অনুবাদ

অনুবাদ

মুগ্ধতা.কম

২৫ মে, ২০২০ , ৬:৩৪ অপরাহ্ণ

নজরুলের অনুবাদ : কাব্যে আমপাড়া

রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ অথবা অন্যান্য সাহিত্যেকের মতো অতো বেশি না হলেও নজরুল যৎসামান্যই অনুবাদ করেছেন। অনুবাদক হিসেবে নজরুল কেমন ছিলেন?—এই প্রশ্নের উত্তর তার একটা রচনাই দিতে পারে, আর তা হলো বিদ্রোহী—যদিও তার রুবাইয়াত ই ওমর খৈয়াম এর মতো চকচকে ও ওজনশীল অনুবাদ রয়েছে। হুইটম্যানের ‘সং মাইসেলফযখন অনুবাদ করা হয় তখন যেন  ‘সং মাইসেলফএর পাঁজর চিড়ে বুলেটের মতো বেড়িয়ে পড়ে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’কবিতা। যেমন—

I am satisfied,

I see, dance, laugh, sing

নজরুলের রূপান্তরের কক্ষপথে আবর্তিত হতে হতে তা হয়েছে-

আমি নৃত্য পাগল ছন্দ

আমি আপনার তালে নেচে যাই

আমি মুক্ত জীবনানন্দ

অথবা

I pass death with the dying and Birth with the new wash’d babe

নজরুলের ভাষাকে ধারণ করে সঞ্চার করেছে নতুন প্রাণশক্তি ও অবয়ব। যেমন—

আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শশ্মান

এ থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্বসাহিত্যের উপর নজরুলের জানাশোনা ও চর্চার পরিধি কতো ব্যাপক আর বিস্তৃত ছিলো। যদিও তিনি রবীন্দ্রনাথ অথবা জীবনানন্দের মতো মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চতর শিক্ষার বিভাসের জীয়নকাঠিতে জীবনকে ছোঁয়াতে পারেন নি। এখানেই তার আশ্চর্যময়তার দ্যূতি আমরা টের পাই। এটাকে চুরি বলা যায় না। প্রভাব বলা যায়। যে কেউই যে কারও দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। তবে তা নিজের মতো করে পথ ও প্রবাহ তৈরি করে—গতি ও গন্তব্য নির্ধারণ করে। নজরুল সেটা পেরেছিলেন বলেই তিনি দুখু থেকে নজরুল হয়েছিলেন—দ্রোহের কবি হয়েছিলেন। এ সম্বন্ধে সৈয়দ আলী আহসান তার ‘কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা বলেছেন—

হুইটম্যানের প্রভাব নজরুল ইসলামের উপর অত্যন্ত বেশি স্পষ্ট, দীপ্ত ও প্রত্যক্ষ। বিদ্রোহ, বিপ্লব ও যৌবনের আবেগে যেখানে তাঁর কাব্যের উপপাদ্য হয়েছে, সেখানেই তিনি হুইটম্যান-কে অনুসরণ করেছেন নিঃসঙ্কোচে। এ অনুসরণের মধ্যে গ্লানির কিছু নেই, কেননা এখানে ভাবগত একাত্মতা বোঝায়।

১৭৭৭ সালে মুদ্রণযন্ত্র আবিস্কার হলেও এ অঞ্চলের মানুষ ১৮১৫ সালের আগে বাংলা মুদ্রণযন্ত্রের সঙ্গে কখনোই পরিচিত হবার তেমন কোনো সুযোগ পায় নি। যদিও ইতিহাসে বাংলাভাষায় কোরআনের প্রথম অনুবাদক কে—এই নিয়ে মতবিরোধ, দ্বিধা আর ঘোর-সন্দেহ রয়েছে, তবুও আমরা ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনকেই ধরে নিই বাংলাভাষায় কোরআনের প্রথম অনুবাদক। তিনি মোট বার খণ্ডে কোরআন বাংলাভাষায় অনুবাদ করেন। ১৮৮১ সালের ১২ ডিসেম্বর কোরআনের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। প্রথম খণ্ড প্রকাশের পর ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন অনুবাদকের নাম গোপন রাখেন। কারণ সে-সময় কাজটা অনেক প্রতিকূল্য ছিলো। মুসলিম সমাজে এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে—সে সম্বন্ধে তার কোনো ধারণাই ছিলো না। গ্রন্থটিতে কেবল প্রকাশক গিরিশ চন্দ্র সেন এবং মুদ্রক তারিণীচরণ বিশ্বাসের নাম ছিলো। ৩২ পৃষ্ঠার এই খণ্ডের মূল্য ছিলো মাত্র চার আনা। এভাবেই অযুত প্রতিকূলতার প্রবাহের ভেতরেই শুরু হয়েছিলো বাংলাভাষায় ধমনীতে কোরআন-অনুবাদের মতো মহৎ কর্মের নীরব-তরঙ্গধ্বনি।

ইসলামি সংস্কৃতির সৌন্দর্যের গর্ভাশয়ে বেড়ে উঠেন নজরুল। ১৯০৮ সালে মাত্র নয় বছর বয়সে যখন তিনি তার পিতা ফকির আহমেদকে হারালেন—তখন তাদের সংসার অভাবের অতলে ডুবতে থাকলো। বড় ভাই কিশোর সাহেবজান আসানসোলের এক কোলিয়ারিতে কাজ নিলে নজরুলও বসে থাকলেন না। গ্রামের যে মক্তব থেকে নিজে পাস করেছিলেন, সেখানেই মৌলবির পদে বহাল হলেন ছোট্ট নজরুল। মাইনে কম কিন্তু ছাত্রদের বাড়ি থেকে সিধেতে যে চাল, ডাল, কলা, মুলো জুটতো তা দিয়ে কোনরকমে দিন চলত তাদের। আসলে ওটাকে চলা বলে না। ফলে এগারো বছরের নজরুলকে মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিন অর্থাৎ আজান-প্রদানকারীর কাজটাও নিতে হলো। পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে নামাজ আদায় করা, রোজা রাখার মতো ইসলামি অনুশাসনসমূহ অনুশীলন করতেন নজরুল।

ছেলেবেলা থেকেই নজরুলের লেখাপড়ার মাথাটা খুব পরিষ্কার ছিলো। তাঁর প্রথম গুরু পিতা ফকির আহমেদ। তাঁর কাছে ভাষাশিক্ষার প্রথম পাঠ অক্ষরজ্ঞান পরিচয় হলো নজরুলের। ভর্তি হলেন পাঠশালায়। সেখানে দ্বিতীয় গুরু কাজী ফজলে আহমেদ। তিনি আরবি, ফারসি, উর্দু আর বাংলা-এই চার ভাষাতেই দক্ষ ছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই নজরুল প্রথম আরবির তালিম নেন এবং মক্তবের পাঠ শেষ করতে করতে তিনি অত্যন্ত সাবলীলভাবে কোরআন শরিফ পাঠ করতে শিখে যান। ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে এভাবেই ছেলেবেলা থেকে তাঁর পরিচয় গাঢ় হয়ে ওঠছিলো। এমনই ছিলো সে পরিচয় যে, পিতার মৃত্যুর পর ওই ছোট্ট কিশোরকে মসজিদের ইমামের পদে চাকরি দিতে দ্বিধা করেননি গ্রামবাসীরা। সেই কৈশোরে এমন পরিণত ভাবনা আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলো যে, তিনি অন্যদের থেকে আলাদা—ইঙ্গিত দিচ্ছিলো যে, ভিন্ন কিছু মহৎ সৃজনের।

নজরুলের এক দূরসম্পর্কের কাকা ছিলেন—নাম মুন্সি বজলে করিম। তাঁর কাছ থেকে কোরআন-হাদিসের পাঠ নিতে শুরু করলেন কিশোর নজরুল। শুধু তাই নয়, ইসলামি অনুশাসননির্ভর ধর্মকেন্দ্রিক গানও রচনা করতে শুরু করলেন তিনি। এই সময়কার কথা বলতে গিয়ে নজরুল-গবেষক ইন্দ্রজিৎ রায় লিখেছেন—

“কিশোর আচার্য নজরুলের সে জীবন তখন মোল্লা প্রভাবান্বিত জীবন। বয়সে নবীন—একেবারে নেহাৎ কচি ও কাঁচা হলেও তাঁর উপর যে কাজের ভার চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তা কচি-কাঁচাদের উপযুক্ত নয়। মসজিদের মাননীয় ইমাম তিনি; তাঁর অধীনে বহুলোক নামাজ পড়েন, খুৎবা (ধর্ম উপদেশ) শোনেন; আসরে আসরে দুলে দুলে সুর করে তাকে মিলাদ শরীফ পাঠ করতে হয়।”

অতএব চটুল গান নয়, তিনি লিখলেন—

নামাজ পড়ো মিয়া, ওগো নামাজ পড়ো মিয়া,

সবার সাথে জমায়েতে মসজিদে গিয়া, 

তাতে যে নেকি পাবে বেশি

পর সে হবে খেশি

থাকবে নাকো ঘৃণা, প্রেমে পূর্ণ হবে হিয়া।

অতএব ইসলামী সংস্কৃতির সৌন্দর্যের গর্ভাশয়ে বেড়ে উঠা নজরুল কোরআনের অনুবাদ করবেন—সেটা একটা সহজাত ক্রিয়া ও স্বাভাবিক ঘটনা। আমরা এটাকে ধর্মীয় পরিমণ্ডলে আবদ্ধ না রেখে সাহিত্য ও শিল্পের সৌকর্ষে বিবেচনা করবো। সেখানে সাহিত্য হবে অবমুক্ত আর শিল্প ছড়াবে সুষমা অসার হৃদয়ের ভেতর।

নজরুল যখন কোরআন অনুবাদ করছিলেন ততদিনে এই ভারতীয় উপমহাদেশে অনেকের হাতেই তা প্রস্ফূটিত হয়ে চৌহদ্দিতে আতর ছড়াচ্ছিলো। তবু তিনি এই মহৎ কর্ম সাধনের জন্য মরিয়া হয়ে না উঠলেও একটু একটু করে নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন আর চিন্তাকে শাণ দিচ্ছিলেন। এই যে নীরব প্রস্তুতি আর শাণিত চিন্তার ঝিলিক থেকে সোনালি শস্যের মতো উৎপন্নতার নামই হচ্ছে কাব্যে আমপারা।

শুরু করিলাম লয়ে নাম আল্লার,

করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।

 

সকলি বিশ্বের স্বামী আল্লাহ মহিমা,

করুণা কৃপার যার নাই নাই সীমা।

বিচার দিনের বিভু! কেবল তোমারি,

আরাধনা করি আর শক্তি ভিক্ষা করি।

সহজ-সরল পথে মোদের চালাও

যাদেরে বিলাও দয়া সে পথ দেখাও।

অভিশপ্ত আর পথ-ভ্রষ্ট যারা, প্রভু,

তাহাদের পথে যেন চালায়ো না কভু! 

(সুরা ফাতেহা)

সাধারণ মানুষ যখন কোরআনকে ভিনদেশি ভাষায় কেবল অজ্ঞের মতো পঠন, চুম্বন আর আমলের অন্তর্জালে আবদ্ধ করে রেখেছিলো, ঠিক তখনই তা থেকে মুক্তির স্ফূরণ হয়ে উঠে কাব্যে আমপারা। নজরুল জানতেন—কোরআন কেবল পাঠের জন্য নয়—জানার জন্য—বোঝার জন্য—আত্মশুদ্ধির পাশাপাশি কুসংস্কার ও সমূহ জড়াজীর্ণ আর শৃঙ্খল থেকে মুক্তির পরশপাথর—সৃজন ও জাগরণের আলোয় অন্ধকারকে পরাস্থ করে মানবজাতির কল্যাণ সাধন করা। নজরুলের ভাষায়—

“ইসলাম ধর্মের মূলমন্ত্র-পুঁজি ধনরত্ন মণি-মাণিক্য সবকিছু-কোর-আন মজীদের মণি-মঞ্জুষায় ভরা, তাও আবার আরবি ভাষার চাবি দেওয়া। আমরা-বাঙালি মুসলমানেরা-তা নিয়ে অন্ধ ভক্তিভরে কেবল নাড়াচাড়া করি। ঐ মঞ্জুষায় যে কোন মণিরত্নে ভরা, তার শুধু আভাসটুকু জানি। আজ যদি আমার চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তিগণ এই কোর-আন মজীদ, হাদিস, ফেকা প্রভৃতির বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন তা হলে বাঙালি মুসলমানের তথা বিশ্ব-মুসলিম সমাজের অশেষ কল্যাণ সাধন করবেন। অজ্ঞান-অন্ধকারের বিবরে পতিত বাঙালি মুসলমানদের তাঁরা বিশ্বের আলোক-অভিযানের সহযাত্রী করার সহায়তা করবেন।”

দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম কোরআনের শেষ পারা অনুবাদ করেন। তার অনূদিত গ্রন্থটির নাম কাব্যে আমপারা। ‘আম্মাশব্দ দিয়ে এই পারা শুরু হয়েছে বলে আমপারা নামকরণ করা হয়েছে বলে নজরুল তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। মোট ৩৮টি সুরার অনুবাদ নিয়ে গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২৩ নভেম্বর, ১৯৩৩ সালে (অগ্রহায়ণ, ১৩৪০ বঙ্গাব্দ)।

সে জানিত না যাহা

মানুষেরে তিনি দেছেন শিক্ষা তাহা,

না, না, মানুষ সীমা লঙ্ঘন করিয়া যায়,

ধন-গৌরবে মত্ত যে ভাবে সে আপনায়।

(সুরা আলক)

নজরুল তার কাব্যে আমপারা গ্রন্থটি অনুবাদ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ভূমিকায় লিখেছেন—

“আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সাধ ছিল পবিত্র ‘কোর-আন’শরীফের বাংলা পদ্যানুবাদ করা। সময় ও জ্ঞানের অভাবে এতদিন তা করে উঠতে পারিনি। বহু বৎসরের সাধনার পর খোদার অনুগ্রহে অন্তত পড়ে বুঝবার মতোও আরবি-ফারসি ভাষা আয়ত্ত করতে পেরেছি বলে নিজেকে ধন্য মনে করছি।”

কোরআন বাংলায় অনুবাদ করেন কোনো এক মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। কী সেই উদ্দেশ্য—ব্যবসায়—খ্যাতি নাকি ভিন্ন কোনো? ব্যবসায় বা খ্যাতি এরকম কোনো স্বার্থসিদ্ধি সাধনের জন্য তিনি কাব্যে আমপারা গ্রন্থটি অনুবাদ করেন নি। তার অনুবাদের উদ্দেশ্য ছিলো ভিন্ন। আর তা হলো মহৎ ও কল্যাণময়তা সাধনের উদ্দেশ্য।

এক.

কোরআনের মর্মার্থ বাঙালি মুসলিমদের মনের মর্মরে সহজে গেঁথে দেয়া।

দুই.

মাতৃভাষায় সহজে কোরআনকে কন্ঠস্থ ও আত্মস্থ করা।

আর কাব্যে কোরআন অনুবাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে কাব্যের মাধুর্যে আকৃষ্ট হয়ে বাঙালি মুসলমান কোরআন পড়তে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। নজরুলের ভাষায়—

“আমার বিশ্বাস, পবিত্র কোর-আন শরীফ যদি সরল বাংলা পদ্যে অনূদিত হয়, তা হলে তা অধিকাংশ মুসলমানই সহজে কণ্ঠস্থ করতে পারবেন-অনেক বালক-বালিকাও সমস্ত কোর-আন হয়তো মুখস্থ করে ফেলবে। এই উদ্দেশ্যেই আমি যতদূর সম্ভব সরল পদ্যে অনুবাদ করবার চেষ্টা করেছি।”

এখন প্রশ্ন হলো-কাব্যে আমপারা অনুবাদে তিনি কতোখানি সফল হয়েছেন?—এই প্রশ্নের উত্তর প্রবন্ধের শুরুতেই দিয়েছি। যিনি হুইটম্যানকে আজীবন অনুসরণ করছেন—তার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সাহিত্যের মতো কণ্টকাকীর্ণ পথে আজন্ম হেঁটেছেন—নিঃসন্দেহে তার অনুবাদ নিয়ে এ ধরনের প্রশ্ন করবার কোনো যৌক্তিকতার অবকাশ থাকে না। এক কথায় বলা যায় যে, নজরুল কাব্যে আমপারা অনুবাদে ছিলেন একনিষ্ঠ, অদ্বিতীয় ও সফল।

তার অনুবাদ পড়লে আমাদের কাছে কোনো দুর্বোধ্য বা নিরস মনে হয় না। মনে হয় না কোনো ভিনদেশি ভাষার ভাষান্তর পড়ছি। মনে হয় যেন কোনো উচু দরের সাহিত্য পড়ছি যা রচিত হয়েছে বাংলাভাষী কোনো এক স্বনামধন্য কবির হাতে। যেমন—

শুরু করিলাম লয়ে নাম আল্লার,

করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।

 

বলো, আমি শরণ যাচি উষা-পতির,

হাত হতে তারসৃষ্টিতে যা আছে ক্ষতির।

আঁধার-ঘন নিশীথ রাতের ভয় অপকার

এসব হতে অভয় শরণ যাচি তাঁহার!

জাদুর ফুঁয়ে শিথিল করে (কঠিন সাধন)

সংকল্পের বাঁধন, যাচি তার নিবারণ।

ঈর্ষাতুরের বিদ্ধেষ যে ক্ষতি করে।

শরণ যাচি, পানাহ্ মাগি তাহার তরে।

(সুরা ফলক)

তিনি ভাষা নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখিয়েছেন যেমন মুন্সিয়ানা—তেমন তাতে ছিলো নিখাদ শিল্পের বার্নিশ। প্রতিটা শব্দ ছিলো সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল। কোনো দুর্বোধ্যতার দূরহ রোগে আমাদের ভুগতে হয় না। অল্প শিক্ষিত মানুষেরাও অকপটে এটি পড়ে ফেলতে পারেন। নিমিষেই এর মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারেন। আর সেই অনুধাবনের অবগাহন থেকে কিছু না কিছ মণি-মাণিক্য অর্জন করতে পারেন। এ সম্বন্ধে নজরুলের স্বগতোক্তি হলো—

মক্তব-মাদ্রাসা স্কুল-পাঠশালার ছেলে-মেয়েদের এবং স্বল্প-শিক্ষিত সাধারণের বোধগম্য ভাষাতেই আমি অনুবাদ করতে চেষ্টা করেছি। যদি আমার এই দিক দিয়ে এই প্রথম প্রচেষ্টাকে পাঠকবর্গ সাদরে গ্রহণ করেনআমার সকল শ্রম সার্থক হল মনে করব।

গ্রন্থটির অনুবাদের কোয়ালিটিতে কোনো প্রকার ঘাটতি রাখেন নি নজরুল। তিনি কোরআনের মূল ভাব ও বিষয় অক্ষত রেখে সরাসরি আরবি ও ফারসি থেকে অনুবাদ করেছেন। তার অনুবাদে কোনো তাড়াহুড়া ছিলো না। তিনি খুব ধীর গতিতে এবং দেখেশুনে—বুঝেসুঝে অনুবাদ করেছেন। এটাকে বলা যায় ভাবগত ও আক্ষরিকতা মিলেমিশে শঙ্কর অনুবাদ। নজরুল চাইলে রুবাইয়াত ই ওমর খৈয়াম এর মতো কেবল ভাবগত অনুবাদ করতে পারতেন কিন্তু তা তিনি করেন নি—কারণ কোরআন মুসলমানদের একটা সেনসেটিভ বিষয়। একটু হেরফের হলে ভয়াবহ কিছু ঘটে যেতে পারে। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাবলি এড়াতেই হয়তো নজরুল এই শঙ্কর অনুবাদের মতো মিশ্র পথ বেছে নিয়েছিলেন। তার অনুবাদ সম্বন্ধে নজরুল ইন্সস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মোঃ এরশাদ হোসেন বলেছেন—

কাব্য আম-পারা গ্রন্থটি পবিত্র কোরআনের ত্রিশ সংখ্যক পারা-র অনুবাদ। এ অনুবাদ গ্রন্থের কাজ করতে গিয়ে নজরুল আরবি ভাষায় বিস্তর বুৎপত্তি অর্জনের চেষ্টা করেন এবং বিভিন্ন কোরআন অনুবাদকের অনুবাদ-কর্মে মনোনিবেশ করতে আগ্রহী হন। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় অগ্রহায়ণ ১৩৪০ সালে (২৩ নভেম্বর ১৯৩৩ সালে)। সর্বমোট আটত্রিশটি সুরার অনুবাদ এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। মূলভাবকে অক্ষত রেখে নির্ভুল অবয়বে সুষম অর্থবহ অনুবাদে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। গ্রন্থের শেষে ‘শানে নুযুল অংশে সুরা সমূহের পরিচয় প্রদান পূর্বক যে টীকা উল্লেখ করেছেন তাতে আরবি ভাষায় বিস্তর জ্ঞান, হাদিস বিষয়ে বুৎপত্তি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতার অসাধারণ পরিচয় পাওয়া যায়। 

নজরুল যেমন ভাষাগত বৈচিত্র্য অক্ষুণ্নতা অটুট রেখেছিলো—তেমন ছন্দ প্রকরণেও ছিলো ভিন্নতা। তিনি গদ্য বা মুক্ত ছন্দ পরিহার করে কতোগুলো পয়ার রচনা করেছিলেন। কোথাও ছিলো অক্ষরবৃত্ত ছন্দের সুষমা—কোথাওবা মাত্রাবৃত্তের মসৃণ গতি ও গন্ধ। যেমন—

শুরু করিলাম শুভ নামে সে আল্লার

করুণা-নিধান যিনি কৃপা পারাবার।

 

দেখ নাই, তব প্রভু কেমন (দুর্গতি),

করিলেন সেই গজ-বাহিনীর প্রতি?

(দেখ নাই, তব প্রভু) করেন নি কিরে,

বিফল তাদের সেই দুরভিসন্ধিরে?

 

পাঠালেন দলে দলে সেথা পক্ষী আর,

করিতে লাগিল তারা প্রস্তর প্রহার

গজপতিদেরে। তিনি তাদেরে তখন

করিলেন ভক্ষিত সে তৃণের মতন।

(সুরা ফিল : অক্ষরবৃত্ত)

অথবা

অধিক লোভের বাসনা রেখেছে তোমাদেরে মোহ-ঘোরে

যাবৎ না দেখো তোমরা গোরস্থানের আঁধার গোরে।

না, না, না, তোমরা শীঘ্র জানিবে পুনরায় (কহি) ত্বরা

জ্ঞাত হবে; না, না, হতে যদি জ্ঞানী ধ্রুব সে জ্ঞানেতে ভরা।

(সুরা : তাকাসুর : মাত্রাবৃত্ত)

ছালেছ-ই কোরআন, মৌলানা এম ডি আলি’স কোরআন, তাফসিরে হুসায়নি, তাফসিরে বায়যাভি, তাফসিরে কাবিরি, তাফসিরে মৌলানা আবদুল হক দেহলভি, তাফসিরে জালালাইন এবং মৌলানা মুহাম্মদ আকরাম খান ও মৌলানা রুহুল আমীন সাহেবের আমপারা হতে সহায়তা নিয়েছেন। তিনি সুরাসমূহের কাব্যানুবাদ শেষ করার পর গ্রন্থের শেষে প্রতিটা সুরার শানে নুযুল উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে তাফসিরে আযিযি, তাফসিরে মাজহারি, তাফসিরে কবির, তাফসিরে কাশশাফ, তাফসিরে বায়যাভি ও তাফসিরে হক্কানিসহ হাদিস শরিফের অমর গ্রন্থ বুখারির মতো বিখ্যাত গ্রন্থসমূহের সূত্র উল্লেখ করেছেন।

কাব্যে আমপারা গ্রন্থটি রচনা ও অনুবাদের উৎসাহ যুগিয়েছিলেন প্রধানত মেসার্স করিম বখশ ব্রাদার্সের স্বত্ত্বাধিকারী মাওলানা আবদুর রহমান খান। এখানেই দাড়ি নয়, গ্রন্থ প্রকাশের সমুদয় অর্থের যোগানও দিয়েছিলেন এই উদার্য ব্যক্তিটি। এছাড়াও বিবিধ বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন তাঁরই ছেলে মৌলবি রেজাউর রহমান খান, মাওলানা মোহাম্মদ মোমতাজউদ্দিন ফখরোল, মাওলানা সৈয়দ আবদুর রশিদ (পাবনবী), ইসকান্দর গজনভী, মৌলবি কে এম হেলাল সাহেবসহ নাম না জানা আরও অনেকে। এই গ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বাংলার নায়েবে-নবী মৌলবি সাহেবানদের দস্ত মোবারকে।

শপথ রবি ও রবি কিরণের

যখন চন্দ্র চলে সে পিছনে তার

দিবস যখন করে সপ্রকাশ

             রবিরে, রজনী অন্ধকার

 

যখন ছাইয়া ফেলে সে রবিরে;

             নভ-নির্মাণ-কারী তাহার;

এই সে পৃথিবী স-বিস্তার;

             আত্মা, সুচারু গঠন তার।

 

সেই আত্মার সৎ ও অসতের

             দিয়াছি দিব্য জ্ঞান,

এই সকলের শপথ ইহারা

             সকলে করিছে সাক্ষ্য দান

 

আত্মশুদ্ধি হইল যার,

             নিশ্চয় সার্থক জীবন,

আত্মায় কলুষিত করিল যে

         চির-বঞ্চিত হলো সে জন।

(সুরা শামস)

 

উৎস : নজরুল রচনাবলী—পঞ্চম খণ্ড, কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা, নজরুলের কোরআন ও পুরাণচর্চা—স্মৃতিকণা চক্রবর্তী ও উইকিপিডিয়া।

 

তরুণ লেখক
জন্ম : ১৯৮৭ সাল, রংপুর।

প্রকাশিত বই দুইটা।
এক. ওকাবোকা তেলাপোকা (২০১৬) -শিশুতোষ
দুই. এলিয়েনের দেশ পেরিয়ে (২০১৭)-শিশুতোষ।

 

নজরুলের অনুবাদ : কাব্যে আমপাড়া

মুগ্ধতা.কম

১১ মে, ২০২০ , ৯:৫০ অপরাহ্ণ

নিভু নিভু আলোয় অন্তরীণ

মূল : ক্রিস হেমেন্সলে

ভূমিকা ও ভাষান্তর : রেজাউল ইসলাম হাসু

ক্রিস হেমেন্সলে

ক্রিস হেমেন্সলে

মিশরীয় মা আর ইংরেজ পিতার চুম্বনে যুক্তরাজ্যের আইল অফ ওয়াইটে ২৬ এপ্রিল, ১৯৪৬ সালে জন্মগ্রহণকারী কবি ক্রিস হেমেন্সলে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় বেড়ে ওঠেন। যেখানে তাঁর বাবা রয়েল এয়ার ফোর্সের সদস্য ছিলেন। ১৯৬৬ সালে হেমেন্সলে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান। মেলবোর্নে তিনি রেডিও সম্প্রচারক ও সাহিত্যের সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন এবং আওয়ার গ্লাস , আর্থ শিপ , দ্য ইয়ার ইন এ হুইটফিল্ড এবং দ্য মেরি ক্রিক বা নেরো  সহ বেশ কয়েকটি সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা করেন ।

তিনি প্রায় বিশটিরও বেশি কবিতা সংকলন প্রকাশ করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : দ্য গোয়িং অ্যান্ড আদার পয়েমস (১৯৬৯), ডমেস্টিকেশনস : এ স্লিকেশন অব পয়েমস ১৯৬৮–১৯৭২ (১৯৭৪) এবং ট্রেস  (১৯৮৪)। তাঁর গদ্যের মধ্যে রয়েছে দ্য রুমস অ্যান্ড আদার প্রোজ পিচেস (১৯৭৫) এবং নো ওয়ার্ড, নো অরি : প্রোজ পিচেস ১৯৬৮–১৯৭০ (১৯৭১)।

হেমেন্সলের গীতি কবিতাসমূহ প্রকৃতি এবং ব্যক্তিসত্তার মধ্যে এক ধরনের  অন্তর্গত আচ্ছন্নতা। অস্ট্রেলিয়ার দ্য এজ  পত্রিকার কোনো এক সাক্ষাৎকারে হেমেন্সলে ‘তাকে লেখার জন্য কোন অনুষঙ্গগুলো প্রণোদিত করে’ সে সম্পর্কে বলেছিলেন,

‘একটি সৃজনশীল সত্তা, পেশাদারিত্বতা, প্রয়োজনীয়তা ও অবস্তুগত  কর্মপথ’ 

তিনি ২০০৪ সালে ক্রিস্টোফার ব্রেনান পুরস্কারে ভূষিত হন।

ক্রিস হেমেন্সলের হাইকু

অ.

(রবার্ট গ্রে’কে উৎসর্গিত)

নিভু নিভু আলোয় অন্তরীণ,

অদৃশ্য রিলকের জানোয়ার ধৃতিমান;

এই দিক স্বর্গের।

 

আ.

বহুবর্ষজীবী সবুজ

নাকি ক্ষণজীবী রঙের কুহক—

হে মনোবন, বলো—কে পর্যাপ্ত?

 ই.

পাতায় পাতায় লালের প্রপাত,

রঙিন পালে মিহিন ধূসর, আকাশের হুমকি—

হোই! কাঁদে নীলনদ।

ঈ.

এই সবুজ অপেক্ষায়—

পাতায় পাতায় স্ফূরিত হবে পাখিদের কম্পন, তারপর

মর্মরে ঝরবে—পরম্পরায়!

 

তরুণ লেখক
জন্ম : ১৯৮৭ সাল, রংপুর।

প্রকাশিত বই দুইটা।
এক. ওকাবোকা তেলাপোকা (২০১৬) -শিশুতোষ
দুই. এলিয়েনের দেশ পেরিয়ে (২০১৭)-শিশুতোষ।

 

নিভু নিভু আলোয় অন্তরীণ - রেজাউল ইসলাম হাসু

মুগ্ধতা.কম

২৬ এপ্রিল, ২০২০ , ৫:১৮ অপরাহ্ণ

তার ব্যাঞ্জণা ঝর্ণার মতো ঝরে

মূল : ইথেরিজ নাইট
ভূমিকা ও ভাষান্তর : রেজাউল ইসলাম হাসু

ইথেরিজ নাইট

লেখকঃ ইথেরিজ নাইট

ইথেরিজ নাইট ১৯৩১-১৯৯১

হাককু থেকে বদলে হাইকু নামে রূপান্তরিত হয় উনিশ শতকের শেষে জাপানি কবি মাসাওকা শিকির হাত ধরে কবিতা বিশ্বের এই ক্ষুদ্রতম সংস্করণটি। এর আদি উৎস তথ্য ও প্রযুক্তিতে উন্নত রাষ্ট্র সূর্যোদয়ের দেশ জাপান হলেও বর্তমান সারা পৃথিবীতে উজ্জ্বল স্বপ্ন ও সৌন্দর্য। আভিজাত্যের সৌকর্ষ হিসেবে জাপানিদের রক্তে মিশে আছে। হাইকু হলো একধরনের ক্ষুদ্র সংস্করণের জাপানি কবিতা। যার শরীর চুমুর চেয়েও ছোট কিন্তু রক্তাভ আর প্রগাঢ়। তিনটি পংক্তিতে যথাক্রমে ৭, ৫ এবং ৭ জাপানি শ্বাসাঘাত মোরাস বা সিলেবলস মিলে মোট ১৭ মোরাসের বা সিলেবলসের সংক্ষিপ্ত পরিসরে এক মুহূর্তেই ঘটিত মনের ভাব এর অভিব্যক্তি-নামা। জাপানি হাইকু একটি লাইনে লেখা হয়। সেই বাক্যটিতে ১৭টি মোরাস বা সিলেবলস থাকে।

মোরাস ও মাত্রা একই ব্যাপার নয়। ইউরোপিয়গণ ১৭ মোরাসকে ১৭ দল মনে করে হাইকু লেখার সূচনা শুরু করে। তাদের দেখাদেখি বাংলাভাষায় ১৭ মাত্রার হাইকু লেখার প্রচলন হয়। মোরাস, দল ও মাত্রা এক-একটি ভাষার নিজস্ব শ্বাস অনুসারী। সেই অনুযায়ী ১২ মোরাসে ১৭ সিলেবল হয়। ইউরোপে ইমেজিস্ট আন্দোলনের পর ১৭ সিলেবলের পরিবর্তে আরও বেশি সিলেবলের হাইকু লেখা শুরু হয়েছে। জ্যাক কেরুয়াক প্রমুখ মার্কিন কবিরা স্বীকার করেছেন যে মার্কিন উচ্চারণ জাপানি উচ্চারণ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। তারা ১৭ দল ও তিন বাক্য্ বন্ধন অস্বীকার করে হাইকু লিখছেন।সাধারণত ছবির বিষয় ও ভাব বর্ণনা করার জন্য হাইকু লেখার সূচনা হলেও তার সে বলয় ভেঙে সে আজ চৌহদ্দিতে বিপুলভাবে বিস্তৃত। কোবায়িশি ইশা, মাৎসু বাসো, য়োসা বুসনসহ প্রমুখ জাপানি কবিরা হাইকু লিখে বিশ্বসাহিত্যে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।

ইথেরিজ নাইট ১৯৩১ সালে মিসিসিপির করিন্থে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি কিশোর বয়সে হাই স্কুল ছেড়ে কোরিয়া যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। সংঘাত চলাকালীন আহত হয়ে তিনি নাগরিক জীবনে ফিরে আসেন। টেরেন্স হেইসের মতে,

“নাইটের জীবনী অস্থির আমেরিকানত্ব, আফ্রিকান আমেরিকানা ও কবিতার গল্প। এতে কিছু ফকনারিয়ান পারিবারিক কাহিনী রয়েছে, কিছু মধ্যসত্মার  রূপান্তরের কাহিনী, নির্মম পুংলিঙ্গ ট্র্যাজেডি আর নিদাগ শিল্প-শ্রদ্ধা । ”

কারাগারে থাকাকালীন নাইট কবিতা লিখতে শুরু করেন। ডুডলি এবং গেন্ডেললিন ব্রুকসের মতো কৃষ্ণাঙ্গ আলোকিত সাহিত্যিকদের সাথে তার যোগাযোগ ছিলো এবং তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে কবিতা থেকে প্রিজন তাঁর প্রথম সংকলন বের হয়। কবিতা থেকে প্রিজন এর ব্যাকপেজের প্রচ্ছদে নিম্নলিখিত বয়ানটি অন্তর্ভুক্ত ছিলো :

“আমি কোরিয়ান শরীরে ক্ষত হয়ে মরে গেলাম আর মাদক আমাকে পুনরুত্থিত করলো। আমি কারাগারের অন্ধকারে মরে গেলাম আর কবিতা আমাকে পুনরুত্থিত করলো।”

তার উল্লেখযোগ্য রচনা হলো নাইট’স বার্ন অব এ ওম্যান : নতুন এবং নির্বাচিত কবিতা (১৯৮০)।
নিজের প্রচেষ্টায় সমাজকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা মানুষ ইথেরিজ নাইট ১৯৯১ সালে মারা যান। নিচে এই মহান কবির কয়েকটি হাইকু ভাষান্তর করতে পেরে নিজেকে গর্বিত বোধ করছি।

এক.

পুবে প্রহরী-পাহাড়

অস্তমিত ছায়া; দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত

অশ্মের উপর যেন গিরগিটি।

দুই.

বখিল বেহালাবাদক

বেজে ওঠে, মধ্যরাতে

তার ব্যাঞ্জণা ঝর্ণার মতো ঝরে।

তিন.

তীর্যকভাবে খুপড়িতে ফেরে ভোর

টালমাতাল, যেন খুঁড়ে খুঁড়ে উড়ে চলা

কারাগারের ফ্লোর।

চার.

একটি বিষাদের গান লিখতে

অবাদে অপচয় করা,

আর অন্ধকার থেকে রত্ন আহরণ।

পাঁচ.

একটি শূন্য পিক্যান গাছ

পিছলে যাওয়া পেন্সিল ছায়াতলে

কোনো তুষারের জ্যোৎস্না।

ছয়.

পতিত তুষার ঝড়ে

বিদীর্ণ হবে না দীর্ঘস্থায়ী শোক অথবা

ইস্পাতের মতো স্তব্ধতা।

সাত.

চাঁদের ছায়ার নিচে

একটি সুদীর্ঘ ছুরি জ্বলছে আর

নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল বরফখণ্ড।

আট.

শ্রাবণের ঘাস

সূর্যের অন্তিম আভায় অভিহত হয়

চায়ের কাপে মুষুলধারে মিনতি।

নয়.

সতেরো শ্বাসাঘাতে

ব্যাঞ্জণার বিকাশ ছাড়া

কবিদের দায় নেই।

 

উৎস : পয়েট্রি ফাউন্ডেশন ও উইকিপিডিয়া।

 

লেখক : তরুণ সাহিত্যিক।
জন্ম : রংপুর, ১৯৮৭সাল।

প্রকাশিত বই দুইটা।
এক. ওকাবোকা তেলাপোকা (২০১৬) -শিশুতোষ
দুই. এলিয়েনের দেশ পেরিয়ে (২০১৭)-শিশুতোষ।

 

ঝর্ণার মতো ঝরে

মুগ্ধতা.কম

২৬ মার্চ, ২০২০ , ১১:০৩ পূর্বাহ্ণ

হ্যাঁ ভয় আছে, আছে বিচ্ছিন্নতা

মূল: রিচার্ড হেন্ড্রিক

ভূমিকা ও অনুবাদ: রেজাউল ইসলাম হাসু

রিচার্ড হেন্ড্রিক

রিচার্ড হেন্ড্রিক

রিচার্ড হেনড্রিক হলেন একজন রোমান ক্যাথলিক। আয়ারল্যান্ড করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে কঠোরভাবে কতিপয় পদক্ষেপের ঘোষণা দেয়। এরই ফলশ্রুতিতে গত ১৩ মার্চ ফেসবুকে হেনড্রিক কবিতাটি শেয়ার করেছিলেন, যাতে এটি বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য সংকটের ‘ভয়’ এবং ‘বিচ্ছিন্নতা’ সমন্ধে মানুষকে সম্যক ধারণা দিতে সক্ষম হয়। কবিতাটি বার বার আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ‘হ্যাঁ ভয় আছে, তবে থাকবে না কোনো ঘৃণা সেজন্য। বিচ্ছিন্নতা আছে তবে থাকবে না কোনো একাকীপনা’। এবং ‘আবার উহানে/পাখিদের কলতানে/মুখখরিত হবে,/স্বচ্ছ হবে আকাশ/আসবে ফাগুন,/এবং আবার হৃদয়ের অন্ধকারে/জ্বলে উঠবে প্রেমাগুন।/হৃদয়ের জানালা খুলে দাও/এবং প্রত্যুষের গান গাও/যদিও সইতে না পারো/গৃহের শূন্যতা কারো… বলে কবিতাটি শেষ করেছেন। এ যেন লকডাউন পৃথিবীরই হৃদপিন্ড থেকে উঠে আসা উৎকণ্ঠা আর উপাসানার অভিব্যক্তি।

হ্যাঁ ভয় আছে।

আছে বিচ্ছিন্নতা।

আতঙ্ক আছে।

আছে অসুস্থতা।

আছে মৃত্যুও।

 

তবুও

 

আমরা বলছি

উহানে

আবার পাখিদের কলতানে

ভাসবে

 

আমরা বলছি

নৈশব্দ্যের দিনলিপি শেষে

ধোঁয়াশার আকাশে

রোদের পাণ্ডলিপি হাসবে।

 

আমরা বলছি

অ্যাসিসির রাস্তা-ঘাটে

ধূধূ মাঠে

মানুষ মেতে উঠবে

বসন্তের কবিতা পাঠে।

 

খুলে দাও বদ্ধ জানালা

রিক্ত যারা

স্বজনদের ডাক শুনত পাক

চারপাশে তারা।

 

আমরা বলছি

বিনামূলে খাবার আসছে

আবদ্ধ গৃহগুলোতে।

 

বিচ্ছিন্নতার বিষাদ ভুলাতে

জানি আজ সেবক-সেবিকারা

শোভাকাঙ্ক্ষী,

প্রেমিক-প্রেমিকারা

ব্যাস্ত আর যেন নিষ্প্রভ তারা।

 

আজ মসজিদ-মন্দির

গীর্জার নীড়,

উপাসনায়-প্রার্থনায়

প্রবল অধীর।

 

এমত সময়ে

হে হৃদয়, হৃদয়ে

থেকো না বধির।

 

আর গৃহহীন,

অসুস্থ-ক্লান্ত

ক্লেদাক্তদের ছাদ দিন

ছাউনি দিন।

 

পৃথিবী লকডাউন হচ্ছে,

আমরা লকডাউন হচ্ছি।

যেন পুনর্জন্ম হবে আমাদের,

নতুন চোখ হাতড়াচ্ছি

চারপাশ দেখার!

 

দাঁড়িয়ে আছি নিবদ্ধ চোখে

কোনো এক শ্রীহীন

সত্যাভিমুখে।

 

হায়

সত্যিই, আমরা কতো অসহায়!

কতো অসহায়!

 

অন্তত

সামান্য নিয়ন্ত্রণ থাক আমাদের।

সামান্য ভালোবাসা থাক হৃদয়ের।

 

অতএব

আসুন আমরা প্রার্থনা করি,

এবং ধারণ করি

 

হ্যাঁ, ভয় আছে।

তবে থাকবে না কোনো ঘৃণা।

আছে বিচ্ছিন্নতা।

তবে থাকবে না একাকীপনা।

 

আতঙ্ক আছে।

তবে থাকবে না নীচতাযোগ।

অসুস্থতা আছে।

তবে থাকবে না মনোরোগ।

 

হ্যাঁ, আছে মৃত্যুও।

প্রণয় পুনর্জন্ম নেবে

 

তবুও।

 

কীভাবে বাঁচবো

হে প্রাচীন সন্ধ্যা?

বের করো সেই পথ,

আর প্রজ্জ্বলিত পন্থা।

 

পেছনে ফেলে

আতঙ্কের শোরগোল,

করুণ কান্নার রোল;

আবার নেবো নিশ্বাস।

 

আবার উহানে

পাখিদের কলতানে

মুখখরিত হবে,

স্বচ্ছ হবে আকাশ।

 

আবার আসবে ফাগুন,

এবং হৃদয়ের অন্ধকারে

জ্বলে উঠবে প্রেমাগুন।

 

হৃদয়ের জানালা খুলে দাও,

এবং প্রত্যুষের গান গাও;

যদিও সইতে না পারো

গৃহের শূন্যতা কারো…

 

অনুবাদক : তরুণ সাহিত্যিক। প্রকাশিত বই দুইটা। এক. ওকাবোকা তেলাপোকা (২০১৬) -শিশুতোষ ও এলিয়েনের দেশ পেরিয়ে (২০১৭)-শিশুতোষ।

 

অনুবাদ-হ্যাঁ ভয় আছে, আছে বিচ্ছিন্নতা

মুগ্ধতা.কম

২৩ মার্চ, ২০২০ , ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

বই থেকে আলোচনা : পতিত চিনার : আমি ডুবতে রাজি নই

পতিত চিনার

বই : দ্য ফ্যালেন চিনার : আই রিফিউজ টু সিঙ্ক

কবি : মাশুদ রাথার

মূল :রিয়াজ মির

অনুবাদ : রেজাউল ইসলাম হাসু

প্রকাশক : লিপার পাবলিকেশনস (শ্রীনগর)

প্রকাশকাল : ২০১৮

পৃষ্ঠা : ৫৬

 

দ্য ফ্যালেন চিনার : আই রিফিউজ টু সিঙ্ক জম্মু ও কাশ্মীরের আঠারো বছরের তরুণ কবি মাশুদ রাথারের প্রথম কবিতার বই। বইটি সহিষ্ণুতার সঙ্গে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই শেষ করা যেতে পারে। তবে কীভাবে একজন তরুণ বিবিধ জটিল বিষয়গুলোকে এমন নান্দনিকতার সঙ্গে কবিতাময় করে তুলেছে তা দীর্ঘকাল ধরে আমাদের ভাবতে বাধ্য করে।

কবিতার ছন্দবিন্যাস, অবয়ব এবং ট্রানসফার অব সাইনের (উৎপ্রেক্ষা, অলংকার ও অনুপ্রাস গুণাবলি) মতো মৌলিক পরিমিতিগুলো আমাদের হৃদয় ও মনকে আন্দোলিত করে। এগুলোকে মাঝেমধ্যে শব্দের খেলা বলা হয়ে থাকে। কেননা, তার কাব্যিক দক্ষতা, আঞ্চলিক ভাষার সদ্ব্যবহার এবং কল্পনা, যা আত্মাকে অস্বাভাবিক যাত্রায় নিয়ে যায়।

সত্যিকারার্থে কবিতার আকৃতি এবং কৌশল নিয়ে বিশ্লেষণ করলে নিখুঁতভাবে দ্য ফ্যালেন চিনার কোনো কবিতার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না। তবে অধিকাংশ কবিতায় প্রকাশের সৃজনশীলতা অনন্য এবং এই তরুণ কবির স্পষ্টতা এবং শক্তিমত্তা যেন কাব্যিক আকাক্সক্ষাকেই প্রতিফলিত করে। কবিতাগুলোর ভেতর জার্নি করার সময় গভীরভাবে বিশ্বাস করা যায় না যে, কবি একজন আঠারো বছরের তরুণ। তিনি তাঁর কবিতায় কিছু পরিপক্ব অভিজ্ঞতা এবং বিস্তৃত কল্পনার জগতকে কিছুটা অপ্রথাগত অভিব্যক্তির সাথে তুলে ধরেছেন।

কবি মনে হয় এমন একজন সংবেদনশীল মানুষ, যিনি তার চারপাশের সমাজকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং তারপর তাঁর কল্পনার জগতকে কবিতায় অনুবাদ করছেন। দ্য ফ্যালেন চিনার তার অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতিগুলো সিরিয়াস প্রক্রিয়াকরণের প্রচেষ্টাকেই প্রতিফলিত করে। প্রতীকী প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে তিনি চিনার এবং এর পরিণতি সম্পর্কে লিখেছেন :

 

ঋতুরা এলো

আর চলে গেলো

যেন চোখ থেকে

অদৃশ্য হয়ে গেলো

তারপর

ছুতারের সঙ্গে দেখা হলো

যেন কাঠঠোঁকড়ার খোদাই করা

তার গল্পগুলো

 

শৈশবকালের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেবার মতো দায়েব এই বইয়ের একটি সুন্দর কবিতা। দায়েব কাশ্মীরের পুরনো বাড়িগুলোতে বারান্দা হিসেবে ব্যবহৃত হতো এবং এর রেলিঙ স্পর্শ করতে চমৎকার লাগতো। মাশুদ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, কীভাবে তিনি দাউবে দাঁড়িয়ে বাতাসে পা ঝোলাতেন এবং অবারিত প্রকৃতির সঙ্গে আনন্দময় মুহূর্তগুলো উপভোগ করার মিশ্র অনুভূতি লিখতেন :

নীল তারা

সোনালি চাঁদ

কর্ষিত মাটি

শুষ্ক মাঠ

ধূ-ধূ

যেন আমরাই

বেঁচে আছি শুধু…

সে উড়ে গেছে

দীর্ঘ পালক বেয়ে

এবং পালিয়ে গেছে

আমার কাছ থেকে

আমার দগ্ধ দৃষ্টি

দেখেছে তাকে

আমি মেঘে গিয়েছিলাম কবিতায় তরুণ কবি অলৌকিক কিছু অর্জন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তাই তিনি নীলাকাশের গভীরে যেতে চান। প্রতীকীভাবে এমন একখানে, যেখানে তিনি যেন পর্যবেক্ষণ করতে পারেন প্রকৃতভাবে পৃথিবীতে কী ঘটছে।

আমার আত্মায় একজন মা পেয়েছি বইটির আরও একটি সুন্দর কবিতা। এটি একজন মায়ের কাছে নিখাঁদ ভালোবাসা এবং আত্মিক শ্রদ্ধাবোধ জানান দেয় আমাদের আত্মায়। কবির ভাষায় :

তারপর

দুঃসময়ে

আমার হৃদয়ে

একটি মোমবাতি জ্বলে ওঠে

তার উদ্ভাসন

আর আন্দোলন

দেখেছি আমরণ

এই দৃষ্টির রেখাতটে।

 

ঠিক পরের কবিতা বৃথা কান্না ছেলো হারোনো একজন মায়ের অন্তর্বেদনার প্রতিফলন এবং তার শোক বয়ে যাচ্ছে কিন্তু সব কান্না বৃথা হয়ে যাচ্ছিলো :

তুমি তল্লাশ করতে পারো না

কারণ তাদর উপাত্তসমূহ মুছে দিয়ে

তারা মরে গেছে।

বিষয়, চিন্তা ও কল্পনাগুলো পরিবর্তিত হয় অথবা এমন একটি পরিস্থিতি উপস্থাপন করে যা মাঝেমধ্যে আশাবাদ থেকে হতাশ্বাসের দিকে নিয়ে যায় কিংবা রাষ্ট্রের অন্ধকার থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে আত্মোৎসর্গ করতে উদ্ভুদ্ধ করে। হয়তো কবি এই সমস্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি হন অথবা তিনি সমাজে যা দেখছেন বা অনুভব করছেন তার বয়ান নিতে তিনি এত সংবেদনশীল? কবির মনে বিভ্রান্তি অথবা কবিতায় কোনো নতুন বিষয় উপলব্ধি করার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

যেহেতু তিনি বয়সে খুব তরুণ, সেহেতু এত জটিল বিষয়ে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠা এবং কবি হিসেবে সেগুলো কবিতায় উপস্থাপন করাও একটি রূঢ় কাজ। চিন্তা ও কল্পনা-কলহের মুখোমুখি হওয়ার জটিলতা প্রকাশের জন্য যখন কবিতা বেছে নেওয়া হয় তখন অবস্তুগতভাবে তুলে ধরা স্বাভাবিকের চেয়ে অস্বাভাবিক আর কঠিন হয়ে যায়।

সুইজারিং কবিতায় কবি আশা ও হতাশার ঘূর্ণিপাকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সুতরাং তিনি একের পর এক আশা এবং হতাশা, আস্থা এবং অবিশ্বাস, আনন্দ এবং বেদনা, ভালোবাসা এবং ঘৃণা, শান্তি এবং যুদ্ধের মতো শব্দগুলি লিখেছেন। বইয়ের অনেক কবিতায় বৈসাদৃশ্যের ধারণাগুলি দেখা যায়। মাশুদ রাথারের মতো এসব একজন তরুণ কবির কাছে অসাধারণ কিছু বলেই মনে হচ্ছে।

বইটিতে কিছু চমৎকার কবিতা রয়েছে যা আমাদের আবেগ, অনুপ্রেরণা এবং সংবেদনকে প্রভাবিত করে। কবিতাও রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কাশ্মীরের শরৎ, দ্য লিঙ্গারিং নাইট ইন মি, আজাদি।

কবি বিগত দুটো কবিতায় নির্যাতনময় কারাগারে বুনো উল্লাসের বিকৃত অনুভূতিকর কাশ্মীরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং এর নিকৃষ্ট প্রতিক্রিয়ার প্রতিচ্ছবিকে আরও নিপুণভাবে আঁকার চেষ্টা করেছেন।

লেট ট্র্যাজেডিস ড্যান্স একটি প্রতিনিধিমূলক কবিতা, যা তাঁর নিজস্ব সমাজের নিরবচ্ছিন্ন মৃত্যু, যন্ত্রণা ও দুর্দশার বিষন্ন বয়ান এবং তিনি দার্শনিকভাবেই লিখেছেন-

আসুন, মৃত্যুকে আবার শান্তিময় করি

শেষ কবিতাটি কারো কারো জন্য কিছু আত্মবাচক জিজ্ঞাসার মতো সামনে এসে দাঁড়ায়। কাশ্মীরের ভয়াবহ জীবনের জিজ্ঞাসা সবার কাছে। এমনকি অন্য কবি অথবা বেসামরিক মানুষের কাছেও তার একই জিজ্ঞাসা :

তুমি কি এখনও কবিতার আড়ালে আড়াল?

পিছনে হতাশা ও অন্তর্ঘাত!

এখনও কি জীবন রচনা করো

ঝরা পাতার মতো মুক্ত পতনের ঝড়ে?

 

বই এবং কবিতাটি ভয়ানক উদ্বেগের সাথে শেষ হয়েছে :

 

অনন্তকালের জন্য

আমি এখনই ঘুমোতে চাই

কেননা

আমি দাঁড়াতে পারছি না

যুদ্ধের বিষ্ঠায়

ততক্ষণ

তোমরা আমার মুখের ভেতর

জন্মহীন

মৃত্যুর সংজ্ঞা সন্ধান করো

 

কবির ভালো কাব্যিক দক্ষতা রয়েছে। তার কল্পনাশক্তি তার বয়সকে ছাড়িয়ে তাঁর সৃজনশীলতাকে আরও হৃদয়গ্রাহী করে তোলে। যারা অনেক জটিল অভিব্যক্তিতে সাধারণ অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতাকে চিত্রিত করার চেষ্টা করেন তাদের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় যারা সহজ অভিব্যক্তিতে লেখেন। সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই মাশুদ রাথারের সাহিত্যও পাঠকের কাছে তুমুল জনপ্রিয়তা পাবার দাবি রাখে।

কবিতায় চেনাশোনার পরিমণ্ডলে স্বতন্ত্র হলে পৃথিবীকে জানা যায় ততটা, যতটা প্রচলিত বা প্রথাগত সমাজের কাছে যায় না। ভিন্নভাবে উপস্থাপনের সর্বোত্তম শিল্প প্রয়াসের জন্য শুভকামনা, মাশুদ রাথারকে।

 

অনুবাদক : তরুণ সাহিত্যিক। প্রকাশিত বই দুটো। এক. ওকাবোকা তেলাপোকা (২০১৬) -শিশুতোষ ও এলিয়েনের দেশ পেরিয়ে (২০১৭)-শিশুতোষ।

বই থেকে আলোচনা : পতিত চিনার : আমি ডুবতে রাজি নই

মুগ্ধতা.কম

১৬ মার্চ, ২০২০ , ৪:২৩ অপরাহ্ণ

অনুবাদ

ভূমিকা : মাশুদ রাথার জম্মু ও কাশ্মীরের একজন তরুণ কবি। তিনি প্রতিদিনের ঘটনাপ্রবাহকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং সেগুলোর বর্ণ-বিবর্ণতার হাসি-কান্না, আলো-আঁধার, আনন্দ-আর্তনাদ কবিতায় প্রসেস করেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, বিশৃঙ্খলা ও সম্পদের ধ্বংসাবশেষের গভীরে ডুবেও শান্তির সন্ধান করা যায় এবং বিশ্বাস করেন কবিতার নীরবতাকেও। দ্যা ফ্যালেন চিনার : আই রিফিউজ টু সিঙ্ক তার প্রকাশিত কবিতার বই। ২০১৮ সালে রিপার পাবলিকেশন থেকে ইংরেজি ভাষায় বইটা প্রকাশিত হয়।

 

আমি কেনো লিখবো?

 

সবার আগে-আমি কেনো লিখবো?

কারণ কাগজ এবং আমার সম্পর্ক হলো

তোমার সাথে আমার যেমন সম্পর্ক ছিলো

যেখানে-আমি কাগজ ছিলাম এবং তুমি ছিলে-কলম।

English : Why do I write?

 

বিবর্ণতার বসন্তে

 

যখন

বিবর্ণতার বসন্তে

বিচ্ছেদের গানে

শরতের বৃষ্টি নামে,

 

আর বৃষ্টির প্রতিটি শ্লোক

তোমাকে বঞ্চিত করে;

 

তখন

অশ্রুকে ধারণ করো

তোমার ব্যক্তনামা লিখতে,

 

আর সমস্ত অশ্রুতে সিক্ত হও

তুমিনামা উচ্চারণ করতে…

English: In the milieu of colorlessness

 

তিনি এমন একজন উন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন

 

তিনি এমন একজন উন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন, যিনি মুহূর্তের আগে মনের ভেতর ব্যাক্ত বিবৃতিকে পুনর্বার ব্যাক্ত করতেন। এবং ভয়ানকভাবে একটি অদ্ভুত সংকেত অথবা আলোকদর্শনের রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করতেন। আর তোমার অন্তর্গত অভিনয় করতেন সেভাবে-যেভাবে অগ্নিশিখার আড়ালে ক্যাসো তোমাকে অভিঘাত করছে’…

English : She had become kind of a person

 

আমরা ডুবে যাচ্ছি

 

আশা-নিরাশার

বিশ্বাস-অবিশ্বাসের

আফসোস-উচ্ছাসের

আর ভালোবাসার

প্রবল ঘূর্ণিপাকে

আমরা ডুবে যাচ্ছি।

 

প্রেম কি হৃদয়ে প্রবেশের আগে

দরজায় নক করে?

একদম না,

উপলব্দি ছাড়া আমাদের মধ্যে আর কিছু অবশিষ্ট নেই।

English : We got drowned

 

অনুবাদক : তরুণ সাহিত্যিক। প্রকাশিত বই দুইটা। এক. ওকাবোকা তেলাপোকা (২০১৬) -শিশুতোষ ও এলিয়েনের দেশ পেরিয়ে (২০১৭)-শিশুতোষ।

মাসুদ রাথারের কবিতা