নজরুলের অনুবাদ : কাব্যে আমপাড়া
রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ অথবা অন্যান্য সাহিত্যেকের মতো অতো বেশি না হলেও নজরুল যৎসামান্যই অনুবাদ করেছেন। অনুবাদক হিসেবে নজরুল কেমন ছিলেন?—এই প্রশ্নের উত্তর তার একটা রচনাই দিতে পারে, আর তা হলো বিদ্রোহী—যদিও তার রুবাইয়াত ই ওমর খৈয়াম এর মতো চকচকে ও ওজনশীল অনুবাদ রয়েছে। হুইটম্যানের ‘সং মাইসেলফ’যখন অনুবাদ করা হয় তখন যেন ‘সং মাইসেলফ’এর পাঁজর চিড়ে বুলেটের মতো বেড়িয়ে পড়ে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’কবিতা। যেমন—
“I am satisfied,
I see, dance, laugh, sing”
নজরুলের রূপান্তরের কক্ষপথে আবর্তিত হতে হতে তা হয়েছে-
“আমি নৃত্য পাগল ছন্দ
আমি আপনার তালে নেচে যাই
আমি মুক্ত জীবনানন্দ”
অথবা
“I pass death with the dying and Birth with the new wash’d babe”
নজরুলের ভাষাকে ধারণ করে সঞ্চার করেছে নতুন প্রাণশক্তি ও অবয়ব। যেমন—
“আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শশ্মান”
এ থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্বসাহিত্যের উপর নজরুলের জানাশোনা ও চর্চার পরিধি কতো ব্যাপক আর বিস্তৃত ছিলো। যদিও তিনি রবীন্দ্রনাথ অথবা জীবনানন্দের মতো মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চতর শিক্ষার বিভাসের জীয়নকাঠিতে জীবনকে ছোঁয়াতে পারেন নি। এখানেই তার আশ্চর্যময়তার দ্যূতি আমরা টের পাই। এটাকে চুরি বলা যায় না। প্রভাব বলা যায়। যে কেউই যে কারও দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। তবে তা নিজের মতো করে পথ ও প্রবাহ তৈরি করে—গতি ও গন্তব্য নির্ধারণ করে। নজরুল সেটা পেরেছিলেন বলেই তিনি দুখু থেকে নজরুল হয়েছিলেন—দ্রোহের কবি হয়েছিলেন। এ সম্বন্ধে সৈয়দ আলী আহসান তার ‘কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা’য় বলেছেন—
হুইটম্যানের প্রভাব নজরুল ইসলামের উপর অত্যন্ত বেশি স্পষ্ট, দীপ্ত ও প্রত্যক্ষ। বিদ্রোহ, বিপ্লব ও যৌবনের আবেগে যেখানে তাঁর কাব্যের উপপাদ্য হয়েছে, সেখানেই তিনি হুইটম্যান-কে অনুসরণ করেছেন নিঃসঙ্কোচে। এ অনুসরণের মধ্যে গ্লানির কিছু নেই, কেননা এখানে ভাবগত একাত্মতা বোঝায়।
১৭৭৭ সালে মুদ্রণযন্ত্র আবিস্কার হলেও এ অঞ্চলের মানুষ ১৮১৫ সালের আগে বাংলা মুদ্রণযন্ত্রের সঙ্গে কখনোই পরিচিত হবার তেমন কোনো সুযোগ পায় নি। যদিও ইতিহাসে বাংলাভাষায় কোরআনের প্রথম অনুবাদক কে—এই নিয়ে মতবিরোধ, দ্বিধা আর ঘোর-সন্দেহ রয়েছে, তবুও আমরা ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনকেই ধরে নিই বাংলাভাষায় কোরআনের প্রথম অনুবাদক। তিনি মোট বার খণ্ডে কোরআন বাংলাভাষায় অনুবাদ করেন। ১৮৮১ সালের ১২ ডিসেম্বর কোরআনের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। প্রথম খণ্ড প্রকাশের পর ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন অনুবাদকের নাম গোপন রাখেন। কারণ সে-সময় কাজটা