গল্প Archives - মুগ্ধতা.কম

গল্প Archives - মুগ্ধতা.কম

মুগ্ধতা.কম

২৬ মার্চ, ২০২৩ , ৮:৫৮ অপরাহ্ণ

সৈনিক

আচ্ছা তারা কি জানে আমার বাবা একজন স্কুল শিক্ষক? তার চেয়েও বড় কথা তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা? জানলে নিশ্চয় এই আচরণ তারা আমার বৃদ্ধ বাবার সাথে করতে পারতেন না। আমি বাবার ছোট মেয়ে। ছোট বলতে সবার ছোট। মা কয়েকবছর আগে গত হয়েছেন। তিনি গত হয়ে ভালোই হয়েছে। বাবা এখন একজন রিটায়ার্ড স্কুল শিক্ষক। আগের মতো আয়-রোজগাড় তার নেই। আমাদের বাবা-মেয়ের চলতেই কত কষ্ট হয়। আমি জানি মা বেচে থাকলে মায়ের আরো কষ্ট হতো। তিনি আবার বেশি কষ্ট সইতে পারেন না। সইতে পারলে কি আর এতো তাড়াতাড়ি ওপারে যাওয়ার টিকেট কাটতেন? ভাবির সাথে সেদিন মায়ের একটু তর্ক লেগেছিল। মা-বাবার প্রেমের বিয়ে না তবুও মা বাবাকে খুব ভালোবাসতো। বাবা তার সারাটা জীবন পার করলেন মানুষকে শিক্ষা দিয়ে। সেই বাবাকে কেউ যদি লেখাপড়ার বিষয়ে জ্ঞান দেয় তা কি বাবার ভালো লাগবে নাকি মায়ের? বাবা ধৈর্যশীল মানুষ তাই তিনি সয়ে গেছেন কিন্তু মায়ের তো আর অত ধৈর্য নেই। তাই ভাবির সাথে তর্কটা লেগে যায়। ভাইয়া রাতে ফিরলে ভাবি ভাইয়াকে কী যে বলল, তা শুনেই ভাইয়া সেকি রাগ মায়ের উপর। মায়ের বড় ছেলে ভাইয়া। খুব আদর করত মা ভাইয়াকে। ভাইয়া নাকি বাবা-মার কত সাধনার ধন। বিয়ের সাত বছর পরও যখন সন্তান হচ্ছিল না তখন কত তাবিজ-কবজ করে নাকি ভাইয়াকে পায়। যাহোক ধান ভাঙতে আর শিবের গান না গাই। সেদিন ভাইয়া মাকে অনেক কথা শুনিয়েছিল। ওই যে বললাম মায়ের আমার ধৈর্য কম ছিল। তাই ছেলের কথাগুলো বোধ হয় তার খুব লেগেছিল। কোথায় লেগেছিল কে জানে। মা রাতে ঘুমিয়ে পড়লেন কিন্তু পরদিন সকালে আর তার ঘুম ভাঙল না। চিরতরে ঘুমিয়ে গেলেন আমার মা। সেই থেকে আমার বাবার একমাত্র চিন্তাও আমি ভরসাও আমি। অন্য ভাই-বোনেরা যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আমার তো আর সংসার নেই তাই আমি সারাদিন বাবাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকি। আমার সংসার থাকবেই বা কি করে? কাকসুন্দরী মেয়েদের কি কেউ বিয়ে করতে চায়? কেউ চাইলেও তাদের বাড়তি চাওয়া পূরণ করার সাধ্য যে বাবার নেই।

বাবাকে  নিয়ে আমি এখন আমাদের জেলার সরকারি মেডিকেলে আছি। বাবার শ্বাসকষ্টটা অনেক বেড়ে গেছে। শীতে মেডিকেলে রোগীর সংখ্যা বেশি। তাই বাবার স্থান হয়েছে ফ্লোরে। আমি কর্তব্যরত একজন নার্সকে বললাম একটা বেডের ব্যবস্থা করে দিতে। তিনি আমাকে বললেন-আপনারা কি এমন ভিআইপি লোক যে বেড না হলে আপনাদের চলবেই না। বেশি অসুবিধা হলে কেবিন ভাড়া নিন। অনেক আরামে থাকবেন।

