ইদ : অধিকারের অন্নেষণ

প্রফেসর মোহাম্মদ শাহ আলম

২ মে, ২০২২ , ৫:১৫ অপরাহ্ণ ; 352 Views

উৎসব বিষয়ে বয়সাক্রান্ত যে কেউ অতিবেশি আবেগাক্রন্ত। সুখের ধারাবর্ণনায় অনেকটা বাঁধভাঙা। অতীতমুখী ধারাবাহিকতা মন্দ নয়। তবে বর্তমান জনগোষ্ঠীর মনোভঙ্গির পরিবর্তন, অতীতের সাথে পার্থক্য বাড়ায় শুধু। উৎসব গোত্রীয় যে কোনো বিষয়ই এক ধরনের নিরপেক্ষ, সমতাভিত্তিক ভাবনা তাড়িত করে আমাদের। ইদ উৎসব বিষয়টি এ ক্ষেত্রে অতিবেশি স্পর্শকাতর। ধর্মীয় নির্দেশনাবলী, সামাজিক দায়, সাংস্কৃতিক বোধ সব মিলিয়ে নৈতিক নিষ্ঠার পর্যায়ে ফেলা যায় ইদ উৎসবকে। স্বত:স্ফুর্ত আনন্দ, নিকট যোগসূত্র, ব্যবধানহীন মুক্ততা, সর্বোপরি মানবিক সাম্যের দাবী প্রধান হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু হিসাব মেলে না বাস্তব দৃষ্টান্তে। যে সূত্রেই প্রশ্ন জাগে ইদ উৎসব কি অধিকারের নাকি করুণার?

ইসলামের সাম্য নির্দেশনা আর অধিকার প্রতিষ্ঠার রীতি বৈজ্ঞানিক অবশ্যই। মানুষ মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ, অর্থনৈতিক সমতার বিধানও স্পষ্ট। দাসত্বের বিরুদ্ধে প্রবল বিধি নিষেধ, বর্ণ-গোত্র, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সবার মর্যাদার স্বীকৃতি সমান। যে কোনো উৎসবে সব মানুষ সমভাবে আনন্দ ভোগ করবে  এ বিষয়েও দ্বিমত নেই। গণতন্ত্র প্রত্যাশী রুশো, আব্রাহাম লিংকন, কাজী নজরুল ইসলাম বলিষ্ঠ কন্ঠে সাম্য বাণীর ঘোষণা দিয়েছেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ে স্পষ্ট নীতি নির্ধারণ করে। প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ(স.) অনেক আগেই জানান দেন ‘মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। সকল মানুষের ধমনীতে একই পিতা-মাতার শোনিতধারা প্রবাহিত।’ ইসলামে রাজা-প্রজা, দাস-দাসি, পুরুষ-নারী, গরির-ধনি সবার অধিকার সমানভাবে স্বীকৃত। তারপরও যখন ইসলামধর্মে বিশ্বাসী মানুষদরে সংকীর্ণ স্বার্থ অর্জনে অতিবেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় তখন সবার অধিকার সমান থাকে না। অধিকারহারা মানুষরা করুণার পাত্র হয়েই পরমুখাপেক্ষি প্রহর গোণে। অথচ ইদ উৎসব নিয়ে কবির অনুভব

‘ঈদ মানে নয়তো শুধু

নতুন জামা পরা

ঈদ মানে গরীর দু:খীর

যতœ সেবা করা।

ঈদ মানে নয়তো শুধু

একলা বসে খাওয়া,

ঈদ মানে দুখীর পানে

একটুখানি চাওয়া।’