অনেক প্রতিকূল্য ছিলো। মুসলিম সমাজে এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে—সে সম্বন্ধে তার কোনো ধারণাই ছিলো না। গ্রন্থটিতে কেবল প্রকাশক গিরিশ চন্দ্র সেন এবং মুদ্রক তারিণীচরণ বিশ্বাসের নাম ছিলো। ৩২ পৃষ্ঠার এই খণ্ডের মূল্য ছিলো মাত্র চার আনা। এভাবেই অযুত প্রতিকূলতার প্রবাহের ভেতরেই শুরু হয়েছিলো বাংলাভাষায় ধমনীতে কোরআন-অনুবাদের মতো মহৎ কর্মের নীরব-তরঙ্গধ্বনি।
ইসলামি সংস্কৃতির সৌন্দর্যের গর্ভাশয়ে বেড়ে উঠেন নজরুল। ১৯০৮ সালে মাত্র নয় বছর বয়সে যখন তিনি তার পিতা ফকির আহমেদকে হারালেন—তখন তাদের সংসার অভাবের অতলে ডুবতে থাকলো। বড় ভাই কিশোর সাহেবজান আসানসোলের এক কোলিয়ারিতে কাজ নিলে নজরুলও বসে থাকলেন না। গ্রামের যে মক্তব থেকে নিজে পাস করেছিলেন, সেখানেই মৌলবির পদে বহাল হলেন ছোট্ট নজরুল। মাইনে কম কিন্তু ছাত্রদের বাড়ি থেকে সিধেতে যে চাল, ডাল, কলা, মুলো জুটতো তা দিয়ে কোনরকমে দিন চলত তাদের। আসলে ওটাকে চলা বলে না। ফলে এগারো বছরের নজরুলকে মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিন অর্থাৎ আজান-প্রদানকারীর কাজটাও নিতে হলো। পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে নামাজ আদায় করা, রোজা রাখার মতো ইসলামি অনুশাসনসমূহ অনুশীলন করতেন নজরুল।
ছেলেবেলা থেকেই নজরুলের লেখাপড়ার মাথাটা খুব পরিষ্কার ছিলো। তাঁর প্রথম গুরু পিতা ফকির আহমেদ। তাঁর কাছে ভাষাশিক্ষার প্রথম পাঠ অক্ষরজ্ঞান পরিচয় হলো নজরুলের। ভর্তি হলেন পাঠশালায়। সেখানে দ্বিতীয় গুরু কাজী ফজলে আহমেদ। তিনি আরবি, ফারসি, উর্দু আর বাংলা-এই চার ভাষাতেই দক্ষ ছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই নজরুল প্রথম আরবির তালিম নেন এবং মক্তবের পাঠ শেষ করতে করতে তিনি অত্যন্ত সাবলীলভাবে কোরআন শরিফ পাঠ করতে শিখে যান। ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে এভাবেই ছেলেবেলা থেকে তাঁর পরিচয় গাঢ় হয়ে ওঠছিলো। এমনই ছিলো সে পরিচয় যে, পিতার মৃত্যুর পর ওই ছোট্ট কিশোরকে মসজিদের ইমামের পদে চাকরি দিতে দ্বিধা করেননি গ্রামবাসীরা। সেই কৈশোরে এমন পরিণত ভাবনা আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলো যে, তিনি অন্যদের থেকে আলাদা—ইঙ্গিত দিচ্ছিলো যে, ভিন্ন কিছু মহৎ সৃজনের।
নজরুলের এক দূরসম্পর্কের কাকা ছিলেন—নাম মুন্সি বজলে করিম। তাঁর কাছ থেকে কোরআন-হাদিসের পাঠ নিতে শুরু করলেন কিশোর নজরুল। শুধু তাই নয়, ইসলামি অনুশাসননির্ভর ধর্মকেন্দ্রিক গানও রচনা করতে শুরু করলেন তিনি। এই সময়কার কথা বলতে গিয়ে নজরুল-গবেষক ইন্দ্রজিৎ রায় লিখেছেন—
“কিশোর আচার্য নজরুলের সে জীবন তখন মোল্লা প্রভাবান্বিত জীবন। বয়সে নবীন—একেবারে নেহাৎ কচি ও কাঁচা হলেও তাঁর উপর যে কাজের ভার চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তা কচি-কাঁচাদের উপযুক্ত নয়। মসজিদের মাননীয় ইমাম তিনি; তাঁর অধীনে বহুলোক নামাজ পড়েন, খুৎবা (ধর্ম উপদেশ) শোনেন; আসরে আসরে দুলে দুলে সুর করে তাকে মিলাদ শরীফ পাঠ করতে হয়।”
অতএব চটুল গান নয়, তিনি লিখলেন—
“নামাজ পড়ো মিয়া, ওগো নামাজ পড়ো মিয়া,
সবার সাথে জমায়েতে মসজিদে গিয়া,
তাতে যে নেকি পাবে বেশি
পর সে হবে খেশি
থাকবে নাকো ঘৃণা, প্রেমে পূর্ণ হবে হিয়া।”
অতএব ইসলামী সংস্কৃতির সৌন্দর্যের গর্ভাশয়ে বেড়ে উঠা নজরুল কোরআনের অনুবাদ করবেন—সেটা একটা সহজাত ক্রিয়া ও স্বাভাবিক ঘটনা। আমরা এটাকে ধর্মীয় পরিমণ্ডলে আবদ্ধ না রেখে সাহিত্য ও শিল্পের সৌকর্ষে বিবেচনা করবো। সেখানে সাহিত্য হবে অবমুক্ত আর শিল্প ছড়াবে সুষমা অসার হৃদয়ের ভেতর।
নজরুল যখন কোরআন অনুবাদ করছিলেন ততদিনে এই ভারতীয় উপমহাদেশে অনেকের হাতেই তা প্রস্ফূটিত হয়ে চৌহদ্দিতে আতর ছড়াচ্ছিলো। তবু তিনি এই মহৎ কর্ম সাধনের জন্য মরিয়া হয়ে না উঠলেও একটু একটু করে নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন আর চিন্তাকে শাণ দিচ্ছিলেন। এই যে নীরব প্রস্তুতি আর শাণিত চিন্তার ঝিলিক থেকে সোনালি শস্যের মতো উৎপন্নতার নামই হচ্ছে কাব্যে আমপারা।
“শুরু করিলাম লয়ে নাম আল্লার,
করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।
সকলি বিশ্বের স্বামী আল্লাহ মহিমা,
করুণা কৃপার যার নাই নাই সীমা।
বিচার দিনের বিভু! কেবল তোমারি,
আরাধনা করি আর শক্তি ভিক্ষা করি।
সহজ-সরল পথে মোদের চালাও
যাদেরে বিলাও দয়া সে পথ দেখাও।
অভিশপ্ত আর পথ-ভ্রষ্ট যারা, প্রভু,
তাহাদের পথে যেন চালায়ো না কভু!”
(সুরা ফাতেহা)
সাধারণ মানুষ যখন কোরআনকে ভিনদেশি ভাষায় কেবল অজ্ঞের মতো পঠন, চুম্বন আর আমলের অন্তর্জালে আবদ্ধ করে রেখেছিলো, ঠিক তখনই তা থেকে মুক্তির স্ফূরণ হয়ে উঠে কাব্যে আমপারা। নজরুল জানতেন—কোরআন কেবল পাঠের জন্য নয়—জানার জন্য—বোঝার জন্য—আত্মশুদ্ধির পাশাপাশি কুসংস্কার ও সমূহ জড়াজীর্ণ আর শৃঙ্খল থেকে মুক্তির পরশপাথর—সৃজন ও জাগরণের আলোয় অন্ধকারকে পরাস্থ করে মানবজাতির কল্যাণ সাধন করা। নজরুলের ভাষায়—
“ইসলাম ধর্মের মূলমন্ত্র-পুঁজি ধনরত্ন মণি-মাণিক্য সবকিছু-কোর-আন মজীদের মণি-মঞ্জুষায় ভরা, তাও আবার আরবি ভাষার চাবি দেওয়া। আমরা-বাঙালি মুসলমানেরা-তা নিয়ে অন্ধ ভক্তিভরে কেবল নাড়াচাড়া করি। ঐ মঞ্জুষায় যে কোন মণিরত্নে ভরা, তার শুধু আভাসটুকু জানি। আজ যদি আমার চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তিগণ এই কোর-আন মজীদ, হাদিস, ফেকা প্রভৃতির বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন তা হলে বাঙালি মুসলমানের তথা বিশ্ব-মুসলিম সমাজের অশেষ কল্যাণ সাধন করবেন। অজ্ঞান-অন্ধকারের বিবরে পতিত বাঙালি মুসলমানদের তাঁরা বিশ্বের আলোক-অভিযানের সহযাত্রী করার সহায়তা করবেন।”
দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম কোরআনের শেষ পারা অনুবাদ করেন। তার অনূদিত গ্রন্থটির নাম কাব্যে আমপারা। ‘আম্মা’শব্দ দিয়ে এই পারা শুরু হয়েছে বলে আমপারা নামকরণ করা হয়েছে বলে নজরুল তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। মোট ৩৮টি সুরার অনুবাদ নিয়ে গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২৩ নভেম্বর, ১৯৩৩ সালে (অগ্রহায়ণ, ১৩৪০ বঙ্গাব্দ)।
“—সে জানিত না যাহা
মানুষেরে তিনি দেছেন শিক্ষা তাহা,
না, না, মানুষ সীমা লঙ্ঘন করিয়া যায়,
ধন-গৌরবে মত্ত যে ভাবে সে আপনায়।”
(সুরা আলক)
নজরুল তার কাব্যে আমপারা গ্রন্থটি অনুবাদ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ভূমিকায় লিখেছেন—
“আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সাধ ছিল পবিত্র ‘কোর-আন’শরীফের বাংলা পদ্যানুবাদ করা। সময় ও জ্ঞানের অভাবে এতদিন তা করে উঠতে পারিনি। বহু বৎসরের সাধনার পর খোদার অনুগ্রহে অন্তত পড়ে বুঝবার মতোও আরবি-ফারসি ভাষা আয়ত্ত করতে পেরেছি বলে নিজেকে ধন্য মনে করছি।”
কোরআন বাংলায় অনুবাদ করেন কোনো এক মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। কী সেই উদ্দেশ্য—ব্যবসায়—খ্যাতি নাকি ভিন্ন কোনো? ব্যবসায় বা খ্যাতি এরকম কোনো স্বার্থসিদ্ধি সাধনের জন্য তিনি কাব্যে আমপারা গ্রন্থটি অনুবাদ করেন নি। তার অনুবাদের উদ্দেশ্য ছিলো ভিন্ন। আর তা হলো মহৎ ও কল্যাণময়তা সাধনের উদ্দেশ্য।
এক.
কোরআনের মর্মার্থ বাঙালি মুসলিমদের মনের মর্মরে সহজে গেঁথে দেয়া।
দুই.
মাতৃভাষায় সহজে কোরআনকে কন্ঠস্থ ও আত্মস্থ করা।
আর কাব্যে কোরআন অনুবাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে কাব্যের মাধুর্যে আকৃষ্ট হয়ে বাঙালি মুসলমান কোরআন পড়তে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। নজরুলের ভাষায়—
“আমার বিশ্বাস, পবিত্র কোর-আন শরীফ যদি সরল বাংলা পদ্যে অনূদিত হয়, তা হলে তা অধিকাংশ মুসলমানই সহজে কণ্ঠস্থ করতে পারবেন-অনেক বালক-বালিকাও সমস্ত কোর-আন হয়তো মুখস্থ করে ফেলবে। এই উদ্দেশ্যেই আমি যতদূর সম্ভব সরল পদ্যে অনুবাদ করবার চেষ্টা করেছি।”
এখন প্রশ্ন হলো-কাব্যে আমপারা অনুবাদে তিনি কতোখানি সফল হয়েছেন?—এই প্রশ্নের উত্তর প্রবন্ধের শুরুতেই দিয়েছি। যিনি হুইটম্যানকে আজীবন অনুসরণ করছেন—তার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সাহিত্যের মতো কণ্টকাকীর্ণ পথে আজন্ম হেঁটেছেন—নিঃসন্দেহে তার অনুবাদ নিয়ে এ ধরনের প্রশ্ন করবার কোনো যৌক্তিকতার অবকাশ থাকে না। এক কথায় বলা যায় যে, নজরুল কাব্যে আমপারা অনুবাদে ছিলেন একনিষ্ঠ, অদ্বিতীয় ও সফল।
তার অনুবাদ পড়লে আমাদের কাছে কোনো দুর্বোধ্য বা নিরস মনে হয় না। মনে হয় না কোনো ভিনদেশি ভাষার ভাষান্তর পড়ছি। মনে হয় যেন কোনো উচু দরের সাহিত্য পড়ছি যা রচিত হয়েছে বাংলাভাষী কোনো এক স্বনামধন্য কবির হাতে। যেমন—
“শুরু করিলাম লয়ে নাম আল্লার,
করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।
বলো, আমি শরণ যাচি উষা-পতির,
হাত হতে তার—সৃষ্টিতে যা আছে ক্ষতির।
আঁধার-ঘন নিশীথ রাতের ভয় অপকার—
এসব হতে অভয় শরণ যাচি তাঁহার!
