মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে নীলফামারী

জাহাঙ্গীর আলম সরকার

১৬ ডিসেম্বর, ২০২২ , ৫:১৪ অপরাহ্ণ

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে নীলফামারী

বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ অর্জন ১৯৭১-এর বিজয়। মুক্তিযুদ্ধ বহুমাত্রিক, এটি বিরাট সংখ্যার ধারণাতীত ত্যাগ, অশ্রæ, বেদনাভোগের সফল পরিণতি। মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পরেও এদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মানেই অনিবার্য দু:খ-কষ্টের মাধ্যমে অর্জিত একটি বীরত্বপূর্ণ বিজয়ের ইতিহাস। আর বিজয়ের ইতিহাস বলতে রণাঙ্গনের সশস্ত্র বিজয়ের কথা বলা হয়। আবার রণাঙ্গনে বিজয়ের প্রসঙ্গে অবধারিত হয়ে ওঠে ১১টি সেক্টরের বিজয় এবং সে বিজয় অর্জনে সেক্টর ও সাব-সেক্টর নেতৃত্বের ভূমিকা। আলোচ্য প্রবন্ধে ৬নং সেক্টরের একটি সাব-সেক্টরের কিছু অংশ নিয়ে সাজানো হয়েছে। ১৯৭১ সালে নীলফামারীর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত হয়েছে প্রবন্ধটি। স্বদেশি আর বিদেশি শত্রæর ধারাবাহিক আক্রমণ নীলফামারীর ইতিহাসের চাকাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করলেও, আন্দোলন সংগ্রামে তা থেমে থাকেনি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম নীলফামারীর সাধারণ মানুষের বীরত্বগাথায় লিপিবদ্ধ হয়েছে নীলফামারীর ইতিহাস। কৈবর্ত বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, প্রজাবিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ, নীলবিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬-দফা, ৬৯’-এর গণঅভ্যুত্থান প্রভৃতিতে নীলফামারীর সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নীলফামারীর ইতিহাস সমৃদ্ধির এক একটি পর্যায় বটে। ১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রামে নীলফামারীর অবদান অগ্রগণ্য। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে নীলফামারীর মতো একটি ছোট্ট, শান্ত জনপদের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিটি শব্দমালাকে বুকে ধারণ করে নীলফামারীর সাধারণ মানুষরাও অসহযোগ আন্দোলনকে বেগবান করতে থাকে। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যেমন বলেছিলেন- ‘আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত, ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ থাকবে।’ ঠিক তাই হয়েছিলো বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো নীলফামারীতেও সবকিছু বন্ধ হয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই সবকিছু চলতে থাকে। ১৯৭১ সালে নীলফামারীতে যারা মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় মাথায় তুলে নিলেন তাদের মধ্যে সিনিয়র একদল ছিলেন সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। অন্যদিকে ছাত্রদের পক্ষ থেকেও নীলফামারীতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কমিটি গঠন করা হয়েছিলো।

৬ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার খাদেমুল বাশার ও নীলফামারী সাব-সেক্টর কমান্ডার লে: ইকবাল রশিদ

