১৫ ই ডিসেম্বর। যুদ্ধ শেষ। সবাই বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। শুধু সেতারা বানু একজনের অপেক্ষায় আছে। তার স্বামী সাইফুল কথা দিয়েছিল যুদ্ধ থেকে ফিরে আসবে। তাই সেতু সাইফুলের জন্য বসে আছে খেয়া ঘাটের পাড়ে।
গ্রামের চেনা পরিচিত সবাই এসেছে। সাইফুলের বন্ধু আশরাফের একটা পা উড়ে গেছে মিলিটারির গুলিতে। সেতু আশরাফের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। সাইফুলের খোঁজ করতে। ওরা এক সাথেই যুদ্ধে গিয়েছিল।
সেতুকে দেখে আশরাফ কাঁদতে লাগল। এ কিসের কান্না? এটা ভাবার সময় এই মুহূর্তে সেতুর নেই। কাছে গিয়ে বলল,
—আশরাফ ভাই! সাইফুল কই? মানুষটা ক্যানবা এলাও নাই। তোমরা ওমার দ্যাখা পাইছিলেন?
আশরাফ চোখের পানি মুছতে মুছতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
—কি আর কইম সেতু বু! হামরাগুলা উয়াক এত আটকাইনু তাও থাম্বার পাইনু না । ওয় আর বাঁচি নাই রে সেতু বু! ওয় শহীদ হইছে।
আশরাফের কান্নায় দক্ষিণ পাড়ার আকাশ মুহূর্তের মধ্যেই ভারী হয়ে উঠল। বর্ষাকাল হলে এতক্ষণে ঝরো হাওয়ায় বৃষ্টি শুরু হয়ে যেত।
সেতু এসব কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। কারণ যে মানুষটা সারাজীবন কথার বরখেলাপ করেনি। আজ সে এত বড় অপরাধ করতে পারে না। সাইফুল তো কথা দিয়েছিল তাকে। তাহলে ও ঠিকই বাড়ি ফিরে আসবে।
আবারও খেয়া ঘাটের পাড়ে বসে আছে সেতু। রাত তখন ১০টা। বিয়ের আগের দিনগুলো ওরা এখানেই বসে থাকত। তাদের ভালবাসা দেখে বাঁদরগুলো চুপ হয়ে যেত। তাদের হাসির শব্দে মুগ্ধ হতো পুকুরের মাছ। এতোটাই গভীর ছিল তাদের প্রেম। ওদের বিয়েটা বেশ ধুমধামেই হয়েছিল। বাবার একমাত্র মেয়ে ও। তাই কমতি রাখেনি আয়োজনের।
সেতুর চোখে পানি। কেন জানি সাইফুলের মুখটা বারবার চোখে ভাসছিল। তার চাপ দাঁড়ি আর মিষ্টি হাসি পাগল করে তুলত সেতুকে। সবসময় মানুষটা হাসত। মাঝে মাঝে সেতু রাগও হত। কারণ ওর ভয় করত, যদি ওই হাসিটা আর কোনদিন আর দেখতে না পায়।
সকাল হয়েছে। ভোরের কুয়াশার ভিড়ে সূর্যের আলোটা আজ একটু বেশীই ফুটে উঠেছে।আশরাফের বউ পানি আনতে গেছে খেয়া ঘাটে। অনেকদিন পর বাড়িতে আজ রান্না হবে। কিন্তু এসেই তার হাত থেকে কলস পড়ে ভেঙ্গে গেল। খেয়া ঘাটের পাড়ের আম গাছটায় সেতুর ঝুলন্ত শরীর দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করছে না।
এমন কেন করল!
সকাল পেরিয়ে দুপুর হতে চলেছে। দক্ষিণ পাড়ায় বাড়ছে মানুষের ভিড়। সবাই সেতুকে দেখে যাচ্ছে আর দু’এক ফোটা চোখের পানি রেখে যাচ্ছে। সবার প্রার্থনা! আল্লাহ যেন অবুঝ মেয়েটাকে মাফ করে দেয়।