প্রতিষ্ঠা-বার্ষিকী Archives - মুগ্ধতা.কম

প্রতিষ্ঠা-বার্ষিকী Archives - মুগ্ধতা.কম

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৭:০৫ অপরাহ্ণ

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্য

ভাষা মানব সভ্যতার আদি বাহন। সময় ও সভ্যতার বিবর্তনে ভাষারও বিবর্তন ঘটে। একটি বিরাট জাতি একক মানবগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত হলেও অঞ্চলভেদে সে জাতির ভাষার মধ্যে তারতম্য পরিলক্ষিত হতে পারে। আর এ কারণেই প্রতিটি জাতি  তার আঞ্চলিক ভাষাকে সামনে রেখে পরিপূর্ণতা লাভ করে। সিলেট, ময়মনসিংহ, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চল ছাড়া বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকেই তাদের একমাত্র ভাষা বলে জানে। এতদসত্বেও বাংলাদেশ নামে ভূখন্ডে বসবাসকারী অসংখ্য বাংলাভাষী মানুষ সযত্নে লালন করছে নিজ অঞ্চলের ভাষার বৈশিষ্ট্যিকে। এক ভাষাভাষী জনগাষ্ঠী হয়েও অঞ্চলভেদে ভাষার তারতম্য অনেক ক্ষেত্রে এমন দাঁড়ায় যে , মনে হয় না তারা একই মানব গোষ্ঠীর, একই মূল ভাষার লোক। একটি ভাষা বহু সালের ধারাবাহিকতায় এবং বহু দেশি-বিদেশি প্রাচীন ভাষার সংস্পর্শে এসে পরিপূর্ণতা লাভ করে। আর এ কারণেই আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্যগুলো ঐ অঞ্চলে প্রচলিত প্রাচীন ভাষার হারিয়ে যাওয়া অস্তিত্বকে বহন করে চলে।

রংপুর বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত এক বিরাট ভূখণ্ড। শতভাগ লোকের ভাষা বাংলা হলেও আঞ্চলিক ভাষার অঙ্গনে রংপুরী ভাষার এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা এ এলাকার প্রাচীন ভাষার হারানো অস্তিত্বের ধারক ও বাহক। অনেক ক্ষেত্রে রংপুরী আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার রংপুরের বাইরের মানুষ অবজ্ঞার চোখে দেখে এবং বাহের দেশের মানুষ বলে অভিহিত করে। বাহে শব্দটি যতই অবজ্ঞার চোখে দেখা হোক না কেন ভাষার ব্যুৎপত্তিতে এর এক ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা বিরাজমান। এ প্রবন্ধে বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশের সাথে রংপুরী আঞ্চলিক ভাষার ঘনিষ্ঠতা ও প্রভাব সম্পর্কে আলোচনাসহ ‘বাহে’  শব্দের প্রচলনের উপর আলোকপাত করা হয়েছে।

বহিরাঞ্চলের মানুষের ধারণা ‘বাহে’ ব্যবহারকারী অঞ্চলের মানুষেরা বোকা। অমার্জিত আর সভ্যতার অগ্রযাত্রা থেকে পশ্চাৎপদ। বাস্তবে এ ধারণা অপূর্ণ এবং অসঙ্গত। রংপুর অঞ্চলের প্রচলিত ভাষার আছে রীতিসম্মত ধারাবহিকতা আর এ ভাষা বাংলা ভাষার আদি স্তরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। ‘বাহে’ শব্দটিও ধারাবাহিকতার ফল। ‘বাহে’ শব্দটি সাধারণত সম্বোধনসূচক। যেমন ‘কোটে গেছনেন বাহে?’ কি বাহে কেমন আছেন? সম্বোধন ব্যতিরেক বাহে শব্দের প্রয়োগ নেই তা নয়, তবে সংখ্যা খুব কম। ‘বাহে’- এ শব্দটি বাবা, মা, চাচা, চাচি, জেঠা, খালা, খালু, ফুফা, ফুফু এরকম সম্পর্কের বেলায় প্রয়োগ করা হয়। ‘বাপুহে’ এ শব্দটির বিবর্তিত, পরিবর্তিত বা সংক্ষিপ্ত রূপ ‘বাহে’। ভাই, ভাবি, দাদা, দাদি, নানা, নাতি, দেবর-ভাশুর, বোন, জা, ভগ্নিপতি এমন সম্পর্কে সম্পর্কিত যারা তাদের বেলায় বাহে শব্দটি প্রয়োগ হয় না। বাস্তবতা হলো ‘বাহে’ শব্দটির সাথে গভীর মমত্ব আর স্নেহের আন্তরিক অনুভূতির প্রকাশ সম্পর্কিত।

ভাষার ধারাবহিকতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলা ভাষার উৎপত্তি এবং বিকাশের সঙ্গে রংপুরের ভাষা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। বিশেষ করে মধ্যভারতীয় আর্যভাষা যেমন পালি, প্রাকৃত ও অপভ্রংশের সাথে (খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দী) রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার  গভীর অন্বয় খুঁজে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত আলোকপাত করা যায় – বাংলা ভাষার বিবর্তনের সংক্ষিপ্ত দিক সম্পর্কে। বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তুর্ভুক্ত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর গবেষণায় এ মূল ভাষার অস্তিত্ব ছিল আধুনিক খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে। খ্রিষ্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর আগে মূল ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু ভাষা জন্ম নেয়, যার মধ্যে অন্যতম প্রধান ভাষা আর্য। এর কাল ১২শ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। ভারতীয় আর্যভাষার স্তর তিনটি-

(১)          প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা- বৈদিক সংস্কৃত ( খ্রিষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দী থেকে থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী)।

(২)          মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা- পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ (খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী হতে খ্রিষ্টিয় দশম শতাব্দী পর্যন্ত)।

(৩)         নব্য ভারতীয় আর্যভাষা-বাংলা, হিন্দী, আসামী, মারাঠী (১০ম শতাব্দী মতান্তরে ১২শ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত)।

স্তর বিন্যাসগত দিক থেকে পালি স্তরের সাথে রংপুর অঞ্চলের ভাষার বহুবিধ সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। পালির মতো রংপুরের ভাষায় ‘স্থ’ জায়গায় ‘থ’ হয় ( স্থল- থল, স্থান-থান), ‘ষ্ঠ’ স্থলে ‘ট্ঠ’ (জ্যেষ্ঠ- জেট্ঠো), ‘ক্ষ’ হয় ‘খ’-( পক্ষী-পাখি, চক্ষু-চউখ), ‘ঋ’ স্থানে ‘ই’ (ঋষি-ইসি; মৃত্যু-মিত্যু), ‘ভ’ স্থানে ‘ব’ (লাভ-লাব, লোভ-নোভ), ‘থ’ স্থানে ‘টঠ্’(কোথায়- কোট্ঠে, সেথায়- সেট্ঠে) উচ্চারিত হয়ে থাকে। পালি ভাষার ন্যায়  ‘র্  ’ (রেফ)  উচ্চারিত না হয়ে বর্ণের দ্বিত্ব হয়। এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বর্জিত হয়। যেমন- বর্ষা-বস্সা, বর্ণ-বন্ন, চৈত্র-চৈত, কর্তা-কত্তা। রংপুরের ভাষায় আনুনাসিক ‘ঞ’ এর উচ্চারণ বহুল যা পালির সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত। উদাহরণ- কে-কাঞ, যে-যাঞ, তুই-তুঞ।

রংপুরের ভাষার সঙ্গে ‘প্রাকৃত’ স্তরের ভাষার নৈকট্য অধিক। প্রাকৃত এবং রংপুর অঞ্চলের কিছু শব্দ পাশাপাশি দেখলে বিষয়টি নিশ্চিত হবে।

প্রাকৃত                                                             রংপুর অঞ্চল

—-                                                                                    ——–

নঙ্গল                                                                               নাঙ্গল

হত্থী                                                                                 হাথী,হাত্তী

এত্তক                                                                              এত্ত

 

প্রাকৃতের আম্ভি, তুম্ভি প্রভৃতি রূপ রংপুরের স্থানীয় কবিগণের কাব্যাদিতে ব্যবহৃত হয়েছে। ক্রিয়াপদের দিক থেকেও ‘প্রাকৃত’ রংপুরের ভাষার নিকটবর্তী। প্রাকৃতে ‘অচ্ছি’র সঙ্গে অনেক ধাতু যুক্ত হয়ে ক্রিয়াপদ নিষ্পন্ন হয়। যেমন করোচ্ছে, করোচ্ছি, মারচ্ছে, মারচ্ছি ইত্যাদি। প্রাকৃত ‘করোম’ যা সর্বত্রই ভবিষ্যতার্থে ব্যবহৃত রংপুর অঞ্চলে এর ব্যবহার ‘করিম’ রূপে। এরকম-খাইম,যাইম, নেইম, দেইম, প্রভৃতি শব্দ ভবিষ্যতকালে প্রযুক্ত। প্রাকৃতে প্রথমা বিভক্তিতে ‘এ’ সংযুক্ত, এ নিয়ম রংপুরের ভাষাতেও বর্তমান। যেমন: রাজা ডাকে(রাজা)-এ ডাকে, চোর সব নিয়েছে- চোরে (এ) সউগ নিছে। প্রাকৃতের ন্যায় দ্বিতীয়াতে ‘ক’ বিভক্তির চিনহো যুক্ত হয়, যথা: তোক, মোক, হামাক,তোমাক। কারণ কারকে যুক্ত হয় ‘ত-দি’ যেমন -দাও দি হাত কাটচে, নাওত চড়ি আচ্চে। অধিকরণেও ‘ত’ যুক্ত হয়- হাতত পাইসা নাই, মাতাত তেল নাই, বাবা হাটত গেইচে। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদেও এরকম ‘ত’ এর প্রয়োগ দৃষ্ট হয়। যেমন:

‘টালত মোর ঘর নাহি পড়বেশী

হাড়িত ভাত নাই নিতি আবেশী।’

বাংলায় নিশ্চিত অর্থে ‘ই’ব্যবহৃত হয়। যেমন: আমরাই যাব, ভালো কাজটি তোমরাই করেছ। ‘ই’ এর পরিবর্তে রংপুরের ভাষায় সংযুক্ত হয় ‘এ’। যথা: হামরাএ যামো, কামটা তোমরাএ করচেন। বহুবচনে ‘ঘর,‘গুলা’ শব্দ যোগ হয়- ছাওয়ারঘর=ছেলেরা, পাখিগুলা=পাথিগুলো।

‘অসীৎ’ শব্দটির অপভ্রংশ ‘আছিল’। এ শব্দ রংপুরের ভাষায় অবিকল প্রচলিত- রহীমের একনা বেটা আছিল।    আছিল অর্থ ‘ছিল’-যা অতীতকাল জ্ঞাপক।

রংপুরের ভাষার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য বর্তমান বাংলা ভাষার সঙ্গে মিলযুক্ত। বাংলা ‘খেলা’, ‘বেলা’, ‘মেলা’, শব্দগুলো আদিবর্ণে একার-‘এ’ কার এর মতো উচ্চারিত না হয়ে খ্যালা, ব্যালা, ম্যালা এরকম উচ্চারিত হয়ে থাকে। রংপুর অঞ্চলের ভাষাতেও আদি বর্ণে এ-কার ‘এ্যা’ এর মতো উচ্চারিত হয়। যেমন: – শেষ- শ্যাষ , বেশ-ব্যাশ, কেশ-ক্যাশ। মধ্য কিংবা শেষ বর্ণে ‘’ে একারের উচ্চারণ অপরিবর্তিত – দেশে-দ্যাশে, শেষে-শ্যাষে।

রংপুর অঞ্চলের  আলোচিত বৈশিষ্ট্য হলো – ‘র’ স্থলে ‘অ’ এবং ‘অ’ এর স্থলে ‘র’ বর্ণের উচ্চারণ(ব্যবহার)। এ বৈশিষ্ট্য দীর্ঘদিনের এবং আঞ্চলিক উচ্চারণে স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহৃত।

এ বৈশিষ্ট্য রীতিগত দিক থেকে এরকম – ‘র’ বর্ণের সঙ্গে স্বরবর্ণ অ, আ, উ, ঊ,ও ,ঔ যুক্ত থাকলে ‘র’ এর পরিবর্তে ওই স্বরগুলোই অবিকল উচ্চারিত হয়। যেমন: রসি-অসি(র+অ),রাম-আম(র+আ), রূপবান-উপবান(র+উ),রোগ-ওগ(র+ও) ইত্যাদি। অন্যদিকে ঐ স্বরবর্ণগুলোর সাথে যদি কোনো ব্যঞ্জনবর্ণ যুক্ত না হয়ে থাকে এবং ওই স্বরগুলো একাকি শব্দের আদিতে থাকে তবে তাদের উচ্চারণ ‘র’ এর মতো হয়। যথা: আম-রাম, ওঝা-রোঝা, ঔষধ-রৌষধ। রংপুরের ভাষাতত্ত্ব কবিতায় রংপুরের বর্ষীয়ান  কবি মতিউর রহমান বসনিয়া লিখেছেন-

‘রংপুর হইলো অমপুর মোদের

আমি হইলাম মুই

আমরার বদল হামরা বলি

তুমির বদল তুঁই ।

রোদকে মোর অইদ বলি

ছায়াকে বলি ছ্যাঁয়া

গিন্নিকে মাইয়া বলি

কেমন মজার ভায়া।

————

কুল হইলো বড়াই ভাইরে

সুপারি হইলো গুয়া

রক্ত হইলো অক্ত মোদের

ফাাঁকা হইলো ধূয়া।

————

*অনেক নাটকে রংপুরের ভাষার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। একজন নারী হাটে নিজের ছাগল বিক্রি করলে অন্যরা মন্দ কথা বললে সে নারীর প্রতিবাদ- ‘মোর ছাগল মুই ব্যাচাইচো, তা সবার মুক কালা ক্যা—–’

*হাটে নারীর দোকান করা যাবে না। কিন্তু পরে নানা ঘটনার পর খাজনা পাবার আশায় ইজাদারের লোক বলে- -‘ভাল কবি ব্যাচাও ঠিকঠাক খাজনা দিবু। না হইলে আর দোকান দিবার পাবু না। কয়া দিনু কিন্তুক।

*নারীর উত্তর-: দেইম দেইম খাজনা ঠিকঠাকে দেইম। তোমারগুলাক চিন্তা করা নাইগবার নয়।’

রংপুরের ভাষার আছে এক সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডার। বাংলা ভাষার পাশাপাশি রংপুর অঞ্চলের ভাষা নানাভাবে নিজের বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। রংপুরের ভাষার কিছু বৈশিষ্ট্য বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে দৃষ্ট হয়। প্রাচীন কোনো কবি রংপুরের, এমন মত পোষণ করেন কোনো কোনো গবেষক । আবার ড. গ্রীয়ার্সন রঙ্গপুর, বগুড়া, দিনাজপুরের কতক অঞ্চল এবং সমগ্র কোচবিহার রাজ্যের জনগণের কথিত ভাষাকে রঙ্গপুর বা রাজবংশী ভাষা আখ্যা দিয়েছেন। ওই সমস্ত স্থানে প্রধানত রাজবংশী জাতিরই বাস আর তাদের কথিত সসীম রঙ্গপুর অঞ্চলের ভাষাকে রংপুরের দেশীয় ভাষা বলা হয়। বৌদ্ধ রাজারা রাজবংশী হিসেবে পরিচিত। এক সময় বঙ্গসহ অন্যান্য প্রদেশে পাল রাজত্ব ছিল। এদেশের বৌদ্ধ স্থপতি ছিলেন ধর্মপাল। ধর্মপালের সঙ্গে তার মৃত ভ্রাতা মানিক চাঁদের পত্নী ময়নামতির যুদ্ধের কাহিনী যুগীদের মুখে মুখে শুনতে পাওয়া যায়। ময়নামতি ও তাঁর পুত্র গোপীচন্দ্রের কাহিনী অবলম্বনে রচিত গানের প্রথম সংগ্রহ করেন জর্জ গ্রীয়ার্সন, ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর থেকে। ১৯০৭-১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য রংপুর থেকেই তিনজন যুগী ভিখারির কাছ থেকে সমস্ত পালাটি লিখে নেন । ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে , ময়নামতি গানের ভাষা পূর্ববর্তী যুগের প্রাকৃত প্রধান বাংলা। যেহেতু প্রাকৃত স্তরের সাথে রংপুর অঞ্চলের ভাষা নানা বৈশিষ্ট্যে নিকটবর্তী, ময়নামতির গানের ভাষার সঙ্গে রংপুর এলাকার ভাষার মিল থাকবে এটাই স্বভাবিক।

ময়নামতির কোট এবং ধর্মপালের গড় রংপুরের দুটি বিখ্যাত স্থান। এ তথ্য থেকে অনুমিত হয়  রংপুর জেলা ছিল বৌদ্ধদের শেষ লীলাভূমি। বঙ্গের অন্যান্য প্রদেশ হতে বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে পালিভাষা বিতাড়িত হলেও কামরূপে তা জায়গা করে নিয়েছিল। হিমাচলের পরপারে যাত্রা সময়ে এই ভাষার যে ক্ষীণ প্রতিধ্বনি তা থেকেই রাজবংশী ভাষার উৎপত্তি। অন্যান্য স্থানের মতো রংপুর অঞ্চলেও রাজবংশী ভাষা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিস্তৃত হয়। এ সূত্রেই পালি ও প্রাকৃত ভাষার সঙ্গে রংপুরের ভাষা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বর্তমানেও রাজবংশী ভাষার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লালিত হচ্ছে রংপুরের ভাষায়। এ ভাষায় রচিত হয়েছে মানিক চাঁদ ও গোপী চাঁদ রাজার গান, সত্যপীর, নিজাম পাগলা এমন কুশান গান, পালাগান, মাইষা যাত্রা, করিম বিলাপসহ আরও বহু রচনা।

রংপুরের ভাষার অনন্য সৃষ্টি ভাওয়াইয়া গান। উত্তরাঞ্চল থেকে সংগৃহীত অধিকাংশ ভাওয়াইয়া গানই রংপুর অঞ্চলের। রংপুরের প্রকৃতি, মানুষ, জীবনযাত্রা, সুখ, বিরহ-বেদনা, মিলন-বিচ্ছেদ ভাওয়াইয়া গানে মিলে মিশে একাকার। এ কারণে ভাওয়াইয়া গানে রংপুর অঞ্চলের কথ্য ভাষার ব্যবহার স্পষ্টতর রূপলাভ করেছে।  রংপুরের কথ্য ভাষার যাবতীয় বৈশিষ্ট্য ভাওয়াইয়ার ভাষায় ব্যবহৃত। ‘র’ এর বদলে ‘অ’ , ‘অ’ এর পরিবর্তে ‘র’ শব্দের আদ্যাক্ষরে  এ-কার  ‘এ্যা’ কার এর মতো উচ্চারণ ভাওয়াইয়ায় বহুল।

‘ পতি একনা (এ্যাকনা) কতা কনু হয়

বাপের বাড়ী নাইওর গেনু হয়

দিনা চারি পতি থাকিয়া আনু হয়। ’

এ ছাড়াও রংপুরের কোনো কোনো এলাকায় ক্রিয়া পদের শেষে ‘ব’ ধ্বনি ‘ম’ অথবা ‘প’ ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়।

‘কানাইরে

আমার বাড়ী যাইয়ো কানাই

বসতে দেমো (দেবো) মেড়া

দুই চরুত হেলানী দিয়া

বাজান গো দোতরা কানাইরে।’

রংপুরের কথ্য ভাষায় ‘ছ’ কে ‘চ’ উচ্চারণ করা হয়-

‘বুড়া মাচ (মাছ) মারে রে

ধইচ্ছে একটা(্এ্যাকটা) পুটি

দুই সতীন বুদ্দি করি

ধইচ্ছে বুড়ার টুটি।’

 

বাক ধ্বনি বিন্যাসে রংপুরী ভাষার শব্দের মধ্যে এবং শব্দের শেষে অতিরিক্ত ‘ই’ ধ্বনি উচ্চারিত হয়-

‘বাপই চ্যাগেরা রে

গচত চড়িয়া দুইটা হা

ও মোক জলপই পাড়েয়া হা দে।’

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার আরও বৈশিষ্ট্য:

ক. ক্রিয়া পদের আগে নঞ্চর্থক অব্যয়ের ব্যবহার: যেমন- না যামো, না নেমো, তোমর সাতে না যাই। চর্যাপদে এমন অনেক প্রয়োগ দৃষ্ট হয়-

*‘ভুসুকু ভনই মূঢ়া-হিঅহি ন পইসই॥’

*আপনা মাশে হরিণা বৈরী

খনহ ন ছাড়ই ভুসুকু অহেরী॥

*‘ দুলি দুহি ধরন ন যাই।’

খ. ব্যঞ্জন ঘোষধ্বনির অঘোষ অল্পপ্রাণ উচ্চারণ হয়- কাছ- কাচ, মাছ- মাচ, গাছ- গাচ, বন্ধু- বন্দু।

গ. শব্দের আদি, মধ্য ও অন্ত স্বরধ্বনির কিছুটা পরিবর্তন হয়- যৌবন- যৈবন, নুতন- নউতন।

ঘ. কখনো কখনো ‘দ’ ধ্বনি ‘ড’ উচ্চারিত হয়- দাড়িয়া – ডারিয়া।

ঙ. ক্রিয়া পদের অন্তে ং, ঙ, ঞ ধ্বনির সংযুক্ততা- নেও- নেং, যাই- যাং, শোনো- নোনোং।

ভাওয়াইয়াগানে -‘ ও মুই না শোনং না শোনং তোর বৈদেশিয়ার কতা রে।’

ধ্বনিতাত্বিক রূপতাত্ত্বিক ও শব্দতাত্ত্বিক হাজারো দৃষ্টান্তে প্রমাণ করা যায় যে , রংপুরের কথ্য ভাষার নিখুঁত ব্যবহার রয়েছে ভাওয়াইয়া গানে।

চ. শব্দের মধ্যে অতিরিক্ত স্বরবর্ণ – গেলে>গেইলে, (তোমরা গেইলে কি আর আসপেন? বোন>বইন(কাইল বইনের বাড়িত যাইম)।

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত অনেক কবিতা, ছড়া. নাটকে, গল্পে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে ষোড়শ শতকে নেজাম পাগলার কেচ্ছা’য় কবি মুহম্মদ কালা, পীরগঞ্জে ঝাড় বিশলার অষ্টাদশ শতকের কবি হেয়াত মামুদ, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার রচনায় রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রখ্যাত নাট্যকার নলডাঙ্গার তুলসী লাহিড়ী ‘ছেঁড়াতার’ নাটকে সফলভাবে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা উপস্থাপন করেছেন। এ ছাড়াও সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ কাব্য নাটকে, ছান্দসিক কবি নূরুল ইসলাম কাব্যবিনোদ ‘হামার অমপুর’ কাব্যগ্রন্থে, আনিসুল হক ‘নাল পিরান’ নাটকে, সিরাজুল ইসলাম সিরাজ ‘মরা মানুষের মিছিল’ নাটকে মকসুদুল হক এর গীতিনাট্য ‘শঙ্খমারীর ঘাট’, নাসিমুজ্জামান পান্না’র ‘নাকফুল’ নাটকে, মুহম্মদ আলীম ্উদ্দীনের ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে উপন্যাসসহ অনেকের লেখায় রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা বহুল ব্যবহৃত।

নুরলদীনের সারাজীবন কাব্যনাট্যে আঞ্চলিক সংলাপ কবিত্বময় ও জীবন্ত। নুরলদীন ও আম্বিয়ার সংলাপাংশ-

নুরলদীন-

‘এ দ্যাশে হামার বাড়ি উত্তরে না আছে হিমালয়

উয়ার মতন খাড়া হয় য্যান মানুষেরা হয়।

এ দ্যাশে হামার বাড়ি দক্ষিণেতে বংপোসাগর

উয়ার মতন গর্জি ওঠে য্যান মানুষের স্বর।’

আম্বিয়া-

‘….ঘোর চিন্তা আসে

চাটি অন্তরে পরাণে

অন্তরে কি হয় তার জংগে যদি পায় পতিধন

ইয়ার চেয় শান্তি যে নিজের মরণ।’

 

রংপুরের বিয়ের গীতেও রংপুরের উপভাষা বহুল ব্যবহৃত। গ্রামীণ নারীরা সমবেত অথবা একক কণ্ঠে গীত গায় বিয়ের বিবধ আনুষ্ঠানিকতায়।

* ‘ওরে হলুদি না হলুদি রে কাইনচা বাড়ির হলোদি

হলুদি না হলুদি রে বাঁশের তলার হলুদি।

কাঁয় আছে দরদী তাঁয় তুলবে হলুদি,

হামার দাদি আছে দরদি তাঁয় তুলবে হলুদি।

কাঁয় আছে দরদী তাঁয় বাটপে হলুদি,

হামার ভাবী আছে দরদি তাঁয় বাটপে হলুদি। ’

 

*‘অংপুরিয়া ডালা, তার মধ্যে কালা ডোরা

সই ডালা নাইরো না

এই ডালাতে আছে, সকিনা বিবির জোড়া

সই ডালা নাইরো না।

সেই ডালা দেকিয়া সকিনার মাও কান্দে বসিয়া

সই ডালা নাইরো না।’

 

ধ্বনিগত ব্যঞ্জনায়, বলিষ্ঠতায় এবং জীবন আদর্শ প্রকাশে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা গতিময় ও স্বতঃস্ফুর্ত। সাহিত্যেও এ ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। রংপুর অঞ্চলের জীবন-জীবিকা, ঐতিহ্য, সংগ্রাম, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যথাযথ তুলে ধরতে রংপুরের ভাষার বিকল্প নেই। এ ভাষা বাংলা ভাষা সমীক্ষায় সহায়ক, চলিত ভাষার রূপ এখানে সংরক্ষিত। এ ভাষার অনেক শব্দ সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়ে নতুন আবহ সৃষ্টি করতে পারে।

চলমানকালে অঞ্চলভেদে বদলে যাচ্ছে রংপুরের ভাষাগত রূপরীতি। ‘যাওয়া’ বিষয়ক বাক্যে কোথাও ‘যাওয়া নাগে’ কোথাও ‘যাওছি’ ‘যাওয়া খায়’ যাইছোল, যাচ্ছোল উচ্চারণ শ্রুত হয়।

শিক্ষা প্রাসারের কারণে মিশ্রণ ঘটছে শুদ্ধ বাংলার সাথে। শিক্ষিতের হার বৃদ্ধির জন্য রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার অনেকটাই হ্রাসমান, অন্যদিকে শিক্ষিতজন অনেকেই স্থানীয় ভাষা ব্যবহার মর্যদা হানিকর বিষয় ভেবে কুণ্ঠিত হন রংপুরের ভাষা ব্যবহারে। বাস্তবে এ কুণ্ঠা নিতান্তই অমূলক এবং আত্মশ্ল¬াঘার।  রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা গানে বা অন্যান্য রচনায় অধিক ব্যবহার করা দরকার, বাক্য বিনিময়েও আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ বিশেষ প্রয়োজন। রংপুরের ভাষা নিয়ে অধিক গবেষণা হওয়া সময়ের দাবী। উপভাষা সংরক্ষণে সিডি, অডিও , চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র নির্মাণ আবশ্যক। আয়োজন করা উচিৎ আঞ্চলিক ভাষায় বিতর্ক, কবিতা আবৃত্তি, বক্তব্য প্রতিযোগিতা।  শহর জীবনে শিশুদের রংপুরের ভাষা সম্পর্কে আলোকপাত করে তাদের এ ভাষা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা আবশ্যক। রংপুরের ভাষ্রা অভিধান রচনাও সময়ের দাবী।

কুণ্ঠার সব দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসা উচিৎ। যথাযথ গবেষণা ও অধিক চর্চায় মনোযোগী হলেই স্বচ্ছ হবে রংপুরের ভাষার আছে গর্বিত ভাষাতাত্ত্বিক ধারাবাহিকতা, আছে বিপুল শব্দসম্ভার। বাংলা ভাষা গঠনে এ ভাষার প্রভাবের কথা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ , দীনেশ চন্দ্র সেন প্রমুখ পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব নানা উদাহরণে প্রমাণ করেছেন। কাজেই কোনো দিক থেকেই উপেক্ষা করা যায় না রংপুরের আঞ্চলিক ভাষাকে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট দেশের উপভাষা অনুসন্ধান, সংরক্ষণ ও বিকাশে বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তার অংশ হিসেবে গত ১৩ নভেম্বর রংপুরে বিভাগীয় পর্যায়ে রংপুরের উপভাষা অনুসন্ধান, সংরক্ষণ এবং সাফল্য বিষয়ে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।  আশা কারা যায় এমন উদ্যোগ রংপুর অঞ্চলের উপভাষার সংরক্ষণ ও  বহুল ব্যবহার নিশ্চিত করতে অনবদ্য ভূমিকা রাখবে।

** রংপুরের কিছু আঞ্চলিক শব্দ ও আধুনিক বাংলা-

হামার>আমার, মুই>আমি, আকাল>অভাব. ঢ্যানা>অবিবাহিত যুবক, আইগনা/খুলি>উঠান, এত্তকোনা>এতটুকু, এমতোন>এমোন, ইতি>এদিক, উতি>ঐদিক, দুড়া>কচ্ছপ, কইতর>কবুতর, চুয়া>কুয়া, কস্টিয়া>কৃপণ, বাড়–ন>ঝাটা, ঠ্যাল>ডাল, গাবরু>রব,পাত্র, গুদাম>বোতাম, টেটিয়া>হিংসুটে,  নাাকারি,দাড়িয়াঘর,খানকা>বৈঠকখানা, চ্যাংড়া>ছেলে, চেংড়ি>মেয়ে, ছাওয়া, ছাওয়াল>সন্তান,  কোষ্টা>পাট,  রশি>দড়ি, বাাইগন>বেগুন, আন্দন>রান্না, বাড়ন>পরিবেশন, ধলা>সাদা, আকালি>মরিচ, ঢাংগা>লম্বা, ভোক>ক্ষুধা, আংগা,পিরান>জামা, আন্দারৎ>অন্ধকারে, দোপর>দুপুর, আইত>রাত, সাঞ্জেরবেলা>সন্ধ্যাবেলা, কাউয়া>কাক, চিলা>চিল, ভূঁই>ভূমি/জমি, মাইঞা>গিন্নি, তাংকু>তামাক, সুঁই>সুঁচ, চাইলোন>চালুনি, বড়াই>কুল, অক্ত>রক্ত, ধূয়া>ফাঁকা, দেওয়া>আসমান/আকাশ, ঝরি>বৃষ্টি, ধলা>সাদা, ঘাটা>রাস্তা, হেঁউত>আমন, ভ্যাটা>শাপলা, দলান>দালান,  ইচলা>চিংড়ি।

তথ্য সহায়তা:

ক. বাঙলা ভাষা (২য় খ- ) সম্পাদনা- হুমায়ুন আজাদ, বাংলা একাডেমি, প্রকাশক-মোাহাম্মদ ইবরাহিম-১৯৮৫।

খ. ভাষাতত্ত্ব- অতীন্দ্র মজুমদার।

গ. একুশের প্রবন্ধ’৯২- বাংলা একাডেমি-প্রকাশক- শামছুজ্জামান খান।

ঘ. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- মাহবুবুল আলম- প্রকাশক – এম.এ ফারুক, তৃতীয় সংস্করণ-১৩৯১।

ঙ. লোকসংস্কৃতি ২য় ও ৩য় সংখ্যা), সম্পাদক-ড. মুহাম্মদ আব্দুল জলিল, লোকসংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র, রাজশাহী- ১৪০২।

 

লেখক:

ভূতপূর্ব অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, কারমাইকেল কলেজ, রংপুর

**

1137 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৭:০৪ অপরাহ্ণ

উপভাষা, ভালোবাসা : রংপুরী ভাষা

ভাষা ভাব প্রকাশের মাধ্যম। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল বা ভূখণ্ডে বসবাসরত মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আবার, প্রত্যেক ভাষারই প্রমিত রূপের পাশাপাশি আঞ্চলিক রূপ বা উপভাষা রয়েছে। উপভাষা  হচ্ছে  প্রমিত ভাষার (ঝঃধহফধৎফ খধহমঁধমব) পাশাপাশি প্রচলিত অঞ্চলবিশেষের জনগোষ্ঠী কর্তৃক ব্যবহূত আঞ্চলিক ভাষা। পৃথিবীর সর্বত্রই প্রমিত ভাষার পাশাপাশি এক বা একাধিক আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা (উরধষবপঃ) ব্যবহৃত হযয়ে থাকে। প্রমিত ভাষার সঙ্গে উপভাষার ব্যবধান ধ্বনি, রূপমূল, উচ্চারণ ও ব্যাকরণগত কাঠামোর মধ্যে নিহিত থাকে। সাধারণত প্রমিত ভাষায় ভাষাভঙ্গির সংখ্যা বৃদ্ধি, ভৌগোলিক ব্যবধান এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসগত পার্থক্যের কারণে উপভাষার সৃষ্টি হয়। অঞ্চলভেদে স্থানীয় রীতি-নীতি, আচার-আচরণ ও পরিবেশগত কারণে একই ভাষায় ব্যবহৃত ও প্রচলিত শব্দ, শব্দের অর্থ ও উচ্চারণগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। কোন ভাষাকে আশ্রয় করে এরূপ সীমিত পরিসরে ব্যবহৃত শব্দ বা বাক্যসমূহই  উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে চিহ্নিত। প্রমিত ভাষা দেশের সর্বস্তরে ব্যবহৃত হয়; লিখিত পদ্ধতির ক্ষেত্রেও তা অনুসৃত হয়, কিন্তু উপভাষার ব্যবহার কেবল বিশেষ অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যেই সীমিত থাকে। তবে  কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাহিত্য ও সঙ্গীতেও উপভাষার সার্থক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।

বাংলা ভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাভাষী জনগণের অঞ্চলভেদে বাকভঙ্গির কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে।  বাংলা ভাষার  যেমন আছে পরিশীলিত প্রমিত রূপ, তেমনি  বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক আঞ্চলিক বাংলাভাষা বা উপভাষা প্রচলিত রয়েছে। বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো এর আঞ্চলিক ভাষার সৌন্দর্য। অসাধারণ সব শব্দের বিন্যাস দিয়ে বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষাগুলো আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। একই শব্দ কত রকমভাবে যে ব্যবহৃত হয় এবং তা মধুর শোনায়, তা শুধু প্রতিটি অঞ্চলে গেলেই দেখা যায় এবং শোনা যায়।

দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত রংপুর অঞ্চলেও পরিশীলিত ও মার্জিত বাংলা ভাষার সমান্তরাল আঞ্চলিক বাংলাভাষা বা উপভাষা  প্রচলিত রয়েছে। বিশেষ করে রংপুরের গ্রামাঞ্চলের মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এই ভাষা ব্যবহার করেন। রংপুরের এই আঞ্চলিক উপভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বিশেষ বৈশিষ্টম-িত। প-িতেরা ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে রংপুরের এই আঞ্চলিক উপভাষাকে উদীচ্য বা বরেন্দ্র উপভাষার  গোত্রভূক্ত  এবং ‘বঙ্গকামরূপী’ ভাষার উত্তরসূরী বলে চিহ্নিত করেছেন।

উল্লেখ্য, ভাষাবিদ সুকুমার সেন বাংলা উপভাষাসমুহকে প্রধানত ৫টি শ্রেণিতে  ভাগ করেছেন । যথা:

১.         রাঢ়ী উপভাষা

২.        বঙ্গালী উপভাষা

৩.        বরেন্দ্রী উপভাষা

৪.        ঝাড়খণ্ডী উপভাষা

৫.        রাজবংশী উপভাষা

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা এই শেষোক্ত  রাজবংশী উপভাষা গোত্রের অন্তর্ভূক্ত। এটি একটি ইন্দো-আর্য পরিবারভুক্ত বাংলার উপভাষা ভাষা। বরেন্দ্রী ও বঙ্গালী উপভাষার মিশ্রণে এই ভাষা গড়ে উঠেছে। রাজবংশী উপভাষা  পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার; আসামের বঙাইগাঁও, কোকড়াঝাড়, গোয়ালপাড়া, ধুবড়ী জেলা এবং বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের সব জেলায় প্রচলিত। এই উপভাষা  কামরূপী, বঙ্গকামরূপী, রংপুরি ভাষা নামেও পরিচিত। একে কেউ কেউ বর্তমানে পৃথক ভাষা হিসেবে গণ্য করেন। এই উপভাষার  একাধিক কথ্য রূপ প্রচলিত।

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার  উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য:

১.         অনুনাসিক বর্ণ রক্ষিত

২.        শ্বাসাঘাতের নির্দিষ্ট সহান নেই

৩.        অধিকরণ কারকে অ, এ, তে বিভক্তির স্থলে ‘ত’ বিভক্তির প্রয়োগ। যেমন- হাটে বুঝাতে হাটত, গাছে>গাছত, বাড়িতে>বাড়িত ইত্যাদি।

৪.        ক্রিয়াপদের আগে নঞ্চর্থক অব্যয়ের ব্যবহার যেমন- না শোনং, না যাইম, না খাইম ইত্যাদি।

৫.        শব্দের আদি ‘র’ ধ্বনির স্থলে অ’ এবং ‘অ’ ধ্বনির স্থলে ‘র’ এর ব্যবহার। যেমন- রাজা>আজা, রস>অস, রংপুর>অমপুর, রক্ত>অক্ত, আম>রাম, আইন>রাইন ইত্যাদি। এজন্যেই  রংপুরী ভাষায় ‘রামবাবুর আমবাগান’-এর উচ্চারণ হয়- আমবাবুর রামবাগান।

৬.        শব্দের আদি ‘ল’ এর স্থলে ‘ন’ এবং ‘ন’ এর স্থলে ‘ল’ ধ্বনির উচ্চারণ রংপুরের ভাষার আরা একটি উল্লে¬খযোগ্য বৈশিষ্ট্য।  যেমন- লাট>নাট,  লাল >নাল, লাগে >নাগে,  লবন>নবন ইত্যাদি।

৭.        ঘোষ ব্যঞ্জণ ধ্বনির অল্পপ্রাণ অঘোষ উচ্চারণ হয়।  যেমন গাছ>গাচ, মাছ>মাচ,বন্ধু>বন্দু।

৮.         শব্দের আদি, মদ্য ও অন্ত স্বধ্বনির পরিবর্তন হয়। যেমন- যৌবন>যৈবন, নুতন>নউতন।

৯.        আদি ও মধ্য ‘এ’ ধ্বনির ‘এ্যা ’ উচ্চারণ- দেখিয়া>দ্যাখিয়া, বিদেশ>বৈদ্যাশ।

১০.       ‘দ’ দ্বনির ‘ড’ উচাচারণ- দাড়িয়া>ডারিয়া।

১১.       অপিনিহিতর ব্যবহার: অদ্য > আইজ , কল্য > কাইল

১২.       শব্দের মধ্যবর্তী স্থানে অতিরিক্ত স্বরবর্ণের ব্যবহার, যেমন : গেলে > গেইলে, বোন > বইন।

১৩.      শব্দের মধ্যবর্তী ব্যঞ্জনবর্ণ লোপ : কহিল > কইল।

১৪.       ক্রিয়া পদের শেষে  ‘ঙ’, ‘ঞ’ ‘ং’ ধ্বনির সংযোগ-খাই>খাং, যাই>যাং,খাচ্ছি>খাইচোং, যাচ্ছি>যাওচোং,  শুনব> শোনং।

১৫.      ‘ছ’ এর ব্যবহার ‘চ’ রূপে : মাছ > মাচ।

১৬.      ‘জ’ এর স্থলে ‘ঝ’ এর ব্যবহার।

১৭.       অপাদান কারকে ‘হাতে’’, ‘টে’ বিভক্তির প্রয়োগ। ‘‘বইখান কারটে আনলু’’।

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার কতিপয় শব্দ :

অকে, অমপুর, অক্ত, আঙা, আন্দন, উদিনকা, আইগন্যা, ক্যাংকা, ফ্যাদলা, এইংকা, উন্দাও, বাইগোন, বাহে, সুন্দরী, তাংকু, দলান, ঢ্যানা, বাড়ুন, গাবরু, কাপাট, কইনা, এইকনা, ছাওয়া ইত্যাদি ।

এছাড়া, অনেক প্রমিত বাংলা শব্দের আঞ্চলিক উচ্চারণ বিশেষভাবে প্রচলিত । যেমন- অভাব/আকাল>মঙ্গা, অদ্ভূদ>আচাভূয়া, অবিবাহিত যুবক>ঢ্যানা, উলঙ্গ>উন্দাও, উঠান>আইগনা/খুলি,  এতটুকু>  এত্তকোনা/এ্যাকনা, এতে> ইতি, এমন>এমতোন, এরকম> এংকা,ঐদিকে>উতি, কনে>কইনা, কচ্ছপ>দুড়া, কবুতর>কতৈর, কূয়া>চুয়া, কেমন>ক্যাংকা, কৃপণ>কশটিয়া, চোয়ানো>ওশশে, ছেলে>চ্যাংরা, ঝাটা>বাড়–ন, ডাল>ঠ্যাল, ডিম>ফল,  দরজা>কাপাট,  দরজা>কাপাট, বর>গাবরু, বোতাম>গুদাম, বৈঠকখানা >খাংকা/ডারিয়াঘর,   মেয়ে> চ্যাংরি, সন্তান> ছাওয়া, শুপারি>গুয়া, হিংসুটে >টেটিয়া, বাপু-হে>বাহে, বেগুন>আইগন, পরিবেশন>পস্যন, রন্ধন>আন্দন,  সুপারি>গুয়া,  শেষ হওয়া> ওড়ে যাওয়া, হঠাৎ >হুমফাইট,   ক্ষুধা>ভোক   ইত্যাদি।

রংপুরের আঞ্চলিক উপভাষার উদাহরণ-

ক. ‘এ্যাকনা মাইনসের দুকনা ব্যাটা আছিল। তার  ছোটকোনা উয়ার বাপোক কইরো, বা, মোর পাইস্যা কড়ির বাগ মোক দেও। ওই কতাতে তাঁয় উমার ঘরোক সব বাটি দিলো।’

খ. ‘একদিন চেংটু আসি দ্যাওয়ানীক কইলো, ও বাহে দ্যাওয়ানীর ব্যাটা হাটাতো অমপুর যাই। হামার ঐ্যাকনা মোকদ্দমা আছে। দ্যাওয়ানী কইলো মুই আজ যাবার পাবার নও, হামার বাড়িত আইজ সাগাই আসপে।’

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণগত সহজবোধ্যতা, সাবলীলতা ও শ্রুতিমাধুর্য অসামান্য। রংপুরের এ ভাষাকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছে এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতি। রচিত হয়েছে এ অঞ্চলের লোকসাহিত্য ও সঙ্গীতের সুবিশাল সম্ভার। রংপুর অঞ্চলে প্রচলিত ভাওয়াইয়া, পালাগান,  লোককথা, মেয়েলী গীত, কিস্সা কাহিনী,  ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন  ইত্যাদিসহ লোকসাহিত্য ও সঙ্গীতের অন্যান্য শাখায়  আঞ্চলিক ভাষার সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে।  কেবলমাত্র লোকসাহিত্য ও সঙ্গীতেই নয় প্রাচীন ও মধ্যযুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের অনেক কবি-সাহিত্যিকও তাদের সাহিত্যকর্মে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার সার্থক প্রয়োগ  করেছেন।

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদের অনেক পদে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার রীতি ও শব্দের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।  যেমন-

‘টালত ঘর মোর নাহি  পরবেসী।

হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী ॥’ – (৩৩নং পদ, ঢেন্ঢপাদানম্)

অধিকরণ কারকে অ, এ, তে বিভক্তির স্থলে ‘ত’ বিভক্তির প্রয়োগ রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেমন- হাটোত, গাছোত ।

অন্যত্র-

‘অপনা মাংসে হরিণা বৈরী।

খনহ ন ছাড়ই ভুসুকু অহেরী ॥

তিন নছুবই হরিণা পিবই ন পাণী।

হরিণা হরিণীর নিলঅ ন জানী ॥

তরঙ্গতে হরিণার খুর ন দীসই।

ভুসুকু ভণই মূঢ়া-হিঅহি ন পইসই ॥’

-( ৬নং পদ, ভুসুকুপাদানম্)

ক্রিয়াপদের আগে নঞ্চর্থক অব্যয়ের ব্যবহার রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার  আর একটি বৈশিষ্ট্য  যেমন- না শোনং, না যাইম, না খাইম ইত্যাদি।

ষোড়শ শতকের কবি মুহম্মদ কালার  ‘নেজাম পাগলার কেচ্ছা’ কাব্যে ব্যব‎হত রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার নমুনা :

‘শুন পিতা কহি আমি তোমারো মোক্ষত

মনে মোর এহি সাদ কহিল তোমাত।

দিব্য এক সহানো চাইয়া মন্দির নিম্মাইব।

চাইর দিকে চাইর মন্দির মদ্ধে তো দলান

চাইর রাজকন্যাকে রাখিব আনিয়া

মন্ধেতো দলান ঘর বসিতা।

চাইর কন্যার ররৈস দেখিব নএ আনে।’

রংপুরের ভাষাতে বাক্য মধ্যে বিশেষ জোর বোঝাতে গিয়ে অনাবশ্যকভাবে “হ এ’ একটি পদ ব্যবহার করা হয়। কবি মুহম্মদ কালার  ‘নেজাম পাগলার কেচ্ছা’য়  এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন-

‘আজি কালির মইধ্যে যদিনা আইল হএ।

য় বোসে য়ভাগিনীর মরণ নিছ এ।

জলে ঝম্প দিআ নহে য়নলে পশিয়া।

নহে প্রাণ তাজিলায় হএ গরল ভক্ষিআ।’

অষ্টাদশ শতকের কবি  হেয়াত মামুদের রচনায় রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার অনেক শব্দ রয়েছে।  বেগম  রোকেয়ার রচনাতেও  রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার অনেক শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। নাট্যকার তুলসী লাহিড়ীর নাটক ‘ছেঁড়াতার’, সৈয়দ শামসুল হক এর নাটক ‘নুরলদীনের সারাজীবন’, নূরুল ইসলাম কাব্যবিনোদের কাব্য ‘হামার অমপুর’, আবুল কাশেমের গ্রন্থ ‘হামার দ্যাশ হারাগাছ’, সিরাজুল ইসলাম সিরাজের নাটক ‘মরা মানুষের মিছিল’, আনিসুল হক এর নাটক ‘নাল পিরান’, মকসুদুল হক এর গীতিনাট্য ‘শঙ্খামারীর ঘাট’, সাখাওয়াত হোসেনের  নাটক ‘বাহে নিধূয়া পাথার’, নাসিমুজ্জমান পান্নার ‘নাকফুল’, মুহম্মদ আলীম উদ্দিনের উপন্যাস ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ ইত্যাদিসহ বিভিন্ন গ্রন্থে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার  সফল প্রয়োগ ঘটেছে। মতিউর রহমান বসনীয়া ‘রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ রচনার পাশাপাশি অনেক কবিতা লিখেছেন এ ভাষায়। এ ধরণের নানা সাহিত্যকর্ম এবং রংপুর অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষার বিপুল শব্দসম্ভারকে আশ্রয় করে আবহমান কাল ধরে প্রবহমান রয়েছে  রংপরের সমৃদ্ধ  আঞ্চলিক ভাষা। সর্বোপরি, রংপুরের লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতি মূলত গড়ে উঠেছে এই আঞ্চলিক উপভাষাকে কেন্দ্র করেই।

উল্লেখ্য, আঞ্চলিক ভাষাই মূলত: মানুষের প্রকৃত মাতৃভাষা। আঞ্চলিক ভাষার মধ্যদিয়েই মানুষের সবধরণের অনুভুতি-অভিব্যক্তির স্বত:স্ফূর্ত ও স্বাভাবিক প্রকাশ ঘটে থাকে। সেই সাথে ভাষার প্রকৃত ও স্বাভাবিক প্রাণপ্রবাহ সচল থাকে তার আঞ্চলিক ভাষার মধ্য দিয়ে। প্রমিত ভাষার মূল কাঠামো গড়ে ওঠে মূলত: আঞ্চলিক ভাষাকে ভিত্তি করেই। আঞ্চলিক ভাষার ধ্বনি, রূপমূল, উচ্চারণ ও ব্যাকরণগত কাঠামোর মধ্যে নিহিত থাকে প্রমিত ভাষার মৌলিক উপাদান। একারণে ভাষাতাত্ত্বিকগণের কাছে আঞ্চলিক ভাষার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ম্যাক্সমূলার বলেছেন-ঞযব ৎবধষ ধহফ হধঃঁৎধষ ষরভব ড়ভ ষধহমঁধমব রং রহ রঃং ফরধষবপঃং. ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন- ভাষাতত্ত্বের অনেক জটিল সমস্যার সমাধান আঞ্চলিক ভাষার সাহায্যে হতে পারে। আঞ্চলিক ভাষাকে ভিত্তি করে রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা সাহিত্যিক প্রভাবে সাহিত্যের ভাষা গড়ে ওঠে। আঞ্চলিক ভাষাগুলোর মধ্যেই সাহিত্যিক ভাষার ইতিহাস বজায় থাকে। কিন্তু, আধুনিক সমাজ ও সংস্কৃতির দ্রুত প্রসার এবং  বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতির লাগামহীন অনুপ্রবেশের প্রেক্ষাপটে  রংপুরসহ অন্যান্য অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাগুলো নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলতে বসেছে। এর ফলে শুধুমাত্র আঞ্চলিক ভাষাই নয়; আমরা হারাতে বসেছি আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অমূল্য অধ্যায়কে।

রংপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য  অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও সুপ্রাচীন। এ জনপদের ইতিহাসের প্রাচীনত্ব ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিশেষ করে রংপুরের সহজ, সাবলীল ও শ্রুতিমধুর  আঞ্চলিক ভাষা এ অঞ্চলকে ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বিশেষত্ব দান করেছে। রংপুর অঞ্চলের এই ভাষাগত ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে  এ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা সংরক্ষণের  গুরুত্ব অপরিসীম।

বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিক ইচ্ছায় প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট অন্যান্য কার্যক্রমের সাথে আঞ্চলিক ভাষা সংরক্ষেণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এরই অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের ১৩ নভেম্বর রংপুরের আঞ্চলিক  ভাষা সংরক্ষণ বিষয়ে এক বিভাগীয় কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। কর্মশালায় রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা সংরক্ষেণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ লক্ষ্যে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্য ও সঙ্গীত চর্চার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপসহ বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, সংবাদপত্র ও অন্যান্য  গণমাধ্যমে এর ব্যাপক প্রচারের পাশাপাশি সরকারি ভাবেও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা সংরক্ষণে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।  #

তথ্যসূত্র :

১. রংপুর জেলার ইতহাস : রংপুর জেলা প্রশাসন।

২. রংপুর সংবর্তিকা : মুহম্মদ আলীম উদ্দিন।

৩. উইকিপিডিয়া।

৪. বাংলাপিডিয়া।

৫. ইন্টারনেটে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধ/নিবন্ধ।

954 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৭:০৩ অপরাহ্ণ

বিলীনপ্রায় উপভাষা ও কয়েকটি কবিতা

হারে গেতিচে হামার গেরামের দিনগুল্যা। হামার গ্রামের দিনগুল্যা- হারে যাওয়া মানে এই দেশোত গেরাম নিপ্যাত হয় য়্যা যাইবে। আরে হামরা যখন ছাওয়া- হামার এনায়েত পুর গেরাম থাকি নানার বাড়িত গেচনো- গরুর গাড়িত করি- সেই পীরগাছা তালুক ইসাদ গেরামে।আস্তার মাজোত ফির ঘাগোট নোদি পার হওয়া নাগচিল। এখন তো গরুর গাড়ি দুরের কতা- নদী বিলিন হতিচে। ইস! কি এক নাল দিনগুল্যা আচিলো- ভাইবোইনেরা আর মা সুদদ্যায় যখন গরুর গাড়িত ওঠনো- গাড়িত একখ্যান টাববোর। ফির টাববোর ঘিরি কাপড় প্যাচে দেচনো- যাতে আস্তার নোকজন না দ্যাখে। নানার বাড়িত থাকি ফির ফেরার সময় দুইট্যা পাকা কাটোল নেচনো। বাপরে বাপ- আস্তার নোকজন কাবরে কাবরে কইচিলো- বাহে কাটালটার সাদ আচে। মুই ফির চিলল্যায় কচনু- আইসেন বাহে খাবার। কতই ন্যা কতা মনোত পরে- গরমের দিন। আচিলো-ন্যা কারেন। আস্তার গাচের নিচোত শুতি- বাতাসের অপেককায় আচনো। হামার পারা পতিবেশি সবাই মিলি- কেউ পাটিত সুতি,  কেউ আস্তার দুগল্যা ঘাসের ওপোর। আর গল্প  কেচ্চা চলছে। আইত  হইলে চাননি রাইতোত আলোমোক ডাক দেচনো। আলোম দোতরা বাজায় ছিলো- আর মিল দিয়্যা দিয়্যা কতো কতা কইছিলো- কতা গুল্যা একেবারে সাদামাটা। হামরা কি হাসাহাসি। এদিকে ফির কাওয়ালি শুনি অনেকে চোখের পানি ফ্যালাইছিলো। কারো মরি যাওয়া ভাতারের কতা মনে পরছিলো, হায়রে সেই কাহিনি- ইলিজ্যার বাপ ফির এমন মনোযোগ দিয়্যা কাওয়ালি শুনছিলো- বিড়ি টানতে টানতে মোচোত নাগিল আগুন- ওই আসোরোত চিল্লায় উঠচিলো।

আইজক্যা দিন গুল্যা আর নাই। মাইস্যা এমন ব্যাস্ত হইছে- গেরামের সেই গাচগাচালি জংগল কিচু নাই। আরে সাগাই বাড়িত আসলে- হামরা সবাই মিলি ডেকি মুরগি দাবরে ধোরচে নো। মা এদিক পিয়্যাজ মরিচ কাটি নিচিল- হামরা গেরামের চেংরা মিলি ঢেকি মুরগি দাবারা-। মুরগি নাই ধরতে সাগাই সাইক্যালোত ক্রিং ক্রিং- হামরাও চায়য়্যা- সাতে একটা সাদা পলিথ্যানে গ্লুকোজ বিস্কুট। আজ এই বিস্কুট পানিত ভিজি ভিজি খাচনো – কি শান্তি। এখোন হামার গেরামো শোক কিচু হারি যাইয়্যা শহরের মতো হইচে। গেরামোত যায়য়্যা আগের মতো আর তিপ্তি পাওয়া যায় না। আরে যখন মুই ছোটো- পাটা  বারিত টু টু খ্যালচো নো। এদিকে অন্যদল খ্যালা শ্যাস করি চলি গেইচে- হামরা আচি পাটবারিত নুকি। আজোব ব্যাপার- সোইদ্যার সময় বাড়িত আসি- ঘরের কানচি দিয়া ঢুকি- যাতে মা টের না পায়। বারিত আসি- কোনোমোতে হাত মুখ ধুইয়্যা- সপোত বসি – পড়া শুরু- বাইরোত বসলে কুপ্যার আলোত পড়ব্যার বসচে নো।সোইনদ্যার পর পরেই ঘুমোত টুপি টুপি পরি গ্যাচনো।পিচোন থাকি মা আসি সেই পিটোন। একোন নাকি সোইলপোলোক পিট্যা যাবো-নায়।  একোন হামার গেরামোত যাইয়্যা দ্যাখো- থ্রি জি, ফোর জি নিয়্যা ব্যস্ত। একোন কার গেরাম গোনজোত থ্রিজির পিরিত চলে। আগে হামার পেরেম পিরিতির এমন টান আচিল- বাপরে বাপরে খেরি ঘরের মোকার থুরি খুলি-ঢুকচিলো। থাক নিয়্যা ফির পরের দিন বিচ্যার শাল্লিস। বাপরে বাপ- সেই বিচ্যার শাল্ললিসের কিততি দেখলে- সুনলে-এলাও মোর হাসি পায়। আহারে- সেই রাকোয়ালের পেরেম- আইল দিয়্যা গরুক ঘাস খাওইছিলো- আর এদিকে গেরামের  চেংরি- আস্তা হাটছিলো। আখাল হালুয়্যা পেন্টি দিয়্যা- সংকেত দিচিল্প- চিঠিক্যান হটে আঠিয়্যা কলা গাচের থোপোত থুইস।

আদিল ফকিরের কয়েকটি কবিতা

১. জেয়াপত

আইসো বাহে সাগাই, বইসো হামার বাড়িত

হাত পাংকার বাতাসে, গাইমো এ্যাকনা গিত

 

কুনদিন থাকি দেখিন্যা, মোনোত ভাসে পিরিত

গোসা হইছেন ক্যান বাহে, হামরা তোমার পিত?