জাদুর ফুঁয়ে শিথিল করে (কঠিন সাধন)
সংকল্পের বাঁধন, যাচি তার নিবারণ।
ঈর্ষাতুরের বিদ্ধেষ যে ক্ষতি করে।
শরণ যাচি, পানাহ্ মাগি তাহার তরে।”
(সুরা ফলক)
তিনি ভাষা নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখিয়েছেন যেমন মুন্সিয়ানা—তেমন তাতে ছিলো নিখাদ শিল্পের বার্নিশ। প্রতিটা শব্দ ছিলো সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল। কোনো দুর্বোধ্যতার দূরহ রোগে আমাদের ভুগতে হয় না। অল্প শিক্ষিত মানুষেরাও অকপটে এটি পড়ে ফেলতে পারেন। নিমিষেই এর মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারেন। আর সেই অনুধাবনের অবগাহন থেকে কিছু না কিছ মণি-মাণিক্য অর্জন করতে পারেন। এ সম্বন্ধে নজরুলের স্বগতোক্তি হলো—
“মক্তব-মাদ্রাসা স্কুল-পাঠশালার ছেলে-মেয়েদের এবং স্বল্প-শিক্ষিত সাধারণের বোধগম্য ভাষাতেই আমি অনুবাদ করতে চেষ্টা করেছি। যদি আমার এই দিক দিয়ে এই প্রথম প্রচেষ্টাকে পাঠকবর্গ সাদরে গ্রহণ করেন—আমার সকল শ্রম সার্থক হল মনে করব।”
গ্রন্থটির অনুবাদের কোয়ালিটিতে কোনো প্রকার ঘাটতি রাখেন নি নজরুল। তিনি কোরআনের মূল ভাব ও বিষয় অক্ষত রেখে সরাসরি আরবি ও ফারসি থেকে অনুবাদ করেছেন। তার অনুবাদে কোনো তাড়াহুড়া ছিলো না। তিনি খুব ধীর গতিতে এবং দেখেশুনে—বুঝেসুঝে অনুবাদ করেছেন। এটাকে বলা যায় ভাবগত ও আক্ষরিকতা মিলেমিশে শঙ্কর অনুবাদ। নজরুল চাইলে রুবাইয়াত ই ওমর খৈয়াম এর মতো কেবল ভাবগত অনুবাদ করতে পারতেন কিন্তু তা তিনি করেন নি—কারণ কোরআন মুসলমানদের একটা সেনসেটিভ বিষয়। একটু হেরফের হলে ভয়াবহ কিছু ঘটে যেতে পারে। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাবলি এড়াতেই হয়তো নজরুল এই শঙ্কর অনুবাদের মতো মিশ্র পথ বেছে নিয়েছিলেন। তার অনুবাদ সম্বন্ধে নজরুল ইন্সস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মোঃ এরশাদ হোসেন বলেছেন—
“কাব্য আম-পারা’ গ্রন্থটি পবিত্র কোরআনের ত্রিশ সংখ্যক পারা-র অনুবাদ। এ অনুবাদ গ্রন্থের কাজ করতে গিয়ে নজরুল আরবি ভাষায় বিস্তর বুৎপত্তি অর্জনের চেষ্টা করেন এবং বিভিন্ন কোরআন অনুবাদকের অনুবাদ-কর্মে মনোনিবেশ করতে আগ্রহী হন। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় অগ্রহায়ণ ১৩৪০ সালে (২৩ নভেম্বর ১৯৩৩ সালে)। সর্বমোট আটত্রিশটি সুরার অনুবাদ এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। মূলভাবকে অক্ষত রেখে নির্ভুল অবয়বে সুষম অর্থবহ অনুবাদে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। গ্রন্থের শেষে ‘শানে নুযুল’ অংশে সুরা সমূহের পরিচয় প্রদান পূর্বক যে টীকা উল্লেখ করেছেন তাতে আরবি ভাষায় বিস্তর জ্ঞান, হাদিস বিষয়ে বুৎপত্তি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতার অসাধারণ পরিচয় পাওয়া যায়।”
নজরুল যেমন ভাষাগত বৈচিত্র্য অক্ষুণ্নতা অটুট রেখেছিলো—তেমন ছন্দ প্রকরণেও ছিলো ভিন্নতা। তিনি গদ্য বা মুক্ত ছন্দ পরিহার করে কতোগুলো পয়ার রচনা করেছিলেন। কোথাও ছিলো অক্ষরবৃত্ত ছন্দের সুষমা—কোথাওবা মাত্রাবৃত্তের মসৃণ গতি ও গন্ধ। যেমন—
“শুরু করিলাম শুভ নামে সে আল্লার
করুণা-নিধান যিনি কৃপা পারাবার।
দেখ নাই, তব প্রভু কেমন (দুর্গতি),
করিলেন সেই গজ-বাহিনীর প্রতি?
(দেখ নাই, তব প্রভু) করেন নি কিরে,
বিফল তাদের সেই দুরভিসন্ধিরে?
পাঠালেন দলে দলে সেথা পক্ষী আর,
করিতে লাগিল তারা প্রস্তর প্রহার
গজপতিদেরে। তিনি তাদেরে তখন
করিলেন ভক্ষিত সে তৃণের মতন।”
(সুরা ফিল : অক্ষরবৃত্ত)
অথবা
“অধিক লোভের বাসনা রেখেছে তোমাদেরে মোহ-ঘোরে
যাবৎ না দেখো তোমরা গোরস্থানের আঁধার গোরে।
না, না, না, তোমরা শীঘ্র জানিবে পুনরায় (কহি) ত্বরা
জ্ঞাত হবে; না, না, হতে যদি জ্ঞানী ধ্রুব সে জ্ঞানেতে ভরা।”
(সুরা : তাকাসুর : মাত্রাবৃত্ত)
ছালেছ-ই কোরআন, মৌলানা এম ডি আলি’স কোরআন, তাফসিরে হুসায়নি, তাফসিরে বায়যাভি, তাফসিরে কাবিরি, তাফসিরে মৌলানা আবদুল হক দেহলভি, তাফসিরে জালালাইন এবং মৌলানা মুহাম্মদ আকরাম খান ও মৌলানা রুহুল আমীন সাহেবের আমপারা হতে সহায়তা নিয়েছেন। তিনি সুরাসমূহের কাব্যানুবাদ শেষ করার পর গ্রন্থের শেষে প্রতিটা সুরার শানে নুযুল উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে তাফসিরে আযিযি, তাফসিরে মাজহারি, তাফসিরে কবির, তাফসিরে কাশশাফ, তাফসিরে বায়যাভি ও তাফসিরে হক্কানিসহ হাদিস শরিফের অমর গ্রন্থ বুখারির মতো বিখ্যাত গ্রন্থসমূহের সূত্র উল্লেখ করেছেন।
কাব্যে আমপারা গ্রন্থটি রচনা ও অনুবাদের উৎসাহ যুগিয়েছিলেন প্রধানত মেসার্স করিম বখশ ব্রাদার্সের স্বত্ত্বাধিকারী মাওলানা আবদুর রহমান খান। এখানেই দাড়ি নয়, গ্রন্থ প্রকাশের সমুদয় অর্থের যোগানও দিয়েছিলেন এই উদার্য ব্যক্তিটি। এছাড়াও বিবিধ বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন তাঁরই ছেলে মৌলবি রেজাউর রহমান খান, মাওলানা মোহাম্মদ মোমতাজউদ্দিন ফখরোল, মাওলানা সৈয়দ আবদুর রশিদ (পাবনবী), ইসকান্দর গজনভী, মৌলবি কে এম হেলাল সাহেবসহ নাম না জানা আরও অনেকে। এই গ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বাংলার নায়েবে-নবী মৌলবি সাহেবানদের দস্ত মোবারকে।
শপথ রবি ও রবি কিরণের
যখন চন্দ্র চলে সে পিছনে তার
দিবস যখন করে সপ্রকাশ
রবিরে, রজনী অন্ধকার
যখন ছাইয়া ফেলে সে রবিরে;
নভ-নির্মাণ-কারী তাহার;
এই সে পৃথিবী স-বিস্তার;
আত্মা, সুচারু গঠন তার।
সেই আত্মার সৎ ও অসতের
দিয়াছি দিব্য জ্ঞান,
এই সকলের শপথ ইহারা
সকলে করিছে সাক্ষ্য দান—
আত্মশুদ্ধি হইল যার,
নিশ্চয় সার্থক জীবন,
আত্মায় কলুষিত করিল যে
চির-বঞ্চিত হলো সে জন।
(সুরা শামস)
উৎস : নজরুল রচনাবলী—পঞ্চম খণ্ড, কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা, নজরুলের কোরআন ও পুরাণচর্চা—স্মৃতিকণা চক্রবর্তী ও উইকিপিডিয়া।
তরুণ লেখক
জন্ম : ১৯৮৭ সাল, রংপুর।
প্রকাশিত বই দুইটা।
এক. ওকাবোকা তেলাপোকা (২০১৬) -শিশুতোষ
দুই. এলিয়েনের দেশ পেরিয়ে (২০১৭)-শিশুতোষ।