শনিবারের চিঠি Archives - মুগ্ধতা.কম

শনিবারের চিঠি Archives - মুগ্ধতা.কম

মুগ্ধতা.কম

১১ মার্চ, ২০২৩ , ১০:১৩ অপরাহ্ণ

বিধবা বিবাহের এক লুপ্ত ইতিহাস পুনরুদ্ধার

আমার বাবা সেই ব্রিটিশ আমলে বিদ্যাসাগর এর অনুপ্রেরণায় আমাদের এলাকায় বিধবা বিবাহ চালু করেছিলেন। বাবা এক এক করে মোট চারটি বিধবা বিবাহ দিয়েছিলেন মর্মে ছোটবেলায় জেনেছিলাম কিন্তু তিনটি বিধবা বিবাহের তথ্য সংগ্রহ করতে পারলেও আর একটি বিধবা বিবাহের তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি। সেই চতুর্থ বিধবা বিবাহের তথ্যটি পেলাম আজকে আমার পারিবারিক দুর্গাপূজায় দায়িত্ব পালনকারী দেউরির কাছ থেকে।

দেউড়ি হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি পুজোর সমস্ত রকম সরঞ্জাম বা উপাচার সাজিয়ে নিয়ে পুজোর সময় পুরোহিতের কাছে উপস্থাপন করেন। তার বাড়ি বড়বাড়ির দিকে। আজ বিভিন্ন রকম আলো আলাপ-আলোচনার সময়ে তিনি কথায় কথায় বাবার সেই আমলে দেয়া আর একটি বিধবা বিবাহের খবর দিলেন।

এই লালমনিরহাট জেলারই মহেন্দ্রনগর ইউনিয়নের নওদাবাস মৌজার ডারারপার গ্রামের তৎকালীন নিবাসী ঢেপড়া চন্দ্র নামে এক ব্যক্তির বিধবা বিবাহ দিয়েছিলেন বাবা। বিধবা বিবাহকারি এই পাত্র ঢেপড়া চন্দ্রের পিতার নাম ছিল আন্ধারু চন্দ্র। বিধবা পাত্রির নাম ছিল পন্তেবালা। বিধবা হওয়ায় বিধবা-বিবাহের পরেও সেই নববধূকে বরের গ্রামের সবাই ডাকতেন পন্তে আড়ি বলে। রংপুরিয়া ভাষায় ‘আড়ি’ শব্দের অর্থ হলো বিধবা, যার শুদ্ধ ভাষা রাঢ়ী।

এই বিধবা দম্পতির সন্তানের নাম ছিল ‘বাঘ-ধরা’। যুবা বয়সে তাকে বাঘে ধরে বলেই তার নাম হয়ে যায় ‘বাঘধরা’। বাঘে ধরার পরে তার আসল নাম হারিয়ে যায় এবং এলাকায় সে পরিচিত হয়ে যায় বা ধরা নামে। কত যুগ আগের কথা। দ্বিতীয় প্রজন্মের সেই লোকটি কবেই হারিয়ে গেছেন, তার সময়েই তার প্রকৃত নামটিও হারিয়ে গিয়ে তার নাম হয়েছিল বাঘ ধরা, কিন্তু প্রকৃত নাম হারিয়ে গিয়ে এলাকায় বাঘ ধরা নামে পরিচিত এই লোকটির নাম এবং তাকে বাঘে ধরার ইতিহাস এখন এলাকার বয়স্কদের স্মৃতিতে বেঁচে আছে এবং এখনও বয়স্ক দের মুখে মুখে মুখে ফেরে তার নাম এবং সেই কাহিনি।

 হিমালয় সংলগ্ন এই এলাকায় আগে- সেই ব্রিটিশ আমলে বাঘের অত্যাচার এবং উৎপাত ছিল। এলাকায় একটা স্থানের নাম আছে খেদাবাঘ, স্থানীয় উচ্চারণে যা খেদাবাগ নামে পরিচিত। শীতকালে এলাকায় বাঘের আবির্ভাব হলে লোকজন সংগঠিত হয়ে সেই বাঘকে  তাড়িয়ে দিত আর সেই বাঘ ধরলা নদীর অববাহিকার একটি জঙ্গলপূর্ণ এলাকায় আশ্রয় নিত। তাড়িয়ে দেয়া সেই বাঘ জনমানবহীন ওই জায়গার জঙ্গলে আশ্রয় নিত বলে ওই এলাকার নাম ছিল খেদাবাগ। 

ব্রিটিশ আমলের সেইসব দিনগুলোতে জনগণকে বাঘের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য বন্দুক দিয়ে বাঘ মেরে বেড়াতেন কোলাঘাটের এক গোঁসাই, যার নাম এখনো তিন পুরুষ ধরে এলাকায় পরিচিত ‘বাঘমারা-গোসাই’ নামে। ওই সময়ে একদিন এলাকায় বাঘের আবির্ভাব হলে সেই বাঘমারা গোঁসাইকে খবর দেয়া হয়। বাঘমারা গোসাই বন্দুক নিয়ে বাঘ মারার  উদ্দেশ্যে এলাকায় এসে সেই বাঘকে আর খুঁজে পান না। বাঘ খুঁজে না পাওয়ায় তিনি ভাবলেন যে তাকে মিথ্যা সংবাদ দিয়ে আনা হয়েছে। মিথ্যা সংবাদ দিয়ে তাকে ডেকে আনার জন্য তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং  যে তাকে সংবাদ দিয়ে ডেকে নিয়ে এসেছে- তাকে গুলি করে মারার জন্য খুঁজতে থাকেন। 

প্রকৃতপক্ষে বাঘ আবির্ভাবের সংবাদটি মিথ্যা ছিল না। বাঘটি লোকজনের ধাওয়া খেয়ে একটি জঙ্গলপূর্ণ বড় খালে লুকিয়ে পড়েছিল। সেই খালের উপর পাশের বাঁশঝাড় থেকে একটি বাঁশ হেলে পড়েছিল। বাঘ খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে সেই বিধবা দম্পতির সেই সন্তান সেই বাঁশ ধরে ধরে ওই জঙ্গলময় খালে বাঘ খুঁজতে নেমে যায় আর তখনই আচমকা বাঘটি তাকে আক্রমণ করে তার হাতের কনুইয়ের উপর কামড় দিয়ে ধরে। এরপর বাঘমারা গোঁসাই গুলি করে বাঘটি হত্যা করে যুবককে রক্ষা করেন। 

সেইদিন যুবকটিকে বাঘে ধরার এই ঘটনাটি এলাকায় তোলপাড় তোলে এবং কাহিনিটি এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এরপরেই সেই বাঘে ধরা যুবকটি এলাকায় ‘বাঘ-ধরা ছেলে’ নামে পরিচিতি পেতে থাকে এবং একসময় তার পিতৃপ্রদত্ত আসল নাম হারিয়ে গিয়ে  ‘বাঘ-ধরা’ নামটি স্থায়ী হয়ে যায়। প্রায় তিন প্রজন্ম আগে ঘটে যাওয়া সেই কাহিনি এলাকার বর্তমান প্রজন্ম এখনো মনে রেখেছে।

কত যুগ আগে ঘটে যাওয়া সেদিনের সেই কাহিনি এবং সেই লোকটি হারিয়ে গেলেও এখনো এই প্রজন্মের মানুষ তাকে ‘বাঘধরা’ হিসেবেই মনে রেখেছে এবং তাকে বাঘে ধরার সেই কাহিনি এখনো এলাকায় কিংবদন্তী হয়ে আছে।