আমি বলতে চাইলাম, আমার বাবা একজন………

কিন্তু বাবা আমাকে ইশারা করে নিষেধ করলেন। বাবার কথা -যুদ্ধ করেছি আমার দায়য়বদ্ধতা থেকে, দেশ মাতৃকাকে রক্ষা করতে। এখানে সেখানে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বলে সুযোগ সুবিধা লাভের জন্য নয়।আর দশজন লোক যেভাবে বাঁচে আমিও সেভাবেই বাঁচতে চাই।

বাবা একটু সুস্থ হলে আমি বাবাকে নিয়ে গ্রামে যাওয়ার জন রেলস্টেশনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। কিন্তু কি এক কারনে পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। আমাদের রিক্সাটা ছিল সবার সামনে। রিক্সাওয়ালা অহেতুক বেল বাজিয়ে চলেছেন। ডিউটিরত পুলিশটা এসে রিক্সাওয়ালাকে কষে একটা চড় দিলেন। ট্রাফিক পুলিশ না থানার পুলিশ। বাবা রিক্সাওয়ালার পক্ষ নিয়ে পুলিশকে বললেন, বাবা ধাপ্পড়টা না দিলেও পারতেন। পেশায় না হোক আপনার থেকে তো বয়সে বড়, তার গায়ে হাত তোলা কি ভালো কাজ?

পুলিশটার আত্মসম্মানবোধ হয় একটু বেশি। উনি আমার বাবার কলার টেনে ধরে রিক্সা থেকে নামালেন। “আমাকে আইন শেখাও বেটা, আমাকে আইন শেখাও? এবার দেখ কেমন লাগে।”

আমি বাবাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু উনি আমাকেও একটা ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিল। বাবা তার স্বভাব সূলভ উত্তর দিলেন- আমিতো আইন নিয়ে কিছু বলিনি। আপনি যে কাজটা করলেন সেটা না করলেও পারতেন তাই বলেছি। ক্ষমতা হাতে পেয়ে তো রীতিমতো তার অপব্যবহার করছেন আপনি। একজন রিক্সাওয়ালা বেল বাজালে তার গায়ে হাত তুলতে হবে এটা কোন আইনে আছে বলেন তো।

মাত্র কয়েক সেকেন্ড। আমার বাবা তার উঁচু মাথা নিচু করে ফেললেন। অথচ জীবনে কখনো আমি বাবাকে মাথা নিচু করে হাঁটতেও দেখিনি। মাথা নিচু করে নাকি ভীতুরা হাটাচলা করে। অথচ আজ আমার সাহসী বাবা মাথা নিচু করে আছে আমার সামনে। চুপচাপ বাবা রিক্সায় উঠে এল। কিছুক্ষণ পর রাস্তা খুলে দেওয়া হলো। আমরা চলে এলাম। বাড়িতে এসে বাবা সবসময় চুপচাপই থাকত। মেয়ের সামনে থাপ্পড় খাওয়া কোনো কাপুরুষ বাবাও সহজে হজম করতে পারবে না। আর আমার বাবা তো সাহসী বাবা, একাত্তরের বীর সৈনিক। তিনি কীভাবে এই লজ্জা হজম করবেন। একসপ্তাহও কাটল না। এই লজ্জা নিয়ে আমার বাবার পক্ষে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা কতটা অসম্ভব ছিল তা একমাত্র আমি জানতাম। তাই তিনিও মায়ের পথ অনুসরণ করলেন। কাউকে কিছু বুঝতে দিলেন না। নিঃশব্দে চলে গেলেন। বাবা মারা যাওয়ার কথা শুনে সেনাবাহিনীর লোকজন এসেছিল আমার বাবাকে সম্মান জানাতে। আমি তাদের তা করতে দেইনি। এতে আমার অন্যান্য ভাইবোন এমনকি গ্রামবাসীও আমার উপর চরম ক্ষেপেছিল। কেন করতে দিব? যে সম্মান আমার বাবা বেঁচে থাকতে পায়নি মরে গিয়ে সেই সম্মান সে কী করবে? কী লাভ সেই সম্মান পেয়ে? সবাই জানে আমার বাবা বার্ধক্য কিংবা শ্বাসকষ্টজনিত কারণে মারা গেছে। কিন্তু আমি তো জানি বাবা কেন মারা গেছে। বাবার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস, উদাস চাহনি আমাকে বারবার শিহরিত করত, আমাকে ভাবাতো, আমাকে ভয় পাইয়ে দিত। একজন মানুষ কীভাবে তিলে তিলে শেষ হয়ে যায় আমি আমার বাবাকে দেখে তা বুঝেছি।

একজন  সাহসী যোদ্ধা যিনি যুদ্ধ করে  দেশের জন্য বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন কিন্তু জীবন যুদ্ধে তিনি পরাজিত সৈনিকের মতো মাথা নত করে চলে গেলেন এই পৃথিবীর মায়াজাল ছিন্ন করে।

সৈনিক
Comments Off
30 Views

মুগ্ধতা.কম

২৫ মার্চ, ২০২৩ , ১:০৪ অপরাহ্ণ

বনলতার বিয়ে

বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে নিয়মিত চাকরি প্রার্থীদের দীর্ঘ লাইন। বনলতার গা শিউড়ে ওঠে এই লাইন দেখে। এক বছর আগেও সে এই লাইনে নিয়মিত দাঁড়াত। অন্য কোথাও এত ইন্টারভিউ দেয়নি। ব্যাংকেই সবচে বেশি দিয়েছে। তার ধারণা এখানেই সবচেয়ে নিরাপদ চাকরি পাওয়া যায়। সেটা সত্যিও হয়েছে। সে একটা সরকারি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার আজ।

অনেক লড়াই করতে হয়েছে তার। সফলতার খবর গ্রামের চারদিকে এখনও উড়ছে। বয়সও অনেক হলো। এখন বিয়ে দরকার। বনলতার পাত্র মেলা কঠিন হয়ে পড়েছে। জাতে নমশুদ্র হওয়ায় যোগ্য পাত্র মিলছে না। বনলতার বেশ তাড়াও আছে বিয়ের। সে গভীরভাবে দীর্ঘশ^াস নিতে পারে- চাকরিটার জন্য। তার বিশ^াস বিয়ে থা হবে এক সময়। সুখে দিন কাটাবে। কিন্তু পাত্রের তীব্র আকালে তার অনেক কলিগ বলে, দেশে পাত্র না পেলে ভারতে যান, ওখানকার ছেলেকে বিয়ে করুন। সরকার অনুমতি দেবে নিশ্চয়।

বনলতার কেমন যেন লাগে। দেশের ছেলে ছাড়া মন কোথাও সায় দেয় না। নিজ জাতে তার সমমর্যাদার ছেলে নাই-এটা সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। এই কারণে যাকে তাকে বিয়েও করতে পারছে না। মহাবিপদে সে। মেয়ে কলিগরা টিপ্পনি কাটতে কাটতে তাদেরই বিরক্ত লেগে গেছে। ছেলে কলিগরা মজা নেয় শুধু। একবার তো বনলতা বিরক্ত হয়ে এক মেয়েকে বলেই ফেলেছে, আপনিও তো যাকে তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন না। আমাকে কেন জোর করেন?

মেয়ে কলিগটা প্রতি উত্তরে বলে, দেখুন, প্রচুর অফার পাচ্ছি তাই যাচাই-বাচাই করতে সময় লাগছে।

বনলতা সমবয়সী সেই কলিগকে বলে, আপনার প্রচুর অফার তাই যাচাই বাচাই করতে সময় লাগছে আর আমার তো কোনো পাত্রই খুঁজে পাচ্ছি না তাই সময় লাগছে। ব্যাপারটা দু’জনের একই-সময় লাগছে কোনো না কোনো কারণে। এটা নিয়ে প্যাঁচ লাগানোর কি আছে?

এই কথা শোনার পর কোনো কলিগই আর এ নিয়ে কথা বলতে আসেনি বনলতার সাথে।

২ ॥

বাবা অসুস্থ হওয়ায় বনলতা বাড়িতে । বাংলা সিনেমায় মুমূর্ষু বাবা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে যেমন মরতে চান বনলতার বাবারও আকুতি তেমন। আশ-পাশের লোকজন মুসলিম, বাদবাকি বামন আর হ্মত্রিয়। বনলতার বাবা দ্রুত চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠলেন। ফলে বিয়ের করুণ চাপটা কমে গেলো আপাতত। বনলতা আবার ঢাকায় চলে এল- বাবাকে পাত্র দেখার জোর তাগদা দিয়ে। কিন্তু বাবা তো মনে হয় মেয়ের পাত্র খুঁজতে খুঁজতে আবারও অসুস্থ হয়ে যাবে…

অফিসে লাঞ্চ বিরতির সময় বনলতার এক বিবাহিত সিনিয়র কলিগ ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলতে বলতে তাকে প্রেমের অফার দিয়ে বসল। সে হেসে উড়িয়ে দিলো। অফিস শেষে বাসা আসার পথে সেই কলিগের সাথে আবার দেখা। দুজনে চা খেতে বসল। বনলতা সিনিয়র কলিগকে বুঝিয়ে বলল, এটা অসম্ভব।

– কেন?

– ধর্ম।

– কেউ জানবে না। এটা জাস্ট প্রেম। আর কিছু না।

– এ নিয়ে আর কথা নয়, বনলতা বাই বলে চলে গেল।

বৃহস্পতিবার অফিস শেষে এক সমবয়সী কলিগ চান্স পেয়ে চায়ের অফার দিলো বনলতাকে। সেদিনও থ্যাংকস বলে বাসার দিকে চলছে। এই কলিগ তার ডিভিশনের নয়- অন্য  একটা ডিভিশনের। নাম-আদিল। আদিল পিছু নিয়ে কাছে এসে বলল, কথা আছে।

বনলতা বললো, কী কথা?

– জরুরি কথা।

– ফোনে জানান।

ফোন নম্বর নেই জানালে আদিলকে ফোন নম্বর দিলো বনলতা।

 রাতে আদিল ফোন দিয়ে বললো, কাল তো শুক্রবার। আসুন রমনায় কথা বলি।

– কখন?

– সকালে আসুন। সারাদিন ঘুরব।

– সকালে যেতে পারব না। বিকেলে ফ্রি থাকব।

– তাহলে বিকেলে আসুন।

– ওকে।

পরের দিন রমনাতে আদিল আর বনলতার দেখা। এই কথা সেই কথার শেষে বিয়ের কথা। আদিল জানাল, আপনাকে আমার ভালো লাগে।

বনলতা জানাল, আমারও একটু একটু আপনাকে ভালো লাগে।

আদিল খুশি হলো, আগে জানাননি কেন?

– এই সম্পর্ক ঠিক নয়।

– কেন?

– আমি হিন্দু আপনি মুসলিম।

– তাতে কী?

– সমাজের পরতে পরতে সমস্যায় পড়তে হবে।

– কোনো সমস্যা হবে না যদি আপনি রাজি থাকেন।

– কীভাবে?

– আপনি মুসলিম হয়ে যান।

অনেক আশায় অনেক সংকোচ নিয়ে আদিল বললেও এই প্রস্তাবে বনলতার কোনো ভাবান্তর নেই। বরং এতে আদিলই বিচলিত হয়ে গেল।  আর এ ধরনের প্রস্তাব তো বনলতার কাছে নতুন নয়।

সে হেসে বলল, আপনাকে আমার ভালো লাগে তা আগে জানাতে পারিনি, অথচ আপনি কত সহজভাবে ভালো লাগার কথাটা জানালেন। আবার ধর্ম পাল্টানোর কথাও বললেন। আমি কিন্তু আপনাকে কখনও ধর্ম পাল্টানোর কথা বলছি না। ভালো লাগার কারণে আমি ধর্ম পাল্টালে আপনি কি পাল্টাবেন? আপনি কি হিন্দু হতে পারবেন?

