ছুঁয়ে দেখা জীবন
গভীর রাত নিঝুম প্রকৃতি কোথাও কোন সাড়া-শব্দ নেই। চারিদিকে ঘোর অন্ধকার সুনসান নীরবতা। মাঝে মাঝে দু’একটি ঝিঝি পোকা ডাকছে। বাঁশবাগানের ভেতরে দলবেঁধে জোনাকিগুলো মিটি মিটি করে জ্বলছে। গোটা আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে আছে। হঠাৎ একটা বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকাল, দরজার জানালার কপাটগুলো থরথর করে কেঁপে উঠল। কোথা হতে একটা দমকা হাওয়া এসে উঠানের আমগাছটার ডালে আঁচড়ে পড়ল। অমনি মড়মড় করে বিরাট একটা ডাল ভেঙ্গে পড়ল উঠানে। ভাঙ্গা চিমনির ফাঁক দিয়ে বাতাস ঢুকে হ্যারিকেনের ক্ষীণ আলোর সাথে যুদ্ধ করছে, তারপর একসময় পরাজিত হয়ে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। দিয়াশলাইটাকে খুঁজে পাচ্ছি না। অন্ধের মতো হাত-পা বাড়িয়ে কোন রকমে বিছানাটা খুঁজে পেলাম। তারপর বিছানার উপরে উঠে হাত পা গুটিয়ে ঝড়-বাদল সেরে যাওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকলাম। মনে হচ্ছে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে, কি অদ্ভুত রকমের বৃষ্টি অঝর ধারায় ঝরছে, যেন গোটা পৃথিবীকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে আজ। বৃষ্টির ঝাপটার ভারী যবনিকা ভেদকরে বাহিরে কিছু দেখা যাচ্ছেনা। জানালার ওপারে অশান্ত বর্ষণ আর মেঘের গর্জনে সব কিছু কেঁপে উঠছে বারবার। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে মনে হচ্ছে, যেন হাজার বছরের নিঃশ্বঙ্গতা নিয়ে আমি নেপোলিয়নের মতো সেন্ট হেলেনা দ্বীপে বন্দি হয়ে আছি।
ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেলে প্রকৃতিটা একটু ঝিমিয়ে পড়ে, চারিদিকটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে যায়। অনেক দূর থেকে ক্ষীণস্বরে একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। আমার বুকের ভিতরটা কেমন ধক্ধক্ করে উঠল। প্রচ- ঝড়ের তা-বে ভেঙ্গে পড়া ঘরবাড়ির নিচে চাপা পড়ে কেউ হয়তো মরে গেছে। কি আশ্চর্য এ মৃত্যু, পলকে সবকিছুকে একেবারে নেই করে দেয়। কান্নার শব্দে মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠল, তাই ঘর থেকে বের হয়ে এক পা-দু’পা করে হাঁটতে শুরু করলাম। একটু সামনে এগিয়ে গেলে শব্দটা আরও স্পষ্ট হয়ে আসে, আর বুঝতে বাকী রইলো না যে, আব্দুল্লাহর বাড়ি থেকেই কান্নার শব্দটা আসছে। আমার উদ্বিগ্নতা আরো বেড়ে গেল, আমি একটু জোর কদমে এগিয়ে গিয়ে তার বাড়িতে উপস্থিত হলাম। ভেতরে গিয়ে দেখি আব্দুল্লাহ পেটের ব্যথায় বিছানায় গড়া-গড়ি দিচ্ছে, আর মুখ দিয়ে আবোল তাবোল বকছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে- গানের সুরে সুরে সে তার স্ত্রী-সন্তানদের ডাকছে-