বিধবা-বিবাহকারী দম্পতি ঢ্যাপড়া-চন্দ্র এবং পন্তে আড়ির একমাত্র সন্তান সেই :বাঘধরা’র বংশে এখন আর কেউ নেই। সেই বিধবা-বিবাহকারী  ঢ্যাপড়া-চন্দ্র, সেই বিধবা পন্তে আড়ি এবং তাদের একমাত্র সন্তান ‘বাঘধরা’ পৃথিবী থেকে অনেক আগে বিদায় নিলেও এবং তাদের কোন বংশধর না থাকলেও এখনো বয়স্কদের মুখে তাদের বিধবা বিবাহের কাহিনি, তার সন্তানকে বাঘে আক্রমন করার লোমহর্ষক কাহিনী এবং বাঘে আক্রমণ করার পরে বাপদাদার দেয়া নাম হারানো সেই ‘বাঘধরা’ লোকটির কাহিনি এখনো সেই এলাকায় জনশ্রুতি হয়ে আছে।

আজ আলাপে আলাপে ওই এলাকার বয়স্ক দেউড়ির কাছে তথ্যগুলি পেলাম। এ পর্যন্ত আমি খোঁজখবর নিয়ে তিনটি বিধবা বিবাহের তথ্য এবং বিবাহকারীদের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করতে পেলেও বাকি একটির নাম ঠিকানা তো দূরের কথা, এ সম্পর্কিত কোন রকম তথ্যই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সৌভাগ্যক্রমে আজ বাবার উদ্যোগে দেয়া সেই চতুর্থ বিধবা বিবাহের তথ্যটি তাদের নাম-ঠিকানাসহ পেলাম।

ফলে বাবার দেওয়া চারটি বিধবা বিবাহের শোনা তথ্যের মধ্যে এতদিন তিনটি পেলেও অন্যটির তথ্য না পাবার মানসিক যাতনা থেকে আজ মুক্তি পেলাম।

উল্লেখ্য যে, সম্ভবত বাবার দেওয়া এইসব বিধবাবিবাহই পূর্ববঙ্গের ইতিহাসে প্রথম এবং শেষ বিধবাবিবাহ। কারণ পূর্ববঙ্গে বিধবাবিবাহের আর কোনো তথ্য নেই।

**

মুকুল রায়

কবি ও কথাসাহিত্যিক 

মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

বিধবা বিবাহের এক লুপ্ত ইতিহাস পুনরুদ্ধার - মুকুল রায়
7 Views

মজনুর রহমান

১১ মার্চ, ২০২৩ , ১০:১২ অপরাহ্ণ

নদীর জল দেখে 

ভোরবেলা শান্তি লিখতে চেয়েছিলাম 

কখন যেন রোদ উঠে গেল, এমন কড়া রোদ,

শান্ত নদীর জল বিরক্ত হতে শুরু করেছে, 

জাবর কাটতে থাকা গরুর গা চিড়বিড় করছে

বিরসমুখে মাছি তাড়াতে গিয়ে নিজেকে পেটাচ্ছে

গরুর মালিক রাগী মুখে গরুর লেজ ধরে টানছে 

ছোট্ট মেয়েটি মালিককে ডেকে ডেকে ত্যক্ত করছে

মেয়েটির জামা ধরে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে তার মা

মায়ের ভেতরেও চুলা জ্বলছে, কখন হবে ভাত?

