মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর বাসীর দুঃসাহসিক ভূমিকা দিনাজপুরের ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটি দিনাজপুরের গর্ব। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল দিনাজপুরে এবং দিনাজপুরে সেই যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল পাকিস্তানিদের দুর্জেয় ঘাঁটি কুঠিবাড়ী ব্যারাক থেকে। কয়েকজন নামহীন, খ্যাতিহীন, পদমর্যাদাহীন বাঙালি ইপিআর জওয়ান শুরু করেছিলেন সেই সংগ্রাম।বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্র্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে অন্যান্য অঞ্চলের মতো দিনাজপুরের সর্বস্তরের জনতা,বিশেষ করে ছাত্র,যুব এবং বুদ্ধিজীবি ও পেশাজীবি স¤প্রদায় মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। ২৫শে মার্র্চের কালরাত্রির অন্ধকারে পাক হানাদার বাহিনীর সুপরিকল্পিত আক্রমণে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনার মতো বড় বড় শহরগুলিতে শুরু হয়েছিল নির্বিচারে গণহত্যা, সর্বত্র জ্বালাও–পোড়াও ও নিষ্ঠুর নির্মম তান্ডব। সেই দুঃসংবাদ দূরের জেলা দিনাজপুরে এসে পৌঁছেছিল যদিও একটু দেরিতে, কিন্তু বারুদের স্তুপে অগ্নিসংযোগ করার মতোই বিদ্যুৎগতিতে প্রতিরোধ যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠেছিল ঢাকা, চট্টগ্রামের পরপরেই দিনাজপুরে।এ সময় দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে অ্যাডভোকেট আজিজার রহমান এমএনএ এবং অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরি পরিষদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন ডা. ওয়াকিল উদ্দিন আহমদ এমএনএ, মোশাররফ হোসেন চৌধুরী এমএনএ এবং এম আব্দুর রহিম এমপি, কমর উদ্দিন আহমদ এমপি, অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম এমপি, মো. ফজলুল করিম এমপি, মো. ইকরামুল হক এমপি, মো. গোলাম রহমান এমপি, এস এম ইউসুফ এমপি, মো. খতিবুর রহমান এমপি, সর্দার মোশাররফ হোসেন এমপি, কাজী আব্দুল মজিদ চোধুরী এমপি প্রমুখ। একমাত্র কাজী আব্দুল মজিদ এমপি ছাড়া অন্যান্য এমএনএ ও এমপিগণ আওয়ামীলীগ দলভুক্ত ছিলেন।আওয়ামী লীগ দলভুক্ত ও আওয়ামী লীগ বহির্ভূত যে সকল প্রভাবশালী নেতা ও কর্মী মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় শামিল হন তাদের মধ্যে বর্ষীয়ান নেতা দুর্গামোহন রায় (প্রাক্তন এমপি), ডা. নইম উদ্দিন আহমদ, অ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন, অ্যাডভোকেট আজিজুল ইসলাম জগলু (আওয়ামীলীগ), ন্যাপপন্থি নেতা গোলাম রহমান, ভাসানীপন্থি নেতা এসএ বারী, তেভাগা আন্দোলনের নেতা গুরুদাস তালুকদার, কমিউনিস্ট নেতা রফিক চৌধুরী, জনগণের নেতা হবি চেয়াম্যান, ছাত্রনেতা এমএ তোয়াব, আসলেহ ভাই, ভাদু ভাই, মজু ভাই, তানু ভাই, দলিল ভাই, জর্জ ভাই, ছুটু ভাই, মাহতাব সরকারের নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া রাজনীতি–নিরপেক্ষ অনেক বুদ্ধিজীবি ও নাগরিকও একাত্ম হন। তাদের মধ্যে বালুবাড়ীর আমিন উদ্দিন আহমেদ, মাড়োয়ারী ব্যবসায়ী ছগন লাল, লোহিয়া, গোপাল ভৌমিক প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।