“আবিয়া, ছাবিহার মা, বেল্লাল উদ্দিন জালালরে, সকলে দেখিয়া যাও আমারে। নিজের দোষে বান্দা মরে আল্লাক দেয়রে দোষ”
আবিয়া, ছাবিহা, বেলাল ও জালাল আব্দুল্লাহর সন্তানদের নাম। বাবার বুকে মাথা রেখে আদরের মেয়ে আবিয়া-ছাবিহা কাঁদছে। আবিয়ার মা কুলসুম আব্দুল্লার মাথায় বালতির পর বালতি পানি ঢালছে। আজ তার নিজের আবিষ্কৃত ঔষধ “খাওয়ার সোডা” তেমন কাজ করছে না। পেটের ব্যথাটা আজ কেন জানি তার সাথে ভীষণ গাদ্দারি করছে, এতোক্ষণ কোন দিনই তাকে জ্বালায় না। যা হোক অল্পকিছুক্ষণের মধ্যে আব্দুল্লাহ চোখ বন্ধ করে একটু ঝিমিয়ে পড়ল। একটা দীর্ঘম্বাস ছেড়ে কুলসুম নিজের আঁচলের এক প্রান্ত দিয়ে তার মাথা ও মুখ ভালো করে মুছে পানির বালতিটা সেখান থেকে সরিয়ে নিল। আব্দুল্লাহর ভেজা মাথা মুছে দিয়ে তাকে ঠিকঠাক ভাবে শুয়ে দিল।
আব্দুল্লাহর বউ কুলসুম বললো- গতরাতে “প্যালকা“(সজনে পাতা, পুঁইশাক, চালের গুড়ো ও খাওয়া সোডা দিয়ে রান্না করা এক প্রকার মজাদার তরকারি) খ্যায়া তার এ্যামন প্যাটের বিষ হইচে। বাবা মুই এ্যাতো করি কনু- আবিয়ার বাপ তোমার প্যাটের বিষ! তোমাক প্যালকা খাবার না নাগে, কায় শোনে কার কথা।
বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে মানুষের বাড়িতে কাজ কর্ম করতে গিয়ে কখন যে শরীরে তার মরণ ব্যাধী বাসা বাঁধে, সেটা নিজেও টের পায় না আব্দুল্লাহ। শুধু পেটের ব্যথাটা তাকে মাঝে মাঝে একটু কাবু করে ফেলে। যখন এই পেটের ব্যাথা তীব্র আকার ধারণ করে আর সহ্য হয় না, তখন সে প্রতিষেধক হিসেবে এক মুঠো খাওয়ার সোডা খেয়ে ঢোক-ঢোক করে দু’এক গ্লাস ঠা-া পানি খেয়ে নেয়, এতে সাময়িক কালের জন্য হলেও ব্যাথা খানিকটা উপশম হয়। পেটের ঝিম-ঝিম ব্যথা নিয়ে সে সারাদিন কাজ করে মানুষের ক্ষেতে খামারে। আর কাজ না করলে পেটের জোগানই বা আসবে কোথা থেকে? সংসারে চার-পাঁচ খানা মুখ হাঁ-করে চেয়ে আছে তার দিকে। এমতাবস্থায় কী বা করার আছে তার?
প্রিয় পাঠক এখানে একটু বলে রাখা দরকার, আব্দুল্লাহর জন্ম যে গ্রামে তার নিজের মতো সেটিও একটি আবহেলিত গ্রাম, যার নাম দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা। চারিদিকে ভারত বেষ্টিত বাংলাদেশের একটি ছোট্ট ভুখ- তারও অর্ধেকটা গ্রাস করেছে তিস্তা নদী। এই গ্রামটি গোটা বিশ্বের কাছে “দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল” নামে পরিচিত। একটি স্বাধীন দেশের মূল ভৌগলিক সীমানা থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অন্য একটি স্বাধীন দেশের মূল ভৌগলিক সীমানার অভ্যন্তরে বিরাজমান ভূখ-। এখানে যেতে হলে অন্য দেশের ভুমির উপর দিয়ে যেতে হয়। এ ভুখ-টি সম্পূর্ণরূপে নিজদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। এখানকার নাগরিকরা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে নিজেস্ব স্বাধীনতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে পঁচা কাষ্ঠখ-ের ভিতরে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে থাকা পোকার মতো নিষ্প্রাণ জীবন-যাপন করে। পূর্ব পুরুষদের পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে তারা এখানে বসবাস করে।
ভারত সরকার তিস্তা নদীর উজানে জলপাইগুড়ি জেলার ‘গজলডোবা’ নামক স্থানে এই নদীর উপর ‘গজলডোবা বাঁধ’ নির্মাণ করেন। ফলে নদী তার গতিবিধি হারিয়ে ফেলে। অথৈ বর্ষায় ভারত সেই বাঁধের সুইস গেইট খুলে দিলে নদী বেসামাল হয়ে পড়ে, বয়ে যায় দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার অর্ধাংশের ওপর দিয়ে। আব্দুল্লাহর ঘর-বাড়ি, জমি-জমা, বিষয়-সম্পত্তি নিমিষে বিলিন হয়ে যায় নদীর বুকে।
আব্দুল্লাহর বউ কুলসুম, মাঝে মধ্যে আমির মাষ্টারের বাড়িতে টুকি-টাকি কাজ কর্ম করে। মজুরি হিসেবে যা পায় সেটা আঁচলে পোটলা বেঁধে শক্ত করে কোমরে গুজে রাখে। তারপর কাঁচা রাস্তা, জমির সরু আইল হাটু পর্যন্ত কাদা পানি পারি দিয়ে বাড়িতে আসে। গতদিনে সেই বাড়িতে মেহমান আসায় অনেক কাজ বাড়ে, শরীরের উপর খুব ধকল যায়। তাই কুলসুমের চোখে যেন রাজ্যের সব ঘুম এসে জড়ো হয়, সে কিছুই টের পায়না। আব্দুল্লাহ ঘুম থেকে ওঠে কাজে যাবার জন্য, হাত-মুখ ধুঁয়ে এসে হাড়ি-পাতিল গুলোর দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে, হাড়ির তলায় সামান্য একটু দলাপাঁকা ভাত, সেটুকুও যদি সে খেয়ে যায় তাহলে অবুঝ বাচ্চা গুলো কি খাবে? সারাদিন তাদের না খেয়ে যে থাকতে হবে। এই ভেবে সে কুয়ো থেকে একবালতি পানি তোলে, বালতিতে মুখ লাগিয়ে ঢোক ঢোক করে অর্ধেক বালতি পানি গিলে ফেলে। তারপর খক্-খক্ করে দু’তিনবার কাশি দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় কাজের সন্ধানে।
বেলা অনেক হয়ে গেছে শরীরটাও খুব ম্যাচ ম্যাচ করছে, সারাগায়ে ব্যথা, তবুও যেতে হবে অনেক থালা বাসন হয়তো তার জন্য এখনও পড়ে আছে। সে গুলো পরিস্কার করতে হবে, ঘর-উঠান ঝাড়– দিতে হবে, রান্না করতে হবে আরোও কতকাজ তার পড়ে আছে। আবিয়া স্কুলে যাওয়ার জন্য জামা কাপড় পড়ছে, মাকে ঘুম থেকে উঠতে দেখে বলে-
মা, তুমিও কি কাজে যাবে?
হ্যাঁ যাওয়া নাগবে-রে মা।
তোমার না শরীর খারাপ? একদিন কাজে না গেলে কি এমন ক্ষতি হবে?
নারে মা, কাইল ম্যালা কাজ থুইয়া আচ্চি। আর আইজ যদি কাজে না যাঁও, তাহলে আপার খুব কষ্ট হইবে। রাগ করি আর কোন দিন মোক কাজে ডাকবার নয়। ছোট হাড়িটায় অল্প একনা ভাত আছে, দুই বোইনে ভাগ করি খাও।
মা তুমি তো কিছুই খাও নাই, একটু খাও?
