মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

ঠাকুরগাঁও জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

হাবিবা বেগম

১৬ ডিসেম্বর, ২০২২ , ৫:২৬ অপরাহ্ণ

ঠাকুরগাঁও জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

১৮৬০ সালে ঠাকুরগাঁওকে মহকুমায় রূপান্তরিত করা হয় ১০টি থানা নিয়ে। প্রসঙ্গত উলেখ্য যে, বাঙালি জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো একটার পর একটা রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠিত হয় এবং প্রতিটি আন্দোলনেই ছিল ঠাকুরগাঁও জনসাধারণের সক্রিয় ভূমিকা। ঠাকুরগাঁও মহকুমা ছিল দিনাজপুর জেলার অর্ন্তভূক্ত। পরে ১৯৮৪ সালে ফেব্রæয়ারি মাসে ৫টি থানা বা উপজেলা নিয়ে গঠিত হয় ঠাকুরগাঁও জেলা। উপজেলাগুলো হচ্ছেঠাকুরগাঁও সদর, পীরগঞ্জ, বালিয়াডাঙ্গী, রানীশংকৈল হরিপুর। ঠাকুরগাঁও জেলায় রুহিয়া নামক আর একটি থানা আত্মপ্রকাশ করে ২০১৩ সালে। বর্তমানে ঠাকুরগাঁও জেলায় ৫টি উপজেলা ৬টি থানা। ঠাকুরগাঁও জেলায় সর্বত্রই ছিল কম বেশি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি। এই জেলায় বিভিন্ন ধর্ম গোত্রের মানুষ বসবাস করে।

বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটলে ১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশে সৃষ্টি হয় দুটি রাষ্ট্রভারত পাকিস্তান। এরপর৫২এর ভাষাআন্দোলন, ৫৪এর নির্বাচন, ৬৬এর দফা, ৬৯এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০এর সাধারণ নির্বাচন। অবশেষ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভুদ্যয় ঘটে। জন্ম হয় এক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এটা বলা অবশ্যই অত্যুক্তি নয় য়ে, অত্যাচার শোষণ ষড়যন্ত্র চিরকালই অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সুপ্ত শক্তির বহি:প্রকাশ ঘটায়। পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এটার ব্যতিক্রম হয়নি। 

 ঠাকুরগাঁও যখন দিনাজপুর জেলার আওতাভূক্ত একটি মহকুমা ছিল তখন থেকে বঙ্গবন্ধুর আগমন পত্রিকা অনুসন্ধানে পাওয়া যায় ১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ সাল থেকে তিনটি সফরের তথ্য। ১৯৬৪ সালের মে, ১৯৬৯ সালের ১২ অক্টোবর এবং ১৯৭০ সালে ২২ অক্টোবর ঠাকুরগাঁও আসেন এবং তিনি বিভিন্ন স্থানে তাঁর ¦ালাময়ী বক্তব্য দেন। আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের উল্লেখ করে ন্যায্য দাবী আদায়ের শেষ নিয়মতান্ত্রি সংগ্রামের কথা বলেন।২ এরপর থেকেই ঠাকুরগাঁওবাসী আওয়ামী লীগ সরকার তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের প্রতি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে এবং ছাত্র, রাজনীতিবীদ, সাধারণ জনগণ আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে একাত্বতা ঘোষণা করে।      বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রদত্ত দফা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা মিলে আন্দোলন অত্যন্ত গতি লাভ করে। গোটা মহকুমার বিভিন্ন থানায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে কমিটি গঠন করা হয় এবং অভূতপূর্ব গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে দফা দাবির ¯øাগান উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জয়ী হলো। আর তখন থেকেই রাজনীতিবিদ ছাড়াও সামরিক জেনারেলরা ১৯৭১ সালের মার্চ মাস নাগাদ গণপরিষদের বাহিরে নানা ধরণের কর্মকান্ডে লিপ্ত হল। এর পেক্ষাপটে দেখতে পাই যে, সমস্ত ধরণের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ায় পাকিস্তানের সামরিক জান্তা চরম পন্থা গ্রহণ করল। ১৯৭১ সালে ২৫ শে মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানের দখলদারী বাহিণী পূর্ববঙ্গে শুরু করল গণহত্যা। ফলে নির্বাচিত সংখ্যাগুরু দলের নেতা হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণহত্যা মোকাবিলায় আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন।৩ ঠাকুরগাঁও মহকুমা থেকেও ১৯৭০এর নির্বাচনে জনাব মোশারফ হোসেন চৌধুরী জনাব মো. আজিজুর রহমান এমএনএ এবং জনাব কমর উদ্দিন ইসলাম, জনাব সিরাজুল ইসলাম, জনাব মো. ফজলুল করিম জনাব মো. ইকরামুল হক এমপিএ নির্বাচিত হন।৪ এই সময় থেকেই ঠাকুরগাঁওয়েও নিয়মিত মিটিং মিছিল জনসভা করতেন বাঙালি জনতাকে উদ্ভুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে। আর এই আন্দোলন এখানকার মানুষকে আরও উজ্জীবিত করে এবং স্বাধীনতা আদায়ে দাবি সম্বলিত নানা শ্লোগানে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।

মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করলে ঠাকুরগাঁও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রলীগএর নেতৃত্বে প্রথমে প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। মিছিল শেষে ঠাকুরগাঁও হাইস্কুলে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২রা মার্চ ঠাকুরগাঁওএর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট প্রতিবাদ মিছিল হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী ৩রা থেকে ৬ই মার্চ প্রতিদিন আন্দোলেনের নানা কর্মসূচী পালিত হয়। সময় একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে বিভিন্ন স্থানে নিহতদের স্মরণে ঠাকুরগাঁওয়ের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন বাসভবন দোকানে কালো পতাকা উত্তোলন কালো ব্যাজ ধারণ করা হয়। এসবের মাধ্যমে গোটা জনপদ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। শুরু হয় আন্দোলন। ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এদিন প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল লতিফ মোক্তার এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশীদ মোক্তার এখানে বত্তৃতা করেন। সভাপতিত্ব করেন ছাত্রলীগ সভাপতি এইচ এম জর্জিসুর রহমান খোকা। ছাত্রনেতা , এইচ, এম, জর্জিসুর রহমান খোকা সাক্ষাৎকারে বলেন, ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ সরাসরি রেডিওতে প্রচারিত না হওয়ায় ঠাকুরগাঁওবাসী বিক্ষুদ্ধ হয় তবে কিছুকিছু সচেতন নাগরিক সেইদিনই বিবিসি, আকাশবাণী কলকতা থেকে শুনেছিলেন। পরেরদিন ৮ই মার্চে ভাষণটি প্রচারিত হলে সকলেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে।

৭ই মার্চের ভাষণ শোনার জন্য ঠাকুরগাঁও থেকে বিভিন্ন সংগঠন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ঢাকায় গিয়েছিলেন। তাঁরা ৯ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ক্যাসেট নিয়ে ফিরে আসেন। মাইকে সে ভাষণ প্রচার করা হয় ফজলুল করিম এমপিএ সাহেবের বৈঠকখানা থেকে। ঠাকুরগাঁওবাসী ভাষণ শোনার পর ঐদিনই মিছিল বের করে এবং মিছিলটি সমস্ত শহর ঘুরে কালিবাড়ি হাটের পশ্চিমে পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে এসে শেষ হয়। মার্চ অফিসআদালত, ব্যাংকবীমা, স্কুলকলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন। মহল্লায় মহল্লায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। ১০ মার্চ এমপিএ ফজলুর করিমের অনুরোধে ঠাকুসগাঁও হাইস্কুলের শিক্ষক এম. ইউসুব ছাত্র, যুবকদের রাইফেল ট্রেনিং দিতে শুরু করেন। ১১ মার্চ জেলখানা খুলে দিলে কয়েদিরা আন্দোলনে যোগ দেয়। ২২ মার্চ পর্যন্ত এভাবেই চলে। ২৩ মার্চ মহকুমা প্রশাসককের কার্যালয়ে পতাকা উত্তোলন করা হয়। থানা ভবনে পতাকা উত্তোলনে অবাঙালি প্রহরি কতৃক বাধাপ্রাপ্ত হলে তৎকালীন ওসি আবদুল গফুর নিজেই পতাকা উত্তোলনের ব্যবস্থা নেন।৬ ২৪ মার্চ ঠাকুরগাঁওয়ে ছাত্রজনতার সকাল থেকেই উত্তাল মিছিল, মিছিলের সামনে মাঝে দেখা গেল সদ্য উত্তলনকৃত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ২৫ মার্চ পূর্বের ন্যায় মিছিল, মিটিং চলতে থাকে। শ্লোগানের পর শ্লোগান দিতে থাকে স্বাধীনতাকামী মুক্তি পাগল জনতা। তখনও জানত না ২৫ মার্চের সার্চলাইটের কথা।                      

