অমর একুশে: চিরায়ত কবিতামালা

একুশের স্বীকারোক্তি

শহীদ কাদরী

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ ; 419 Views

যখন শত্রুকে গাল-মন্দ পাড়ি

কিম্বা অযথা চেঁচাই,

আহ্লাদে লাফিয়ে উঠে

বিছানায় গাড়াই; মধ্য-রাতে তেরাস্তায় দাঁড়িয়ে

সম্মিলিত কণ্ঠে চীৎকারে দিনে দিনে জমে ওঠা উষ্মাকে

অশুভ পেঁচক ভেবে উদ্বিগ্ন গৃহস্থের মতো

সখেদে তাড়াই আর সাঁতার কাটতে গিয়ে

সখের প্রতিযোগিতায় নেমে মাঝ-নদীতে হঠ্যাৎ

শবে-বরাতের শস্তা হাউই-এর মতো দম খরচ হয়ে গেলেে

উপকূলবাসীদের সাহায্যের আশায়

যখনই প্রাণপণে ডাকি,

অথবা বক্তৃতামঞ্চে (কদাচ সুযোগ পেলে) অমৃত ভাষণে

জনতাকে সংযত রেখে অনভ্যস্ত জিহ্বা আমার

নিষ্ঠীবনের ফোয়ারা ছোটায়

অথবা কখনো রঙ্গোমঞ্চের আলো নিভে গেলেে

আঁধারের আড়াল থেকে যেসব অশ্লীল শব্দ ছুঁড়ে মারি,

এবং উজ্জ্বলমুখো বন্ধুদের ম্লান করে দেয়ার মতো কোনো

নিদারুণ দুঃসংবাদ জানিয়ে

সশব্দে গান ধরি,

মিছিল প্রত্যাগত কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে শাসাই,

উর্ধ্বশ্বাসে ট্যাক্সির মুখে ছিটকে-পড়া

উর্ধ্বশ্বাস ট্যাক্সির মুখে ছিটকে-পড়া

দিকভ্রান্ত গ্রাম্যজনের চকিত, উদ্বেল মুখ দেখে

টিটকারিতে ফেটে পড়ি

অর্থাৎ যখনই চীৎকার করি

দেখি, আমারিই কণ্ঠ থেকে

অনবরত

ঝ’রে পড়ছে অ, আ, ক, খ

যদিও আজীবন আমি অচেনা ঝোড়ো সমুদ্রে

নীল পোষাক পরা নাবিক হ’তে চেয়েে

আপাদমস্তক মুড়ে শার্ট-পাৎলুন

দিনের পর দিন

ঘুরেছি পরিচিত শহরের আশেপাশে,

স্বদেশের বিহ্বল জনস্রোতে

অথচ নিশ্চিত জানি

আমার আবাল্য-চেনা ভূগোলের পরপারে

অন্য সব সমৃদ্ধতর শহর রয়েছে,

রয়েছে অজানা লাবণ্যভরা তৃণের বিস্তার

উপত্যকার উজ্জ্বল আভাস,

বিদেশের ফুটপাথে বর্ণোজ্জ্বল দোকানের বৈভব,

মধ্যরাত পেরুনো আলো-জ্বলা কাফের জটলা,

সান্টাক্লজের মতো এভিনিউর দু’ধারে

তুষারমোড়া শাদা-বৃক্ষের সারি

নিত্য নতুন ছাঁদের জামা-জুতো,

রেস্তোরাঁর কাঁচের ওপারে ব’সে থাকা বেদনার স্ফুরিত অধর

আর মানুষের বাসনার মতো উর্ধ্বগামী

স্কাইস্ক্রেপারের কাতার-

কিন্তু তবু

চরুট ধরিয়ে মুখে

তিন বোতামের চেক-কাটা ব্রাউনরঙা সুট প’রে,

বতাসে উড়েয়ে টাই

ব্রিফকেস হাতে ‘গুডবাই’ বলে দাঁড়াবো না

টিকিট কেনার কাউন্টারে কোনোদিন-

ভুলেও যাবো না আমি এয়ারপোর্টের দিকে

দৌড়ুতে- দৌড়ুতে, জানি, ধরবো না

মেঘ- ছোঁয়া ভিন্নদেশগামী কোনো প্লেন।

 

[শহীদ কাদরী (১৪ আগস্ট ১৯৪২ – ২৮ আগস্ট ২০১৬) ছিলেন বাংলাদেশী কবি ও লেখক। তিনি আধুনিক নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিক অভিব্যক্তির অভিজ্ঞতাকে কবিতায় রূপ দিয়েছেন।]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *