উপভাষা-প্রবন্ধ Archives - মুগ্ধতা.কম

উপভাষা-প্রবন্ধ Archives - মুগ্ধতা.কম

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৭:০৫ অপরাহ্ণ

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্য

ভাষা মানব সভ্যতার আদি বাহন। সময় ও সভ্যতার বিবর্তনে ভাষারও বিবর্তন ঘটে। একটি বিরাট জাতি একক মানবগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত হলেও অঞ্চলভেদে সে জাতির ভাষার মধ্যে তারতম্য পরিলক্ষিত হতে পারে। আর এ কারণেই প্রতিটি জাতি  তার আঞ্চলিক ভাষাকে সামনে রেখে পরিপূর্ণতা লাভ করে। সিলেট, ময়মনসিংহ, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চল ছাড়া বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকেই তাদের একমাত্র ভাষা বলে জানে। এতদসত্বেও বাংলাদেশ নামে ভূখন্ডে বসবাসকারী অসংখ্য বাংলাভাষী মানুষ সযত্নে লালন করছে নিজ অঞ্চলের ভাষার বৈশিষ্ট্যিকে। এক ভাষাভাষী জনগাষ্ঠী হয়েও অঞ্চলভেদে ভাষার তারতম্য অনেক ক্ষেত্রে এমন দাঁড়ায় যে , মনে হয় না তারা একই মানব গোষ্ঠীর, একই মূল ভাষার লোক। একটি ভাষা বহু সালের ধারাবাহিকতায় এবং বহু দেশি-বিদেশি প্রাচীন ভাষার সংস্পর্শে এসে পরিপূর্ণতা লাভ করে। আর এ কারণেই আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্যগুলো ঐ অঞ্চলে প্রচলিত প্রাচীন ভাষার হারিয়ে যাওয়া অস্তিত্বকে বহন করে চলে।

রংপুর বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত এক বিরাট ভূখণ্ড। শতভাগ লোকের ভাষা বাংলা হলেও আঞ্চলিক ভাষার অঙ্গনে রংপুরী ভাষার এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা এ এলাকার প্রাচীন ভাষার হারানো অস্তিত্বের ধারক ও বাহক। অনেক ক্ষেত্রে রংপুরী আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার রংপুরের বাইরের মানুষ অবজ্ঞার চোখে দেখে এবং বাহের দেশের মানুষ বলে অভিহিত করে। বাহে শব্দটি যতই অবজ্ঞার চোখে দেখা হোক না কেন ভাষার ব্যুৎপত্তিতে এর এক ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা বিরাজমান। এ প্রবন্ধে বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশের সাথে রংপুরী আঞ্চলিক ভাষার ঘনিষ্ঠতা ও প্রভাব সম্পর্কে আলোচনাসহ ‘বাহে’  শব্দের প্রচলনের উপর আলোকপাত করা হয়েছে।

বহিরাঞ্চলের মানুষের ধারণা ‘বাহে’ ব্যবহারকারী অঞ্চলের মানুষেরা বোকা। অমার্জিত আর সভ্যতার অগ্রযাত্রা থেকে পশ্চাৎপদ। বাস্তবে এ ধারণা অপূর্ণ এবং অসঙ্গত। রংপুর অঞ্চলের প্রচলিত ভাষার আছে রীতিসম্মত ধারাবহিকতা আর এ ভাষা বাংলা ভাষার আদি স্তরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। ‘বাহে’ শব্দটিও ধারাবাহিকতার ফল। ‘বাহে’ শব্দটি সাধারণত সম্বোধনসূচক। যেমন ‘কোটে গেছনেন বাহে?’ কি বাহে কেমন আছেন? সম্বোধন ব্যতিরেক বাহে শব্দের প্রয়োগ নেই তা নয়, তবে সংখ্যা খুব কম। ‘বাহে’- এ শব্দটি বাবা, মা, চাচা, চাচি, জেঠা, খালা, খালু, ফুফা, ফুফু এরকম সম্পর্কের বেলায় প্রয়োগ করা হয়। ‘বাপুহে’ এ শব্দটির বিবর্তিত, পরিবর্তিত বা সংক্ষিপ্ত রূপ ‘বাহে’। ভাই, ভাবি, দাদা, দাদি, নানা, নাতি, দেবর-ভাশুর, বোন, জা, ভগ্নিপতি এমন সম্পর্কে সম্পর্কিত যারা তাদের বেলায় বাহে শব্দটি প্রয়োগ হয় না। বাস্তবতা হলো ‘বাহে’ শব্দটির সাথে গভীর মমত্ব আর স্নেহের আন্তরিক অনুভূতির প্রকাশ সম্পর্কিত।

ভাষার ধারাবহিকতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলা ভাষার উৎপত্তি এবং বিকাশের সঙ্গে রংপুরের ভাষা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। বিশেষ করে মধ্যভারতীয় আর্যভাষা যেমন পালি, প্রাকৃত ও অপভ্রংশের সাথে (খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দী) রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার  গভীর অন্বয় খুঁজে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত আলোকপাত করা যায় – বাংলা ভাষার বিবর্তনের সংক্ষিপ্ত দিক সম্পর্কে। বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তুর্ভুক্ত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর গবেষণায় এ মূল ভাষার অস্তিত্ব ছিল আধুনিক খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে। খ্রিষ্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর আগে মূল ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু ভাষা জন্ম নেয়, যার মধ্যে অন্যতম প্রধান ভাষা আর্য। এর কাল ১২শ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। ভারতীয় আর্যভাষার স্তর তিনটি-

(১)          প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা- বৈদিক সংস্কৃত ( খ্রিষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দী থেকে থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী)।

(২)          মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা- পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ (খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী হতে খ্রিষ্টিয় দশম শতাব্দী পর্যন্ত)।

(৩)         নব্য ভারতীয় আর্যভাষা-বাংলা, হিন্দী, আসামী, মারাঠী (১০ম শতাব্দী মতান্তরে ১২শ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত)।

স্তর বিন্যাসগত দিক থেকে পালি স্তরের সাথে রংপুর অঞ্চলের ভাষার বহুবিধ সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। পালির মতো রংপুরের ভাষায় ‘স্থ’ জায়গায় ‘থ’ হয় ( স্থল- থল, স্থান-থান), ‘ষ্ঠ’ স্থলে ‘ট্ঠ’ (জ্যেষ্ঠ- জেট্ঠো), ‘ক্ষ’ হয় ‘খ’-( পক্ষী-পাখি, চক্ষু-চউখ), ‘ঋ’ স্থানে ‘ই’ (ঋষি-ইসি; মৃত্যু-মিত্যু), ‘ভ’ স্থানে ‘ব’ (লাভ-লাব, লোভ-নোভ), ‘থ’ স্থানে ‘টঠ্’(কোথায়- কোট্ঠে, সেথায়- সেট্ঠে) উচ্চারিত হয়ে থাকে। পালি ভাষার ন্যায়  ‘র্  ’ (রেফ)  উচ্চারিত না হয়ে বর্ণের দ্বিত্ব হয়। এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বর্জিত হয়। যেমন- বর্ষা-বস্সা, বর্ণ-বন্ন, চৈত্র-চৈত, কর্তা-কত্তা। রংপুরের ভাষায় আনুনাসিক ‘ঞ’ এর উচ্চারণ বহুল যা পালির সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত। উদাহরণ- কে-কাঞ, যে-যাঞ, তুই-তুঞ।

রংপুরের ভাষার সঙ্গে ‘প্রাকৃত’ স্তরের ভাষার নৈকট্য অধিক। প্রাকৃত এবং রংপুর অঞ্চলের কিছু শব্দ পাশাপাশি দেখলে বিষয়টি নিশ্চিত হবে।

প্রাকৃত                                                             রংপুর অঞ্চল

—-                                                                                    ——–

নঙ্গল                                                                               নাঙ্গল

হত্থী                                                                                 হাথী,হাত্তী

এত্তক                                                                              এত্ত

 

প্রাকৃতের আম্ভি, তুম্ভি প্রভৃতি রূপ রংপুরের স্থানীয় কবিগণের কাব্যাদিতে ব্যবহৃত হয়েছে। ক্রিয়াপদের দিক থেকেও ‘প্রাকৃত’ রংপুরের ভাষার নিকটবর্তী। প্রাকৃতে ‘অচ্ছি’র সঙ্গে অনেক ধাতু যুক্ত হয়ে ক্রিয়াপদ নিষ্পন্ন হয়। যেমন করোচ্ছে, করোচ্ছি, মারচ্ছে, মারচ্ছি ইত্যাদি। প্রাকৃত ‘করোম’ যা সর্বত্রই ভবিষ্যতার্থে ব্যবহৃত রংপুর অঞ্চলে এর ব্যবহার ‘করিম’ রূপে। এরকম-খাইম,যাইম, নেইম, দেইম, প্রভৃতি শব্দ ভবিষ্যতকালে প্রযুক্ত। প্রাকৃতে প্রথমা বিভক্তিতে ‘এ’ সংযুক্ত, এ নিয়ম রংপুরের ভাষাতেও বর্তমান। যেমন: রাজা ডাকে(রাজা)-এ ডাকে, চোর সব নিয়েছে- চোরে (এ) সউগ নিছে। প্রাকৃতের ন্যায় দ্বিতীয়াতে ‘ক’ বিভক্তির চিনহো যুক্ত হয়, যথা: তোক, মোক, হামাক,তোমাক। কারণ কারকে যুক্ত হয় ‘ত-দি’ যেমন -দাও দি হাত কাটচে, নাওত চড়ি আচ্চে। অধিকরণেও ‘ত’ যুক্ত হয়- হাতত পাইসা নাই, মাতাত তেল নাই, বাবা হাটত গেইচে। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদেও এরকম ‘ত’ এর প্রয়োগ দৃষ্ট হয়। যেমন:

‘টালত মোর ঘর নাহি পড়বেশী

হাড়িত ভাত নাই নিতি আবেশী।’

বাংলায় নিশ্চিত অর্থে ‘ই’ব্যবহৃত হয়। যেমন: আমরাই যাব, ভালো কাজটি তোমরাই করেছ। ‘ই’ এর পরিবর্তে রংপুরের ভাষায় সংযুক্ত হয় ‘এ’। যথা: হামরাএ যামো, কামটা তোমরাএ করচেন। বহুবচনে ‘ঘর,‘গুলা’ শব্দ যোগ হয়- ছাওয়ারঘর=ছেলেরা, পাখিগুলা=পাথিগুলো।

‘অসীৎ’ শব্দটির অপভ্রংশ ‘আছিল’। এ শব্দ রংপুরের ভাষায় অবিকল প্রচলিত- রহীমের একনা বেটা আছিল।    আছিল অর্থ ‘ছিল’-যা অতীতকাল জ্ঞাপক।

রংপুরের ভাষার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য বর্তমান বাংলা ভাষার সঙ্গে মিলযুক্ত। বাংলা ‘খেলা’, ‘বেলা’, ‘মেলা’, শব্দগুলো আদিবর্ণে একার-‘এ’ কার এর মতো উচ্চারিত না হয়ে খ্যালা, ব্যালা, ম্যালা এরকম উচ্চারিত হয়ে থাকে। রংপুর অঞ্চলের ভাষাতেও আদি বর্ণে এ-কার ‘এ্যা’ এর মতো উচ্চারিত হয়। যেমন: – শেষ- শ্যাষ , বেশ-ব্যাশ, কেশ-ক্যাশ। মধ্য কিংবা শেষ বর্ণে ‘’ে একারের উচ্চারণ অপরিবর্তিত – দেশে-দ্যাশে, শেষে-শ্যাষে।

রংপুর অঞ্চলের  আলোচিত বৈশিষ্ট্য হলো – ‘র’ স্থলে ‘অ’ এবং ‘অ’ এর স্থলে ‘র’ বর্ণের উচ্চারণ(ব্যবহার)। এ বৈশিষ্ট্য দীর্ঘদিনের এবং আঞ্চলিক উচ্চারণে স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহৃত।

এ বৈশিষ্ট্য রীতিগত দিক থেকে এরকম – ‘র’ বর্ণের সঙ্গে স্বরবর্ণ অ, আ, উ, ঊ,ও ,ঔ যুক্ত থাকলে ‘র’ এর পরিবর্তে ওই স্বরগুলোই অবিকল উচ্চারিত হয়। যেমন: রসি-অসি(র+অ),রাম-আম(র+আ), রূপবান-উপবান(র+উ),রোগ-ওগ(র+ও) ইত্যাদি। অন্যদিকে ঐ স্বরবর্ণগুলোর সাথে যদি কোনো ব্যঞ্জনবর্ণ যুক্ত না হয়ে থাকে এবং ওই স্বরগুলো একাকি শব্দের আদিতে থাকে তবে তাদের উচ্চারণ ‘র’ এর মতো হয়। যথা: আম-রাম, ওঝা-রোঝা, ঔষধ-রৌষধ। রংপুরের ভাষাতত্ত্ব কবিতায় রংপুরের বর্ষীয়ান  কবি মতিউর রহমান বসনিয়া লিখেছেন-

‘রংপুর হইলো অমপুর মোদের

আমি হইলাম মুই

আমরার বদল হামরা বলি

তুমির বদল তুঁই ।

রোদকে মোর অইদ বলি

ছায়াকে বলি ছ্যাঁয়া

গিন্নিকে মাইয়া বলি

কেমন মজার ভায়া।

————

কুল হইলো বড়াই ভাইরে

সুপারি হইলো গুয়া

রক্ত হইলো অক্ত মোদের

ফাাঁকা হইলো ধূয়া।

————

*অনেক নাটকে রংপুরের ভাষার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। একজন নারী হাটে নিজের ছাগল বিক্রি করলে অন্যরা মন্দ কথা বললে সে নারীর প্রতিবাদ- ‘মোর ছাগল মুই ব্যাচাইচো, তা সবার মুক কালা ক্যা—–’

*হাটে নারীর দোকান করা যাবে না। কিন্তু পরে নানা ঘটনার পর খাজনা পাবার আশায় ইজাদারের লোক বলে- -‘ভাল কবি ব্যাচাও ঠিকঠাক খাজনা দিবু। না হইলে আর দোকান দিবার পাবু না। কয়া দিনু কিন্তুক।

*নারীর উত্তর-: দেইম দেইম খাজনা ঠিকঠাকে দেইম। তোমারগুলাক চিন্তা করা নাইগবার নয়।’

রংপুরের ভাষার আছে এক সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডার। বাংলা ভাষার পাশাপাশি রংপুর অঞ্চলের ভাষা নানাভাবে নিজের বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। রংপুরের ভাষার কিছু বৈশিষ্ট্য বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে দৃষ্ট হয়। প্রাচীন কোনো কবি রংপুরের, এমন মত পোষণ করেন কোনো কোনো গবেষক । আবার ড. গ্রীয়ার্সন রঙ্গপুর, বগুড়া, দিনাজপুরের কতক অঞ্চল এবং সমগ্র কোচবিহার রাজ্যের জনগণের কথিত ভাষাকে রঙ্গপুর বা রাজবংশী ভাষা আখ্যা দিয়েছেন। ওই সমস্ত স্থানে প্রধানত রাজবংশী জাতিরই বাস আর তাদের কথিত সসীম রঙ্গপুর অঞ্চলের ভাষাকে রংপুরের দেশীয় ভাষা বলা হয়। বৌদ্ধ রাজারা রাজবংশী হিসেবে পরিচিত। এক সময় বঙ্গসহ অন্যান্য প্রদেশে পাল রাজত্ব ছিল। এদেশের বৌদ্ধ স্থপতি ছিলেন ধর্মপাল। ধর্মপালের সঙ্গে তার মৃত ভ্রাতা মানিক চাঁদের পত্নী ময়নামতির যুদ্ধের কাহিনী যুগীদের মুখে মুখে শুনতে পাওয়া যায়। ময়নামতি ও তাঁর পুত্র গোপীচন্দ্রের কাহিনী অবলম্বনে রচিত গানের প্রথম সংগ্রহ করেন জর্জ গ্রীয়ার্সন, ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর থেকে। ১৯০৭-১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য রংপুর থেকেই তিনজন যুগী ভিখারির কাছ থেকে সমস্ত পালাটি লিখে নেন । ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে , ময়নামতি গানের ভাষা পূর্ববর্তী যুগের প্রাকৃত প্রধান বাংলা। যেহেতু প্রাকৃত স্তরের সাথে রংপুর অঞ্চলের ভাষা নানা বৈশিষ্ট্যে নিকটবর্তী, ময়নামতির গানের ভাষার সঙ্গে রংপুর এলাকার ভাষার মিল থাকবে এটাই স্বভাবিক।

ময়নামতির কোট এবং ধর্মপালের গড় রংপুরের দুটি বিখ্যাত স্থান। এ তথ্য থেকে অনুমিত হয়  রংপুর জেলা ছিল বৌদ্ধদের শেষ লীলাভূমি। বঙ্গের অন্যান্য প্রদেশ হতে বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে পালিভাষা বিতাড়িত হলেও কামরূপে তা জায়গা করে নিয়েছিল। হিমাচলের পরপারে যাত্রা সময়ে এই ভাষার যে ক্ষীণ প্রতিধ্বনি তা থেকেই রাজবংশী ভাষার উৎপত্তি। অন্যান্য স্থানের মতো রংপুর অঞ্চলেও রাজবংশী ভাষা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিস্তৃত হয়। এ সূত্রেই পালি ও প্রাকৃত ভাষার সঙ্গে রংপুরের ভাষা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বর্তমানেও রাজবংশী ভাষার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লালিত হচ্ছে রংপুরের ভাষায়। এ ভাষায় রচিত হয়েছে মানিক চাঁদ ও গোপী চাঁদ রাজার গান, সত্যপীর, নিজাম পাগলা এমন কুশান গান, পালাগান, মাইষা যাত্রা, করিম বিলাপসহ আরও বহু রচনা।

রংপুরের ভাষার অনন্য সৃষ্টি ভাওয়াইয়া গান। উত্তরাঞ্চল থেকে সংগৃহীত অধিকাংশ ভাওয়াইয়া গানই রংপুর অঞ্চলের। রংপুরের প্রকৃতি, মানুষ, জীবনযাত্রা, সুখ, বিরহ-বেদনা, মিলন-বিচ্ছেদ ভাওয়াইয়া গানে মিলে মিশে একাকার। এ কারণে ভাওয়াইয়া গানে রংপুর অঞ্চলের কথ্য ভাষার ব্যবহার স্পষ্টতর রূপলাভ করেছে।  রংপুরের কথ্য ভাষার যাবতীয় বৈশিষ্ট্য ভাওয়াইয়ার ভাষায় ব্যবহৃত। ‘র’ এর বদলে ‘অ’ , ‘অ’ এর পরিবর্তে ‘র’ শব্দের আদ্যাক্ষরে  এ-কার  ‘এ্যা’ কার এর মতো উচ্চারণ ভাওয়াইয়ায় বহুল।

‘ পতি একনা (এ্যাকনা) কতা কনু হয়

বাপের বাড়ী নাইওর গেনু হয়

দিনা চারি পতি থাকিয়া আনু হয়। ’

এ ছাড়াও রংপুরের কোনো কোনো এলাকায় ক্রিয়া পদের শেষে ‘ব’ ধ্বনি ‘ম’ অথবা ‘প’ ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়।

‘কানাইরে

আমার বাড়ী যাইয়ো কানাই

বসতে দেমো (দেবো) মেড়া

দুই চরুত হেলানী দিয়া

বাজান গো দোতরা কানাইরে।’

রংপুরের কথ্য ভাষায় ‘ছ’ কে ‘চ’ উচ্চারণ করা হয়-

‘বুড়া মাচ (মাছ) মারে রে

ধইচ্ছে একটা(্এ্যাকটা) পুটি

দুই সতীন বুদ্দি করি

ধইচ্ছে বুড়ার টুটি।’

 

বাক ধ্বনি বিন্যাসে রংপুরী ভাষার শব্দের মধ্যে এবং শব্দের শেষে অতিরিক্ত ‘ই’ ধ্বনি উচ্চারিত হয়-

‘বাপই চ্যাগেরা রে

গচত চড়িয়া দুইটা হা

ও মোক জলপই পাড়েয়া হা দে।’

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার আরও বৈশিষ্ট্য:

ক. ক্রিয়া পদের আগে নঞ্চর্থক অব্যয়ের ব্যবহার: যেমন- না যামো, না নেমো, তোমর সাতে না যাই। চর্যাপদে এমন অনেক প্রয়োগ দৃষ্ট হয়-

*‘ভুসুকু ভনই মূঢ়া-হিঅহি ন পইসই॥’

*আপনা মাশে হরিণা বৈরী

খনহ ন ছাড়ই ভুসুকু অহেরী॥

*‘ দুলি দুহি ধরন ন যাই।’

খ. ব্যঞ্জন ঘোষধ্বনির অঘোষ অল্পপ্রাণ উচ্চারণ হয়- কাছ- কাচ, মাছ- মাচ, গাছ- গাচ, বন্ধু- বন্দু।

গ. শব্দের আদি, মধ্য ও অন্ত স্বরধ্বনির কিছুটা পরিবর্তন হয়- যৌবন- যৈবন, নুতন- নউতন।

ঘ. কখনো কখনো ‘দ’ ধ্বনি ‘ড’ উচ্চারিত হয়- দাড়িয়া – ডারিয়া।

ঙ. ক্রিয়া পদের অন্তে ং, ঙ, ঞ ধ্বনির সংযুক্ততা- নেও- নেং, যাই- যাং, শোনো- নোনোং।

ভাওয়াইয়াগানে -‘ ও মুই না শোনং না শোনং তোর বৈদেশিয়ার কতা রে।’

ধ্বনিতাত্বিক রূপতাত্ত্বিক ও শব্দতাত্ত্বিক হাজারো দৃষ্টান্তে প্রমাণ করা যায় যে , রংপুরের কথ্য ভাষার নিখুঁত ব্যবহার রয়েছে ভাওয়াইয়া গানে।

চ. শব্দের মধ্যে অতিরিক্ত স্বরবর্ণ – গেলে>গেইলে, (তোমরা গেইলে কি আর আসপেন? বোন>বইন(কাইল বইনের বাড়িত যাইম)।

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত অনেক কবিতা, ছড়া. নাটকে, গল্পে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে ষোড়শ শতকে নেজাম পাগলার কেচ্ছা’য় কবি মুহম্মদ কালা, পীরগঞ্জে ঝাড় বিশলার অষ্টাদশ শতকের কবি হেয়াত মামুদ, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার রচনায় রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রখ্যাত নাট্যকার নলডাঙ্গার তুলসী লাহিড়ী ‘ছেঁড়াতার’ নাটকে সফলভাবে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা উপস্থাপন করেছেন। এ ছাড়াও সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ কাব্য নাটকে, ছান্দসিক কবি নূরুল ইসলাম কাব্যবিনোদ ‘হামার অমপুর’ কাব্যগ্রন্থে, আনিসুল হক ‘নাল পিরান’ নাটকে, সিরাজুল ইসলাম সিরাজ ‘মরা মানুষের মিছিল’ নাটকে মকসুদুল হক এর গীতিনাট্য ‘শঙ্খমারীর ঘাট’, নাসিমুজ্জামান পান্না’র ‘নাকফুল’ নাটকে, মুহম্মদ আলীম ্উদ্দীনের ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে উপন্যাসসহ অনেকের লেখায় রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা বহুল ব্যবহৃত।

নুরলদীনের সারাজীবন কাব্যনাট্যে আঞ্চলিক সংলাপ কবিত্বময় ও জীবন্ত। নুরলদীন ও আম্বিয়ার সংলাপাংশ-

নুরলদীন-

‘এ দ্যাশে হামার বাড়ি উত্তরে না আছে হিমালয়

উয়ার মতন খাড়া হয় য্যান মানুষেরা হয়।

এ দ্যাশে হামার বাড়ি দক্ষিণেতে বংপোসাগর

উয়ার মতন গর্জি ওঠে য্যান মানুষের স্বর।’

আম্বিয়া-

‘….ঘোর চিন্তা আসে

চাটি অন্তরে পরাণে

অন্তরে কি হয় তার জংগে যদি পায় পতিধন

ইয়ার চেয় শান্তি যে নিজের মরণ।’

 

রংপুরের বিয়ের গীতেও রংপুরের উপভাষা বহুল ব্যবহৃত। গ্রামীণ নারীরা সমবেত অথবা একক কণ্ঠে গীত গায় বিয়ের বিবধ আনুষ্ঠানিকতায়।

* ‘ওরে হলুদি না হলুদি রে কাইনচা বাড়ির হলোদি

হলুদি না হলুদি রে বাঁশের তলার হলুদি।

কাঁয় আছে দরদী তাঁয় তুলবে হলুদি,

হামার দাদি আছে দরদি তাঁয় তুলবে হলুদি।

কাঁয় আছে দরদী তাঁয় বাটপে হলুদি,

হামার ভাবী আছে দরদি তাঁয় বাটপে হলুদি। ’

 

*‘অংপুরিয়া ডালা, তার মধ্যে কালা ডোরা

সই ডালা নাইরো না

এই ডালাতে আছে, সকিনা বিবির জোড়া

সই ডালা নাইরো না।

সেই ডালা দেকিয়া সকিনার মাও কান্দে বসিয়া

সই ডালা নাইরো না।’

 

ধ্বনিগত ব্যঞ্জনায়, বলিষ্ঠতায় এবং জীবন আদর্শ প্রকাশে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা গতিময় ও স্বতঃস্ফুর্ত। সাহিত্যেও এ ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। রংপুর অঞ্চলের জীবন-জীবিকা, ঐতিহ্য, সংগ্রাম, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যথাযথ তুলে ধরতে রংপুরের ভাষার বিকল্প নেই। এ ভাষা বাংলা ভাষা সমীক্ষায় সহায়ক, চলিত ভাষার রূপ এখানে সংরক্ষিত। এ ভাষার অনেক শব্দ সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়ে নতুন আবহ সৃষ্টি করতে পারে।

চলমানকালে অঞ্চলভেদে বদলে যাচ্ছে রংপুরের ভাষাগত রূপরীতি। ‘যাওয়া’ বিষয়ক বাক্যে কোথাও ‘যাওয়া নাগে’ কোথাও ‘যাওছি’ ‘যাওয়া খায়’ যাইছোল, যাচ্ছোল উচ্চারণ শ্রুত হয়।

শিক্ষা প্রাসারের কারণে মিশ্রণ ঘটছে শুদ্ধ বাংলার সাথে। শিক্ষিতের হার বৃদ্ধির জন্য রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার অনেকটাই হ্রাসমান, অন্যদিকে শিক্ষিতজন অনেকেই স্থানীয় ভাষা ব্যবহার মর্যদা হানিকর বিষয় ভেবে কুণ্ঠিত হন রংপুরের ভাষা ব্যবহারে। বাস্তবে এ কুণ্ঠা নিতান্তই অমূলক এবং আত্মশ্ল¬াঘার।  রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা গানে বা অন্যান্য রচনায় অধিক ব্যবহার করা দরকার, বাক্য বিনিময়েও আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ বিশেষ প্রয়োজন। রংপুরের ভাষা নিয়ে অধিক গবেষণা হওয়া সময়ের দাবী। উপভাষা সংরক্ষণে সিডি, অডিও , চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র নির্মাণ আবশ্যক। আয়োজন করা উচিৎ আঞ্চলিক ভাষায় বিতর্ক, কবিতা আবৃত্তি, বক্তব্য প্রতিযোগিতা।  শহর জীবনে শিশুদের রংপুরের ভাষা সম্পর্কে আলোকপাত করে তাদের এ ভাষা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা আবশ্যক। রংপুরের ভাষ্রা অভিধান রচনাও সময়ের দাবী।