৭ই মার্র্চের পর থেকেই আন্দোলনের পথ ছেড়ে শুরু হয় আক্রমণের প্রস্তুতি। দৈনন্দিন মিটিং–মিছিল ছাড়াও যুবকদের সমন্বয়ে শহরে কয়েকটি গুপ্ত প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। আওয়ামী লীগ কর্তৃপক্ষ গোপনে ৫শ তরুণকে গেরিলা ট্রেনিং দেয়ার কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ কাজের দায়িত্ব দেয়া হয় জর্জ ভাইয়ের উপর। তিনি তখন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত একজন ইপিআর। একাডেমী প্রাঙ্গনে ড্রিল শিক্ষা দেওয়ার ছদ্মাবরণে তরুণদের অস্ত্র শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয় আহমদ আলী খানকে। এছাড়া আনসার ক্লাব, মুজাহিদ ক্লাব এবং শহর ও গ্রামের অনেক সংগঠন ও ক্লাবেও গোপন প্রক্রিয়ায় গেরিলা প্রশিক্ষণের উৎসাহ ছড়িয়ে দেয়া হয়। এভাবে দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও ছাত্র–যুব–শ্রমিক সংগঠনগুলি স্বল্পকালের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। উৎসাহিত হয়ে ওঠেন সচেতন জনসাধারণও।ইতোমধ্যে সৈয়দপুরে বাঙ্গালি–বিহারি দাঙ্গার খবর ছড়িয়ে পড়ে। উত্তরবঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের প্রধান ঘাঁটি ছাড়াও সৈয়দপুর ছিল বিহারিদের বড় একটি আবাসস্থল। সাদা পোষাকে পাকসেনারা বিহারিদের সঙ্গে দাঙ্গায় যোগ দিয়ে বাঙ্গালি নিধনে নেমে পড়ে। এভাবে বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয় সৈয়দপুরের অলি–গলি ও রাজপথ। এ গণ নিধনের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে দিনাজপুর, রংপুর শহরসহ সৈয়দপুরের চারিদিকের গ্রামাঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।উত্তেজনায় ফেটে পড়ে আপামর জনতা।প্রতিশোধের আক্রোশে ফুঁসে ওঠেন ঐ অঞ্চলের নির্ভীক নেতা দীর্ঘকালীন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট এবং তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহ মাহতাব বেগ। তিনি পুত্র ও কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে বন্দুক হাতে সৈয়দপুর সীমান্ত পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং দুর্দমনীয় সাহসে সৈয়দপুর সেনানিবাসের ওপর শুরু করেন এলোপাথাড়ি গুলি। সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য পাল্টা গুলি ছুটে আসে তাদের দিকে। নিহত হন মাহতাব বেগ ও তার সঙ্গীরা। এভাবে আনুষ্ঠানিক মুক্তিযুদ্ধ শুরু না হতেই জনপ্রিয় নেতা মাহতাব বেগ প্রথম শহিদ হন। তার আত্মত্যাগ পাকিস্তানি আক্রমণ প্রতিরোধ ও প্রতিহত করতে প্রেরণা যোগায়। এর কিছু দিনের মধ্যে দিনাজপুরে শুরু হয়ে যায় মারমুখী মুক্তিযুদ্ধ।ঐ সময় দিনাজপুর–রংপুর জেলা সামরিক শাসনের একই সেক্টরের অধীন ছিল। সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স ছিল দিনাজপুর শহরের দক্ষিণ–পশ্চিম উপকন্ঠে কাঞ্চন নদীর পূর্বতীরে প্রাচীন কুঠিবাড়ী ভবনে। তখন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল তারেক রসুল কোরেশী। জুলুম সাগরের পাড়ে রাজাদের নির্মিত জুলুম সাগর কুঠিতে তার বাস ভবন ছিল। অপর পদস্থ সেনা অফিসার ছিলেন মেজর তারেক আমীন। তিনি থাকতেন দিনাজপুর হাইস্কুলের পূর্ব ধারে একটি ভাড়া বাসায়। সিকিউরিটি মেজর রাজা থাকতেন পাহাড়পুরে অমিয় কুঠিতে। এছাড়া মেজর জিলানী, মেজর দুররানী, মেজর নাসের ও আরো ৫/৬ জন সেনা অফিসার ছিলেন যারা সবাই ছিলেন অবাঙ্গালি বা পাঞ্জাবি। কুঠিবাড়ী ব্যারাকের অধিকাংশ জওয়ান ও ছিলেন অবাঙ্গালি।পদস্থ বাঙ্গালি সেনা অফিসার ছিলেন মুষ্টিমেয়। বিভিন্ন সূত্রে যে নামগুলি জানতে পারা যায়, তারা হলেন
হলেন সেক্টর এডজুটান্ট ক্যাপটেন নজরুল হক, মেজর ডা. মাকসুদ হোসেন চৌধুরী, ক্যাপটেন নাজির আহমদ, ক্যাপটেন ইদ্রিস, সুবেদার মেজর আব্দর রউফ প্রমুখ। এছাড়া ছিলেন কোয়ার্টার মাস্টার আবু সাইদ খোন্দকার, হাবিলদার ভুলু, প্লাটুন হাবিলদার নাজেম, সুবেদার আরব আলী, সেক্টর স্টোরম্যান একরামুল হক, হাবিলদার আবুল কালাম, নায়েক আবদুল হাকিম, নায়েক আবদুল আজিজ, হাবিলদার ইসহাক, হাবিলদার রেজাউর রহমান, হাবিলদার আবদুল সোবহান, সিপাহী মোস্তাফিজুর, সিপাহী কাঞ্চন আলী, ল্যান্স নায়েক মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ। সব মিলে বাঙালি ইপিআর ২০/২৫ জনের বেশী হবে না। কুঠিবাড়ীর একই সেনা বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারী হয়েও বাঙালি–অবাঙালি বৈষম্য ছিল প্রকট। বাঙ্গালিরা ছিল পদে পদে উপেক্ষিত, নিগৃহিত। ২৬ মার্চ রাতে দক্ষিণ কোতয়ালীর গদাগাড়ী হাটে সর্বসাধারণের এক বৈঠকে একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হবার তথ্য পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক এবং এমপি আব্দুর রহিমের ‘কে বি এম কলেজ ক্যাম্প’ নামক রচনায়। এ ক্যাম্প গঠনে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন আব্দুর রহিম এমপি। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন আনোয়ার সরকার, ইয়াকুব আলী মাস্টার, গোলাম রহমান মাস্টার, নাদির চৌধুরী, আশরাফ সিদ্দিকী, কামাল হাই, জর্জ ভাই, হবি চেয়ারম্যান, মহিউদ্দিন মাস্টার, বেশার উদ্দিন মাস্টার, ইউসুফ আলী মাস্টার, মো. মহসীন, সেকেন্দার আলী, সফর আলী প্রমুখসহ অনেক বুদ্ধিজীবি,ছাত্র ও যুবনেতা। অনেক বাঙ্গালি ইপিআর, পুলিশ আনসার ও মুজাহিদ সদস্যও এই ক্যাম্পের সঙ্গে জড়িত হন। দিনাজপুরে সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে কেবিএম কলেজ ভিত্তিক সংগঠনটি যুদ্ধ প্রস্তুতির একটি অগ্রণী সাহসী প্রচেষ্টা ছিল।
২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে কুঠিবাড়িতে বরাবরের মতো উৎসবের আয়োজন করা হয়। তবে সেবারের আয়োজনে কিছু ব্যতিক্রম বাঙ্গালি জওয়ানদের মনে সন্দেহের উদ্রেক করে। ২০ মার্চ তারিখে পাকিস্তানি বাহিনীর ফার্স্ট ফিল্ড কোম্পানীর ১৫০ জন সেনা বিশেষ উদ্দেশ্যে দিনাজপুরে এসে পৌঁছায়। তারা বড় মাঠের বদলে সার্কিট হাউস চত্বরে ছাউনি ফেলে, যা আগে কখনো হয়নি। এমনকি প্রজাতন্ত্র দিবসের উৎসবে ঐ সব সেনা কুচকাওয়াজে অংশ নেয়, যা আগে কেবল ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীই প্রদর্শন করত। প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাবার পরও সেনারা সার্কিট হাউস চত্বরেই থেকে যায়। ফলে বাঙ্গালি জওয়ানদের মনে সন্দেহ শংকা আরও ঘনীভূত হয়ে উঠতে থাকে।প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে ভোজের আয়োজন ছিল। আরো ছিল আনন্দ বিনোদনের ব্যবস্থা। কুঠিবাড়ীর পাকিস্তানি অফিসার ও ইপিআরগণ সবাই আমন্ত্রিত ছিল। কিন্তু বলা হলো, পাকিস্তানি সেনা ও অফিসার এবং অবাঙ্গালি ইপিআরগণ ইউনিফরম পরিহিত অবস্থায় অস্ত্রসহ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে করতে পারবেন, কিন্তু বাঙ্গালি ইপিআরগণ তা পারবেন না। তাদের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হবে অস্ত্র জমা দিয়ে সাদা পোষাকে। এ ছাড়া বাঙ্গালি জওয়ানদের জন্য আলাদা জায়গায় বসার ব্যবস্থা করা হয়। এটা ছিল বাঙ্গালি জওয়ানদের এক সঙ্গে বন্দী করার কৌশল। এ মতলব বুঝতে পেরে বাঙ্গালি জওয়ানরা অস্ত্র জমা দিতে অস্বীকার করেন।