২৫ এবং ২৬ মার্চের ঢাকার খবর জানতে না পেরে সকাল / টা নাগাদ নেতাকর্মীরা ফজলে করিম এম. পি. সাহেবের বৈঠকখানায় সমবেত হয়ে একটা ভীতিকর উত্তেজনা আর আলোচনার মাধ্যমে অপেক্ষা করতে থাকল সময়ের। তবে ২৫ মার্চের কাল রাত্রিতে ঢাকার পাকিস্তান হানাদান বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার খবর এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উক্ত স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ মার্চের দিনের বেলার মধ্যপ্রহর থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে শুনতে পায় বলে জানিয়েছেন ঠাকুরগঁওয়ের ছাত্রনেতা , এইচ, এম জর্জিসুর রহমান খোকা এবং মো. আব্দুল গোফরান। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা বার্তাটি শুনে এবং বর্বরোচিত আক্রমণে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর খবর জানতে পেরে শুরু হয়ে যায় সশস্ত্র

২৭ মার্চ কারফিউ ভেঙে সকাল থেকে জনতার ভিড় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। চারিদিক থেকে Ð Ð মিছিল এসে মূল মিছিলে যোগ দিচ্ছিল। ঠাকুরগাঁওয়ের তৎকালীন সি. (ডেভ) আব্দুল ওহাব আন্ধার মানিক  ‘অমর কাহিনীকার গ্রন্থের শহিদ আলী সড়কনামক গ্রন্থে তাঁর অনুভূতিপ্রবণ লেখায় বলেছেন, ‘বেলা ১২ টা বেজে ১০ মিনিট। কেরামত আলীর মোক্তার সাহেবের বাসার সামনে মিছিলটি এসে থেমে গেল। দক্ষিন দিক থেকে দ্রæ বেগে ধেয়ে আসছিল একটি জীপ এক লরী সৈন্য। মেজরের জীপটা এসে সামনে থামল। উইং কমাÐার মেজর মোহাম্মদ হোসেন ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম জীপ থেকে নামলেন। তাদের দেখে মিছিলে অংশগ্রহণকারী জনতা যেন বারুদের মত ¦লে উঠল। মিছিল থেকে অসীম সাহসী, বলিষ্ঠদেহী মুখে চাঁপদাড়ি মধ্য বয়সের মোহাম্মদ আলী নামের এক রিক্সা চালক সামনে চলে আসে। মেজর মোহাম্মদ হোসেনের সামনে গিয়ে দৃপ্ত অকুতোভয় স্পষ্ট আওয়াজে চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা।সাথে সাথে পরপর তিনটি গুলির শব্দ হলো। একটা বিকট চিৎকার দিয়ে লুটিয়ে পড়লো একটি দেহ।এই রিকশাচালকই ঠাকুরগাঁওয়ের প্রথম শহিদ।

জনতার আন্দোলন দমন করতে ২৮ শে মার্চ শহরে ইপিআর টহল গাড়ি বাজার পাড়ার কাছ দিয়ে যাচ্ছিল তখন বছরের নরেশ চৌহান তাদের জীর্ণ কুড়ে ঘড় থেকেজয় বাংলাশ্লোগান দিলে প্রাণ হারায়। ঘটনায় সংগ্রামী জনতার ক্ষোভ চরমে পৌঁছে। এদিন রাত ১০টার পর ইপিআরএর বাঙালি সৈনিকরা বিদ্রোহ করে ক্যাম্প থেকে করে বেরিয়ে আসেন। তাঁরাজয় বাংলা’, জনতা ইপিআর ভাই ভাইশ্লোগান দেন। তাঁরা চিৎকার করে বলতে থাকেনআমরা রিভোল্ট করেছি’, ‘আপনারা ঘর থেকে বেরিয়ে আসুন তখনো অবিরাম গুলি চলছিল। এভাবেই ঠাকুরগাঁওবাসী অনেক সাহসী হয়ে ওঠেছিল।                                                                                                                  