 

তোমরা হামার এ্যাকনা সাগাই, আসমেন বেশি নায়োর

মনের কতা খুলি কমো, হামরা থাকমো তোইয়োর

 

আণ্ডা আনমো ডুগি আনমো, খামো এ্যাক সাতে

আরে তোমার হাত -হামার হাত, থাকবে এ্যাক পাতে

 

তোরা ক্যামা টেমকি থাকেন, বোজোনা কিছু

আরে  ফকির তোমার কি করিলো,উলট্যা নাগেন পিছু?

 

মুই হবার চাও সাদা মাইস্যা, থাকপ্যানায় সুদঘুস

তোরা ক্যান ফাস্কা কতা কয়য়া,করেন ফুসফুস

 

আরে এইতো আছি এইতো নাই, হামরা ভাই ভাই

হিংস্যাবিদেস সব ভুলি, আইসো এ্যাক সাতে খাই।

২. এনায়েতপুর

এইকন্যা মোর সোনার গেরাম

সোনা ঝকমক করে-

ধানের গায়োত ফোকলা হাসি

মণি মুকত্যা ঝড়ে।

 

এই গেরামের মরদ হামার

টিটুল নামে চেনে-

আইত দুপুরে ভ্যানের ওপোর

বউ-বধূ টানে।

 

দিন হইলে কাটে ধান

মোন উদ্যার ছাওয়া

কামের ঘোরে মাঠের টানে

যায়না যে পাওয়া।

 

মাইষ্যার জালায় চুপচাপ

সামসুম করি চলে

কতা কয় হিস্যাব করি

খোঁজে পান্তার জলে।

 

আর একন্যা কতা শোনো

বিয়্যা করচে গোরোত

সেইকন্যা সুইদ-ধ্যা কাম করে

মানায় ক্যামা সোগোত।

 

ধান মারে- ধান কাটে

টিটুল গায় গান

কামকন্নি কুল্যা ধরে

পিচকি খায় পান।

 

হায়রে টিটুল, নাইরে রুব্যাল

যদি থাকিল বাচি-

আইজ হামার সোনার গেরাম

করতো নাচানাচি।

৩. হামার গ্রাম

ছোটদের ধ্বনিতত্ত্ব

দাদু হামার পুরাতোন নোক, এ্যাকশো বচর বাচি

কততো গপপো শুনাইচেন, দুই এ্যাকটা কইম জাচি।

 

গপপো শুনি তোরা অবাক হইমেন, কি আর কইম ভাই

স্যারে স্যারে হইচিলো দুধ- আচিল নাকি তার গাই।

 

বস্তায় বস্তায় পাকা আম, পরি আচিল বাড়িত

দলে দলে সাগাই সোদোর, আসচিলো গরু গাড়িত।

 

এ্যাকসাতে গপপো গুজুব, কততো হাসাহাসি

রাইত হইলে কেচ্চা গপপো, সুতছিলো ঠাসাঠাসি।

 

আরে দাদার কতা কি আর কইম- মোরে চোখে দ্যাখা

সাপ খ্যালা দেখিয়া -নাকচিলো ভ্যাকাচ্যাকা।

 

সোইনধ্যা হইলে কাওয়ালি, আরো কতো গান

রাইত দুপুরে খেঁকশিয়ালি, দ্যাখে আকাশ চান।

 

এ্যালাও যদি দ্যাখপের চান, আইসো হামার গ্রামোত

হাসতে হাসতে হাপসি যাইমেন,মরি যাইমেন সরমোত।

 

এ্যালাউ হামার বউঝিরা, দীঘিত কাটে সাতার

মাঠোত হামরা কাম করি, যারা যারা ভাতার।

৪. উপভাষা

ক্যা বাহে তোরা ক্যামা সোগোত

আগা পাচা গোরোত

কিছুই তোমার বোঝো না

সোকটে বাজান খঞ্জনা।

 

বাতুল অ্যাকনা বাচাই করো

ছোয়াচ ওগ খারাপ বড়ো।

 

দ্যাখেন না গনেশের ব্যাটা

শোকটে নাগায় শুধু আটা

আরে হামার করি হামরা খাই

সুড়সুড়ি ক্যান তোমার ভাই।

 

তোমরা অ্যাকনা ন্যাকেন বেশি

তাই তো তোমার ফুসফুসি

দ্যাখেন না আতুসির মাও

এক্কেবারে ঊনিশ ছাও

তাও করে না ড্যাপড্যাপ

তোমার নাই ন্যাকতে পরে ছ্যাপ।

401 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৭:০২ অপরাহ্ণ

ভাষা ভাবনায় রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা

একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয়তা বনাম ভাষার প্রতি ভালোবাসার ক্ষেত্রে এক তাৎপর্যময় দিন। ১৯৫২ সালে রফিক, শফিক সালামসহ শহিদ ভ্ইায়েরা আমাদের যে মাতৃভাষার দাবিতে প্রাণ দিয়েছিল, তা ছিল আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের দাবি। পরবর্তীতে কানাডা প্রবাসী বাঙালি জনাব রফিক এবং সালামের মাধ্যমে ইউনেস্কো যে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে, তা হলো মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা হলেও আমরা কিন্তু মায়ের মুখ থেকে এ ভাষা শিখি না। আমরা মায়ের কাছ থেকে প্রথম আমাদের আঞ্চলিক ভাষা শিখি। এ ক্ষেত্রে রংপুরের  আঞ্চলিক ভাষা বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। ২০০৭ সালের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ১৫ মিলিয়ন মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষাকে রংপুরী ভাষা বলা হয়ে থাকে। এছাড়াও এটাকে বাংলাদেশে বাহে, বাংলা, কামতা, পলিয়া এবং ভারতে কামতাপুরী, দত্তা, গোয়ালপুরীয়া, কোচ, রাজবংশী বলা হয়ে থাকে।

রংপুরী ভাষা ভারতের অন্যান্য ভাষার মতো ইন্দো-আর্য ভাষা হতে উদ্ভূত। ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থে এ ভাষাকে কামরূপী ভাষা হিসেবে অভিহিত করেছেন। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, এ ভাষা কামরূপী উপ-ভাষার একটি বিভাষা। আবার অনেক নৃতত্ত্ববিদের মতে এ ভাষা বোড়ো ভাষার পরিবার গোত্র।

যেহেতু রংপুর এক সময় কামরূপের অন্তর্গত ছিল, তাই স্বাভাবিকভাবে এ ভাষার সাথে কামরূপের ভাষা মিল থাকতে পারে। কামরূপী ভাষা হলো অসমীয়া ভাষার গোত্র। অসমীয়া ভাষার অন্য গোত্রটি হলো গোয়ালপুরিয়া। ভারতে অনেকে রংপুরী ভাষাকে গোয়ালপুরিয়া ভাষা বলে থাকেন। এক সময় কোচ রাজা বিশ্বসিংহ গোয়ালপুরে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন এবং তিনি রংপুরও শাসন করেন। এরই ভিত্তিতে রংপুরী ভাষা কামরূপ ভাষার সমগোত্র তা যুক্তিযুক্ত।

যেমন- ‘এটা কাম আইসু’ এই কামরূপী বাক্যটিকে আমাদের রংপুরে বলে ‘একটা কামোত আসসুং’। এ থেকে পরিলক্ষিত হয় কামরূপের সাথে রংপুরী ভাষার মিলকরণ।

অসমীয়া ভাষার কথা যেহেতু আসলই, তবে চর্যাপদের ভাষাতেও কি রংপুরের ভাষার প্রভাব রয়েছে? ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, চর্যাপদের ভাষা ‘প্রাচীন বঙ্গ-কামরূপী ভাষা’। সুকুমার সেনও চর্যাপদের ভাষাকে অসমীয়া ভাষা বলে দাবি করেছেন। তাই অবশ্যই এখন আমাদের চর্যাপদের ভাষা নিয়ে গবেষণা করতে হবে।

অনেকের মতে রংপুরী ভাষা বোড়ো ভাষা গোত্রের। কথাটি একেবারই যুক্তিহীন নয়। আমরা রংপুরী ভাষায় ক্রিয়ার শেষে যেমন অনুস্বার (ং) বা ম ব্যবহার করে থাকি, তা বোড়ো ভাষারই প্রভাবিত রূপ। তাছাড়া তিস্তা নদীর নামটি এসেছে বেড়ো ভাষার ডি¯ডাং শব্দ থেকে। অনেকে রংপুরী ভাষাকে রাজবংশী ভাষা বলে থাকেন। রাজবংশীদের বিশাল একটি অংশ রংপুরে বাস করে। আর রাজবংশীরা হলো কোচ সম্প্রদায় থেকে বিবর্তিত সম্প্রদায়। কোচরা বেড়ো ভাষায় কথা বলে থাকেন। তাই রংপুরী ভাষা যে বোড়ো ভাষা গোত্রের নয়, তা বলা যাবে না।

এরপর রংপুরে আগমন ঘটেছে আরব, ইউরোপ, চীনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের শাসক, ব্যবসায়ী, ধর্মপ্রচারক ও পর্যটকদের। তাদের ভাষারও প্রভাব রয়েছে এ রংপুরী ভাষায়। কিন্তু আজ থেকে শতবর্ষ আগেও আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে রংপুরী ভাষা যতটা প্রবল ছিল, তা এখন আর পরিলক্ষিত হয় না। বর্তমান সময়ে এ ভাষার ব্যবহার অনেকটাই কমে গেছে। আমরা যত শিক্ষিত হচ্ছি, ততই ভুলে যাচ্ছি আমাদের এই প্রিয় ভাষাকে। অনেক মা বাবাই তাদের সন্তানকে তথাকথিত মুর্খতা থেকে দুরে রাখার জন্য এ ভাষা বলা থেকে বিরত রাখছেন। কিন্তু এ ভাষা বলাতো কোন মুর্খতা নয়। আমাদের এ ভাষার চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের দেশের বিভিন্ন আদিবাসীরা বাড়িতে এবং সমগোত্রের মানুষদের সাথে মাতৃভাষায় কথা বলে থাকেন। আমরাও কি আমাদের বাড়িতে কিংবা আমাদের অঞ্চলের মানুষদের সাথে এ ভাষায় কথা বলতে পারি না? এখন অনেক শিক্ষিত ও শহুরে পরিবারে এ ভাষার চর্চা হয় না। আমাদের রংপুরী ভাষার ওপর ইতিহাসবিদ মতিউর রহমান বসনীয়া ‘রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান ও প্রয়োগরীতি’ নামে একটি অভিধান লিখেছেন। আমরা এ অভিধানটি সংগ্রহে রাখলে খুব সহজেই আমাদের এ ভাষার চর্চা করতে পারব। আসুন আমরা আগামী ভাষা দিবস থেকেই আমরা এ প্রিয় ভাষাকে মৃত ভাষার কাতারে না ফেলে এ ভাষার চর্চা বৃদ্ধি করি।

তথ্যসূত্র :

(ক) রাজবংশী সমাজ ও সংস্কৃতি- ড. অসীত কুমার বিশ্বাস।

(খ) রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান ও প্রয়োগরীতি- মতিউর রহমান বস্নীয়া।

(গ) বিভিন্ন ইন্টারনেট লিংক।

476 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৭:০১ অপরাহ্ণ

ভাষা, উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা

সূচনা: ভাষা, উপভাষা এবং আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই৷ অনেকে মনে করেন মানুষ মনের ভাব প্রকাশের জন্য যে ইঙ্গিত করে, যে শব্দ উচ্চারণ করে কিংবা শারীরিক ভঙ্গী প্রকাশ করে তাই ভাষা৷ একই ভাষা যারা ব্যবহার করে তাদেরকে বলে একই ভাষাভাষী বা ভাষিক সম্প্রদায় (Language Community)। আমরা যারা বাংলা ভাষায় কথা বলি তারা সকলে বাংলাভাষী সম্প্রদায়ের অন্তর্গত।

সকলের বাংলা আবার এক নয়। ভৌগোলিক ব্যবধান, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সমাজগঠন, ধর্ম, পেশা ইত্যাদি কারণে এক এলাকার ভাষার থেকে অন্য এলাকার ভাষায় পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। ভৌগোলিক ব্যবধান বা অঞ্চল ভেদে ভাষার যে-বৈচিত্র্য তা-ই হলো উপভাষা। এ ভাষাকে আঞ্চলিক ভাষা-ও বলা হয়।

অর্থাৎ অঞ্চলভেদে বাংলা ভাষার প্রচলিত কথ্যরূপকেই আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা বলে।

ভাষা

অর্থবাহী বাকসংকেত যা মনের ভাব প্রকাশ করে ও একই সমাজের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে।

ভাষা ধারণাটির কোন সুনির্দিষ্ট, যৌক্তিক ও অবিতর্কিত সংজ্ঞা দেয়া কঠিন, কেননা যেকোন কিছুর সংজ্ঞা ভাষার মাধ্যমেই দিতে হয়। তাই ভাষার আত্মসংজ্ঞা প্রদান দুরূহ। তবে ভাষার একটি কার্যনির্বাহী সংজ্ঞা হিসেবে বলা যায় যে ভাষা মানুষের মস্তিষ্কজাত একটি মানসিক ক্ষমতা যা অর্থবাহী বাকসংকেতে রূপায়িত (বাগযন্ত্রের মাধ্যমে ধ্বনিভিত্তিক রূপে বা রূপে) হয়ে মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করতে এবং একই সমাজের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করে। মানুষ তার মনের ভাব অন্যের কাছে প্রকাশ করার জন্য কণ্ঠধ্বনি এবং হাত, পা, চোখ ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে ইঙ্গিত করে থাকে। কণ্ঠধ্বনির সাহায্যে মানুষ যত বেশি পরিমাণ মনোভাব প্রকাশ করতে পারে ইঙ্গিতের সাহায্যে ততটা পারে না। আর কণ্ঠধ্বনির সহায়তায় মানুষ মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবও প্রকাশ করতে সমর্থ হয়। কণ্ঠধ্বনি বলতে মুখগহ্বর, কণ্ঠ, নাসিকা ইত্যাদির সাহায্যে উচ্চারিত বোধগম্য ধ্বনি বা ধ্বনি সৃষ্টি হয় বাগ্যন্ত্রের দ্বারা। গলনালি, মুখবিবর, কণ্ঠ, জিহ্বা, তালু, দন্ত, নাসিকা ইত্যাদি বাক্প্রত্যঙ্গকে এক কথায় বলে বাগযন্ত্র। এই বাগযন্ত্রের দ্বারা উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনির সাহায্যে মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যমকে ভাষা বলে। সকল মানুষের ভাষাই বাগযন্ত্রের দ্বারা সৃষ্ট। তবুও একই ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টির অর্থ বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হতে পারে। এ কারণে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর জন্য আলাদা আলাদা ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের কণ্ঠনিঃসৃত বাক্ সংকেতের সংগঠনকে ভাষা বলা হয়। অর্থাৎ বাগযন্ত্রের দ্বারা সৃষ্ট অর্থবোধক ধ্বনির সংকেতের সাহায্যে মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যমই হলো ভাষা। দেশ, কাল ও পরিবেশভেদে ভাষার পার্থক্য ও পরিবর্তন ঘটে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থান করে মানুষ আপন মনোভাব প্রকাশের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বস্তু ও ভাবের জন্য বিভিন্ন ধ্বনির সাহায্যে শব্দের সৃষ্টি করেছে। সেসব শব্দ মূলত নির্দিষ্ট পরিবেশে মানুষের বস্তু ও ভাবের প্রতীক (Symbol) মাত্র। এ জন্যই আমরা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষার ব্যবহার দেখতে পাই। সে ভাষাও আবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়ে এসেছে। ফলে এ শতকে মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে যে ভাষা ব্যবহার করে, হাজার বছর আগেকার মানুষের ভাষা ঠিক এমনটি ছিল না। বর্তমানে পৃথিবীতে সাড়ে তিন হাজারের বেশি ভাষা প্রচলিত আছে। তার মধ্যে বাংলা একটি ভাষা। ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলা পৃথিবীর চতুর্থ বৃহৎ মাতৃভাষা। বাংলাদেশের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলাদেশ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ এবং ত্রিপুরা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের কয়েকটি অঞ্চলের মানুষের ভাষা বাংলা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশে বাংলা ভাষাভাষী জনগণ রয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ত্রিশ কোটি লোকের মুখের ভাষা বাংলা। ভাষা মানুষে-মানুষে যোগাযোগের প্রধানতম বাহন। ভাষার কতটুকু মানুষের কোন জন্মগত বৈশিষ্ট্য আর কতটুকু পরিবেশনির্ভর সে ব্যাপারে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানীদের মতভেদ আছে। তবে সবাই একমত যে স্বাভাবিক মানুষমাত্রেই ভাষা অর্জনের মানসিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়, এবং একবার ভাষার মূলসূত্রগুলি আয়ত্ত করে ফেলার পর বাকী জীবন ধরে মানুষ তার ভাষায় অসংখ্য নতুন নতুন বাক্য সৃষ্টি করতে পারে। এরকম অসীম প্রকাশক্ষমতাসম্পন্ন ভাষা একান্তই একটি মানবিক বৈশিষ্ট্য; মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণি এই ক্ষমতার অধিকারী নয়। প্রতিটি মানুষ ভাষা আয়ত্ত করার সহজাত বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেয় এবং ঐ মানুষটি যে নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পর্যায়ের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিবেশ-বেষ্টিত ভাষিক সমাজের অন্তর্গত, সেই সমাজে সে দৈনন্দিন ভাষাপ্রয়োগের মাধ্যমে তার নিজস্ব ভাষাজ্ঞান বিকশিত করে।

তুমি অন্য কারো ছাতিমফুল

ভাষা মূলত বাগযন্ত্রের মাধ্যমে কথিত বা “বলা” হয়, কিন্তু একে অন্য মাধ্যমে তথা লিখিত মাধ্যমেও প্রকাশ করা সম্ভব। এছাড়া প্রতীকী ভাষার মাধ্যমেও ভাবের আদান-প্রদান হতে পারে। ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো একটি ভাষিক প্রতীক এবং এর দ্বারা নির্দেশিত অর্থের মধ্যকার সম্পর্ক যাদৃচ্ছিক। একই বস্তু বা ধারণা কেন বিভিন্ন ভাষায় ভিন্ন ধরনের ধ্বনিসমষ্টি দ্বারা নির্দেশিত হয় (যেমন – একটি গৃহপালিত চতুষ্পদ প্রাণির নাম বাংলা ভাষায় “গরু”, ইংরেজি ভাষায় “Cow” কাও, ফরাসি ভাষায় “Vache” ভাশ্‌, ইত্যাদি কেন হয়), তার পেছনে একেকটি ভাষার বক্তাসমাজের ভেতর সমঝোতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রীতিনীতি ছাড়া আর কোনো কারণ নেই। মানুষের ভাষার সাথে অন্য প্রাণিদের যোগাযোগের “ভাষার” একটা বড় পার্থক্য হলো ভাষার সাহায্যে মানুষ বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে, যা প্রাণিরা পারে না। যেমন – মৌমাছিদের নাচ কেবল মধু আহরণের সুবিধার জন্যই কাজে লাগে। আর উল্লুক জাতীয় বানরদের ভাষিক দক্ষতা অন্যান্য প্রাণিদের চেয়ে বেশি হলেও বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে সামগ্রিকভাবে তাদের ভাষা একটি দুই বছরের মনুষ্য শিশুর ভাষার চেয়ে উন্নত নয়।

আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা:

উপভাষা  প্রমিত ভাষার (Standard Language) পাশাপাশি প্রচলিত অঞ্চলবিশেষের জনগোষ্ঠী কর্তৃক ব্যবহূত আঞ্চলিক ভাষা। পৃথিবীর সর্বত্রই প্রমিত ভাষার পাশাপাশি এক বা একাধিক আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা (Dialect) ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রমিত ভাষার সঙ্গে উপভাষার ব্যবধান ধ্বনি, রূপমূল, উচ্চারণ ও ব্যাকরণগত কাঠামোর মধ্যে নিহিত থাকে। সাধারণত প্রমিত ভাষায় ভাষাভঙ্গির সংখ্যা বৃদ্ধি, ভৌগোলিক ব্যবধান এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসগত পার্থক্যের কারণে উপভাষার সৃষ্টি হয়। প্রমিত ভাষা দেশের সর্বস্তরে ব্যবহূত হয়; লিখিত পদ্ধতির ক্ষেত্রেও তা অনুসৃত হয়, কিন্তু উপভাষার ব্যবহার কেবল বিশেষ অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যেই সীমিত থাকে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে বিভিন্ন উপভাষার সৃষ্টি হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় স্বতন্ত্র শ্রেণির প্রমিত ভাষা গড়ে উঠলেও ঢাকায় তা হয়নি; এমনকি ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী হওয়ার পরেও নয়।

বাংলাদেশের উপভাষাসমূহকে প্রধানত চার শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যথা: ১. উত্তরবঙ্গীয় দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া ও পাবনায় প্রচলিত উপভাষা; ২. রাজবংশী রংপুরের উপভাষা; ৩. পূর্ববঙ্গীয় (ক) ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা, বরিশাল ও সিলেটের উপভাষা, (খ) ফরিদপুর, যশোর ও খুলনার উপভাষা এবং ৪. দক্ষিণাঞ্চলীয় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও চাকমা উপভাষা। পশ্চিমবঙ্গের উপভাষাগুলি প্রধানত দু শ্রেণিতে বিভক্ত: ১. রাঢ়ী ও ঝাড়খন্ডী (দক্ষিণ-পশ্চিম বর্ধমান ও প্রেসিডেন্সি বিভাগের অধিকাংশ) এবং ২. বরেন্দ্রী ও কামরূপী (গোয়ালপাড়া থেকে পূর্ণিয়া পর্যন্ত)।

বাংলাদেশে উপভাষার বহুল ব্যবহারের জন্য উপভাষাভাষী ও প্রমিত ভাষাভাষীদের মধ্যে বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়।  বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনটি ভাষারীতি সমানভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সাধারণভাবে শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে লেখ্য ও কথ্যরূপে প্রমিত বাংলা, লিখিতরূপে ও পাঠ্যপুস্তকে সাধু/চলিত রীতি এবং বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষাভাষীদের মধ্যে মৌখিক ভাষারূপে উপভাষা ব্যবহূত হয়। প্রমিত বাংলা ব্যবহারকারীরা প্রমিত সাধু/চলিত রীতি ব্যবহার করে থাকে। উপভাষা অঞ্চল থেকে আগত ভাষাভাষীরা বাংলা ভাষার দুটি রূপ ব্যবহার করে। তারা বাড়িতে আঞ্চলিক রূপ এবং সর্বসাধারণের সঙ্গে ও শিক্ষার প্রয়োজনে সাধু/চলিত রীতিতে প্রমিত রূপ ব্যবহার করে। বর্তমানে অবশ্য সাধুরীতির ব্যবহার অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।

প্রমিত বাংলা ভাষা উপভাষায় কেমন রূপ লাভ করে তা একটি উদাহরণের মাধ্যমে বোঝানো যেতে পারে। যেমন ‘ছেলে’ শব্দটিকে বিভিন্ন উপভাষায় যেভাবে উচ্চারণ করা হয় তা হলো এরূপ: পো (মেদিনীপুর), ব্যাটা (মালদহ), বেটা (মানভূম), ছা (সিংহভূম), ছাওয়াল (খুলনা, যশোর), ব্যাটা ছৈল (বগুড়া), পোলা (ঢাকা, ফরিদপুর), পুত (ময়মনসিংহ), পুয়া (সিলেট), পুতো (মণিপুর), পোয়া (চট্টগ্রাম, চাকমা) এবং হুত (নোয়াখালী)।

অনেক সময় একই ভাষারূপ ব্যবহার করা সত্ত্বেও ব্যক্তি-বিশেষের উচ্চারণে স্বাতন্ত্র্যের সৃষ্টি হয়। এ ধরনের স্বাতন্ত্র্য সাধারণত শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা কিংবা পেশাগত কারণে হয়ে থাকে। ব্যক্তি-বিশেষে ভাষার এ রীতি ‘ব্যক্তি-বিশেষের বাক্রীতি’ (Idiolect) হিসেবে পরিচিত। অনেকে উপভাষার সঙ্গে অশিষ্ট ভাষার (Slang) সম্পর্কের উল্লেখ করলেও উভয় ভাষারীতির মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রথমত, উপভাষা বিস্তৃত অর্থে ব্যবহৃত হলেও অশিষ্ট ভাষা শুধু রূপমূলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দ্বিতীয়ত, অশিষ্ট ভাষার জীবনকাল স্বল্পমেয়াদি। তৃতীয়ত, অশিষ্ট ভাষা স্বেচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহৃত হয়, যেমন ‘গ্যাঞ্জাম’। এ ছাড়া সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে নারী-পুরুষের ভাষা, হিন্দু-মুসলমানের ভাষা, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের ভাষা এবং শহর ও গ্রামের ভাষার মধ্যেও পার্থক্য সূচিত হয়। উপভাষার বিশ্লেষণ এবং এর অভিধান ও মানচিত্র প্রণয়নের প্রাথমিক প্রস্ত্ততি হিসেবে উপভাষা জরিপ প্রয়োজনীয়। উপভাষার মানচিত্রে কোনো বিশেষ অঞ্চলের শব্দের উচ্চারণ এবং পার্থক্যসহ ধ্বনির রূপান্তর নির্দেশিত হয়ে থাকে। আঞ্চলিক অভিধানে একটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শব্দের বানান, উচ্চারণ, ব্যুৎপত্তি ও অর্থের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বাংলাদেশের  আঞ্চলিক ভাষার অভিধান ১৯৬৫ সালে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সম্পাদনায়  বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়।

আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষার সংজ্ঞা:

বিভিন্ন অঞ্চলে যে ভাষা প্রচলিত সেই ভাষাকে আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা বলে। যে ভাষা শিশু প্রাকৃতিক নিয়মে শেখে, যার লিখিত কোন ব্যাকরণ নাই, যে ভাষা অঞ্চলভেদে পরিবর্তিত হয় সেই ভাষাই আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা।

প্রায় ত্রিশ মাইল অন্তর এই পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এই পরিবর্তনে উচ্চারণ দোষ বা নানারকম ভুল থাকে। তাই নদীয়া বা পুরুলিয়া, চাটগাঁ ও ময়মনসিংহের ভাষায় যথেষ্ট ভিন্নতা পাওয়া যায়। আবার কুষ্টিয়ার সঙ্গে কোলকাতা, ত্রিপুরার সঙ্গে চট্টগ্রামের, সিলেটের সঙ্গে আসাম সংলগ্ন অঞ্চলের ভাষার ঐক্যও খুঁজে পাওয়া যায়।

বাংলা ভাষায় অসংখ্য উপভাষা রয়েছে। তাদের মধ্যে প্রধানগুলো হলো:

=> রাঢ়ি উপভাষা (উত্তর ও দক্ষিণ),

=> ঝাড়খণ্ডি উপভাষা,

=> বরেন্দ্রি উপভাষা (পশ্চিম),

=> কামরূপি উপভাষা (উত্তর ও পশ্চিম) ইত্যাদি।

একই আচার রীতিনীতি এমনকি একই সংরক্ষিত এলাকার একই গোত্র বা সমাজের মানুষের একই রকমের ছাঁদের প্রচলিত ভাষাই আঞ্চলিক উপভাষা। এটি ভাষার অন্তর্গত এমন একটি বিশেষরূপ যা একটি বিশেষ অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত থাকে এবং যার সঙ্গে সেই আদর্শ ভাষা বা সাহিত্যিক ভাষার ধ্বনির রূপগত পার্থক্য সৃষ্টি করে।

উপভাষা সম্পর্কে সুকুমার সেন বলেছেন, কোনো ভাষা সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছোট ছোট দলে বা অঞ্চলে বিশেষে প্রচলিত ভাষাছাঁদকে উপভাষা বলে।

পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই উপভাষা আছে। উপভাষায় রচিত প্রাচীন মৌখিক সাহিত্যই ‘লোক সাহিত্য’, উপভাষার শব্দাবলির মধ্যে রয়েছে একটি জাতির ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিকর সামাজিক পরিচয়, মূল্য মান ভাষার একান্ত আঞ্চলিক রূপটি আছে উপভাষাতেই, আছে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের প্রাধান্য, বিশেষ অঞ্চলের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ভাষা এবং অকৃত্রিম সারল্য। উপভাষার মধ্যে রয়েছে কোনো ভাষার মূলশক্তি।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ গ্রন্থে বলেছেন—ভাষার জীবন্তরূপ তাহার কথ্য ভাষায়। স্থানভেদে বাঙ্গালার কথ্যরূপ, নানাবিধ যেমন:

