমাম সাহেব যুবকদের কাছে আসতে আসতে বাইকে দুজন পুলিশ চলে এল। পুলিশ দেখে যুবকেরা মৃদু হাসল। পুলিশ অফিসার ইমাম সাহেবকে বললেন, বিয়া করায় দেন।

ইমাম সাহেব বললেন, আপনারাও এই কথা বলেন! মেয়েটার সম্মান কোথায়? ধর্ষকের সাথে বিয়েতে বসতে রাজি নয় মেয়েটা। জোর করে বিয়ে দিতে বাধ্য করা হচ্ছে ইমামকে। পুলিশও ইমামকে সাহায্য করছে না। এলাকার আলেম সমাজের নীরব সম্মতি আছে যুবকদের প্রতি। কিন্তু আপত্তি শুধু এই ইমাম সাহেবের। পুলিশ চলে গেল। যুবকরা এটা জানত। পুলিশ তাদের দখলে। নানা রকম যুক্তি-তর্ক হচ্ছে কিন্তু ইমাম সাহেব বেয়াদব। কাউকেই পাত্তা দিচ্ছেন না। ধীরে ধীরে লোকজন বেশি হতে লাগল। শিশু, নারী, কিশোর, বৃদ্ধ, স্থানীয় আলেম-ওলামাগণ এলেন। স্থানীয় একজন আলেম সাহেব বললেন, বিয়াশাদি আল্লার ইচ্ছায় হয়। আপনি বাধা দেবার কে?

এলাকাবাসী রাজী আছে, তাদের ইজ্জতের দাম আছে না? একটা মেয়ের জন্য সারাজীবন কেন আমাদের বদনাম বয়ে বেড়াতে হবে?

তবুও ইমাম সাহেব অনড়। বললেন, একজন অপরাধীর সাথে বিয়ে হতে পারে না। তার থাকা উচিত ফাঁসির কাষ্টে। যুবকেরা ক্ষেপে গেল এই কথায়। তারা মারমুখী হয়ে বলল, এই এলাকায় না হলে অন্য এলাকা থেকে হুজুর আনতে হবে। যত টাকা লাগুক। এলাকায় একজন হুজুর হইলে এই সমস্যা। ভাব বেশি।

যুবকদের কথা শুনে ইমাম সাহেব ঘাবড়ে গেলেন। যুবকদের বড়ো ভাই বলল, হুজুর আপনি আমাদের ইমাম। আমরা আপনারে সম্মান করি। আপনি আমাদের সম্মান রক্ষা

করবেন এটাই তো নিয়ম। দশগ্রামে আপনার মতো কেউ নাই। আপনি যদি আমাদের বিপদে এগিয়ে না আসেন কে আসবে?

ইমাম বললেন, আরে ভাই অপরাধীকে শাস্তি না দিয়ে তার পক্ষে যাচ্ছেন কেন? ‘পোলাপান মানুষ আকাম না হয় একটা করছে। মুরুব্বিরা যদি ক্ষমা না করে তাইলে কি হইল?’

‘আপনারা শুধু অপরাধীর কথা ভাবছেন, ভুক্তভোগী মেয়েটার কথা তো ভাবছেন না।’

সেই বড়ো ভাই আরও রেগে গেল। তুই তোকারি করে কথা বলতে লাগল ইমামকে। সে ঘোষণা দিলো, যে করেই হোক এই মেয়ের সাথে আজ রাতেই বিয়ে হবে ধর্ষকের।

আর ধুমধাম করেই হবে বিয়েটা। সে তার সাঙ্গপাঙ্গদের বাসর সাজাতে নির্দেশ দিলো।

এলাকাবাসী বিয়ের দাওয়াত পাবে এতেই তারা খুশি। ন্যায়-অন্যায় তাদের কাছে কোনো বিষয়ই নয়। তারা বিয়ে নিয়ে উল্লসিত।

ইমাম সাহেব উঠে চলে যেতে চাইলেন। যুবকদের বিস্ময় বাড়ল। ইমাম সাহেব বললেন, কাজটা ঠিক হচ্ছে না। এটা অন্যায়।

