আমার বাবা সেই ব্রিটিশ আমলে বিদ্যাসাগর এর অনুপ্রেরণায় আমাদের এলাকায় বিধবা বিবাহ চালু করেছিলেন। বাবা এক এক করে মোট চারটি বিধবা বিবাহ দিয়েছিলেন মর্মে ছোটবেলায় জেনেছিলাম কিন্তু তিনটি বিধবা বিবাহের তথ্য সংগ্রহ করতে পারলেও আর একটি বিধবা বিবাহের তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি। সেই চতুর্থ বিধবা বিবাহের তথ্যটি পেলাম আজকে আমার পারিবারিক দুর্গাপূজায় দায়িত্ব পালনকারী দেউরির কাছ থেকে।
দেউড়ি হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি পুজোর সমস্ত রকম সরঞ্জাম বা উপাচার সাজিয়ে নিয়ে পুজোর সময় পুরোহিতের কাছে উপস্থাপন করেন। তার বাড়ি বড়বাড়ির দিকে। আজ বিভিন্ন রকম আলো আলাপ-আলোচনার সময়ে তিনি কথায় কথায় বাবার সেই আমলে দেয়া আর একটি বিধবা বিবাহের খবর দিলেন।
এই লালমনিরহাট জেলারই মহেন্দ্রনগর ইউনিয়নের নওদাবাস মৌজার ডারারপার গ্রামের তৎকালীন নিবাসী ঢেপড়া চন্দ্র নামে এক ব্যক্তির বিধবা বিবাহ দিয়েছিলেন বাবা। বিধবা বিবাহকারি এই পাত্র ঢেপড়া চন্দ্রের পিতার নাম ছিল আন্ধারু চন্দ্র। বিধবা পাত্রির নাম ছিল পন্তেবালা। বিধবা হওয়ায় বিধবা-বিবাহের পরেও সেই নববধূকে বরের গ্রামের সবাই ডাকতেন পন্তে আড়ি বলে। রংপুরিয়া ভাষায় ‘আড়ি’ শব্দের অর্থ হলো বিধবা, যার শুদ্ধ ভাষা রাঢ়ী।
এই বিধবা দম্পতির সন্তানের নাম ছিল ‘বাঘ-ধরা’। যুবা বয়সে তাকে বাঘে ধরে বলেই তার নাম হয়ে যায় ‘বাঘধরা’। বাঘে ধরার পরে তার আসল নাম হারিয়ে যায় এবং এলাকায় সে পরিচিত হয়ে যায় বা ধরা নামে। কত যুগ আগের কথা। দ্বিতীয় প্রজন্মের সেই লোকটি কবেই হারিয়ে গেছেন, তার সময়েই তার প্রকৃত নামটিও হারিয়ে গিয়ে তার নাম হয়েছিল বাঘ ধরা, কিন্তু প্রকৃত নাম হারিয়ে গিয়ে এলাকায় বাঘ ধরা নামে পরিচিত এই লোকটির নাম এবং তাকে বাঘে ধরার ইতিহাস এখন এলাকার বয়স্কদের স্মৃতিতে বেঁচে আছে এবং এখনও বয়স্ক দের মুখে মুখে মুখে ফেরে তার নাম এবং সেই কাহিনি।
হিমালয় সংলগ্ন এই এলাকায় আগে- সেই ব্রিটিশ আমলে বাঘের অত্যাচার এবং উৎপাত ছিল। এলাকায় একটা স্থানের নাম আছে খেদাবাঘ, স্থানীয় উচ্চারণে যা খেদাবাগ নামে পরিচিত। শীতকালে এলাকায় বাঘের আবির্ভাব হলে লোকজন সংগঠিত হয়ে সেই বাঘকে তাড়িয়ে দিত আর সেই বাঘ ধরলা নদীর অববাহিকার একটি জঙ্গলপূর্ণ এলাকায় আশ্রয় নিত। তাড়িয়ে দেয়া সেই বাঘ জনমানবহীন ওই জায়গার জঙ্গলে আশ্রয় নিত বলে ওই এলাকার নাম ছিল খেদাবাগ।
ব্রিটিশ আমলের সেইসব দিনগুলোতে জনগণকে বাঘের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য বন্দুক দিয়ে বাঘ মেরে বেড়াতেন কোলাঘাটের এক গোঁসাই, যার নাম এখনো তিন পুরুষ ধরে এলাকায় পরিচিত ‘বাঘমারা-গোসাই’ নামে। ওই সময়ে একদিন এলাকায় বাঘের আবির্ভাব হলে সেই বাঘমারা গোঁসাইকে খবর দেয়া হয়। বাঘমারা গোসাই বন্দুক নিয়ে বাঘ মারার উদ্দেশ্যে এলাকায় এসে সেই বাঘকে আর খুঁজে পান না। বাঘ খুঁজে না পাওয়ায় তিনি ভাবলেন যে তাকে মিথ্যা সংবাদ দিয়ে আনা হয়েছে। মিথ্যা সংবাদ দিয়ে তাকে ডেকে আনার জন্য তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং যে তাকে সংবাদ দিয়ে ডেকে নিয়ে এসেছে- তাকে গুলি করে মারার জন্য খুঁজতে থাকেন।