ঠাকুরগাঁও ইপিআর হেডকোয়ার্টাসে ২৮ শে মার্চ রাত ১০টার পর বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করে পশ্চিমা সেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাঙালি সেনাদের কাছে আগেই খবর ছিল যে, রাতে তাঁরা আক্রান্ত হতে পারেন। ফলে আক্রান্ত হবার আগেই তাঁরা শত্রæদের আক্রমণের সিদ্ধান্ত করেন। ২৮ শে মার্চ থেকে ৩০ শে মার্চ পর্যন্ত বাঙালি সেনাদের হাতে বহু পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। ইপিআর ৯ম উইং ঠাকুরগাঁওএর উইং কমান্ডার ছিল পাঞ্জাবি মেজর মোহাম্মদ হোসেন এবং সেকেন্ডইনকমান্ড ছিল ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম। মেজর মোহাম্মদ মোহাম্মদ হোসেন ৩০ শে মার্চ বেলা ৩টা নাগাদ তার কোয়ার্টারে নিহত হয়। ক্যাপ্টেন নাবিদ সপরিবারে সৈয়দপুর সেনা ছাউনিতে পালিয়ে যাওয়ার সময় ঠাকুরগাঁও থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে খোঁচাবাড়ি এলাকায় জনসাধারণের হাতে সোপর্দ করা হলে তারও একই পরিণতি হয়। ঠাকুরগাঁওএর উইং এর অপারেশনে ১১৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এর মধ্যে ইপিআর ১০৪ জন। অন্যদের মধ্যে সেনাবাহিনীর জন এবং বিমান বাহিনীর জন। এদের অধিকাংশই ছিল কমিশন, জুনিয়র কমিমশন, নন কমিশন প্রাপ্ত অফিসার।৮ ঠাকুরগাঁওএর বাঙালি সেনাদের সাফল্য জনসাধারণের মনে ব্যপক প্রাণ সঞ্চার করে ৩১ মার্চ সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন কোমান্ড গ্রহণ করেন।

অবাঙালি অধ্যুষিত সৈয়দপুর এবং সেখানে অবস্থিত ক্যান্টনমেন্ট তখন পাকিস্তানিদের দখলে ছিল। তাদের অস্ত্র গোলাবারুদ এর তুলনায় ঠাকুরগাঁওএর ইপিআর ক্যাম্পে খুবই কম গোলাবারুদ ছিল। তবুও সৈয়দপুরের কাছে প্রতিরোধব্যূহ তৈরি করে বাঙালি ইপিআর বিদ্রোহীরা পাকবাহিনীকে বেশকয়েকদিন ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। ১৪ এপ্রিল পাকসেনারা ভারি অস্ত্র নিয়ে ভাতগাঁ ব্রিজের কাছে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। একসময় বাধ্য হয়ে তাঁদের পিছু হটতে হয়। অবশেষে ১৫ই এপ্রিল ঠাকুরগাঁও অনুপ্রবেশ করে। ডাকবাংলা ইপিআর ক্যাম্পে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। আরসিও অফিসে আলবদরদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এছাড়াও থানার আরও অন্য স্থানে কয়েকটি রাজাকার স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্যাম্প ঘাঁটি ছিল। এসব ক্যাম্প থেকেই হত্যা, নির্যাতন,ধর্ষণ, লুন্ঠন অগ্নিসংযোগ চালায়।৯ ঠাকুরগাঁও উপজেলায় সবচাইতে বড় গণহত্যা জাটিভাঙ্গা গণহত্যা। এখানে ২০০০ থেকে ২৫০০ মানুষকে হত্যা করা হয়। এছাড়াও রয়েছে টাঙ্গন ব্রিজ সংলগ্ন বধ্যভূমি, ফারাবাড়ি গণকবর, রুহিয়া রমানাথ হাটের গণকবর, বর্তমান পুলিশ লাইনের পূর্ব পাশে সাত জনের জোড়া কবর, ভেলাজান ভক্তি নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত একটি গণকবর এবাদেও রয়েছে আরও অনেক কবর।

ঠাকুরগাঁও ইপিআর ক্যাম্প ছিল আর একটি নির্যাতন কেন্দ্র। এখানে একটি বাঘের খাঁচায় দুটি পূর্ণ বয়স্ক চিতাবাঘ দুটি শাবক ছিল। এখানে প্রায় ৫০জন মানুষকে খাঁচায় ঢুকিয়ে খাওয়ানো হয়। পীরগঞ্জের তরুণ সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধাকে পাশবিক নির্যাতনের পর ছুঁড়ে দেয় বাঘের খাঁচায়। টেনেছিঁড়ে সেখানেই তাঁকে খেয়ে ফেলে। বাঘের খাঁচায় ঢোকানোর পরও বেঁচে গিয়েছিলেন এমন দুজন হলেন শফিকুল আলম চৌধুরী সিরাজদৌল্লা।১০ সিরাজদৌ এখনও বেঁচে আছেন।