ঊাস্তবতা হলো ইদ উৎসবও এখন সর্বজনীন আনন্দমাখা থাকছে না। এর কারণ বহুবিধ। উল্লেখ করা যায় মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অতিমাত্রায় আত্মস্বার্থকেন্দ্রিকতা, আদর্শচ্যুতি, দান-খয়রাত, যাকাত, ফেতরা বিধান যথাযথ অনুসরণ না করার বিষয়গুলোর কথা। এর বাইরেও আছে ক্ষমতার দর্প, বিত্তবানের খেয়াল খুশির মানসিকতা, মানুষকে ছোট করে দেখার প্রবণতা। এমন অবস্থায় ইদ আনন্দ অধিকার হিসেবে বিবেচিত হবে কেমন করে? তাই তো রমজান শুরু হবার পর থেকে অসহায় মানুষের শংকা বাড়ে. বিত্তবানদের বাড়ে জৌলুশ। প্রতিযোগিতার অসম মাত্রা বিত্তহীনদের অধিকার করে খর্বিত। আমাদের সমাজ ভাবনায় গরিবরা প্রাধান্য পায় না কখনও। ইদকে ঘিরে সামাজিক শুভ চিন্তাার বিকাশ কতটা জোরালো – তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
রোজা-ইদ আসলেই চাঁদাবাজী, ছিনতাই, চোরাচালান, ঘুষ, প্রতারণা, দ্রব্রমূল্য পালা দিয়ে বাড়ে। আশ্বাস থাকে কিন্তু থাকে না বাস্তবায়ন। সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বোধের জায়টা কোথায় পত্রিকাগুলো তা তুলে ধরলেও নীতি-নৈতিকতার বৃক্ষ বনসাই হয়েই থাকে। প্রায়োগিক কোনো সুফল সমাজ পায় না।

এবার হাওড়ের মানুষ বিপর্যস্ত। আগাম বন্যা হাওড়ের মানুষের স্বচ্ছলতার স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে। সোনালি ফসলের বদলে অমানিশার ঘোর আঁধার তাদের সংসারে। প্রকৃতির বিরূপতার বিরুদ্ধে কষ্টময় সংগ্রাম করেই বেঁচে থাকা এখন তাদের। সে প্রভাবে যতটা বাড়ার কথা তার চেয়ে অনেকগুণ বাড়ানো হয়েছে খাদ্যপণ্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য। ক্ষুদ্ধ পরিকল্পনা মন্ত্রী একবার বলেছিলেন ‘এ দেশে সূর্য উঠলেও দাম বাড়ে, সূর্য ডুবলেও দাম বাড়ে।’ এমন আক্ষেপ যে পরিবেশেই হোক না কেন তা পুরোটাই সত্য। ব্যবসায়ীদের আত্মস্ফীতির মনেবৃত্তি সামাজিক কল্যাণী চিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করতেই থাকে আর বাড়তেই থাকে পণ্যমূল্য। পণ্যমূল্য শুধু কেন? নির্বিঘ ঈদ যাত্রাও মানুষের অধিকার। এবার যাত্রা নির্বিঘ হলেও টিটিক প্রাপ্তিতে ছিল ভোগান্তি। বাসের টিকেটের আসল মুল্য নিশ্চিত কারাই কঠিন। বেশী নেয়াটাই যেনো পূণ্যের কাজ।

রোজা ও ইদেকে কেন্দ্র করে ত্যাগের যে পতাকা তুলে ধরার কথা তা কখনই হয় না আমাদের দেশে। ভোগের স্বপ্ন বিভোর বিত্তবানদের আরও চাই আরও চাই তৃষ্ণা মেটে না কখনও। এক্ষেত্রে রোজা, ইদ,পহেলা বৈশাখ নানা উৎসবে মাত্রারিক্ত মূল্য নেবার জন্যই জাল পেতে বসে থাকে। ধর্র্মীয় বিধি নিষেধ লোভের কাছে হার মানে। রোজা ও ইদে ভ্ক্তোারা সহনীয় মূল্যে পণ্য কিনে স্বচ্ছন্দে রোজা রাখবে, পরিবার পারিজনসহ ইদ আনন্দে যোগ দেবে এমনটাই কাম্য। এ তাদের অধিকার। কিন্তু কারও কিছু করার নেই।

সত্য হলো বিত্তবানদের সম্পদে আছে বিত্তহীনদের অধিকার। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিত্তবানদের সংকীর্ণতার পথ থেকে বেরিয়ে আসার আহŸান জানিয়েছেন। প্রবল প্রতাপে অধিকার আদায়ে বলিষ্ঠ হতে বলেছেন সবহারাদের।

‘মোদের হিস্যা আদায় করিতে ঈদে
দিলে হুকুম আল্লাহ-তা’আলা।
..আল্লাহর ঋণ শোধ কর, যদি বাঁচিবার থাকে সাধ
আমাদের বাঁকা ছুরি আাঁকা দেখ
আকাশে ঈদের চাঁদ।’ (ঈদের চাঁদ)

নজরুল নিজস্ব প্রত্যয়ে ইদ উৎসবকে যথার্থ অধিকার হিসেবে বিচার করেছেন । বঞ্চিতদের বঞ্চনার মূলে আঘাত হেনেছেন নিঃসংকোচে। যাকাত ফতরা করুণার দান নয়। এ মেহনতী মানুষের অধিকার। যারা সম্পদের পাহাড় গড়েÑ যথাযথ হিস্যা দিতে কুণ্ঠিত তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে হবে। ইদের চাঁদকে অধিকার আদায়ের বার্তাবাহক হিসেবে তুলে ধরেছেন কবি নজরুলÑ

‘ডাকাত এসেছে যাকাত লইতে , খোলো বাক্সের চাবি

আমাদের নয়, আল্লাহর, দেওয়া ইহা মানুষের দাবি।’

বঞ্চিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নজরুলের উচ্চ কণ্ঠ

‘প্রজারাই রোজ রোজা রাখিয়াছে আজীবন উপবাসী

তাহাদেরই তরে এই রহমত, ঈদের চাঁদের হাসি।

শুধু প্রজাদের জমায়েত হবে আজিকার ঈদগাহে

কাহার সাধ্য, কোন ভোগী রাক্ষস সেথা যেতে চাহে?’

মনুষ্যতের বর্তমান বিনাশী চিন্তায় নজরুলের বাণী কাঁদে নিরবে নিভৃতে। অনেকক্ষেত্রে যাকাত, ফেতরাসহ অন্যান্য দান করুণা ও দয়ার পর্যায়ে বিবেচিত হয়। গার্মেন্টস কর্মীসহ অনেক শ্রমজীবী মানুষকে ঠিকমত বোনাস বেতন দেয়া হয় না। সরকার প্রদত্ত চাল, টাকাও গরিবরা পুরো পায় না। আত্মাসাত করেন বিতরণে দায়িত্ববানগণ। সরকারের সদিচ্ছা লোভীদের কারণে পূর্ণতা পায় না। অন্যদিকে দিনান্ত পরিশ্রম করেও ন্যায্য মজুরী না পাওয়া, সরকারি সহায়তা বঞ্চিত মানুষরা ইদ আনন্দে শরীক হতে পারে না। অধিকার কেড়ে নায়া দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকারী অসৎ মানুষদের তেমন শাস্তিও হয় না, বিবেকও জাগে না।

আমাদের অনুদার মানসিকতার প্রতাপে দরিদ্ররা ইদ আনন্দ পুরোটা উপভোগ করতে পারে না। এ অবস্থার পরিবর্তনে শুধু অতীত সুখের স্মৃতি তর্পণ নয়, প্রয়োজন অধিকার আদায়ের মনেবৃত্তি। নিজ অধিকার আদায়ে অবহেলিতরা জোটবদ্ধ না হলে বর্তমান ধারাবাহিকতায় ছেদ আসবে না। পাশাপাশি মনুষ্যত্বের কল্যাণময় চিন্তা, দরদবোধ জাগ্রত করা দরকার স্বাবলম্বীদের। ইদের সাম্য চিন্তা, সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব নিছক বিবরণের না হয়ে আচরণীয় হওয়া উচিৎ। গরিবদের আনন্দ উপভোগের বিষয়টি করুণার দৃষ্টিতে না দেখে অধিকার হিসেবে বিচার করা সময়ের অন্যতম দাবী। সরকার, ধর্মবেত্তা, সুশীল সমাজ, সাংস্কৃতিককর্মীগণ যদি বিত্তবানদের দায়বদ্ধতা বিষয়ে সচেতন করতে থাকেন, নিজেরাও যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন, তা হলে বিবেকের জাগরণ আসবে, ঘটবে মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন, ইদের আনন্দ আর সীমাবদ্ধ থাকবে না বিত্তবানদের আঙিনায়, তা হবে সবার, কেউ অধিকারহারা হবে না, ইদ হবে সবার।

(লেখক বিশিষ্ট সাহিত্যিক, ভূতপূর্ব অধ্যাপক, বাংলা , কারমাইকেল কলেজ,রংপুর)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *