ইতিহাস

ইতিহাস

আকবর হোসেন

২৭ মার্চ, ২০২১ , ১২:৩৯ পূর্বাহ্ণ

মুগ্ধতা.কম

৩ এপ্রিল, ২০২০ , ৭:১৬ পূর্বাহ্ণ

দখিগঞ্জ শ্মশান গণহত্যা দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল, শনিবার। রংপুর জেলায় ঘটেছিল এক অকল্পনীয় হত্যাযজ্ঞ। হটাৎ করেই মধ্য রাতে দখিগঞ্জ শ্মশানের কাছে গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে আশপাশের মানুষের। ঠিক ২৫ মার্চের কালো রাত্রির মতোই। রংপুরবাসী কোন দিন কল্পনাও করতে পারেনি হাত পা বাঁধা অবস্থায় এমনভাবে বাঙ্গালীদের হত্যা করতে পারে পাক হানাদার বাহিনী। রংপুরের সর্বজন শ্রদ্ধেয় সবার প্রিয় জররেজ ভাই (শহীদ এ্যাডঃ ইয়াকুব মাহফুজ আলী, যিনি ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ রংপুর শহরের নবাবগঞ্জ বাজারে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন) সহ ১১ জন বাঙ্গালীকে দখিগঞ্জ শ্মশানে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় লাইন ধরে দাঁড় করে গুলি চালিয়ে হত্যা করে হায়েনার দল। গুলিবিদ্ধ এক জন আর একজনের উপরে ঢলে পরে। নিমিষেই ঝরে যায় তরতাজা প্রাণ।

সেই ধ্বংসযজ্ঞের সময় একজন অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। তিনি গুলিবর্ষণের সঙ্গে সঙ্গেই মাটিতে পড়ে যান এবং তার শরীরের ওপর অন্যরা পড়েছিল বলে তার পায়ে গুলি লাগে। এতে পাক বাহিনী ভাবে তিনি মারা গেছেন। কিছুক্ষণ মৃত আরও দশ জনের সাথে শুয়ে থেকে পাক বাহিনী ঐ এলাকা ত্যাগ করার পরে কোন ক্রমে ঐ এলাকা থেকে বেরিয়ে এসে অন্যদের সহযোগিতায় ভারতে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া সেই ব্যক্তি হচ্ছেন রংপুরের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব তাজহাটের দীনেশ চন্দ্র ভৌমিক। তিনি এলাকায় পরিচিতি ছিলেন মন্টু ডাক্তার নামে।

পরদিনই দখিগঞ্জ শ্মশানের হত্যাযজ্ঞের ঘটনা রংপুরের মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এ খবর মুহূর্তের মধ্যে সারা জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। শত শত মানুষ ছুটে আসে শ্মশানের দিকে নিহতদের এক নজর দেখতে। ঐদিন থেকেই রংপুরের পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাঁচতে মানুষ পালাতে শুরু করে শহর ছেড়ে গ্রামে। গ্রাম ছেড়ে আরো নিরাপদ দূরত্বে সীমান্তের ওপারের দেশ ভারতে।

সে রাতে দখিগঞ্জ শ্মশানে সৈন্যদের হাতে যারা শহীদ হন তারা হলেন –

১) শহীদ এ্যাডঃ ইয়াকুব মাহফুজ আলী (জররেজ)। সকলের প্রিয় জররেজ ভাই। ২) মোহাম্মদ মহরম ৩) শ্রী গোপাল চন্দ্র, ৪) উত্তম কুমার অধিকারী ৫)দুলাল মিয়া ৬) রফিক আলী ৭) সতীশ হাওলাদার ৮) দুর্গা দাস অধিকারী ও আরো দু’জন যাদের নাম পাওয়া যায়নি।

আজো কালের সাক্ষী হয়ে আছে রংপুরের দখিগঞ্জ শ্মশান বধ্যভূমি। বেশ কয়েক বছর আগে ঐ এলাকায় শহীদদের নাম লেখা একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছিল। অতি সম্প্রতি এখানে একটি দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়েছে। এছাড়া রংপুরের অন্যতম প্রধান এই বধ্যভূমি সংরক্ষণ করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ডিসেম্বর এলেই ফুল পড়ে শহীদদের স্মরণে। কিন্তু আজ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। রংপুরের গনমানুষের দাবী দখিগঞ্জ শ্মশান বধ্যভূমিসহ জেলার প্রতিটি বধ্যভূমিতে একটি করে কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হোক। সরকারীভাবে এখনই উদ্যোগ না নেয়া হলে হয়তো আগামী প্রজন্ম জানতেই পারবে না এখানে কেমন পৈশাচিকতার শিকার হয়েছিলেন তাদের পূর্বসূরি নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ।

আজকের এই দিনে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি দখিগঞ্জ বধ্যভূমির সকল শহীদদের।

দখিগঞ্জ শ্মশান গণহত্যা দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

রিয়াদ আনোয়ার শুভ

২৪ মার্চ, ২০২০ , ৫:০০ পূর্বাহ্ণ

২৪ মার্চ, ১৯৭১ পাক সেনা অফিসার হত্যার মধ্য দিয়ে রংপুরবাসীর মুক্তিযুদ্ধ শুরু

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করেন ৭১’র ২৬ মার্চ, আর পাকিস্তান সেনা বাহিনীর ট্যাংক ডিভিশনের পাঞ্জাবী সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আব্বাসীসহ তিন জন জওয়ানকে হত্যার মধ্য দিয়ে তার দুই দিন আগে ২৪ মার্চই স্বাধীনতার যুদ্ধ আরম্ভ করে রংপুর জেলার সাবেক সাতগাড়া ইউনিয়নের (এখন সিটি কর্পোরেশনে) দামোদরপুরের সাধারণ, অনাহারী, জীর্ণশীর্ণ মানুষ। রচিত হয় ইতিহাস। এক গর্বের ইতিহাস।