যুবকেরা এবং এলাকার ময়মুরুব্বিরা কোনো কথা বলল না।

হঠাৎ যুবকদের বড়ো ভাইয়ের মনে হলো, ইমাম যদি আবার নতুন কোনো প্যাঁচ লাগায়? তাই ইমামকে ডেকে হুমকি দিলো, আমরা অন্য হুজুর আনতেছি। আপনার দরকার নাই। এই বিষয়টা নিয়া আর কোনো কথা বলবেন না। কোনো বাড়াবাড়ি করবেন না।

ইমাম সাহেব শুধু বললেন, এই কাজে টাকা ছাড়াও বহু হুজুর, ইমাম পাবেন। অনেক মুফতি, মওলানাও আপনাদের সাথে থাকবে। কিন্তু একটা কথা বলি। এটাই শেষ কথা-এটা কিন্তু অন্যায়।

কথাটা শেষ করা মাত্র ইমাম সাহেবকে একটা চড় মেরে বসল বড়ো ভাই। এরপর শুরু হলো এলপাথাড়ি মার। এলাকাবাসী দর্শকের ভূমিকায়। কিছুক্ষণ আগেও যারা তার পেছনে নামাজ পড়েছে তারাও নীরব। কিছু করছে না কিছু বলছেও না।

ঠিক সেই মুহূর্তে ঝড়োগতিতে ঘর থেকে বিধ্বস্ত একটা মেয়ে বেরিয়ে আসে। তার হাতে একটা দোধারি তলোয়ার। তলোয়ার দিয়ে সে আক্রমণকারী যুবকদের এলপাথারি কোপাতে লাগল। তার ক্ষিপ্র আঘাতে দিশেহারা যুবকেরা দিগি¦দিক পালিয়ে গেল।

রণবিজয়ী মেয়েটি দেখতে পেল, রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছেন ইমাম সাহেব-যার পেছনে কোনোদিন সে নামাজ পড়ার সুযোগ পায়নি।

জাকির সোহান

সিংগীমারী

হাতীবান্ধা,

লালমনিরহাট।

মোবাইল-০১৭৬৩০৮৮৬১১

ইমাম
41 Views

মুগ্ধতা.কম

২১ এপ্রিল, ২০২৩ , ১১:৩৮ অপরাহ্ণ

ঈদ শপিং 

সজীবের ফোনটা বেজেই চলেছে। একটানা ৭২ বার। সজীব ফোন রিসিভ করছে না। ইনকামিং কল একজনের। তার নাম চৈতী। 

চৈতীর ধৈর্য আছে বলা যায়। একটানা কেউ কল দেয়! অবশ্য সজীবের সহ্য ক্ষমতাও কম না। সে মোবাইল সাইলেন্ট করেনি। চুপচাপ রিংটোন শুনেছে। সজীবের মোবাইলের রিং টোনে চৈতীর কন্ঠ। চমৎকার কন্ঠ। মাঝে মাঝে আশ্চর্য হয় সজীব। এতো সুন্দর কন্ঠ হয় কারো! কি মায়াবী কন্ঠ। তার কন্ঠ শুনলে যে কোন ছেলে পাগল হবে। সজীবও পাগল।

পুরুষ মানুষগুলো হয়তো এমনই। এটা সবাই বলে। কিন্তু আজকাল নারীগুলোও এমন। একঘেয়েমি কাটাতে ভিন্নতা খুঁজে। ভিন্নতা পেলে সময় দিয়ে এগিয়ে যেতে চায়। অবশ্য এতে ভালোবাসার মানুষের প্রতি ভালোবাসা কমে না, বরং বাড়ে। কী হাস্যকর কথা।

আজ সজীব ও চৈতীর ঈদ শপিং করার কথা। সজীবের হাতে টাকা নেই। টাকা পাওয়ার কথা ছিল কিন্তু সে পায়নি। অনেক চেষ্টা করে ফেল করেছে। চৈতীকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বললেও সে বুঝবে না। চৈতী বোঝে না। কিংবা বুঝতে চায় না। এই অবুঝ ভাবটাও সজীবের ভালো লাগে।

ভালোবাসার অত্যাচার। আসলে এটা অত্যাচার। সেহেরি খাওয়ার পর থেকেই সজীবের ফোন বাজছে। দুই দিন হলো সজীব রুমে একাই আছে। তার রুমমেট ঈদ করতে বাড়িতে চলে গেছে। সজীব যায়নি। তিনটা টিউশনি করায় সজীব। দুইটার টিউশন ফি এখনও দেয়নি। একটি ঈদের পূর্বে দেবে না, জানিয়ে দিয়েছে। গতকাল একটির টাকা দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু দেয়নি। আগামীকাল হয়তো দেবে।

দুপুর হবার অপেক্ষা। দুপুর ঠিক ২.০০ টায় সজীব টিউশনি করায়। রমজান মাসে এই সময় বেছে নিয়েছে। অপেক্ষার সময় দীর্ঘ হলেও একসময় শেষ হয়। ২.০০ টা বাজার পূর্বেই সাহেদ হাজির হয় টিউশন বাড়িতে। লাল বোতামে চাপ দেয়। তার স্বভাব অনুযায়ী একবারের বেশি কলিং বেল বাজায় না। কিন্তু অপেক্ষা তার ভালো লাগছে না। পর পর দু বার কলিং বাজিয়ে অপেক্ষা করে। ১০ মিনিট। আবার কলিং বেলে টিপ দেয় সে। দরজা খোলে না। সজীব অবাক হয়। 

কিছুক্ষণ পর পাশের ফ্লাটের দরজা খুলে এক মহিলা বের হয়। সজীবকে দেখে একটি চিঠি ধরিয়ে দেয় আর বলে মমরা গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। সে খাম পেয়ে খুশি মনে হাত বাড়িয়ে নেয়। ভাবে- যাক গ্রামের বাড়ি গেলেও টাকাটা দিয়ে গেছে।

মহিলা দরজা বন্ধ করতেই সজীব রাস্তার দিকে পা বাড়ায়। খামটা হাতে নিয়ে সে বুঝতে পারে খামের ভিতরে টাকা নেই। কোনো চিঠি থাকতে পারে। সজীব খাম খোলে না। ভাঁজ করে পকেটে রেখে দেয়। চৈতীর সাথে আর দেখা করবে না। পিচ ঢালা রাস্তায় হাঁটতে থাকে। মাঝে মাঝে আকাশের তাকায়। বিশাল আকাশের নিচে নিজেকে একমাত্র অসহায় পুরুষ মনে করে। এই শহরে ঈদের পূর্বে চেনা মুখগুলো কয়েকদিনের জন্যে হারিয়ে যায়। আবার কিছু অচেনা মুখ যোগ হয়। সজীবের দৃষ্টিতে সবই অচেনা মুখ। আকাশের বিশালতা তাকে স্পর্শ করে না। কুয়োর অন্ধকার তাকে টানে। চেনা হাসির শব্দে রিকশার দিকে তাকায় সজীব।

চৈতীর হাসি। সেই হাসি। অসম্ভব চমৎকার কন্ঠের সুর মেশানো হাসি। বাতাসের  বেগের চেয়েও তীব্রতার সাথে ছুটে চলছে রিকশা। চৈতীর পাশে অন্য কেউ। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চৈতী আর সজীবের চোখে চোখ আটকে যায়। বাতাসের সাথে মিলিয়ে যায় সব।

ঈদ শপিং 
64 Views

শিস খন্দকার

২ মে, ২০২২ , ৫:৫০ অপরাহ্ণ

নারী ও নিকোটিন 

||এক||

—মা প্রিয়া, এই ভোরে বসে বসে কী করছিস?

—কিছু না, বাবা।

—কিছু তো করছিস।

—কী করি করি, তোমাকে বলবো কেন? এই ভোরে আমার জানালার কাছে আর কখনো আসবে না। যাও ঐ দিকে হাঁটো।

‘ঠিক আছে, আসবো না। থাক।’—বলেই বিষ্ণুর বাবা চলে যাচ্ছিল। ‘বাবা, একটু দাঁড়াও।’—মেয়ের ডাক শুনতেই ফিরে তাকালো।

—বাবা, আমি কবিতা লেখার চেষ্টা করছি, কিন্তু হচ্ছে না। আমার এক বন্ধু তুখোড় কবিতা লেখে। তুমি লিখতে জানো, বাবা?