আদিল নানান যুক্তি দিতে লাগল তার ধর্মের পক্ষে। শ্রেষ্ঠত্বের ইতিহাস আবৃত্তি করতে করতে বললো, মানুষ অন্য ধর্ম থেকে মুসলিম হয়, মুসলিম থেকে অন্য ধর্মে যায় না।

এক পর্যায়ে প্রেম-প্রণয়ের চেয়ে ধর্মপ্রচারটাই মুখ্য হয়ে উঠল রমনায়। সন্ধ্যা হয়ে এলে দুজন দুদিকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

৩ ॥

জীবনের তাগিদে সাপে-নেউলে এক হতে পারে। ঠিক তেমনি এক তাগিদে বনলতার বিয়ে পাক্কা বামনের ছেলের সাথে। জাত-পাতের অনেক ব্যাপার থাকলেও একটা বিশেষ কোটায় তা এখানে কার্যকর হচ্ছে না। শতসহস্র সাধনার বিশ্বাস সুযোগ পেলে গোপনে একটু দম নেয়। ছেলে তো বেকার,  জাত-পাতের খরচা বহন করার সামর্থ্য নেই। তার দরকার এমন একজন যে তার বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার জ্বালানি সরবরাহ করতে পারবে। মেয়ে চাকরি করে- অনেক টাকা ইনকাম করে। আর কী চাই? কারণ ছেলের জাত বামন হলেও বলার মতো কোনো সম্পত্তি নেই। ছেলের বাবার যা ছিল তা কীভাবে যে খরচ হয়েছে সে খবর নতুন প্রজন্মের কেউ জানে না। চাকরিজীবী বনলতার মাধ্যমে যদি বামনের হারানো গৌরব ফিরে আসে এই গোপন আশায় বিয়েতে এক পায়ে রাজি ছেলেপক্ষ। আর অপরদিকে জীবন যৌবন উপভোগ করতে শুদ্র পরিচয় মগজ থেকে শুকাতে সময় লাগেনি বনলতার।

বনলতার বিয়ে
42 Views

রবীন জাকারিয়া

১১ মার্চ, ২০২৩ , ৯:৪৭ অপরাহ্ণ

ক্ষুধা

বাবা বিখ্যাত কেউ না থাকলেও একটা বিশেষ কাজের জন্য তাকে সবাই চেনে৷ বৃটিশ বেনিয়াদের কাছ থেকে যখন এদেশ স্বাধীন হলো৷ সেদিন নিজের দোকানের ছাদে বাবাই এ শহরে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে৷ সেটা দেখতে কতো যে লোক এসেছিলো! স্যালুট দিয়েছিলো! এখনো অনেকে সে গল্প করে৷ ভালো লাগে৷

কোনো অসুখ-বিসুখ ছিল না৷ কিংবা খুব বয়স হয়েছে তা-ও নয়৷ হঠাৎ করে বাবা মারা গেলেন৷  পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি চলে যাওয়ায় আমরা অতল সাগরে পতিত হলাম৷ 

আমরা চার ভাই-বোন৷ দুই ভাই৷ দুই বোন৷ সবচেয়ে বড়বোনের বিয়ে হয়েছে৷ এখানেই থাকে৷ তবে ঘরজামাই বলা যায়না৷ শশুরের একখন্ড জমিতে নিজে বাড়ি বানিয়েছে৷ আয় রোজগার ভালো৷ উপরন্ত বাবার দোকানটা ভাড়ার নাম করে দখলে নিয়েছেন৷ এমন দুর্দিনে ভাড়াও দিচ্ছেন না আবার অন্যকে ভাড়া দিতেও দিচ্ছেননা৷ তাই আমাদের খোঁজ নেয় না৷ দূরত্ব রেখে চলে৷