অল্প একনা ভাতই আছেরে মা, তোমরা খাও। মুই এ্যালা আপার বাড়িত কিছু একটা খ্যায়া নিম।
রাতে আবিয়ার মা কুলসুম, মেঝেতে একটা মাদুর পেতে আবিয়া, ছাবিহা ও তার বাবাকে খেতে দেয়। আবিয়া তার মাকে তাদের সাথে খাওয়ার জন্য টানা টানি করে, কিন্তু কুলসুম খেতে বসে না। আবিয়া খুব বেশী পিড়া-পিড়ি করলে, কুলসুম বলে- মারে তুই বুঝবু না, তোর বাপক ভালো করি না খাওয়াইলে মোর প্যাটত (পেটে) ভাত যাইবে না।
কুলসুমের বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস আসে তার দুই ছেলের একটিও কাছে নেই, তারা যে কোথায় আছে, কি খাইতেছে, মায়ের মন সন্তাদের চোখের সামনে না দেখলে সায় দেয় না। অভাবের তাড়ণায় বড় ছেলে বেলাল ভারতে যেয়ে কাজ করে। আর ছোট ছেলেটা মানুষের বাড়িতে বাৎসরিক চুক্তিতে কাজ-কর্ম করে, মালিকের বাড়িতেই খায়, সেখানেই থাকে। অনেকদিন বাড়িতে আসে না, মালিক নাকি ছুটি দেয় না।
আজকের দিনটা কোন রকমে আধপেটে পার হলে আবার কালকে কি হবে এই ভেবে রাতে আব্দুল্লাহর ঘুম আসে না। এ পাশ ওপাশ করে কখনো চোখের পাতা দু’টো এক হলে পরোক্ষণে আবার গা ঝিমিয়ে ওঠে। হাত-পায়ের শিরা গুলো টন-টন করে। শিরার ভেতর দিয়ে ক’ফোটা রক্ত যায়-আসে, সেটাও বলতে পারে সে। তার একমাত্র সম্পদ দু’টো বকরি, শত কষ্টের মধ্যেও সে বিক্রি করে নাই কিন্তু এবার বুঝি আর রক্ষা করা গেল না। বাচ্চা কাচ্চা যদি তার না খেয়ে মরে যায়, তবে বকরি দিয়ে কি হবে? তাছাড়া অনাহারে থেকে তার শরীরের অবস্থাও দিনদিন কাহিল হয়ে পড়ছে।
চরের বসত যেমন আজ আছে, কাল নেই। নদীর খেয়াল-খুশির উপর নির্ভর করে এর আয়ুস্কাল। নদীর খুশিতে তার বুকে চর জাগায় আবার ইচ্ছে হলে মুহুর্তের মধ্যে সব কিছুকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। মানুষের কতো দুঃখ, কষ্ট, হাহাকার, বুক ভাঙ্গা আর্তনাদ কোন কিছু তাকে নূন্যতম বিচলিত করতে পারে না। আপন জঠরে টেনে নিয়ে স্বগর্বে প্রবাহিত হয় আপন ঠিকানায়। কোন কিছু ভ্রুক্ষেপ করার সময় তার নেই। আব্দুল্লাহ আর জেলহকের মতো হাজারো পরিবার ঘর-দোর ভেঙ্গে, পরিবার পরিজন, গরু-বাছুর, ছাগল-ভেরা, হাঁস-মুরগী নিয়ে রাস্তার ধারে কিংবা কারো পতিত জমিতে মাথা গোজার ঠাঁই করে। তারপর আস্তে আস্তে দু’চারদিন পর সেই ঘরগুলোকে খুঁটি দিয়ে খাড়া করে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। শুরু হয় আবার বেঁচে থাকার সংগ্রাম, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে জীবিকা উপার্জনের চেষ্টা করে। শরীরে দিকে নজর দেয়ার সময় এখন নাই। পেট নামক যে ভয়ঙ্কর দোজখ সর্বা দাউ-দাউ করে জ্বলে তার তো খোরাক জোগান দিতে হবে?