অঞ্চল—————————————আঞ্চলিক ভাষার নমুনা

খুলনা, যশোহর————– : অ্যাক জন মানশির দুটো ছাওয়াল ছিল।

মানভূম ——————— : এক লোকের দুটো বেটা ছিল।

রাঁচি (সরাকি) —————: এক লোকের দু বেটারাহে।

সিংহভূমি (ধলভূম)  ——— : এক লোকের দুটা ছা ছিল।

মেদিনীপুর (দক্ষিণ পশ্চিম) — : এক লোক্কর দুট্টা পো থাইল।

পূর্ণিয়া (সিরিপুরিয়া) ——- : এক ঝনের দুই পুআ ছিল।

মালদা   ——————— : য়্যাক ঝোন ম্যান্শের দুটা ব্যাটা আছ্লো।

বগুড়া ———————– : য়্যাক ঝনের দুটা ব্যাটা আছিল।

রংপুর ———————–: এক জন ম্যানশের দুইক্না ব্যাটা আছিল্।

ঢাকা  ————————: একন মানশের দুইডা পোলা আছিল।

ময়মনসিংহ ——————: য়্যাক জনের দুই পুৎ আছিল্।

সিলেহেট ——————– : এক মানুশর দুই পুয়া আছিল্।

কাছাড়————————: এক জন মানুশর দুগুয়া পুয়া আছিল্।

চট্টগ্রাম———————– : এগুয়া মানশের দুয়া পোয়া আছিল্।

নোয়াখালি ——————- : একজনের দুই হুত আছিল।

চট্টগ্রাম (চাকমা) ———— : এক জন তুন দিবা পোয়া এল্।

মণিপুর (মায়াং) ————-: মুনি আগোর পুতো দুগো আসিল্।

রংপুরী ভাষা:

প্রাচীন কামতাপুর অঞ্চলের কোচ-রাজবংশী জনগোষ্ঠীর ভাষা

রংপুরী (ভারত ও নেপাল এ কামতাপুরী বা রাজবংশী ) একটি ইন্দো-আর্য পরিবারভুক্ত বাংলার উপভাষা ভাষা। এ ভাষায় বাংলাদেশের রাজবংশী সম্প্রদায়, ভারত এবং নেপাল এর রাজবংশী, তাজপুরিয়া, নস্যশেখ, নাথ-যোগী, খেন সম্প্রদায়ের লোকেরা কথা বলে। বাংলা ভাষার প্রমিত রীতির ভিত্তি নদীয়া তথা পশ্চিমাঞ্চলীয় আঞ্চলিক বাংলা হওয়ায়, বাংলা ভাষার মূল রীতির সাথে এর যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। তবে এই ভাষাভাষী জনগণ কার্যত দ্বিভাষী। তারা রাজবংশী ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষা অথবা অসমীয়া ভাষায় কথা বলে।

কামতাপুরী:

কামতাপুরী/রাজবংশী /গোয়ালপাড়ীয়া (ভারত)

রংপুরী (বাংলাদেশ)

রাজবংশী (নেপাল)

রংপুরি ভাষার একাধিক কথ্য রূপ প্রচলিত। একে পূর্ব, মধ্য, পশ্চিম এবং পাহাড়ী (কোচ) এই চার ভাগে ভাগ করা যায়। এই ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্য রাজবংশী ভাষায় অধিকাংশ লোকে কথা বলে। ভাষা মোটামুটি একই রকম এবং এই ভাষায় কিছু প্রকাশনা আছে। পশ্চিমা কথ্যরূপে এলাকাভেদে পরিবর্তিত হয়। তিন কথ্যরূপের মধ্যে ৭৭-৮৯% মিল পাওয়া যায়। রাজবংশী ভাষা ৪৮-৫৫ ভাগ বাংলা, ৪৩-৪৯ ভাগ মৈথিলি এবং নেপালি শব্দ দ্বারা গঠিত।

ভাষা ও সংস্কৃতি:

রংপুরের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সাহিত্যকর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি সুপ্রাচীন ও বিভাসিত। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন এই রংপুর। বলা যায় প্রকৃতির রহস্যময়তায় নান্দনিক সৌন্দর্যে প্রকৃতির আদরণীয় হিল্লোলে ও প্রাণময়তায় ভরপুর রংপুর। অর্থাৎ ‘‘রঙ্গঁরসে ভরপুরএই রঙ্গপুর’’। (রংপুর জেলার আঞ্চলিক ভাষার উদাহরণ)এই রঙ্গরস শিক্ষা-সাহিত্য, সঙ্গীত, সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্য বিশেষ করে লোকসংস্কৃতি মিলিয়ে অনবদ্য। রঙ্গঁপুরের পরিবর্তিত রূপ রংপুর।বাংলাদেশের প্রাচীনতম অংশের নাম বরেন্দ্র বা রারেন্দ্রী। রংপুর (রঙ্গপুর) সমতল বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্তর্গত। পরবর্তী সময়ে যে অঞ্চল গৌড় অঞ্চল বলে পরিচিতি লাভ করে।প্রাচীন ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলে দেখা যায়, রংপুর (রঙ্গপুর) এর ভূমি সম্প্রসারিত ছিল গৌহাটি কেন্দ্রিক রাজ্য প্রাগজ্যোতিষপুরের অন্তর্গত।রংপুরের রঙ্গপুর নামটির নামকরণ এখনও চূড়ান্তভাবে বিতর্করহিত হয়নি। কেউ কেউ মনে করেন মহাভারতের সময়ে প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা ভগদত্তের রংমহলো ছিল রংপুরের এবং সেই রংমহলো হতে নাম হয়েছে রঙ্গপুর। কারো কারো মতে ভগদত্তের কন্যা পায়রাবতীর নামানুসারে নারীজাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্মভুমি পায়রাবন্দের নামকরণ হয়েছে।কেউ কেউ মনে করেন রংপুরের বস্ত্ররঞ্জনী কারখানা (Dying Industry) ছিল। পাট নির্মিত বস্ত্রে বা চটে রং করা হতো বলে রংপুরকে রংরেজপুর বলা হতো এবং তার পরিবর্তনে হয়েছে রঙ্গপুর (রংপুর)। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন রংপুরের নামকরণের ক্ষেত্রে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজীর অবদান গ্রহণযোগ্য। রঙ্গপুর শব্দটির ফার্সী শব্দ আর তাই সঙ্গত কারণে বখতিয়ার শাসন আমলে রংপুরের নাম রঙ্গপুর হয়েছে।রংপুর কালেক্টর ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে তা পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। ১৭৯৩ খ্রিঃ রংপুর কালেক্টর হতে বিচার বিভাগ আলাদা হলে একজন বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়।তিস্তা, ধরলা, যমুনেশ্বরী, ঘাঘট, আখিরা, বিধৌত রংপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং প্রাচীনত্ব ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ভাষাঃ মানুষের আবেগ, অনুভূতি, অভিব্যক্তি, চিন্তা, চেতনা সবকিছু প্রকাশের বাহন। তাইতো বলা হয়েছে ‘‘মানুষের কণ্ঠোচ্চারিত অর্থযুক্ত ধ্বনি সমস্টিই ভাষা’’। আর এ ভাষা পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদের ভিন্ন ভিন্ন। যেমন বাঙালি জাতির ভাষা বাংলা। এই বাংলা ভাষা ভারতীয় কথ্য ভাষার প্রাচীন প্রাকৃত (খৃ.পূ.৫০০) হতে গৌড়ীয় প্রাকৃতের মধ্য দিয়ে বাংলার জন্ম হয়েছে।বাংলা ভাষার যেমন আছে পরিশীলিত রূপ তেমনি অঞ্চল ভিত্তিক গ্রামীণ জনপদে প্রচলিত রয়েছে আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা।ভৌগোলিক কারণে হোক বা শারীরিক গঠনের জন্য হোক রংপুরের শিক্ষিতজনেরা বাংলাদেশের অনেক জেলার অপেক্ষা পরিশীলিত ভাষায় কথা বলতে পারেন। তাদের উচ্চারণে কোন বিকৃতি নেই, নেই অস্পষ্টতা। তারা অনায়াসে আঞ্চলিকতা সম্পন্ন ভাষা বা উচ্চারণ পরিহার করতে পারেন।ম্যাকসমূলার বলেছেন ‘‘The real and natural life of language is in its dialects’’. ভাষার প্রকৃত ও স্বাভাবিক জীবন তার উপভাষাগুলিতে। উল্লেখ্য বাংলাভাষাও তার ব্যতিক্রম নয়। রংপুরেও পরিশীলিত ও মার্জিত ভাষার সমান্তরাল রংপুরের প্রামাঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে।আঞ্চলিক ভাষা, যখন এ গ্রামাঞ্চলের জনপদে উদ্ভব হয়েছে নিঃসন্দেহে সে সময় হতে গ্রামীণ জনপদ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে আসছে। এ ভাষার উচ্চারণগত সহজবোধ্যতা, সাবলীলতা ও শ্রুতিমাধুর্য অসামান্য। আর এ আঞ্চলিক ভাষায় রচিত হয়েছে সাহিত্য-সঙ্গীত, প্রবাদ-প্রবচন, ছড়া, গীত ইত্যাদি যা মানুষের আনন্দের উপকরণ। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত সমৃদ্ধ সাহিত্যকর্মের মাত্র কটির নাম করা হলো, ষোড়শ শতকের কবি মুহম্মদ কালার নেজাম পাগলার কেচ্ছা , অষ্টাদশ শতকের কবি হেয়াত মামুদের রচনায় রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার অনেক শব্দ রয়েছে । বেগম রোকেয়ার রচনায় রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার শব্দাবলিও আছে । পরবর্তী সময়ে নাট্যকার তুলসী লাহিড়ীর ছেঁড়াতার, সৈয়দ শামসুল হক এর নুরলদীনের সারাজীবন, নূরুল ইসলাম কাব্যবিনোদেরহামার অমপুর, আবুলকাশেমের হামার দ্যাশ হারাগাছ, সিরাজুল ইসলাম সিরাজের মরা মানুষের মিছিল,আনিসুল হক এর নাল পিরান, মকসুদুল হক এর শঙ্খামারীর ঘাট, সাখাওয়াত হোসেনের বাহে নিধূয়া পাথার, নাসিমুজ্জমান পান্নার নাকফুল এবং মতিউর রহমান বসনীয়া রংপুরের ভাষার অভিধান ও অনেক কবিতা লিখেছেন এ ভাষায় ।

তাছাড়াও অনেকে রংপুরের ভাষা ব্যবহার করেছেন রচনায় এবং মুহম্মদ আলীম উদ্দীন তাঁর ‘রংপুর সংবর্তিকা’ গ্রন্থে রংপুরের ভাষা শিরোনামে প্রবন্ধ রচনা করেছেন । রংপুরের ভাষা উদীচ্য বা বরেন্দ্র উপভাষার গোত্রভূক্ত । এ ভাষার বৈশিষ্ট্য: ১)আনুনাসিক বর্ণ রক্ষিত,২)শ্বাসাঘাতের নির্দিষ্ট সহান নেই ৩)শব্দের আদিকে ‘র’ এর আগয় লোপ,যথা: রস= অস, রামবাবু= আমবাবু, রংপুর= অমপুর, রক্ত = অক্ত, ‘‘আমবাবুর রামবাগানে অনেক রাম পেকেছে’’। ৪) অধিকরণ কারকে ‘ত’ বিভক্তির প্রয়োগ। ‘‘বাবা বাড়িত নাই’’। ৫) অপিনিহিতর ব্যবহার: অদ্য> অহিজ, কাল্য>কাইল ৬) শব্দের মধ্যবর্তী ব্যঞ্জনবর্ণ লোপ: কহিল>কইল, ৭) ‘ছ’ এর ব্যবহার ‘চ’ রূপে: মাছ>মাচ ৮) শব্দের মধ্যবর্তী সহানে অতিরিক্ত স্বরবর্ণের ব্যবহার, যাকে মধ্যস্বরাগম বলা যায়, যেমন: গেলে>গেইলে, বোন>বইন ৯) ‘ল’ এর সহলে ‘ন’ এর আগম: লাট>নাট, লাগে>নাগে।

রংপুরের সাহিত্যকর্ম: অনেক বাংলা সাহিত্যের গবেষক ও ঐতিহাসিক বলেছেন যে বাংলা সাহিত্যের আদিনীড় রংপুর । রংপুরের ভাষার যেমন প্রাচীনত্ব আছে তেমনি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনত্বে্র রংপুরের অংশীদারিত্ব আছে । বাংলা ভাষা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ অর্থাৎ প্রাচীন বাংলায় রচিত ৫১টি পদ অখন্ডিত ৪৭ পদই বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন, রচয়িতা ২৪ জন কবি । ড. মুহষমদ শহীদুল্লাহর মতে যা রচিত হয়েছে ৭ম শতাব্দী হতে ১০ শতাব্দীর মধ্যে । আর এই পাণ্ডুলিপিটি ১৯০৭ সালে আবিস্কৃত হয়েছে নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থাগার হতে । আবিস্কারক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ।অনেকে মনে করেন চর্যাপদের কবিদের অনেকের পদচারনা হয়তো ঘটেছিল রংপুরে । ফলে চর্যাপদের ভাষা অনেক রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার শব্দও বিশেষত দেখতে পাওয়া যায় যেমন. টালত মোর ঘর/নাহি পরবেসী/ হাড়িত ভাত নাই নিতি আবেসী‘ তে’ বিভক্তির স্থলে ‘ত’ বিভক্তির প্রয়োগ রংপুরের ভাষার বৈশিষ্ট্য। তেমনি নঞক অব্যয়ের ব্যবহার ব্যবহার ক্রিয়াপদের আগে, যেমন, গাছের তেস্তুল কুম্ভীরে নক্ষত্র, রংপুরের উদাহরণ। না যাও, না খাও। শব্দ মোর, তোর, সুতি, পোহাই, ঘিন, খাল, ইত্যাদি শব্দ রংপুরেও ব্যবহৃত হয়। রংপুর হতে স্যার জর্জ গ্রীয়ার্সন আবিষ্কার করেছেন নাথ গীতিকা, মধ্যযুগের অনেক বিশিষ্ট কবি কাব্য রচনা করেছেন রংপুরে। তাঁরা হলেন কমললোচন, হরিশচন্দ্র বসু, হেয়াত মামুদ, শাকের খাদম, মুহম্মদ কালা, দ্বিজহরি, ধুরহানুল্লাহ, শরিয়তুল্লাহ।আধুনিক যুগের অনেক কবি সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন আর তারা হলেন, পন্ডিত যাদবেশ্বর, তর্করত্ন, জামাল উদ্দিন, রামনারায়ণ তর্করত্ন যিনি বাংলা মৌলিক নাটক ‘কুলিনকুল সর্বস্ব’ রচনা করেন এবং কুন্ডির জমিদার প্রদত্ত ৫০/- টাকা পুরস্কার লাভ করেন। হরগোপাল রায়, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া, অতুল গুপ্ত, অতুল প্রসাদ সেন, শেখ ফজলুল করিম, খেরাজ আলী, রবীন্দ্র নাথ মৈত্র, তুলসী লাহিড়ী, নুরুল ইসলাম কাব্য বিনোদ, সৈয়দ শামসুল হক, আশুতোষ দত্ত, মোতাহার হোসেন সুফী, মতিউর রহমান বসনীয়া, মহফিল হক, মোনাজাত উদ্দীন, মুহম্মদ আলীম উদ্দীন, মঞ্জু সরকার, আনিসুল হক, আব্দুল হাই সিকদার, সৈকত আসগার সহ আরো অনেক সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে অবদান রেখেছেন এবং এখনও অনেকে সাহিত্যকর্মে সচল আছেন।

লোক সাহিত্য ও সংস্কৃতি: (রংপুর জেলার আঞ্চলিক ভাষার উদাহরণ) লোক সাহিত্য ও লোক সংস্কৃতিতে রংপুরের অবদান অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আর এসব কর্মকান্ড সম্পাদিত হয়েছে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায়। আঞ্চলিকতার দিক দিয়ে ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালীর বিপরীত প্রান্তের লোকসঙ্গীত। ভাওয়াইয়া রংপুরের লোকসঙ্গীত ধারায় সর্বাপেক্ষা উজ্জবল ও সমৃদ্ধ শাখা। ভাওয়াইয়া সম্রাট আববাস উদ্দীন ১৯৫৪ সালে ভাওয়াইয়াকে বিশ্বদরবারে উপস্থাপিত করেন। ভাওয়াইয়া লোকসঙ্গীতের ধারায় এই অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদের বিভিন্ন পেশার মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-ভালোবাসা, বিরহ-বেদনাকে আশ্রয় করে লোকের মুখে মুখে রচিত এবং বিপুল আবেদনময় সুরে বাঁশি ও দোতরার মতো বাদ্যযন্ত্র যোগে গীত হয়ে আসছে।আঞ্চলিক নামানুসারে ভাওয়াইয়া ৫টি ধারায় বিভক্ত, ‘ভাব’ ‘ভাওয়া’, ‘বাওয়া’, ‘বাউদিয়া’ প্রভৃতি শব্দ হতে ভাওয়াইয়া শব্দের উৎপত্তি বলে গবেষকরা মতামত ব্যক্ত করেছেন। উল্লেখ্যযোগ্য জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া-১.ওকি গাড়িয়াল ভাই ২.কি ও কাজল ভোমরা ৩. তোরসা নদীর ধারে ধারে ৪. নাইওর ছাড়িয়া যেও মোর বন্ধু ৫. নদী না যাই ওরে বৈদ ৬.ফাঁন্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে।

রংপুরের মেয়েলী গীত/বিয়ের গীত: রংপুরের লোক সংস্কৃতি ও সঙ্গীতের ধারায় মেয়েলী গীত- বিয়ের গীত একটি উল্লেখযোগ্য । রংপুরের মেয়েলী গীত মেয়েলী আচার অনুষ্ঠানের অনেক বিষয় নিয়ে রচিত ও গীত। যেমন বিয়ে, সাধভক্ষন, অন্নপ্রাসন, নবজাতকের ক্ষৌ্র কাজসহ বিয়ের বিভিন্ন পর্বকে ঘিরে এই গীতগুলো রচিত এবং নৃত্যযোগে আনন্দমুখরতার মধ্যদিয়ে গীত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।রংপুরের লোক সঙ্গীতের ধারায় আরো আছে হুদমার গান, জগেরগান, যোগীর গান, গোয়ালীর গান, ক্ষ্যাপাগান, জারীগান, মালশা গান, পালাগান, বা কাহিনীগান লোকসঙ্গীত রংপুরের উল্লেখযোগ্য সঙ্গীত ধারা। এ ধারায় রয়েছে অসংখ্য পালাগান। যেমন, নসিমন সুন্দরীর পালা, গুনাইবিবি, অমমূলা কন্যা, নেকোবিবি, কলিরাজা, চিনুবিনু, আরো অনেক।রংপুরের লোকসঙ্গীতের ধারায় আছে, রংপুরের ভাষায় ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন, ধাঁধা (শিল্কা) এই সঙ্গে আছে লোক বিশ্বাস রংপুরের কারু শিল্প-চারুশিল্প প্রশংসিত অবস্থায় ছিল, আর এগুলো হলো: শতরঞ্চি, পাটশিল্প, রেশম, তাঁত, মৃতশিল্প, নকশীকাথা, বাঁশশিল্প, কাঠশিল্প, কাসা-পিতল, লোহা শিল্প, ঢেঁকি শিল্প ইত্যাদি।

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার একটি উদাহরণ – আমি ঢাকা যেতে চাই- ‘মুই ঢাকাত গেনু হয়’

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্য:

১) অনুনাসিক বর্ণ রক্ষিত

২ ) শ্বাসাঘাতের নির্দিষ্ট সহান নেই

৩) শব্দের আদিতে ‘র’ এর আগম ও লোপ, যথা: রস – অস, রাম বাবু – আম বাবু, রংপুর – অমপুর, রক্ত – অক্ত। ‘‘আম বাবুর বাগানোত ম্যালা রাম পাকছে।’’

৪) অধিকরণ কারকে ‘ত’ বিভক্তির প্রয়োগ। ‘‘বাবা বাড়িত নাই’’।

৫) অপিনিহিতর ব্যবহার: অদ্য > আইজ , কল্য > কাইল

৬) শব্দের মধ্যবর্তী ব্যঞ্জনবর্ণ লোপ : কহিল > কইল

৭) ‘ছ’ এর ব্যবহার ‘চ’ রূপে : মাছ > মাচ

৮) ‘জ’ এর স্থলে ‘ঝ’ এর ব্যবহার

৯) শব্দের মধ্যবর্তী স্থানে অতিরিক্ত স্বরবর্ণের ব্যবহার, যেমন : গেলে > গেইলে, বোন > বইন,

১০) ‘ল’ এর স্থলে ‘ন’ এর উচ্চারণ হয়। যেমন : লাট > নাট, লাগে > নাগে

১১) অপাদান কারকে ‘‘হাতে’’, ‘‘টে’’ বিভক্তির প্রয়োগ। ‘‘বইখান কারটে আনলু’’।

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার কতিপয় শব্দ :

অকে, অমপুর, অক্ত, আঙা, আন্দন, উদিনকা, আইগন্যা, ক্যাংকা, ফ্যাদলা, এইংকা, উন্দাও, বাইগোন, বাহে, সুন্দরী, তাংকু, দলান, ঢ্যানা, বাড়ুন, গাবরু, কাপাট, কইনা, এইকনা, ছাওয়া ইত্যাদি ।

উপসংহার: ভাষা হলো প্রাতিষ্ঠানিক/দাপ্তরিক/নাগরিক সমাজ অথবা বলা যেতে পারে একটি বৃহৎ ভৌগলিক জনগোষ্ঠীকে পারষ্পরিক মিঁথস্ক্রিয়া সম্পাদনের জন্য যে প্রক্রিয়ায় নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করে তাকেই বোঝায়৷ আমরা যাকে প্রমিত ভাষা বলি৷ আঞ্চলিক ভাষার অপর নাম উপভাষা। আমাদের প্রতিটি জেলার ভাষাই বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং নিজস্ব উপভাষা রয়েছে। উপভাষায় কথা বলা মোটেও দোষের নয়। উপভাষা হলো মায়ের মতো। মাকে আমরা শ্রদ্ধা করি, নিজ-নিজ উপভাষাকে আমাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে হবে। আমরাও চেষ্টা করব রংপুরের আঞ্চলিক ভাষাকে সম্মান করতে৷

তথ্যসূত্র:

* উইকিপিডিয়া৷

* বাংলাপিডিয়া৷

* আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ৷

* ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ গ্রন্থ৷

* www.myacademybd.com

* ফেসবুক পোস্ট৷

* বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, রংপুর জেলা৷

* রংপুর জেলার ইতিহাস – জেলা প্রশাসন (২০০০ সাল)৷

* রংপুর সংবর্তিকা – মুহাম্মদ আলিম উদ্দিন৷

* সুরেন্দ্র চন্দ্র রায় চৌধুরী (জীবনীগন্থ) – সুশান্ত চন্দ্র খাঁ৷

* রঙ্গপুর-রংপুর, ইতিহাস থেকে ইতিহাসে – মোস্তফা তোফায়েল।

* রিয়াদ শুভ৷

* My syllabus notes.

* এনসিটিবি,৬ষ্ঠ শ্রেণি, বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি, ১ম অধ্যায়-ভাষা ও বাংলা ভাষা

1413 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৬:৪০ অপরাহ্ণ

ভুঁইপুত্র

পরান গহীনে ম্যালা কষ্ট লোহিত, ম্যালা কষ্ট

হু হু করি ওঠে পেরান

কষ্টগুলা উতলি উতলি ওঠে

কাক কঁও পেরানের কতা

হাকাউ কাঁয় শোনে কার কতা

মানুষ কান্দে, মানুষ শোনে না

মানুষ কোন্টে-

মানুষ নাই-মানুষ নাইরে-মানুষ নাই।

 

ভুঁইপুত্র মুই- মানুষ কাড়ি নেয় মাইনসের ভুঁই

তুফান আইসে-

পাষাণ ভাঙি খান্ খান্ হয়্যা যায়

তুফান মাইনসের ঘর-বাড়ি ভাঙে

মানুষ মাইনসের ঘুম কাড়ি নেয়

জয়তু জয়তু কয়া জিতার নিশান উড়্যায়

হামার বুকখ্যান ফাঁটি চৌচির হয়্যা যায়

মানুষ আছিল-রে, মানুষ আছিল-

মানুষ চলি গ্যাইছে আসমানোত

কাঁয় আর ডাকাইবে জাইগব্যার

“কোন্টে বাহে জাগো সগায়” ।

 

মানুষ নাই বাহে, মানুষ নাই

ভুঁইপুত্র মুই- মাইনসে খায় মাইনসের ভুঁই

পরাণ গহীনে ম্যালা কষ্টরে সাকিল, ম্যালা কষ্ট

বুকখ্যান খাঁক হয়্যা গ্যাইছে

খাঁক হয়্যা গ্যাইছেরে, খাঁক হয়্যা গ্যাইছে…

430 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৬:৪০ অপরাহ্ণ

এ্যামোন হামার দ্যাশ

গরোম যাইবে ঝরি যাইবে আসপে কাটা মারি,

নয়া ধানের পিঠা পোলাও বানাইবে বাড়ি বাড়ি।

নবান করবে সগায়গুলা সগার মনোত সুখ,

ফুত্তিতে সগারগুলার উচা হইবে বুক।

 

কারো ঘরোত মঙ্গা নাই হাসি খুশী মন,

সগায়গুলার সগায় হামরা খুবই আপন জন।

সকাল সকাল উঠি হামরা কাজ কামোত যাই,

ভাই-ভাতিজা সগায় হামার ছোট বড় নাই।

 

কাঁয়ো করি হাল গৃহস্তি কাঁয়ো নেকা পড়ি,

সগায় মিলি হামরাগুলা সোনার দ্যাশ গড়ি।

আশিন কাতি আসলে ফির কাম থাকেনা কারো,

বসি বসি থাকে সগায় বসি থাকে আরো।

 

আগন পুষ কাটামারি ধান কাটার ধূম,

বউ ভাতিজি বানে বাড়া কারো চোকোত নাই ঘুম।

আগনা খুলি পোয়ালপুজ কানচাত পালং শাক,

শুকটা শেদল ভত্তা দিয়া তাকাই হয় পাক।

 

সুখের দিন মঙ্গা নাই আসলে কাটামারি,

চাইরোপাকে খাবার জিনিস যায় যে গড়াগড়ি।

সোনামিঁয়া, ফজর আলী আর ছলিমুদ্দীন পাঁঠা,

প্রতোক দিনে ফ্যালায় ওমরা মিঁয়া বাড়িত ঘাটা।

 

হুঁকা খায় ছিলিম টানে আরো খায় বিড়ি,

কামোত নাই,অকামোত সগটে হুড়াহুড়ি।

এ্যাগলা হইলো হামার দ্যাশের নকশা ছবি ভাই,

কোনো দ্যাশোত হামার গাঁয়ের নাই তুলনা নাই।

 

বারো মাসোত ছয় ঋতুতে নানান রকম খ্যলা,

এ্যামোন করি হামারগুলার কাটি যায় ব্যলা।

সগার চ্যায়া কাতি আগন এ্যাকনা মজার দিন,

দিন যায় কাজ কামোত আইতোত পারি নিন।

 

শব্দার্থঃ

*এ্যামোন-এই রকম,যা দেখিতেছেন। দ্যাশ-দেশ। যাইবে-যাবে। ঝরি-বৃষ্টি। আসপে-আসবে। কাটামারি-আমন ধান কাটা বাড়িতে আনার মৌসুম। বানাইবে-তৈরি করবে। নবান-নবান্ন। সগায়গুলা-সকলে,সবাই। সগার-সবারেই। মনোত-মনের মধ্যে। ফুর্তিতে – আনন্দে। উচা-উঁচু। হবে-হবে।

 

*কারো-কাহারও। ঘরোত-ঘরে। মঙ্গা-দুর্ভিক্ষ। কামোত-কাজে।

 

*কাঁয়ো-কেহ। হাল গৃহস্তি-চাষাবাদ। নেকাপড়ি-লেখাপড়া। মিলি-এক সাথে। আশিন-আশ্বিন মাস। কাতি-কার্তিক মাস। আসলে-আসা। ফির-আবার। কাম-কাজ। কারো-কাহারও। বসি বসি-অলস সময়,কাজ নাই।

 

*আগন-অগ্রহায়ণ মাস। পুষ-পৌষ মাস। বানে বাড়া-ঢেকিতে ধান ভানা। চোকোত-চোখে। আগনা-ভেতর ঘরের উঠোন। খুলি-বাহিরের উঠোন। পোয়ালপুজ-খড়ের গাদা। কানচাত-ঘরের পিছন দিক। শুকটা-শুকটি মাছ। শেদল-রংপুর অঞ্চলের একটি তরকারি,শুটকি ও কালো কচু দিয়ে তৈরি। তকাই-তরকারি,আনাজ। পাক-রান্না।

 

*চাইরোপাকে-চারদিকে।  জিনিস-বস্তু। গড়াগড়ি-প্রচুর,অনেক। পাঁঠা-এখানে দুষ্টলোক,যে বেশি বেশি লোকের সাথে ইতরামি করে ( ছাগলের পাঁঠা নয়,বিদ্রুপাত্মক )  প্রতেকদিন-প্রতিদিন,প্রত্যহ। ফ্যালায়-পা ফেলে। ওমরা-তাহারা। বাড়িত-বাড়িতে। ঘাটা-রাস্তা। *ছিলিম-কলকি। টানে-সেবন কালে জোর টান ( সেবন করা ), অকামোত-যা কাজ নয়,বাজে কাজ,কুকর্ম। সগটে-সব জায়গায়,সব খানে। হুড়াহুড়ি-অহেতুক আস্ফালন। এ্যাগলা-এইগুলো,এইসব। হইলো-হলো। হামার-আমাদের।

 

*মাসোত-মাসে। এ্যামোন-এই রকম। খ্যলা-খেলা। ব্যলা-বেলা,সময়। সগার-সবার। চ্যায়া-চেয়ে। এ্যাকনা-এক। মজার-ভালো লাগার। কাজ কামোত-সংসারী কাজ কর্ম। আইতোত-রাতে। নিন- ঘুম।

( কবিতার নামগুলো কাল্পনিক যদি কাকতালীয় ভাবে কারো নামের সাথে মিলে যায় সে জন্য লেখক দায়ী নয়)

450 Views

রানা মাসুদ

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৬:৪০ অপরাহ্ণ

আনসুন ফ্যাদলা—৬

কইতরিরে ফাঁটি যাওছে মোর জীউ জান

চোখোত না ঝরে পানি না দেয় খোদা দান

না থাকিল খাবার পানি, আছে  তিস্তা ভরা

উচলিয়া,ভাসেয়া হামাক কচ্চে  জিন্দা মরা,

চর নোহালি,আলমবিদিত,কচুয়া খুঁজো মুই,

পানিত ডুবিছে খুঁজি না পাও এত্তিকোনা ভূঁই,

বুড়ি মা আর কাছুয়া ছোওয়াটাকে নিয়া তুই

বান্দের ডাঙাত আছিস এ দুঃস্ক কোনটে থুই।

মাইনষ্যি ও গরু-ছাগল ওটে সোগ একেকার

কায় গেরেস্ত, কায় কামলা সগার দাবি খাবার।

— তোরা না চিন্তা করেন ইগলা হামার নয়া কি

ভোক ও অভাব এই নিয়াই তো হামরা থাকি।

টাউনের খবর ক’ উজি ওজগার এলা ক্যামন?

কামড়ে থাক ধরি কামাই হউক  যেমন তেমন।

তিস্তার পাড়োত এলা খালিই কান্দোনের শব্দ

হামার দীর্ঘ নিঃশ্বাসে বাতাসও হয় মেলা জব্দ।

ইলিপের মাল যা আইসে তাকে দিয়াতো হয় না

কোনটে ইলিপ দেমে তাকো ফির কাও কয় না।

আইতের বেলা গরু-ছাগল সাতে হামরা সোওগ

সাপ,ব্যাঙ,ইন্দুর, বিলাই আর আছে ম্যালা ওগ,

চাইরপাকে পানিবন্দি মাইনষ্যির খালি নাই নাই

চ্যাংটুর বাপ মুই না পারো টাউনোত যাবার চাই।

 

টাউনোত কি মুই আছোং আজার হালোত বসি

‘সুখের মাও ভাতার ধচ্চে’ মোর মুখোত নাই হাসি,

ইশকা চালে তাকে থাকো অঙিন মাইনষ্যি পাকে

ওমার সুখ দেখি হামরাও খোঁজোং তারে ফাঁকে।

এটে কোনা চোর- ছ্যাচোর ভরা, আছে অংবাজ

এমরা গুলা মশার পেছোনেত ফেলি সোগ কাজ।

গজবে গজবে টাউন গ্রাম সোগ এলা একেকার

আইসো বাহে হাত তুলি দোয়া চাই জইন্যে সবার।

425 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৬:৪০ অপরাহ্ণ

জব্বারের মায়ের দিনলিপি

ফির বাতাস শুরু হইলো, আউলা ঝাউলা বাতাস

কয়দিনের কাইতান বিষ্টি পইত্তোয়ছে, পইত্তোয়ছে

এবার তাড়াতাড়ি জার পইড়বে,

এবার আর বাইচপ্যার দিবান্নয়।

গত বছর যে জার পইল্লো, ছেঁড়া খ্যাতা গাওদদিয়া আইত পার করা নাগে,

কই কাঁইওতো একনা কম্বল দিলো না

ভোটেস সময় এক একজনের ফটর ফটর, কতাত্ পানি ওশ্যেনা

চেয়ারমেনের বাড়িত কয়দিন যায়া ঘুরি আনু

এতদূর ঘাটা হাইটপ্যারে মোনায় না

ভোট পার হয়্যা গেইলে নাউয়্যার ব্যাটারা কারও খোঁজ থাকেনা

প্যাটও চলে না, ঠ্যাঙও চলে না, মোর কি আর সেই বয়স আছে!

 

খালি শোনোম অমপুরোত বোলে ঢাকা হাতে কতো লোক আসি কম্বল দেয়,

হামারগুলাক কারো চোকোতে পড়েনা

শীতেদদিন আইলে ময়না মোর মরণ!

এবার বোদায় আজরাইল আর ঘুরি যাবান্নোয়।

 

কাঁয়রে ওটা! মেম্বারের ব্যাটা না ওটা?

চোখেও আর ভালো করি দেখোম না।

হায়রে, মোর দিন কি এইদ্যান আছিল!

কপালটা পুল্লো এই স্বাধীনের সময়।

জব্বারের বাপ যদি বাঁচি থাইকলো হয়

তাইলে কি আর ভিক্ষ্যার ঝোলা হাতোত নেওয়া নাগে!

মরার গণ্ডগোলে মোর কপালটা খাইলো।

ব্যাটা একনা আছিল তাঁইও খোঁজ নাই,

ঢাকাত গেছিল্ এশকা চলাবার, তাও পোনোরো বিশ বছর হইবে

কাঁই জানে বাবা মইচ্চে না বাঁচি আছে!

বাঁচি থাইকলে এ্যাগবারও আইসলো না হয়?

 

হায়রে! দ্যাশ তো স্বাধীন হইল্ কিন্তু মোর দুঃখ দুদ্দশাত তো শ্যাষ হইল্ না!

 

শরীল আর চলে না ময়না,

কি দিয়া যে কি করি, জিনিসপত্তরের দাম একেবারে আকাশোত উঠি গেইছে,

আগে মুলা-বাইগোন গরুও খায় না, এ্যালা মাইনশে পায়না

এখন এইগল্যায় হইছে সোনাদ দাম।

মোর মরণও হয়না!

520 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৬:৪০ অপরাহ্ণ

শতবর্ষী পাতানিবুড়ির শীতকাল

ক্যা ব্যাহে —

এই কনকনে হাড়কাঁপানো শীতোত

ওমরা ব্যালে হামাক কম্বল দ্যায়!

ন্যাপ দ্যায়! শীতের কাপড় বিলায়!

হামার কপালোত কি কিছুই জোটে না?

খালি শুনি আইজ ব্যালে ওমরা কম্বল দেবে!

কাইল ব্যালে ন্যাপ-তোষক দেবে!

 

হাড্ডি মেরা শরিল নিয়া কাজ কাম ছাড়ি

আইজ মুই যখন বাড়ি থাকি বেড়ানু,

আছিয়া আসি কইলে- আইজ কম্বল দেওয়া শ্যাষ।

কি আর করোঁও, ঝুপরিত ফিরি আসিয়া

শামটি আনা পাতাত আগুন ধরে দ্যাঁও

গাও খান গরম করি সকালের ভাত খায়া

ছিঁড়া চটের কম্বলখান গাওত দিয়া শুতি পড়োঁও।

 

ক্যা ব্যাহে —

হামার ওস্তোম আলিক ভোট দিয়া যে

হামরাগুলা তাক চেয়ারমেন বানাইনো!

কই, তাঁয় ক্যানেবা অ্যালা হামার খবরে ন্যায় না।

ভোটের আগোত ওমরা খালি ঘনঘন পাক পারিল,

অ্যালা ক্যানেবা ওমরা হামার গেরামোতে আইসে না!

ভোট চাবার আসিয়া ওমরা হামাক মাও কইলে,

চাচি কইলে, পাওত পড়ি ছালাম করলে।

অ্যালা ফির হামার কি দোষ দেখিল?

বাপরে, হামাক অ্যাকনা কম্বলে দ্যায় না!

না কি হামাক ভুলি গেইচে?

ক্যা ব্যাহে–

চেয়ারমেন হইলে কি সবায় এই মতোন হয়?

 

— এমনি আরো কতো ব্যথাভরা আক্ষেপ

শতবর্ষী পাতানিপুড়ির স্বরকাঁপা কন্ঠে!

পাতানিবুড়ির সাথে আমার শৈশব থেকে ওঠাবসা

তার মমতামাখা কোমল স্পর্শ আজও

আমাকে মানুষ হয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়।

আমি নিতান্তই একজন সামান্য কবি,

কম্বল বিতরণের সামর্থ্য আমার নেই।

এই হাড়কাঁপা কনকনে শীতে

তোমারা কি কেউ পারো না

কঙ্কালসার পাতানিবুড়ির গায়ে

মানবতা ও সহানুভূতির এক টুকরো

কম্বল জড়িয়ে দিতে?

331 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৬:৪০ অপরাহ্ণ

শিক্ষিত্ হইস, মানুষও হইস

তুই বেলে শিক্ষিত্ বেটাছাওয়া?!

এ্যাত্তোবড়ো কলেজোত এত্তো এত্তো নেকাপড়া শিকচিস?

মেলা বেলে আদব-কায়দা?!

তা,

মোক পুছ না করি চুমা দিলু কেনে?

কেনে মোক দেকলে তুই চৌউক টিপিস? জিবা দেকাইস?

বগলাবগলি হইলে-  খালি বারে বারে গাওয়ের সাতে গাও নাগবার চাইস!

তোর ঐইগলা পড়া মুই পড়োং নাই ঠিকে, কিন্তুক মতলবটা বোজোং।

 

বাবায় মোক নেকাপড়া করায় নাই, চেংড়ি ছাওয়া তকনে।

কইচে – নাম নেইকপার পাইলেই হইবে।

কোটে বেলে জজ-বারিস্টারের ঘরোত বিয়াও দেমো!

তুই তো নেকাপড়া করি জজ ব্যারিস্টার হবু। তোর সাথে তো মোর বিয়াও দিবার নয়।

তাইলে?

 

শুন,

তোর ভদ্দরনোকি কতা মুই জানোং না,

কিন্তুক তোর ইশরা,তোর চৌকের চাওনি, ভুরুর নাচন মুই বোজোং।

তুই পোত্তেকবার ছুটিত আসি মোর পাচোত ঘুরিস, মোর বাদে এখান ওখান ধরি আসি শ্যাবা শ্যাবি করিস।

মুইতো তোর ঐইগলা জিনিস এখানো নেও নাই!

তাও তুই মোক পুচ না করি চুমা দিলু কেন?

 

মুই চুমা মানে পেরেম বোঝোং। বিয়াও বোজোং,ভাতার বোজোং।

তোর সাতে তো মোর পেরেম নাই, মুইতো তোক কোনোদিন স্বপোনোত দেকোংনা!

তোর জিনিসপত্ররও নেও না।

তুই কি মোক বিয়াও করবু?

মোর ভাতার হবু?

নাইলে….. তুই মোক পুচ না করি চুমা দিলু কেন?

 

মুই জানোং তুই ভাতার হবার বাদে চুমা দেইস নাই।

তুই নাগোর হবার চাইস! তুই মোক ভোলে ভালে বগলোত আইসবার চাইস।

তারপরে কয়দিন বাদ মোর মোকোত চুনকালি দিয়া ভদ্দরনোক সাজি তুই ভালে থাকপু।

মাইনষে মোক মাগী কইবে।

কইবে বামনের ছাওয়া চাঁন ধইরবার চাও!

কিন্তুক তুই যে নিশি রাইতের ভাঙ্গাচালের ফুটা দিয়া  জোছনার মতোন মোর গাত আসি নিজে নিজে পরচিলু, তুই মোক পুচ না করি চুমা দিচিস,

এইগলা কতা কায়ো মাইনবার নয়।

তুইতো তকন ভাল মাইনষের ছাওয়া!

মুই তোক ফান্দ পাতি ধইরবার চাচুং,মুই ই  খারাপ।

তুই তকন কিচ্চু বুঝিস না হয়া যাবু।

তুই তকন তুলশিরপাত!

 

সারতো, বগলোত আসিস না। টানাও তোর আলগা পিড়িত। আরেকবার চুমা দিলে মাইনষোক কয়া দিম।

তোর শিক্ষিত বাপ মাও তোক এইগলা শিকাইচে?

বড় কলেজোত কি এইগলা পড়ায়?

বাড়ি যা!

যায়া তোর বাপোক ক, তোর মাক ক। ক বেলে মোক তুই বিয়াও করবু!

ক্যান, এলা আও করিস না ক্যান?

হ্যা?

মুই মুরকো হবার পারো। হামরা গরীব হবার পারি।

মোর বাপের মেলা টাকা নাই।হামরা ইসকুল কলেজ পড়ি নাই।

কিন্তু হামার শিক্ষা আচে। হামার লোভ নাই।

মোর বাপ মোক মিচা কতা কওয়া, আর মানুষ ঠকা শিকায় নাই।

চুপ করি কাকো হাকাউ চুমা দেওয়া শিকায় নাই।

তুই মোক ঠকাবার আসচিস?

তোর টাকা, জিনিপত্তর, কাপর চোপর আর জৌলুস দেকি মুই না বাগিম।

ভাল না বাসি, মিচ্যা কতা কয়া কারো সব্বোনাশ করি বিয়াও না করার নাম যদি হয় বড় নেকাপড়া, তাইলে তোর নেকা পড়া ধুয়া তুই পানি খা।

 

কালা অক্ষর পেটোত গেইলে, বিদ্যাশিক্ষা করলে মানুষে বেলে মানুষ হয়!

কেমন মানুষ হয়?! তোরে মোতোন?

সুযোগ পাইলে জুয়ান চেংড়ি পাইলে পুচ না করি চুমা দেয়?

মুইতো মানুষ বলতে মোর বাপোক চেনোং। গেরামের ইসকুলের হেড মাষ্টারোক চেনোং।

ওমরা মোক কত জ্ঞানের কতা কয়!

ওমরা ছুইলে মোক খারাপ নাগে না। গাওখান ইচপিচ করে না।

তুই চেংড়ি দেকলে উজা বন্ধ কর।

বাড়ি যা, বড় কলেজোত পড়ি বড় মানুষ হ।

মোর বাপের মতোন, গেরামের স্কুলের হেডমাস্টারের মতন মানুষ হ।

496 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৬:১৬ অপরাহ্ণ

নয়া কইন্যা

নাকের নেচোত নথ কইন্যার

কানোত মাকড়ী-পাশা

কমরোত এখান বিছা পিন্দি

পুরাইল মনোত আশা।

 

মাতাত কইন্যা টিকলি দেছে

পায়োত আচে নূপুর

সোনার রুলী দুখ্যান হাতোত

দ্যাকে ঘুপুর ঘুপুর।

 

সোন্দোর এখান থ্যাবড়া মালা

থুইচে ঝুলি গালাত

নউগের গোড়াত আংটি আচে

মেন্দি হাতের তালাত।

 

সাজে কইন্যা বিয়্যার সাজোত

যাইবে শ্বশুর বাড়ি

সোউগ ফ্যালেয়া যাবান নাগে

বাপের ভিটা ছাড়ি।

 

মা’ক জড়েয়া ডুকরি কান্দে

কান্দে বাপের আগোত

এক বান্দোনোত হাঁটে কইন্যা

গাবরু হাঁটে সাথোত।।

 

আঞ্চলিক শব্দের চলিতরূপঃ

কইন্যা= পাত্রী, রুলি= কাঁকন,  ঘুপুর ঘুপুর= বারবার, থ্যাবড়া= চ্যাপ্টা,

মাকড়ী-পাশা = কানের ঝুমকা

পুরাইল= পূর্ণ করা, নউগ= আঙ্গুল, সাজে= সাজুগুজু, তালাত= হাতের তালু,

বিয়্যার= বিয়ের, জড়েয়া= জড়িয়ে ধরে, আগোত= সামনে, বান্দোনোত= বন্ধনে, গাবরু= বর, সাথোত= সঙ্গে।

458 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৬:১৫ অপরাহ্ণ

ছড়ায় অমপুর

কেটা তোমরা মবিল কচ্চেন

কেটা বাহে তুই ?

আউ মোক চিনিস ন্যাই

হামার বাড়ির মুই !

 

ও বু   কতা   শোন

তুই কী অমপুর আসপু

হেটে তুই ম্যালা ম্যালা

অংগের মেলা দেকপু।

 

টাওন হল ম্যালা বড়

ঢাক ঢোল বাজে

নাটক দেকায় নাচ দেকায়

আজা বাতশা  সাজে।

 

পাবলিক নাইবেরীর বড়ো মাট

ম্যালা অনুষ্ঠান হয়

কতো নেতা যায় আসে

কতো কতা কয়।

 

শহীদ মিনার আচে সাতে

ফুল দিয়া ভরে

শহীদদের স্মরণ করি দেয়

ফুল তামার তরে।

 

গণতাগার আচে আরও

আসে মানুষ তাতে

ভাষার মাসে বই মেলা

গনতাগারের মাটে ।

 

আশপাশে ম্যালা ম্যালা

কবি নেকোকের ঘর

মিলিমিশি বানায় বই

নোয়ায় কেউ কারো পর।

 

বড়ো বড়ো মেডিকোল

ম্যালা ম্যালা দাক্তার

অসুক নিয়া আচ্চিল

পুব পাড়ার সাত্তার ।

 

চিকনি বিল সুরভি উদ্দেন

চিড়িয়াখানা আচে

বাগ ভাল্লুক হরিণ আরও

বান্দর কতো নাচে।

 

চিড়িয়াখানাত ভূতের বাড়ি

দেকলে নাগে ভয়

বড়ো বড়ো দোকানোত গেলে

স্যার স্যার কয়।

 

ভাইজ্যানোক নিয়া আয়

কয়দিন ব্যাড়ে যাবু

ফুচক্যা চটপটি আরও

ভালো মন্দ খাবু।

539 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৬:১৫ অপরাহ্ণ

মতিয়ার সমাচার

ক্যানে বাহে মতিয়ার তুই

গাছোত আছিস ঝুলি?

কোনটে তোর কাজুলি

আর কোনটে টুলটুলি?

 

জাহেদুল আর সাহেদুল

খুঁজি না পায় ক্যান

জীবন ক্যানে কানের গোরত

করে ঘ্যানোর ঘ্যান?

 

লাভলু কয় ঐ তো অয়

গাছোত ক্যানে ঝুলি!

হাসতে হাসতে পাগলা

শ্যাষোত কাজুলি টুলটুলি।

 

মোক ক্যানেতা ফাকোত ধরি

করেন টানাটানি!

কাজুলি আর টুুলটুলিতে

কীসের কানাকানি?

 

সে কথা আর না কন মামু

কাইলকা সান্জোত দ্যাখওঁ

থাউক সে কতা, সেইগলা কতা

ক্যামন করি ন্যাকও!

 

কানাকানি করে অটে

কাজুলি টুলটুলি

ফাকোত আসি মিনার আসি

ছাড়ে ক্যানে বুলি?

 

কী দেকচেন মিনার ভায়া

সান্ঝোত যায়া কাইল?

মোকও একনা কন তো খুলি

কপালখান কায় খাইল!

 

কনতো এ্যালা তোমরা গুলায়

মুই ক্যানতা ওটি?

কখন বা মোর চান্দির ভেতর

মেজাজটায় যায় চটি।

 

তো রে মেলাত বিয়ান বেলায়

এইগলা কতা রটে

চটা চটি খারাপ জিনিস

এইক না বুঝ না ঘটে ?

 

মরিস না আর ঐদ্যান করি

ওরে মিনার কবি

গাছের মাথাত ঝুলি থুইছে

মতিয়ারের ছবি।

 

তাকে দেখি লাভলু ভাইয়ের

গেইছে ঘুরি মাথা

জীবন খালি প্যাঁচাল পাড়ে

কওচে মুখোত যা-তা।

 

সাঈদ কোনা কাণ্ড দেখি

মুচকি মুচকি হাসে

জাহিদ কোনা শেষোত আসি

খাড়ায় ওমার পাশে।

 

গোপন কথা ফাঁস করি দ্যাও

নোয়ায় খালি টুলটুলি

পরকীয়ার লিষ্টে আছে

শেফালি ও বুলবুলি।

 

শেফালি আর বুলবুলি কি

এ্যাঁলাও এট্টে আইসে?

শুনছিনু মুই মতিয়ারের

কপাল ওমরায় খাইছে !

 

বাপের দেয়া হোন্ডা বেচে

করছিল ওয় ডেটিং

সেল ফোনেতে চুপিচুপি

করছে শুধু চ্যাটিং।

 

প্রেম করিয়া হইছে ফতুর

গেইচে ত্রিশ কাঠা

বলতে হবে মতিয়ারের

আছে বুকের পাঠা।

 

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে

দুই’শ মন আর গম

শেফালিও সুন্দরি খুব

রেশমা কী সে কম?

 

জমি গ্যালো ধানও গ্যালো

গ্যালো হোন্ডা গাড়ি

প্রেমিকা সব চুইষা নিয়া

দিছে বিদেশ পাড়ি।

 

মতিয়ার আইজ মনের দুঃখে

হইছে যে দেবদাস

গাঞ্জা খ্যায়া গাছের মাথাত

নটকে থুইছে ফাঁস।

 

রেশমা ফির কায় বাহে?

কনতো খানিক খুলি

ঐ জইন্যে কি ক্ষ্যাপছে কাইল

কাজুলি টুলটুলি?

 

হয় বাহে আরো আছে

জুলি, কণা, সোনিয়া

থাকেন ক্যানে কয়টা আছে

দ্যাখোং হাতোত গোনিয়া।

 

তিতলি, ইমা, কলি, শানু

শ্যামা, তনু, সোমা,

এই বাজারোত মতিয়ারের

আছে কী আর কমা?

 

ক্যানে বাহে মতিয়ার তুই

গাছোত আছিস ঝুলি?

কোনটে তোর কাজুলি

আর কোনটে টুলটুলি?

476 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ১২:২৬ অপরাহ্ণ

ন্যাম্পোত ত্যাল নাই

—১—

আইজক্যা মফিজের মনট্যা খুপ ভাল৷ ম্যালাদিন পর আইজক্যা একখান ভাল যাত্রা পালা দেখতোছে৷ এলা আর সেই দিনগুল্যা নাই৷ কী দিনগুল্যা ছিলোরে বাবা৷ আহ্! মনখান ভরি গেইতো৷ এলা বলে কায়ো আর যাত্রা দ্যাখে না! ক্যানে বাহে! ইয়ার চ্যায়্যা কি টকিজ দেখিয়া মজ্যা পান? আসলে সগারগুলার একন্যা ঢগ হইছে৷ মুই কী হনুরে!

আইজক্যার পালার নাম হইল “গরীব ক্যানে কান্দে”৷ সগায়গুল্যা ভালই পাঠ করতোছে৷ তয় নায়িক্যাট্যা সব্যার চ্যায়্যা ভাল পাঠ করে৷ চেংরিকোনার নাম বলে লাইলি৷ দেখপ্যারো সুন্দর৷ আইজ ধরা পরাপর চাইরদিন ধরি মফিজ পালাট্যা দেখতোছে৷ জানা কতা শ্যাষদিন পয্যন্ত অয় এই পালাট্যা দেখপে৷ এটা উইয়ার পুরান্যা ব্যারাম৷ এই কয়দিনে মফিজ লাইলির পিরিতত পড়ি গেইছে৷ গেরামের সবায় জানে শ্যাষ পয্যন্ত মফিজ লাইলিক নিয়্যা কয়দিন রাইত কাটাইবে৷ কায়ো কিছু কবান্নায়৷ উইয়্যার যেমন আছে ট্যাকা তেমন ক্ষমত্যা৷ গেরামের মোড়ল৷

মফিজের মেজাজটা বিগড়ি গেইসে৷ কয়দিন ধরি চেষ্টা করিয়াও লাইলির সাথোত এলাও ভাব জমাবার পায়নাই৷ পালার মালিক পাইস্যা নিতোছে৷ আর কইতোছে হইবে হইবে৷ ধুর শাল্যা কিছুই হবোন্যায় কইতে কইতে মফিজ বাড়ির ঘাটা ধরিল৷

—২—

পইস মাস৷ এব্যার ক্যানব্যা জার পইড়ছে বেশি৷ কী আর করিম৷ তাওতো বিয়ানবেলা উঠপ্যার নাগবে৷ বাড়ির কী আর কামের অভাব আছে? গায়োত একনা পুরান কাপড়া ভাঁজ করি আলোয়ানের নাকান পরিয়া চকিত থাকি নামি পড়িল ওকেয়া৷ কইতর, হাঁস, মুরগি ছাড়ি দিয়্যা কয়ল্যা দিয়্যা দাঁত মাজিয়া হাত মুখ ধুইল৷

এক সানকি পান্তা ভাত আর নুন-আকালি নিয়্যা সোয়ামিক ডাকে তুলিল৷ বিয়ান বেলা উঠি খাবার না পাইলে এই ম্যানশেটা এলা চিল্লাচিল্লি করবে৷ খারাপ খারাপ গাইলাইবে৷

সোয়ামি দোলা বাড়ি গেইলে ওকেয়া ধান উশা শুক্যা করবে৷ সেইগল্যা ফির উরুন গাইন দিয়্যা চাউল বানেয়া দোপরের ভাত আন্না করা নাগবে৷ ওকেয়া জানে ম্যানশেটা দোলাবাড়ি থাকি আসিয়্যা ভাত না পাইলে বাপ-মাও ধরি গাইলাইবে৷ হালুয়্যা পেন্টি দিয়া মাইরাবারো পারে৷ ওমাক খুব ডর লাগে৷

ওকেয়া ওমার ছোট বউ৷ বড় সতীন মরি গেইছে৷ তামারগুল্যার চাইরট্যা ডাঙ্গর ডাঙ্গর ব্যাটা আছে৷ সগায়গুল্যা ওকেয়ার চায়্যা বয়সে বড়৷ সগায় বিয়্যা করিয়্যা মাইয়া, ছাওল-পোল নিয়্যা আলদা খায়৷ ওকেয়া এই বুড়্যা সোয়ামিক নিয়্যা পড়ছে এক জ্বালাত৷ ম্যানশেটার চরিত্রটা যেমন ভাল না তেমন বদমেজাজী৷ কতক সময় সোগ কিছু থুয়্যা পালে যাবার মন চায়৷ কিন্ত যাইবে কোনটে৷ উইয়ারতো কায়ো নাই৷ ফির ম্যানশেটার জন্যে মায়া হয়৷ যতই মারুক৷ গাইল্যাক তাওতো সোয়ামী৷

ওকেয়া জানে বাইরের দুনিয়্যাটা কত খারাপ৷ এই প্যাটটার জন্যে কতনা কিছু করতে হইছে ওয়্যাক৷ কায়ো কোনকিছু ছাড়া এক আনাও হেলেপ করে নাই৷ সারা গতরে এলাও ঐ পাপ নাগি আছে৷ শ্যাষে একটা সার্কেস পার্টিতে ঢুকি যায়৷ স্যাটে থাকি যাত্রা পার্টিত৷ তখন দেখতে শুনতে ছিল মাশাআল্লাহ্৷ উইয়ার জন্যেই লোকজন যাত্রা দেইখপার আসতো বেশি৷ ওকেয়ার দাম আর ঢক দুইটায় বাড়ি গেইল৷ সেই যাত্রা পালা দেখিয়াই ওই ম্যানশেটা পিছ পিছ লাগিল৷ শ্যাষে বিয়্যা করিল৷ ওকেয়াও মাথা গোঁজার একনা জায়গা পাইল৷

হায়রে জনম৷ হায়রে কপাল৷ মাইয়্যা হয়্যা জনমিবার শাস্তি৷

ওকেয়া এইটাকেই মানি নিছে৷ তাছাড়া ম্যানশেটা যে একনাও পিরিত করে না তাও নোয়ায়৷ এলাও মাঝে মাঝে চুড়ি, গয়না, শাড়ি নিয়্যা আসি দ্যায়৷ ত্যাল-সাবুনের কথা না হয় না-ই ধরনু৷

গঞ্জত শুননু যাত্রা নাকছে৷ ম্যানশেটা পতিদিন স্যাটে যায়৷ নয়া ধান নামছে৷ এমার কোন চিন্তা নাই৷ খালি বস্তায় বস্তায় ধান বেচতোছে৷ আর পাইস্যা নষ্ট করতোছে৷ কুনদিন যে হায়্যা হইবে আল্লাহ্ই জানে৷

আইজ সাঁজের ব্যালা ম্যানশেটা একখান নয়া পিরান আর নয়া তবন পরি ব্যাড় হইছে৷ গায়োত আঁতরও লাগাইছে৷ ভাবসাব একনা অন্য রকম৷ কী জানো! কী করতোছে এই বুড়্যা বয়সোত ওকেয়া ভাবে৷

অনেক রাইত পর্যন্ত ওকেয়া বসি থাকিল৷ ম্যানশেটা যদি আইসে৷ ঐ অবস্থায় কখন যে নিন্দ আসছে টের পায় নাই ওকেয়া৷

—৩—

দুয়ারোত জোরে জোরে আওয়াজ শুনিয়া ওকেয়া ধরপর করি উঠি বসিল৷ জারের রাইতেও ওকেয়া ঘামবার লাগিল৷ দুয়ারোত ন্যাদাই দিতোছে আর চিল্লি চিল্লি গাইলাইতোছে ওইয়ার সোয়ামি৷ কইতোছে ওই হারামজাদী৷ শশুরের বেটি৷ মাগীর বেটি তুই কি মরণের নিন্দ পারতোছিস৷

ওকেয়া ধরপর করি উঠিয়্যা ন্যাম্পোটা জ্বলাইল৷ আইজক্যা ক্যানবা ন্যাম্পোটা ক্যামন ভুকুত ভুকুত করতোছে৷ এলায় বুঝি নিভি যায় নাকি! ওকেয়া ডর ডর ভাব নিয়্যা দুইয়্যারটা খুলি দ্যায়৷ ঘরোত ঢুকিয়ায় মফিজ চিল্লি চিল্লি গাইলা গাইলি শুরু করি দেইল৷ ওকেয়া কোন কতা না কয়া পাক ঘরোত থাকি ভাত আইনব্যার গেইল৷ ওয় জানে এলা কতা কইলে মাইরব্যার পারে৷

মফিজ চুয়ার পাড় থাকি হাত মুখ ধুয়্যা আসিল৷ চোকির এক কোনাত ওকেয়া সানকি, খোরা, মগ দিয়্যা কইল আইসো ভাত খায়্যা ন্যাও৷ মফিজ ভাত খাইতে খাইতেও চিল্লাইতোছে৷ থামতোছে না৷ ওকেয়া শাড়ির আঁচলটা দিয়্যা মুখ ঢাকি হাসতোছে৷ এই চিল্লাচিল্লির মানে ওয় বুঝপ্যার পায়৷ কারণ ওয় একজন মাইয়্যা মানুষ৷

ভাত খাওয়া শ্যাষ হইলে ওকেয়া থালি-খোরা চোকি থাকি সারে ফ্যালে৷ বিছন্যাটা ঠিক করে৷ ন্যাম্পোটা গচার উপর থুয়্যা দ্যায়৷ ন্যাম্পোটা এলাও ভুকুত ভুকুত কোরতোছে৷

মফিজ চোকির উপর আগ হয়্যা এলাও বসি আছে৷ ওকেয়া মুখোত একনা হাসি নিয়্যা চিৎ হয়্যা শুয়্যা পড়ে৷ তারপর সোয়ামির দিকে চায়্যা ফিশফিশ করি কয়্যা উঠিল ‘তোমরা কী করমেন করো, ন্যাম্পোত ত্যাল নাই৷’

 

লেখক: কবি ও গল্পকার, রংপুর।

522 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ১২:২৩ অপরাহ্ণ

স্বপ্নঘড়ি

১) বাহিরে কনকনে ঠাণ্ডা । সেই সাথে বইছে হিমেল হাওয়া। এই ঠাণ্ডায় যেখানে ঘরের ভিতরে থাকা দায় সেখানে শিউলি বাহিরে যাচ্ছে কী কারণে? মা বললেন- কিরে শিউলি, এই ঠাণ্ডার দিনোত কোটে কোনা যাওছিস? শিউলি বাজারের ব্যাগ হতে নিয়ে বললো – মা, এ্যানা কাম আছে, যাইম আর আসিম ।

-কলেজত যাবু না, ১০ টা তো বাজি গেছে ।

-আইজ মনে হয় কলেজত যাওয়া হবার নয় । মা মোক ছয়শোটা টাকা দে তো ।

মা চোখ আসমানে তুলে বললেন – ওমা ওমা, এটা তুই কি কওছিস শিউলি ? এত টাকা মুই কোটে কোনা পাইম। এতগুলা টাকা কি মুই কোন দিন চোখে দেখছোও । তাছাড়া আজই শাবানা আইসবো জামাই নিয়ে । উমরা গুলার জন্য হাট থাকি মুরগি, তেল, চিনি আইনবার লাগবার নয়?

-সগেই এ্যালা হবে মা, মোক আগে টাকা দে তো । মুই দেখ কি নিয়া আইসম। শিউলি জোর জবরদস্ত করে মায়ের আচল থেকে টাকা বের করে নিয়ে একটা শাল গায়ে জড়িয়ে বাহিরে চলে যায় ।

২) পোস্ট অফিসের সামনে অনেক ভিড়। আজ সোমবার , টিসিবির মাল দেওয়ার কথা আছে এখানে । তাই তো শিউলি কলেজ বাদ দিয়ে এত ঠাণ্ডা শীত উপেক্ষা করে এখানে এসেছে । ভালই হলো, খুব একটা লোকজন নেই আজ । এর আগের দুইদিন এসেছিল শিউলি কিন্তু এত ভীড় ছিল তাকে লাইনের শেষ সীমায় দাঁড়াতে হয়েছিল । তার সিরিয়াল আসতে আসতে তেল, ডাল, পিয়াজ সব শেষ হয়ে গিয়েছিল । বাকি  ছিল শুধু চিনি । শিউলি সেদিন শুধু চিনি নেয়নি । আজ সে লাইনের প্রথমে দাঁড়িয়েছে । তার পিছনে মাত্র পাঁচ সাত জন । কিন্তু ট্রাক কোথায় ? সময়ের সাথে সাথে লাইন দীর্ঘ হচ্ছে । অনেক লোকজন এসে তার পিছনে দাঁড়িয়েছে । সবার মুখে বিরক্তির ভাব । বেলা বাজে আটটা । এখনো ট্রাক আসার নাম নাই । আস্তে আস্তে  লোকজন কমতে থাকে । শিউলি পণ করেছে আজ সে টিসিবির মাল নিবেই নিবে । বাবা অসুস্থ, কামাই রোজার বন্ধ । তাছাড়া তার বুবু শাবানা অনেক দিন পর আজ বেড়াতে আসছে । টিসিবির তেল, পিয়াজ, চিনি পেলে দুই তিনশ টাকা বাচানো যাবে । বাজারে তেল চিনির যা দাম, তাদের মতো নিম্নবিত্ত পরিবারের বাজার থেকে এসব কিনে খাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে । শিউলির ভাবনার মাঝে কার যেন একটা হাত এসে তার ঘাড়ে পরে । সে চমকে পিছনে তাকায় । দেখে তার বন্ধু মনিরা । মনিরা বললো- কিরে শিউলি, এটিকোনা যে ?

শিউলি বললো, তেল ডাল নিমরে । তার দেখিস এলাউ কোনা ট্রাক আসপ্যার নাকছে না । কলেজ বাদ দিনু কয়টা টাকা লাভের আশায়, তাক বুছি আর হইল ন্যা । মোর কথা বাদ দে, তুই ক, তুই এটি ক্যা ?

–         মুই আসচোম পোষ্টপিসো একখান চিঠি দিব্যার । তোক দেখি এটিকোনা আনু ।

–         কলেজোত গেছিলু ?

–         হ, গেছুম। শামীম স্যার তোর কথা জানবার  চাইলো ।

শামীম স্যারের কথা শুনে শিউলির মুখটা খুশিতে চকচক করে উঠলো । সে মৃদু হেসে বললো  – শামীম স্যার মোর কথা কি কইলোরে মনিরা ? মনিরাও হাসে । হেসে বলে  – শামীম স্যার কইল, তুই ব্যান কোনদিন লেখাপড়া বাদ দেইস না । লেখাপড়া করি তুই যেন একদিন বড় চাকরি করিস।

–         শামীম স্যার মোক নিয়া খুব ভাবে, তাই নারে মনিরা ?

–         ভাবিয়া আর কি করবি ক । তেলে জলে তো আর কোনদিন মিশ খাবার নয় । শিউলি এবার মনিরাকে ধাক্কা দিয়ে বললো – কি এগুলা কওছেস মনিরা, বাদ দে তো । তুই তেল চিনি নিবু নাকি ?

–         হ, নেওয়ার তো ইচ্ছা আছিল, কিন্তু ট্রাকতো আইসপার নাগছে না । তাদের কথার মাঝে ট্রাক চলে আসে । ট্রাক ভর্তি মালামাল । শিউলি আর মনিরা তাদের ইচ্ছামতো মালামাল নিয়ে খুশিতে হেঁটে হেটে বাড়িতে আসে ।

৩)      টিসিবির মাল দেখে মা খুব খুশি । তিন চারশ টাকার মতো বাচলো আজ । শাবানা এসেছে। শাবানাকে আজ তেল পিঠা বানিয়ে খাওয়াবে শিউলি । চারশ টাকা বাচাতে পেরে তাদের খুশি আর ধরে না । এই টাকা সাথে আরো কিছু টাকা যোগ করে শিউলি তার ছোট ভাই রানাকে নিয়ে বাজারে মাছ মাংশ আনতে গেল ।

রাত বাজে এগারোটা । শাবানা খেয়ে দেয়ে শিউলির বিছানায় এস বসলো । শিউলি বললো  – বুবু কিছু   কবু ? মোর না খুব ঘুম পাইছে ।

শাবানা বোনের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদু স্বরে বললো  – তোর জন্য একটা সমন্ধো আনছোম শিউলি, খুব ভাল চ্যাংরা । সৌদিত থাকে । ম্যালা টাকা পয়সা । বিয়া করার জন্য আসছে ।

শিউলি বিস্মিত স্বরে বললো  – এটা তুই কি কওছিস বুবু ? মোক বিয়া দিবু মানে ? মোর তো এ্যালাও আঠার বছর হয় নাই । তাছাড়া মুই এ্যালাই বিয়া করবার নও । মুই মাষ্টারনি হইম । কলেজোত চাকরী করিম । তুই এ কথা আর মুখোত আনিস না বুবু ?

শাবানা বললো  – আঠার হয় নাই, হইবে । এমন ভাল চ্যাংরা আর জীবনে পাবু না । শুনছোম সৌদি থাকি দশ ভরি সোনা আনছে । সগেই বউক দিবে ।

–         মিছা কথা বুবু, সউব মিছা কথা । যামরা বিদেশোত চাকরী করে তামার চরিত্র ভাল হয় না। তাছাড়া মুই পড়ব্যার চাও । শামীম স্যার কইছে লেখাপড়া ছাড়া নারীর মূল্যায়ন কেউ করে না । লেখাপড়া হলো প্রত্যেক মেয়ের জন্মগত অধিকার ।

শাবানা এবার মুখ বিকৃতি করে বললো – তুই দেখম শুদ্ধ করে কথা কওছিস শিউলি। আর শামীম স্যারটা কেটা ? তোর মাষ্টার ?

শামীম স্যার যাই হয় হোক, তুই এ্যালা এটি থেকি যা । শিউলি একরকম জোর করে বোনকে ঘর থেকে বের করে দেয় ।

৪)       শিউলি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে । কিন্তু ঘুম আসেনা । তার বুকটা ধক ধক করে কাঁপতে থাকে,  বুবু এটা কি শুনালো ? বিয়ে !! না না, বিয়ে সে করবে না । সে লেখাপড়া করবে । এই মুহূর্তে তার শামীম স্যারে কথা খুব মনে পড়ে । একমাত্র শামীম স্যারই তাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবে । তার ভাবনার মাঝে বালিশের পাশে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো । শিউলি ফোনটা হাতে নিতেই অপর প্রান্ত থেকে শামীম স্যারের সুমধুর কন্ঠ ভেসে আসে – হ্যালো, শিউলি কেমন আছো, আজ যে কলেজে এলে না ?

– শিউলি হুরমুড় করে বলে উঠলো  – স্যার ভাল নেই স্যার ।

– কেন কি হয়েছে ?

– স্যার মোর বুবু মোক বিয়া দিবার চাওছে । মোক বাচান স্যার । মুই লেখাপড়া করবার চাও।

– শিউলি শুদ্ধ করে কথা বল এবং আমাকে পরিষ্কার করে বল বিষয়টা কি ।

– স্যার কোন বিষয় নাই স্যার । আমি বিয়া করবো না । আপনি কি আমার দায়িত্ব নিতে পারবেন স্যার ?

– দায়িত্ব নিতে পারব কিনা জানি না, তবে তোমার লেখাপড়ার যাতে কোন ক্ষতি না হয় সেদিকে জোড়ালো নজর রাখব । দরকার হলে থানায় যাব তোমার জন্য একটা ডায়রী করতে । দেখি তোমার মতের বিরুদ্দে কে তোমাকে বিয়ে দেয় ? স্যারের কথা শুনে শিউলির মনের স্বপ্ন ঘড়িটা ঢং ঢং করে বেজে ওঠে । সে একটা স্বস্তির নিঃশ^াস ছেড়ে বলে  – স্যার পৃথিবীতে এখনো ভাল মানুষ আছে । আপনাদের মতো কয়েকজন ভাল মানুষ থাকলেই এদেশের মেয়েদের এগিয়ে যেতে কোন সমস্যা হবে না । আপনি ভাল থাকুন স্যার, বলেই শিউলি ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করে ।

 

লেখক: গল্পকার, রংপুর।

495 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ১২:২২ অপরাহ্ণ

ছুঁয়ে দেখা জীবন

গভীর রাত নিঝুম প্রকৃতি কোথাও কোন সাড়া-শব্দ নেই। চারিদিকে ঘোর অন্ধকার সুনসান নীরবতা। মাঝে মাঝে দু’একটি ঝিঝি পোকা ডাকছে। বাঁশবাগানের ভেতরে দলবেঁধে জোনাকিগুলো মিটি মিটি করে জ্বলছে। গোটা আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে আছে। হঠাৎ একটা বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকাল, দরজার জানালার কপাটগুলো থরথর করে কেঁপে উঠল। কোথা হতে একটা দমকা হাওয়া এসে উঠানের আমগাছটার ডালে আঁচড়ে পড়ল। অমনি মড়মড় করে বিরাট একটা ডাল ভেঙ্গে পড়ল উঠানে। ভাঙ্গা চিমনির ফাঁক দিয়ে বাতাস ঢুকে হ্যারিকেনের ক্ষীণ আলোর সাথে যুদ্ধ করছে, তারপর একসময় পরাজিত হয়ে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। দিয়াশলাইটাকে খুঁজে পাচ্ছি না। অন্ধের মতো হাত-পা বাড়িয়ে কোন রকমে বিছানাটা খুঁজে পেলাম। তারপর বিছানার উপরে উঠে হাত পা গুটিয়ে ঝড়-বাদল সেরে যাওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকলাম। মনে হচ্ছে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে, কি অদ্ভুত রকমের বৃষ্টি অঝর ধারায় ঝরছে, যেন গোটা পৃথিবীকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে আজ। বৃষ্টির ঝাপটার ভারী যবনিকা ভেদকরে বাহিরে কিছু দেখা যাচ্ছেনা। জানালার ওপারে অশান্ত বর্ষণ আর মেঘের গর্জনে সব কিছু কেঁপে উঠছে বারবার। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে মনে হচ্ছে, যেন হাজার বছরের নিঃশ্বঙ্গতা নিয়ে আমি নেপোলিয়নের মতো সেন্ট হেলেনা দ্বীপে বন্দি হয়ে আছি।

ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেলে প্রকৃতিটা একটু ঝিমিয়ে পড়ে, চারিদিকটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে যায়। অনেক দূর থেকে ক্ষীণস্বরে একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। আমার বুকের ভিতরটা কেমন ধক্ধক্ করে উঠল। প্রচ- ঝড়ের তা-বে ভেঙ্গে পড়া ঘরবাড়ির নিচে চাপা পড়ে কেউ হয়তো মরে গেছে। কি আশ্চর্য এ মৃত্যু, পলকে সবকিছুকে একেবারে নেই করে দেয়। কান্নার শব্দে মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠল, তাই ঘর থেকে বের হয়ে এক পা-দু’পা করে হাঁটতে শুরু করলাম। একটু সামনে এগিয়ে গেলে শব্দটা আরও স্পষ্ট হয়ে আসে, আর বুঝতে বাকী রইলো না যে, আব্দুল্লাহর বাড়ি থেকেই কান্নার শব্দটা আসছে। আমার উদ্বিগ্নতা আরো বেড়ে গেল, আমি একটু জোর কদমে এগিয়ে গিয়ে তার বাড়িতে উপস্থিত হলাম। ভেতরে গিয়ে দেখি আব্দুল্লাহ পেটের ব্যথায় বিছানায় গড়া-গড়ি দিচ্ছে, আর মুখ দিয়ে আবোল তাবোল বকছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে- গানের সুরে সুরে সে তার স্ত্রী-সন্তানদের ডাকছে-

“আবিয়া, ছাবিহার মা, বেল্লাল উদ্দিন জালালরে, সকলে দেখিয়া যাও আমারে। নিজের দোষে বান্দা মরে আল্লাক দেয়রে দোষ”

আবিয়া, ছাবিহা, বেলাল ও জালাল আব্দুল্লাহর সন্তানদের নাম। বাবার বুকে মাথা রেখে আদরের মেয়ে আবিয়া-ছাবিহা কাঁদছে। আবিয়ার মা কুলসুম আব্দুল্লার মাথায় বালতির পর বালতি পানি ঢালছে। আজ তার নিজের আবিষ্কৃত ঔষধ “খাওয়ার সোডা” তেমন কাজ করছে না। পেটের ব্যথাটা আজ কেন জানি তার সাথে ভীষণ গাদ্দারি করছে, এতোক্ষণ কোন দিনই তাকে জ্বালায় না। যা হোক অল্পকিছুক্ষণের মধ্যে আব্দুল্লাহ চোখ বন্ধ করে একটু ঝিমিয়ে পড়ল। একটা দীর্ঘম্বাস ছেড়ে কুলসুম নিজের আঁচলের এক প্রান্ত দিয়ে তার মাথা ও মুখ ভালো করে মুছে পানির বালতিটা সেখান থেকে সরিয়ে নিল। আব্দুল্লাহর ভেজা মাথা মুছে দিয়ে তাকে ঠিকঠাক ভাবে শুয়ে দিল।

আব্দুল্লাহর বউ কুলসুম বললো- গতরাতে “প্যালকা“(সজনে পাতা, পুঁইশাক, চালের গুড়ো ও খাওয়া সোডা দিয়ে রান্না করা এক প্রকার মজাদার তরকারি) খ্যায়া তার এ্যামন প্যাটের বিষ হইচে। বাবা মুই এ্যাতো করি কনু- আবিয়ার বাপ তোমার প্যাটের বিষ! তোমাক প্যালকা খাবার না নাগে, কায় শোনে কার কথা।

বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে মানুষের বাড়িতে কাজ কর্ম করতে গিয়ে কখন যে শরীরে তার মরণ ব্যাধী বাসা বাঁধে, সেটা  নিজেও টের পায় না আব্দুল্লাহ। শুধু পেটের ব্যথাটা তাকে মাঝে মাঝে একটু কাবু করে ফেলে। যখন এই পেটের ব্যাথা তীব্র আকার ধারণ করে আর সহ্য হয় না, তখন সে প্রতিষেধক হিসেবে এক মুঠো খাওয়ার সোডা খেয়ে ঢোক-ঢোক করে দু’এক গ্লাস ঠা-া পানি খেয়ে নেয়, এতে সাময়িক কালের জন্য হলেও ব্যাথা খানিকটা উপশম হয়। পেটের ঝিম-ঝিম ব্যথা নিয়ে সে সারাদিন কাজ করে মানুষের ক্ষেতে খামারে। আর কাজ না করলে পেটের জোগানই বা আসবে কোথা থেকে? সংসারে চার-পাঁচ খানা মুখ হাঁ-করে চেয়ে আছে তার দিকে। এমতাবস্থায় কী বা করার আছে তার?

প্রিয় পাঠক এখানে একটু বলে রাখা দরকার, আব্দুল্লাহর জন্ম যে গ্রামে তার নিজের মতো সেটিও একটি আবহেলিত গ্রাম, যার নাম দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা। চারিদিকে ভারত বেষ্টিত বাংলাদেশের একটি ছোট্ট ভুখ- তারও অর্ধেকটা গ্রাস করেছে তিস্তা নদী। এই গ্রামটি গোটা বিশ্বের কাছে “দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল” নামে পরিচিত। একটি স্বাধীন দেশের মূল ভৌগলিক সীমানা থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অন্য একটি স্বাধীন  দেশের মূল ভৌগলিক সীমানার অভ্যন্তরে বিরাজমান ভূখ-। এখানে যেতে হলে অন্য দেশের ভুমির  উপর দিয়ে যেতে হয়। এ ভুখ-টি সম্পূর্ণরূপে নিজদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। এখানকার নাগরিকরা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে নিজেস্ব স্বাধীনতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে পঁচা কাষ্ঠখ-ের ভিতরে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে থাকা পোকার মতো নিষ্প্রাণ জীবন-যাপন করে। পূর্ব পুরুষদের পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে তারা এখানে বসবাস করে।

ভারত সরকার তিস্তা নদীর উজানে জলপাইগুড়ি জেলার ‘গজলডোবা’ নামক স্থানে এই নদীর উপর ‘গজলডোবা বাঁধ’ নির্মাণ করেন। ফলে নদী তার গতিবিধি হারিয়ে ফেলে। অথৈ বর্ষায় ভারত সেই বাঁধের সুইস গেইট খুলে দিলে নদী বেসামাল হয়ে পড়ে, বয়ে যায় দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার অর্ধাংশের ওপর দিয়ে। আব্দুল্লাহর ঘর-বাড়ি, জমি-জমা, বিষয়-সম্পত্তি নিমিষে বিলিন হয়ে যায় নদীর বুকে।

আব্দুল্লাহর বউ কুলসুম, মাঝে মধ্যে আমির মাষ্টারের বাড়িতে টুকি-টাকি কাজ কর্ম করে। মজুরি হিসেবে যা পায় সেটা আঁচলে পোটলা বেঁধে শক্ত করে কোমরে গুজে রাখে। তারপর কাঁচা রাস্তা, জমির সরু আইল হাটু পর্যন্ত কাদা পানি পারি দিয়ে বাড়িতে আসে। গতদিনে সেই বাড়িতে মেহমান আসায় অনেক কাজ বাড়ে, শরীরের উপর খুব ধকল যায়। তাই কুলসুমের চোখে যেন রাজ্যের সব ঘুম এসে জড়ো হয়, সে কিছুই টের পায়না। আব্দুল্লাহ ঘুম থেকে ওঠে কাজে যাবার জন্য, হাত-মুখ ধুঁয়ে এসে হাড়ি-পাতিল গুলোর দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে, হাড়ির তলায় সামান্য একটু দলাপাঁকা ভাত, সেটুকুও যদি সে খেয়ে যায় তাহলে অবুঝ বাচ্চা গুলো কি খাবে? সারাদিন তাদের না খেয়ে যে থাকতে হবে। এই ভেবে সে কুয়ো থেকে একবালতি পানি তোলে, বালতিতে মুখ লাগিয়ে ঢোক ঢোক করে অর্ধেক বালতি পানি গিলে ফেলে। তারপর খক্-খক্ করে দু’তিনবার কাশি দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় কাজের সন্ধানে।

বেলা অনেক হয়ে গেছে শরীরটাও খুব ম্যাচ ম্যাচ করছে, সারাগায়ে ব্যথা, তবুও যেতে হবে অনেক থালা বাসন হয়তো তার জন্য এখনও পড়ে আছে। সে গুলো পরিস্কার করতে হবে, ঘর-উঠান ঝাড়– দিতে হবে, রান্না করতে হবে আরোও কতকাজ তার পড়ে আছে। আবিয়া স্কুলে যাওয়ার জন্য জামা কাপড় পড়ছে, মাকে ঘুম থেকে উঠতে দেখে বলে-

মা, তুমিও কি কাজে যাবে?

হ্যাঁ যাওয়া নাগবে-রে মা।

তোমার না শরীর খারাপ? একদিন কাজে না গেলে কি এমন ক্ষতি হবে?

নারে মা, কাইল ম্যালা কাজ থুইয়া আচ্চি। আর আইজ যদি কাজে না যাঁও, তাহলে আপার খুব কষ্ট হইবে। রাগ করি আর কোন দিন মোক কাজে ডাকবার নয়। ছোট হাড়িটায় অল্প একনা ভাত আছে, দুই বোইনে ভাগ করি খাও।

মা তুমি তো কিছুই খাও নাই, একটু খাও?

অল্প একনা ভাতই আছেরে মা, তোমরা খাও। মুই এ্যালা আপার বাড়িত কিছু একটা খ্যায়া নিম।

রাতে আবিয়ার মা কুলসুম, মেঝেতে একটা মাদুর পেতে আবিয়া, ছাবিহা ও তার বাবাকে খেতে দেয়। আবিয়া তার মাকে তাদের সাথে খাওয়ার জন্য টানা টানি করে, কিন্তু কুলসুম খেতে বসে না। আবিয়া খুব বেশী পিড়া-পিড়ি করলে, কুলসুম বলে- মারে তুই বুঝবু না, তোর বাপক ভালো করি না খাওয়াইলে মোর প্যাটত (পেটে) ভাত যাইবে না।

কুলসুমের বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস আসে তার দুই ছেলের একটিও কাছে নেই, তারা যে কোথায় আছে, কি খাইতেছে, মায়ের মন সন্তাদের চোখের সামনে না দেখলে সায় দেয় না। অভাবের তাড়ণায় বড় ছেলে বেলাল ভারতে যেয়ে কাজ করে। আর ছোট ছেলেটা মানুষের বাড়িতে বাৎসরিক চুক্তিতে কাজ-কর্ম করে, মালিকের বাড়িতেই খায়, সেখানেই থাকে। অনেকদিন বাড়িতে আসে না, মালিক নাকি ছুটি দেয় না।

আজকের দিনটা কোন রকমে আধপেটে পার হলে আবার কালকে কি হবে এই ভেবে রাতে আব্দুল্লাহর ঘুম আসে না। এ পাশ ওপাশ করে কখনো চোখের পাতা দু’টো এক হলে পরোক্ষণে আবার গা ঝিমিয়ে ওঠে। হাত-পায়ের শিরা গুলো টন-টন করে। শিরার ভেতর দিয়ে ক’ফোটা রক্ত যায়-আসে, সেটাও বলতে পারে সে। তার একমাত্র সম্পদ দু’টো বকরি, শত কষ্টের মধ্যেও সে বিক্রি করে নাই কিন্তু এবার বুঝি আর রক্ষা করা গেল না। বাচ্চা কাচ্চা যদি তার না খেয়ে মরে যায়, তবে বকরি দিয়ে কি হবে? তাছাড়া অনাহারে থেকে তার শরীরের অবস্থাও দিনদিন কাহিল হয়ে পড়ছে।

চরের বসত যেমন আজ আছে, কাল নেই। নদীর খেয়াল-খুশির উপর নির্ভর করে এর আয়ুস্কাল। নদীর খুশিতে তার বুকে চর জাগায় আবার ইচ্ছে হলে মুহুর্তের মধ্যে সব কিছুকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। মানুষের  কতো দুঃখ, কষ্ট, হাহাকার, বুক ভাঙ্গা আর্তনাদ কোন কিছু তাকে নূন্যতম বিচলিত করতে পারে না। আপন জঠরে টেনে নিয়ে স্বগর্বে প্রবাহিত হয় আপন ঠিকানায়। কোন কিছু ভ্রুক্ষেপ করার সময় তার নেই। আব্দুল্লাহ আর জেলহকের মতো হাজারো পরিবার ঘর-দোর ভেঙ্গে, পরিবার পরিজন, গরু-বাছুর, ছাগল-ভেরা, হাঁস-মুরগী নিয়ে রাস্তার ধারে কিংবা কারো পতিত জমিতে মাথা গোজার ঠাঁই করে। তারপর আস্তে আস্তে দু’চারদিন পর সেই ঘরগুলোকে খুঁটি দিয়ে খাড়া করে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। শুরু হয় আবার বেঁচে থাকার সংগ্রাম, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে জীবিকা উপার্জনের চেষ্টা করে। শরীরে দিকে নজর দেয়ার সময় এখন নাই। পেট নামক যে ভয়ঙ্কর দোজখ সর্বা দাউ-দাউ করে জ্বলে তার তো খোরাক জোগান দিতে হবে?

এত বড় গেরস্তের ছেলে হয়ে নদীতে মাছ ধরে বিক্রি করা তার আত্মসম্মানে বাজে, খুবই নিন্দার কাজ বলে মনে হয়। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনেরা দেখলে কি মনে করবে, তার ভীষণ লজ্জা লাগে। কিন্তু পেটের ক্ষুধায় তো আর না খেয়ে থাকা যায় না। দিনের পর দিন কতো অভাব-অনটনের ভেতর দিয়ে সংসার চলছিল তারপরেও সে মাছ বেচার কথা কোন দিন স্বপ্নেও ভাবেনি আব্দুল্লাহ। বউ বাচ্চা নিয়ে দিন-রাত না খেয়ে, ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আব্দুল্লাহ জাল নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে যায়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় অনেক মাছ ধরা পড়ে তার জালে। একবার মনে হয় মাছগুলো রান্না করে বড় মাছ দু’টো বাচ্চারা খাবে ছোট গুলো এখন আমরা খাব। কিন্তু শুধু মাছ খেয়ে কি বাচ্চাদের ক্ষুধা মিটবে? কাল থেকে তারা শিঁকায় তোলা এতোটুকু চালের ভাজা খেয়ে আছে। আত্মসম্মানের দিকে তাকালে আমার বউ-বাচ্চা না খেয়ে মরবে। কাজেই এই মুহুর্তে আত্মসম্মানের চেয়ে নিজের জীবনের দাম অনেক বেশী। শুধারাম জেলে মাছ ধরা শেষ করে বালুচরে জালখানা রোদে বিছিয়ে দিয়ে এদিক-ওদিক টানা-টানি করে তাড়াতাড়ি শুকানোর চেষ্টা করছে।

আব্দুল্লাহকে এদিকে আসতে দেখে শুধারাম জিজ্ঞাসা করে- কি আব্দল্লাহ দা আজি কতোগুলা মাছ পাইলেন? তোমার খলাই (মাছ রাখার পাত্র) যে ক্যানে নড়েই না।

হ্যাঁরে শুধা, ভালোই পাইছি আর মাছও বেশ বড় বড়, দুইটা আইড় মাছও পাইছি-রে। সবে সেইজনের ইচ্ছা, গরিবের ওপর দয়া। নইলে যে গরিবের ঘর না খ্যায়া মারি যাবে।

তোমা ঠিক কথাই কইছেন দাদা। ভগবান কাউকে না খ্যায়া মারে না। দাদা তোমা যে কার মুখ দেখি আইসেন, তা কায় জানে। নিত্যদিন তো ভাল-ভাল মাছগুলা তোমায় পান। তা, বাড়ি যাবার নন দাদা?

হ্যাঁরে শুধা তোর সাথে এ্যাকনা কথা কবার জন্য আসিনু।

কি কথা দাদা? তাড়াতাড়ি কয়া ফেলাও? বাজারের বেলা শ্যাষ হয়া যাবার নাকছে। মাছগুলা ব্যাচেবার নাগবে না?

শুধা, তুইতো জানিস, মোর আর আগের দিন নাই। সংসারে আয়-রোজগার নাই, কেমন করি বাঁচা যায় ক’? এখন মান সম্মানের কথা চিন্তা করিলে মোক বউ-ছওয়া নিয়া না খ্যায়া মরা নাগবে।

সামান্য কয়েকটা পুটি, খলসে আর ট্যাংরা মাছ নিয়ে যখন আব্দুল্লাহ বাড়িতে আসে, তখন কুলসুম তার হাতে এ কয়েকটা মাছ দেখে মনে মনে ভীষণ রাগ হয়, কাল থেকে বাচ্চারা না খেয়ে এক রকম উপস করে আছে আর আজও যদি রান্নার কোন ব্যবস্থা না হয়, তাহলে তারা বাঁবে কিভাবে? অনাহারে থেকে থেকে মেজাজটাও কেমন রুক্ষ খটখটে হয়ে যায়। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে-

হা আবিয়ার বাপ আইজ যে শিঁকার কৌটাগুলাও খালি হয়া পড়ি আছে। আর যে কোন উপায়ও নাই, আইজ কি হইবে?

আব্দুল্লাহ মনে মনে একটু ভাব নেয়, যেমন পৃথিবীর সব পুরুষেরাই বউয়ের উপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য নিজেকে বীরপুরুষ হিসেবে উপস্থাপন করে। সেও এমন ভাব যে বউয়ের কোন কথাই এখন পর্যন্ত তার কানে পৌছায় নি। আব্দুল্লাহ বলে-বউ বাজারের ব্যাগটা এ্যাকনা দেও তো? তাড়াতাড়ি কর, দেরি কর না।

কুলসুম ব্যাগ নিয়ে এসে বলে-এই নাও তোমার ব্যাগ। চাল-ডাল কেনার টাকা কোনটে পাবেন এ্যালা? খালি হাতে যে বাজার যাবার নাগছেন?

বউরে আল্লাহ আইজ হামার ভিত্তি মুখ তুলে তাকাইছে, নদীতে অনেকগুলা মাছ পাইছি। শুধারাম’ক বেচার জন্য দিনু, এতোক্ষণে তায় ব্যাচেও ফেলাইছে মনে হয়। মুই তাড়াতাড়ি য্যায়া, বাজারটা করি আসিবার নাগচু।

কুলসুম চুলা থেকে ছাই বেরকরে মাছগুলো মেখে কুটতে শুরু করে। এমন সময় পাশের বাড়ির এরফান খাঁর বউ হাতে একটা পোটলায় কেজি দুয়েকের মতো চাউল নিয়ে আসে। কুলসুমকে বলে-চাচি এই এগুলো একনা থনতো।

ও-গুলা কি বউমা?ক্যান চাচি তোমার মনে নাই? শুক্রবার হামার বাড়িত সাগাই আসছিল সেইজন্য না  তোমার কাছে  চাউল ধার নিছিনু?

না বউমা, মোর একনাও মনে নাই। আইজকাল যে কি হইছে বউমা, কোন কিছুই মোর মনে থাকে না। কুলসুমের নিজের উপর ভীষন রাগ হলো, তার চাল মানুষের ঘরে আর সে কি না চালের অভাবে কাল থেকে বাচ্চা-কাচ্চা সহ না খেয়ে আছে?

ভাতের থালা নিয়ে বসে আব্দুল্লাহ ভাবে- কি সুন্দর পরীর মতো মেয়ে দু’ইটা তার, কাল থাকি না খ্যায়া আছে অথচ একবারের জন্য খাবার চায় না। ক্ষুধার জ¦ালায় নিস্পাপ মুখগুলো লাল হয়ে আছে। হায় খোদা! কোন পাপের শাস্তি মোক দিবরি নাগচিস। মাছের ঝোল মাখা এক লোকমা ভাত মুখে তুলে দেবে এমন সময় পিছন থেকে জালাল এসে ডাকে- মা, ও মা?

এক লাফ দিয়ে কুলসুম উঠে দাঁড়ায়, অনেক দিন পর ছেলেকে দেখে তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে। জালালকে বলে,-

হ্যাঁরে বাবা, এতোদিন  পর তোর মায়ের মায়ের কথা মনে পড়িল?

মা, -মালিক মোক ছুটি না দিলে বাড়ি আইসো ক্যামন করি?

সেটা অবশ্য ঠিক কইছিস বাবা। গরিবের কপাল, যা বাবা হাত-মুখ ধুইয়া আয় সবাই মিলে একসাথে বসি খাই।

ছাবিহা ভাতের থালা ছেড়ে উঠে চুপি চুপি ক’য়োর পারে যেয়ে জালালের কানের কাছে মুখ লাগিয়ে দিয়ে বলে-এই ভাইয়া, মোর জন্য কি আনছিস?

জালাল আর হাসি আটকাটে না পেরে হো হো করে হেসে ওঠে। তারপর ছাবিহাকে কোলে নিয়ে ভাত খেতে আসে।

আবিয়া আর ছাবিয়ার মাঝখানে বসে জালাল। আবিয়া কানে কানে বলে-ভাইয়া, ছাবিহা তোক কি কইলোরে ?

জালাল আবার হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠে বলে- আচ্ছা আগোত ভাতটাতো খাবার দে, তারপর কবার নাগচু।

অনেক দিন পর ভাই-বোনের মুখে হাসি দেখে আবারো কুলসুমের চোখের কোণে অশ্রু এসে গেল। আজ তার মনে হলো, ছোট্ট এই ভাঙা কুঁড়ে ঘরে যেন স্বর্গ নেমে এসেছে। এখন শরৎকাল আকাশে ভাঙ্গা ভাঙ্গা মেঘের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ। চারিেিক অম্লান জোছনা। সেই চাঁদের আলোয় তার তিন সস্তানের মুখগুলো যেন তিনটা চাঁদের মতো জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। মাঝে মাঝে দক্ষিণা বাতাস ঝিরিঝিরি করে বইছে। অনেকদিন পর জীবনটাকে তার অন্যরকম মনে হচ্ছে। ছেলে তার যে কয়েকদিনই থাকুক না কেন সবাইকে যেন বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে থাকে।

 

লেখক: শিক্ষক ও লেখক, লালমনিরহাট।

474 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ১২:২০ অপরাহ্ণ

নাল পিরান

বৈশাখের শেষের কয়দিন। কিশোরীর মনের মতো আকাশের রূপ।ইচ্ছে হলেই বরিষণ আবার দিনের বেলায় আলোর মারাত্বক ঝলকানি।সন্ধার পরই প্রায়শ শুরু হয় বজ্রপাত, দমকা বাতাস,ঝড়,বৃষ্টি যেন নৈমিত্তিক ভীতিকর রজনী।গত কয়েক দিনের ঝড়ের তাণ্ডবে উপড়ে পড়ে গাছপালা, ভেঙে যায় কাঁচা বাড়ি, লণ্ডভণ্ড হয় বিদ্যুৎ সংযোগ। স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পর বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া জাওরানী গ্রামের মানুষ সামান্য বৃষ্টি হলে অন্ধকারেই থাকে।বৃষ্টির সাথে বিদ্যুতের লুকোচুরি খেলার সাথে মানিয়ে নিয়েছে ভুক্তভোগীরা। কর্তৃপক্ষের প্রতি আঙুল তোলা দূরের থাক টু শব্দও করে না।দিনের বেলায় প্রচণ্ড তাপদাহ আর রাতে ঠাণ্ডা এমন বিরূপ আবহাওয়ার সাথে পরিচিত নয় এখানকার সাধারণ মানুষ।

এ গ্রামের উত্তর পূর্বে বড়দল বিল।বিল দিয়ে বর্ষার পানি  গড়িয়ে প্রতিবেশি দেশ ভারতে ঠাঁই নেয়।বিলে রকমারি জলজ প্রাণী বাস করে।প্রতিদিনের মতো রাখী ও রাহী বিকেলে হাঁসের ছানা ঘরে আনার জন্য বিলের ধারে গিয়ে পানকৌড়ির মাছ শিকার ও জলকেলি দেখে ভুলে যায় বাড়ি ফেরার কথা।আকাশ মেঘলা হলেও সেদিকে লক্ষ্য থাকে না তাদের। মা রহিমা ডাকতে ডাকতে নাকাল হয়ে অবশেষে বিলের কাছ থেকে আদরের সন্তানকে নিয়ে এসে স্বস্থি পায়।রাখী  পঞ্চম ও রাহী তৃতীয় শ্রেণিতে পাশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। মা গৃহিণী বাবা প্রান্তিক কৃষক।

বাবা রহিম সন্ধার পূর্বে বাড়ি ফিরেই নিয়ম করে দুকন্যার মুখ দেখে শান্তি পায়।আজ স্বভাবজাত হাসি দিয়ে রাহীর হাতে চকলেট আর রাখীর হাতে লাল কাঁচের চুরি তুলে দেয়।রহিমার হাতে দেয় বাজারের ব্যাগ আর পলিথিনের প্যাকে ইফতারি আর কাগজে মোড়ানো পানেরখিলি।দু’ বোন খুশি মনে হাসতে হাসতে পড়ার টেবিলে চলে যায়।পড়ার ফাঁকে দু’ বোনের খুনসুটি,গল্প, এবং আগামি ইদে বাবার কাছে বায়না  ঠিক করে।এবার তারা  একই রকম লাল জামা ও নুপূর  নিয়েই ছাড়বে। রাখী রাহীকে বলে-

আহী, এবার রিদোত বাবার কান্ঠ্যাত নাল পিরান আর নূপুর নেঈম কিন্তু।দু’ জনে এক্টে হয়া বায়না ধরমো।আর তুই বায়নাটা আগোত ধরবু।বাবা তোক বেশি ভাল্বাসে।ফম থুইস বইনো?
-ঠিকি ফম থাইকপে বুবু।

মাইকে এশার আযান হয়ে গেল।বাবা- মা দু’ জনেই রোযা ছিল বলে রাতের খাবার নামাযের আগেই সেরে ফেলতে চায়।রহিম দম্পতির দু’ কন্যা দুনয়নের মতো প্রিয়। তাদের স্বপ্ন কন্যাদ্বয় ঘিরে। তারা রান্নাঘরে কাঁচা মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে এক সাথে খাওয়া করে। যথারীতি কন্যাদ্বয়কে নিয়ে বাবা-মা মাদুরে বসলেন। রাহী বাবার কোলে বসে গলা ধরে বলতে থাকে-
– বাবা, ওযা বেড়াইলে রিদ। এইবার হামাগুলাক একে মতোন নাল পিরান আর নূপুর গড়ে দিবার নাগবে।হামা রিদের দিন পরি বেড়ামো। বাবা বলে-
– মা রে মোর তো কস্টে কোন মতোন দিন চলে।তোমা গুলার মুখের ভিতি চ্যায়া বায়নাকোনা পুরন করিম, মাওও। দুই দোন জমির ধান পাকি গেইছে।ধান কাটি বাজারোত বেচে কিনি আনমো।তোমার গুলা চিন্তা না করেন,মাও,ভাল্ করি পড়া পড়েন।

রহিম -রহিমা কর্মঠ দম্পতি। রহিমা  ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েই পাঠ চুকে যায়।তাকে পারিবারিক সিদ্ধান্তে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। সে রান্নার কাজ করেও হাঁস- মুরগী পালন এমনকি ফাঁকা যায়গায় সবজি চাষ করে।নিজের চাহিদা পুরণ করেও বাজারে মাঝেমধ্যে বিক্রি করতে পারে।তবে বিলের ধারে থাকলেও মাছ ধরার সুযোগ নেই।কারণ বিল এখন উন্মুক্ত নয়, বিলের মালিকরা ইজারা দিয়ে থাকে।চোখর সামনে মাছের খেলা দেখলেও উদরপুর্তি করার কোন সুযোগ নেই।যদ্বরুন দু’ কন্যার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে  বাবা- মা কে হিমশিম খেতে হয়।

পুরোদিন পরিশ্রম ও কাজের ক্লান্তি শেষে সন্ধার পর স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে খোশগল্প,সাংসারিক পরামর্শ,ভালোলাগা,ভালোবাসা ভাগাভাগি হয়।রহিমা স্বামীকে বলে-
– আখির বাপ,ছাওয়াগুলা তরতর করি বড় হবার নাকছে।দুই বইনে কাজে কামে মোক মেল্লা সাহায্য করে।সকাল সইন্ধাত পড়ির বইসে।ছাওয়া দুইকনা খিব ভাল্।আরেকখান কতা,সামনের রিদোত তোমা মোক কি দিমেন?
রহিমা স্বামীর কাছে বায়না ধরতে ধরতে তার পছন্দের পান -জর্দা   মুখে পুরে দেয়।স্বামী- স্ত্রীর মুচকি হাসিতে ঘরটাই আলোকিত হয়ে পরে।রহিম অভ্যাস বশত রহিমাকে আলতো করে কাছে টানতে চাইলে সরে গিয়ে বলে-
– তোমার স্বভাব ভাল্ হইল না।এ্যালা ছাওয়া পাওয়া বড় হইছে, অমতোন না করেন তো।এ্যকনা ভাল্ হন।আচ্ছা,তোমাক যা কইনে শুনির পাইছেন কি?
– কি?
– রিদোত মোক কি কিনি দিমেন?
– শোনেক বউ,ভাল্ করে জানিস মোর হাউস থাকলেও টাকা পাইসা তেমন নাই।মন তো চায় ম্যল্লা কিছু কিনি দিবার।দেখিস না পাশের বাড়ির পুলিশের বউ দেখতে তোর মতো সুন্দরীও নোমায় ওই ভাবি নয়া দামী শাড়ি আর গয়না পিন্দিয়া কেমন করি ঘুরি বেড়ায়। মোরও তো মন চায়।

– ওরে মোর ওইল্যা কতা থোন তো।তোমা মোক ভালবাসেন তাতেই মোর চইলবে।মোর কিছু নাগবে না। ঐ ভাবি ভাল্ শাড়ি গয়না পিন্দিলে কি হইবে উমার দিনাং কাজিয়া।শুনছুং আইতোত বেগল থাকে,ছাওয়া পাওয়াও নাই।
– মাইনসের ভিতি দেখার হামার টাইম নাই। হামাক দিছে আল্লায় দুইকোনা মাই ছাওয়া মুই বাচি থাকতে মানুষ করিম।হামার সময় বাড়ির কাইন্ঠাত ইশকুল কলেজ না আছলো।হামা খেলা খেলাছি আর ঘুরি বেড়াছি।বাপ মাও হাল চাষোত নাগে দিছে।এ্যালা থিত পাছুং না পড়ি কি বিপদ।পদে পদে ঠগা নাগে।আর শোনেক,ঐ যে মদাতি ইউনিয়ন কাউন্সিলের কাদের চেয়ারম্যনের বেটি দুইকোনা, শুনছুং মেল্লা বড় অপিছার।কিসের বলে ম্যজিস্টেট।মুইও বাচি থাকলে বেটি দুইকনাক মানুষের মতো মানুষ করিম।
– তোমার যত স্বপন।হামা গরীব মানুষ।হামার বেটি কি ওমার মতো হইবে?
– ক্যা না হইবে? মুই চেস্টা করিম।সরকার তো টাকা পাইসা দেয়, সমইস্যা কী?
-আরেকখান কতা, সামনের সেমাই খাওয়া রিদোত মুই সেমাই কিনিম না। হামার সিয়ামের বাপ কলেজের মাস্টার ওমরা কইছে সেমাইয়োত ভেজাল বেড়াইছে।ফমে নাই আরো মেল্লা কিছোত ভেজালের কতা কইছে।মুই তো নেকাপড়া জানংনা কোনটা ভেজাল আর কোনটা ভাল্ বুজির পাইম না।ছাওয়া গুলার ভবিষ্যতের ভিতি চ্যায়া ওইল্যা  সেমাই আনমো না টাকাও নস্ট করমোনা। বাড়িত হাতের সেমাই গড়ে থুইস, বউ।
– তোমা চিন্তা না করেন।মোর মাও আলো চাইল দিয়া পাঠাইছে।উরুন- গাইনোত আটা কুটি হানে সেমাই আর পিঠা বানে থুইম।-
– ম্যল্লা কতা কইনেন।এ্যলা ছাওয়া গুলাক নিয়া খেয়া শুতি পরি নিন যাই,,,

সন্তানদের ঘিরে স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে রহিম- রহিমা।সব পরিশ্রমের ক্লান্তি দূরীভূত হয় দু’ কন্যার চাঁদবদন দেখে। ওদের স্কুল যাবার বেলায় নিজ হাতে সাজিয়ে দেয় এবং  টিফিনটা সাথে দিতেও ভুলে না রহিমা।যাবার বেলায় যতক্ষণ দেখা যায় পথপানে তাকিয়ে থাকে।আবার ফেরার সময় হলে অপেক্ষার প্রহর গুণে।

রাখী -রাহীর ইদের আব্দারের কথা ভুলে যায় নি স্নেহময়ী পিতা।নিত্য ধানক্ষেতে যাওয়া আসা করে আর ভাবে কবে সোনালি বরণ ধারন করবে।এই সোনালি ধানের সাথে প্রিয় সন্তানের আব্দার পুরণ যেন একাকার হয়ে মিশে আছে।ধানী জমির চারিদিকে পায়-চারি করে আর বিড়বিড় করে বলতে থাকে তার মনোবাসনার কথা।মনে হয় ধানক্ষেত তৃতীয় সন্তানের মতো পরম মমতায় ঘিরে রেখেছে রহিম দম্পতিকে।

ধীরে ধীরে ধানের সোনালি আভা চলে আসে।খুশিতে পুলকিত হয় রহিম।বাড়িতে ধান পাকার গল্প করে রহিমার  কাছে। রহিমা স্বামীকে দরদমাখা কণ্ঠে বলে-

– আখির বাপ,বোশেক মাসের দেয়ার ঠিক ঠিকানা নাই।কখন যে তুফান আর ঝড়ি আইসে।তোমা ২/৩ জন লোক নিয়া ধান কোনা কাটি ফেলান।আর ধনতলা পুলের কাইন্ঠাত পাকা আস্তাত তুলেন।মেশিনোত ডাংগেয়া ওটেই শুকির দিমো।
– শোনেক বউ,আরেকনা ভাল করি পাকুক।অংকোনা ভাল্ হইলে বাজারোত বেচাইতে সুবিদা হইবে।শুনবার নাকচং  এবারে ধানের দাম খুপ কম।
–  মুই আর কি কং।তোমরা যা ভাল্ বোজেন,,,,,।

সন্ধা ঘনিয়ে আসতেই উত্তর আকাশর ঘনকাল মেঘের আনাগোনা।মেঘ আকাশের গায়ে নয় ঠিক যেন রহিম- রহিমার গায়ে।ঝোড়ো হাওয়া মেঘমালা তাদের স্বপ্নের সলিল সমাধী দিতে আসবে।এমনিতে ধানক্ষেত নিচু জমিতে হওয়ায় অল্প বৃষ্টিতে তলিয়ে যাবে।তাদের চিন্তার অন্ত নাই।

কিছুক্ষণেরর মধ্যেই ভারী বর্ষণ আর ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হয়ে গেল।প্রতিটি বিজলি চমক যেন রহিম রহিমার বুকে সেলের মতো বিঁধতে লাগল।রাখী ও রাহীকে বুকে জড়িয়ে ঘুম পারালেও তাদের দু’ জনের নির্ঘুম রাত যেন স্বপ্ন হত্যার নিরব স্বাক্ষী হয়ে থাকতে হল।সেহরীর সময় বাইরের ঝড় থামলেও রহিম- রহিমার ঝড় কবে থামবে উপরওয়লাই জানেন।

ভোরের আলো ফুটতেই দু’ জনেই ছুটে চলে সন্তানসম লালন করা ধানক্ষেতে।ক্ষেতের কিনারে দাঁড়িয়ে দেখে ধানক্ষেতের কোন আলামত নেই যেন থৈ থৈ জলে ভড়া নদী।।ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা কারো মুখে টু শব্দও নেই,শুধুই দীর্ঘশ্বাস! রাখী ও রাহী হাঁসের ছানা নিয়ে ভাবলেশহীন পিতা- মাতার মুখপানে তাকিয়ে। অমন করুণ মুখ তারা কোন দিন দেখে নি।হাঁসের ছানা বৃষ্টির জলে যতটা আনন্দে নাচতে থাকে অপরদিকে ততটা নিরানন্দ তারা।অনেকক্ষণ চুপ থেকে রহিম বলতে থাকে-

– হায়রে মেঘের পানি! মোর ছাওয়ার রিদের নাল পিরান আর নুপূর ভাসে নিলু? মুই ক্যংকরি ছাওয়া দুইকনার বায়না পুরণ করিম।সরকার তো মেল্লা উন্নয়ন করিল।মোক কি কিছু দিবে?

 

লেখক:
সহকারী অধ্যাপক
দইখাওয়া আদর্শ কলেজ
হাতীবান্ধা, লালমনিরহাট।

466 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ১২:১৬ অপরাহ্ণ

ময়নার বাপ

-আইজ ভেষণ জার নাগোছে বউ!

— বিয়ান বিয়ান তোমার আরও যা কতা, শেতেরদেনোত জার নাগবে নাতো কী গরম নাগবে?

-ধুর…ও, তোক্ কোনো কতা কওয়ায় যায় না। একান কতা কইলে খালি ঠাসঠাস করি আরেকটা ওত্তর দেইস।

— হয়…। তা মোর সাথোত কতা না কইলেই পারেন। মোর মোখোত কোনো মধু নাই। আছেন তো সোখোত কী বোজমেন। সেই সক্কালে উঠি কাম করতোছি, ঠাণ্ডাত হাতপাও বরপ হওয়া গেইছি, মুই এলা কাক্ কও? হইচে, এলা ওটো…। উঠি মোক এনা উদ্ধার করো।

মাও ময়না…. কোনটে গেইনেন মাও, এদি মোর কাছোত এনা এস্কা মোছা কপড়াখান ধরি আইসোতো মাও, মেলা বেলা হয়া গেইছি টপকরি শহরোত এস্কা ধরি কামাইত যাওয়া নাগবে, আইজ বুঝি আর স্কুলের ভড়া ধরির পাইম না, মেলা নেট হয়া গেইছি আইজ।

-বাজান অংপুর গেইলে মোর বোদে একান ফাইভের নয়া বাংলা ব্যাকরণ বই আর যে জার পইরচে তার বাদে একান মোর জামপাটও ধরি আইসেন তো।

— ক্যানে মাও সেদিনে না বই আনি দিনু?

– ছার কইছে এলা বোলে ওটা বই আর চইলবার নোয়ায়, নয়া নয়া কী কী বলে দেছে নয়া বইয়োত।

— কায় জানে বা… কী যে নয়া নয়া ভেজাল হয়ছে! ঠিক আছে মাও আনিম এলা।

-ময়নার বাপ বেটিক ধরি কী আও করেনছেন এতকন হাতে?

— তুই থামলু এলা। এই বেটিছওয়ার জবানোত কোনোই অসকষ নাই, সোগসময় খালি খাসাউ খাসাউ…।

-হয়… মুই কতা কইলে তো, তোমার খালি আগ চরি যায়! বেটিক অতো পড়ানেকা করায়া কী কইরমেন শোনো? সেই তো ব্যাচে খাওয়ায় নাইগবে। মাইনসির বাড়িত যায়া কাম করি খাওয়ায় নাইগবে।

— তুই চুপ হলু ময়নার মাও! (শালির বেটিছওয়া)।

— মাও… তাইলে থাকেন, মুই আসনু। মন দিয়া পড়া পড়েন, তোমার মাকো এনা কাজোত আগেটাগে দ্যান। বাইরোত কিন্তু এক্কেবারে বেড়াইমেন না, সাবধানে থাকেন মাও!

