স্মৃতি কখনো কখনো মানুষের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে। স্মৃতি বিস¥রণ মানুষের জন্য কল্যানও হয়, কেনো না যদি সেই স্মৃতিতে মানুষ বিতারিত হতো তাহলে প্রয়োজনের মৃত্যু তাকে স্মৃতি ভ্রষ্ট করে তুলত। এই স্মৃতি বিস্মরণ কখনো কখনো জাতি কে তার নিজস্ব গতি পথ থেকে অন্যত্র ধাবিত করে তোলে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি সমগ্র অস্তিত্বকে জাতির উৎসের সন্ধানে যেভাবে আলোড়িত করেছিল বাঙালিকে অশান্ত ক্ষুব্ধ যন্ত্রনা, কিংবা আন্দোলিত এবং উদ্বীপিত করেছিল সেই চেতনা যেন ১৯৭১ এর পহেলা মার্চ পূর্বঘোষিত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষনা করা হলে পূর্ববাংলায় গণবিস্ফোরণ ঘটে। অন্যান্য স্থানের মতো গাইবান্ধাতেও অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষিত সকল কর্মসূচি স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হতে থাকে। ৩ মার্চ গোটা গাইবান্ধায় পূর্ণ দিবস হরতাল পালিত হয়। সরকারি-বেসরকারি, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বিমা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সকল প্রকার যান-বাহন চলাচল বন্ধ থাকে। বিকেলে আওয়ামীলীগের উদ্বোগে নবনির্বাচিত এম,এন,এ লুৎফর রহমানের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নামে যৌথ ভাবে আন্দোলন সংগ্রামের কর্মসূচী পালন করতে থাকে। ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষনের নির্দেশনা অনুসারে সদর উপজেলাসহ মহকুমার সর্বত্র সরকারি- বেসরকারি অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট অব্যাহত থাকে। বন্ধ হয়ে যায় সকল প্রকার খাজনা ট্যাক্স আদায়। প্রতিটি বাড়িতে উড়তে থাকে কালো পতাকা। প্রায় প্রতিদিন মহকুমার শহরে লাঠি-সোটাসহ পতাকা হাতে মিছিল হতে থাকে। ১২ মার্চ গাইবান্ধা মিউনিসিপ্যালিটি পার্কে আওয়ামীলীগের উদ্যোগে এম,এন,এ লুৎফর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় স্বাধিকার আদায়ে দৃঢ় শপত গ্রহন করা হয়। একই দিনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আয়োজনে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা গনেশ প্রশাদের সভাপতিত্বে একটি ছাত্র সভাও অনুষ্ঠিত হয়। ১৫ই মার্চে মহকুমার আওয়ামীলীগের সভাপতি এম,এন,এ লুৎফর রহমানকে আহবায়ক এবং সদর উপজেলার এমপিএ ওয়ালিউর রহমান রেজা ও মহকুমা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ আতাউর রহমান কে যুগ্ন আহবায়ক করে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট মহকুমার সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। অন্য ১৪ জন সদস্য হলেন নবনির্বাচিত দুই এম.এন.এ শাহ্ আব্দুল হামিদ ও ডা. সোলাইমান মন্ডল, ৫ এমপিএ ডা. মফিজার রহমান, আবু তালেব মিয়া, জামালুর রহমান প্রধান, আজিজার রহমান, শামসুল হোসেন সরকার, ভাষা সৈনিক মতিউর রহমান, হাসান ইমাম টুলু, গোলাম কিবরিয়া, নির্মলেন্দু বর্মন,হাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ খালেদ ও নূরুল আবছার তারা মিয়া। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কর্মীরা উদ্যোগী হয়ে এলাকা ভিত্তিক সংগ্রাম কমিটির গঠন করতে থাকে। তৎকালীন অবাঙালি মহকুমা প্রশাসক এস.এস.জি.এ রিজভী ও অগ্রনী ব্যাংক কর্মকর্তা রেজা শাজাহান প্রশাসনিক কার্যক্রমে মহকুমা সংগ্রাম কমিটিকে সহযোগিতা করেন।
২৩ শে মার্চ রিপাবলিকান দিবস ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকার সর্বত্র পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলরের নির্দেশ দেয়। অন্য দিকে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও স¦াধীন বাংলা শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ ঐ দিন দেশব্যাপী ‘প্রতিরোধ দিবস’ আহবান করে। সেই সকল কর্মসূচী সফল করতে ২৩ মার্চ গাইবান্ধা পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে (বর্তমান স্বাধীনতার বিজয়স্তম্ভ চত্বর) ছাত্রলীগের মহকুমা সভাপতি এম.এন.নবী লালুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ছাত্র জনতার সমাবেশে বক্তৃতা করেন আওয়ামীলীগ নেতা নির্মলেন্দু বর্মন, মোহাম্মদ খালেদ, ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল আরেফিন তারেক, সৈয়দ শামস্ উল আলম হীরু, সদরুল কবীর আঙ্গুর, আমিনুল ইসলাম ডিউক প্রমুখ। সমাবেশ শেষে পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে উড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। ২৪ শে মার্চ গাইবান্ধা শহরে মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঐদিন বিকেলে ভিএইড রোডস্থ বার্মা ব্যংক ভবনে গাইবান্ধা শহরে অবস্থানকারী অবসর প্রাপ্ত বা ছুটিতে আসা সেনা, নৌ, বিমান ও আনছার বাহিনীর সদস্যদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২৬ শে মার্চ সকালে গাইবান্ধার ওয়্যারলেস কেন্দ্রের মাধ্যমে মহকুমা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক লুৎফর রহমান এম,এম,এ যুগ্ন আহবায়ক ওয়ালিউর রহমান রেজা এমপিএ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনা পেয়ে যান। ঐদিন মহকুমা সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক হাসান ইমাম টুলুর নেতৃতে¦ গাইবান্ধা ট্রেজারি থেকে দু’শ রাইফেল ও গোলাবারুদ এবং আনসার ক্যাম্পে অস্ত্রগুলো নিয়ে ছাত্র যুবকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। ২৭শে মার্চ থেকে গাইবান্ধা কলেজ এবং ইসলামিয়া হাই স্কুল মাছে যুদ্ধের প্রশিক্ষন শুরু হয়। গাইবান্ধা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ অহিদউদ্দিন আহম্মেদ রোভার স্কাউটের তিন’শ কাঠের রাইফের নিয়ে প্রশিক্ষনের সহায়তা করেন।
