উপভাষা, ভালোবাসা

ফান্দে পড়ি খুশি

তানজিলা লাবণী

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ১১:৫২ পূর্বাহ্ণ ; 466 Views

গপ্পটা ম্যালাদিন আগের তকন মুই বিএসসি পড়ো আর পাশাপাশি চাকরির পড়া সাথে পরীক্কাও দেও।

পোত্তেক মাইনষ্যের একটা স্বপ্ন থাকে চাকরি করা, মোরও আছে।

তা কয়টা চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার পর জাইনবার পাননু প্রাইমারি ইশকুলের সহকারি শিক্ষক পদে ভাইভাত মোর রোল আলচে। মুই তো মহা খুশি নেকিতো পরীক্কা ভাল হইচে, ফির নারী আর পোষ্য কোটাও আচে।

মনে মনে একনা ভরসা পাওচু, মনে হওচে চাকরিটা হইবে।

এই খবর মোবাইলোত না দিয়া সরাসরি বাড়ি আসি দিনু। শুনিয়া মোর ছোট ভাই কইল এই চাকরি কইরবার পাবু?

মুই কনু ক্যান না পাইম।

তারপর কওচে প্রাইমারি-র ছইলেরা গ্যাদড়া খুব, পরিস্কার হয়া স্কুল আইসে না তার উপর নাকের স্যাদন। ফির সোন্দর করি কতা কয় না। তুই মুই করি কতা কয়।

তুই তো ফির স্ট্যান্ডার্ড কতা কইস (তখন বাড়ির মধ্যে মুই একমাত্র চলিত ভাষাত কতা কও আঞ্চলিক ভাষা পছন্দ করো না) মুই কনু যে দোয়া করিস চাকরি হইলে সউগ বদলে দেইম, ইন শা আল্লাহ।

কয়দিন পর ভাইভার ডেট চলি আইল। একটা খালাতো বইনোক ধরি ডিসি অফিস গেনু ভাইভা দিবার। ভাইভা বোর্ডত কয়টা প্রশ্ন করার পর মোর পড়ার বিষয় সম্পর্কে জাইনবার চাইল তকন কনু যে মুই ল্যাবরেটরি মেডিসিন (প্যাথলজি) বিষয়ে পড়ো। তখন এক স্যার মজা করি কয়া ফ্যালাল তোমাক চাকরি দেয়া যাবান্যায়, তোমরা এইটে থাইকপার ন্যান। তকন মুই একনা মিচা কতা কনু যে, মোর স্বপ্নের পেশা এইটা। চাকরি হইলে ছাইরবার ন্যাও। আসলে মোর স্বপ্ন আচিল পাইলট হওয়া। যেহেতু সেটা আর হওয়া সম্ভব নোয়ায় সেইজন্যে ভাগ্যের উপর ছাড়ি দিয়া মিছা কতা কনু।

তাছাড়া হামার দ্যাশত একটা সরকারি চাকরি সবায় সোনার হরিণ কইলেও মুই কও হীরা-র হরিণ।

তারপর মোক কইল মুই নাচ গান জানো কি না? মুই কনু স্যার নাচ না জানলেও গান চেষ্টা কইরবার পাও।

কইলো ঠিক আচে কন,

শুরু করনু

যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই……….

এরপর কইল ঠিক আচে তোরা এবার আইসো।

বাইরোত বেরাইতে আর সবায় হুড়মুড়ি পড়িল মোর উপর কি কি ধরাচিল সেইগলা জাইনবার তকনে।

মুই ও কনু কি কি ধরাইছে।

এরপরে মোর খালার বেটির সাথে চলি গেনু পুলিশ লাইন ইশকুল মাঠের ম্যালাত। ম্যালাত য্যায়া জামাকাপড় কিনি হাওয়াই-মিঠাই খাইতে খাইতে বাড়ি আনু।

মাসখানেক পর ফাইনাল রেজাল দেইল মোর এক বড় ভাই ফোন করি কইল মোর চাকরি হয়্যা গেইছে।

উয়ার কতা বেশ্বেস না করি মুই নেজে গেনু কম্পিউটার এর দোকান য্যায়া দেকো সত্যয় মোর চাকরি হইছে।

দোকান থাকি মেস যাবার ধরি খুশির ঠেলায় কোটে যে মোবাইল ফেলাচু আর মনে কইরবার পাওচু না। মন টা একনা খারাপ হইল মোবাইল টা হারেয়া। এলাও বাপ-মাক খুশির খবরটা দিবার পানু না।

মেস-ত য্যায়া রুমমেট এর মোবাইল থাকি খবরটা সবাকে জানানু। কতা কয়া মনে হইল সবার চ্যায়া খুশি মোর বাপ। মোর বাপও একজন ইশকুলের মাষ্টার আছিলো, তাঁর পথ ধরি তার বেটি হাটপে  সেই তকনে মনে হয় খুব খুশি। এরপরে আস্তা ঘাটে  যারে দেকা পাও তায় খালি মিষ্টি খাবার চায় আর কয় মুই চাকরি কইরবার পাইম তো? কায়ো কায়ো কয় এইবার ফান্দোত পলচিস। কয়জনের মোকত এই কতা শুনার পর পুছ করনু এই কতা-র মানে কি?

