উপভাষা, ভালোবাসা

ভাষা ভাবনায় রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা

প্রমথ রায়

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ , ৭:০২ অপরাহ্ণ ; 473 Views

একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয়তা বনাম ভাষার প্রতি ভালোবাসার ক্ষেত্রে এক তাৎপর্যময় দিন। ১৯৫২ সালে রফিক, শফিক সালামসহ শহিদ ভ্ইায়েরা আমাদের যে মাতৃভাষার দাবিতে প্রাণ দিয়েছিল, তা ছিল আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের দাবি। পরবর্তীতে কানাডা প্রবাসী বাঙালি জনাব রফিক এবং সালামের মাধ্যমে ইউনেস্কো যে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে, তা হলো মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা হলেও আমরা কিন্তু মায়ের মুখ থেকে এ ভাষা শিখি না। আমরা মায়ের কাছ থেকে প্রথম আমাদের আঞ্চলিক ভাষা শিখি। এ ক্ষেত্রে রংপুরের  আঞ্চলিক ভাষা বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। ২০০৭ সালের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ১৫ মিলিয়ন মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষাকে রংপুরী ভাষা বলা হয়ে থাকে। এছাড়াও এটাকে বাংলাদেশে বাহে, বাংলা, কামতা, পলিয়া এবং ভারতে কামতাপুরী, দত্তা, গোয়ালপুরীয়া, কোচ, রাজবংশী বলা হয়ে থাকে।

রংপুরী ভাষা ভারতের অন্যান্য ভাষার মতো ইন্দো-আর্য ভাষা হতে উদ্ভূত। ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থে এ ভাষাকে কামরূপী ভাষা হিসেবে অভিহিত করেছেন। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, এ ভাষা কামরূপী উপ-ভাষার একটি বিভাষা। আবার অনেক নৃতত্ত্ববিদের মতে এ ভাষা বোড়ো ভাষার পরিবার গোত্র।

যেহেতু রংপুর এক সময় কামরূপের অন্তর্গত ছিল, তাই স্বাভাবিকভাবে এ ভাষার সাথে কামরূপের ভাষা মিল থাকতে পারে। কামরূপী ভাষা হলো অসমীয়া ভাষার গোত্র। অসমীয়া ভাষার অন্য গোত্রটি হলো গোয়ালপুরিয়া। ভারতে অনেকে রংপুরী ভাষাকে গোয়ালপুরিয়া ভাষা বলে থাকেন। এক সময় কোচ রাজা বিশ্বসিংহ গোয়ালপুরে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন এবং তিনি রংপুরও শাসন করেন। এরই ভিত্তিতে রংপুরী ভাষা কামরূপ ভাষার সমগোত্র তা যুক্তিযুক্ত।

যেমন- ‘এটা কাম আইসু’ এই কামরূপী বাক্যটিকে আমাদের রংপুরে বলে ‘একটা কামোত আসসুং’। এ থেকে পরিলক্ষিত হয় কামরূপের সাথে রংপুরী ভাষার মিলকরণ।

অসমীয়া ভাষার কথা যেহেতু আসলই, তবে চর্যাপদের ভাষাতেও কি রংপুরের ভাষার প্রভাব রয়েছে? ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, চর্যাপদের ভাষা ‘প্রাচীন বঙ্গ-কামরূপী ভাষা’। সুকুমার সেনও চর্যাপদের ভাষাকে অসমীয়া ভাষা বলে দাবি করেছেন। তাই অবশ্যই এখন আমাদের চর্যাপদের ভাষা নিয়ে গবেষণা করতে হবে।

অনেকের মতে রংপুরী ভাষা বোড়ো ভাষা গোত্রের। কথাটি একেবারই যুক্তিহীন নয়। আমরা রংপুরী ভাষায় ক্রিয়ার শেষে যেমন অনুস্বার (ং) বা ম ব্যবহার করে থাকি, তা বোড়ো ভাষারই প্রভাবিত রূপ। তাছাড়া তিস্তা নদীর নামটি এসেছে বেড়ো ভাষার ডি¯ডাং শব্দ থেকে। অনেকে রংপুরী ভাষাকে রাজবংশী ভাষা বলে থাকেন। রাজবংশীদের বিশাল একটি অংশ রংপুরে বাস করে। আর রাজবংশীরা হলো কোচ সম্প্রদায় থেকে বিবর্তিত সম্প্রদায়। কোচরা বেড়ো ভাষায় কথা বলে থাকেন। তাই রংপুরী ভাষা যে বোড়ো ভাষা গোত্রের নয়, তা বলা যাবে না।

এরপর রংপুরে আগমন ঘটেছে আরব, ইউরোপ, চীনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের শাসক, ব্যবসায়ী, ধর্মপ্রচারক ও পর্যটকদের। তাদের ভাষারও প্রভাব রয়েছে এ রংপুরী ভাষায়। কিন্তু আজ থেকে শতবর্ষ আগেও আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে রংপুরী ভাষা যতটা প্রবল ছিল, তা এখন আর পরিলক্ষিত হয় না। বর্তমান সময়ে এ ভাষার ব্যবহার অনেকটাই কমে গেছে। আমরা যত শিক্ষিত হচ্ছি, ততই ভুলে যাচ্ছি আমাদের এই প্রিয় ভাষাকে। অনেক মা বাবাই তাদের সন্তানকে তথাকথিত মুর্খতা থেকে দুরে রাখার জন্য এ ভাষা বলা থেকে বিরত রাখছেন। কিন্তু এ ভাষা বলাতো কোন মুর্খতা নয়। আমাদের এ ভাষার চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের দেশের বিভিন্ন আদিবাসীরা বাড়িতে এবং সমগোত্রের মানুষদের সাথে মাতৃভাষায় কথা বলে থাকেন। আমরাও কি আমাদের বাড়িতে কিংবা আমাদের অঞ্চলের মানুষদের সাথে এ ভাষায় কথা বলতে পারি না? এখন অনেক শিক্ষিত ও শহুরে পরিবারে এ ভাষার চর্চা হয় না। আমাদের রংপুরী ভাষার ওপর ইতিহাসবিদ মতিউর রহমান বসনীয়া ‘রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান ও প্রয়োগরীতি’ নামে একটি অভিধান লিখেছেন। আমরা এ অভিধানটি সংগ্রহে রাখলে খুব সহজেই আমাদের এ ভাষার চর্চা করতে পারব। আসুন আমরা আগামী ভাষা দিবস থেকেই আমরা এ প্রিয় ভাষাকে মৃত ভাষার কাতারে না ফেলে এ ভাষার চর্চা বৃদ্ধি করি।

তথ্যসূত্র :

(ক) রাজবংশী সমাজ ও সংস্কৃতি- ড. অসীত কুমার বিশ্বাস।

(খ) রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান ও প্রয়োগরীতি- মতিউর রহমান বস্নীয়া।

(গ) বিভিন্ন ইন্টারনেট লিংক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *