১) বাহিরে কনকনে ঠাণ্ডা । সেই সাথে বইছে হিমেল হাওয়া। এই ঠাণ্ডায় যেখানে ঘরের ভিতরে থাকা দায় সেখানে শিউলি বাহিরে যাচ্ছে কী কারণে? মা বললেন- কিরে শিউলি, এই ঠাণ্ডার দিনোত কোটে কোনা যাওছিস? শিউলি বাজারের ব্যাগ হতে নিয়ে বললো – মা, এ্যানা কাম আছে, যাইম আর আসিম ।
-কলেজত যাবু না, ১০ টা তো বাজি গেছে ।
-আইজ মনে হয় কলেজত যাওয়া হবার নয় । মা মোক ছয়শোটা টাকা দে তো ।
মা চোখ আসমানে তুলে বললেন – ওমা ওমা, এটা তুই কি কওছিস শিউলি ? এত টাকা মুই কোটে কোনা পাইম। এতগুলা টাকা কি মুই কোন দিন চোখে দেখছোও । তাছাড়া আজই শাবানা আইসবো জামাই নিয়ে । উমরা গুলার জন্য হাট থাকি মুরগি, তেল, চিনি আইনবার লাগবার নয়?
-সগেই এ্যালা হবে মা, মোক আগে টাকা দে তো । মুই দেখ কি নিয়া আইসম। শিউলি জোর জবরদস্ত করে মায়ের আচল থেকে টাকা বের করে নিয়ে একটা শাল গায়ে জড়িয়ে বাহিরে চলে যায় ।
২) পোস্ট অফিসের সামনে অনেক ভিড়। আজ সোমবার , টিসিবির মাল দেওয়ার কথা আছে এখানে । তাই তো শিউলি কলেজ বাদ দিয়ে এত ঠাণ্ডা শীত উপেক্ষা করে এখানে এসেছে । ভালই হলো, খুব একটা লোকজন নেই আজ । এর আগের দুইদিন এসেছিল শিউলি কিন্তু এত ভীড় ছিল তাকে লাইনের শেষ সীমায় দাঁড়াতে হয়েছিল । তার সিরিয়াল আসতে আসতে তেল, ডাল, পিয়াজ সব শেষ হয়ে গিয়েছিল । বাকি ছিল শুধু চিনি । শিউলি সেদিন শুধু চিনি নেয়নি । আজ সে লাইনের প্রথমে দাঁড়িয়েছে । তার পিছনে মাত্র পাঁচ সাত জন । কিন্তু ট্রাক কোথায় ? সময়ের সাথে সাথে লাইন দীর্ঘ হচ্ছে । অনেক লোকজন এসে তার পিছনে দাঁড়িয়েছে । সবার মুখে বিরক্তির ভাব । বেলা বাজে আটটা । এখনো ট্রাক আসার নাম নাই । আস্তে আস্তে লোকজন কমতে থাকে । শিউলি পণ করেছে আজ সে টিসিবির মাল নিবেই নিবে । বাবা অসুস্থ, কামাই রোজার বন্ধ । তাছাড়া তার বুবু শাবানা অনেক দিন পর আজ বেড়াতে আসছে । টিসিবির তেল, পিয়াজ, চিনি পেলে দুই তিনশ টাকা বাচানো যাবে । বাজারে তেল চিনির যা দাম, তাদের মতো নিম্নবিত্ত পরিবারের বাজার থেকে এসব কিনে খাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে । শিউলির ভাবনার মাঝে কার যেন একটা হাত এসে তার ঘাড়ে পরে । সে চমকে পিছনে তাকায় । দেখে তার বন্ধু মনিরা । মনিরা বললো- কিরে শিউলি, এটিকোনা যে ?
শিউলি বললো, তেল ডাল নিমরে । তার দেখিস এলাউ কোনা ট্রাক আসপ্যার নাকছে না । কলেজ বাদ দিনু কয়টা টাকা লাভের আশায়, তাক বুছি আর হইল ন্যা । মোর কথা বাদ দে, তুই ক, তুই এটি ক্যা ?
– মুই আসচোম পোষ্টপিসো একখান চিঠি দিব্যার । তোক দেখি এটিকোনা আনু ।
– কলেজোত গেছিলু ?
– হ, গেছুম। শামীম স্যার তোর কথা জানবার চাইলো ।
শামীম স্যারের কথা শুনে শিউলির মুখটা খুশিতে চকচক করে উঠলো । সে মৃদু হেসে বললো – শামীম স্যার মোর কথা কি কইলোরে মনিরা ? মনিরাও হাসে । হেসে বলে – শামীম স্যার কইল, তুই ব্যান কোনদিন লেখাপড়া বাদ দেইস না । লেখাপড়া করি তুই যেন একদিন বড় চাকরি করিস।
– শামীম স্যার মোক নিয়া খুব ভাবে, তাই নারে মনিরা ?
– ভাবিয়া আর কি করবি ক । তেলে জলে তো আর কোনদিন মিশ খাবার নয় । শিউলি এবার মনিরাকে ধাক্কা দিয়ে বললো – কি এগুলা কওছেস মনিরা, বাদ দে তো । তুই তেল চিনি নিবু নাকি ?
– হ, নেওয়ার তো ইচ্ছা আছিল, কিন্তু ট্রাকতো আইসপার নাগছে না । তাদের কথার মাঝে ট্রাক চলে আসে । ট্রাক ভর্তি মালামাল । শিউলি আর মনিরা তাদের ইচ্ছামতো মালামাল নিয়ে খুশিতে হেঁটে হেটে বাড়িতে আসে ।
৩) টিসিবির মাল দেখে মা খুব খুশি । তিন চারশ টাকার মতো বাচলো আজ । শাবানা এসেছে। শাবানাকে আজ তেল পিঠা বানিয়ে খাওয়াবে শিউলি । চারশ টাকা বাচাতে পেরে তাদের খুশি আর ধরে না । এই টাকা সাথে আরো কিছু টাকা যোগ করে শিউলি তার ছোট ভাই রানাকে নিয়ে বাজারে মাছ মাংশ আনতে গেল ।
রাত বাজে এগারোটা । শাবানা খেয়ে দেয়ে শিউলির বিছানায় এস বসলো । শিউলি বললো – বুবু কিছু কবু ? মোর না খুব ঘুম পাইছে ।
শাবানা বোনের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদু স্বরে বললো – তোর জন্য একটা সমন্ধো আনছোম শিউলি, খুব ভাল চ্যাংরা । সৌদিত থাকে । ম্যালা টাকা পয়সা । বিয়া করার জন্য আসছে ।
শিউলি বিস্মিত স্বরে বললো – এটা তুই কি কওছিস বুবু ? মোক বিয়া দিবু মানে ? মোর তো এ্যালাও আঠার বছর হয় নাই । তাছাড়া মুই এ্যালাই বিয়া করবার নও । মুই মাষ্টারনি হইম । কলেজোত চাকরী করিম । তুই এ কথা আর মুখোত আনিস না বুবু ?
শাবানা বললো – আঠার হয় নাই, হইবে । এমন ভাল চ্যাংরা আর জীবনে পাবু না । শুনছোম সৌদি থাকি দশ ভরি সোনা আনছে । সগেই বউক দিবে ।
– মিছা কথা বুবু, সউব মিছা কথা । যামরা বিদেশোত চাকরী করে তামার চরিত্র ভাল হয় না। তাছাড়া মুই পড়ব্যার চাও । শামীম স্যার কইছে লেখাপড়া ছাড়া নারীর মূল্যায়ন কেউ করে না । লেখাপড়া হলো প্রত্যেক মেয়ের জন্মগত অধিকার ।
শাবানা এবার মুখ বিকৃতি করে বললো – তুই দেখম শুদ্ধ করে কথা কওছিস শিউলি। আর শামীম স্যারটা কেটা ? তোর মাষ্টার ?
শামীম স্যার যাই হয় হোক, তুই এ্যালা এটি থেকি যা । শিউলি একরকম জোর করে বোনকে ঘর থেকে বের করে দেয় ।
৪) শিউলি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে । কিন্তু ঘুম আসেনা । তার বুকটা ধক ধক করে কাঁপতে থাকে, বুবু এটা কি শুনালো ? বিয়ে !! না না, বিয়ে সে করবে না । সে লেখাপড়া করবে । এই মুহূর্তে তার শামীম স্যারে কথা খুব মনে পড়ে । একমাত্র শামীম স্যারই তাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবে । তার ভাবনার মাঝে বালিশের পাশে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো । শিউলি ফোনটা হাতে নিতেই অপর প্রান্ত থেকে শামীম স্যারের সুমধুর কন্ঠ ভেসে আসে – হ্যালো, শিউলি কেমন আছো, আজ যে কলেজে এলে না ?
– শিউলি হুরমুড় করে বলে উঠলো – স্যার ভাল নেই স্যার ।
– কেন কি হয়েছে ?
– স্যার মোর বুবু মোক বিয়া দিবার চাওছে । মোক বাচান স্যার । মুই লেখাপড়া করবার চাও।
– শিউলি শুদ্ধ করে কথা বল এবং আমাকে পরিষ্কার করে বল বিষয়টা কি ।
– স্যার কোন বিষয় নাই স্যার । আমি বিয়া করবো না । আপনি কি আমার দায়িত্ব নিতে পারবেন স্যার ?
– দায়িত্ব নিতে পারব কিনা জানি না, তবে তোমার লেখাপড়ার যাতে কোন ক্ষতি না হয় সেদিকে জোড়ালো নজর রাখব । দরকার হলে থানায় যাব তোমার জন্য একটা ডায়রী করতে । দেখি তোমার মতের বিরুদ্দে কে তোমাকে বিয়ে দেয় ? স্যারের কথা শুনে শিউলির মনের স্বপ্ন ঘড়িটা ঢং ঢং করে বেজে ওঠে । সে একটা স্বস্তির নিঃশ^াস ছেড়ে বলে – স্যার পৃথিবীতে এখনো ভাল মানুষ আছে । আপনাদের মতো কয়েকজন ভাল মানুষ থাকলেই এদেশের মেয়েদের এগিয়ে যেতে কোন সমস্যা হবে না । আপনি ভাল থাকুন স্যার, বলেই শিউলি ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করে ।
লেখক: গল্পকার, রংপুর।