প্রকৃতপক্ষে বাঘ আবির্ভাবের সংবাদটি মিথ্যা ছিল না। বাঘটি লোকজনের ধাওয়া খেয়ে একটি জঙ্গলপূর্ণ বড় খালে লুকিয়ে পড়েছিল। সেই খালের উপর পাশের বাঁশঝাড় থেকে একটি বাঁশ হেলে পড়েছিল। বাঘ খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে সেই বিধবা দম্পতির সেই সন্তান সেই বাঁশ ধরে ধরে ওই জঙ্গলময় খালে বাঘ খুঁজতে নেমে যায় আর তখনই আচমকা বাঘটি তাকে আক্রমণ করে তার হাতের কনুইয়ের উপর কামড় দিয়ে ধরে। এরপর বাঘমারা গোঁসাই গুলি করে বাঘটি হত্যা করে যুবককে রক্ষা করেন।
সেইদিন যুবকটিকে বাঘে ধরার এই ঘটনাটি এলাকায় তোলপাড় তোলে এবং কাহিনিটি এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এরপরেই সেই বাঘে ধরা যুবকটি এলাকায় ‘বাঘ-ধরা ছেলে’ নামে পরিচিতি পেতে থাকে এবং একসময় তার পিতৃপ্রদত্ত আসল নাম হারিয়ে গিয়ে ‘বাঘ-ধরা’ নামটি স্থায়ী হয়ে যায়। প্রায় তিন প্রজন্ম আগে ঘটে যাওয়া সেই কাহিনি এলাকার বর্তমান প্রজন্ম এখনো মনে রেখেছে।
কত যুগ আগে ঘটে যাওয়া সেদিনের সেই কাহিনি এবং সেই লোকটি হারিয়ে গেলেও এখনো এই প্রজন্মের মানুষ তাকে ‘বাঘধরা’ হিসেবেই মনে রেখেছে এবং তাকে বাঘে ধরার সেই কাহিনি এখনো এলাকায় কিংবদন্তী হয়ে আছে।
বিধবা-বিবাহকারী দম্পতি ঢ্যাপড়া-চন্দ্র এবং পন্তে আড়ির একমাত্র সন্তান সেই :বাঘধরা’র বংশে এখন আর কেউ নেই। সেই বিধবা-বিবাহকারী ঢ্যাপড়া-চন্দ্র, সেই বিধবা পন্তে আড়ি এবং তাদের একমাত্র সন্তান ‘বাঘধরা’ পৃথিবী থেকে অনেক আগে বিদায় নিলেও এবং তাদের কোন বংশধর না থাকলেও এখনো বয়স্কদের মুখে তাদের বিধবা বিবাহের কাহিনি, তার সন্তানকে বাঘে আক্রমন করার লোমহর্ষক কাহিনী এবং বাঘে আক্রমণ করার পরে বাপদাদার দেয়া নাম হারানো সেই ‘বাঘধরা’ লোকটির কাহিনি এখনো সেই এলাকায় জনশ্রুতি হয়ে আছে।
আজ আলাপে আলাপে ওই এলাকার বয়স্ক দেউড়ির কাছে তথ্যগুলি পেলাম। এ পর্যন্ত আমি খোঁজখবর নিয়ে তিনটি বিধবা বিবাহের তথ্য এবং বিবাহকারীদের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করতে পেলেও বাকি একটির নাম ঠিকানা তো দূরের কথা, এ সম্পর্কিত কোন রকম তথ্যই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সৌভাগ্যক্রমে আজ বাবার উদ্যোগে দেয়া সেই চতুর্থ বিধবা বিবাহের তথ্যটি তাদের নাম-ঠিকানাসহ পেলাম।
ফলে বাবার দেওয়া চারটি বিধবা বিবাহের শোনা তথ্যের মধ্যে এতদিন তিনটি পেলেও অন্যটির তথ্য না পাবার মানসিক যাতনা থেকে আজ মুক্তি পেলাম।
উল্লেখ্য যে, সম্ভবত বাবার দেওয়া এইসব বিধবাবিবাহই পূর্ববঙ্গের ইতিহাসে প্রথম এবং শেষ বিধবাবিবাহ। কারণ পূর্ববঙ্গে বিধবাবিবাহের আর কোনো তথ্য নেই।
**
মুকুল রায়
কবি ও কথাসাহিত্যিক