এরই ধারাবায়িকতায় থানা সদরগুলোসহ বিভিন্ন এলাকায় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হতে থাকে। বিভিন্ন থানা সংগ্রাম কমিটির আহŸায়ক ছিলেনঃ সুন্দরগঞ্জ–মোসলেম আলী, সাদুল্লাপুর–আবু তালেব মিয়া, পলাশবাড়ী–তোফাজ্জল হোসেন, গোবিন্দগঞ্জ–জামালুর রহমান প্রধান, সাঘাটা–আতাউর রহমান। এরা সবাই ছিলেন আওয়ামীলীগের নেতা। সুবেদার আলতাফ হোসেন তার অধীনস্ত বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদের নিয়ে দেশ মুক্ত করার সংগ্রাম সংগঠিত করতে গাইবান্ধা চলে আসেন। আলতাফ সুবেদার নামে এই সাহসী যোদ্ধা গাইবান্ধা কারাগার থেকে সকল বন্দীকে মুক্ত করে দেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহনের আহŸান জানান। শহরের বিভিন্ন স্থানে চলতে থাকে সশস্ত্র প্রশিক্ষন। অন্যান্য থানাগুলোতেও চলতে থাকে মুক্তি সংগ্রামে প্রস্তুতি।
গাইবান্ধার বীর সন্তানেরা ছড়িয়ে পড়ে কুড়িগ্রামের রৌমারী, রাজিবপুর ও চিলমারীর মুক্ত এলাকায় এবং ব্রক্ষপুত্রের পূর্ব পাড়ের নিরাপদ স্থানে। গাইবান্ধা নির্বাচিত প্রতিনিধির অনেকেই বি এস এফ (সীমান্ত নিরাপত্তারক্ষী) এর সাথে যোগাযোগ করে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য ছুটে যাওয়া দামাল সন্তানদের সংগঠিত করে তাদের আশ্রয় ও মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য শিবির স্থাপনে তৎপর হন। লুৎপর রহমান এমএনএ মুক্তিযুদ্ধ কালে নর্দান জোনাল কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য ও মানকারচরে মুক্তিযুদ্ধ শিবির প্রধানের দায়িত¦ পালন করেন। গাইবান্ধা সদরের এমপিএ ওয়ালিউর রহমান রেজা মুজিবনগর সরকারের সিভিল এ্যাফেয়ার্স এ্যাডভাইজার হিসেবে ৬ নম্বর সেক্টরে দায়িত্ব পালন করেন। সাঘাটা–ফুলছড়ি থেকে নির্বাচিত এমপিএ ডা. মফিজার রহমান মুক্তিযুদ্ধকালে আসামের কাকড়িপাড়া মুক্তিযোদ্ধা যুব ক্যাম্পের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, মুজিবনগর সরকারের উত্তরাঞ্চলীয় সাব সেক্টরের বেসরকারি গোয়েন্দা শাখার প্রতিষ্ঠাতা প্রধান ছিলেন। সাদুল্লাপুর থেকে নির্বাচিত এমপিএ আবু তালেব মিয়া গোয়ালের চর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন। গাইবান্ধা মহকুমা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক আতাউর রহমান ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার রায়গঞ্জ থানাধীন ধানেশ্রী সেন্ট্রাল ইয়্যুথ ক্যাম্পের ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করেন।
এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সীমান্ত এলাকায় যুবকদের সংগঠিত এবং প্রশিক্ষণের জন্য ১১০টি যুব অভ্যর্থনা শিবির খোলা হয়। এর মধ্যে মানকার চরের সরণতলী এবং কুচবিহারের খোচাবাড়ি শিবিরের ক্যাম্প–ইনচার্জের দায়িত্ব পান গাইবান্ধার দুই এমটিএ যথাক্রমে ডা. মফিজার রহমান এবং ওয়ালিউর রহমান রেজা। শিবিরগুলোতে নবাগতদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। গাইবান্ধা বিভিন্ন অঞ্চল স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সংগঠকদের অন্যতম আলী মাহবুব প্রধান ও আনসার কমান্ডার আজিম উদ্দিনের তত্ত¡াবধানে বড়াইবাড়িতে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করার সিদ্ধা›ত নেয়া হয়। ওদিকে বড়াইবাড়ি ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দ্রæত বৃদ্ধি পায়। মানকার চরে অবস্থানরত এম.এন.এ এবং এম.পি.এ সহ নেতৃবৃন্দের সার্বিক সহযোগিতায় পরিচালিত বড়াইবাড়ি ক্যাম্প থেকে ব্যাপক প্রশিক্ষনেন জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাকড়িপাড়ায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ১ম ব্যাচ হিসেবে ১১৩ জনকে ভারতের তরা পাহাড়ে প্রেরণ করা হয়।কাকড়িপাড়ায় প্রাথমিক প্রশিক্ষণ অব্যাহত থাকে। তুরায় চলে ১১৩ জনের গেরিলা প্রশিক্ষন। এসময় মুক্তিযুদ্ধে বেগবান হতে থাকে এবং মুক্তিযোদ্ধারা সফলতা অর্জন করতে থাকেন।ক্রমান্বয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এছাড়া উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ শেষে পুনরায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
একাত্তরের ১৭ এপ্রিল গাইবান্ধা শহরে প্রবেশ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হেলাল পার্কে (বর্তমান শাহ্ আব্দুল হামিদ স্টেডিয়াম) মহকুমার সদর দপ্তর স্থাপন করে। শহরে ঢুকেই তারা গাইবান্ধা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মাদারগঞ্জ প্রতিরোধ যুদ্ধে আহত বীরযোদ্ধা নুরুল আমিনকে হত্যা করে। এরপর কামারপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ চলার খবর পেয়ে সেখানে যাওয়ার পথে তারা হাট ল²ীপুরে হত্যা করে পাঁচজন সাধারণ মানুষকে। পরবর্তীকালে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা গাইবান্ধার শহর–বন্দর, গ্রাম–গঞ্জে হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা সংঘঠিত করে। আর এ সকল কাজে তাদের সহায়তা করে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগের সমন্বয়ে গঠিত শান্তি কমিটি (পিস কমিটি), রাজাকার, আলবদর, ফজলুল হক ব্যাটালিয়ান, অবাঙালি মুজাহিদ বাহিনী।
১৯৭১ সালের ১৮ অক্টোবর রাতে কোম্পানি কমান্ডার সাইফুল আলম সাজা এবং গোয়েন্দা গ্রæপের প্রধান ফজলুল রহমান রাজার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দলের সাথে যুদ্ধে এই গণহত্যা সংঘটিত হয়। তৎকালীন গাইবান্ধা মহকুমার সদর থানার সাহাপাড়া ইউনিয়নের নান্দিনা গ্রামে এই হত্যাকান্ড ঘটে।
গাইবান্ধা মহকুমার পলাশবাড়ী থানার কিশোরগাড়ী ইউনিয়নের কাশিয়াবাড়ী এলাকায় স্বাধীনতা যুদ্ধকালে সংঘটিত হয়েছিল নির্মম এক হত্যাকান্ড। ১৯৭১ সালের ১১ জুন পাকিস্তানি হানাদার এবং তাদের এদেশীয় দোসররা হত্যা করেছিল ঢাকা–রংপুর মহাসড়ক থেকে ৯ কিলোমিটার দূরের এই এলাকার শতাধিক মানুষকে।
১৯৭১ সালের ১৮ অক্টোবর গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের নিভৃত ‘পাখেড়া গ্রামে সকাল ১০টার পর হঠাৎ করেই উপস্থিত হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তারা ঐ গ্রামের স্কুল শিক্ষক দীনেশ চক্রবর্তীসহ ৪জন এবং পাশ^বর্তী ক্রোড়গাছা গ্রাম থেকে কৃষি কাজ করতে আসা ৩ জন সহ মোট ৭জন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে পাশের বাঁশের ঝাড়ে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করে।
বোনারপাড়ার রেলওয়ে লোকোসেডের স্টিম ইঞ্জিন ও পাম্প মেশিনের জ¦লন্ত বয়লারে নিক্ষেপ করে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটেছে। ১৯৭১ সালের ১৭ নভেম্বর বোনারপাড়ায় পাকিস্তানি হানাদাররা এক নির্মম গণহত্যা সংঘটিত করে। ঐদিন সকাল ৯টার দিকে পাকিস্তানি সেনা ও অবাঙালিরা বোনারপাড়ার পাশর্^বর্তী শিমুলতাইড় গ্রামের মধ্যপাড়া ঘিরে ফেলে। ঐ এলাকা থেকে হানাদাররা ৩০ জন বাঙালিকে আটক করে বোনারপাড়া রেলের এনএ খান রিত্রেæয়েশন ক্লাবে নিয়ে আসে। সেখানে নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদের পর ১৩ জনকে আটক রেখে বাকীদের ছেড়ে দেয়। ঐদিন রাতে আটক ১৩ জনকে নির্যাতন করে অর্ধমৃত অবস্থায় লোকশেডের স্টিম ইঞ্জিন ও পাম্প মেশিনের জ¦লন্ত বয়লারে নিক্ষেপ করে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর আরো অনেককেই এভাবে হত্যা করা হয়।
১৯৭১ সালে ২ জুন সাঘাটা থানার বোনারপাড়া ইউনিয়নের দলদলিয়া গ্রামে পাকিস্তানি সেনারা তাদের এদেশীয় দোসর অবাঙালিরাসহ ভোরবেলা ঘিরে ফেলে। তারপর হিন্দু প্রধান গ্রামটিতে শুরু করে নারকীয় তান্ডব। অনেক গ্রামবাসীর ঘুম ভাঙ্গে ভীত সন্ত্রস্ত মানুষের চিৎকার আর দৌড়াদৌড়িতে। হানাদাররা শুরু করে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, পৈশাচিক নির্যাতন। রেহাই পায়নি বৃদ্ধ, নারী, শিশু কেউই।
১৯৭১ সালের ১১ জুলাই থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সামরিক অফিসারদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টর বিভক্ত করা হয়। মেজর জিয়ার নেতৃত্বে জেড ফোর্স গঠন করা হয়। গাইবান্ধা অঞ্চল ছিল এই জেড ফোর্সের অধীন। সেপ্টেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর নির্দেশে জেড ফোর্স সিলেট অঞ্চল চলে গেলে এ অঞ্চল হয়ে উঠে ১১ নম্বর সেক্টর। এতে নেতৃত্ব দেন মেজর আবু তাহের। উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১১৩জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে মানকার চরের কামাক্ষা মন্দিরের টিলায় ১১ নম্বর সাব সেক্টরের গোড়া পত্তন ঘটে। এই সাব–সেক্টরের কমান্ডের দায়িত্ব পান বিমান বহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার মো. শফিক উল্লাহ এবং পরবর্তীতে ফ্লাইট লেঃ হামিদুল্লাহ খান। কামালপুরে সম্মুখ যুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার মেজর তাহের গুরুতর আহত হলে হামিদুল্লাহ খান সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব লাভ করেন। এই সাব সেক্টরের উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন খায়রুল ইসলাম ওরফে নজরুল ইসলাম, এম এন নবী লালু, রোস্তম আলী, মাহাবুব এলাহী রঞ্জু, আমিনুল ইসলাম সুজা, ছোট নূরু,মবিনুল ইসলাম জুবেল, মোজাম্মেল হক মন্ডল, রফিকুল ইসলাম হিরু, বজলার রহমান, মহসীন, গৌতম, সামছুল আলম, বজলু, বন্দে আলী, মান্নান, নাজিম, বক্কর, তোতা, আহসান, কাসেম, হায়দার, মজিবর, জিন্নু,মহব্বত প্রমুখ। জুনের প্রথম দিকে তুরায় প্রথম ব্যাচ ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি কোম্পানি গঠন করা হয়। কোম্পানি কমান্ডার আমিনুল ইসলাম সুজার অধীনে তিনটি প্লাটুনের কমান্ডার ছিলেন এমএন নবী লালু, মাহাবুব এলাহী রঞ্জু ও রোস্তম আলী কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত¦ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অপারেশন শুরু করতে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। এখানে কিছু দুঃসাহসিক যুদ্ধের বর্ণনা উপস্থাপন করা হলো।
মাহাবুব এলাহী রঞ্জু ও রোস্তম আলীর নেতৃত্বাধীন দুটি সেকশন এল এম, জি, স্টেনগান, এস এল আর, রাইফেল ও গ্রেনেড নিয়ে যৌথভাব গাইবান্ধা উপজেলাধীন বাদিয়াখালী রোড–ব্রিজ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেন।
২৯ মে কাজিউল ইসলাম নৌকা যাত্রীদের কাছে জানতে পারেন যে সুন্দরগঞ্জ কালীবাজারে হানাদার বাহিনী কয়েকজন রাজাকার নিয়ে অবস্থান করছে।
১৮ আগস্ট ভোর না হতেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য অন্যতম যুদ্ধ কোদালকাটির যুদ্ধ শুরু হয়। হানাদার বাহিনী নৌ, স্থল ও আকাশ পথে একযোগে আক্রোমন করে। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনীর ত্রিমুখী বর্বরোচিত হামলা প্রতিরোধ হাতে থাকে জেড ফোর্স অধিনায়ক মেজর জিয়ার সার্বিক নেতৃত্বে। সুবেদার আলতাফের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর ৩মটারটি এক পর্যায়ে বিকল হয়ে যায়। সুবেদার আলতাফ উন্মাদের মত ছুটাছুটি করতে থাকেন। মুখোমুখী যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী যুদ্ধরত রাইফেল, স্টেন ও এলএমজিধারী বীর যোদ্ধাদের যুদ্ধে কভারিং ফায়ার সম্ভব হচ্ছিল না। এদিকে হানাদার বাহিনীর গানবোট থেকে শেলিং, এয়ার এ্যাটাক ও ভারী অস্ত্রসহ মেশিনগানের গুলির গগণবিদারী শব্দে মানকার চরাঞ্চল যেমনি কাঁপতে থাকে তেমনি গাছ-পালা, ঘরবাড়ি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হতে থাকে। ভোর রাত থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত হানাদার বাহিনীর ত্রিমুখী হামলার গুলি বর্ষণ এক মুহুর্তের জন্যও বন্ধ হয়নি। ২ এম এফ কোম্পানী সম্মুখভাগের (পশ্চিমমুখী) ডিফেন্স উইথড্র করতে তখন বাধ্য হয়েছে এবং ফাস্ট বেঙ্গলের পশ্চিমমুখি একটা অংশ উইথড্র করে। মুক্তিযোদ্ধারা আগের দিনের প্রতিশ্রæতি সরবরাহ পায়নি এবং বিএসএফ এর কাভারিং ফায়ার হয়নি। ইতিমধ্যে মজিদ মুকুলের নেতৃত্বাধীন অংশের ইতিমধ্যে পশ্চিম পার্শ্বের বাংকারগুলো ঘেরাও হয়েছে। এটিএম খালেদ দুলু ও শওকত আলী ঘেরাও থেকে আখক্ষেতে সুযোগ বুঝে আতœগোপন করেন। কিন্তু বাদিয়াখালীর বীরযোদ্ধা আলতাফ ও সামাদ রক্ষা পান না। দুজনকেই বাংকারের মধ্যেই হানাদাররা খুচিয়ে হত্যা করে। তাঁদের চিৎকার শুনে পাশের বাংকার থেকে বেরিয়ে দেওয়ানগঞ্জের বীরযোদ্ধা নজরুল পাশের বাংকারে অবস্থানরত মজিদ মুকুলকে অনুরোধ করে উইথড্র করতে। কিন্তু শহিদ সামাদ ও আলতাফের করুণ চিৎকার শুনে তিনি তার দলবল নিয়ে পিছু হটে যেতে পারেননি। নজরুল আখ ক্ষেতে ঢুকতেই পদব্রজে সারিবদ্ধভাবে আগত হানাদারদের জুজনে ইয়া আলী’ বলে মজিদ মুকুলের বাংকারে চার্জ করে। মজিদ মুকুল বাংকারের এক পাশে অবস্থান নিয়ে গ্রেনেড বিস্ফোরণ করেন। সর্ববামের ডিফেন্স থেকে হাবিলদার মকবুল মেশিনগানের গুলি বর্ষণ করেন মজিদ মুকুলের বাংকারের চার্জকারী হানাদারদের উপর। বীর সহযোদ্ধা মকবুলের মেশিনগানের গুলিতে লুটিয়ে পড়ে হানাদার শত্রæসেনারা। এমনি সময়ে নিহত শত্রæ সেনাদের পিছন সারি মজিদ মুকুলের বাংকার অতিক্রমেকালে ২ এম এফ কোম্পানীর উত্তর পশ্চিমমুখী ডিফেন্সের সাহসী বীর বাঙালী সৈনিক বরিশালের কাশেম তার হাতে থাকা এল এম জি থেকে ব্রাশ ফায়ার করলে বেশ ক’জন শত্রæ সেনা নিহত হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত শত্রæ সেনারা গানবোট থেকে মাঝে মাঝে মেশিনগানের গুলি ছুড়ছে আর দু’একটা করে শেলিং করছে। বীরযোদ্ধা এবি সিদ্দিক সুফী খবর পৌঁছায় যে আমাদের মর্টারটি বিকল হবার আগেই তাদের মর্টার বিকল হয়েছে। পাশের সেকশন থেকে মজিদ রকেট লাঞ্চার দিয়ে শেলিং করে শত্রæসেনাদের একটা গানবোট ও একটা লঞ্চের মারত্মক ক্ষতিসাধন করেছেন। আর তিনিসহ বীর সহযোদ্ধা আনোয়ারুল কাদির ফুলমিয়া, রঞ্জু, আলমগীর, শাহ্ শরিফুল ইসলাম বাবলু, ডা. মনছুর এবং হাবিলদার মনছুর, নায়েক মফিজ উল্লাহ ও নায়েক আবু তাহেরের কভারিং ফায়ারে নায়েক রেজাউল তার সেকশন নিয়ে উইথড্র করতে পেরেছিলেন। এদিকে বীর সেনা বিক্রমপুরের আবুল কাশেমের নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন, হান্নান, বাবলু, রেজা নদীর পূর্বপাড়ে গিয়ে মজিদ মজিদ মুকুল, দুলু ও নজরুলকে পার করে নিয়ে আসে। জেড ফোর্স তাদের ডিফেন্স উইথড্র করলে, হানাদার বাহিনী তাদের সহযোদ্ধা হানাদারদের মরদেহ দেখে কোদালকাটি চরের বাসিন্দা যে দু’চারজন মানুষ ছিলেন তাদেরকে হত্যা করে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসখ্যাত কোদালকাটির যুদ্ধে ৩৫০ জন পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য নিহত হয়। জেড ফোর্সের ২ এম এফ কোম্পানী হানাদার বাহিনীর ৩টা এল এম জি স্টেনগান ও ৬টা চাইনিজ রাইফেল এবং প্রচুর গোলাবারুদ ও হেলমেট দখল করতে সক্ষম হয়। ১৮ তারিখের ত্রিমুখী আক্রমণের পূর্ববর্তী ৬ দিন হানাদারদের সাথে গুলি বিনিময় হয়েছিল। এক সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধে জেড ফোর্সের ২ এম এফ কোম্পানীর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
কোদালকাটি যুদ্ধে সুবেদার আলতাফের নেতৃত্বাধীন ২ এম এফ কোম্পানী ও লেঃ আসাদের নেতৃত্বাধীন ফাস্ট বেঙ্গলের একটা কোম্পানীর বীরযোদ্ধাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে পরাজিত হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ও লোকবল হারিয়ে লঞ্চযোগে চিলমারিতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
রসুলপুর ¯øুইস গেটে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাদের উপর আক্রমণ করা হয়। কালাসোনার চরে ইউপি সদস্য মকসুদ আলী ও রহিম উদ্দি সরকার সহায়তায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের কোম্পানি কমান্ডার এম এন নবী লালু ১৫ অক্টোবর রাতে খবর পান ¯øুইস গেটের হানাদারদের বেশ কজন গাইবান্ধায় যাওয়ায় শত্রæসেনার সংখ্যা কম। তিনি প্লাটুন কমান্ডারদের সাথে পরামর্শক্রমে ত্বরিত ¯øুইস গেটে আত্রæমণের সিদ্ধান্ত নেন। তখন কালাসোনার চরে সুন্দরগঞ্জ ও দারিয়াপুর ব্রিজ অপারেশরের জন্য রঞ্জু কোম্পানি অবস্থান নিয়েছিলো। পাশের চরেই ছিল রোস্তম কোম্পানি।
১৯৭১ সালের ১৮ অক্টোবর রাতে কোম্পানি কমান্ডার সাইফুল আলম সাজা এবং গোয়েন্দা গ্রæপের প্রধান ফজলুর রহমান রাজার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দলের সাথে পাকিস্তানি সেনাদের এই যুদ্ধ সংঘটিত হয় গাইবান্ধা মহকুমার সদর থানার সাহাপাড়া ইউনিয়নের নান্দিনা গ্রামে।
৯ আগস্ট দিবাগত রাতে মাহাবুব এলাহী রঞ্জু কোম্পানির পচিশ জনের একটি দল বড় আকারে একটি নৌকায় চেপে বিশাল ব্রক্ষপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে পশ্চিম তীরের ফুলছড়ি থানাধীন রতনপুর চরের আতিকুল্লা চেয়ারম্যানের খামার বাড়িতে আশ্রয় নেয়।
৩ নভেম্বর ভোরবেলা কালাসোনার চর থেকে রঞ্জু কোম্পানির একটি প্লাটুন প্রায় শুকিয়ে যাওয়া মানস নদী পার হয়ে পশ্চিম পাড়ের বালাসি খেয়া ঘাট অভিমুখে রওনা দেয়। উত্তরের রসুলপুর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থেকে দখলদার পাকিস্তানি সেনারা এসে ঘাটের আশেপাশের গ্রামে অত্যাচর ও লুণ্ঠন করে থাকে। গাইবান্ধা রণাঙ্গানে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রোস্তম কোম্পানির বহুল আলোচিত অভিযান সংঘটিত হয় গাইবান্ধা মহকুমার সাঘাটা থানার পদুমশহর ইউনিয়নের বোনারপাড়া তিস্তামুখ ঘাট রেললাইন কুমারগাড়ী নামক স্থানে। কোম্পানির গোয়েন্দা শাখা বিভিন্ন সূত্রে খবর পায় যে ২২ আগষ্ট সকাল ১০ টার ব্রিগেড সদর রংপুর হতে একটি মিরিটারি স্পেশাল ট্রেন তিস্তামুখ ঘাটে আসবে। এই খবর পেয়ে রোস্তম কোম্পানির যোদ্ধারা ২০আগষ্ট গলনার চরের হাইগ আউট হতে তৎকালীন সগুনা ইউনিয়নের বেলতলী গ্রামের মফিজ মন্ডলের বাড়িসহ কয়েকটি বাড়িতে হাইড আউট করে।১৮ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধা-ফুলছড়ি সড়কের ভাঙ্গামোড় নামক স্থানে এই এ্যামবুশ পাতা হয়েছিল। এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন হানাদার বাহিনীর কনভয় যাতায়াত করত। গাইবান্ধা- বোনারপাড়া রেলপথে আলাই নদীর উপর সন্নাসদহ রেলব্রিজ (পদুম শহর ইউনিয়ন) একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এই ব্রিজের নিরাপত্তার দায়িত্বে ১০ জন রাজাকার নিয়োজিত ছিল। তারা ব্রিজের পাশের জনগনকে নানাভাবে অত্যাচার নির্যাতন করত। ২০ জুন সাঘাটা থানার কামালেরপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ডিফেন্স থেকে এই রেইড পরিচালনা করা হয়েছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা রোস্তম আলীর নেতৃত্বে ২২ জনের মুক্তিযোদ্ধার দল ১০টার দিকে সাঘাটা থানার উপর তিন দিক থেকে আক্রমণ করা হয়। ভরতখালী স্টেশন সংলগ্ন এই ব্রিজের এক পাশে রেল গাড়ি ও অপর পাশের্^ লোকজন চলাচল করত। ভরতখালী বাজারে জুট র্বোডের গুদাম ছিল। পাকিস্তানের বৈদেশিক মুর্দ্রা অর্জনের প্রধান পণ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সোনালি আঁশ পাট। সরকার অর্থনীতি দুর্বল করার মানসে ঐ পাট গুদামে অগ্নিসংযোগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গাইবান্ধা জেলায় হানাদার বাহিনীর সাথে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২৪ অক্টোবর সাঘাটা থানার ত্রিমোহিনী ঘাটে। বাংলাদেশের অন্যতম অবাঙালি অধ্যুষিত সাঘাটা থানা সদর বোনারপাড়ার উপর সর্বাতœক আক্রোমণের পরিকল্পনা নেওয়া হয় ২৬ অক্টোবর।
সাঘাটা থানার সওলা ইউনিয়নের পুরাতন ভরতখালী একটি প্রসিদ্ধ হাট। এই বন্দরে সরকারি বেসরকারি অনেক পাট গুদাম ছির। গুদামগুলিতে প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়নগঞ্জে মাধ্যমে বিদেশে রফতানীর জন্য বিপুল সংখ্যক বেল বাঁধা পাট ছিল। মহিমাগঞ্জ চিনিকল এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চিনিকল। এটি ছিল একটি লাভজনক শিল্প প্রতিষ্ঠান। এই মিলটি ধ্বংস করতে পারলে পাকিস্তানি সরকারের অর্থনীতি দুর্বল হবে সেই লক্ষ্যে রোস্তম আলী খন্দকারের দল ১৩ নভেম্বর এই মিলটির উপর আক্রমণ চালিয়ে চিনিকলটি ক্ষতিগ্রস্ত করে। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে রোস্তম আলী খন্দকারের নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার সাঘাটা থানা আক্রমণ করা হয়। থানার অধিকাংশ পুলিশ সদস্য এই দলের কাছে আতœসমর্পণ করে, কিছু পালিয়ে যায়। বোনারপাড়া তিস্তামুখ রেলপথের মধ্যবর্তী স্থানে সিংড়া ব্রিজের অবস্থান (পদুম শহর ইউনিয়ন)। ২০ জন রাজাকার এই ব্রিজের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। রাজাকাররা পাশ^বর্তী এলাকার জনগনকে বিভিন্নভাবে দায়িতে¦ নিপীড়ন–নির্যাতন করতো। উপর্যুপরি কয়েকটি অপারেশন শেষে গলনার চরের হাইড আউটে মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হয়। গাইবান্ধা শহর থেকে মহকুমার উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য গাইবান্ধা–সুন্দরগঞ্জ সড়কের দারিয়াপুর সেতুটি ধ্বংসের পরিকল্পনা করে মুক্তিযোদ্ধারা। সে অনুযায়ী মাহাবুব এলাহী রঞ্জু নেতৃত্বে তার কোম্পানির ১০০ জন সদস্য সুন্দরগঞ্জ থানার শ্রীপুরে অবস্থান করেন। ১৭ সেপ্টেম্বর সাদুল্লাপুর থানা আক্রমণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। কমান্ডার সাইফুল আলম সাজা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফজলুর রহমান রাজার নেতৃত্বে এ অভিযান পরিচালিত করে। রোস্তম আলী খন্দকারের দলের সদ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধা রফিকুল, আফজাল ও খালেক সাঘাটা থানার কচুয়া ইউনিয়নের বুঝরি হকে মুক্তিবাহিনীর তথ্য সংগ্রহরত পাকিস্তান আর্মি ইন্টেলিজেন্স এর একজন অফিসারকে দিনের বেলা ধরে আনে।
যাঁদের রক্তত্যাগে বাংলাদেশ তাঁদের মধ্যে গাইবান্ধার বীর দামাল সন্তান শহিদ বীরমুক্তিযোদ্ধা হচ্ছেন:
সদর উপজেলা, গাইবান্ধা:
১। আবুল কাশেম খোকা, পিতা: ইসমাইল হোসেন, পশ্চিম পাড়া, গাইবান্ধা শহর,
২। নজরুল ইসলাম, পিতা: নিজামউদ্দিন, মুন্সীপাড়া, গাইবান্ধা শহর,
৩। আসাদুজ্জামান নবাব, পিতা: আজিজার রহমান, মুন্সীপাড়া, গাইবান্ধা শহর,
৪। শহিদুল হক চৌধুরী, পিতা: আবু মো. ফজলুল করিম, স্টেশন রোড, গাইবান্ধা,
৫। এ.কে.এম. হামিদুর রহমান, পিতা: কামাল উদ্দিন, থানাসিংপুর, বোয়ালি,
৭। আহম্মেদ আলী, পিতা: মোঃ শমসের আলী,কুজতলা,
৮।এ.কে.এম মাহবুবর রহমান জাহাঙ্গীর, পিতা: আব্দুর সালাম, স্কুলের বাজার, কুপতলা
৯। হায়দার আলী ব্যপারী, পিতা: হাফেজ উদ্দিন বেপারী, মীরপুর সাহাপাড়া,
১০। আব্দুস সালাম, পিতা: গোলজার রহমান আকন্দ, চকবরুল, বাদিয়াখালী,
১১। আলতাফ হোসেন, পিতা: গরীবউল্লাহ,রামনাথের ভিটা, বাদিয়াখালী,
১২। আবুল হোসেন, পিতা: কালু শেখ, রিফাইতপুর, বাদিয়াখালী,
১৩। আবুল হোসেন, পিতা: কাইম উদ্দিন, রিফাইতপুর, বাদিয়াখালী,
১৪। ছাবেদ আলী, পিতা: জমসের আলী, বালাআটা, গোবিন্দপুর, লক্ষ¥ীপুর,
১৫। আবুল হাসান, পিতা: রশিদুজ্জামান, পূর্ব কোমরনই, খোলাহাটি,
১৬।ডা. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, পিতা: সিদ্দিক হোসেন, স্টেশন রোড, গাইবান্ধা শহর,
১৭। আবু তালেব মিয়া, পিতা: মো. আব্দুর মজিদ,
১৮। আব্দুস সোবহান, পিতা: আব্দুল মজিদ, মুন্সীপাড়া, গাইবান্ধা শহর,
১৯। আব্দুল মোতালেব, পিতা: মহসিন আলী মন্ডল, থানাসিংহ, বোয়ালী
২০। সদরুজ্জামান হক, পিতা: হায়াত উদ্দিন আহমেদ, সাদুল্লাপুর রোড,
২১। আজিজুল হক, পিতা: কাউসার উদ্দিন, নারায়নপুর,
২২। গিয়াস উদ্দিন প্রাথানিক, পিতা: দসিম উদ্দিস প্রাথানিক, পশ্চিম বারবলদিয়া, মালিবাড়ী,
২৩। মহির উদ্দিন সরকারম পিতা: সফর মাহমুদ, গোবিন্দপুর, গাইবান্ধা শহর।
০১। আব্দুল আজিজ, মৃত. বাবর উদ্দিন বেপারী, ধুমাইটারী ২। মুসলিম উদ্দিন, মৃত. জামাল উদ্দিন, ঝিনিয়া, ৩। করিম মন্ডল, পিতা: আউস উদ্দিন মন্ডল, পশ্চিম ছাপরহাটি।
১। মজিবর রহমান, পিতা: গোলজার রহমান, বুজরক পাটানোছা, বনগ্রাম, ২। আবুবকর সিদ্দিক, পিতা: বছির উদ্দিন মন্ডল, ঘেগার বাজার, ফরিদপুর, ৩। রেজাউল করিম, পিতা: আব্দুল জোব্বার মাস্টার, রসুলপুর।
১। খায়রুল খন্দকার, পিতা- হাবিবর রহমান খন্দকার, বালাবামুনিয়া, পবনাপুর, ২। আঞ্জু মন্ডল, পিতা-ইমাম উদ্দিন নয়া মিয়া, পবনাপুর ৩। আবুল কাশেম, পিতা আব্দুল করিম প্রধান, পারবামুনিয়া, পবনাপুর, ৪। এ.কে.এম গাজী রহমান, পিতা মো. আজগর আলী, বালাবামুনিয়া, পবনাপুর, ৫। আব্দুল হামিদ প্রধান, পিতা কদম আলী প্রধান, বালাবামুনিয়া, পবনাপুর, ৬। কে, এম আতিয়ার রহমান, পিতা মতিয়ার রহমান খন্দকার, বালাবামুনিয়া, পবনাপুর, ৭। মাহতাব আলী, পিতা মনির উদ্দিন প্রধান, হরিনাবাড়ি, হরিনাথপুর, ৮। ফজলে হোসেন, পিতা-হেদায়েত উল্লাহ, হরিনাবাড়ি, হরিনাথপুর, ৯। আব্দুল কাদের, পিতা- সমশের উদ্দিন, হরিন বাড়ি, হরিনাথপুর, ১০। শওকত আলী সাবু, পিতা- ময়েনউদ্দিন প্রধান শোকটা, জামালপুর, পলাশবাড়ি, ১১ গোলাম রব্বানী, পিতা- ফরহাদ আলী সরকার, সাতারপাড়া, বেতকাপা, ১২। আব্দুল লতিফ, পিতা- জালাল উদ্দিন ব্যাপারী, সাতারপাড়া, বেতকাপা, ১৩। মোকছেদ আলী মন্ডল, পিতা- নাজির উদ্দিন মন্ডল, নান্দিশহর, বেতকাপা, ১৪। মোজাম্মেল হক মন্ডল, পিতা- সাফায়েত উল্লাহ পূর্ব নারায়নপুর, বেতকাপা, ১৫। মো. আফছার আলী, পিতা- মো. কবেজ উদ্দিন, জালাগাড়ি, মহোদীপুর, ১৬। আব্দুস সামাদ, পিতা- আহসান উদ্দিন মুন্সি, ফরকান্দাপুর, মহোদীপুর, ১৭। শাহজাহান আলী বাদল, পিতা- আজিম মিয়া, কালিঙ্গি, মহোদীপুর, ১৮। দেলোয়ার হোসেন, পিতা- সৈয়দ আশরাফ, ঝালিসি, মহোদীপুর, ১৯। অজিত চন্দ্র বর্মন, পিতা- গোপাল চন্দ্র বর্মন, বড় শিমুলতলা, কিশোরগাড়ি, ২০। মংপু রাম- বর্মন, পিতা- রজনী কান্ত বর্মন, বড় শিমুলতলা, কিশোরগাড়ি, ২১। আব্দুল মান্নান, পিতা- অজ্ঞাত, গিরিধারী, পলাশবাড়ি, তাজুল ইসলাম, পিতা- দেলোয়ার হোসেন, বালাবামুনিয়া, পবনাপুর, ২৩। নুরুন্নবী প্রধান, পিতা- আমিন প্রধান, বরকতপুর, পবনাপুর, ২৪। সুবেদার নুরুল্লা, পিতা আব্দুল হক মুন্সি, আমলাগাছি, বরিশাল, ২৫। সিপাহী আব্দুল মজিদ, মানিকউল্লাহ মন্ডল, নাদিশহর, বেতকাপা, ২৬ এসএম হুদা, পিতা-সোবহান সরকার, দয়ারপাড়া, পলাশবাড়ি।
১। আব্দুল মান্নান আকন্দ, পিতা- ওসমান আলী আকন্দ, গোলাপবাগ, গোবিন্দগঞ্জ, ২। মনোরঞ্জন মোহন্ত বাবলু, পিতা দেবেন্দ্র নাথ মোহন্ত, গোলাপবাগ, গোবিন্দগঞ্জ, ৩। বাবু দত্ত, পিতা- ইন্দ্রেশ্বর দত্ত (বুনু দত্ত), গোলাপবাগ, গোবিন্দগঞ্জ, ৪। আ. হারেছ আকন্দ, পিতা- ওসমান আলী আকন্দ, তুলশীপাড়া, গোবিন্দগঞ্জ, ৫। জালাল মাহমুদ, পিতা- জিতু মন্ডল, কাটাবাড়ী, কাটাবাড়ী, ৬। মো. ভোলা শেখ, পিতা- আবেদ আলী শেখ, হামিদপুর, ঘোড়াঘাট, ৭। দেলোয়ার হোসেন দুলাল, পিতা- সৈয়দ আশরাফ আলী, কাটাবাড়ী, ৮। গোলাম হায়দার, পিতা- সিরাজুল হক, রোগদহ, কাটাবাড়ী, ৯। আলতাফ হোসেন, পিতা- মফিজ উদ্দিন, গোপালপুর, মহিমাগঞ্জ, ১০। মো. মনোয়ারুল হক, পিতা- হাছেন আলী সরকার, বিরাট, শাখাহার, ১১ সিরাজুল ইসলাম, পিতা- হাসান আলী, শাখাহার, ১২। ফেরদৌস সরকার, পিতা- খালেছ উদ্দিন সরকার, শাখাহার, ১৩। তোবারক আলী সাবু, পিতা- মমতাজ আলী, নীলকণ্ঠপুর, শালমারা, ১৪। ফজলুল করিম, পিতা- দেলোয়ার হোসেন, পুনতাইড়, মহিমাগঞ্জ, ১৫। মোজাম্মেল হক, পিতা মোজাহার আলী প্রধান, উত্তর ধর্মপুর, রাখাল বুরুজ, ১৬ মাহবুবুর রহমান, পিতা আফতাব উদ্দিন, রামপুরা, হরিরামপুর, ১৭। খয়বর আলী,
পিতা- কাদের বহু দিঘলকান্দি, কামারদহ, ১৮। সৈয়দ আশরাফুল আলম, পিতা- সৈয়দ আব্দুল গফুর, ধর্মকাজী পাড়া, কোচাশহর, ১৯ অমূল্য চন্দ্র কর্মকার, পিতা-প্রসন্ন কর্মকার, শ্রীপতিপুর, মহিমাগঞ্জ, ২০। আঃ সাত্তার, পিতা- নছির উদ্দিন, পুনতাই, মহিমাগঞ্জ, ২১। অমরলাল চাকী, পিতা- অমৃতলাল চাকী, ফতেউল্লাপুর, গোবিন্দগঞ্জ, ২২। আলতাফ হোসেন, পিতা- মফিজ উদ্দিন, গোপালপুর, মহিমাগঞ্জ, ২৩। রিয়াদ হোসেন, পিতা-হারেজ উদ্দিন, কামদিয়া, ২৪। আ. মজিদ ফকির, পিতা- নঈম উদ্দিন ফকির, বিশ্ববাড়ী, তালুককানুপুর, ২৫। কছি মৃধা, পিতা বাসরত উরা, গোপালপুর, মহিমাগঞ্জ, ২৬। কুদ্দুস, পিতা- অজ্ঞাত, পাটোয়া, নাকাই, ২৭ আ. সাত্তার মন্ডল, পিতা- আফাতুল্লা, নিয়ামতের বাইগুনি, সোনাতলা, ২৮। ছানোয়ার হোসেন, পিতা-আজিজার রহমান, নিয়ামতের বাইগুনি, সোনাতলা।
১। নাজিম উদ্দিন পিতা ইয়াকুব আলী গ্রাম: হাসিলকান্দি, ২। আনসার আলী পিতা আব্দুল মজিদ প্রধান গ্রাম: থৈকরেরপাড়া, জুমারবাড়ি, ৩। আব্দুল হাই সর্দার পিতা – আব্দুল বাকী সর্দার গ্রাম: শ্যামপুর, মুক্তিনগর, ৪। মোবারক আলী পিতা হোসেন আলী গ্রাম: মাদুরা, ভরতখালী, সাঘাটা, ৫। আব্দুস সোবহান, পিতা ইয়াসিন আলী, গ্রাম: আমদিরপাড়া, জুমারবাড়ি, ৬। ওসমান গনি, পিতা- বাহাদুর শেষ গ্রাম: মামুদপুর, জুমারবাড়ি, ৭। আফজাল হোসেন, পিতা আব্দুল করিম, গ্রাম: গরাবেড়া, হলদিয়া, ৮। মজিবর রহমান পিতা নছির আলী গ্রাম: রামনগর, কচুয়া, ৯। হবিবর রহমান, পিতা নছির আলী গ্রাম: রামনগর, কচুয়া, ১০। কাবেজ আলী, পিতা- কোমর উদ্দিন, গ্রাম: কালপানি, বোনারপাড়া, ১১। মছির আলী পিতা আব্দুল গনি মন্ডল, গ্রাম: শিমুলকাইড, বোনারপাড়া, ১২। আব্দুস সাত্তার, পিতা- ফইম উদ্দিন, গ্রাম: সাঘাটা।
১। শহিদুল্লা, পিতা- সাহেব আলী, গজারিয়া, ২। হাবিবুর রহমান, পিতা- জয়নাল সরকার, গজারিয়া। ৩। ছলিম উদ্দিন, পিতা- করব উদ্দিন হরিপুর, উদাখালী, ৪। শহিদুল ইসলাম, ফুলছড়ি, ৫। মসির আলী, ঘরভাঙ্গা, ফুলছড়ি ৬। জবেদ আলী, পিতা বাদল উদ্দিন ব্যাপারী, উড়িয়া। আলী, ঘরভাঙ্গা, ফুলছড়ি ৬। জবেদ আলী, পিতা বাদল উদ্দিন ব্যাপারী, উড়িয়া।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র গাইবান্ধা পৌরসভার গোডাউন রোডের বছির উদ্দিন আহমেদ এর পুত্র বদিউল আলম চুনীকে আহসানউল্লা হল থেকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর থেকে তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি সহায়তা করতেন।
এই তালিকায় বাইরে অজ্ঞাত কিছু শহিদ মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। সেকারণে শহিদ তালিকাটি অসম্পূর্ণ।
একাত্তরের শহিদদের স্মরণে গাইবান্ধায় স্মৃতিফলক, স্মারকচিহ্ন, শুভগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- গাইবান্ধা সদর উপজেলার পৌরপার্কের স্বাধীনতার বিজয়স্তম্ভ, স্বাধীনতা প্রাঙ্গণ, পশ্চিমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে স্মৃতিযুদ্ধ মুন্সীপাড়া শহিদ মিনার, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সামনের শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ, শহি সৈয়দ আনোয়ার হোসেন সড়ক, পশ্চিমপাড়ার শহিদ আসাদুজ্জামান নবাব পত্রিকা ফলক, পুলিশ লাইনের পার্শ্ববর্তী মাতৃভান্ডারের দুই ভাইয়ের সমাধিস্তম্ভ, খালেদ মুলু বীর প্রতীক সড়ক, পৌরপার্কের খালেন দুলু বীর প্রতীক পত্রিকা ফলক, সাঘাটা উপজেলার মুক্তিনগরে পাঁচ শহিদের কবর ও স্মৃতিফলক, ত্রিমোহনী ঘাট স্মৃতিস্তম্ভ, শিমুলতাইড় গ্রামের স্মৃতিস্তম্ভ, বোনারপাড়া শহিদ নামফলক, ফুলছড়ি উপজেলার বধ্যভ‚মির শহিদ
মিনার, গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালি স্মৃতিস্তম্ভ, পাখেড়া গ্রামের গণকবরের শহিদ মিনার, পলাশবাড়ী বধ্যভ‚মির স্মৃতিস্তম্ভ, দক্ষিণ রামচন্দ্রপুর বধ্যভ‚মির স্মৃতিস্তম্ভ, মুংলিশপুর-জাফর স্মৃতিফলক, সুন্দরগঞ্জ গোয়ালের ঘাট বধ্যভ‚মির শহিদ মিনার। এছাড়াও শহিদ ফজলুল করিমের স্মৃতিতে ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়ন ও সাঘাটার পাঁচ শহিদ স্মরণে মুক্তিনগর ইউনিয়ন নামকরণ করা হয়েছে।
দেশের অন্যান্য স্থানের মতো গাইবান্ধাতেও মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তানি সেনাদের লড়াই অব্যাহত থাকে। এক পর্যায়ে ২৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা খবর পায় পাকিস্তানি সেনারা গাইবান্ধা ছেড়ে চলে গেছে। ঐ দিন মুক্তিযোদ্ধারা এগোতে থাকে এবং রসুলপুরে ¯øুইস গেট উড়িয়ে দেওয়ার জন্য ডিনামাইড সেট করে। কিন্তু সেটা অকেজো হয়ে যায়। ওখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা কঞ্চিপাড়া আসে। রসদ ফুরিয়ে গেলে তারা আবার রসুলপুরে পজিশন নেয়। পরদিন বিকাল ৪টায় পাকিস্তানি বিমান ঐ এলাকা এবং মোল্লার চরে বোমা বর্ষণ করে। আহত হয় বেশ কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা। ৬ ডিসেম্বর সকালে ভারতীয় বিমান বাহিনীর দুটি বিমান গাইবান্ধা রেলস্টেশনের পাশে বোমা ফেলে এবং বিকালে ট্যাংক নিয়ে মিত্রবাহিনী প্রবেশ করে শহরে। অপরদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুর এলাহী রঞ্জুর নেতৃত্বে দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ৬ ডিসেম্বর কালাসোনার চর থেকে শহরের পাশর্^বর্তী গ্রামে রউফ মিয়ার বাড়িতে রাত কাটিয়ে পরদিন ৭ ডিসেম্বর সকালে বিজয়ীর বেশে হাজার হাজার মানুষের আনন্দ উৎসবের মধ্যে শহরে প্রবেশ করে। ৭ ডিসেম্বর তৎকালীন এসডিও মাঠে এক গণসংবর্ধনা দেয়া হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। দশ হাজারের বেশি মানুষ ঐ সংবর্ধনায় উপস্থিত হয়। কোম্পানি কমান্ডার মাহাবুর এলাহী রঞ্জু (বীর প্রতীক) তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে আনসার ক্যাম্পে অবস্থান গ্রহন করে। ৪ ডিসেম্বর রোস্তম কোম্পানি সরাসরি যুদ্ধের মাধ্যমে হানাদার মুক্ত করে ফুলছড়ি থানা। কোম্পানি কমান্ডার মফিজুর রহমান খোকা সুন্দরগঞ্জ থানা মুক্ত করে ওখানে অবস্থান নেন। কোম্পানি কমান্ডার রোস্তম আলী খন্দকার ও টু আই সি গৌতম চন্দ্র মোদকের নেতৃত্বে বেতলতলী গ্রামের মফিজ উদ্দিন মন্ডলের বাড়ির হাইড আউট থেকে ৪৫০ জনের মুক্তিযোদ্ধা দল বিজয় উল্লাসে ৮ ডিসেম্বর বিকালে বোনারপাড়া আসে। সাদুল্লাপুর ও পলাশবাড়ি থানা ৬ ডিসেম্বর এবং গোবিন্দগঞ্জ থানা ১১ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়। এভাবেই গাইবান্ধা শহরসহ আশপাশের এলাকামুক্ত হয়।
গাইবান্ধার ইতিহাস ৩য় খÐ থেকে সংকলিত
তথ্য সূত্র:
১। মূলধারা’ ৭১-মাঈদুল হাসান, ২। আমরা স্বাধীন হলাম-কাজী সামসুজ্জামান, ৩। একাত্তরের ধ্বণি- বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা এ্যাকশন কমান্ড কাউন্সিল, গাইবান্ধার প্রকাশনা, ৪। মুক্তিযুদ্ধের উত্তর রণাঙ্গণ-উইং কমান্ডার (অবঃ) হামিদুল্লাহ খান, বীর প্রতীক- ভোরের কাগজ, ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৯১, ৫। একাত্তরের গাইবান্ধা- ড. মাহবুবর রহমান, ৬। গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ, গাইবান্ধা জেলা- জহুরুল কাইয়ুম, ৭। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, গাইবান্ধা জেলা ইউনিট, ৮। হৃদয়ে একাত্তর- প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও ষষ্ঠ সংখ্যা, সম্পাদক জহুরুল কাইয়ুম, ৯। বাংলাদেশ গেজেট (অতিরিক্ত সংখ্যা) সেপ্টেম্বর-২০০৩, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।