আমাদের আত্মীয়-স্বজনরাও এখন এমুখো হয়না৷ 

বড় ভাই ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে৷ সে এখন আমাদের এ “জীবন-সংসার” নামক জাহাজের একমাত্র সারেং৷ আমরা বুঝি সংসার চালাতে তার কী প্রাণান্তকর সংগ্রাম৷ কলেজপড়ুয়া এক মেধাবী ছাত্রকে আজ দিন হাজিরাসহ এমন কোন কাজ নেই করতে হচ্ছেনা৷ একদিকে নিজের লেখাপড়া৷ অন্যদিকে আমাদের পড়াশুনা ও সংসারের খরচ৷ পেরে উঠছেনা৷ তবুও অদ্ভুত প্রাণশক্তি তার৷ হার না মানার জেদ৷

প্রায়দিন আমাদেরকে দিনের বেলা উপোস করতে হয়৷ আমি এইটে আর আমার ছোটবোন সিক্সে পড়ে৷ সেই সকালে একমুঠো মুড়ি-চিড়া খেয়ে সারাদিন স্কুল শেষে খালি পেটে থাকা কী কষ্ট তা সবাই বুঝবেনা৷ আমার আর ছোটবোনের ক্ষুধা সহ্য হয়না৷ মাকে জ্বালাতন করি৷ খাবার দিতে বলি৷ এটা-ওটায় লাথি মেরে রাগ আর ক্ষুধার কষ্ট প্রকাশ করি৷ মা রাগ না করে বরং শুধু কাঁদে৷ বলতে থাকে তোরাতো শুধু নিজের কথা ভাবছিস অথচ তোদের বড়ভাই জাকির এই ঝড়-বৃষ্টি-রোদের ভেতর কী কষ্ট করে যাচ্ছে সংসারের জন্য! ও কি কিছু খেয়েছে কী-না সেটা কেন বলিসনারে তোরা৷ বলতে বলতেই কাঁদতে থাকে৷ জাকিররে কতো স্বপ্ন ছিলো তোর৷ পড়াশুনা শেষ করে মস্ত বড় চাকরি করবি তুই! আর এখন তুই লেবারি করছিস ব্যাটা! মা গীত গাওয়ার মতো সুর তুলে কাঁদে আর বলে আল্লাহ্ কেন আমাকে তুলে নিলোনা গো আল্লাহ্৷

মা’র কান্না শুনতে ভাল্লাগছেনা৷ ক্ষুধায় মেজাজ ঠিক নেই৷ এমন সময় আমাদের আদরের ছোট বোনটা এসে আমার হাত ধরে টানতে থাকে৷ ওকে সাথে নিয়ে গিয়ে বলি কী হয়েছে বলতো? ও নিজের পেটটাতে হাত দিয়ে ঘঁষতে ঘঁষতে বললো ছোটভাই খুব ক্ষুধা লেগেছে৷ আমাকে কিছু খেতে দাওনা! বলেই কান্না জুড়ে দিলো৷ ওর কান্না যেন আমার বুকের ভেতর তীরের মতো বিঁধছিলো৷ নিজেও কেঁদে ফেললাম অঝোরে৷ এটা কি শুধু বোনের ব্যথায় নাকি ক্ষুধার সেটা আজো রহস্যাবৃত৷ ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম চুপ কর৷ একটা ব্যবস্থা করছি৷ ওর হাত ধরে হাঁটছি আর ভাবছি কী করা যায়! এমন সময় মাথায় আইডিয়াটা এসে গেলো৷ 

আমাদের বাড়ি থেকে আধাঘন্টা পথ দূরে বড়খালার বাড়ি৷ ওনারা অনেক বড়লোক৷ খালাতো ভাই-বোনেরা সকলে উচ্চশিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত৷ এজন্য অবশ্য বড়খালা কম অহংকার করেননা! যার ফলে ওনারা আমাদের সাথে তেমন সম্পর্ক রাখেননি৷ 

