ভয়ভুজঙ্গম
ভয়ভুজঙ্গম যেন মাকড়াসা-জালের মতো বিস্তর ছড়িয়ে আঁকড়ে ধরেছে আমাদের সমূহ যাপন-প্রণালি।
থমকে যাওয়া চাকার মতো সমূহ ঘূর্ণন যেন স্থবির হয়ে পড়েছে নেহাৎ কয়েক মাসের ব্যবধানে। কোনো এক অযাচিত অবরুদ্ধ খাঁচার ভেতর অসহায় প্রাণির মতো স্বপ্ন ও সৌন্দর্য অদ্যাবধি অন্তরীণ। প্রতিটা পা ফেলে পদে পদে বিপদ বিছানো পথে এগুতে হয় সতর্ক যোদ্ধার মতো।
এরকমই এক ভয়দ অন্ধকার-বিবরে গলে গলে পড়ছে রমজানের ম্যাচুউরড চাঁদ। কয়েকদিন পরে এই চাঁদের সাম্পানেই চড়ে আসবে রোজার ঈদ।
ঈদ এলেই এই কাচ ও কংক্রিটের ওজনশীল ঢাকাই নগরে আমার মতো মধ্যবিত্ত নাগরিকদের ছুটতে হয় রূপকথার পঙ্ক্ষিরাজ ঘোড়ার মতো। একটু লাগাম টেনে আস্তাবলে জিরাবার মতো ফুসরত থাকে না বলে মরিয়া হয়ে উঠতে হয় প্রতিটা পদক্ষেপ বাস্তবায়নে। পরিবার-পরিজনদের জন্য শপিং করা। দূরাত্মীয়দের ভালো-মন্দ খোঁজ নেয়া। বিকাশের মাধ্যমে বিশেষ অর্থ-সহায়তা পাঠানো। গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য সেহরি খেয়ে সুদীর্ঘ লাইনের ঠেস সামাল দিয়ে বাসের টিকিট কাটা। এছাড়া ছোটখাটো কতো কাজ তো রয়েছেই, সেসবের নাম নাইবা লিখলাম।
কিন্তু! হ্যাঁ, কেবল একটা কিন্তু এসবকে আরও দুঃস্বপ্নের দ্রবণে দূরহ ও দুস্কর করে তুলেছে— সেই কিন্তুটা হলো কোভিড-১৯ নামক ভয়ভুজঙ্গম।
এমনিতেই বৃদ্ধা মাকে নিয়ে ভয়দ নদী সাঁতরে পার হচ্ছি নিদানের দিনলিপি। তার উপর অফিসে চাকরিচ্যুত হবার আরেক নবোদয় ভয় ভয়দভাবে চেপে ধরেছে স্তব্ধতায় লুপ্ত প্রায় স্বর ও শরীর। মেরুদণ্ডের মেরুতে কষাঘাতের মতো দেগে ধরা কদর্য কোভিডে সরকারিভাবে ঘোষিত সাধারণ ছুটি শেষ হতে না হতেই আমাদের অফিসের দরজা খুলে গেছে। নামমাত্র স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিবিধ ভয়ের সুঁড়ঙ্গ হেঁটে হেঁটেই খুঁজে নিতে হচ্ছে অফিসের গলি ও গন্তব্য। রেডিমেড পোশাকের মতো মুখে হাসির ক্রিম মেখে অফিসের অসমাপ্ত কাজসমূহ সম্পন্ন করতে হচ্ছে। এর উপর একটার পর একটা রিপোর্ট দিতে হচ্ছে। একটু বিলম্ব হলেই অকথ্য কথনের যাতাকলে পিষ্ট হতে হচ্ছে। দম ফেলার মতো কোনো ফুসরত নেই। তার সঙ্গে জি-মেইলের ইনবক্সে অন্ধ অশ্বের মতো ছুটে আসা একটার পর একটা পরিপত্র যেন চাবুকের ঘায়ের মতো শপাশপ বসে যাচ্ছে ভয়ে কুঁজে যাওয়া ন্যুব্জ জীবনের পিঠে। শেষ ঘা-টা এসে পড়লো তখনই—যখন পরিপত্রের প্রতাপ থেকে ঘোষিত হলো—
এবার ঈদের ছুটিতে স্টেশন লিভ করা যাবে না। নিজ নিজ কর্ম-এলাকায় অবস্থান করতে হবে। যদি কেউ অজ্ঞাতভাবে দেশের বাড়ি বা অন্যত্র কোথাও ঈদ করতে যান—তাহলে তাকে বিনা নোটিশেই চাকরিচ্যুত করা হবে।
রেনেসাঁসের চাবুক থেকে কর্পোরেট বাক্স অব্দি এই যে পুঁজিবাদের পাপ ও পালকের প্রচার-প্রসারক কোনো এক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা—গভীরতার শরবত মিশিয়ে গাম্ভীর্য গলায় তিলাওয়াত ও তরজমা করে যাচ্ছিলেন সেই পাথুরে পরিপত্রের প্রতাপশীলতা। তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো—ফিলাডেলফিয়ার সেই অন্ধ রোমান বিচারপতি, যিনি বহু ঈশ্বরবাদ অস্বীকারকারী প্লুতুনিয়াসকে আগুনে পুড়িয়ে মারার মৃত্যুদণ্ড-রায় ঘোষণা করেছিলেন।
প্লাস্টিক যুগের চেয়ারে আসীনরত আমাদের মতো পুঁজিবাদের হুকুমত মেনে চলা ছা-পোষা অপারগ-আগাছারা কেবল পরস্পরের দিকে বিস্ময়ের বিষাদে তাকাই। আর একের পর এক পুস্পার্ঘ্যর মতো ইশারা বিনিময় মারফত নৈঃশব্দ্যের ময়দানে প্রতিবাদের অনুরণন তুলতে থাকি। কিন্তু প্রকাশ্যে এই প্রতিবাদের স্ফূরণকে উসকে দিতে পারি না আমাদের অপার অক্ষমতার বেড়ি থাকায়।
মায়ের জন্য কেনা নতুন কাপড়গুলো কুরিয়ার করতে না পেরে অনেক খারাপ লাগছে। সবচেয়ে খারাপ লাগছিলো—যখন মা বিরবির সিলাবলে বলছিলেন—তাহলে কি তোমাদের সঙ্গে আমার ঈদ করা হচ্ছে না! ভাইবোন ও সুহৃদের সমূহ মুখ ও মায়ার নহবত ভুলে শূন্যতার মর্মরি উঠে গহিন-গহনে। ভয়দ এইসব মেনে নিয়েই মনের পায়ে বেড়ি পড়িয়ে অফিস থেকে বাসায় ফিরি রোজকার মতো।
পরদিন যে ঈদ, তা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম, যদি না বাজারের ব্যাগ হাতে গুঁজিয়ে কল্পনা আমাকে সদাই কেনার তাগাদা না দিতো।
সামাজিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদের নামাজ পড়বার অনুমতি পেয়েছে উপাসক-শূন্য মসজিদগুলো। খুব জাঁকজমকভাবে না সাজলেও কোনোরকমভাবে তাড়াহুড়োর ভেতর সীমিত পরিসরে প্রস্তুত হয়েই মাইকিংয়ে আহ্বানের তরঙ্গ ছড়াচ্ছে রাত থেকেই। রাতে তাড়াহুড়ো ঘুমানোর সুবিধায় একেবারে প্রচলিত ঘড়ির কাঁটা ধরে সাতটায় ঘুম ভেঙে যায়। অবশ্য এর পেছনে রয়েছে মসজিদের মাইকগুলো আর কল্পনার কঠোর ভূমিকা। পাঁচ বছরের একমাত্র সন্তান রাগিবকে ডাকতে ডাকতে গলা ব্যথা হয়েছে। উপায়ন্তর না পেয়ে শেষমেষ হাল ছেড়ে দিয়ে বাথরুমে ঢুকে যাই। ঝর্ণাটা ছেড়ে দিয়ে জলের ফোয়ারার নিচে দাঁড়াই। সকালের শীতল জলে কোভিডে দগ্ধ শরীরটা সাময়িকভাবে ঠাণ্ডা অনুধাবন করি। ইচ্ছে করে আরও কিছুক্ষণ মনের মচকানো ডানাগুলো জলের জাফরানে মেলে ধরে থাকি। কিন্তু তা আর হয়ে উঠে না। আরে, আটটা তো বেজে গেলো। নামাজ শেষ হলে তোমার গোসল শেষ হবে নাকি! কল্পনার কঠোর জোরাজুরিতে বাথরুম থেকে বের হয়ে জায়নামাজটা হাতে নিয়ে মসজিদের পথে পা বাড়াই।
আল্লাহু আকবর—আল্লাহু আকবর—তকবির দিই আর হাঁটি। হাঁটি আর তকবির দিই। হাঁটতে হাঁটতে ভাই-ভাতিজাদের কথা মনে পড়ে যায়। এরকম তকবির দিতে দিতে আমরা সমবেতভাবে বায়তুল মামুর জামে মসজিদের ঈদগাহে ছুটে যেতাম। এক জায়নামাজে দাঁড়িয়ে জামাতের সঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করতাম। নামাজ শেষে কোনো এক এপ্রিলে—আমাদের জানালা বিদীর্ণ করে—শাদা মেঘের রেইনকোট পড়ে— অনন্তর অভিমুখে চলে যাওয়া বাবার গোর জিয়ারত করতাম। কান্না ও করুণার জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যেতাম দোয়া-দরুদ জপতে জপতে।