‘না রে মা। তোর মা ভালো কবিতা লিখতো।’—বলেই বিষ্ণুর বাবা চলে গেলেন। হঠাৎ বিষ্ণুর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। যখন সে ক্লাস সিক্সে, অজানা কারণে মা কে হারায়।

বিষ্ণুপ্রিয়া। মেয়েটির কবিতা লেখার বড়-ই শখ। রুমের দখিন জানালা খুলে প্রতি প্রভাতে ডায়েরি আর কলম নিয়ে বসে। অধির আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে কয়েকটি শব্দের জন্য, আর কলমে-দাঁতে যুদ্ধ চালায়। একটির পর একটি শব্দ-বাক্য-পৃষ্ঠা কেঁটে-ছিঁড়ে ফেলে। কাব্যিক শব্দ একটিও মনে হয় না ওর কাছে। না, এ জীবনে সে আর লিখতে বসবে না—প্রতিদিন সিদ্ধান্ত শেষের, প্রতিদিন চেষ্টা নতুনের। অবসরে কবিতার বইয়ে বুঁদ হয়ে থাকে। এভাবেই কবিতার সাথে সখ্যতা, কবিতার প্রতি প্রেম, কবিদের সাথে সখ্যতা।

এক ঘনিষ্ঠ কবি বন্ধু আছে ওর, যার কাছে থেকে রোজ দু’বেলা প্রস্তাব পায় প্রেমের। কিন্তু প্রতিবারেই ঠাট্টার ছলে প্রত্যাখ্যান করে।

—এই বিষ্ণু, বাস না রে …একবার শুধু বেসেই দেখ না …

—বাসলে কী দিবি রে অনি…?

—কবিতার সমুদ্রে তোকে ডুবে মারবো!

—তাহলে বেসে লাভ কী, মরেই তো গেলাম?

—ধুর, এই মরা তো মরা নয়। তোর সারা জীবনের কাব্যতৃষ্ণা মেটাবো।

—ও …আচ্ছা। আচ্ছা বাসলাম।

—সত্যি?

—হু, সত্যি।

—তোর সাথে আমার বিয়ে হবে?

—না।

—কেন হবে না?

—তুই আমার ফ্রেণ্ড, তোকে বিয়ে করতে যাব কেন?

—তাহলে বললি বাসিস আমাকে?

—বাসলেই বিয়ে করতে হবে বুঝি? বন্ধু বন্ধুকে ভালোবাসবে না? যা আর বাসবো না …

 

—সরি সরি …তুই বাসলেই চলবে। বিয়ে-টিয়ে করতে হবে না।

—প্রমিস?

—প্রমিস।

—মি. অনিকেত, এই বিষ্ণুপ্রিয়ার কাছে আজ কততম প্রমিস করলেন?

—একশত চার।

—কাল একশত পাঁচ হবে না তো?

—চল বিষ্ণু হাঁটি…

—চল…

 

অনিকেত। কবিতা লেখায় হাত আছে। দুর্দান্ত সব কবিতা লেখে নিয়মিত। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ওর লেখা ছাপে। বন্ধুরা ওর কবিতার ভীষণ ভক্ত। ‘সমুদ্র সঙ্গম’ নামক একটি কবিতার মাধ্যমে বন্ধু মহলে কবি হিসেবে পরিচিতি পায় সে। এ হলো বিষ্ণুপ্রিয়ার সেই প্রেমিক কবি বন্ধু। কবিতাসূত্রে ঘনিষ্ঠতা প্রগাঢ়। গত একশত চার দিন ধরে বিষ্ণুপ্রিয়াকে প্রেম প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।

—রুমমেট প্রেম-ট্রেম করবে না আর?

—আরে না। ফালতু একটা বস্তু এই ‘প্রেম’।

—আরে তোমার কয়েকটা গেছে তো, এখন ফালতু মনে হবেই। এখন পর্যন্ত একটা প্রেম জুটলো না কপালে।

—কেন, তোমার বিষ্ণুর খবর কী?

—ধুর, ওটা প্রেম বোঝে না। প্রতিদিন দু’বার করে বলি, উড়িয়ে দেয়।

‘তাহলে সিগারেট খাওয়া শুরু করো, নাও একটা টান দাও। একটা জ্বলন্ত সিগারেট মানুষ কে সব ভুলে থাকতে সাহায্য করে।’—হাতের সিগারেট টা অনিকেতের দিকে বাড়িয়ে দেয় রূপম।

অনিকেত একটা টান দিয়ে কাশতে কাশতে সিগারেট অ্যাশ ট্রেতে দুমড়ে রেখে বলে, ‘রুমমেট, এটা ক্যামনে খাও? তুমি কি সিগারেট ছাড়বে না?’

‘উঁহু’—বলে হাতের আঙুলের ফাঁকে জ্বালানো সিগারেটে আরেকটা টান দেয় রূপম।

রূপম। ভবঘুরে স্বভাবের। মেয়েদের পিছনে বছর তিনেক শরীর-মন-মাথা ঘামিয়ে নামের সামনে ‘ছ্যাঁকা’ শব্দটি জুটয়েছে। পরিচিত মহলে ‘ছ্যাঁকা রূপম’ নামে সমাদৃত। ব্যাপক মাত্রায় ধূমপায়ী। মধ্যবয়সী মা আর সদ্য নাবালিকা পেরুনো বোন বাসায় থাকা সত্ত্বেও নারীকুল ওর কাছে ঘৃণার বস্তু। ফোনের কন্টাক্ট লিস্ট নারী শূন্য, ওর বন্ধু মহল নারী শূন্য। এই বাইশ বছর বয়সেই নিজেকে চিরকুমার ঘোষণা দিয়েছে। তিন-চার মাস অন্তর বাসায় যায়। দ্রোহের কবিতা পছন্দ, বিচ্ছেদের গল্প ওর কাছে সার্থক সাহিত্য। মেস লাইফ প্রিয়। এরই রুমমেট অনিকেত, যাকে সে প্রতিদিন সিগারেটে একটি করে টান দেওয়ায়।

||দুই||

—এ বিষ্ণু, কিছু ভেবে দেখলি?

—প্রতিদিন ভাবি রে, একটা কবিতাও আসে না।

—আরে কবিতা না, আমার কথা কী ভাবলি?

—তোর কথা…আজ আবার শুরু করলি? তুই যে কালটু, তোর সাথে আমার যায় নাকি?

 

—নিজে তো আটার বস্তা। যা তোকে লাগবে না। এখনো তেরোটা অপেক্ষমাণ রেখেছি, একটা বেছে নিবো।

—নিস। চল কিছু খাওয়াও এখন।

—পারব না। তোকে খাওয়ায় কী লাভ?

‘চল আমি খাওয়াবো।’ বিষ্ণু অনির হাত টেনে নিয়ে গেল।

ক্যান্টিনে দু’জনে খাচ্ছে আর গল্প করছে।

—আগামী বই মেলায় একটা বই বের করবো, কিছু টাকা দিস।

—আমাকে বন্ধক রেখে কারো কাছে টাকা নিস।

—আচ্ছা।

—তুই আমাকে বন্ধক রাখতেও রাজি?

 

ক্যান্টিনের এক কোণায় রূপম একা এসে বসলো। দেখেই ডাক দিলো অনিকেত, ‘রুমমেট, আসো খাই।’

‘খাও তোমরা।’—বলে রূপম দ্রুত খেয়ে চলে গেলো।

—তোর রুমমেট টা বদলাবে না রে?

—না। তুই চেষ্টা করতে পারিস।

—কাজ নেই তো আর। তোর রুমমেট যা সিগারেট খায়। সিগারেট খাওয়া মানুষ আমার একদম অপছন্দ।

—তোর বর যদি বিয়ের পর সিগারেট খায়?

—সেদিনই ডিভোর্স।

—ঠিক আছে, তোকে কিছুই করতে হবে না। তুই শুধু ফোনে রূপম কে পটাবি। পারবি?

—কী দিবি?

—কী চাস?

—তোর বাসায় গিয়ে তোর মায়ের হাতের রান্না খাবো।

—ঠিক আছে। ফোন নম্বর নে। ও কিন্ত তোকে বিষ্ণু নামে চেনে।

—প্রিয়া নামে তো চেনে না?

—হু।

 

সন্ধ্যার পর। রূপম শুয়ে আছে; শরীর টা ম্যাজম্যাজ করছে। অনিকেত পড়ার টেবিলে; ফোন চাপছে। রূপমের ফোনে একটি অপরিচিত নম্বরের কল বাজছে। রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে, ‘আমি প্রিয়া বলছি, তুমি নিশ্চয় রূপম?’

 

—হ্যাঁ।

—ব্যস্ত?

—না। কী বলবেন সোজা বলুন।

—আমাকে তুমি করে বলতে পারো। তোমাকে ক্যাম্পাসে প্রায়ই দেখি।

—তো?

—তোমাকে আমার ভালো লাগে।

রূপম তড়িৎগতিতে ফোনটা রাখলো।

—রুমমেট, কে?

—আরে যত্তসব আজিব প্রাণী কই থেকে যে আসে। পিয়া না টিয়া, ক্যাম্পাসে দেখে ভালো লেগেছে। আজগুবি।

—সমস্যা কী? চালাও।

 

রুপম সিগারেট ধরিয়ে বললো, ‘তুমি বুঝবে না রুমমেট, এসব ভীষণ ক্ষতিকর।’

—সিগারেট কি ক্ষতিকর নয়?

—হু, শারীরিক। একজন নারী শারীরিক ও মানসিক একসাথে দু’ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

—রাজা আম্বুর না কার জানি তৃতীয় রাণী বলেছিলেন, ‘প্রতিটি সফল পুরুষের পিছনে একজন নারীর অবদান থাকে …’

 

অনিকেতের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রূপম বলে, ‘একজন নারী নয়, একজন সফল ও একনিষ্ঠ নারী।’

—যাই হোক, নারী তো?

—না রুমমেট, তুমি যাই বলো আমি জানি এরা কতটা সমস্যার বস্তু। কবি নজরুল কি সাধে বলেছিলেন,

‘নারী নাহি হ’তে চায় শুধু একা কারো,

এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা

চায় তত আরো!

ইহাদের অতিলোভী মন

একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়,

যাচে বহু জন।…’

অনিকেত আর রূপমের আজকের সন্ধ্যেটা কেটে গেলো এভাবেই। রূপমের শরীরের ম্যাজম্যাজ এখনো থামে নি। অনিকেত বিষ্ণু কে ফোন দিয়ে হেসে অস্থির, ‘আমার মা’র হাতের রান্না খাওয়া এত্ত সহজ!’

—ভালো হয়েছে, চুপ থাক।

—ঠিক আছে।

—কাল ক্যাম্পাসে আয়, একটা কথা আছে।

—কাল তো শুক্রবার, ফোনেই বল।

—শুক্রবার তাতে কী? আমি ডেকেছি, তুই আসবি।

—আচ্ছা।

রাতে টিভি রুমে বাবা-মেয়ে গল্প করছে। প্রসঙ্গক্রমে বিষ্ণুর বাবা বললেন, ‘যুবক বয়সে ফ্রেণ্ডরা মিলে ধূমপান করতাম। বিয়ের পর তোর মা’র জন্য আর হলো না। তুইও তোর মা’র মতোই হয়েছিস।’

—হু।

—ভাবছি শুরু করবো আবার…

—করে দেখো, বাসা থেকে বের করে দিবো তোমকে।

—তাই! আচ্ছা করবো না।

—মনে থাকে যেন। চলো খাবো এখন।

—চল…।

||তিন||

মাঝে তিনদিন বিষ্ণু অনিকেতের দেখা পায় নি। আজ হঠাৎ ক্যাম্পাসে দেখা ক্যাম্পাসের বড় বটগাছটার নিচে।

—এই তিনদিন কই ছিলি?

অনিকেত মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে।

—চুপ করে আছিস কেন, বল কোথায় ছিলি? ক্যাম্পাসে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি, কতবার ফোন দিয়েছি, তুই অন্তত ফোন টা রিসিভ করতে পারতি?

অনিকেত নিরুত্তর।

বিষ্ণুর কণ্ঠে উত্তেজনা, ‘প্রতিটা দিন জ্বালাতি ভালোবাসি বলে বলে। আজ চুপ করে কেন? জ্বালাও আমাকে, বল আজ কত ভালোবাসিস?’

অনিকেত নিশ্চুপ; চোখে জল।

—ভাবছিস প্রতিবারেই তো না বলি, তাই আর বলবি না। তোকে বলেছিলাম না, একটা কথা আছে। গত তিনদিন সেই কথাটি বলতেই এসেছিলাম, কিন্তু তুই নেই। শুনবি না আজ?

—বল।

—ভালোবাসি তোকে। আগের মতো ভালোবাসা নয়, এটা প্রেম। তোর আমার বিয়ে হবে।

অনিকেত চোখে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে বিষ্ণুর দিকে।

—কি রে কথা বলছিস না কেন, বাসবি না? বিষ্ণুকে তোর প্রিয়া বানাবি না?

অনিকেত গম্ভীর কণ্ঠে বললো, ‘না।’

—দুষ্টুমি হচ্ছে? ভাব নিচ্ছিস?

—না। তোকে অনেক ভালোবাসতাম, আর বাসি না।

বিষ্ণু মুহূর্তেই নিশ্চুপ হয়ে গেল।

—আমি তোর সাথে আর কখনই এভাবে বসবো না। তুই শুধু না, কোনো নারীর সংস্পর্শ আমি চাই না। আমি এখন থেকে ধূমপান করবো, দ্রোহের কাব্য লিখবো। আমি রূপম হবো।

অনিকেতের চোখে জল। বিষ্ণু নরম কণ্ঠে বললো, ‘চুপ কর অনি, কাঁদিস না। তোর কী হয়েছে, আমাকে খুলে বল প্লিজ।’

অনিকেত চোখ মুছলো। একটু পর ধিরে ধিরে বললো, ‘রূপম আর নেই, আমার রুমমেট মরে গেছে।’

দুজনেই চুপ।

একটু পর অনিকেত বললো, ‘ডাক্তার বলেছেন, অতিরিক্ত ধূমপানের ফলে ওর রক্ত দূষিত হয়েছিলো, ফুসফুস কাজ করছিলো না। কিন্ত আমি জানি ওর মৃত্যুর কারণ নারী। আমিও চাই না আমার জীবনে কোনো নারী আসুক। আমি ধূমপান করব। আর আমি জানি তুই ধূমপায়ীদের অপছন্দ করিস।’

বিষ্ণু কিছু না বলেই উঠে চলে গেল।

—বাবা, এটা তোমার জন্য।

—কী করব আমি?

—খাবে।

—তুই আমাকে সিগারেট খেতে বলছিস?

—হ্যাঁ, কোনো সমস্যা?

—না। তুইতো ধূমপান অপছন্দ করিস?

—আর করি না। ভেবে দেখলাম তোমার ধূমপান করা উচিৎ।

—আচ্ছা। দে দেখি…

দু’দিন পর। অনিকেত ওর রুমে শুয়ে আছে। রূপমের বেড, পড়ার টেবিল তেমনি আছে। টেবিলের ওপর পরে আছে মুখ খোলা একটি সিগারেটের প্যাকেট, দেয়াশলাই, ছাঁই, দুমড়ানো সিগারেট আর পোঁড়া কাঠি সহ অ্যাশ ট্রে।

কী যেন ভেবে বিষ্ণুকে ফোন করল। রিসিভ করল না। আবার দিলো, কেটে দিলো। আবার দিলো, রিসিভ করল। অনিকেত বলল, ‘কেমন আছিস?’

বিষ্ণু গম্ভীর কণ্ঠে বললো, ‘ভালো।’

—ক্যাম্পাসে আসবি না?

—না।

—সেদিনের জন্য সরি।

—তো?

—আমার মা’র হাতের রান্না খাবি না?

—না।

অনিকেত একটু চুপ থেকে বলল, ‘ভালোবাসি।’

ফোনটা কেটে গেল। আবার ফোন দিলো অনিকেত, কেটে দিলো। আবারো দিলো, বিষ্ণুর ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে।

অনিকেত রূপমের টেবিলের ওপর থেকে একটি সিগারেট ধরালো। টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তেই যেন হৃদপিণ্ড হতে বিষ্ণু নামটি উড়ে গেল।

ঈদ সংখ্যা - ২০২২
274 Views

প্রমথ রায়

২ মে, ২০২২ , ৫:৪৬ অপরাহ্ণ

এক টুকরো অস্থিমজ্জা এবং হারানো স্বপ্ন

পুরো আকাশ চাঁদের আলোয় ছেয়ে গেছে। পুরো আকাশ শুধু নয়, পুরো পৃথিবীও আলোকিত হয়েছে। ডেকোরেশনের রঙিন আলোও চাঁদের আলোয় ক্ষীয়মান। এ আলোয় জোনাকির মতো নেচে বেড়াচ্ছে ডা. আভার আনন্দে মাতাল মন । আজ তার  বিয়ে। দীর্ঘদিন পর ‘ব্রাইডাল প্যালেস’ কমিউনিটি সেন্টার পেয়েছে নতুন মাত্রা। করোনার পর এত বর্ণাঢ্যভাবে কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান হয়নি। আভা সবেমাত্র জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে গ্রাজুয়েশন শেষ করে। তাঁর বিয়ে হচ্ছে  ডা. ফয়সাল দস্তগির নামক একজন চিকিৎসকের সাথে। তিনি আভার বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটলোজী বিভাগের একজন প্রভাষকও। তাঁদের পরিচয় কিন্তু পড়াশুনা করতে গিয়ে নয়; বরং চিকিৎসা করাতে গিয়ে।