তাই ২৪ মার্চ শুধু রংপুর নয়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন ‘‘ভাতে মারবো, পানিতে মারবো’’। সেই কথাই যেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে রংপুরের বীর জনতা। সেনানিবাসে সকল প্রকার খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে সেনানিবাসে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। বাধ্য হয়ে ২৪ মার্চ সেনাবাহিনীর একটি জীপ সেনানিবাসের পশ্চিম দিকে দিয়ে বের হয়ে নিসবেতগঞ্জ হাটে উপস্থিত হয় খাদ্য (মুরগী ও ডিম) সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। সেনা সদস্যদের দেখে গ্রাম বাসী হতচকিত হয়ে যায়।

জানা যায় জীপের ড্রাইভার বাঙ্গালী। মুক্তির নেশায় মরিয়া হয়ে উঠেছে মানুষ, কয়েকজন সিদ্ধান্ত নেন আক্রমণের, চলতে থাকে প্রস্তুতি।

সেনা সদস্যদের দেখে যুবক শাহেদ আলী (পেশায় কসাই) সাইকেল চেপে আগেই নিজ গ্রামে চলে যান। দ্রুতই এই খবরটি ছড়িয়ে পরে সম্মানীপুর, দামোদরপুর, বড়বাড়ি, মনোহরপুর গ্রামের মানুষদের কাছে। শত শত গ্রামবাসী দা, বল্লম, কুড়াল, বটি, খুন্তিসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বাঁশের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে জীপের জন্য।

অবশেষে জীপটি যখন দামোদরপুর বড় ময়দান এলাকায় আসে তখন যুবক শাহেদ আলী এগিয়ে যান এবং জানতে চান তাদের গ্রামের আসার কারণ। গাড়িতে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর ট্যাংক ডিভিশনের পাঞ্জাবী লেফটেন্যান্ট আব্বাসীসহ এলএমজি হাতে তিন জওয়ান। এর মধ্যেই বাদশা, সালাম, রফিকুলসহ তিন চার জন গাড়ির কাছে চলে এসেছে।

পাক সেনারা কিছু বুঝে উঠার আগেই শাহেদ আলী জিপের বনেটে উঠে যান এবং এক টানে ছিনিয়ে নেন এলএমজি। ঘটনা এতো দ্রুত ঘটেছিল যে লেঃ আব্বাসী হতভম্ব হয়ে যায়। এই সুযোগে শাহেদ আলী খাপ্পর (বল্লম টাইপের) দিয়ে আব্বাসীকে আঘাত করলে সে লুটিয়ে পরে। অপরদিকে বাদশা, সালাম, রফিকুল তাদের হাতে থাকা দা, কুড়াল, বল্লম দিয়ে আঘাত হানে তিন সেনা সদস্যের উপরে। তিনজনই তখন মৃত্যু পথযাত্রী।

গাড়ি চালক বাঙ্গালী বিধায় সহযোগিতা করেছিল, তাই দায় মুক্তির জন্য তাঁকেও দা দিয়ে আঘাত করা হলো যেন সন্দেহ না করতে পারে। আহত বাঙ্গালী ড্রাইভার নিসবেতগঞ্জ পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে আনেন।

ইতোমধ্যেই খবর পৌঁছে যায় ক্যান্টনমেন্টে। আহতদের সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু জনতা হাসপাতালে পাক সেনাদের চিকিৎসার বিরোধিতা করলে ভীত সন্ত্রস্ত পাক সেনারা গুলি চালায়। তাদের গুলিতে পৌর বাজার (বর্তমান সিটি বাজার) এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন আব্দুর রাজ্জাক নামের একজন। এই ঘটনায় আবারও উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়।

শহীদ আব্দুর রাজ্জাকের সমাধি রয়েছেন নগরীর হনুমান তলা কাজী নজরুল ইসলাম সরণীতে।

এদিকে সেনা সদস্য হত্যার ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে সেদিনই বিকাল বিকাল চারটার দিকে নগরীর গনেশপুর এলাকাকে ঘটনাস্থল ভেবে পুরো এলাকা জ্বালিয়ে দেয় পাক হানাদারেরা। এর ঠিক চারদিন পরেই ২৮ মার্চ সাধারণ জনগণ তীর-ধনুক, বাঁশের লাঠি, দা, কুড়াল নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে আক্রমণ করে। সবার মুখে ছিল গগনবিদারী স্লোগান ‘‘এস ভাই অস্ত্র ধর, ক্যান্টনমেন্ট দখল কর’’।

 

রিয়াদ আনোয়ার শুভ
ইতিহাস গবেষক, রংপুর

 

মুক্তিযুদ্ধে রংপুর: ২৪ মার্চ, ১৯৭১ পাক সেনা অফিসার হত্যার মধ্য দিয়ে রংপুরবাসীর মুক্তিযুদ্ধ শুরু