এত বড় গেরস্তের ছেলে হয়ে নদীতে মাছ ধরে বিক্রি করা তার আত্মসম্মানে বাজে, খুবই নিন্দার কাজ বলে মনে হয়। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনেরা দেখলে কি মনে করবে, তার ভীষণ লজ্জা লাগে। কিন্তু পেটের ক্ষুধায় তো আর না খেয়ে থাকা যায় না। দিনের পর দিন কতো অভাব-অনটনের ভেতর দিয়ে সংসার চলছিল তারপরেও সে মাছ বেচার কথা কোন দিন স্বপ্নেও ভাবেনি আব্দুল্লাহ। বউ বাচ্চা নিয়ে দিন-রাত না খেয়ে, ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আব্দুল্লাহ জাল নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে যায়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় অনেক মাছ ধরা পড়ে তার জালে। একবার মনে হয় মাছগুলো রান্না করে বড় মাছ দু’টো বাচ্চারা খাবে ছোট গুলো এখন আমরা খাব। কিন্তু শুধু মাছ খেয়ে কি বাচ্চাদের ক্ষুধা মিটবে? কাল থেকে তারা শিঁকায় তোলা এতোটুকু চালের ভাজা খেয়ে আছে। আত্মসম্মানের দিকে তাকালে আমার বউ-বাচ্চা না খেয়ে মরবে। কাজেই এই মুহুর্তে আত্মসম্মানের চেয়ে নিজের জীবনের দাম অনেক বেশী। শুধারাম জেলে মাছ ধরা শেষ করে বালুচরে জালখানা রোদে বিছিয়ে দিয়ে এদিক-ওদিক টানা-টানি করে তাড়াতাড়ি শুকানোর চেষ্টা করছে।
আব্দুল্লাহকে এদিকে আসতে দেখে শুধারাম জিজ্ঞাসা করে- কি আব্দল্লাহ দা আজি কতোগুলা মাছ পাইলেন? তোমার খলাই (মাছ রাখার পাত্র) যে ক্যানে নড়েই না।
হ্যাঁরে শুধা, ভালোই পাইছি আর মাছও বেশ বড় বড়, দুইটা আইড় মাছও পাইছি-রে। সবে সেইজনের ইচ্ছা, গরিবের ওপর দয়া। নইলে যে গরিবের ঘর না খ্যায়া মারি যাবে।
তোমা ঠিক কথাই কইছেন দাদা। ভগবান কাউকে না খ্যায়া মারে না। দাদা তোমা যে কার মুখ দেখি আইসেন, তা কায় জানে। নিত্যদিন তো ভাল-ভাল মাছগুলা তোমায় পান। তা, বাড়ি যাবার নন দাদা?
হ্যাঁরে শুধা তোর সাথে এ্যাকনা কথা কবার জন্য আসিনু।
কি কথা দাদা? তাড়াতাড়ি কয়া ফেলাও? বাজারের বেলা শ্যাষ হয়া যাবার নাকছে। মাছগুলা ব্যাচেবার নাগবে না?
শুধা, তুইতো জানিস, মোর আর আগের দিন নাই। সংসারে আয়-রোজগার নাই, কেমন করি বাঁচা যায় ক’? এখন মান সম্মানের কথা চিন্তা করিলে মোক বউ-ছওয়া নিয়া না খ্যায়া মরা নাগবে।
সামান্য কয়েকটা পুটি, খলসে আর ট্যাংরা মাছ নিয়ে যখন আব্দুল্লাহ বাড়িতে আসে, তখন কুলসুম তার হাতে এ কয়েকটা মাছ দেখে মনে মনে ভীষণ রাগ হয়, কাল থেকে বাচ্চারা না খেয়ে এক রকম উপস করে আছে আর আজও যদি রান্নার কোন ব্যবস্থা না হয়, তাহলে তারা বাঁবে কিভাবে? অনাহারে থেকে থেকে মেজাজটাও কেমন রুক্ষ খটখটে হয়ে যায়। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে-
হা আবিয়ার বাপ আইজ যে শিঁকার কৌটাগুলাও খালি হয়া পড়ি আছে। আর যে কোন উপায়ও নাই, আইজ কি হইবে?
আব্দুল্লাহ মনে মনে একটু ভাব নেয়, যেমন পৃথিবীর সব পুরুষেরাই বউয়ের উপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য নিজেকে বীরপুরুষ হিসেবে উপস্থাপন করে। সেও এমন ভাব যে বউয়ের কোন কথাই এখন পর্যন্ত তার কানে পৌছায় নি। আব্দুল্লাহ বলে-বউ বাজারের ব্যাগটা এ্যাকনা দেও তো? তাড়াতাড়ি কর, দেরি কর না।
কুলসুম ব্যাগ নিয়ে এসে বলে-এই নাও তোমার ব্যাগ। চাল-ডাল কেনার টাকা কোনটে পাবেন এ্যালা? খালি হাতে যে বাজার যাবার নাগছেন?