এইসব দৃশ্য দেখে নদী গা ছেড়ে দিলো ভাটিতে

যাবার সময় দুয়েকটা জানালার দিকে দৃষ্টি দিয়ে-

একটা জানালার পাশে বসে আছি একটা আমি

ক্লান্ত নদীর দিকে তাকিয়ে শান্তি লিখতে ইচ্ছে করে না।

এর বদলে কী লেখা যায় ভাবছি,

তখন দুপুর এসে উঁকি দেয় বাতাবিলেবুর গাছে

পুকুরের পাশে সুপারির ছায়ায় কিছু হাঁস শুয়ে আছে

হাঁসের দিকে তাকিয়ে মা ভাবছে কে কটা ডিম দেবে,

আব্বা এসে ডিমের টাকা আগাম চেয়ে নিয়ে গেল,

টাকা ফুরিয়ে যাবার ব্যথাসহ গরুর গায়ে হাত বোলাচ্ছে মা-

এই গরু এখন দুপুরবেলা গম্ভীর মুখে ঘাস চিবাচ্ছে 

যাকে দেখে বিরক্ত হয়েছিল শান্ত নদীর জল,

নদীর জল দেখে এখন কেবল দুঃখ লিখতে ভালো লাগে। 

মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

নদীর জল দেখে
10 Views

মুগ্ধতা.কম

১১ মার্চ, ২০২৩ , ১০:০৩ অপরাহ্ণ

মাসুম মোরশেদ

১১ মার্চ, ২০২৩ , ৯:৫৩ অপরাহ্ণ

আসুন বদলে যাই

১.

আমরা তো বিসমিল্লাহ বলে কাজ শুরু করি।
তার সব কি বৈধ?
সব কি হালাল?
হারাম কাজ বিসমিল্লাহ বলে শুরু করলে হালাল হবে কি?
বিসমিল্লাহ বলে
ধুমপান
মদ্যপান
তাসখেলাসহ যেকোন জুয়াখেলা,
মানুষের ঘরে আগুন দেয়া, সংসার ভেঙ্গে দেয়া, ব্যবসা-বানিজ্যের ক্ষতি করা, কোন কিছু ধ্বংস করে দেয়া, হাত-পায়ের রগকেটে দেয়া, খুন করা, সর্বোপরি দেশের ক্ষতি করা এসব কোন কাজই নিশ্চয় বৈধতা পায় না।

২.

দেখবেন যাদের জোর আছে। যেমন মামা-চাচার জোর, খুঁটির জোর, নেতার জোর, পুলিশের জোর, টাকা-পয়সার জোর কিংবা গোষ্ঠিজ্ঞাতির জোর তারা কেউ কেউ পা পাড়িয়ে-মাড়িয়ে ঝগড়া করি।
মারামারি করি।

ছোটবড় বুঝি না, মানি না। সম্মান-অসম্মান বুঝি না। অন্যের সামনে হাত-পা ছোড়াছুড়িটা ঠিক মনে করি।
এসব কি খুব ভাল কাজ? মানুষ কি আপনার সেসব কাজের প্রশংসা করে?

৩.

কেউ কেউ প্রচুর মিথ্যে কথা বলি।
আবার কথায় কথায় কসম কাটি।
দরকারে বা অদরকারে বলি। আনন্দে বা নিরানন্দে বলি৷ যেন কোন ব্যাপার না মিথ্যা বলা।
কোন বিকার নেই। পাপবোধ নেই। খারাপ লাগা নেই।
খুব সহজে, অনায়াসে মিথ্যা বলি।
কখনও নিজের লাভের জন্য বলি। কখনও অন্যের মন যোগাতে বলি।
আবার বাঁচতে গিয়ে বাবা-মার নামে কসম কাটি। সন্তানসন্ততি নিয়ে কসম করি।
অন্যকে বিশ্বাস করাতে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ টানি। ধর্মগ্রন্থের নাম তুলে, সৃষ্টিকর্তার নাম তুলে কসম করি।
অহরহ এটা। সব সমাজে বিদ্যমান এসব।
সবটাই স্বার্থের জন্য। বেশিরভাগ মানুষ নিজের লাভ ছাড়া কিছু বুঝি না।

৪.

আমরা অন্যকে ঠকাতে চাই। অন্যকে ঠকিয়ে জিততে চাই।
ওজনে কম দিই।
ভাগে কম দেই।
কাজে কম করি।
নিজের বেশিটা চাই, বড়টা চাই।
চাই চাই চাই করতে
মাকে ঠকাই, বাপকে ঠকাই। বোন-ভাইকে ঠকাই।
আত্মীয়, সহকর্মী, গোত্রের, দলের সবাইকে ঠকাতে ব্যস্ত থাকি।
কোন দায়বদ্ধতা নাই।
সহযোগিতা, সহমর্মিতা নাই।
নিজের স্বার্থচিন্তা করে শুধু খাই খাই করি বেশিরভাগ মানুষ। অধিকাংশ মানুষই এমন।

৫.

আবার আমরাই অনেকে গলাবাজি করি। লোকশোনানো কথা বলি। লোক দেখানো কাজ করি। সবসময় নিজেকে জাহির করার চেষ্ট করি।
সত্যি কি মানুষ এসব পছন্দ করে?
গলাবাজি করে কেউ কেউ টেকার চেষ্টা করলেও ঠিক একটা সময় মুখ থুবড়ে পড়ে।

৬.

আমরা অনেকেই অনেক অনেক নীতিকথা বলি।
পরামর্শ দিই,
উপদেশ দিই।
তার অনেকটা আমরা নিজেরাই পালন করি না। দিব্বি চলছি এভাবে। লজ্জা শরম বলতে কিছু নেই অনেকের। কতশত বড় বড় কথা বলি এখানে-সেখানে, জনসমুখে। তার ইয়ত্তা নেই।

৭.

ধর্ম পালনের ভাল ভাল দিক তুলে ধরি। ধর্ম পালনের কথা বলি। আবার নিজেরাই অনেক অন্যায় কাজ করি কিংবা অন্যায় কাজে সমর্থন করি।
সুবিধা আদায় করি।
সুবিধা পাইয়ে দেই।
নিজের প্রচুর দোষ না দেখে
বা ঢেকে রেখে অন্যের দোষ খুঁজি।
নিজেরটা এড়িয়ে যাই। সংশোধন হই না।

আমরা মানুষ হয়ে গেছি চটকদারি। লেবাস ঠিক আছে, মুখটাও ঠিক আছে কিন্তু কাজের বেলায় বৈপরিত্যে বসবাস। বিসমিল্লাহ বলে নিজের সুখটাই হাতড়াই। আর তাতে হারাম-হালালের বালাই ষাট! খারাপ কাজের মানুষগুলো একসময় আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। মানুষ ঠিকই তাদের চেনে। তাদের ঘৃনা করে।
আসুন ভাল মানুষ হই।
ভাল কাজ করি।
মানবিক হই।

সবার বোধোদয় হোক- সে প্রত্যাশা করি।
আসুন, সবাই বদলাই, বদলে দিই।

মাসুম মোরশেদ
শিক্ষক, সাহিত্যকর্মী।

মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

আসুন বদলে যাই - মাসুম মোরশেদ
24 Views

রবীন জাকারিয়া

১১ মার্চ, ২০২৩ , ৯:৪৭ অপরাহ্ণ

ক্ষুধা

বাবা বিখ্যাত কেউ না থাকলেও একটা বিশেষ কাজের জন্য তাকে সবাই চেনে৷ বৃটিশ বেনিয়াদের কাছ থেকে যখন এদেশ স্বাধীন হলো৷ সেদিন নিজের দোকানের ছাদে বাবাই এ শহরে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে৷ সেটা দেখতে কতো যে লোক এসেছিলো! স্যালুট দিয়েছিলো! এখনো অনেকে সে গল্প করে৷ ভালো লাগে৷

কোনো অসুখ-বিসুখ ছিল না৷ কিংবা খুব বয়স হয়েছে তা-ও নয়৷ হঠাৎ করে বাবা মারা গেলেন৷  পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি চলে যাওয়ায় আমরা অতল সাগরে পতিত হলাম৷ 

আমরা চার ভাই-বোন৷ দুই ভাই৷ দুই বোন৷ সবচেয়ে বড়বোনের বিয়ে হয়েছে৷ এখানেই থাকে৷ তবে ঘরজামাই বলা যায়না৷ শশুরের একখন্ড জমিতে নিজে বাড়ি বানিয়েছে৷ আয় রোজগার ভালো৷ উপরন্ত বাবার দোকানটা ভাড়ার নাম করে দখলে নিয়েছেন৷ এমন দুর্দিনে ভাড়াও দিচ্ছেন না আবার অন্যকে ভাড়া দিতেও দিচ্ছেননা৷ তাই আমাদের খোঁজ নেয় না৷ দূরত্ব রেখে চলে৷