ছোটবোনটা বুড়ির মতো পাকা পাকা কথা বলে আর সবাই ভালোবাসি তাই আমরা ওকে বুড়ি বলে ডাকি৷ আমি বললাম বুড়ি চল বড়খালার বাড়িতে যাই৷ ওখানে খেলতেও পারবো আর দুপুরে ভাত খেয়ে চলে আসবো৷ কেউ টেরই পাবেনা৷

দুপুর অবধি আমরা ক্ষুধার্ত দুই ভাই বোন খালার বাড়িতে থাকলাম৷ আঙ্গিনার অনেক গাছ৷ সেখানে কত পাখি! দু’একটা গাছে পাখির বাসা৷ বুড়ি পাখির ছানা চাচ্ছে৷ এ গাছ থেকে ও গাছে চড়ছি-নামছি৷ গাছের কোঁটরে হাত ঢুকে দেই৷ কিন্ত নাহ্৷ কোন ছানা পেলাম না৷ ভেতরে ভেতরে আনন্দ৷ কিছুক্ষণ পরেতো খালা খেতে দেবে৷ পেট ভরে খেয়ে বাড়ি যাবো৷ একটা প্রত্যাশা আর দারুণ ভালোলাগা যেনো ক্ষুধার কথাটাকে ভুলিয়ে রাখলো৷

ঠিক খাবারের সময় বড়খালা আমাদের ডাকলেন৷ বাঁধভাঙ্গা আনন্দে ছুটলাম৷ যে ডাকটার অপেক্ষায় এতো কসরত, এতো আয়োজন৷ বললাম কী বলবেন বলেন খালা? তিনি যা বললেন তার জন্য মোটেও প্রস্তত ছিলামনা৷ এমনকি কল্পনাও করিনি৷ খালা বললেন এখন খাবার সময় হয়েছে৷ খেলাধুলা বন্ধ করে বাড়ি চলে যাও৷ 

অনেক ছোট হলেও খালার কথাগুলো মনে দাগ কাঁটলো৷ প্রচন্ড ব্যথা পেলাম৷ তবে এবার আর আবেগপ্রবন হলাম না৷ বুড়ির হাতটা ধরে অনেকটা জোর করে টেনে আনলাম ঐ “মৃত্যুপুরী” থেকে৷ যেখানে আর কখনোই যাইনি আমি৷

আজ রোদের তীব্রতা বেশ৷ এটাকেই কি সানি ডে বলে? আচ্ছা সানি ডে’র বিশেষত্ব কী! 

ক্ষুধা নিবারণের ছলে বেশি ছোটাছুটির কসরত দু’ভাই-বোনের ক্ষুধার জ্বালাকে করেছে আরো তীব্র৷ বুড়ি কাঁদতে থাকে৷ ওকে আশ্বস্ত করি৷ এখান থেকে আমাদের বাড়ির পথে একটা বড় কবরস্থান আছে৷ সেখানে অনেক ফুল-ফলের গাছ৷ বিশাল ফলগাছগুলোতে প্রচুর ফল ধরে৷ ওখানেই পড়ে যায়৷ পাখি ছাড়া ফল খাওয়ার লোক নেই৷ কবরস্থানের গাছের ফল কেউ খায়না৷ কী জানি ভয়ে নাকি ধর্মে নিষেধ আছে জানিনা! বুড়িকে রাস্তার একপাশে ছায়ায় বসিয়ে রেখে আমি একটা আতা গাছে উঠে পরলাম৷ বড় আর পাকা দেখে বেশ কিছু আতা নিয়ে বুড়িকে বললাম৷ খেয়ে নে বুড়ি! পেটভরে খা৷ মনে মনে বলতে থাকি কবরে শায়িত লোকের নয় জীবিত মানুষের জন্য খাবার প্রয়োজন৷ কেননা তাদের ক্ষুধা আছে৷

খাওয়া শেষ করে যখন দু’জনে বাড়ি ফিরলাম তখনো হাতে ছিলো কিছু আতা৷ হয়তো আর কারো ক্ষুধা মেটাবে৷

মেঘে মেঘে অনেক বেলা৷ কিংবা বলা যায় মিনিট, ঘন্টা, দিন, বছর পেড়িয়ে যায়৷ সময়ের সাথে সাথে মানুষ সার্ভাইভ করে৷ নতুন করে গড়ে তোলে জীবন৷ আর জীবনও থেমে থাকে না কখনো৷

বড়ভাই সরকারী চাকুরে থেকে অবসরে গেছেন৷ আর বুড়ি এবং ওর স্বামী দুজনে সরকারি চাকুরি করে৷ বাহিরে থাকে৷ আমরা হয়তো কেউই বড়খালার সন্তানদের মতো মস্ত বড় মানুষ হতে পারিনি৷ তবে এখন আর আমাদের ক্ষুধা নেই৷

এখন আমি প্রতিষ্ঠিত৷ রং শিল্পি৷ সকলে আর্টিস্ট বলে৷ শিল্পচর্চার জন্য কত যে পুরুষ্কার আর সম্মাননা পেয়েছি তার হিসেব নেই৷ এছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানী ভাতা পাই৷ 

কী অদ্ভুত জেনারেশন গ্যাপ৷ বাবা প্রচন্ড ভালোবাসায় পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে খ্যাতি পেয়েছিল৷ অথচ ঠিক চব্বিশ বছর পরে তার সন্তানরা সেই পতাকা ছুড়ে ফেলে স্বাধীন বাংলার পতাকার জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছে৷ এনেছে এক নতুন পতাকা৷ নতুন দেশ৷ আর সীমাহীন স্বপ্ন৷ 

আমি, আমার স্ত্রী আর আমাদের দুই সন্তান ও নাতি-নাতনী ছাড়াও আমার বাড়িতে এখন আরো একজন থাকে৷ মা মারা যাবার পর তাকে মায়ের মতো যত্ন  করি৷ যেখানে শ্রদ্ধার চেয়ে করুণা কাজ করে বেশি৷

আমার বড়খালার তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত সন্তানরা সম্পদের মালিকানার পর কেউই তাকে নিজের কাছে না রেখে অবহেলা করতে থাকে৷ তখনতো বৃদ্ধাশ্রম বলে কিছু ছিলো না৷ খালার থাকার জায়গা নেই৷ খাবার নেই৷ বেশ কিছুদিন আশেপাশের বাড়িতে ভিক্ষুকের মতো খাবার চেয়ে খেয়েছে৷ এসব মানিয়ে নিতে না পারায় অসুস্থ্য হয়ে পড়েন৷ একদিন আটপৌঢ়ে কাপড় পরিহিত অসহায় আর মলীন চেহারার এক বৃদ্ধাকে বাড়ির গেটে দেখে জিজ্ঞেস করলাম কী চাই? তাঁর পরিচয় পেয়ে একবার মনে করেছিলাম দূর করে দেই৷ কিন্ত পরে ভাবলাম একজন অধম হবে বলে আমি উত্তম হবোনা কেন? সেই থেকে আজো তিনি এখানে আছেন৷ হয়তো থাকবেন আমৃত্যু! 

একজন ক্ষুধার্তের মুখমন্ডল দেখতে কেমন হয়? আচ্ছা বহুদিন আগে ক্ষুধার্ত দুই ভাই-বোনের মুখচ্ছবি কেমন ছিল? জানতে ইচ্ছে করে৷ 

এখন ক্ষুধার জ্বালা নেই৷ তবে খাবার সময় বড়খালা যেভাবে চোখ বড় বড় করে এক মুঠো ভাত মুখে ঢুকিয়ে পরবর্তি মুঠোর জন্য তাকিয়ে থাকেন৷ সেই দৃশ্য দেখার ক্ষুধাটা হয়তো থেকে যাবে অনন্তকাল৷

মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

ক্ষুধা - রবীন জাকারিয়া
88 Views