বউরে আল্লাহ আইজ হামার ভিত্তি মুখ তুলে তাকাইছে, নদীতে অনেকগুলা মাছ পাইছি। শুধারাম’ক বেচার জন্য দিনু, এতোক্ষণে তায় ব্যাচেও ফেলাইছে মনে হয়। মুই তাড়াতাড়ি য্যায়া, বাজারটা করি আসিবার নাগচু।
কুলসুম চুলা থেকে ছাই বেরকরে মাছগুলো মেখে কুটতে শুরু করে। এমন সময় পাশের বাড়ির এরফান খাঁর বউ হাতে একটা পোটলায় কেজি দুয়েকের মতো চাউল নিয়ে আসে। কুলসুমকে বলে-চাচি এই এগুলো একনা থনতো।
ও-গুলা কি বউমা?ক্যান চাচি তোমার মনে নাই? শুক্রবার হামার বাড়িত সাগাই আসছিল সেইজন্য না তোমার কাছে চাউল ধার নিছিনু?
না বউমা, মোর একনাও মনে নাই। আইজকাল যে কি হইছে বউমা, কোন কিছুই মোর মনে থাকে না। কুলসুমের নিজের উপর ভীষন রাগ হলো, তার চাল মানুষের ঘরে আর সে কি না চালের অভাবে কাল থেকে বাচ্চা-কাচ্চা সহ না খেয়ে আছে?
ভাতের থালা নিয়ে বসে আব্দুল্লাহ ভাবে- কি সুন্দর পরীর মতো মেয়ে দু’ইটা তার, কাল থাকি না খ্যায়া আছে অথচ একবারের জন্য খাবার চায় না। ক্ষুধার জ¦ালায় নিস্পাপ মুখগুলো লাল হয়ে আছে। হায় খোদা! কোন পাপের শাস্তি মোক দিবরি নাগচিস। মাছের ঝোল মাখা এক লোকমা ভাত মুখে তুলে দেবে এমন সময় পিছন থেকে জালাল এসে ডাকে- মা, ও মা?
এক লাফ দিয়ে কুলসুম উঠে দাঁড়ায়, অনেক দিন পর ছেলেকে দেখে তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে। জালালকে বলে,-
হ্যাঁরে বাবা, এতোদিন পর তোর মায়ের মায়ের কথা মনে পড়িল?
মা, -মালিক মোক ছুটি না দিলে বাড়ি আইসো ক্যামন করি?
সেটা অবশ্য ঠিক কইছিস বাবা। গরিবের কপাল, যা বাবা হাত-মুখ ধুইয়া আয় সবাই মিলে একসাথে বসি খাই।
ছাবিহা ভাতের থালা ছেড়ে উঠে চুপি চুপি ক’য়োর পারে যেয়ে জালালের কানের কাছে মুখ লাগিয়ে দিয়ে বলে-এই ভাইয়া, মোর জন্য কি আনছিস?
জালাল আর হাসি আটকাটে না পেরে হো হো করে হেসে ওঠে। তারপর ছাবিহাকে কোলে নিয়ে ভাত খেতে আসে।
আবিয়া আর ছাবিয়ার মাঝখানে বসে জালাল। আবিয়া কানে কানে বলে-ভাইয়া, ছাবিহা তোক কি কইলোরে ?
জালাল আবার হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠে বলে- আচ্ছা আগোত ভাতটাতো খাবার দে, তারপর কবার নাগচু।
অনেক দিন পর ভাই-বোনের মুখে হাসি দেখে আবারো কুলসুমের চোখের কোণে অশ্রু এসে গেল। আজ তার মনে হলো, ছোট্ট এই ভাঙা কুঁড়ে ঘরে যেন স্বর্গ নেমে এসেছে। এখন শরৎকাল আকাশে ভাঙ্গা ভাঙ্গা মেঘের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ। চারিেিক অম্লান জোছনা। সেই চাঁদের আলোয় তার তিন সস্তানের মুখগুলো যেন তিনটা চাঁদের মতো জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। মাঝে মাঝে দক্ষিণা বাতাস ঝিরিঝিরি করে বইছে। অনেকদিন পর জীবনটাকে তার অন্যরকম মনে হচ্ছে। ছেলে তার যে কয়েকদিনই থাকুক না কেন সবাইকে যেন বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে থাকে।
লেখক: শিক্ষক ও লেখক, লালমনিরহাট।