পাকিস্তানি সেক্টর কমান্ডার কর্নেল কোরেশী ছিলেন ধুরন্ধর এক ব্যক্তি। তার প্রথম পরিকল্পনা এভাবে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি ভিন্ন পথ ধরলেন। বাঙ্গালি জওয়ানদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে তিনি পরের দিন ২৪ মার্চ তারিখে ব্যারাক সংলগ্ন আম বাগানে আম দরবার আহবান করেন। সঙ্গে কারো হাতিয়ার থাকবে না, আসতে হবে সিভিল পোষাকে। বাঙ্গালি ইপিআরদের কটাক্ষ করে শুরু হয় কর্নেল কোরেশীর বাজখাই কন্ঠের সামরিক বক্তৃতা। ‘‘তোমরা বাঙ্গালিরা হারমখোর গাদ্দার জাতি। তোমাদের মধ্যে ঈমান নাই, ইসলাম নাই– দেশপ্রেমও নাই। তা না হলে পাকিস্তানি অফিসের সিক্রেসি আউট হয়ে বাইরে যায় কি করে? তোমাদের কাছে এর জবাব চাই। নইলে তুম লোক কো সাথ এ্যয়সা কারওয়াই পড়ে গা, যেয়সা কুত্তা কা সাথ কিয়া যাতা হ্যায়।’’দরবার শেষে ঐ দিনই বাঙ্গালি সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন নাজির আহমদকে ডেকে অর্ধেক বাঙ্গালি জওয়ানকে অবিলম্বে ট্রাকে করে ঠাকুরগাঁয়ে এবং অবশিষ্টদের দশ জনের দল করে সীমান্তে পাঠানোর জন্য জরুরি নির্দেশ দেয়া হয়। বাঙ্গালি জওয়ানরা যেন সমবেত হওয়ার সুযোগ না পায়, সে উদ্দেশ্যে এ পরিকল্পনা করা হয়।এভাবে পরিস্থিতি সংকট থেকে মহাসংকটের দিকে এগুতে থাকে। এসে যায় পরিকল্পিত ২৫ মার্র্চের কালরাত্রি। রাতের অন্ধকারে রাজধানীর নিরীহ নিদ্রিত জনসাধারণের উপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হায়েনারা। শুরু হয় বর্বর গণহত্যা। আতংক ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার বাইরে জেলা শহর হতে শুরু করে গ্রামাঞ্চলে। পরদিন ২৬ মার্চ সকাল ১১টায় কারফিউ জারি হয় দিনাজপুর শহরে।২৬ মার্চ দিনাজপুর শহরের পরিস্থিতি রীতিমত থমথমে। শহরবাসী গৃহবন্দী। যোগাযোগ বন্ধ। টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন। সব দিক থেকে দিনাজপুর এক অবরুদ্ধ শহর। পাঞ্জাবি, পাঠান ও বিহারিরা টহল দিচ্ছে শহরে। চারদিকে নিরপরাধ লোককে গুলি করে মেরে ফেলার গুজব।জনসাধারণ ভীত–সন্ত্রস্ত। বাঙ্গালি ক্যাপ্টেন নজরুল হক ও জেলা প্রশাসক ফয়েজ উদ্দিন আহমদ সার্কিট হাউসে নজরবন্দী।২৬ মার্চ দশ মাইল এলাকায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করতে যাওয়া হবি চেয়ারম্যানের ছোট ভাই মনু মিঞা ও সঙ্গী পাঁচ জন তরুণ বীর সন্তানকে ধরে আনা হয় কুঠিবাড়ীতে। সেখানে তাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে লাশ ঘাঘরার খালপাড়ে ফেলে রাখা হয়। এ বীভৎস দৃশ্য দেখে কুঠিবাড়ির মুষ্টিমেয় বাঙ্গালি জওয়ান বিদ্রোহ করেন। নজরবন্দী জেলা প্রশাসক ফয়েজউদ্দিন আহমদকে অস্ত্রের মুখে বাধ্য করা হয় তার সইযুক্ত একটি চিরকুট লিখতে। সেই চিরকুটে ঐ সময় শহরে অবস্থানরত এমএনএ এবং এমপিদের সার্কিট হাউসে একটি মিটিং–এ আমন্ত্রণ জানানো হয়। চিরকুটে বলা হয়েছিল: “আমার বাসায় আমার সঙ্গে চা খেলে আমি খুব খুশী হবো।”সব রাজনৈতিক নেতাকে এক জায়গায় জড়ো করে হত্যা করার এ ষড়যন্ত্র সেদিন বাস্তবায়িত হয়নি। ফাঁস হয়ে গিয়েছিল সে ষড়যন্ত্র। জনতার ঘৃণা আরো প্রবল হয়ে ওঠে। গোয়েন্দা সূত্রে পাক কর্তারা তা জানতে পারেন। তাই দায়সারা মিটিং সেরে নেতাদের বেকায়দা সৌজন্য প্রকাশ ছাড়াই বিদায় দেয়া হয়।