আনন্দ করতে উপলক্ষ লাগে কি? নাকি উপলক্ষ ছাড়াও আনন্দ করা যায়? তা যায় বৈ কি। ধরুন আপনার আজ হুট করে মন ভালো হয়ে গেল। আপনি এ খুশিতে গায়ে সেন্ট মেখে বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলেন। কিন্তু এই আনন্দ পাশের বাড়ির ইমনের না। তার আজ মন খারাপ কারণ তার পোষা বিড়ালটা মারা গেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে একেক জনের জন্য আনন্দ একেকদিন। সবার মাঝে সেই আনন্দ নিয়ে আসে ইদ। একমাত্র বলব না,পহেলা বৈশাখ, নিউ ইয়ারও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে একই দিনে সমান আনন্দের বারতা নিয়ে আসে। ইদ বছরে দুটো। এক মাস কঠিন সিয়াম সাধনার পর ইদ-উল-ফিতর আর ত্যাগের মহিমা নিয়ে ইদ-উল-আযহা। সিয়াম বা রোজা পালন শারীরিকভাবে সুস্থ সকল মানব সম্প্রদায়ের জন্য ফরজ করা হয়েছে। কিন্তু কেন?
বিষয়টা এক সময় ভাবা হতো, আমিও শুনেছি মুরুব্বিরা বলেছে, আমাদের মাঝে অনেকে অনাহারে থাকে, রোজা আসলে আমরাও তাদের মতো অনাহারে থাকি ফলে তারা যে কষ্টটা ভোগ করে আমরাও সেটা অনুভব করি, ফলে এক ধরনের সহমর্মিতা গড়ে ওঠে। আবার অনেকে বলে, মুসলমানরা যোদ্ধা জাতি, যুদ্ধের সময় দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে হতে পারে আবার ধর্ম প্রচারের জন্য সফরেও খাদ্য প্রাপ্তির অনিশ্চিয়তা। তাই তার যদি এই ট্রেনিং থাকে তবে সে সহজেই কাবু হবে না। বর্তমান বিজ্ঞান অবশ্য ভিন্ন কথা বলছে, জাপানি বিজ্ঞানী প্রফেসর ইয়োশিনোরি ওহসুমি অটোফ্যাজি( Autophagy) প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করার জন্য ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। এটা বুঝতে হলে বুঝতে হবে অটোফ্যাজি আসলে কী?
অটোফ্যাজি আসলে কোষের নিজেই নিজেকে ধ্বংস করা, যা অন্তর্বর্তী উপবাস দ্বারা বৃদ্ধি পায়। মানব বিবর্তনের মাধ্যমে একটি সংরক্ষিত মৌলিক সেলুলার ফাংশন যেখানে কোষের মধ্যে উপস্থিত লাইসোসোমগুলি তার নিজস্ব ক্ষয় এবং পুনরুদ্ধার করে। কোষের ভিতরের (ক্ষতিগ্রস্ত অর্গানেল, মিউট্যান্ট এবং অসুস্থ প্রোটিন ইত্যাদি) এবং বহিরাগত জীবাণু (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি)। এই জাতীয় প্রক্রিয়াগুলির শেষে ক্ষতিকারক পণ্যগুলি নিরীহ সহজ অণুতে ভেঙে যায়, দরকারি পদার্থগুলি ধরে রাখা হয় এবং পুনরায় ব্যবহার করা হয়। এর ফলে শরীরের ক্ষতিকর বস্তু, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস শরীর থেকে দূরীভুত হয় এবং উপকারী বস্তু শরীরে থেকে যায়। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁর এক হাদিসে বলেছেন, “মাতৃগর্ভ থেকে শিশু যেমন নিষ্পাপ হয়ে ভূমিষ্ঠ হয়, রমজানের রোজা পালন করলে মানুষ ঠিক তেমনি নিষ্পাপ হয়ে যায়।”
রমজানের উপহার হিসেবে মুসলমানদের ঘরে আসে ইদ। গ্রামে এখনও বড় ময়দানে ইদের নামাজ হয় বলেই মাঠগুলো, ইদগাহ মাঠ নামেই সমাদৃত। সেই মাঠে থাকে বড়বড় বট-পাকুড় গাছ। তারই ফাঁকে বিছানো হয় সাদা লম্বা-লম্বা কাপড়। সেখানে দাঁড়িয়ে সবাই নামাজ পড়ে। পাশেই বসে ছোটখাটো মেলা। মাটির খেলনাপাতি, বাদাম, চানাচুর, জিলাপি, পাপড়ভাজির পশরা নিয়ে বসে প্রধানত হিন্দু ধর্মাবলম্বী দোকানদারেরা। শিশুদের পোয়াবারো। নামাজ না পড়ে, মেলায় চক্কর দিতেই তাদের আনন্দ। শহরের ইদ যদিও অনেক জায়গায় মানে জেলা শহরগুলোতে ইদগাহ মাঠেই হয় তবে ঢাকা শহরে মাঠ কোথায় পাবে, সব তো দখলদারদের দখলে ফলে ইদ হয় মসজিদে। গম্ভীরমুখে হাতে জায়নামাজ, পরনে দামি পাজামা পাঞ্জাবি পরে তারা নামাজ পড়তে যায় আবার গম্ভীর মুখেই বাসায় ফিরে আসে। তাদের দেখে বোঝার উপায় নাই যে, এটা কোনও আনন্দের দিন। ইদের কথা ভাবলেই আসে কোলাকুলির কথা। কোলাকুলি করা সুন্নত। এ বিষয়ে বিজ্ঞান কী বলে?