পীরগঞ্জে মার্চের শুরুতেই মো. ইকরামুল হক এমপিএ, ডা. আব্দুল রাজ্জাক, অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফাসহ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছাত্রযুবকদের সংগঠিত যুদ্ধের জন্য তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। প্রশিক্ষণ দেন অত্র থানার সুবেদার নায়েক। ১৭ এপ্রিল পাকবাহিনী পীগেঞ্জে অনুপ্রবেশ করে। এদিন তারা অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফাসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজনকে হত্যা করে, অনেক বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করে। ২৫ এপ্রিল পাকবাহিনী কলেজে, গোদাবাড়ি, শিয়ালগাজী, বাঘমারা, মশালডাঙ্গী, মিলন বাজার সাগুনীতে ক্যাম্প স্থাপন করে। কুঠিবাড়ি মশালডাঙ্গীতে রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। এছাড়াও পাকবাহিনী শহরে ৮টি বড় ব্যাংকার তৈরি করে প্রতিরক্ষাব্যূহ সৃষ্টি করেছিল। ক্যাম্পগুলো ছিল নির্যাতনের কেন্দ্র। এছাড়া পাকবাহিনী রাজাকারদের দ্বারা অনেক নারী ধর্ষণের স্বীকার হন। মাসে পীগেঞ্জ ২০ হাজারেরও বেসি মানুষকে হত্যা করে। এখারকার উল্লেখযোগ্য বধ্যভূমিগুলো রাইসমিল থেকে ব্রিজ পর্যন্ত স্থান, কলেজের পুকুর, ছাত্রাবাস সংলগ্ন পুকুর, বিশ মাইল, জামালপুর ফার্ম, খামার সেনুয়া, আজাদ স্পোটিং ক্লাবের পার্শে ভাস্কর্য শহিদ মিনার সংলগ্ন স্থান, লোহাগাড়া চার্চ, শিমুলবাড়ি এবং চানপুর। সবচেয়ে বড় গণকবর মুক্তিযোদ্ধা পুকুর কলেজ হোস্টেলের পুকুর। আংরা হাটেও গলকবর রয়েছে। এছাড়াও পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধা সালাউদ্দিনকে আটক করে দিন যাবত বর্বর নির্যাতনের পর ১০ নভেম্বর ঠাকুরগাঁও ক্যাম্পে পাঠানো হয়। ১১ নভেম্বর বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করে।১১

বালিয়াডাঙ্গীতে আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের অন্য স্থানীয় নেতারা মুক্তিযুদ্ধের মূল সংগঠক। এঁদের নেতৃত্বেই মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ১৪ই এপ্রিল পাকবাহিনী বালিয়াডাঙ্গীতে অনুপ্রবেশ করে এবং ২০ এপ্রিল বালিয়াডাঙ্গী থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। পরে একইদিনে পারিয়া রোডে, দুলুয়াহাট, ধনতলা, খোচাবাড়ী হাঠ, আধারদিঘী এবং খকসায় ক্যাম্প স্থাপন করে। রাজাকারদের অনেকেই ছিল বিহারী। এখানে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ অন্যান্য অপকর্ম চালাত স্বাধীনতা বিরোধীরা সমগ্র উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি সাধারণ মানুষের উপর। থানা ডেভলপমেন্ট অফিস পাকবাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র বন্দিশিবির ছিল। এখানকার উল্লেখযোগ্য গণকবরগুলো হলোবামুনিয়া, কুশলডাঙ্গী, সাপটীহাট, বাঙ্গাটলী, খাদেমগঞ্জ ইত্যাদি স্থানে পাকসেনা রাজাকারদের হাতে নিহত ব্যক্তিদের গণকবর রয়েছে। থানায় অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন।১২

পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য আজিজুর রহমান এমএনএ এর উদ্যোগে রালীশংকৈলে  সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। ২৭ মার্চ থেকে ডাকবাংলার মাঠে ছাত্রযুবকদের সশস্ত্র যুদ্ধের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন আবু সুফিয়ান, সাইফুল ইসলাম নফিজউদ্দিন। মে মাসে পাকবাহিনী রাণীশংককৈলে অনুপ্রবেশ করে থানায় স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়াও ভিবিন্ন স্বাধীনতাবিরোধী বিহারীদের ঘাঁটি ছিল। এরা বিভিন্ন স্থানে হত্যা, গণহত্যা, নারীনির্যাতন অগ্নিসংযোগ করে। এখানে সবচেয়ে বড় বদ্ধভূমি হলোখুনিয়াদিঘি এখানে হাজার মানুষকে হত্যা করে। এছাড়াও রয়েছে কামিপুর, নলদিঘি, মমরেজপুর, শিয়ালগাজী পুকুর, নেকমরদ কুশুমউদ্দিন বালিকা বিদ্যালয়ে গণকবর।১৩ রাণীশংকৈল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও একটি বদ্ধভূমি রয়েছে।

হরিপুরে হামিদুর চৌধুরী, আলী আকবর, আজিজুল হক, কেরামত আলী চৌধুরী প্রমূখের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাÐ বেগবান হয়। এখানে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং আনছারমজাহিদদের সংগঠিত করে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ হয়। ইপিআর সদস্যরা প্রশিক্ষণে সহযোগিতা করে। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে এখানে পাকবাহিনী অনুপ্রবেশ করে এবং যাদুরাণী হাটে ব্যাংকার খনন করে। স্থানীয়রাজাকারআলী বদরবাহিনীর সহায়হায় হত্যাকাÐ নির্যাতন চালায়। জুমারদিন নামাজে গমনরত মুসুল্লিদেরও সুকৌশলে ডেকে নির্মমভাবে হত্যা করে কামার পুকুরে নিক্ষেপ করে। কয়েকটি হত্যাকাÐ তিন শতাধিক লোক নিহত করে। হরিপুরের উল্লেখযোগ্য বদ্ধভূমি যুদ্ধের স্থানগুলো-‘কামারপুকুর বদ্ধভূমিকাঠালডাঙ্গী যুদ্ধ, শিশুডাঙ্গী বিল যুদ্ধ, বজরুজ যুদ্ধ বীরগড় যুদ্ধ। ১৪ বীর মক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল মান্নান বলেন,-ঠাকুরগাঁও ডিসেম্বরের তারিখ শত্রæমুক্ত হয়। সকালে বিজয়আনন্দের মাঝেও সন্তানহারা মা, বিধবা স্ত্রী, নির্যাতিত নারীর কান্নাকাটি শোনা গেলেও আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে  ঠাকুরগাঁওবাসী এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে।

তথ্যসূত্রঃ

.         ফারজানা হক, জাঠিভাঙ্গা গণহত্যা, ১৯৭১ : গণহত্যানির্যাতন আর্কাইভ জাদুঘর ট্রাস্ট, খুলনা, জুলাই ২০২১, পৃ. ১৪

.        আনারুল হক আনা, উত্তরবঙ্গে বঙ্গবন্ধু, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন, রাজশাহী২০২০, পৃ.২৮৫২৯১

.        আনু মাহমুদ, একুশ থেকে স্বাধীনতা, ঝিঙেফুল, ঢাকা প্রথম প্রকাশ, বইমেলা ২০৯, পৃ. ৪০

.        মেহাম্মদ এমদাদুল হক, মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও, জনপ্রিয় প্রকাশনী, ঢাকা, পুনঃমুদ্রণ ২০১৫ পৃ. ৪০

.        মনতোষ কুমার দে, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ Ð, প্রধান সম্পাদক, হারুনঅররশিদ, বাংলাদেশ এসিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা২০২০ পৃ. ১৬২

.        ফারজানা হক, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫১৬

.        মনতোষ কুমার দেপূর্বোক্ত, পৃ. ১৬৫

.        শফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম Ð, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৯৬

.        মনতোষ কুমার দেপূর্বোক্ত, পৃ. ১৬৫

১০.      বিলু কবির, প্রামাণ্য সালাহউদ্দিন, গতিধারা, ঢাকা, ২৬ মার্চ ২০১২, পৃ.১১ এবং ৬২

১১.       মো. আসাদুজ্জামান, ৬ষ্ট Ð, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪২০

১২.      মো. আব্দুল ওয়াহাব, ৭ম Ð, পূর্বোক্ত, পৃ.

১৩.      মো. তাজুল ইসলাম, ৯ম Ð, পূর্বোক্ত, পৃ.১৩২১৩৪

১৪.      মো. ওসমান গনী, ১০ম Ð, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৪৭৩৪৯