আমাদের আত্মীয়-স্বজনরাও এখন এমুখো হয়না৷ 

বড় ভাই ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে৷ সে এখন আমাদের এ “জীবন-সংসার” নামক জাহাজের একমাত্র সারেং৷ আমরা বুঝি সংসার চালাতে তার কী প্রাণান্তকর সংগ্রাম৷ কলেজপড়ুয়া এক মেধাবী ছাত্রকে আজ দিন হাজিরাসহ এমন কোন কাজ নেই করতে হচ্ছেনা৷ একদিকে নিজের লেখাপড়া৷ অন্যদিকে আমাদের পড়াশুনা ও সংসারের খরচ৷ পেরে উঠছেনা৷ তবুও অদ্ভুত প্রাণশক্তি তার৷ হার না মানার জেদ৷

প্রায়দিন আমাদেরকে দিনের বেলা উপোস করতে হয়৷ আমি এইটে আর আমার ছোটবোন সিক্সে পড়ে৷ সেই সকালে একমুঠো মুড়ি-চিড়া খেয়ে সারাদিন স্কুল শেষে খালি পেটে থাকা কী কষ্ট তা সবাই বুঝবেনা৷ আমার আর ছোটবোনের ক্ষুধা সহ্য হয়না৷ মাকে জ্বালাতন করি৷ খাবার দিতে বলি৷ এটা-ওটায় লাথি মেরে রাগ আর ক্ষুধার কষ্ট প্রকাশ করি৷ মা রাগ না করে বরং শুধু কাঁদে৷ বলতে থাকে তোরাতো শুধু নিজের কথা ভাবছিস অথচ তোদের বড়ভাই জাকির এই ঝড়-বৃষ্টি-রোদের ভেতর কী কষ্ট করে যাচ্ছে সংসারের জন্য! ও কি কিছু খেয়েছে কী-না সেটা কেন বলিসনারে তোরা৷ বলতে বলতেই কাঁদতে থাকে৷ জাকিররে কতো স্বপ্ন ছিলো তোর৷ পড়াশুনা শেষ করে মস্ত বড় চাকরি করবি তুই! আর এখন তুই লেবারি করছিস ব্যাটা! মা গীত গাওয়ার মতো সুর তুলে কাঁদে আর বলে আল্লাহ্ কেন আমাকে তুলে নিলোনা গো আল্লাহ্৷

মা’র কান্না শুনতে ভাল্লাগছেনা৷ ক্ষুধায় মেজাজ ঠিক নেই৷ এমন সময় আমাদের আদরের ছোট বোনটা এসে আমার হাত ধরে টানতে থাকে৷ ওকে সাথে নিয়ে গিয়ে বলি কী হয়েছে বলতো? ও নিজের পেটটাতে হাত দিয়ে ঘঁষতে ঘঁষতে বললো ছোটভাই খুব ক্ষুধা লেগেছে৷ আমাকে কিছু খেতে দাওনা! বলেই কান্না জুড়ে দিলো৷ ওর কান্না যেন আমার বুকের ভেতর তীরের মতো বিঁধছিলো৷ নিজেও কেঁদে ফেললাম অঝোরে৷ এটা কি শুধু বোনের ব্যথায় নাকি ক্ষুধার সেটা আজো রহস্যাবৃত৷ ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম চুপ কর৷ একটা ব্যবস্থা করছি৷ ওর হাত ধরে হাঁটছি আর ভাবছি কী করা যায়! এমন সময় মাথায় আইডিয়াটা এসে গেলো৷ 

আমাদের বাড়ি থেকে আধাঘন্টা পথ দূরে বড়খালার বাড়ি৷ ওনারা অনেক বড়লোক৷ খালাতো ভাই-বোনেরা সকলে উচ্চশিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত৷ এজন্য অবশ্য বড়খালা কম অহংকার করেননা! যার ফলে ওনারা আমাদের সাথে তেমন সম্পর্ক রাখেননি৷ 

ছোটবোনটা বুড়ির মতো পাকা পাকা কথা বলে আর সবাই ভালোবাসি তাই আমরা ওকে বুড়ি বলে ডাকি৷ আমি বললাম বুড়ি চল বড়খালার বাড়িতে যাই৷ ওখানে খেলতেও পারবো আর দুপুরে ভাত খেয়ে চলে আসবো৷ কেউ টেরই পাবেনা৷

দুপুর অবধি আমরা ক্ষুধার্ত দুই ভাই বোন খালার বাড়িতে থাকলাম৷ আঙ্গিনার অনেক গাছ৷ সেখানে কত পাখি! দু’একটা গাছে পাখির বাসা৷ বুড়ি পাখির ছানা চাচ্ছে৷ এ গাছ থেকে ও গাছে চড়ছি-নামছি৷ গাছের কোঁটরে হাত ঢুকে দেই৷ কিন্ত নাহ্৷ কোন ছানা পেলাম না৷ ভেতরে ভেতরে আনন্দ৷ কিছুক্ষণ পরেতো খালা খেতে দেবে৷ পেট ভরে খেয়ে বাড়ি যাবো৷ একটা প্রত্যাশা আর দারুণ ভালোলাগা যেনো ক্ষুধার কথাটাকে ভুলিয়ে রাখলো৷

ঠিক খাবারের সময় বড়খালা আমাদের ডাকলেন৷ বাঁধভাঙ্গা আনন্দে ছুটলাম৷ যে ডাকটার অপেক্ষায় এতো কসরত, এতো আয়োজন৷ বললাম কী বলবেন বলেন খালা? তিনি যা বললেন তার জন্য মোটেও প্রস্তত ছিলামনা৷ এমনকি কল্পনাও করিনি৷ খালা বললেন এখন খাবার সময় হয়েছে৷ খেলাধুলা বন্ধ করে বাড়ি চলে যাও৷ 

অনেক ছোট হলেও খালার কথাগুলো মনে দাগ কাঁটলো৷ প্রচন্ড ব্যথা পেলাম৷ তবে এবার আর আবেগপ্রবন হলাম না৷ বুড়ির হাতটা ধরে অনেকটা জোর করে টেনে আনলাম ঐ “মৃত্যুপুরী” থেকে৷ যেখানে আর কখনোই যাইনি আমি৷

আজ রোদের তীব্রতা বেশ৷ এটাকেই কি সানি ডে বলে? আচ্ছা সানি ডে’র বিশেষত্ব কী! 

ক্ষুধা নিবারণের ছলে বেশি ছোটাছুটির কসরত দু’ভাই-বোনের ক্ষুধার জ্বালাকে করেছে আরো তীব্র৷ বুড়ি কাঁদতে থাকে৷ ওকে আশ্বস্ত করি৷ এখান থেকে আমাদের বাড়ির পথে একটা বড় কবরস্থান আছে৷ সেখানে অনেক ফুল-ফলের গাছ৷ বিশাল ফলগাছগুলোতে প্রচুর ফল ধরে৷ ওখানেই পড়ে যায়৷ পাখি ছাড়া ফল খাওয়ার লোক নেই৷ কবরস্থানের গাছের ফল কেউ খায়না৷ কী জানি ভয়ে নাকি ধর্মে নিষেধ আছে জানিনা! বুড়িকে রাস্তার একপাশে ছায়ায় বসিয়ে রেখে আমি একটা আতা গাছে উঠে পরলাম৷ বড় আর পাকা দেখে বেশ কিছু আতা নিয়ে বুড়িকে বললাম৷ খেয়ে নে বুড়ি! পেটভরে খা৷ মনে মনে বলতে থাকি কবরে শায়িত লোকের নয় জীবিত মানুষের জন্য খাবার প্রয়োজন৷ কেননা তাদের ক্ষুধা আছে৷

খাওয়া শেষ করে যখন দু’জনে বাড়ি ফিরলাম তখনো হাতে ছিলো কিছু আতা৷ হয়তো আর কারো ক্ষুধা মেটাবে৷

মেঘে মেঘে অনেক বেলা৷ কিংবা বলা যায় মিনিট, ঘন্টা, দিন, বছর পেড়িয়ে যায়৷ সময়ের সাথে সাথে মানুষ সার্ভাইভ করে৷ নতুন করে গড়ে তোলে জীবন৷ আর জীবনও থেমে থাকে না কখনো৷

বড়ভাই সরকারী চাকুরে থেকে অবসরে গেছেন৷ আর বুড়ি এবং ওর স্বামী দুজনে সরকারি চাকুরি করে৷ বাহিরে থাকে৷ আমরা হয়তো কেউই বড়খালার সন্তানদের মতো মস্ত বড় মানুষ হতে পারিনি৷ তবে এখন আর আমাদের ক্ষুধা নেই৷

এখন আমি প্রতিষ্ঠিত৷ রং শিল্পি৷ সকলে আর্টিস্ট বলে৷ শিল্পচর্চার জন্য কত যে পুরুষ্কার আর সম্মাননা পেয়েছি তার হিসেব নেই৷ এছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানী ভাতা পাই৷ 

কী অদ্ভুত জেনারেশন গ্যাপ৷ বাবা প্রচন্ড ভালোবাসায় পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে খ্যাতি পেয়েছিল৷ অথচ ঠিক চব্বিশ বছর পরে তার সন্তানরা সেই পতাকা ছুড়ে ফেলে স্বাধীন বাংলার পতাকার জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছে৷ এনেছে এক নতুন পতাকা৷ নতুন দেশ৷ আর সীমাহীন স্বপ্ন৷ 

আমি, আমার স্ত্রী আর আমাদের দুই সন্তান ও নাতি-নাতনী ছাড়াও আমার বাড়িতে এখন আরো একজন থাকে৷ মা মারা যাবার পর তাকে মায়ের মতো যত্ন  করি৷ যেখানে শ্রদ্ধার চেয়ে করুণা কাজ করে বেশি৷

আমার বড়খালার তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত সন্তানরা সম্পদের মালিকানার পর কেউই তাকে নিজের কাছে না রেখে অবহেলা করতে থাকে৷ তখনতো বৃদ্ধাশ্রম বলে কিছু ছিলো না৷ খালার থাকার জায়গা নেই৷ খাবার নেই৷ বেশ কিছুদিন আশেপাশের বাড়িতে ভিক্ষুকের মতো খাবার চেয়ে খেয়েছে৷ এসব মানিয়ে নিতে না পারায় অসুস্থ্য হয়ে পড়েন৷ একদিন আটপৌঢ়ে কাপড় পরিহিত অসহায় আর মলীন চেহারার এক বৃদ্ধাকে বাড়ির গেটে দেখে জিজ্ঞেস করলাম কী চাই? তাঁর পরিচয় পেয়ে একবার মনে করেছিলাম দূর করে দেই৷ কিন্ত পরে ভাবলাম একজন অধম হবে বলে আমি উত্তম হবোনা কেন? সেই থেকে আজো তিনি এখানে আছেন৷ হয়তো থাকবেন আমৃত্যু! 

একজন ক্ষুধার্তের মুখমন্ডল দেখতে কেমন হয়? আচ্ছা বহুদিন আগে ক্ষুধার্ত দুই ভাই-বোনের মুখচ্ছবি কেমন ছিল? জানতে ইচ্ছে করে৷ 

এখন ক্ষুধার জ্বালা নেই৷ তবে খাবার সময় বড়খালা যেভাবে চোখ বড় বড় করে এক মুঠো ভাত মুখে ঢুকিয়ে পরবর্তি মুঠোর জন্য তাকিয়ে থাকেন৷ সেই দৃশ্য দেখার ক্ষুধাটা হয়তো থেকে যাবে অনন্তকাল৷

মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

ক্ষুধা - রবীন জাকারিয়া
33 Views