সবায় কওচে তুই যে পোচপাচ নিয়া বেড়াইস, এই চাকরি তোর জন্যে নোয়ায়। তুই ছাওয়ার ঘরে এদন কাজকারবার সহ্য কইরবার পাবার নেইস। এইগলা কতা আর মোর ভাই এর কতা শুনিয়া মনে হইল মোর কিছু ভাল না নাগলে বদলে ফেলাইম তাছাড়া বয়স তো আচে।

কিচুদিন পর জয়েন করার চিটি পানু, মনটা খারাপ হয়া গেলো চিটি প্যায়া।

বাড়ি থাকি স্কুল ম্যালাদূর। প্রায় ১৯ মাইল বাড়ি থাকি। পরেরদিন গেনু স্কুল দেইকপার। কি আর কইম দুক্কের কতা।

এমনি তো দূর তার উপর ফির আড়াই মাইল ঘাটা কাচা। এখান করি পাও ফেলাওচু আর ধুমার মতোন ধুলা উড়াওচে। আদখান সাদা হয়া স্কুল পৌছিনু। সবায় মোক দেকি মনে করচে মুই সাংবাদিক।যাই হোক কনু যে মুই ও তোমার সহকর্মী হবার যাওচু। সবার সাতে কতা কয়া ভালই নাগিল।

বাড়ি আসিয়া ভাবুচু এই এতদূর ঘাটা মুই ক্যামন করি যাইম নেত্তেদিন?

ভাবতে ভাবতে হঠ্যাৎ একটা সুপ্ত ইচ্চার কতা মনে হইল। ছোটতে ন্যাশনাল টিভিত দেকচিনু ইন্ডিয়ান নাইকাগুলা সাঁ সাঁ করি উড়ি যায় স্কুটার নিয়া। তকন থাকি ইচ্চা একটা চাকরি হইলে এখান স্কুটার কিনিম। তকন মনে হইল স্কুটার ই একমাত্র এই সমস্যার সমাধান। বাড়িত সবাকে কনু স্কুটার কিনবার চাও। সবায় একমত হইল মোর কতার সাথে।

যেদিন অফিসিয়ালি ইশকুল গেনু পোত্থম দিন। সবায় খুশি। ইশকুলের ছাওয়াগুলা একেরে মোক দেইকপার জন্যে ঠেলাঠেলি শুরু করি দেচে। ওমাক কনু তোমরা ক্লাসত যাও মুই তোমার ক্লাসত যাইম।

একনা পড়ে হেড স্যার আর অন্য স্যারের ঘরে সাতে ক্লাসত গেনু য্যায়া দেকো মোর ভাই এর কতা সত্য, নাক দিয়া স্যাদন বেড়াওচে, স্কুল ড্রেস নাই সবারে, পিরান দেকি মনে হওচে খুবই গরীব।

সউগ ক্লাস দেকিয়া মন টা খারাপ হয়া গ্যাল। বার বার খালি মোর ভাই এর কতা মনে হওচে।

কয়দিন ধরি পরিচয় পর্ব চলার পর মোর খালি মনে হওচে পরিবর্তন দরকার।

একলায় কি পাইম?

খারাপ নাগা বিষয়গুলা নিয়া হেড স্যারের সাতে আলোচনা করনু।

একজন মাষ্টার কয়ায় ফ্যালাইল নয়া আলচেন তো এইজন্যে ত্যাল।

মুইও মুকের উপর কনু এই পেশায় থাকলে এই ত্যাল আজীবন থাকপে ইন শা আল্লাহ। এরপরে যেদিন ক্লাস নেওয়া শুরু করনু দেকো ছইলগুলা মোক ভয় করোচে গায়ের গোরত আইসবার চায় না, কতা বাড়বার চায় না। এর কারণ হিসাবে আবিষ্কার করনু মুই যেভাবে চলিত ভাষাত কতা কওচু ওরা এই ভাষাত অভ্যস্থ নোয়ায়। মুই তো ওমার মতোন আঞ্চলিক কতা কবার পাও না। ভাল নাগে না মোর এই রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা। তাইলে বুদ্দি? ওমার কাছাকাছি আইসবার গেইলে  তো মোক ওমার ভাষাতে কতা কওয়াই নাগবে। পরের ক্লাসত চেষ্টা করনু ওমার মতোন করি কতা কবার।

অনেকটা কবার পাও ওমার মতোন করি। এরপর সবায় মোক খুব পছন্দ করিল। মোর গোরত এই আঞ্চলিক ভাষা প্রিয় হয়া উঠিল।

পোত্থমবার উপলব্ধি করনু  এইটা মোর মায়ের ভাষা, মোর নিজের ভাষা!

এখন কি যে মজা নাগে কইতে!

এরপরে শুরু হইল ওমাক চলিত ভাষা শিখবার। সবাকে বুজানু ইশকুলত সবায় শুদ্ধ করি কতা কমো আর বাইরোত আঞ্চলিক ভাষায় কতা কমো।

কারণ এইটা হামার মায়ের ভাষা। হামার অস্তিত্বের শিকড় গাড়া এই ভাষার সাথে।

এরপরে থাকি কাছের বন্ধু আত্মীয় স্বজন সবারে সাথে মুই আঞ্চলিক ভাষাত কতা কও। আর মনে মনে ধন্যবাদ দেও মোর প্রথম স্টুডেন্ট গুলাক। ওরা নাই হইলে হয়তো বুজনুই না হয় আঞ্চলিক ভাষা কি জিনিস?

এরপরে আস্তে আস্তে মুই ইশকুলত সউগ ছাওয়ারে প্রিয় ম্যাডাম হয়া গেনু।;ওরা এখন নিয়ম মানে, সউগ কতা শোনে, পরিষ্কার হয়া ইশকুল আইসে। যারা কচিল মুই ফান্দে পড়ি কান্দিম এলা তামাক কবার মোনায় মুই এই ফান্দত পড়ি হাসো।

 

লেখক: তরুণ লেখক ও শিক্ষক, রংপুর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *