আচ্ছা তারা কি জানে আমার বাবা একজন স্কুল শিক্ষক? তার চেয়েও বড় কথা তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা? জানলে নিশ্চয় এই আচরণ তারা আমার বৃদ্ধ বাবার সাথে করতে পারতেন না। আমি বাবার ছোট মেয়ে। ছোট বলতে সবার ছোট। মা কয়েকবছর আগে গত হয়েছেন। তিনি গত হয়ে ভালোই হয়েছে। বাবা এখন একজন রিটায়ার্ড স্কুল শিক্ষক। আগের মতো আয়-রোজগাড় তার নেই। আমাদের বাবা-মেয়ের চলতেই কত কষ্ট হয়। আমি জানি মা বেচে থাকলে মায়ের আরো কষ্ট হতো। তিনি আবার বেশি কষ্ট সইতে পারেন না। সইতে পারলে কি আর এতো তাড়াতাড়ি ওপারে যাওয়ার টিকেট কাটতেন? ভাবির সাথে সেদিন মায়ের একটু তর্ক লেগেছিল। মা-বাবার প্রেমের বিয়ে না তবুও মা বাবাকে খুব ভালোবাসতো। বাবা তার সারাটা জীবন পার করলেন মানুষকে শিক্ষা দিয়ে। সেই বাবাকে কেউ যদি লেখাপড়ার বিষয়ে জ্ঞান দেয় তা কি বাবার ভালো লাগবে নাকি মায়ের? বাবা ধৈর্যশীল মানুষ তাই তিনি সয়ে গেছেন কিন্তু মায়ের তো আর অত ধৈর্য নেই। তাই ভাবির সাথে তর্কটা লেগে যায়। ভাইয়া রাতে ফিরলে ভাবি ভাইয়াকে কী যে বলল, তা শুনেই ভাইয়া সেকি রাগ মায়ের উপর। মায়ের বড় ছেলে ভাইয়া। খুব আদর করত মা ভাইয়াকে। ভাইয়া নাকি বাবা-মার কত সাধনার ধন। বিয়ের সাত বছর পরও যখন সন্তান হচ্ছিল না তখন কত তাবিজ-কবজ করে নাকি ভাইয়াকে পায়। যাহোক ধান ভাঙতে আর শিবের গান না গাই। সেদিন ভাইয়া মাকে অনেক কথা শুনিয়েছিল। ওই যে বললাম মায়ের আমার ধৈর্য কম ছিল। তাই ছেলের কথাগুলো বোধ হয় তার খুব লেগেছিল। কোথায় লেগেছিল কে জানে। মা রাতে ঘুমিয়ে পড়লেন কিন্তু পরদিন সকালে আর তার ঘুম ভাঙল না। চিরতরে ঘুমিয়ে গেলেন আমার মা। সেই থেকে আমার বাবার একমাত্র চিন্তাও আমি ভরসাও আমি। অন্য ভাই-বোনেরা যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আমার তো আর সংসার নেই তাই আমি সারাদিন বাবাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকি। আমার সংসার থাকবেই বা কি করে? কাকসুন্দরী মেয়েদের কি কেউ বিয়ে করতে চায়? কেউ চাইলেও তাদের বাড়তি চাওয়া পূরণ করার সাধ্য যে বাবার নেই।
বাবাকে নিয়ে আমি এখন আমাদের জেলার সরকারি মেডিকেলে আছি। বাবার শ্বাসকষ্টটা অনেক বেড়ে গেছে। শীতে মেডিকেলে রোগীর সংখ্যা বেশি। তাই বাবার স্থান হয়েছে ফ্লোরে। আমি কর্তব্যরত একজন নার্সকে বললাম একটা বেডের ব্যবস্থা করে দিতে। তিনি আমাকে বললেন-আপনারা কি এমন ভিআইপি লোক যে বেড না হলে আপনাদের চলবেই না। বেশি অসুবিধা হলে কেবিন ভাড়া নিন। অনেক আরামে থাকবেন।
আমি বলতে চাইলাম, আমার বাবা একজন………
কিন্তু বাবা আমাকে ইশারা করে নিষেধ করলেন। বাবার কথা -যুদ্ধ করেছি আমার দায়য়বদ্ধতা থেকে, দেশ মাতৃকাকে রক্ষা করতে। এখানে সেখানে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বলে সুযোগ সুবিধা লাভের জন্য নয়।আর দশজন লোক যেভাবে বাঁচে আমিও সেভাবেই বাঁচতে চাই।
বাবা একটু সুস্থ হলে আমি বাবাকে নিয়ে গ্রামে যাওয়ার জন রেলস্টেশনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। কিন্তু কি এক কারনে পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। আমাদের রিক্সাটা ছিল সবার সামনে। রিক্সাওয়ালা অহেতুক বেল বাজিয়ে চলেছেন। ডিউটিরত পুলিশটা এসে রিক্সাওয়ালাকে কষে একটা চড় দিলেন। ট্রাফিক পুলিশ না থানার পুলিশ। বাবা রিক্সাওয়ালার পক্ষ নিয়ে পুলিশকে বললেন, বাবা ধাপ্পড়টা না দিলেও পারতেন। পেশায় না হোক আপনার থেকে তো বয়সে বড়, তার গায়ে হাত তোলা কি ভালো কাজ?
পুলিশটার আত্মসম্মানবোধ হয় একটু বেশি। উনি আমার বাবার কলার টেনে ধরে রিক্সা থেকে নামালেন। “আমাকে আইন শেখাও বেটা, আমাকে আইন শেখাও? এবার দেখ কেমন লাগে।”
আমি বাবাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু উনি আমাকেও একটা ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিল। বাবা তার স্বভাব সূলভ উত্তর দিলেন- আমিতো আইন নিয়ে কিছু বলিনি। আপনি যে কাজটা করলেন সেটা না করলেও পারতেন তাই বলেছি। ক্ষমতা হাতে পেয়ে তো রীতিমতো তার অপব্যবহার করছেন আপনি। একজন রিক্সাওয়ালা বেল বাজালে তার গায়ে হাত তুলতে হবে এটা কোন আইনে আছে বলেন তো।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড। আমার বাবা তার উঁচু মাথা নিচু করে ফেললেন। অথচ জীবনে কখনো আমি বাবাকে মাথা নিচু করে হাঁটতেও দেখিনি। মাথা নিচু করে নাকি ভীতুরা হাটাচলা করে। অথচ আজ আমার সাহসী বাবা মাথা নিচু করে আছে আমার সামনে। চুপচাপ বাবা রিক্সায় উঠে এল। কিছুক্ষণ পর রাস্তা খুলে দেওয়া হলো। আমরা চলে এলাম। বাড়িতে এসে বাবা সবসময় চুপচাপই থাকত। মেয়ের সামনে থাপ্পড় খাওয়া কোনো কাপুরুষ বাবাও সহজে হজম করতে পারবে না। আর আমার বাবা তো সাহসী বাবা, একাত্তরের বীর সৈনিক। তিনি কীভাবে এই লজ্জা হজম করবেন। একসপ্তাহও কাটল না। এই লজ্জা নিয়ে আমার বাবার পক্ষে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা কতটা অসম্ভব ছিল তা একমাত্র আমি জানতাম। তাই তিনিও মায়ের পথ অনুসরণ করলেন। কাউকে কিছু বুঝতে দিলেন না। নিঃশব্দে চলে গেলেন। বাবা মারা যাওয়ার কথা শুনে সেনাবাহিনীর লোকজন এসেছিল আমার বাবাকে সম্মান জানাতে। আমি তাদের তা করতে দেইনি। এতে আমার অন্যান্য ভাইবোন এমনকি গ্রামবাসীও আমার উপর চরম ক্ষেপেছিল। কেন করতে দিব? যে সম্মান আমার বাবা বেঁচে থাকতে পায়নি মরে গিয়ে সেই সম্মান সে কী করবে? কী লাভ সেই সম্মান পেয়ে? সবাই জানে আমার বাবা বার্ধক্য কিংবা শ্বাসকষ্টজনিত কারণে মারা গেছে। কিন্তু আমি তো জানি বাবা কেন মারা গেছে। বাবার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস, উদাস চাহনি আমাকে বারবার শিহরিত করত, আমাকে ভাবাতো, আমাকে ভয় পাইয়ে দিত। একজন মানুষ কীভাবে তিলে তিলে শেষ হয়ে যায় আমি আমার বাবাকে দেখে তা বুঝেছি।
একজন সাহসী যোদ্ধা যিনি যুদ্ধ করে দেশের জন্য বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন কিন্তু জীবন যুদ্ধে তিনি পরাজিত সৈনিকের মতো মাথা নত করে চলে গেলেন এই পৃথিবীর মায়াজাল ছিন্ন করে।