মাইকের মুখ থেকে মুহুর্মুহু ভেসে আসছে অন্তিম আহ্বান—একটু পরেই জামাত শুরু হয়ে যাবে। পেছনের উজ্জ্বলতা মুছে সামনের কাচ-কুয়াশার অভিমুখে অগ্রসর হই।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে দীর্ঘ কাতারের সারিতে উপাসকদের উপস্থিত দেখে মনটা খুঁতখুঁতিয়ে ওঠে। অনেকেই স্বাস্থ্যমুখোশ না পড়ে এবাদতে এসেছে। এদের এড়িয়ে যেতে না যেতেই কয়েকজন ঘেঁষাঘেঁষি করে আমার ডানে-বাঁয়ে হাঁটুমুড়ে বসেন। একটু সড়ে দাঁড়ান বলতেই নামাজ শুরু হয়ে যায়। নামাজ শেষে হুজুরের খোৎবা আরম্ভ হলে মোনাজাতের জন্য নাতিদীর্ঘ অপেক্ষা করি।
খোৎবা শেষে হুজুরের বিশেষ বয়ানে অপেক্ষা আরও দীর্ঘ হয়। সেকেলে বয়ানের বিবরে মৃত্যুর ভয়ের ভয়দতা শুনে যেটুকু খুশিবোধ মনের মধ্যে সঞ্চয় করে নামাজ পড়তে এসেছিলাম, তার পালকও পলকের মধ্যে পলেস্তরার মতো খসে খসে নির্মমভাবে নিঃস্ব করে তোলে।
নিঃস্বতার নিকুঞ্জ নিয়ে বাসায় এলে স্ত্রী ও সন্তানের হাস্যোজ্জ্বলতার টুকরাটাকরা দেখে মলিন মুখটা বর্ষাদিনের সূর্যের মতো ঝলকে ওঠে। আগে থেকেই সাজিয়ে রাখা ব্রেকফাস্টের ট্রে থেকে মিষ্টান্নের বাটিটা হাতে তুলে দেয় ক্লান্ত কল্পনা। কয়েকদিন থেকে ও যে গতর খেটেছে, তা মিনিমাম এক মাসের ইকুয়েশন হবে। ঈদ আসার তিনদিন আগ থেকে আশপাশ পরিস্কার, ঘরদোর ন্যাপাক্যাচা, বেডশিট-মশারি ও অন্যান্য কাপড়চোপড় ওয়াশ করতে মাকে দেখতাম হাফপ্যান্টবেলায়।
এতক্ষণে হয়তো বাবার গোর জিয়ারত শেষে সকলে বাড়িতে ফিরে ঈদ-সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়েছে। ভিভো ব্রান্ডের ইন্ডিয়ান অ্যান্ড্রয়েড ফোনটা পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের ছোটকে কল দিলে অনুমানটা সত্যি হয়। একে একে ইমন, জিয়ন ও মায়ের সঙ্গে ফোনালাপ শেষে বুক ফসকে কোনো এক অস্থায়ী তৃপ্তির ঢেঁকুর উঠে হাওয়াই হয়ে যায়।
ঈদের দিনটাও ফুরিয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে ছাদের কার্নিশে নেমে আসছে অপ্রতিরোধ্য অন্ধকার। কাচ ও কংক্রিটের জানালা থেকে মুছে যাচ্ছে বিকেলের বিভা।
আমাদের মূর্ছা যাওয়া হাসির মতো মা’র কপালের কৃষ্ণচূড়া-টিপ সদৃশ রক্তাভ সূর্যটা পশ্চিমে গড়াতে গড়াতে মাগরিবের সিম্ফনি ভেসে আসে করুণ লিলাবলে। ভয়ভুজঙ্গম আরও ফোঁস ফোঁস করে ওঠে—যখন পুঁজিবাদ প্রলয়ঙ্কর হুঙ্কার তুলে বলে—
‘টিকা না আসা অব্দি কোভিডকে সঙ্গি করেই আমাদের বাঁচতে হবে’
জন্ম : ১৯৮৭ সাল, রংপুর।
প্রকাশিত বই দুইটা।
এক. ওকাবোকা তেলাপোকা (২০১৬) -শিশুতোষ
দুই. এলিয়েনের দেশ পেরিয়ে (২০১৭)-শিশুতোষ।