গবেষণায় দেখা গেছে কোলাকুলি করলে মানসিক চাপ হতে রক্ষা পাওয়া যায়। ক্লান্তি দূর হয়। অক্সিটোসিন হরমন নিঃসরণের কারণে মন আনন্দে ভরে ওঠে। ডোপামিন নিঃসরণের কারনে পারকিন্সনিজম রোগ হবার সম্ভাবনা কমে যায়। কোলাকুলিতে সেরোটোনিন হরমন নিঃসরণ বাড়ার কারনে মানসিক শান্তি বৃদ্ধি পায়, মন আনন্দে ভরে থাকে। এজন্য বলা হয় দিনে অন্তত আট বার কোলাকুলি করা প্রয়োজন। ইদ ছাড়া সে সুযোগ কই? রমজানের ফলে শরীর থেকে অতিরিক্ত মেদ ঝরে পড়ার কারণে শরীর থাকে চনমনে।
ইদের দিন গ্রামে গরীব বড়লোক সবার বাড়িতেই সেমাই হয়। সে সেমাই খাওয়া হয় চালের আটা দিয়ে। সুস্বাদু সে রুটির স্বাদ জিভে লেগে থাকে সারাজীবন। সাধারণত মা-বোনেরা গোল হয়ে বসে এ রুটি কেউ বানায় কেউ সেকে নেয়। রুটি সেমাই অথবা মুড়ি সেমাই খেয়ে সবাই ইদগাহ মাঠের দিকে যায়। ইদগাহ মাঠ হয়ে ওঠে দেখা সাক্ষাতের স্থান। পেটের দায়ে গ্রামের বহু লোক ঢাকার গার্মেন্টসে কাজ করে। ইদ তারা গ্রামের বাড়িতে করতে চায় পরিবারের সাথে। খুবই নির্মল চাওয়া কিন্তু সেই সাধারণ চাওয়াটাও রাষ্ট্র পূরণ করতে পারছে না। টিকিটের মূল্য দ্বিগুণ, পথে পথে যানজট। রংপুর থেকে ঢাকা আসতেই সময় লাগে পনেরো-ষোলো ঘন্টা। দেশে দূর্নীতি যে কি পরিমাণ বেড়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন দেখি রেলওয়ের অনলাইন টিকিটিং এ জড়িত সহজ অনলাইনের একজন ভাই বছরে দুই-তিন হাজার টিকিট সরিয়ে কালোবাজারে বিক্রি করেন। সুখের কথা দুই একটা চুনোপুঁটি ধরা পরছেন তবে রাঘব বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে।
তারপরও ইদ আসে। বাংলাদেশের বাঙালিদের অধিকারবোধ কম থাকায় তারা মেনে নিয়ে হাসিমুখে ইদের নামাজ আদায় করে। বাড়ি ফিরে যাওয়া আবার সেই একই কাহিনি। যুগযুগ ধরে এই চলে আসছে।রাজনৈতিক নেতার আসর গরম করা বক্তৃতায় চেয়ারে বসে নিতম্ব গরম হওয়া ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন হয় না। তবুও ঠিক উনত্রিশ রোজার দিন ইফতারের পর আমরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকব পশ্চিম দিকে,হয়তো ভেসে উঠবে ইদের বাঁকা চাঁদ। হয়তো—–।
ডা. ফেরদৌস রহমান পলাশ
লেখক ও চিকিৎসক, রংপুর।