কুণ্ঠার সব দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসা উচিৎ। যথাযথ গবেষণা ও অধিক চর্চায় মনোযোগী হলেই স্বচ্ছ হবে রংপুরের ভাষার আছে গর্বিত ভাষাতাত্ত্বিক ধারাবাহিকতা, আছে বিপুল শব্দসম্ভার। বাংলা ভাষা গঠনে এ ভাষার প্রভাবের কথা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ , দীনেশ চন্দ্র সেন প্রমুখ পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব নানা উদাহরণে প্রমাণ করেছেন। কাজেই কোনো দিক থেকেই উপেক্ষা করা যায় না রংপুরের আঞ্চলিক ভাষাকে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট দেশের উপভাষা অনুসন্ধান, সংরক্ষণ ও বিকাশে বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তার অংশ হিসেবে গত ১৩ নভেম্বর রংপুরে বিভাগীয় পর্যায়ে রংপুরের উপভাষা অনুসন্ধান, সংরক্ষণ এবং সাফল্য বিষয়ে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।  আশা কারা যায় এমন উদ্যোগ রংপুর অঞ্চলের উপভাষার সংরক্ষণ ও  বহুল ব্যবহার নিশ্চিত করতে অনবদ্য ভূমিকা রাখবে।

** রংপুরের কিছু আঞ্চলিক শব্দ ও আধুনিক বাংলা-

হামার>আমার, মুই>আমি, আকাল>অভাব. ঢ্যানা>অবিবাহিত যুবক, আইগনা/খুলি>উঠান, এত্তকোনা>এতটুকু, এমতোন>এমোন, ইতি>এদিক, উতি>ঐদিক, দুড়া>কচ্ছপ, কইতর>কবুতর, চুয়া>কুয়া, কস্টিয়া>কৃপণ, বাড়–ন>ঝাটা, ঠ্যাল>ডাল, গাবরু>রব,পাত্র, গুদাম>বোতাম, টেটিয়া>হিংসুটে,  নাাকারি,দাড়িয়াঘর,খানকা>বৈঠকখানা, চ্যাংড়া>ছেলে, চেংড়ি>মেয়ে, ছাওয়া, ছাওয়াল>সন্তান,  কোষ্টা>পাট,  রশি>দড়ি, বাাইগন>বেগুন, আন্দন>রান্না, বাড়ন>পরিবেশন, ধলা>সাদা, আকালি>মরিচ, ঢাংগা>লম্বা, ভোক>ক্ষুধা, আংগা,পিরান>জামা, আন্দারৎ>অন্ধকারে, দোপর>দুপুর, আইত>রাত, সাঞ্জেরবেলা>সন্ধ্যাবেলা, কাউয়া>কাক, চিলা>চিল, ভূঁই>ভূমি/জমি, মাইঞা>গিন্নি, তাংকু>তামাক, সুঁই>সুঁচ, চাইলোন>চালুনি, বড়াই>কুল, অক্ত>রক্ত, ধূয়া>ফাঁকা, দেওয়া>আসমান/আকাশ, ঝরি>বৃষ্টি, ধলা>সাদা, ঘাটা>রাস্তা, হেঁউত>আমন, ভ্যাটা>শাপলা, দলান>দালান,  ইচলা>চিংড়ি।

তথ্য সহায়তা:

ক. বাঙলা ভাষা (২য় খ- ) সম্পাদনা- হুমায়ুন আজাদ, বাংলা একাডেমি, প্রকাশক-মোাহাম্মদ ইবরাহিম-১৯৮৫।

খ. ভাষাতত্ত্ব- অতীন্দ্র মজুমদার।

গ. একুশের প্রবন্ধ’৯২- বাংলা একাডেমি-প্রকাশক- শামছুজ্জামান খান।

ঘ. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- মাহবুবুল আলম- প্রকাশক – এম.এ ফারুক, তৃতীয় সংস্করণ-১৩৯১।

ঙ. লোকসংস্কৃতি ২য় ও ৩য় সংখ্যা), সম্পাদক-ড. মুহাম্মদ আব্দুল জলিল, লোকসংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র, রাজশাহী- ১৪০২।

 

লেখক:

ভূতপূর্ব অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, কারমাইকেল কলেজ, রংপুর

**

1136 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৭:০৪ অপরাহ্ণ

উপভাষা, ভালোবাসা : রংপুরী ভাষা

ভাষা ভাব প্রকাশের মাধ্যম। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল বা ভূখণ্ডে বসবাসরত মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আবার, প্রত্যেক ভাষারই প্রমিত রূপের পাশাপাশি আঞ্চলিক রূপ বা উপভাষা রয়েছে। উপভাষা  হচ্ছে  প্রমিত ভাষার (ঝঃধহফধৎফ খধহমঁধমব) পাশাপাশি প্রচলিত অঞ্চলবিশেষের জনগোষ্ঠী কর্তৃক ব্যবহূত আঞ্চলিক ভাষা। পৃথিবীর সর্বত্রই প্রমিত ভাষার পাশাপাশি এক বা একাধিক আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা (উরধষবপঃ) ব্যবহৃত হযয়ে থাকে। প্রমিত ভাষার সঙ্গে উপভাষার ব্যবধান ধ্বনি, রূপমূল, উচ্চারণ ও ব্যাকরণগত কাঠামোর মধ্যে নিহিত থাকে। সাধারণত প্রমিত ভাষায় ভাষাভঙ্গির সংখ্যা বৃদ্ধি, ভৌগোলিক ব্যবধান এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসগত পার্থক্যের কারণে উপভাষার সৃষ্টি হয়। অঞ্চলভেদে স্থানীয় রীতি-নীতি, আচার-আচরণ ও পরিবেশগত কারণে একই ভাষায় ব্যবহৃত ও প্রচলিত শব্দ, শব্দের অর্থ ও উচ্চারণগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। কোন ভাষাকে আশ্রয় করে এরূপ সীমিত পরিসরে ব্যবহৃত শব্দ বা বাক্যসমূহই  উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে চিহ্নিত। প্রমিত ভাষা দেশের সর্বস্তরে ব্যবহৃত হয়; লিখিত পদ্ধতির ক্ষেত্রেও তা অনুসৃত হয়, কিন্তু উপভাষার ব্যবহার কেবল বিশেষ অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যেই সীমিত থাকে। তবে  কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাহিত্য ও সঙ্গীতেও উপভাষার সার্থক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।

বাংলা ভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাভাষী জনগণের অঞ্চলভেদে বাকভঙ্গির কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে।  বাংলা ভাষার  যেমন আছে পরিশীলিত প্রমিত রূপ, তেমনি  বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক আঞ্চলিক বাংলাভাষা বা উপভাষা প্রচলিত রয়েছে। বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো এর আঞ্চলিক ভাষার সৌন্দর্য। অসাধারণ সব শব্দের বিন্যাস দিয়ে বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষাগুলো আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। একই শব্দ কত রকমভাবে যে ব্যবহৃত হয় এবং তা মধুর শোনায়, তা শুধু প্রতিটি অঞ্চলে গেলেই দেখা যায় এবং শোনা যায়।

দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত রংপুর অঞ্চলেও পরিশীলিত ও মার্জিত বাংলা ভাষার সমান্তরাল আঞ্চলিক বাংলাভাষা বা উপভাষা  প্রচলিত রয়েছে। বিশেষ করে রংপুরের গ্রামাঞ্চলের মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এই ভাষা ব্যবহার করেন। রংপুরের এই আঞ্চলিক উপভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বিশেষ বৈশিষ্টম-িত। প-িতেরা ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে রংপুরের এই আঞ্চলিক উপভাষাকে উদীচ্য বা বরেন্দ্র উপভাষার  গোত্রভূক্ত  এবং ‘বঙ্গকামরূপী’ ভাষার উত্তরসূরী বলে চিহ্নিত করেছেন।

উল্লেখ্য, ভাষাবিদ সুকুমার সেন বাংলা উপভাষাসমুহকে প্রধানত ৫টি শ্রেণিতে  ভাগ করেছেন । যথা:

১.         রাঢ়ী উপভাষা

২.        বঙ্গালী উপভাষা

৩.        বরেন্দ্রী উপভাষা

৪.        ঝাড়খণ্ডী উপভাষা

৫.        রাজবংশী উপভাষা

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা এই শেষোক্ত  রাজবংশী উপভাষা গোত্রের অন্তর্ভূক্ত। এটি একটি ইন্দো-আর্য পরিবারভুক্ত বাংলার উপভাষা ভাষা। বরেন্দ্রী ও বঙ্গালী উপভাষার মিশ্রণে এই ভাষা গড়ে উঠেছে। রাজবংশী উপভাষা  পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার; আসামের বঙাইগাঁও, কোকড়াঝাড়, গোয়ালপাড়া, ধুবড়ী জেলা এবং বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের সব জেলায় প্রচলিত। এই উপভাষা  কামরূপী, বঙ্গকামরূপী, রংপুরি ভাষা নামেও পরিচিত। একে কেউ কেউ বর্তমানে পৃথক ভাষা হিসেবে গণ্য করেন। এই উপভাষার  একাধিক কথ্য রূপ প্রচলিত।

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার  উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য:

১.         অনুনাসিক বর্ণ রক্ষিত

২.        শ্বাসাঘাতের নির্দিষ্ট সহান নেই

৩.        অধিকরণ কারকে অ, এ, তে বিভক্তির স্থলে ‘ত’ বিভক্তির প্রয়োগ। যেমন- হাটে বুঝাতে হাটত, গাছে>গাছত, বাড়িতে>বাড়িত ইত্যাদি।

৪.        ক্রিয়াপদের আগে নঞ্চর্থক অব্যয়ের ব্যবহার যেমন- না শোনং, না যাইম, না খাইম ইত্যাদি।

৫.        শব্দের আদি ‘র’ ধ্বনির স্থলে অ’ এবং ‘অ’ ধ্বনির স্থলে ‘র’ এর ব্যবহার। যেমন- রাজা>আজা, রস>অস, রংপুর>অমপুর, রক্ত>অক্ত, আম>রাম, আইন>রাইন ইত্যাদি। এজন্যেই  রংপুরী ভাষায় ‘রামবাবুর আমবাগান’-এর উচ্চারণ হয়- আমবাবুর রামবাগান।

৬.        শব্দের আদি ‘ল’ এর স্থলে ‘ন’ এবং ‘ন’ এর স্থলে ‘ল’ ধ্বনির উচ্চারণ রংপুরের ভাষার আরা একটি উল্লে¬খযোগ্য বৈশিষ্ট্য।  যেমন- লাট>নাট,  লাল >নাল, লাগে >নাগে,  লবন>নবন ইত্যাদি।

৭.        ঘোষ ব্যঞ্জণ ধ্বনির অল্পপ্রাণ অঘোষ উচ্চারণ হয়।  যেমন গাছ>গাচ, মাছ>মাচ,বন্ধু>বন্দু।

৮.         শব্দের আদি, মদ্য ও অন্ত স্বধ্বনির পরিবর্তন হয়। যেমন- যৌবন>যৈবন, নুতন>নউতন।

৯.        আদি ও মধ্য ‘এ’ ধ্বনির ‘এ্যা ’ উচ্চারণ- দেখিয়া>দ্যাখিয়া, বিদেশ>বৈদ্যাশ।

১০.       ‘দ’ দ্বনির ‘ড’ উচাচারণ- দাড়িয়া>ডারিয়া।

১১.       অপিনিহিতর ব্যবহার: অদ্য > আইজ , কল্য > কাইল

১২.       শব্দের মধ্যবর্তী স্থানে অতিরিক্ত স্বরবর্ণের ব্যবহার, যেমন : গেলে > গেইলে, বোন > বইন।

১৩.      শব্দের মধ্যবর্তী ব্যঞ্জনবর্ণ লোপ : কহিল > কইল।

১৪.       ক্রিয়া পদের শেষে  ‘ঙ’, ‘ঞ’ ‘ং’ ধ্বনির সংযোগ-খাই>খাং, যাই>যাং,খাচ্ছি>খাইচোং, যাচ্ছি>যাওচোং,  শুনব> শোনং।

১৫.      ‘ছ’ এর ব্যবহার ‘চ’ রূপে : মাছ > মাচ।

১৬.      ‘জ’ এর স্থলে ‘ঝ’ এর ব্যবহার।

১৭.       অপাদান কারকে ‘হাতে’’, ‘টে’ বিভক্তির প্রয়োগ। ‘‘বইখান কারটে আনলু’’।

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার কতিপয় শব্দ :

অকে, অমপুর, অক্ত, আঙা, আন্দন, উদিনকা, আইগন্যা, ক্যাংকা, ফ্যাদলা, এইংকা, উন্দাও, বাইগোন, বাহে, সুন্দরী, তাংকু, দলান, ঢ্যানা, বাড়ুন, গাবরু, কাপাট, কইনা, এইকনা, ছাওয়া ইত্যাদি ।

এছাড়া, অনেক প্রমিত বাংলা শব্দের আঞ্চলিক উচ্চারণ বিশেষভাবে প্রচলিত । যেমন- অভাব/আকাল>মঙ্গা, অদ্ভূদ>আচাভূয়া, অবিবাহিত যুবক>ঢ্যানা, উলঙ্গ>উন্দাও, উঠান>আইগনা/খুলি,  এতটুকু>  এত্তকোনা/এ্যাকনা, এতে> ইতি, এমন>এমতোন, এরকম> এংকা,ঐদিকে>উতি, কনে>কইনা, কচ্ছপ>দুড়া, কবুতর>কতৈর, কূয়া>চুয়া, কেমন>ক্যাংকা, কৃপণ>কশটিয়া, চোয়ানো>ওশশে, ছেলে>চ্যাংরা, ঝাটা>বাড়–ন, ডাল>ঠ্যাল, ডিম>ফল,  দরজা>কাপাট,  দরজা>কাপাট, বর>গাবরু, বোতাম>গুদাম, বৈঠকখানা >খাংকা/ডারিয়াঘর,   মেয়ে> চ্যাংরি, সন্তান> ছাওয়া, শুপারি>গুয়া, হিংসুটে >টেটিয়া, বাপু-হে>বাহে, বেগুন>আইগন, পরিবেশন>পস্যন, রন্ধন>আন্দন,  সুপারি>গুয়া,  শেষ হওয়া> ওড়ে যাওয়া, হঠাৎ >হুমফাইট,   ক্ষুধা>ভোক   ইত্যাদি।

রংপুরের আঞ্চলিক উপভাষার উদাহরণ-

ক. ‘এ্যাকনা মাইনসের দুকনা ব্যাটা আছিল। তার  ছোটকোনা উয়ার বাপোক কইরো, বা, মোর পাইস্যা কড়ির বাগ মোক দেও। ওই কতাতে তাঁয় উমার ঘরোক সব বাটি দিলো।’

খ. ‘একদিন চেংটু আসি দ্যাওয়ানীক কইলো, ও বাহে দ্যাওয়ানীর ব্যাটা হাটাতো অমপুর যাই। হামার ঐ্যাকনা মোকদ্দমা আছে। দ্যাওয়ানী কইলো মুই আজ যাবার পাবার নও, হামার বাড়িত আইজ সাগাই আসপে।’

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণগত সহজবোধ্যতা, সাবলীলতা ও শ্রুতিমাধুর্য অসামান্য। রংপুরের এ ভাষাকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছে এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতি। রচিত হয়েছে এ অঞ্চলের লোকসাহিত্য ও সঙ্গীতের সুবিশাল সম্ভার। রংপুর অঞ্চলে প্রচলিত ভাওয়াইয়া, পালাগান,  লোককথা, মেয়েলী গীত, কিস্সা কাহিনী,  ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন  ইত্যাদিসহ লোকসাহিত্য ও সঙ্গীতের অন্যান্য শাখায়  আঞ্চলিক ভাষার সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে।  কেবলমাত্র লোকসাহিত্য ও সঙ্গীতেই নয় প্রাচীন ও মধ্যযুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের অনেক কবি-সাহিত্যিকও তাদের সাহিত্যকর্মে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার সার্থক প্রয়োগ  করেছেন।

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদের অনেক পদে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার রীতি ও শব্দের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।  যেমন-

‘টালত ঘর মোর নাহি  পরবেসী।

হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী ॥’ – (৩৩নং পদ, ঢেন্ঢপাদানম্)

অধিকরণ কারকে অ, এ, তে বিভক্তির স্থলে ‘ত’ বিভক্তির প্রয়োগ রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেমন- হাটোত, গাছোত ।

অন্যত্র-

‘অপনা মাংসে হরিণা বৈরী।

খনহ ন ছাড়ই ভুসুকু অহেরী ॥

তিন নছুবই হরিণা পিবই ন পাণী।

হরিণা হরিণীর নিলঅ ন জানী ॥

তরঙ্গতে হরিণার খুর ন দীসই।

ভুসুকু ভণই মূঢ়া-হিঅহি ন পইসই ॥’

-( ৬নং পদ, ভুসুকুপাদানম্)

ক্রিয়াপদের আগে নঞ্চর্থক অব্যয়ের ব্যবহার রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার  আর একটি বৈশিষ্ট্য  যেমন- না শোনং, না যাইম, না খাইম ইত্যাদি।

ষোড়শ শতকের কবি মুহম্মদ কালার  ‘নেজাম পাগলার কেচ্ছা’ কাব্যে ব্যব‎হত রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার নমুনা :

‘শুন পিতা কহি আমি তোমারো মোক্ষত

মনে মোর এহি সাদ কহিল তোমাত।

দিব্য এক সহানো চাইয়া মন্দির নিম্মাইব।

চাইর দিকে চাইর মন্দির মদ্ধে তো দলান

চাইর রাজকন্যাকে রাখিব আনিয়া

মন্ধেতো দলান ঘর বসিতা।

চাইর কন্যার ররৈস দেখিব নএ আনে।’

রংপুরের ভাষাতে বাক্য মধ্যে বিশেষ জোর বোঝাতে গিয়ে অনাবশ্যকভাবে “হ এ’ একটি পদ ব্যবহার করা হয়। কবি মুহম্মদ কালার  ‘নেজাম পাগলার কেচ্ছা’য়  এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন-

‘আজি কালির মইধ্যে যদিনা আইল হএ।

য় বোসে য়ভাগিনীর মরণ নিছ এ।

জলে ঝম্প দিআ নহে য়নলে পশিয়া।

নহে প্রাণ তাজিলায় হএ গরল ভক্ষিআ।’

অষ্টাদশ শতকের কবি  হেয়াত মামুদের রচনায় রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার অনেক শব্দ রয়েছে।  বেগম  রোকেয়ার রচনাতেও  রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার অনেক শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। নাট্যকার তুলসী লাহিড়ীর নাটক ‘ছেঁড়াতার’, সৈয়দ শামসুল হক এর নাটক ‘নুরলদীনের সারাজীবন’, নূরুল ইসলাম কাব্যবিনোদের কাব্য ‘হামার অমপুর’, আবুল কাশেমের গ্রন্থ ‘হামার দ্যাশ হারাগাছ’, সিরাজুল ইসলাম সিরাজের নাটক ‘মরা মানুষের মিছিল’, আনিসুল হক এর নাটক ‘নাল পিরান’, মকসুদুল হক এর গীতিনাট্য ‘শঙ্খামারীর ঘাট’, সাখাওয়াত হোসেনের  নাটক ‘বাহে নিধূয়া পাথার’, নাসিমুজ্জমান পান্নার ‘নাকফুল’, মুহম্মদ আলীম উদ্দিনের উপন্যাস ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ ইত্যাদিসহ বিভিন্ন গ্রন্থে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার  সফল প্রয়োগ ঘটেছে। মতিউর রহমান বসনীয়া ‘রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ রচনার পাশাপাশি অনেক কবিতা লিখেছেন এ ভাষায়। এ ধরণের নানা সাহিত্যকর্ম এবং রংপুর অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষার বিপুল শব্দসম্ভারকে আশ্রয় করে আবহমান কাল ধরে প্রবহমান রয়েছে  রংপরের সমৃদ্ধ  আঞ্চলিক ভাষা। সর্বোপরি, রংপুরের লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতি মূলত গড়ে উঠেছে এই আঞ্চলিক উপভাষাকে কেন্দ্র করেই।

উল্লেখ্য, আঞ্চলিক ভাষাই মূলত: মানুষের প্রকৃত মাতৃভাষা। আঞ্চলিক ভাষার মধ্যদিয়েই মানুষের সবধরণের অনুভুতি-অভিব্যক্তির স্বত:স্ফূর্ত ও স্বাভাবিক প্রকাশ ঘটে থাকে। সেই সাথে ভাষার প্রকৃত ও স্বাভাবিক প্রাণপ্রবাহ সচল থাকে তার আঞ্চলিক ভাষার মধ্য দিয়ে। প্রমিত ভাষার মূল কাঠামো গড়ে ওঠে মূলত: আঞ্চলিক ভাষাকে ভিত্তি করেই। আঞ্চলিক ভাষার ধ্বনি, রূপমূল, উচ্চারণ ও ব্যাকরণগত কাঠামোর মধ্যে নিহিত থাকে প্রমিত ভাষার মৌলিক উপাদান। একারণে ভাষাতাত্ত্বিকগণের কাছে আঞ্চলিক ভাষার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ম্যাক্সমূলার বলেছেন-ঞযব ৎবধষ ধহফ হধঃঁৎধষ ষরভব ড়ভ ষধহমঁধমব রং রহ রঃং ফরধষবপঃং. ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন- ভাষাতত্ত্বের অনেক জটিল সমস্যার সমাধান আঞ্চলিক ভাষার সাহায্যে হতে পারে। আঞ্চলিক ভাষাকে ভিত্তি করে রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা সাহিত্যিক প্রভাবে সাহিত্যের ভাষা গড়ে ওঠে। আঞ্চলিক ভাষাগুলোর মধ্যেই সাহিত্যিক ভাষার ইতিহাস বজায় থাকে। কিন্তু, আধুনিক সমাজ ও সংস্কৃতির দ্রুত প্রসার এবং  বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতির লাগামহীন অনুপ্রবেশের প্রেক্ষাপটে  রংপুরসহ অন্যান্য অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাগুলো নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলতে বসেছে। এর ফলে শুধুমাত্র আঞ্চলিক ভাষাই নয়; আমরা হারাতে বসেছি আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অমূল্য অধ্যায়কে।

রংপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য  অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও সুপ্রাচীন। এ জনপদের ইতিহাসের প্রাচীনত্ব ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিশেষ করে রংপুরের সহজ, সাবলীল ও শ্রুতিমধুর  আঞ্চলিক ভাষা এ অঞ্চলকে ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বিশেষত্ব দান করেছে। রংপুর অঞ্চলের এই ভাষাগত ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে  এ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা সংরক্ষণের  গুরুত্ব অপরিসীম।

বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিক ইচ্ছায় প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট অন্যান্য কার্যক্রমের সাথে আঞ্চলিক ভাষা সংরক্ষেণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এরই অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের ১৩ নভেম্বর রংপুরের আঞ্চলিক  ভাষা সংরক্ষণ বিষয়ে এক বিভাগীয় কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। কর্মশালায় রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা সংরক্ষেণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ লক্ষ্যে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্য ও সঙ্গীত চর্চার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপসহ বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, সংবাদপত্র ও অন্যান্য  গণমাধ্যমে এর ব্যাপক প্রচারের পাশাপাশি সরকারি ভাবেও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা সংরক্ষণে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।  #

তথ্যসূত্র :

১. রংপুর জেলার ইতহাস : রংপুর জেলা প্রশাসন।

২. রংপুর সংবর্তিকা : মুহম্মদ আলীম উদ্দিন।

৩. উইকিপিডিয়া।

৪. বাংলাপিডিয়া।

৫. ইন্টারনেটে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধ/নিবন্ধ।

954 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৭:০৩ অপরাহ্ণ

বিলীনপ্রায় উপভাষা ও কয়েকটি কবিতা

হারে গেতিচে হামার গেরামের দিনগুল্যা। হামার গ্রামের দিনগুল্যা- হারে যাওয়া মানে এই দেশোত গেরাম নিপ্যাত হয় য়্যা যাইবে। আরে হামরা যখন ছাওয়া- হামার এনায়েত পুর গেরাম থাকি নানার বাড়িত গেচনো- গরুর গাড়িত করি- সেই পীরগাছা তালুক ইসাদ গেরামে।আস্তার মাজোত ফির ঘাগোট নোদি পার হওয়া নাগচিল। এখন তো গরুর গাড়ি দুরের কতা- নদী বিলিন হতিচে। ইস! কি এক নাল দিনগুল্যা আচিলো- ভাইবোইনেরা আর মা সুদদ্যায় যখন গরুর গাড়িত ওঠনো- গাড়িত একখ্যান টাববোর। ফির টাববোর ঘিরি কাপড় প্যাচে দেচনো- যাতে আস্তার নোকজন না দ্যাখে। নানার বাড়িত থাকি ফির ফেরার সময় দুইট্যা পাকা কাটোল নেচনো। বাপরে বাপ- আস্তার নোকজন কাবরে কাবরে কইচিলো- বাহে কাটালটার সাদ আচে। মুই ফির চিলল্যায় কচনু- আইসেন বাহে খাবার। কতই ন্যা কতা মনোত পরে- গরমের দিন। আচিলো-ন্যা কারেন। আস্তার গাচের নিচোত শুতি- বাতাসের অপেককায় আচনো। হামার পারা পতিবেশি সবাই মিলি- কেউ পাটিত সুতি,  কেউ আস্তার দুগল্যা ঘাসের ওপোর। আর গল্প  কেচ্চা চলছে। আইত  হইলে চাননি রাইতোত আলোমোক ডাক দেচনো। আলোম দোতরা বাজায় ছিলো- আর মিল দিয়্যা দিয়্যা কতো কতা কইছিলো- কতা গুল্যা একেবারে সাদামাটা। হামরা কি হাসাহাসি। এদিকে ফির কাওয়ালি শুনি অনেকে চোখের পানি ফ্যালাইছিলো। কারো মরি যাওয়া ভাতারের কতা মনে পরছিলো, হায়রে সেই কাহিনি- ইলিজ্যার বাপ ফির এমন মনোযোগ দিয়্যা কাওয়ালি শুনছিলো- বিড়ি টানতে টানতে মোচোত নাগিল আগুন- ওই আসোরোত চিল্লায় উঠচিলো।

আইজক্যা দিন গুল্যা আর নাই। মাইস্যা এমন ব্যাস্ত হইছে- গেরামের সেই গাচগাচালি জংগল কিচু নাই। আরে সাগাই বাড়িত আসলে- হামরা সবাই মিলি ডেকি মুরগি দাবরে ধোরচে নো। মা এদিক পিয়্যাজ মরিচ কাটি নিচিল- হামরা গেরামের চেংরা মিলি ঢেকি মুরগি দাবারা-। মুরগি নাই ধরতে সাগাই সাইক্যালোত ক্রিং ক্রিং- হামরাও চায়য়্যা- সাতে একটা সাদা পলিথ্যানে গ্লুকোজ বিস্কুট। আজ এই বিস্কুট পানিত ভিজি ভিজি খাচনো – কি শান্তি। এখোন হামার গেরামো শোক কিচু হারি যাইয়্যা শহরের মতো হইচে। গেরামোত যায়য়্যা আগের মতো আর তিপ্তি পাওয়া যায় না। আরে যখন মুই ছোটো- পাটা  বারিত টু টু খ্যালচো নো। এদিকে অন্যদল খ্যালা শ্যাস করি চলি গেইচে- হামরা আচি পাটবারিত নুকি। আজোব ব্যাপার- সোইদ্যার সময় বাড়িত আসি- ঘরের কানচি দিয়া ঢুকি- যাতে মা টের না পায়। বারিত আসি- কোনোমোতে হাত মুখ ধুইয়্যা- সপোত বসি – পড়া শুরু- বাইরোত বসলে কুপ্যার আলোত পড়ব্যার বসচে নো।সোইনদ্যার পর পরেই ঘুমোত টুপি টুপি পরি গ্যাচনো।পিচোন থাকি মা আসি সেই পিটোন। একোন নাকি সোইলপোলোক পিট্যা যাবো-নায়।  একোন হামার গেরামোত যাইয়্যা দ্যাখো- থ্রি জি, ফোর জি নিয়্যা ব্যস্ত। একোন কার গেরাম গোনজোত থ্রিজির পিরিত চলে। আগে হামার পেরেম পিরিতির এমন টান আচিল- বাপরে বাপরে খেরি ঘরের মোকার থুরি খুলি-ঢুকচিলো। থাক নিয়্যা ফির পরের দিন বিচ্যার শাল্লিস। বাপরে বাপ- সেই বিচ্যার শাল্ললিসের কিততি দেখলে- সুনলে-এলাও মোর হাসি পায়। আহারে- সেই রাকোয়ালের পেরেম- আইল দিয়্যা গরুক ঘাস খাওইছিলো- আর এদিকে গেরামের  চেংরি- আস্তা হাটছিলো। আখাল হালুয়্যা পেন্টি দিয়্যা- সংকেত দিচিল্প- চিঠিক্যান হটে আঠিয়্যা কলা গাচের থোপোত থুইস।

আদিল ফকিরের কয়েকটি কবিতা

১. জেয়াপত

আইসো বাহে সাগাই, বইসো হামার বাড়িত

হাত পাংকার বাতাসে, গাইমো এ্যাকনা গিত

 

কুনদিন থাকি দেখিন্যা, মোনোত ভাসে পিরিত

গোসা হইছেন ক্যান বাহে, হামরা তোমার পিত?

 

তোমরা হামার এ্যাকনা সাগাই, আসমেন বেশি নায়োর

মনের কতা খুলি কমো, হামরা থাকমো তোইয়োর

 

আণ্ডা আনমো ডুগি আনমো, খামো এ্যাক সাতে

আরে তোমার হাত -হামার হাত, থাকবে এ্যাক পাতে

 

তোরা ক্যামা টেমকি থাকেন, বোজোনা কিছু

আরে  ফকির তোমার কি করিলো,উলট্যা নাগেন পিছু?

 

মুই হবার চাও সাদা মাইস্যা, থাকপ্যানায় সুদঘুস

তোরা ক্যান ফাস্কা কতা কয়য়া,করেন ফুসফুস

 

আরে এইতো আছি এইতো নাই, হামরা ভাই ভাই

হিংস্যাবিদেস সব ভুলি, আইসো এ্যাক সাতে খাই।

২. এনায়েতপুর

এইকন্যা মোর সোনার গেরাম

সোনা ঝকমক করে-

ধানের গায়োত ফোকলা হাসি

মণি মুকত্যা ঝড়ে।

 

এই গেরামের মরদ হামার

টিটুল নামে চেনে-

আইত দুপুরে ভ্যানের ওপোর

বউ-বধূ টানে।

 

দিন হইলে কাটে ধান

মোন উদ্যার ছাওয়া

কামের ঘোরে মাঠের টানে

যায়না যে পাওয়া।

 

মাইষ্যার জালায় চুপচাপ

সামসুম করি চলে

কতা কয় হিস্যাব করি

খোঁজে পান্তার জলে।

 

আর একন্যা কতা শোনো

বিয়্যা করচে গোরোত

সেইকন্যা সুইদ-ধ্যা কাম করে

মানায় ক্যামা সোগোত।

 

ধান মারে- ধান কাটে

টিটুল গায় গান

কামকন্নি কুল্যা ধরে

পিচকি খায় পান।

 

হায়রে টিটুল, নাইরে রুব্যাল

যদি থাকিল বাচি-

আইজ হামার সোনার গেরাম

করতো নাচানাচি।

৩. হামার গ্রাম

ছোটদের ধ্বনিতত্ত্ব

দাদু হামার পুরাতোন নোক, এ্যাকশো বচর বাচি

কততো গপপো শুনাইচেন, দুই এ্যাকটা কইম জাচি।

 

গপপো শুনি তোরা অবাক হইমেন, কি আর কইম ভাই

স্যারে স্যারে হইচিলো দুধ- আচিল নাকি তার গাই।

 

বস্তায় বস্তায় পাকা আম, পরি আচিল বাড়িত

দলে দলে সাগাই সোদোর, আসচিলো গরু গাড়িত।

 

এ্যাকসাতে গপপো গুজুব, কততো হাসাহাসি

রাইত হইলে কেচ্চা গপপো, সুতছিলো ঠাসাঠাসি।

 

আরে দাদার কতা কি আর কইম- মোরে চোখে দ্যাখা

সাপ খ্যালা দেখিয়া -নাকচিলো ভ্যাকাচ্যাকা।

 

সোইনধ্যা হইলে কাওয়ালি, আরো কতো গান

রাইত দুপুরে খেঁকশিয়ালি, দ্যাখে আকাশ চান।

 

এ্যালাও যদি দ্যাখপের চান, আইসো হামার গ্রামোত

হাসতে হাসতে হাপসি যাইমেন,মরি যাইমেন সরমোত।

 

এ্যালাউ হামার বউঝিরা, দীঘিত কাটে সাতার

মাঠোত হামরা কাম করি, যারা যারা ভাতার।

৪. উপভাষা

ক্যা বাহে তোরা ক্যামা সোগোত

আগা পাচা গোরোত

কিছুই তোমার বোঝো না

সোকটে বাজান খঞ্জনা।

 

বাতুল অ্যাকনা বাচাই করো

ছোয়াচ ওগ খারাপ বড়ো।

 

দ্যাখেন না গনেশের ব্যাটা

শোকটে নাগায় শুধু আটা

আরে হামার করি হামরা খাই

সুড়সুড়ি ক্যান তোমার ভাই।

 

তোমরা অ্যাকনা ন্যাকেন বেশি

তাই তো তোমার ফুসফুসি

দ্যাখেন না আতুসির মাও

এক্কেবারে ঊনিশ ছাও

তাও করে না ড্যাপড্যাপ

তোমার নাই ন্যাকতে পরে ছ্যাপ।

401 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৭:০২ অপরাহ্ণ

ভাষা ভাবনায় রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা

একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয়তা বনাম ভাষার প্রতি ভালোবাসার ক্ষেত্রে এক তাৎপর্যময় দিন। ১৯৫২ সালে রফিক, শফিক সালামসহ শহিদ ভ্ইায়েরা আমাদের যে মাতৃভাষার দাবিতে প্রাণ দিয়েছিল, তা ছিল আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের দাবি। পরবর্তীতে কানাডা প্রবাসী বাঙালি জনাব রফিক এবং সালামের মাধ্যমে ইউনেস্কো যে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে, তা হলো মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা হলেও আমরা কিন্তু মায়ের মুখ থেকে এ ভাষা শিখি না। আমরা মায়ের কাছ থেকে প্রথম আমাদের আঞ্চলিক ভাষা শিখি। এ ক্ষেত্রে রংপুরের  আঞ্চলিক ভাষা বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। ২০০৭ সালের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ১৫ মিলিয়ন মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষাকে রংপুরী ভাষা বলা হয়ে থাকে। এছাড়াও এটাকে বাংলাদেশে বাহে, বাংলা, কামতা, পলিয়া এবং ভারতে কামতাপুরী, দত্তা, গোয়ালপুরীয়া, কোচ, রাজবংশী বলা হয়ে থাকে।

রংপুরী ভাষা ভারতের অন্যান্য ভাষার মতো ইন্দো-আর্য ভাষা হতে উদ্ভূত। ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থে এ ভাষাকে কামরূপী ভাষা হিসেবে অভিহিত করেছেন। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, এ ভাষা কামরূপী উপ-ভাষার একটি বিভাষা। আবার অনেক নৃতত্ত্ববিদের মতে এ ভাষা বোড়ো ভাষার পরিবার গোত্র।

যেহেতু রংপুর এক সময় কামরূপের অন্তর্গত ছিল, তাই স্বাভাবিকভাবে এ ভাষার সাথে কামরূপের ভাষা মিল থাকতে পারে। কামরূপী ভাষা হলো অসমীয়া ভাষার গোত্র। অসমীয়া ভাষার অন্য গোত্রটি হলো গোয়ালপুরিয়া। ভারতে অনেকে রংপুরী ভাষাকে গোয়ালপুরিয়া ভাষা বলে থাকেন। এক সময় কোচ রাজা বিশ্বসিংহ গোয়ালপুরে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন এবং তিনি রংপুরও শাসন করেন। এরই ভিত্তিতে রংপুরী ভাষা কামরূপ ভাষার সমগোত্র তা যুক্তিযুক্ত।

যেমন- ‘এটা কাম আইসু’ এই কামরূপী বাক্যটিকে আমাদের রংপুরে বলে ‘একটা কামোত আসসুং’। এ থেকে পরিলক্ষিত হয় কামরূপের সাথে রংপুরী ভাষার মিলকরণ।

অসমীয়া ভাষার কথা যেহেতু আসলই, তবে চর্যাপদের ভাষাতেও কি রংপুরের ভাষার প্রভাব রয়েছে? ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, চর্যাপদের ভাষা ‘প্রাচীন বঙ্গ-কামরূপী ভাষা’। সুকুমার সেনও চর্যাপদের ভাষাকে অসমীয়া ভাষা বলে দাবি করেছেন। তাই অবশ্যই এখন আমাদের চর্যাপদের ভাষা নিয়ে গবেষণা করতে হবে।

অনেকের মতে রংপুরী ভাষা বোড়ো ভাষা গোত্রের। কথাটি একেবারই যুক্তিহীন নয়। আমরা রংপুরী ভাষায় ক্রিয়ার শেষে যেমন অনুস্বার (ং) বা ম ব্যবহার করে থাকি, তা বোড়ো ভাষারই প্রভাবিত রূপ। তাছাড়া তিস্তা নদীর নামটি এসেছে বেড়ো ভাষার ডি¯ডাং শব্দ থেকে। অনেকে রংপুরী ভাষাকে রাজবংশী ভাষা বলে থাকেন। রাজবংশীদের বিশাল একটি অংশ রংপুরে বাস করে। আর রাজবংশীরা হলো কোচ সম্প্রদায় থেকে বিবর্তিত সম্প্রদায়। কোচরা বেড়ো ভাষায় কথা বলে থাকেন। তাই রংপুরী ভাষা যে বোড়ো ভাষা গোত্রের নয়, তা বলা যাবে না।

এরপর রংপুরে আগমন ঘটেছে আরব, ইউরোপ, চীনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের শাসক, ব্যবসায়ী, ধর্মপ্রচারক ও পর্যটকদের। তাদের ভাষারও প্রভাব রয়েছে এ রংপুরী ভাষায়। কিন্তু আজ থেকে শতবর্ষ আগেও আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে রংপুরী ভাষা যতটা প্রবল ছিল, তা এখন আর পরিলক্ষিত হয় না। বর্তমান সময়ে এ ভাষার ব্যবহার অনেকটাই কমে গেছে। আমরা যত শিক্ষিত হচ্ছি, ততই ভুলে যাচ্ছি আমাদের এই প্রিয় ভাষাকে। অনেক মা বাবাই তাদের সন্তানকে তথাকথিত মুর্খতা থেকে দুরে রাখার জন্য এ ভাষা বলা থেকে বিরত রাখছেন। কিন্তু এ ভাষা বলাতো কোন মুর্খতা নয়। আমাদের এ ভাষার চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের দেশের বিভিন্ন আদিবাসীরা বাড়িতে এবং সমগোত্রের মানুষদের সাথে মাতৃভাষায় কথা বলে থাকেন। আমরাও কি আমাদের বাড়িতে কিংবা আমাদের অঞ্চলের মানুষদের সাথে এ ভাষায় কথা বলতে পারি না? এখন অনেক শিক্ষিত ও শহুরে পরিবারে এ ভাষার চর্চা হয় না। আমাদের রংপুরী ভাষার ওপর ইতিহাসবিদ মতিউর রহমান বসনীয়া ‘রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান ও প্রয়োগরীতি’ নামে একটি অভিধান লিখেছেন। আমরা এ অভিধানটি সংগ্রহে রাখলে খুব সহজেই আমাদের এ ভাষার চর্চা করতে পারব। আসুন আমরা আগামী ভাষা দিবস থেকেই আমরা এ প্রিয় ভাষাকে মৃত ভাষার কাতারে না ফেলে এ ভাষার চর্চা বৃদ্ধি করি।

তথ্যসূত্র :

(ক) রাজবংশী সমাজ ও সংস্কৃতি- ড. অসীত কুমার বিশ্বাস।

(খ) রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান ও প্রয়োগরীতি- মতিউর রহমান বস্নীয়া।

(গ) বিভিন্ন ইন্টারনেট লিংক।

476 Views

মুগ্ধতা.কম

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৭:০১ অপরাহ্ণ

ভাষা, উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা

সূচনা: ভাষা, উপভাষা এবং আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই৷ অনেকে মনে করেন মানুষ মনের ভাব প্রকাশের জন্য যে ইঙ্গিত করে, যে শব্দ উচ্চারণ করে কিংবা শারীরিক ভঙ্গী প্রকাশ করে তাই ভাষা৷ একই ভাষা যারা ব্যবহার করে তাদেরকে বলে একই ভাষাভাষী বা ভাষিক সম্প্রদায় (Language Community)। আমরা যারা বাংলা ভাষায় কথা বলি তারা সকলে বাংলাভাষী সম্প্রদায়ের অন্তর্গত।

সকলের বাংলা আবার এক নয়। ভৌগোলিক ব্যবধান, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সমাজগঠন, ধর্ম, পেশা ইত্যাদি কারণে এক এলাকার ভাষার থেকে অন্য এলাকার ভাষায় পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। ভৌগোলিক ব্যবধান বা অঞ্চল ভেদে ভাষার যে-বৈচিত্র্য তা-ই হলো উপভাষা। এ ভাষাকে আঞ্চলিক ভাষা-ও বলা হয়।

অর্থাৎ অঞ্চলভেদে বাংলা ভাষার প্রচলিত কথ্যরূপকেই আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা বলে।

ভাষা

অর্থবাহী বাকসংকেত যা মনের ভাব প্রকাশ করে ও একই সমাজের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে।

ভাষা ধারণাটির কোন সুনির্দিষ্ট, যৌক্তিক ও অবিতর্কিত সংজ্ঞা দেয়া কঠিন, কেননা যেকোন কিছুর সংজ্ঞা ভাষার মাধ্যমেই দিতে হয়। তাই ভাষার আত্মসংজ্ঞা প্রদান দুরূহ। তবে ভাষার একটি কার্যনির্বাহী সংজ্ঞা হিসেবে বলা যায় যে ভাষা মানুষের মস্তিষ্কজাত একটি মানসিক ক্ষমতা যা অর্থবাহী বাকসংকেতে রূপায়িত (বাগযন্ত্রের মাধ্যমে ধ্বনিভিত্তিক রূপে বা রূপে) হয়ে মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করতে এবং একই সমাজের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করে। মানুষ তার মনের ভাব অন্যের কাছে প্রকাশ করার জন্য কণ্ঠধ্বনি এবং হাত, পা, চোখ ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে ইঙ্গিত করে থাকে। কণ্ঠধ্বনির সাহায্যে মানুষ যত বেশি পরিমাণ মনোভাব প্রকাশ করতে পারে ইঙ্গিতের সাহায্যে ততটা পারে না। আর কণ্ঠধ্বনির সহায়তায় মানুষ মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবও প্রকাশ করতে সমর্থ হয়। কণ্ঠধ্বনি বলতে মুখগহ্বর, কণ্ঠ, নাসিকা ইত্যাদির সাহায্যে উচ্চারিত বোধগম্য ধ্বনি বা ধ্বনি সৃষ্টি হয় বাগ্যন্ত্রের দ্বারা। গলনালি, মুখবিবর, কণ্ঠ, জিহ্বা, তালু, দন্ত, নাসিকা ইত্যাদি বাক্প্রত্যঙ্গকে এক কথায় বলে বাগযন্ত্র। এই বাগযন্ত্রের দ্বারা উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনির সাহায্যে মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যমকে ভাষা বলে। সকল মানুষের ভাষাই বাগযন্ত্রের দ্বারা সৃষ্ট। তবুও একই ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টির অর্থ বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হতে পারে। এ কারণে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর জন্য আলাদা আলাদা ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের কণ্ঠনিঃসৃত বাক্ সংকেতের সংগঠনকে ভাষা বলা হয়। অর্থাৎ বাগযন্ত্রের দ্বারা সৃষ্ট অর্থবোধক ধ্বনির সংকেতের সাহায্যে মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যমই হলো ভাষা। দেশ, কাল ও পরিবেশভেদে ভাষার পার্থক্য ও পরিবর্তন ঘটে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থান করে মানুষ আপন মনোভাব প্রকাশের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বস্তু ও ভাবের জন্য বিভিন্ন ধ্বনির সাহায্যে শব্দের সৃষ্টি করেছে। সেসব শব্দ মূলত নির্দিষ্ট পরিবেশে মানুষের বস্তু ও ভাবের প্রতীক (Symbol) মাত্র। এ জন্যই আমরা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষার ব্যবহার দেখতে পাই। সে ভাষাও আবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়ে এসেছে। ফলে এ শতকে মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে যে ভাষা ব্যবহার করে, হাজার বছর আগেকার মানুষের ভাষা ঠিক এমনটি ছিল না। বর্তমানে পৃথিবীতে সাড়ে তিন হাজারের বেশি ভাষা প্রচলিত আছে। তার মধ্যে বাংলা একটি ভাষা। ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলা পৃথিবীর চতুর্থ বৃহৎ মাতৃভাষা। বাংলাদেশের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলাদেশ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ এবং ত্রিপুরা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের কয়েকটি অঞ্চলের মানুষের ভাষা বাংলা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশে বাংলা ভাষাভাষী জনগণ রয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ত্রিশ কোটি লোকের মুখের ভাষা বাংলা। ভাষা মানুষে-মানুষে যোগাযোগের প্রধানতম বাহন। ভাষার কতটুকু মানুষের কোন জন্মগত বৈশিষ্ট্য আর কতটুকু পরিবেশনির্ভর সে ব্যাপারে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানীদের মতভেদ আছে। তবে সবাই একমত যে স্বাভাবিক মানুষমাত্রেই ভাষা অর্জনের মানসিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়, এবং একবার ভাষার মূলসূত্রগুলি আয়ত্ত করে ফেলার পর বাকী জীবন ধরে মানুষ তার ভাষায় অসংখ্য নতুন নতুন বাক্য সৃষ্টি করতে পারে। এরকম অসীম প্রকাশক্ষমতাসম্পন্ন ভাষা একান্তই একটি মানবিক বৈশিষ্ট্য; মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণি এই ক্ষমতার অধিকারী নয়। প্রতিটি মানুষ ভাষা আয়ত্ত করার সহজাত বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেয় এবং ঐ মানুষটি যে নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পর্যায়ের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিবেশ-বেষ্টিত ভাষিক সমাজের অন্তর্গত, সেই সমাজে সে দৈনন্দিন ভাষাপ্রয়োগের মাধ্যমে তার নিজস্ব ভাষাজ্ঞান বিকশিত করে।

তুমি অন্য কারো ছাতিমফুল

ভাষা মূলত বাগযন্ত্রের মাধ্যমে কথিত বা “বলা” হয়, কিন্তু একে অন্য মাধ্যমে তথা লিখিত মাধ্যমেও প্রকাশ করা সম্ভব। এছাড়া প্রতীকী ভাষার মাধ্যমেও ভাবের আদান-প্রদান হতে পারে। ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো একটি ভাষিক প্রতীক এবং এর দ্বারা নির্দেশিত অর্থের মধ্যকার সম্পর্ক যাদৃচ্ছিক। একই বস্তু বা ধারণা কেন বিভিন্ন ভাষায় ভিন্ন ধরনের ধ্বনিসমষ্টি দ্বারা নির্দেশিত হয় (যেমন – একটি গৃহপালিত চতুষ্পদ প্রাণির নাম বাংলা ভাষায় “গরু”, ইংরেজি ভাষায় “Cow” কাও, ফরাসি ভাষায় “Vache” ভাশ্‌, ইত্যাদি কেন হয়), তার পেছনে একেকটি ভাষার বক্তাসমাজের ভেতর সমঝোতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রীতিনীতি ছাড়া আর কোনো কারণ নেই। মানুষের ভাষার সাথে অন্য প্রাণিদের যোগাযোগের “ভাষার” একটা বড় পার্থক্য হলো ভাষার সাহায্যে মানুষ বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে, যা প্রাণিরা পারে না। যেমন – মৌমাছিদের নাচ কেবল মধু আহরণের সুবিধার জন্যই কাজে লাগে। আর উল্লুক জাতীয় বানরদের ভাষিক দক্ষতা অন্যান্য প্রাণিদের চেয়ে বেশি হলেও বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে সামগ্রিকভাবে তাদের ভাষা একটি দুই বছরের মনুষ্য শিশুর ভাষার চেয়ে উন্নত নয়।

আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা:

উপভাষা  প্রমিত ভাষার (Standard Language) পাশাপাশি প্রচলিত অঞ্চলবিশেষের জনগোষ্ঠী কর্তৃক ব্যবহূত আঞ্চলিক ভাষা। পৃথিবীর সর্বত্রই প্রমিত ভাষার পাশাপাশি এক বা একাধিক আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা (Dialect) ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রমিত ভাষার সঙ্গে উপভাষার ব্যবধান ধ্বনি, রূপমূল, উচ্চারণ ও ব্যাকরণগত কাঠামোর মধ্যে নিহিত থাকে। সাধারণত প্রমিত ভাষায় ভাষাভঙ্গির সংখ্যা বৃদ্ধি, ভৌগোলিক ব্যবধান এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসগত পার্থক্যের কারণে উপভাষার সৃষ্টি হয়। প্রমিত ভাষা দেশের সর্বস্তরে ব্যবহূত হয়; লিখিত পদ্ধতির ক্ষেত্রেও তা অনুসৃত হয়, কিন্তু উপভাষার ব্যবহার কেবল বিশেষ অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যেই সীমিত থাকে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে বিভিন্ন উপভাষার সৃষ্টি হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় স্বতন্ত্র শ্রেণির প্রমিত ভাষা গড়ে উঠলেও ঢাকায় তা হয়নি; এমনকি ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী হওয়ার পরেও নয়।

বাংলাদেশের উপভাষাসমূহকে প্রধানত চার শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যথা: ১. উত্তরবঙ্গীয় দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া ও পাবনায় প্রচলিত উপভাষা; ২. রাজবংশী রংপুরের উপভাষা; ৩. পূর্ববঙ্গীয় (ক) ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা, বরিশাল ও সিলেটের উপভাষা, (খ) ফরিদপুর, যশোর ও খুলনার উপভাষা এবং ৪. দক্ষিণাঞ্চলীয় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও চাকমা উপভাষা। পশ্চিমবঙ্গের উপভাষাগুলি প্রধানত দু শ্রেণিতে বিভক্ত: ১. রাঢ়ী ও ঝাড়খন্ডী (দক্ষিণ-পশ্চিম বর্ধমান ও প্রেসিডেন্সি বিভাগের অধিকাংশ) এবং ২. বরেন্দ্রী ও কামরূপী (গোয়ালপাড়া থেকে পূর্ণিয়া পর্যন্ত)।

বাংলাদেশে উপভাষার বহুল ব্যবহারের জন্য উপভাষাভাষী ও প্রমিত ভাষাভাষীদের মধ্যে বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়।  বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনটি ভাষারীতি সমানভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সাধারণভাবে শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে লেখ্য ও কথ্যরূপে প্রমিত বাংলা, লিখিতরূপে ও পাঠ্যপুস্তকে সাধু/চলিত রীতি এবং বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষাভাষীদের মধ্যে মৌখিক ভাষারূপে উপভাষা ব্যবহূত হয়। প্রমিত বাংলা ব্যবহারকারীরা প্রমিত সাধু/চলিত রীতি ব্যবহার করে থাকে। উপভাষা অঞ্চল থেকে আগত ভাষাভাষীরা বাংলা ভাষার দুটি রূপ ব্যবহার করে। তারা বাড়িতে আঞ্চলিক রূপ এবং সর্বসাধারণের সঙ্গে ও শিক্ষার প্রয়োজনে সাধু/চলিত রীতিতে প্রমিত রূপ ব্যবহার করে। বর্তমানে অবশ্য সাধুরীতির ব্যবহার অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।

প্রমিত বাংলা ভাষা উপভাষায় কেমন রূপ লাভ করে তা একটি উদাহরণের মাধ্যমে বোঝানো যেতে পারে। যেমন ‘ছেলে’ শব্দটিকে বিভিন্ন উপভাষায় যেভাবে উচ্চারণ করা হয় তা হলো এরূপ: পো (মেদিনীপুর), ব্যাটা (মালদহ), বেটা (মানভূম), ছা (সিংহভূম), ছাওয়াল (খুলনা, যশোর), ব্যাটা ছৈল (বগুড়া), পোলা (ঢাকা, ফরিদপুর), পুত (ময়মনসিংহ), পুয়া (সিলেট), পুতো (মণিপুর), পোয়া (চট্টগ্রাম, চাকমা) এবং হুত (নোয়াখালী)।

অনেক সময় একই ভাষারূপ ব্যবহার করা সত্ত্বেও ব্যক্তি-বিশেষের উচ্চারণে স্বাতন্ত্র্যের সৃষ্টি হয়। এ ধরনের স্বাতন্ত্র্য সাধারণত শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা কিংবা পেশাগত কারণে হয়ে থাকে। ব্যক্তি-বিশেষে ভাষার এ রীতি ‘ব্যক্তি-বিশেষের বাক্রীতি’ (Idiolect) হিসেবে পরিচিত। অনেকে উপভাষার সঙ্গে অশিষ্ট ভাষার (Slang) সম্পর্কের উল্লেখ করলেও উভয় ভাষারীতির মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রথমত, উপভাষা বিস্তৃত অর্থে ব্যবহৃত হলেও অশিষ্ট ভাষা শুধু রূপমূলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দ্বিতীয়ত, অশিষ্ট ভাষার জীবনকাল স্বল্পমেয়াদি। তৃতীয়ত, অশিষ্ট ভাষা স্বেচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহৃত হয়, যেমন ‘গ্যাঞ্জাম’। এ ছাড়া সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে নারী-পুরুষের ভাষা, হিন্দু-মুসলমানের ভাষা, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের ভাষা এবং শহর ও গ্রামের ভাষার মধ্যেও পার্থক্য সূচিত হয়। উপভাষার বিশ্লেষণ এবং এর অভিধান ও মানচিত্র প্রণয়নের প্রাথমিক প্রস্ত্ততি হিসেবে উপভাষা জরিপ প্রয়োজনীয়। উপভাষার মানচিত্রে কোনো বিশেষ অঞ্চলের শব্দের উচ্চারণ এবং পার্থক্যসহ ধ্বনির রূপান্তর নির্দেশিত হয়ে থাকে। আঞ্চলিক অভিধানে একটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শব্দের বানান, উচ্চারণ, ব্যুৎপত্তি ও অর্থের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বাংলাদেশের  আঞ্চলিক ভাষার অভিধান ১৯৬৫ সালে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সম্পাদনায়  বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়।

আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষার সংজ্ঞা:

বিভিন্ন অঞ্চলে যে ভাষা প্রচলিত সেই ভাষাকে আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা বলে। যে ভাষা শিশু প্রাকৃতিক নিয়মে শেখে, যার লিখিত কোন ব্যাকরণ নাই, যে ভাষা অঞ্চলভেদে পরিবর্তিত হয় সেই ভাষাই আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা।

প্রায় ত্রিশ মাইল অন্তর এই পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এই পরিবর্তনে উচ্চারণ দোষ বা নানারকম ভুল থাকে। তাই নদীয়া বা পুরুলিয়া, চাটগাঁ ও ময়মনসিংহের ভাষায় যথেষ্ট ভিন্নতা পাওয়া যায়। আবার কুষ্টিয়ার সঙ্গে কোলকাতা, ত্রিপুরার সঙ্গে চট্টগ্রামের, সিলেটের সঙ্গে আসাম সংলগ্ন অঞ্চলের ভাষার ঐক্যও খুঁজে পাওয়া যায়।

বাংলা ভাষায় অসংখ্য উপভাষা রয়েছে। তাদের মধ্যে প্রধানগুলো হলো:

=> রাঢ়ি উপভাষা (উত্তর ও দক্ষিণ),

=> ঝাড়খণ্ডি উপভাষা,

=> বরেন্দ্রি উপভাষা (পশ্চিম),

=> কামরূপি উপভাষা (উত্তর ও পশ্চিম) ইত্যাদি।

একই আচার রীতিনীতি এমনকি একই সংরক্ষিত এলাকার একই গোত্র বা সমাজের মানুষের একই রকমের ছাঁদের প্রচলিত ভাষাই আঞ্চলিক উপভাষা। এটি ভাষার অন্তর্গত এমন একটি বিশেষরূপ যা একটি বিশেষ অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত থাকে এবং যার সঙ্গে সেই আদর্শ ভাষা বা সাহিত্যিক ভাষার ধ্বনির রূপগত পার্থক্য সৃষ্টি করে।

উপভাষা সম্পর্কে সুকুমার সেন বলেছেন, কোনো ভাষা সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছোট ছোট দলে বা অঞ্চলে বিশেষে প্রচলিত ভাষাছাঁদকে উপভাষা বলে।

পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই উপভাষা আছে। উপভাষায় রচিত প্রাচীন মৌখিক সাহিত্যই ‘লোক সাহিত্য’, উপভাষার শব্দাবলির মধ্যে রয়েছে একটি জাতির ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিকর সামাজিক পরিচয়, মূল্য মান ভাষার একান্ত আঞ্চলিক রূপটি আছে উপভাষাতেই, আছে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের প্রাধান্য, বিশেষ অঞ্চলের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ভাষা এবং অকৃত্রিম সারল্য। উপভাষার মধ্যে রয়েছে কোনো ভাষার মূলশক্তি।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ গ্রন্থে বলেছেন—ভাষার জীবন্তরূপ তাহার কথ্য ভাষায়। স্থানভেদে বাঙ্গালার কথ্যরূপ, নানাবিধ যেমন:

অঞ্চল—————————————আঞ্চলিক ভাষার নমুনা

খুলনা, যশোহর————– : অ্যাক জন মানশির দুটো ছাওয়াল ছিল।

মানভূম ——————— : এক লোকের দুটো বেটা ছিল।

রাঁচি (সরাকি) —————: এক লোকের দু বেটারাহে।

সিংহভূমি (ধলভূম)  ——— : এক লোকের দুটা ছা ছিল।

মেদিনীপুর (দক্ষিণ পশ্চিম) — : এক লোক্কর দুট্টা পো থাইল।

পূর্ণিয়া (সিরিপুরিয়া) ——- : এক ঝনের দুই পুআ ছিল।

মালদা   ——————— : য়্যাক ঝোন ম্যান্শের দুটা ব্যাটা আছ্লো।

বগুড়া ———————– : য়্যাক ঝনের দুটা ব্যাটা আছিল।

রংপুর ———————–: এক জন ম্যানশের দুইক্না ব্যাটা আছিল্।

ঢাকা  ————————: একন মানশের দুইডা পোলা আছিল।

ময়মনসিংহ ——————: য়্যাক জনের দুই পুৎ আছিল্।

সিলেহেট ——————– : এক মানুশর দুই পুয়া আছিল্।

কাছাড়————————: এক জন মানুশর দুগুয়া পুয়া আছিল্।

চট্টগ্রাম———————– : এগুয়া মানশের দুয়া পোয়া আছিল্।

নোয়াখালি ——————- : একজনের দুই হুত আছিল।

চট্টগ্রাম (চাকমা) ———— : এক জন তুন দিবা পোয়া এল্।

মণিপুর (মায়াং) ————-: মুনি আগোর পুতো দুগো আসিল্।

রংপুরী ভাষা:

প্রাচীন কামতাপুর অঞ্চলের কোচ-রাজবংশী জনগোষ্ঠীর ভাষা

রংপুরী (ভারত ও নেপাল এ কামতাপুরী বা রাজবংশী ) একটি ইন্দো-আর্য পরিবারভুক্ত বাংলার উপভাষা ভাষা। এ ভাষায় বাংলাদেশের রাজবংশী সম্প্রদায়, ভারত এবং নেপাল এর রাজবংশী, তাজপুরিয়া, নস্যশেখ, নাথ-যোগী, খেন সম্প্রদায়ের লোকেরা কথা বলে। বাংলা ভাষার প্রমিত রীতির ভিত্তি নদীয়া তথা পশ্চিমাঞ্চলীয় আঞ্চলিক বাংলা হওয়ায়, বাংলা ভাষার মূল রীতির সাথে এর যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। তবে এই ভাষাভাষী জনগণ কার্যত দ্বিভাষী। তারা রাজবংশী ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষা অথবা অসমীয়া ভাষায় কথা বলে।

কামতাপুরী:

কামতাপুরী/রাজবংশী /গোয়ালপাড়ীয়া (ভারত)

রংপুরী (বাংলাদেশ)

রাজবংশী (নেপাল)

রংপুরি ভাষার একাধিক কথ্য রূপ প্রচলিত। একে পূর্ব, মধ্য, পশ্চিম এবং পাহাড়ী (কোচ) এই চার ভাগে ভাগ করা যায়। এই ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্য রাজবংশী ভাষায় অধিকাংশ লোকে কথা বলে। ভাষা মোটামুটি একই রকম এবং এই ভাষায় কিছু প্রকাশনা আছে। পশ্চিমা কথ্যরূপে এলাকাভেদে পরিবর্তিত হয়। তিন কথ্যরূপের মধ্যে ৭৭-৮৯% মিল পাওয়া যায়। রাজবংশী ভাষা ৪৮-৫৫ ভাগ বাংলা, ৪৩-৪৯ ভাগ মৈথিলি এবং নেপালি শব্দ দ্বারা গঠিত।

ভাষা ও সংস্কৃতি:

রংপুরের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সাহিত্যকর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি সুপ্রাচীন ও বিভাসিত। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন এই রংপুর। বলা যায় প্রকৃতির রহস্যময়তায় নান্দনিক সৌন্দর্যে প্রকৃতির আদরণীয় হিল্লোলে ও প্রাণময়তায় ভরপুর রংপুর। অর্থাৎ ‘‘রঙ্গঁরসে ভরপুরএই রঙ্গপুর’’। (রংপুর জেলার আঞ্চলিক ভাষার উদাহরণ)এই রঙ্গরস শিক্ষা-সাহিত্য, সঙ্গীত, সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্য বিশেষ করে লোকসংস্কৃতি মিলিয়ে অনবদ্য। রঙ্গঁপুরের পরিবর্তিত রূপ রংপুর।বাংলাদেশের প্রাচীনতম অংশের নাম বরেন্দ্র বা রারেন্দ্রী। রংপুর (রঙ্গপুর) সমতল বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্তর্গত। পরবর্তী সময়ে যে অঞ্চল গৌড় অঞ্চল বলে পরিচিতি লাভ করে।প্রাচীন ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলে দেখা যায়, রংপুর (রঙ্গপুর) এর ভূমি সম্প্রসারিত ছিল গৌহাটি কেন্দ্রিক রাজ্য প্রাগজ্যোতিষপুরের অন্তর্গত।রংপুরের রঙ্গপুর নামটির নামকরণ এখনও চূড়ান্তভাবে বিতর্করহিত হয়নি। কেউ কেউ মনে করেন মহাভারতের সময়ে প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা ভগদত্তের রংমহলো ছিল রংপুরের এবং সেই রংমহলো হতে নাম হয়েছে রঙ্গপুর। কারো কারো মতে ভগদত্তের কন্যা পায়রাবতীর নামানুসারে নারীজাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্মভুমি পায়রাবন্দের নামকরণ হয়েছে।কেউ কেউ মনে করেন রংপুরের বস্ত্ররঞ্জনী কারখানা (Dying Industry) ছিল। পাট নির্মিত বস্ত্রে বা চটে রং করা হতো বলে রংপুরকে রংরেজপুর বলা হতো এবং তার পরিবর্তনে হয়েছে রঙ্গপুর (রংপুর)। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন রংপুরের নামকরণের ক্ষেত্রে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজীর অবদান গ্রহণযোগ্য। রঙ্গপুর শব্দটির ফার্সী শব্দ আর তাই সঙ্গত কারণে বখতিয়ার শাসন আমলে রংপুরের নাম রঙ্গপুর হয়েছে।রংপুর কালেক্টর ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে তা পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। ১৭৯৩ খ্রিঃ রংপুর কালেক্টর হতে বিচার বিভাগ আলাদা হলে একজন বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়।তিস্তা, ধরলা, যমুনেশ্বরী, ঘাঘট, আখিরা, বিধৌত রংপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং প্রাচীনত্ব ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ভাষাঃ মানুষের আবেগ, অনুভূতি, অভিব্যক্তি, চিন্তা, চেতনা সবকিছু প্রকাশের বাহন। তাইতো বলা হয়েছে ‘‘মানুষের কণ্ঠোচ্চারিত অর্থযুক্ত ধ্বনি সমস্টিই ভাষা’’। আর এ ভাষা পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদের ভিন্ন ভিন্ন। যেমন বাঙালি জাতির ভাষা বাংলা। এই বাংলা ভাষা ভারতীয় কথ্য ভাষার প্রাচীন প্রাকৃত (খৃ.পূ.৫০০) হতে গৌড়ীয় প্রাকৃতের মধ্য দিয়ে বাংলার জন্ম হয়েছে।বাংলা ভাষার যেমন আছে পরিশীলিত রূপ তেমনি অঞ্চল ভিত্তিক গ্রামীণ জনপদে প্রচলিত রয়েছে আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা।ভৌগোলিক কারণে হোক বা শারীরিক গঠনের জন্য হোক রংপুরের শিক্ষিতজনেরা বাংলাদেশের অনেক জেলার অপেক্ষা পরিশীলিত ভাষায় কথা বলতে পারেন। তাদের উচ্চারণে কোন বিকৃতি নেই, নেই অস্পষ্টতা। তারা অনায়াসে আঞ্চলিকতা সম্পন্ন ভাষা বা উচ্চারণ পরিহার করতে পারেন।ম্যাকসমূলার বলেছেন ‘‘The real and natural life of language is in its dialects’’. ভাষার প্রকৃত ও স্বাভাবিক জীবন তার উপভাষাগুলিতে। উল্লেখ্য বাংলাভাষাও তার ব্যতিক্রম নয়। রংপুরেও পরিশীলিত ও মার্জিত ভাষার সমান্তরাল রংপুরের প্রামাঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে।আঞ্চলিক ভাষা, যখন এ গ্রামাঞ্চলের জনপদে উদ্ভব হয়েছে নিঃসন্দেহে সে সময় হতে গ্রামীণ জনপদ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে আসছে। এ ভাষার উচ্চারণগত সহজবোধ্যতা, সাবলীলতা ও শ্রুতিমাধুর্য অসামান্য। আর এ আঞ্চলিক ভাষায় রচিত হয়েছে সাহিত্য-সঙ্গীত, প্রবাদ-প্রবচন, ছড়া, গীত ইত্যাদি যা মানুষের আনন্দের উপকরণ। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত সমৃদ্ধ সাহিত্যকর্মের মাত্র কটির নাম করা হলো, ষোড়শ শতকের কবি মুহম্মদ কালার নেজাম পাগলার কেচ্ছা , অষ্টাদশ শতকের কবি হেয়াত মামুদের রচনায় রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার অনেক শব্দ রয়েছে । বেগম রোকেয়ার রচনায় রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার শব্দাবলিও আছে । পরবর্তী সময়ে নাট্যকার তুলসী লাহিড়ীর ছেঁড়াতার, সৈয়দ শামসুল হক এর নুরলদীনের সারাজীবন, নূরুল ইসলাম কাব্যবিনোদেরহামার অমপুর, আবুলকাশেমের হামার দ্যাশ হারাগাছ, সিরাজুল ইসলাম সিরাজের মরা মানুষের মিছিল,আনিসুল হক এর নাল পিরান, মকসুদুল হক এর শঙ্খামারীর ঘাট, সাখাওয়াত হোসেনের বাহে নিধূয়া পাথার, নাসিমুজ্জমান পান্নার নাকফুল এবং মতিউর রহমান বসনীয়া রংপুরের ভাষার অভিধান ও অনেক কবিতা লিখেছেন এ ভাষায় ।

তাছাড়াও অনেকে রংপুরের ভাষা ব্যবহার করেছেন রচনায় এবং মুহম্মদ আলীম উদ্দীন তাঁর ‘রংপুর সংবর্তিকা’ গ্রন্থে রংপুরের ভাষা শিরোনামে প্রবন্ধ রচনা করেছেন । রংপুরের ভাষা উদীচ্য বা বরেন্দ্র উপভাষার গোত্রভূক্ত । এ ভাষার বৈশিষ্ট্য: ১)আনুনাসিক বর্ণ রক্ষিত,২)শ্বাসাঘাতের নির্দিষ্ট সহান নেই ৩)শব্দের আদিকে ‘র’ এর আগয় লোপ,যথা: রস= অস, রামবাবু= আমবাবু, রংপুর= অমপুর, রক্ত = অক্ত, ‘‘আমবাবুর রামবাগানে অনেক রাম পেকেছে’’। ৪) অধিকরণ কারকে ‘ত’ বিভক্তির প্রয়োগ। ‘‘বাবা বাড়িত নাই’’। ৫) অপিনিহিতর ব্যবহার: অদ্য> অহিজ, কাল্য>কাইল ৬) শব্দের মধ্যবর্তী ব্যঞ্জনবর্ণ লোপ: কহিল>কইল, ৭) ‘ছ’ এর ব্যবহার ‘চ’ রূপে: মাছ>মাচ ৮) শব্দের মধ্যবর্তী সহানে অতিরিক্ত স্বরবর্ণের ব্যবহার, যাকে মধ্যস্বরাগম বলা যায়, যেমন: গেলে>গেইলে, বোন>বইন ৯) ‘ল’ এর সহলে ‘ন’ এর আগম: লাট>নাট, লাগে>নাগে।

রংপুরের সাহিত্যকর্ম: অনেক বাংলা সাহিত্যের গবেষক ও ঐতিহাসিক বলেছেন যে বাংলা সাহিত্যের আদিনীড় রংপুর । রংপুরের ভাষার যেমন প্রাচীনত্ব আছে তেমনি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনত্বে্র রংপুরের অংশীদারিত্ব আছে । বাংলা ভাষা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ অর্থাৎ প্রাচীন বাংলায় রচিত ৫১টি পদ অখন্ডিত ৪৭ পদই বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন, রচয়িতা ২৪ জন কবি । ড. মুহষমদ শহীদুল্লাহর মতে যা রচিত হয়েছে ৭ম শতাব্দী হতে ১০ শতাব্দীর মধ্যে । আর এই পাণ্ডুলিপিটি ১৯০৭ সালে আবিস্কৃত হয়েছে নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থাগার হতে । আবিস্কারক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ।অনেকে মনে করেন চর্যাপদের কবিদের অনেকের পদচারনা হয়তো ঘটেছিল রংপুরে । ফলে চর্যাপদের ভাষা অনেক রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার শব্দও বিশেষত দেখতে পাওয়া যায় যেমন. টালত মোর ঘর/নাহি পরবেসী/ হাড়িত ভাত নাই নিতি আবেসী‘ তে’ বিভক্তির স্থলে ‘ত’ বিভক্তির প্রয়োগ রংপুরের ভাষার বৈশিষ্ট্য। তেমনি নঞক অব্যয়ের ব্যবহার ব্যবহার ক্রিয়াপদের আগে, যেমন, গাছের তেস্তুল কুম্ভীরে নক্ষত্র, রংপুরের উদাহরণ। না যাও, না খাও। শব্দ মোর, তোর, সুতি, পোহাই, ঘিন, খাল, ইত্যাদি শব্দ রংপুরেও ব্যবহৃত হয়। রংপুর হতে স্যার জর্জ গ্রীয়ার্সন আবিষ্কার করেছেন নাথ গীতিকা, মধ্যযুগের অনেক বিশিষ্ট কবি কাব্য রচনা করেছেন রংপুরে। তাঁরা হলেন কমললোচন, হরিশচন্দ্র বসু, হেয়াত মামুদ, শাকের খাদম, মুহম্মদ কালা, দ্বিজহরি, ধুরহানুল্লাহ, শরিয়তুল্লাহ।আধুনিক যুগের অনেক কবি সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন আর তারা হলেন, পন্ডিত যাদবেশ্বর, তর্করত্ন, জামাল উদ্দিন, রামনারায়ণ তর্করত্ন যিনি বাংলা মৌলিক নাটক ‘কুলিনকুল সর্বস্ব’ রচনা করেন এবং কুন্ডির জমিদার প্রদত্ত ৫০/- টাকা পুরস্কার লাভ করেন। হরগোপাল রায়, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া, অতুল গুপ্ত, অতুল প্রসাদ সেন, শেখ ফজলুল করিম, খেরাজ আলী, রবীন্দ্র নাথ মৈত্র, তুলসী লাহিড়ী, নুরুল ইসলাম কাব্য বিনোদ, সৈয়দ শামসুল হক, আশুতোষ দত্ত, মোতাহার হোসেন সুফী, মতিউর রহমান বসনীয়া, মহফিল হক, মোনাজাত উদ্দীন, মুহম্মদ আলীম উদ্দীন, মঞ্জু সরকার, আনিসুল হক, আব্দুল হাই সিকদার, সৈকত আসগার সহ আরো অনেক সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে অবদান রেখেছেন এবং এখনও অনেকে সাহিত্যকর্মে সচল আছেন।

লোক সাহিত্য ও সংস্কৃতি: (রংপুর জেলার আঞ্চলিক ভাষার উদাহরণ) লোক সাহিত্য ও লোক সংস্কৃতিতে রংপুরের অবদান অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আর এসব কর্মকান্ড সম্পাদিত হয়েছে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায়। আঞ্চলিকতার দিক দিয়ে ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালীর বিপরীত প্রান্তের লোকসঙ্গীত। ভাওয়াইয়া রংপুরের লোকসঙ্গীত ধারায় সর্বাপেক্ষা উজ্জবল ও সমৃদ্ধ শাখা। ভাওয়াইয়া সম্রাট আববাস উদ্দীন ১৯৫৪ সালে ভাওয়াইয়াকে বিশ্বদরবারে উপস্থাপিত করেন। ভাওয়াইয়া লোকসঙ্গীতের ধারায় এই অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদের বিভিন্ন পেশার মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-ভালোবাসা, বিরহ-বেদনাকে আশ্রয় করে লোকের মুখে মুখে রচিত এবং বিপুল আবেদনময় সুরে বাঁশি ও দোতরার মতো বাদ্যযন্ত্র যোগে গীত হয়ে আসছে।আঞ্চলিক নামানুসারে ভাওয়াইয়া ৫টি ধারায় বিভক্ত, ‘ভাব’ ‘ভাওয়া’, ‘বাওয়া’, ‘বাউদিয়া’ প্রভৃতি শব্দ হতে ভাওয়াইয়া শব্দের উৎপত্তি বলে গবেষকরা মতামত ব্যক্ত করেছেন। উল্লেখ্যযোগ্য জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া-১.ওকি গাড়িয়াল ভাই ২.কি ও কাজল ভোমরা ৩. তোরসা নদীর ধারে ধারে ৪. নাইওর ছাড়িয়া যেও মোর বন্ধু ৫. নদী না যাই ওরে বৈদ ৬.ফাঁন্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে।

রংপুরের মেয়েলী গীত/বিয়ের গীত: রংপুরের লোক সংস্কৃতি ও সঙ্গীতের ধারায় মেয়েলী গীত- বিয়ের গীত একটি উল্লেখযোগ্য । রংপুরের মেয়েলী গীত মেয়েলী আচার অনুষ্ঠানের অনেক বিষয় নিয়ে রচিত ও গীত। যেমন বিয়ে, সাধভক্ষন, অন্নপ্রাসন, নবজাতকের ক্ষৌ্র কাজসহ বিয়ের বিভিন্ন পর্বকে ঘিরে এই গীতগুলো রচিত এবং নৃত্যযোগে আনন্দমুখরতার মধ্যদিয়ে গীত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।রংপুরের লোক সঙ্গীতের ধারায় আরো আছে হুদমার গান, জগেরগান, যোগীর গান, গোয়ালীর গান, ক্ষ্যাপাগান, জারীগান, মালশা গান, পালাগান, বা কাহিনীগান লোকসঙ্গীত রংপুরের উল্লেখযোগ্য সঙ্গীত ধারা। এ ধারায় রয়েছে অসংখ্য পালাগান। যেমন, নসিমন সুন্দরীর পালা, গুনাইবিবি, অমমূলা কন্যা, নেকোবিবি, কলিরাজা, চিনুবিনু, আরো অনেক।রংপুরের লোকসঙ্গীতের ধারায় আছে, রংপুরের ভাষায় ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন, ধাঁধা (শিল্কা) এই সঙ্গে আছে লোক বিশ্বাস রংপুরের কারু শিল্প-চারুশিল্প প্রশংসিত অবস্থায় ছিল, আর এগুলো হলো: শতরঞ্চি, পাটশিল্প, রেশম, তাঁত, মৃতশিল্প, নকশীকাথা, বাঁশশিল্প, কাঠশিল্প, কাসা-পিতল, লোহা শিল্প, ঢেঁকি শিল্প ইত্যাদি।

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার একটি উদাহরণ – আমি ঢাকা যেতে চাই- ‘মুই ঢাকাত গেনু হয়’

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্য:

১) অনুনাসিক বর্ণ রক্ষিত

২ ) শ্বাসাঘাতের নির্দিষ্ট সহান নেই

৩) শব্দের আদিতে ‘র’ এর আগম ও লোপ, যথা: রস – অস, রাম বাবু – আম বাবু, রংপুর – অমপুর, রক্ত – অক্ত। ‘‘আম বাবুর বাগানোত ম্যালা রাম পাকছে।’’

৪) অধিকরণ কারকে ‘ত’ বিভক্তির প্রয়োগ। ‘‘বাবা বাড়িত নাই’’।

৫) অপিনিহিতর ব্যবহার: অদ্য > আইজ , কল্য > কাইল

৬) শব্দের মধ্যবর্তী ব্যঞ্জনবর্ণ লোপ : কহিল > কইল

৭) ‘ছ’ এর ব্যবহার ‘চ’ রূপে : মাছ > মাচ

৮) ‘জ’ এর স্থলে ‘ঝ’ এর ব্যবহার

৯) শব্দের মধ্যবর্তী স্থানে অতিরিক্ত স্বরবর্ণের ব্যবহার, যেমন : গেলে > গেইলে, বোন > বইন,

১০) ‘ল’ এর স্থলে ‘ন’ এর উচ্চারণ হয়। যেমন : লাট > নাট, লাগে > নাগে

১১) অপাদান কারকে ‘‘হাতে’’, ‘‘টে’’ বিভক্তির প্রয়োগ। ‘‘বইখান কারটে আনলু’’।

রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার কতিপয় শব্দ :

অকে, অমপুর, অক্ত, আঙা, আন্দন, উদিনকা, আইগন্যা, ক্যাংকা, ফ্যাদলা, এইংকা, উন্দাও, বাইগোন, বাহে, সুন্দরী, তাংকু, দলান, ঢ্যানা, বাড়ুন, গাবরু, কাপাট, কইনা, এইকনা, ছাওয়া ইত্যাদি ।

উপসংহার: ভাষা হলো প্রাতিষ্ঠানিক/দাপ্তরিক/নাগরিক সমাজ অথবা বলা যেতে পারে একটি বৃহৎ ভৌগলিক জনগোষ্ঠীকে পারষ্পরিক মিঁথস্ক্রিয়া সম্পাদনের জন্য যে প্রক্রিয়ায় নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করে তাকেই বোঝায়৷ আমরা যাকে প্রমিত ভাষা বলি৷ আঞ্চলিক ভাষার অপর নাম উপভাষা। আমাদের প্রতিটি জেলার ভাষাই বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং নিজস্ব উপভাষা রয়েছে। উপভাষায় কথা বলা মোটেও দোষের নয়। উপভাষা হলো মায়ের মতো। মাকে আমরা শ্রদ্ধা করি, নিজ-নিজ উপভাষাকে আমাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে হবে। আমরাও চেষ্টা করব রংপুরের আঞ্চলিক ভাষাকে সম্মান করতে৷

তথ্যসূত্র:

* উইকিপিডিয়া৷

* বাংলাপিডিয়া৷

* আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ৷

* ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ গ্রন্থ৷

* www.myacademybd.com

* ফেসবুক পোস্ট৷

* বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, রংপুর জেলা৷

* রংপুর জেলার ইতিহাস – জেলা প্রশাসন (২০০০ সাল)৷

* রংপুর সংবর্তিকা – মুহাম্মদ আলিম উদ্দিন৷

* সুরেন্দ্র চন্দ্র রায় চৌধুরী (জীবনীগন্থ) – সুশান্ত চন্দ্র খাঁ৷

* রঙ্গপুর-রংপুর, ইতিহাস থেকে ইতিহাসে – মোস্তফা তোফায়েল।

* রিয়াদ শুভ৷

* My syllabus notes.

* এনসিটিবি,৬ষ্ঠ শ্রেণি, বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি, ১ম অধ্যায়-ভাষা ও বাংলা ভাষা

1413 Views