২০১৯ সালের শেষের দিক। একদিন হঠাৎ করে আভা রক্তবমি করে। পরে তার রক্ত পরীক্ষা করে জানা যায় তার রক্তে ক্যান্সারের জীবাণু লিউকেমিয়া বাস করছে। সাথে সাথে দুজন জাপানি ডাক্তারসহ ডা. ফয়সালের তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা চলতে থাকে। তার অসুস্থতা বাড়তে থাকে। সে প্রায় ফাইনাল স্টেজের কাছাকাছি। তার শরীরে আর রক্ত তৈরি হয় না। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করতে হবে। নাহলে তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হবে না। এ চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। তারপরও চিকিৎসা চলতে থাকে। কিন্তু অস্থিমজ্জা পাওয়া এত সহজ না। অনেক ঝামেলা। সারা বিশ্বের নামী হাসপাতালগুলোতে খোঁজ করা হলো। কিন্তু তবুও কোনো হদিস  মিললো না। যদিও একটা দুটা মিলে, শতভাগ ম্যাচ করে না। অবশেষে একজন ভারতীয় ডোনার পাওয়া গেল। নাম সুনীল বাজপেয়ী।  কিন্তু তার একটি শর্ত, আভাকে সারাজীবন এ ধরনের রোগীদের চিকিৎসার ব্যয় বহন করবে। আভা কথা দিলো সে এ রোগেরই চিকিৎসক হবে হবে বিনামূল্যে চিকিৎসা করবে। শুধু আভা নয়; ডা. ফয়সালও কথা দিলো , সেও একজন রক্তরোগের চিকিৎসক হিসেবে এ সেচ্ছাসেবী মহৎ কাজের দায়িত্ব নিবে। তখন সুনীলই প্রস্তাব দিয়েছিল তাঁরা  বিয়ে করলেই তো একসাথে তার স্বপ্ন সহজে পূরণ করতে পারবে। জীর্ণ মুখেও আভা হাসবার চেষ্টা করেছিল।

তারপর ধীরে ধীরে আভা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে। সুস্থ হয়ে ওঠে। গ্রাজুয়েশনও শেষ হয়। তারপর জাপানেই থেকে যায়। ফয়সালের সাথে সুন্দর দিন কাটতে থাকে, বেমালুম ভুলে যায় সুনীলের কথা। এবছর তাঁরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। আভার বাবার ইচ্ছে তাদের বিয়েটা বাংলাদেশেই হবে।

কাকতালীয়ভাবে আজই আভার মোবাইলে একটি ইমেল আসার শব্দ হয়। শারদ বাজপেয়ী নামে একজন ভদ্রলোক পাঠিয়েছেন। তাঁর মেইলের সারকথা হলো সুনীল বাজপেয়ী তাঁর বাবা এবং তিনি গতকালই মারা গেছেন। সম্ভবত আভাকে অস্থিমজ্জা দেয়ার কারণেই তিনি এত তাড়াতাড়ি মারা গেছেন। তার অনেক ইচ্ছে ছিলো তাঁর অস্থিমজ্জায় বেঁচে যাওয়া আভা তাঁর স্বপ্ন পূরণ করবেন। তাই জনাব শারদের অনুরোধ, আভা যেন তার বাবাকে দেওয়া কথা রাখার চেষ্টা করেন।

এক টুকরো মেঘ এসে চাঁদকে ঢেকে ফেলে। আভার মুখের হাসিও বিবর্ণ হয়ে যায়। একটু পর সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সে রাতে আর বিয়ে হলো না। পরের দিন হাসপাতালে জ্ঞান ফিরলে আভা সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে আর বিয়ে করবে না। সে সুনীল বাজপেয়ীর স্বপ্নকে আমৃত্যু বাঁচিয়ে রাখবে।

ঈদ সংখ্যা - ২০২২
220 Views