জনসাধারণ,বিশেষ করে শহরের পশ্চিমাঞ্চলের জনসাধারণ,জানতে পারেন সার্কিট হাউসে বৈঠকের নামে তাদের রাজনৈতিক নেতারা বন্দী। এসব গ্রামের ২/৩ হাজার লোক লাঠিসোটা, বল্লম নিয়ে ঝড়ের মত ছুটে আসে। কারফিউ ভঙ্গ করে তারা কাঞ্চন নদীর পশ্চিম পাশের বাঁধে জড়ো হয়। অধ্যাপক ইউসুফ আলীসহ নেতারা সার্কিট হাউসে বন্দী হননি, প্রাণ নিয়ে নিরাপদেই ফিরে আসেন।তিনি সার্কিট হাউস থেকে বাড়িতে ফিরে শুনতে পান হাজার হাজার জনতা নদীর ওপারে তার অপেক্ষায় আছে। অধ্যাপক ইউসুফ তৎক্ষণাৎ সেখানে ছুটে যান। লোকজন তাকে নিরাপদ অবস্থায় দেখতে পেয়ে আনন্দে উল্লাসে হর্ষধ্বনি করে স্বাগত জানায়। কিন্তু এ আনন্দের মধ্যে হঠাৎকরে কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে ধরাশায়ী হয় ৫/৬ জন লোক। জনসাধারণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেই আরো কয়েকটি নৃশংস ঘটনা ঘটে যা অগ্নিকুন্ডে ঘৃতাহুতির কাজ করে। মুক্তি সংগ্রামীদের কাছে মোটর সাইকেল যোগে বিপ্লব সংক্রান্ত একটি জরুরি মেসেজ পৌঁছে দিতে গিয়ে দশ মাইলের কাছে পাক সেনাদের গুলিতে মারা যান কলেজ ছাত্র বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী জিন্না।ঐ সময় কুঠিবাড়ীতে তিন জন অস্ত্র চালনায় সিদ্ধহস্ত বাঙ্গালি সেনাছিলেন। একমাত্র কামান চালক ছিলেন হাবিলদার নাজেম। তাছাড়া ৩ ইঞ্চি বেড়ের তিনটি মর্টার ছিল সেখানে, যেগুলি এরা তিন জনই ব্যবহার করতে জানতেন। এই তিন হাবিলদারের সার্ভিস কুঠিবাড়ীতে তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তা ছাড়া ঐ সময় কুঠিবাড়ীতে আরো একজন বাঙ্গালি সুবেদার ছিলেন, নাম আরব আলী। চাতুর্যে ও নৈপুণ্যে তিনিও ছিলেন বিশিষ্ট।২৭ মার্চ কুঠিবাড়ীর অস্ত্রাগার পাহারায় ছিলেন হাবিলদার খালেক। তিনি পাঞ্জাবি। আনসার আলী ও অপর একজন সহকারি পাহারাদার ছিলেন, তারাও পাঞ্জাবি। তখন বিকাল ৩টা থেকে ৪টা হবে। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগকারী সিগন্যাল সেটের জিপ বিদ্যুৎগতিতে আবার ব্যারাকে প্রবেশ করে। তা দেখে চূড়ান্ত দুঃসংবাদ ভেবে নিয়ে বাঙ্গালি জওয়ানদের পক্ষে আর স্থির থাকা সম্ভব হয়নি। তাদের অব্যর্থ গুলি ছুটে যায় অস্ত্রখানার পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত হাবিলদার খালেকও অপর দুই পাঞ্জাবি সেনার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে তিন জনই খতম। অবাঙ্গালি ইপিআরগণ কোনো কিছু বুঝে উঠারআগেই কুঠিবাড়ী অস্ত্রাগার বাঙ্গালি জওয়ানদের দখলে। আশপাশের অন্যান্য অবাঙ্গালি জওয়ানরাও খতম হয়।কুঠিবাড়ীতে গুলির আওয়াজ শোনামাত্র শহরের সর্বত্র শুরু হয়ে যায় আতসবাজির মতো অনর্গল গুলিবর্ষণ। ছুটোছুটি, চিৎকার, আর্তনাদ আর গোলাগুলির ধোঁয়া চারদিকে। বাঙালি ইপিআরদের ঝটিকা আক্রমণে দিশেহারা পাকিস্তানি ইপিআর সদস্যরা প্রয়োজনীয় ডিফেন্স নিতে পারার আগেই কুঠিবাড়ী বাঙ্গালি জওয়ানদের দখলে এসে যায়। বিকেল ৫টার মধ্যেই অন্যান্য পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পাকিস্তানি সেনা অফিসাররা ব্যারাকের বাইরে ছিলেন বলে তারা প্রাণে রক্ষা পান।কুঠিবাড়ী পতনের পর সেখানে উত্তেজিত নেতা, জনতা ও জওয়ান সবাই একাকার হয়ে গিয়েছিলেন।বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে অধ্যাপক ইউসুফ আলী, এম আব্দুল রহীম এবং তরুণ নেতাদের মধ্যে আশরাফ সিদ্দিকী, বেশার উদ্দিন মাস্টার, মহিউদ্দিন মাস্টার, নাদির চৌধুরী, জর্জ ভাই, শফিকুল হক ছুটু প্রমুখ সেখানে উপস্থিত থেকে বিপ্লবীদের তদারকির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া শহরে ও বাইরের গ্রামগুলি থেকে ছুটে আসা মুক্তি সংগ্রামী যুবকরাও ছিলেন অনেক। তাদের মধ্যে রবার্ট–লুইস ভাইয়েরা, আবুল কাশেম অরু, মজুখাঁ, আমজাদ হোসেন, রফিকুল ইসলাম, হালিম গজনবী, মকছেদ আলী মঙ্গোলিয়া, আবুল হায়াত, আমানুল্লাহ, গেরা, সইফুদ্দিন আখতার এবং দূর গ্রামের মনসুর আলী মুন্সী (বিজোড়া) নজরুল ইসলামের (তেঘরা) নাম উল্লেখযোগ্য।
৩০ মার্র্চের মধ্যেই দিনাজপুর শহর শত্রুমুক্ত হয়। ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত ২২টি থানা সহ সমগ্র দিনাজপুর জেলা পরাধীনতার কবলমুক্ত মুক্তাঞ্চল ছিল। জেলা ছাত্রলীগের ছেলেরা বীরদর্পে তাদের গণেশতলা অফিসে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিল। সৈয়দপুর থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর পাল্টা হামলা প্রতিহত করতে বাঙ্গালি ইপিআর, পুলিশ ও আনসারদের নেতৃত্বে মুক্তি সংগ্রামীদের সমন্বয়ে দশ মাইল, রাণীরবন্দর, মোহনপুর,এমনকি বিহারি কলোনী উপ–শহরেও সামান্য অস্ত্রশস্ত্র দিয়েই অগ্রগামী ফ্রণ্ট স্থাপন করা হয়। নেতা–কর্মীদের চেষ্টায় ফ্রণ্টে নিয়োজিত মুক্তি সংগ্রামীদের নিয়মিত খাবার ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহ করতে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসে দেশ প্রেমিক জনতা। পাশাপাশি আইন–শৃংখলা রক্ষা ও অবাঙ্গালিদের জানমাল রক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হয়।এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য প্রগতিশীল দলগুলির সমন্বয়ে ইনস্টিটিউট মাঠে অনুষ্ঠিত সভায় জনসাধারণের উপস্থিতিতে ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। আহবায়ক নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আজিজার রহমান (এমএনএ)। পরিষদে অন্তর্ভুক্ত হন অধ্যাপক ইউসুফ আলী, অ্যাডভোকেট এম আব্দুর রহিম, অ্যাডভোকেট শাহ মাহতাব, অ্যাডভোকেট গোলাম রহমান, অ্যাডভোকেট এস এ বারী, অ্যাডভোকেট আজিজুল ইসলাম জগলু, অ্যাডভোকেট তেজেন নাগ, প্রাক্তন এমপি দুর্গামোহন রায়, গুরুদাশ তালুকদার, রফিক চৌধুরী, মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানু, হবি চেয়ারম্যান, গোপাল ভৌমিক, ছগণ লাল লোহিয়াসহ আরো অনেকে। শহরের বিশিষ্ট সিগারেট ডিলার সৈয়দ হাসমতুল্লার মুন্সীপাড়ার একতালা বাড়িটিতে সংগ্রাম পরিষদের অফিস স্থাপন করা হয়। এই বাড়ি থেকেই ৩০ মার্চ থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত জেলা সংগ্রাম পরিষদের যাবতীয় কার্যাবলী পরিচালিত হয়।এ সময় বহু বিদেশী সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার সদ্যমুক্ত দিনাজপুরে প্রবেশ করেন। পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিকরা ও অনেকে আসেন। ৪ এপ্রিল তারিখে ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত বিরাট জনসভায় বিবিসির ক’জন সাংবাদিক কলকাতা থেকে জিপে করে এসে সভায় যোগদান করায় সভাটি জনারণ্যে পরিণত হয়। বিবিসির দলটিতে ছিলেন পিটার হেগেল হান্ট, উইলিয়াম ক্রলি, মার্ক টালি প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য সাংবাদিক। তাদের ধারণকৃত ভিডিও ও সংবাদ বিবিসি’র সবক’টি চ্যানেলে গুরুত্ব দিয়ে প্রচারিত হওয়ায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব চিত্র পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয়। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে উঠতে শুরু করে।
১৩ এপ্রিল পর্যন্ত দিনাজপুরকে মুক্তাঞ্চল হিসেবে রক্ষা করা সম্ভব হলেও কৌশলগত কারণে পরিস্থিতি বিপরীত দিকে মোড় নেয়। ঐ রাতেই সৈয়দপুর ঘাঁটি থেকে হানাদার বাহিনী বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ও সাঁজোয়া বহর নিয়ে দিনাজপুর শহরের দিকে অগ্রসর হয়। সড়ক পথের পরিবর্তে একটি দল আসে রামডুবী হাট হয়ে মেঠো পথ ধরে চেহেলগাজীর দিকে, অপর একটি দল আসে রাজবাড়ী শালবনের ভেতর দিয়ে এবং তৃতীয় দলটি আসে পার্বতীপুর হয়ে মোহনপুরের পথে। তারা একসঙ্গে সুপরিকল্পিতভাবে শহরের উপর ছাঁপিয়ে পড়ে। ঐ সময় বাঙ্গালি সংগ্রামীদের পক্ষে পিছু হটা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প ছিল না। হানাদারদের অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণে বহু বাঙ্গালি প্রাণ হারায়, আহত হয় আরো অনেকে। সন্ধ্যা হবার আগেই সমস্ত শহর খালি হয়ে যায়।তারপর থেকে মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্র গড়ে উঠতে শুরু করে প্রবাসী সরকারের তৎপরতায়। নিয়মিত মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়। উদ্বাস্তু বাঙ্গালি ছাত্র ও যুবকরা মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করে। দেশোদ্ধার করতে অবিরাম অবিশ্রান্ত গতিতে হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলে ১৬ ডিসেম্বর শত্রুবাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পরাজিত হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর হাই কমান্ডের নিকট আত্মসর্ম্পণ করে। দিনাজপুরে বিজয় উৎসব উদযাপিত হয় তার চার দিন পরে অর্থাৎ ২০ ডিসেম্বর তারিখে। ১৭ ডিসেম্বর সূর্যোদয়ের আগেই দিনাজপুরের বিভিন্ন রনাঙ্গণ থেকে বিজয়ী মুক্তিসেনারা বীরদর্পে শহরে এসে পৌঁছায়। প্রত্যাগত মুক্তিসেনারা দিনাজপুর স্টেডিয়াম, মহারাজা হাইস্কুল ভবন প্রভৃতি স্থানে অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরী করে অবস্থান গ্রহণ করেন।দিনাজপুর রণাঙ্গনের বিভিন্ন সেক্টরে দায়িতরত দলনেতাদের মধ্যে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা বেশারউদ্দিন মাস্টার, রেজাউল ইসলাম, নজরুল, ইদ্রিস, মঙ্গোলিয়া, আবুল কাশেম অরু, আবুল হায়াত, আশরাফ সিদ্দিকী, নাদির চৌধুরী, সফর আলী, আনোয়ারুল কাদির জুয়েল, শফিকুল হক ছুটু, গেরা, তোয়াফ, আমানুল্লা, জর্জভাই, মমিনউদ্দিন, মজু খাঁন, হবি চেয়ারম্যান দ্রæত শহরে এসে পৌঁছান। এমপিদের মধ্যেও অনেকে এসে পৌঁছাতে সক্ষম হন। ফলে সকাল না হতেই মুক্তি সেনায় সারা শহর ভরে যায়। স্বাধীনতার গানে মুখরিত হয়ে ওঠে চারিদিক।
২০ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বড়মাঠে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ইতোমধ্যে ভারতের শরণার্থী শিবির থেকে শহরের শীর্ষস্থানীয় নেতাগণ, মান্যগণ্য ব্যক্তিগণ প্রায় সবাই দিনাজপুরে এসে পৌঁছান। গোর–এ–শহিদ মাজার সংলগ্ন মাঠে উন্মুক্ত খোলা মঞ্চ তৈরী করে অসাধারণ উদ্দীপনা ও উল্লাস মুখর ণপরিবেশে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে দিনাজপুরে স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলন পর্ব শুরু হয়। পবিত্র কোরআন পাঠের পর গৌরবজনক এ মহান কাজের দায়িত্ব ওসামরিক অভিবাদন গ্রহণ করেন আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট এম আব্দুর রহীম। তিনি তখন যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের উত্তর জোনের অর্থাৎ দিনাজপুর–রংপুর–বগুড়া জেলার পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান অধিনায়ক।মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হলেও তখনো দেশের সর্বত্র হানাদার বাহিনীর অসংখ্য নাশকতার চিহ্ন ছড়িয়ে ছিল। বিশেষ করে দিনাজপুরের পথে–ঘাটে মারাত্মক বিস্ফোরক অস্ত্র মাটির নিচে পুঁতে রাখা ছিল। এছাড়া শত্রুদের ফেলে যাওয়া অসংখ্য আগ্নেয়াস্ত্রও পড়ে ছিল যেখানে সেখানে। এসব অস্ত্রমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত জেলার পথঘাটে চলাচল ছিল বিপজ্জনক। তাই এসব স্থান অস্ত্রমুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা নিয়োজিত হয় এবং প্রতিদিন প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে প্রত্যন্ত এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র নির্ধারিত রক্ষণাগার মহারাজা হাইস্কুলে এনে জড়ো করা হয়। অস্ত্র সংগ্রহের এই কাজ চলার সময় ৬ জানুয়ারি,১৯৭২ সালে একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। ঐ দিন সন্ধ্যার সময় এক ভূমি মাইন বিস্ফোরণে গোটা শহরসহ আশেপাশের এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। নিহিত হন মহারাজা হাইস্কুল ভবনে অবস্থানরত অনেক মুক্তিসেনা।বিশাল স্কুল ভবনটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়,ক্ষতিগ্রস্ত হয় আশেপাশের বহু বাড়ি ঘর ও সম্পদ।পরের দিন উদ্ধারকৃত দেহাবশেষগুলি সামরিক মর্যাদায় পবিত্র ভূমি চেহেলগাজীর মাজার প্রাঙ্গনে সমাহিত করা হয়। অগণিত শোকার্ত মানুষ শোক মিছিলে যোগদান করে। এতো বড় শোক মিছিল দিনাজপুরে আর কখনো হয়নি। বিভিন্ন সূত্রে অনুসন্ধান চালিয়েও সে সময় বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ ও শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক নাম, পরিচয় ও সংখ্যা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ১৯৯৬–৯৭ সালে গভীর অনুসন্ধানের পর বিস্ফোরণের কারণ উদঘাটিত হয়। উদ্ধার করা হয় শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ও ঠিকানা।মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর রণাঙ্গণঃ মহান মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর ৬ ও ৭ নং সেক্টরের অধীন ছিল। ৬ নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন উইং কমান্ডার এম কে বাশার এবং ৭ নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর নাজমুল হক ও মেজর কিউ এনজামান।যাদের রক্তে মুক্ত এ ভুমি মহান মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর জেলার কত জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হয়েছেন, তার পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে শহিদদের অমর স্মৃতির নিদর্শন হিসাবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্ত¡রে নির্মিত হয়েছে শহিদ বেদী। সেই শহিদ বেদীতে জেলার ১৩৪ জন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার নাম উৎকীর্ণ রয়েছে। প্রতি বছর মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে কৃতজ্ঞ দিনাজপুরবাসী বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করে এই শহিদ বেদীতে।