১৯৭১ সালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ছিল অত্যন্ত সুবিন্যস্ত একটি সশস্ত্র বাহিনী। সকল প্রকার প্রস্তুতি গ্রহণ করে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ঝাপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র বাঙালীর উপর। উত্তরাঞ্চলের বিশাল এলাকা পাকবাহিনীর জিওসি ছিলেন মেজর জেনারেল নজর হোসেন সাহ, তার অধীনে ছিল সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত ২৩ৎফ ওহভধহঃৎু ইৎরমধফব এর ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শাফী, যার অধীনে ছিল- ৩৪ পাঞ্জাব; ২৫ পাঞ্জাব; ৪৮ পাঞ্জাব; ২৬ ফ্রন্টিয়ারস ফোর্স; ৮ পাঞ্জাব; ৮৬ মুজাহিদ। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শুরুতেই ৩৪, পাঞ্জাব ব্যাটেলিয়ন নীলফামারী দখল করে নেয়। ১৯৭১-এর মুক্তির সংগ্রামে নীলফামারী মহকুমা ৬ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল। ৬নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন খাদেমুল বাশার। এ অঞ্চলের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই ৬ নম্বর সেক্টরের অধীনে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। শুধু নীলফামারী নয় বরং বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর নিয়ে এই সেক্টর ছিল। এই সেক্টর বাহিনী গঠিত হয় নিয়মিত বাহিনীর সাথে সাবেক ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ ও বেসামরিক জনগণদের নিয়ে। ৬ নং সেক্টরের লিয়াজো অফিসার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইসলাম। চিলাহাটি সাব-সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যন্ট ইকবাল রশিদ। তাঁর দায়িত্বপূর্ণ এলাকা ছিল সমগ্র নীলফামারী। তিস্তা নদীর পশ্চিম প্রান্তে এ সাব-সেক্টরের অবস্থান ছিল। লেঃ ইকবাল রশিদের নেতৃত্বে ডিসেম্বরে চিলাহাটী থেকে ডোমার এবং নীলফামারীর দিকে এগিয়ে যায়। একই সাথে মুক্তিযুদ্ধে নীলফামারীতে মুক্তিবাহিনী ও বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করেছিলেন।

মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ হয় মিত্রবাহিনী যার উত্তরাঞ্চলের প্রধান ছিলেন জিওসি লে: জেনারেল এম এল তপন এবং তার অধীনে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার পি এন কাথপালিয়া। একইসাথে মেজর জেনারেল পি সি রেড্ডি ছিলেন মিত্রবাহিনীর উত্তর-পশ্চিম সেক্টরে। তিনি ৬ মাউন্টেন ডিভশনের প্রধান ছিলেন। ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তান আকস্মিকভাবে ভারতের পশ্চিম অংশে আক্রমণ চালায়, যা যুদ্ধের নাটকীয় পরিণতি ঘটায়। সেদিন থেকেই বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো নীলফামারী অঞ্চলের পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে চলতে থাকে মিত্র বাহিনীর অভিযান। ১৯৭১ সালে ১৩ ডিসেম্বর তারিখে সংঘটিত ইছামতির যুদ্ধ। নীলফামারীর ইতিহাসে এটি একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ। খানসামা-দারোয়ানী সড়কের ব্রিজ এলাকা থেকে ১৩ ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় আক্রমণ শুরু হয়। ২১, রাজপুত ব্যাটেলিয়ানের একটি কোম্পনী এই যুদ্ধে সম্মুখে থেকে যুদ্ধ করেছে। পাঞ্জাব ব্যাটেলিয়ন সাংঘাতিক ক্ষিপ্রতার সাথে গড়ে তুললো প্রতিরোধ। উভয়পক্ষই প্রাণপন যুদ্ধ চালালো। প্রায় ৩০ মিনিট পরেই পি এন কাথপালিয়ার নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী অক্ষত অবস্থায় ইছামতি ব্রিজ দখল করে নেয়। মিত্র বাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা এতোটাই ছিলো যে ৩০ মিনিট পরেই ৪৮, পাঞ্জাব কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পরে। এক পর্যায়ে পাকসেনারা দ্রæতই খরখড়িয়া নদীর দিকে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। খরখড়িয়ার যুদ্ধে ৪৮, পাঞ্জাব ব্যাটেলিয়ন সর্বশেষ প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করে। ইছামতি থেকে রাজপুত ব্যাটলিয়নের সেনা সদস্যরা কাথপালিয়ার নেতৃত্বে দ্রæতই খরখড়িয়ার দিকে এগুতে থাকে। ফলে ওই দিনের শেষভাগে খরখরিয়ার প্রান্তরে রাজপুত ব্যাটেলিয়নকে আরেকটি যুদ্ধে অবতির্ন হতে হলো। এই যুদ্ধে মিত্রবাহিনী সম্পূর্ণভাবে ৪৮, পাঞ্জাবকে পরাস্থ করে গ্রেফতার করে মিত্রবাহিনী। দিনের শেষভাগে সূর্যাস্তের আগে গোধুলী লগ্নে একটা মল্লযুদ্ধ সম্পন্ন হলো। ৪৮, পাঞ্জাব ব্যাটেলিয়নের প্রচুর সৈন্য মুহূর্তেই হতাহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন-যা নীলফামারীতে খরখড়িয়ার যুদ্ধে ভয়াবহতার সাক্ষী হয়ে রইলো নীরফামারীর ইতিহাসের পাতায়।

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে সৈয়দপুরে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হয়। এই আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানটি ছিল মূলত: সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত ২৩ৎফ ওহভধহঃৎু ইৎরমধফব এর ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শাফীর সাথে মিত্রবাহিনীর ৭১, মাউন্টেন ব্রিগেডের অধিনায়ক পি এন কাথপালিয়ার মধ্যে আত্মসমর্পন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে ৪৮, পাঞ্জাবের অধিনায়ক একজন ধোপার মাধ্যমে আত্মসমর্পণ প্রস্তাব পাঠায়। অবশেষে জিওসি পিসি রেড্ডি নীলফামারী মহকুমার দারওয়ানিতে হেলিকাপ্টারে আসেন। নীলফামারীর দারওয়ানিতে রেড্ডির সাথে দুপুর আড়াইটায় আলোচনা সম্পন্ন হয়। ২৩, ব্রিগেড কমান্ডার ইকবাল শাফী তার সকল বাহিনী একত্র করার জন্য ১৭ তারিখ বিকেল পর্যন্ত সময় চান। আলোচনার শর্ত অনুসারে অঅত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হয় জমজম বিমান বন্দরে ১৫ টা ৪৫ মিনিটে। মিত্রবাহিনীর ২১, রাজপুতকে সকল অস্ত্র আটক করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। ১২, রাজপুতকে সকল যুদ্ধবন্ধিদের দেখাশুনা করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। ৫, গ্রেনেদিয়ারসকে সৈয়াদপুরের আাইন শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ৭, মারাঠা সৈয়দপুরে রিজার্ভ রাখা হয়। ৭, মারাঠা পুকুর ডোবা থেকে বিপুল অস্ত্র উদ্ধার করে। ১৭ ডিসেম্বর সৈয়দপুরে আম্মসমর্পণ করেন ১১১ জন অফিসার, ১৫৫ জন জেসিও, ৪৪৩২ জন সৈনিক, অন্যান্য ৭৯, বেসামরিক ৩৭, মোট ৪৯৪১ জন। এভাবেই নীলফামারীতে যুদ্ধ পরিস্থিতির যবানিকা ঘটে।

পরিশেষে একটি কথা না বললেই নয়। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছিলো একটি জনযুদ্ধ। জনযুদ্ধ তত্তের প্রবক্তা মাও সেতুং বলেছিলেন- ‘জনযুদ্ধ সবসময়ই বিপ্লবী যুদ্ধ, বিপ্লবী যুদ্ধ জনগণের যুদ্ধ; এটি শুধুমাত্র জনগণকে সংঘবদ্ধ করে তাদের উপর নির্ভর করে চালানো যেতে পারে।’ জনযুদ্ধের এই সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, জনযুদ্ধের তত্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সফলভাবে প্রয়োগ হয়েছে। আর নীলফামারীর মতো আঞ্চলিক পর্যায়ের বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ ছিল অবরুদ্ধ দেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত কারিগর। অথচ স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৫০ বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধে প্রভূতভাবে বিপুল অবদান রাখা স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইতিহাসগুলো লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে উপযুক্তভাবে মূল্যায়ন করা থেকে রাষ্ট্র আজও অনেক দূরে। আঞ্চলিক ইতিহাস সংরক্ষণের বিষয়ে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াতে হবে তা না হলে জাতিয় ইতিহাস কখনই সমৃদ্ধ হবে না।

লেখক : আইনজীবী ও পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।