-আইচ্ছা বাজান। বই আনির কতা ভোলেন না ফির।

— ঠিক আছে মাও, ভুলিম না, আনিম… আনিম।

 

লেখক: কবি, রংপুর।

474 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ১১:৫৮ পূর্বাহ্ণ

সাত সতেরো

অ শম্পার বাপ। নিন্দাইচেন নাকি বাহে ।

নোয়ায়। কি কবার চাইস।

থ্যাইক এলা কবার নঁও।

আউ এত আইতত উটি কোন্টে যাইস।

এই এলায় আসম্।

ঘরত্ এ্যাকনাও নিদ আসিচ্ছল না। কি করম। ক্যাংকা করি এই দরিয়া সাঁতরাইম। কুল কিনারা খুঁজি পাং না বাহে। আগিনা খুলিত এ্যানা ঘোরাফেরা করং। মনটা হালকা হবার বাদে যায়া শুতিম আলা।

আউ আউ দেকচেন বাহে চরাই গোরার দুয়ারের হুরক্যা ক্যাঁও দেয় নাই। এইটা কতা হইল। মুই না দেখলে কিচু হবার নয়। এ্যানা ইতি উতি হইলে হয়, সউগ এক্কেরে ভাসি যাইবে। একে তো শরীল পারে না তার উপরোত মাইয়াক নিয়া এ্যাংক্য অবস্তা আর পাঁরো না।

উদিনক্যা মাসদের বাপ ঘটোকক্ কনু তোমরা যদিক্যাল এইং করেন , হামরা আউগাইম ক্যাংকা করি । হামাক এ্যানা চিন্তা ভাবনার সময় দিবার নন বাহে।

বেটিটা মোর কলেজ পাশ করিল। আরো পড়িবার বাদে  ক্যাচাল করোচ্ছল। হামরা গেরামের মানুষ আরকতো উপরোত যাঁও। তাতে মোর মনটা কয় বেশি দূর গেইলে অন্যটা যদিক্যাল হয়।  মাইয়ার মুখোত চৌপরদিন আইত, ভাসান ভাসান কতা উগলে উগলে পরে। ভয়োতে মুই এ্যক্কেরে সিটকি যাঁও।

শম্পা মোর একেনাই বেটি  , দেখতে শুনতেও অপছন্দের নোয়ায় । কিন্তুক ভাবনার কথা হইল ঘটক আনচে চ্যযারম্যনের ব্যটার সম্বন্ধ । আক্কেলখ্যান দ্যাখো দেখি । অমার ব্যাটা বোলে হামার বেটির তাকি নেকাপড়াত কম । তা এক্কেরে যে কম বাহে । খালিবোলে স্বাক্ষর  দিবার পারে ।  হামার ভাবনার বিষয় হইল এটি । বাড়ি ঘর সমন্ধ সউগ ঠিক আছে । এটি আসি থামি গেঁইচু ।

পাড়াপরশি কয়ছোল শম্মার বোলে বিযার বয়স পার হইচে। এলা কি করং। তারবাদে কি  বেটির থাকি কম পড়াজানা ছোয়ালোক জামাই করিম । বাপের টাকা পইসা জমি জিড়াত আবাদ সুবাদ তামান হামার থাকি ম্যালা বেশি। ছইলের মোর কোন অভাব হবার নোয়ায় ।

মোর কতা হইল বাপের আছে তাত কি । বাপের ধুইয়া সারা জেবন চইলবে  । বাপের নামে গগন ফাটাইলে হইবে। নিজে কি তাক দাখার ন্যাগবার নোয়ায় । বাপের জমি আছে ,খামার আছে , বাপে এলকার পত্তন দিছে , বপোক সগলায় চেনে — হামার এলকার রাজা , ভালো কতা কিন্তুক তার বেটাক যখন জামাই করিম মাইনষে পুচলে কি কইম । না পড়া না সম্পদ । এগলা চিন্তা ভাবনাত ফমও থাকেনা ।

অ পারুল পারুল ঘুমাইচিস মাইও । দিগিবাতাত টাপোত শুটকির ক’ল্যাখান নামাচিস মা

হু ।

অ শম্পার মাও ব্যাড়ালুতে ব্যাড়ালু । এত আইতোত খুলিত কি কামখান করিস ক’দেখি । আয় তো শোতেক । কাইল মাসদের বাফ  আইসপে হামরা কি কইম শুনবার বাদে ।

তোমরা কি কন ঐ ছইলোক জামাই করা যায় । বাপোক ব্যাচে খাওয়া ছইল।

 

লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষক, রংপুর।

495 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ১১:৫৩ পূর্বাহ্ণ

উপহার 

খুব- ই হিয়াল ৷ ওশ, ঠাণ্ডা বাতাস ৷ পাঁচ হাত দূরের ঘাটায় দেখা না যায় ৷ সূয্যের মুখ কয়দিনে দেখা যাইবে কাঁয় জানে ৷ অমিজল কেংকা করি গাড়ি ধরি যাইবে এলা  ৷ মমতাক ওমরা রাইতোতে কয়া থুইচে , ‘ সকালে গরম ভাত আন্ধিবু মমতা ৷ খায়া গাড়ি ধরি অমপুর  যাইম ৷ মহাজনের মাল আনা নাইগবে ৷ ‘

ওমাক ফির মানা করাও যাবার নয়  ৷ কতা একবার দিলে হয় , হাকিম নইড়বে আর ওমাক নড়ায় কাঁই ৷ কোনো কূলকিনারা করবার পায় না মমতা ৷ ঘুম থাকি উঠিয়া ওমরা কলের পাড়ত গাঁও ধুয়ায় তো কইবে মমতা হইচে তোর আন্ধাবাড়ি ৷ এই ঠাণ্ডাত সাবান দিয়া ঘষিঘষি মজিমজি গাঁও ধুইবে ৷ মোকো কইবে গাঁও গোসল করি আন্ধাবাড়ি চড়াচিস নাকি ছুয়া গায়ে চুলার পাড়ত নটরঘটর করিস  ৷ হুকুমমতো না চললে মুখখান থাকি ভালো কতা বাড়ায়ে না ওমার ৷

বিয়ার পর থাকি ওমার এইদোন ব্যবহার দেখি আইসে মমতা ৷ বিয়া হইচে বছরখানিক হইল ৷ সংসারত অমিজল, ওমার মাও আর ছোটো একনা বইন ৷ খুবে আদর করে বইনকোনাক ৷ কোনো জায়গা থাকি আসি বাড়িত ঢুকলে হয় বইন কোনার জন্যে কিছু ধরি আইসায় চাই ৷ অমিজল উয়াক

অহনা , কোনসমায় ছোট ‘ বু করি ডাকায় ৷

অহনা উয়ার মাও শুদ্ধায় এক ঘরত আর মমতা ,অমিজল আর এক ঘরত ৷ বিয়ার পর পর অমিজল উয়ার ঘরকোনা ডিমডাম করি একনা খাট, আলনা , আয়না নাগা আলমারী বানেয়া কোনোমতে ঘরকোনা সাজাইছে ৷ মনোত ভর্তি আশা ৷ মাথায় ঘনচুলে সিঁথি করা , চ্যাপ্টা শরীরে শ্বশুরের দেওয়া নাল শার্টকোনা অমিজলক খুবেই মানায় ৷ কোনোঠাই যাবার হইলে জামা, প্যান্ট কোনা পিন্দিয়া আয়নার বগলোত যায় আর ঘুরি ঘুরি দ্যাখে ৷ একসময় মমতাক কয় ,

‘ মমতা তুই মোক পায়া খুসি তো ? ‘

‘ তোমার শরম নাই ! ‘তোমরা মোর স্বামী ৷ আল্লাহর দোয়ায় তোমাক নিয়া মুই খুবেই খুসি ৷ আল্লাহ দিলে হামারো বালবাচ্চা হইবে ৷ সংসার বড় হইবে ৷ ‘ আর কবার  পায় না মমতা ৷ শরমে নাল হয়া গেল একেবারে ৷

‘ শরম পালু  মমতা ? -ঠিকই তো কচিস ৷

কয়দিন থাকি তোমাক একটা কতা কবার চাঁও ৷ মনে কিছু করবার নন তো ৷

ঐযে তোমার বলে কিসের বাল্য বন্ধু হেকমত উয়ার আও বোঝেন তোমরা ? উয়ার ভাবভাষা ভালো নোয়ায় ৷ সেদিন মোক কয় ‘  ভাবি , হাঁটো পুকুর পাড় থাকি আসি ৷ ‘

‘ মুই ক্যান সাঁনজোত পুকুর পাড়োত যাও অবিয়া চেংরাটার সাথে ! কিসের বা ঐ গায়োত ট্যাংলে ট্যাংলে কতা কয় ৷ ক্যা এমনি  আও কইরলে মুই বোঝোম তো ৷ ভোটের সমায় ঐ পত্তায় এবেলা ওবেলা ৷ আর কইবে ভাবি, এককাপ চা হইবে ৷ না থাইকলে চা চিনি আনি দ্যাও ৷ ‘

‘ ভাত একটা টিপলে খবর হয় ৷  উয়ার নজর সুবিধার নোয়ায় ৷ ‘

‘ আরে নোয়ায় ৷ ‘ কথাটা উড়ি দিলেও অমিজল আন্দাজ কইরবার পাইছে ৷ হেকমত অমিজলের সংসারের সুখ সবার পায়না ৷ মোকো তো ঘুরি ঘুরি কয় , ‘ মমতাক পায়া  তোর তো দিন ভালোয় যায় ৷ মুই কানা শুকানোত পড়নু রে অমিজল ৷ ‘

‘ শীতের সমায় বউ ভালো ৷ ‘ অমিজল শুনতে শুনতে একবার ধমক দেয় ৷ তোর আর কতা নাই রে হেকমত ৷

হ কামের কতাত আসি , ভোটটা কােনটই দিবু ? চাচী , তোর ভোট জলিল মাষ্টারক দেইস নাকি অন্য কোনো চিন্তা করি থুছিস ? না , না তুই য্যাটে , মুইও স্যাটে ৷ অমিজল জানে হেকমতের সাথে উল্টাপাল্টা কয়া লাভ নাই ৷

গাড়ির শব্দ শুনি বাইর হয় মমতা ৷ ওমরা বুঝি আসিল ৷ আছরের আযান হইলো মসজিদে ৷ গামছা, লুঙ্গিখান আউগি দিয়া কয় ‘ হাতমুখ ভালো করি ধুয়া আসিয়া আগে খাও ৷ ‘ ঠাণ্ডাত আর এবেলায় গাও ধুবার না নাগে ৷ তোমরা যাও মুই খাবার দ্যাও ৷

‘ হইবে এলা ৷ মমতা অনেকক্ষন তোক দেখোনা ৷ আইজক্যা কি বার , কয় তারিখ মনে আছে ? ক্যা কি হইছে ৷ আজকার দিনে তোক মুই বিয়া করি ঘরত তুলছোম ৷ তুই কানা কিছুই মনে থুবার না পাইস ৷ বিয়ার বছরকি জন্য তোর জন্য এই শাড়িটা ‘ উপহার ‘ আনছম ৷ পিন্দি আয়তো দেখম৷ হইবে এ্যালা তো ৷

ভাইয়া মোর ? অহনা দৌড়ে ভাইয়াক পাঞ্জা করি ধরে ৷ মোর জন্যে কি আনছিস ভাইয়া ৷ এইয়ে – সোন্দর ড্রেরেস ৷ পড়ি আয়তো বু ৷

অমিজল কি ব্যাপার রে ? সারাদিন তোর দেখা নাই  ৷ ইতি কত কি ঘটি গেল ৷ অমিজল অবাক – টাস্কি লাগি গেল হেকমতের কথাত ৷ আব্বা – চাচা সবাই যায়া উজানটারির আবুল মন্ডলের বেটি বিউটির সাথে মোর বিয়ার নিশ্যান দিয়া আসিল ৷ সামনের সোমবার বিয়া ৷

কি সুসংবাদ ৷ তুই হামরা আইজ একসাথে এটে খাম ৷ আইজ অমিজল মমতার বিয়ার একবছর হইলো ৷ তাহলে তো মোকো কিছু দিবার নাগে ৷ মুই বাজার যাইম আর আসিম ৷ দৌড়ে বাইর হইলো হেকমত ৷ অমিজল মমতা ওর কাজে তাজ্জব হয়া গেল ৷ নির্মল শান্তির পরশে পরম আলিঙ্গনে মমতাকে বুকে জড়িয়ে আদর করে অমিজল ৷

 

লেখক: সাহিত্যিক ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, রংপুর

451 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ১১:৫২ পূর্বাহ্ণ

ফান্দে পড়ি খুশি

গপ্পটা ম্যালাদিন আগের তকন মুই বিএসসি পড়ো আর পাশাপাশি চাকরির পড়া সাথে পরীক্কাও দেও।

পোত্তেক মাইনষ্যের একটা স্বপ্ন থাকে চাকরি করা, মোরও আছে।

তা কয়টা চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার পর জাইনবার পাননু প্রাইমারি ইশকুলের সহকারি শিক্ষক পদে ভাইভাত মোর রোল আলচে। মুই তো মহা খুশি নেকিতো পরীক্কা ভাল হইচে, ফির নারী আর পোষ্য কোটাও আচে।

মনে মনে একনা ভরসা পাওচু, মনে হওচে চাকরিটা হইবে।

এই খবর মোবাইলোত না দিয়া সরাসরি বাড়ি আসি দিনু। শুনিয়া মোর ছোট ভাই কইল এই চাকরি কইরবার পাবু?

মুই কনু ক্যান না পাইম।

তারপর কওচে প্রাইমারি-র ছইলেরা গ্যাদড়া খুব, পরিস্কার হয়া স্কুল আইসে না তার উপর নাকের স্যাদন। ফির সোন্দর করি কতা কয় না। তুই মুই করি কতা কয়।

তুই তো ফির স্ট্যান্ডার্ড কতা কইস (তখন বাড়ির মধ্যে মুই একমাত্র চলিত ভাষাত কতা কও আঞ্চলিক ভাষা পছন্দ করো না) মুই কনু যে দোয়া করিস চাকরি হইলে সউগ বদলে দেইম, ইন শা আল্লাহ।

কয়দিন পর ভাইভার ডেট চলি আইল। একটা খালাতো বইনোক ধরি ডিসি অফিস গেনু ভাইভা দিবার। ভাইভা বোর্ডত কয়টা প্রশ্ন করার পর মোর পড়ার বিষয় সম্পর্কে জাইনবার চাইল তকন কনু যে মুই ল্যাবরেটরি মেডিসিন (প্যাথলজি) বিষয়ে পড়ো। তখন এক স্যার মজা করি কয়া ফ্যালাল তোমাক চাকরি দেয়া যাবান্যায়, তোমরা এইটে থাইকপার ন্যান। তকন মুই একনা মিচা কতা কনু যে, মোর স্বপ্নের পেশা এইটা। চাকরি হইলে ছাইরবার ন্যাও। আসলে মোর স্বপ্ন আচিল পাইলট হওয়া। যেহেতু সেটা আর হওয়া সম্ভব নোয়ায় সেইজন্যে ভাগ্যের উপর ছাড়ি দিয়া মিছা কতা কনু।

তাছাড়া হামার দ্যাশত একটা সরকারি চাকরি সবায় সোনার হরিণ কইলেও মুই কও হীরা-র হরিণ।

তারপর মোক কইল মুই নাচ গান জানো কি না? মুই কনু স্যার নাচ না জানলেও গান চেষ্টা কইরবার পাও।

কইলো ঠিক আচে কন,

শুরু করনু

যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই……….

এরপর কইল ঠিক আচে তোরা এবার আইসো।

বাইরোত বেরাইতে আর সবায় হুড়মুড়ি পড়িল মোর উপর কি কি ধরাচিল সেইগলা জাইনবার তকনে।

মুই ও কনু কি কি ধরাইছে।

এরপরে মোর খালার বেটির সাথে চলি গেনু পুলিশ লাইন ইশকুল মাঠের ম্যালাত। ম্যালাত য্যায়া জামাকাপড় কিনি হাওয়াই-মিঠাই খাইতে খাইতে বাড়ি আনু।

মাসখানেক পর ফাইনাল রেজাল দেইল মোর এক বড় ভাই ফোন করি কইল মোর চাকরি হয়্যা গেইছে।

উয়ার কতা বেশ্বেস না করি মুই নেজে গেনু কম্পিউটার এর দোকান য্যায়া দেকো সত্যয় মোর চাকরি হইছে।

দোকান থাকি মেস যাবার ধরি খুশির ঠেলায় কোটে যে মোবাইল ফেলাচু আর মনে কইরবার পাওচু না। মন টা একনা খারাপ হইল মোবাইল টা হারেয়া। এলাও বাপ-মাক খুশির খবরটা দিবার পানু না।

মেস-ত য্যায়া রুমমেট এর মোবাইল থাকি খবরটা সবাকে জানানু। কতা কয়া মনে হইল সবার চ্যায়া খুশি মোর বাপ। মোর বাপও একজন ইশকুলের মাষ্টার আছিলো, তাঁর পথ ধরি তার বেটি হাটপে  সেই তকনে মনে হয় খুব খুশি। এরপরে আস্তা ঘাটে  যারে দেকা পাও তায় খালি মিষ্টি খাবার চায় আর কয় মুই চাকরি কইরবার পাইম তো? কায়ো কায়ো কয় এইবার ফান্দোত পলচিস। কয়জনের মোকত এই কতা শুনার পর পুছ করনু এই কতা-র মানে কি?

সবায় কওচে তুই যে পোচপাচ নিয়া বেড়াইস, এই চাকরি তোর জন্যে নোয়ায়। তুই ছাওয়ার ঘরে এদন কাজকারবার সহ্য কইরবার পাবার নেইস। এইগলা কতা আর মোর ভাই এর কতা শুনিয়া মনে হইল মোর কিছু ভাল না নাগলে বদলে ফেলাইম তাছাড়া বয়স তো আচে।

কিচুদিন পর জয়েন করার চিটি পানু, মনটা খারাপ হয়া গেলো চিটি প্যায়া।

বাড়ি থাকি স্কুল ম্যালাদূর। প্রায় ১৯ মাইল বাড়ি থাকি। পরেরদিন গেনু স্কুল দেইকপার। কি আর কইম দুক্কের কতা।

এমনি তো দূর তার উপর ফির আড়াই মাইল ঘাটা কাচা। এখান করি পাও ফেলাওচু আর ধুমার মতোন ধুলা উড়াওচে। আদখান সাদা হয়া স্কুল পৌছিনু। সবায় মোক দেকি মনে করচে মুই সাংবাদিক।যাই হোক কনু যে মুই ও তোমার সহকর্মী হবার যাওচু। সবার সাতে কতা কয়া ভালই নাগিল।

বাড়ি আসিয়া ভাবুচু এই এতদূর ঘাটা মুই ক্যামন করি যাইম নেত্তেদিন?

ভাবতে ভাবতে হঠ্যাৎ একটা সুপ্ত ইচ্চার কতা মনে হইল। ছোটতে ন্যাশনাল টিভিত দেকচিনু ইন্ডিয়ান নাইকাগুলা সাঁ সাঁ করি উড়ি যায় স্কুটার নিয়া। তকন থাকি ইচ্চা একটা চাকরি হইলে এখান স্কুটার কিনিম। তকন মনে হইল স্কুটার ই একমাত্র এই সমস্যার সমাধান। বাড়িত সবাকে কনু স্কুটার কিনবার চাও। সবায় একমত হইল মোর কতার সাথে।

যেদিন অফিসিয়ালি ইশকুল গেনু পোত্থম দিন। সবায় খুশি। ইশকুলের ছাওয়াগুলা একেরে মোক দেইকপার জন্যে ঠেলাঠেলি শুরু করি দেচে। ওমাক কনু তোমরা ক্লাসত যাও মুই তোমার ক্লাসত যাইম।

একনা পড়ে হেড স্যার আর অন্য স্যারের ঘরে সাতে ক্লাসত গেনু য্যায়া দেকো মোর ভাই এর কতা সত্য, নাক দিয়া স্যাদন বেড়াওচে, স্কুল ড্রেস নাই সবারে, পিরান দেকি মনে হওচে খুবই গরীব।

সউগ ক্লাস দেকিয়া মন টা খারাপ হয়া গ্যাল। বার বার খালি মোর ভাই এর কতা মনে হওচে।

কয়দিন ধরি পরিচয় পর্ব চলার পর মোর খালি মনে হওচে পরিবর্তন দরকার।

একলায় কি পাইম?

খারাপ নাগা বিষয়গুলা নিয়া হেড স্যারের সাতে আলোচনা করনু।

একজন মাষ্টার কয়ায় ফ্যালাইল নয়া আলচেন তো এইজন্যে ত্যাল।

মুইও মুকের উপর কনু এই পেশায় থাকলে এই ত্যাল আজীবন থাকপে ইন শা আল্লাহ। এরপরে যেদিন ক্লাস নেওয়া শুরু করনু দেকো ছইলগুলা মোক ভয় করোচে গায়ের গোরত আইসবার চায় না, কতা বাড়বার চায় না। এর কারণ হিসাবে আবিষ্কার করনু মুই যেভাবে চলিত ভাষাত কতা কওচু ওরা এই ভাষাত অভ্যস্থ নোয়ায়। মুই তো ওমার মতোন আঞ্চলিক কতা কবার পাও না। ভাল নাগে না মোর এই রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা। তাইলে বুদ্দি? ওমার কাছাকাছি আইসবার গেইলে  তো মোক ওমার ভাষাতে কতা কওয়াই নাগবে। পরের ক্লাসত চেষ্টা করনু ওমার মতোন করি কতা কবার।

অনেকটা কবার পাও ওমার মতোন করি। এরপর সবায় মোক খুব পছন্দ করিল। মোর গোরত এই আঞ্চলিক ভাষা প্রিয় হয়া উঠিল।

পোত্থমবার উপলব্ধি করনু  এইটা মোর মায়ের ভাষা, মোর নিজের ভাষা!

এখন কি যে মজা নাগে কইতে!

এরপরে শুরু হইল ওমাক চলিত ভাষা শিখবার। সবাকে বুজানু ইশকুলত সবায় শুদ্ধ করি কতা কমো আর বাইরোত আঞ্চলিক ভাষায় কতা কমো।

কারণ এইটা হামার মায়ের ভাষা। হামার অস্তিত্বের শিকড় গাড়া এই ভাষার সাথে।

এরপরে থাকি কাছের বন্ধু আত্মীয় স্বজন সবারে সাথে মুই আঞ্চলিক ভাষাত কতা কও। আর মনে মনে ধন্যবাদ দেও মোর প্রথম স্টুডেন্ট গুলাক। ওরা নাই হইলে হয়তো বুজনুই না হয় আঞ্চলিক ভাষা কি জিনিস?

এরপরে আস্তে আস্তে মুই ইশকুলত সউগ ছাওয়ারে প্রিয় ম্যাডাম হয়া গেনু।;ওরা এখন নিয়ম মানে, সউগ কতা শোনে, পরিষ্কার হয়া ইশকুল আইসে। যারা কচিল মুই ফান্দে পড়ি কান্দিম এলা তামাক কবার মোনায় মুই এই ফান্দত পড়ি হাসো।

 

লেখক: তরুণ লেখক ও শিক্ষক, রংপুর

462 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ১১:৪৪ পূর্বাহ্ণ

তোরা এ্যালা কোনটে….

হ্যালো…. ফেলানির বাপ, তোরা এ্যালা কোনটে কোনা? বউয়ের ফোন পেয়ে আদর আলী উত্তর দিলো, ক্যানে? মুই তো এ্যালা সিটি বাজারোত ঢুকপ্যার নাকচু।

ফেলানির মা চেঁচিয়ে বলতে লাগলো- সেই কোন সমায় বাড়ি থাকি বাইর হয়া গেইচেন আর এ্যালানি কন সিটি বাজারোত ঢোকেনছোল? তা এতোবেলা ধরি কি করি বেড়াইনেন?তাকে আগোত কন তো মোক? ইতি যে ছাওয়াডার জ্বরে গাওখ্যান পুড়ি যাবার নাকচে-সেডা ফমে আচে?

আদর আলী এবার একটু নরম সুরে বলল-ফমে কেমন না থাকে! এডা একটা কতা কইনেন ফেলানির মাও?দশটা নোহায় পাঁচটা নোহায়-দুনিয়া শুদ্দেয় ফেলানি হামার একনা ছাওয়াল।তার বাদে মোর কি একনাও ময়া নাই?

হইচে, হইচে; আর দরদ দেকপার নাগবের নয়।মুই কি কং সেডা আগোত মোন দিয়া শুনি নেও।ফেলানির মা এবার  ইনিয়ে-বিনিয়ে বললেন।সিটি বাজার থাকি আলু,কবি,শিমে,মূলে,পিঁয়েজ, কাঁচা আকালি নেন।আর পাইলে আদা-পাকা দেকি টমেটো নেন তো। আইসপ্যার সমায় অষুদের দোকানোত সমাচারের কতা কয়া ফেলানির বাদে টেবলেডের বড়ি নিয়ে আইসেন কিন্তুক।

ফেলানির মা যতবারই যত কথা বলুক না কেন আদর আলী স্ত্রীর মুখে নতুন করে সে কথাগুলো আর একবার শুনতে চাইবেই। এটা তার পুরোনো অভ্যেস। তাই সে জিজ্ঞেস করল- কি বা কইনেন ফেলানির মাও? অটো আর এশকার হরেনের শব্দে তোমার  কথাগুল্যা মুই সউগ শুনব্যারে নাই পাং ……।

ক্যানে? মোর কতা তোরা শুনব্যারে রে নাই পান? তাইলে শোনো ফির কং-আলু,কবি,শিমে,মূ্লে,পিঁয়েজ, কাঁচা আকালি আনব্যার কঁচুং। আর, অষুদের দোকানোত সমাচারের কতা কয়া ফেলানির বাদে টেবলেডের বড়ি নিয়ে আইসেন।

ও হো, এ্যালানে মুই তোমার কতা বুজব্যার পানু। তোরা কোনো চিন্তা না করেন।  এই ধরো মুই ঘন্ডাখানেকের ভেতরোত আসপ্যার নাকচোং।

ফেলানির মা বল্লেন,তৎকরি আইসেন।দেরী না করেন।ঠাণ্ডাও খুব বেশি হয়া গেইচে। চাইরো পাকে মাইনসোক যে হারে করুনায় ধরোচে।মুখ থাকি মাকস খুলব্যারে নন।কারো গার সাতে গাও নাগান না।অটোত চড়েন না।উয়াতে মাইনসে দেকচুং মাকস পড়ে না।হাটিয়াও না আইসেন। পাচে ভাংগা ডেরেনোত পড়বেন। টেহা নাগে নাগুক তোরা ইসকা নিয়্যা বাড়িত আইসেন। তোরা মোটে দেরী না করেন ফেলানির বাপ…..।  সাবধানে আইসেন। মুঁই এ্যালা মোবাইল থুনু কিন্তু ! মোর ম্যালা কাম পড়ি আচে।

রসিক আদর আলী  বললেন, আই লাভ ইউ ফেলানির মা…….মুঁই এ্যালায় আইসোচোং ………..।

 

লেখক: ছড়াকার, রংপুর।

474 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ১১:৪৪ পূর্বাহ্ণ

ভাতের জন্য

– মা ভাত দে।

– ভাত নাইযে বাবা। বাড়িত বসি থাকি কি খাবার আসপে বাবা। আল্লাহ আল্লাহ কর। আইতোত বলে ত্রাণ দেবে। তারপর খাইস।

– মা এলা তো ঝড় বৃষ্টি নাই ত্রাণ কেনে দেবে?

– বাবারে দেশোত মহামারি নাগছে, ভাইরাস বেরাইছে। সবার কাম কাজ বন্ধ, কী খাইবে মানুষ? তারবাদে সরকার থাকি ঘরে ঘরে খাবার দেওছে বাবা। দেখিস না মুইও তো মেলা দিন হতে কামোত যাও না। মোক আম্মা কামোত যাবার মানা করছে।

-মা এই মহামারি কোনদিন শেষ হইবে? আব্বাও তো বাড়িত আইসে না কেমন আছে খবরো তো নেন না? আইজ আব্বার খোঁজ নেন তো।

– আচ্ছা বাবা ফোন দিম এলা।

সন্ধা গড়িয়ে রাত্রি হতে লাগলো। নিলুফা ত্রাণ নেয়ার জন্য  বাসা হতে  ছেলেকে আদর করে বের হলো পথিমধ্যে একজনের মোবাইল হতে স্বামী সুরুজ মিয়ার সাথে শেষ কথাটা বলে নিল নিলুফা।

আবার এগুতে লাগলো স্কুলের দিকে ত্রাণ নিতে। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে দীর্ঘ লাইন অতিক্রম করে দেখা মেলে কাঙ্ক্ষিত খাবার বস্তা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, হাজারো মানুষের  প্রচণ্ড ভিড়ে নিলুফা অন্যের পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে পৃথিবী হতে চলে যান। কেউ জানে না কে এই নিলুফা  কী বা তার পরিচয়। সবাই চলে যাওয়ার পরে স্হানীয় মেম্বার কিছু লোক ডাকিয়ে তাকে সনাক্ত করে তার বাসায় নিয়ে আসে।

হাবাগোবা ছেলে মায়ের লাশ দেখে পাগলের মতো কান্না করে  আর চিৎকার করে

মা মাগো কি হইছে তোর।

কথা কও মা

মোক যে খু্ব ভোক নাগছে। কায় দেবে মোক ভাত। মা তুই মোক ছারি গেলু কেন

তার কান্নায় ভেঙে পরে পাশের বাড়ির আলেয়া, ফুলবানুরা তারাও মেনে নিতে পারছে না এই মৃত্যু। সন্ধায় যে মানুষটি ছিল তাদের সাথে এখন সে ওপারের বাসিন্দা।

 

লেখক: লেখক ও সংগঠক, রংপুর।

441 Views