পর্ব – ৪
৭
ঠাকুরপ্রসাদ রায় যে বাড়িতে থাকেন তার তিন দিকে গাছ দিয়ে ঘেরা। ভোরে ওঠা অভ্যাস। ঘুম থেকে উঠে খড়ম পায়ে বাড়ির চারপাশটা ঘুরে দেখেন তারপর বাসায় এসে কুয়ার পানি দিয়ে স্নান সেরে নেন। গতকাল থেকে তার মনটা খারাপ। উনি যে আন্দোলন শুরু করতে যাচ্ছেন সেজন্য গান্ধীজির আশীর্বাদ কামনা করে চিঠি লিখেছিলেন। গান্ধীজি এই আন্দোলনের বিরোধিতা (more…)
১৯৪৬-৪৭ সালে সংঘটিত ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন রংপুর দিনাজপুর অঞ্চলে প্রচণ্ড দানা বেঁধে উঠেছিল। এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেই লিখিত হয়েছে এই উপন্যাস। গল্পের ছলে এই কাহিনী আমাদের নিয়ে যাবে এমন এক অধ্যায়ে যেখানে ধানের জন্য, খাবারের জন্য আমাদের পূর্বপুরুষেরা অবতীর্ণ হয়েছিলেন এক অসম যুদ্ধে। পর্যায়ক্রমে (more…)
(পর্ব-৮)
অনেকক্ষণ আগেই বাড়িতে আলো জ্বেলে উঠেছে। এ সময় কত কী কাজ আছে, সকলেই কিছু না কিছুতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রান্নাঘর সামলাতে যায় মা, রাতুলকে পড়াতে বসায় রাত্রি। রাত্রি দূর থেক্ েচিৎকার করে বললো, বাবা, তারুলের পড়ার সময় হয়ে গেছে।
ওই লোকটি, অবাঞ্চিত একটা লোক হয়ে গেছে যে শ্রাবণ, কিছুকাল আগেও এ বাড়িতে এলে জামাই আদর পাক বা না পাক, একটা সৌজন্য দেখাতে কেউ কার্পণ্য করতো না। এখন হয়ে গেছে ্কটা বিব্রতকর শুঁয়োপোকা। ঝাটায় ডগায় তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারলেই যেন শান্তি। শুধু ওই লোকটার উপস্থিতির কারণে সারা বাড়িটাই স্থির হয়ে গেছে। স্থির করে দেওয়া ভিডিও ছবির মতন, চলে গেলেই আবার সচল হবে।
শ্রাবণ চলে যাবার সাথে সাথে রাতুল একটা ব্যাগ হাতে লাফাতে লাফাতে এল, বেশ খুশি। সঙ্গে সঙ্গে রাত্রির সমস্ত মন বিস্বাদ হয়ে গেল।
হাসি হাসি মুখে রাতুল বললো- কাকু কত কী দিয়ে গেল দেখ মা। ব্যাগ থেকে একটা ক্যাডবেরি বের করে বললো- কত বড় দেখ।
রাত্রির মুখ ততক্ষণে ক্রুদ্ধ কঠিন। ক্যাডবেরি আর ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে বললো, এসব আমি তোমাকে কিনে দেব, আমি কিনে দেবো।
প্রথম প্রথম এই ভুলটাই তো করতে বসেছিল রাত্রি। ভাবত, রাতুল শুধুই আমার। এত স্নেহ, মমতা ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করে তুলছে, সে তো শুধু আমার। আমাকে সেই ভালবাসা ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া তার যেন আর কোনো অস্তিত্ব না থাকে। তার ভবিষ্যৎ, তার ভালমন্দ বিচার, সবাই আমার দায়িত্ব।
অথচ শ্রাবণ এলেই কেমন খুশি হয়ে ওঠে রাতুল। বেশ খুশি খুশি ভাবেই একদিন বলেছিল, আজ কাকুর আসার দিন, না মা?
ওর ওই খুশি খুশি ভাব, মুখের হাসি বিষাক্ত তীর হয়ে এসে বিধত রাত্রির বুকে। ওর নিজের মুখটাই বিবর্ণ হয়ে যেত। ভিতরে ভিতরে ছেলের ওপর রেগে যেত। কী অকৃতজ্ঞ, কী অকৃতজ্ঞ। তোকে মানুষ করে তুলব, বড় করে তুলব বলেই এত কষ্ট সহ্য করছি। অথচ তুই….
সেই প্রথম দিন যখন শ্রাবণ এসে রাতুলকে একটা বড় ক্যাডবেরি, আর এক ব্যাগ কত কী উপহার দিয়ে গিয়েছিল, সেদিনই রাত্রি বুঝতে পেরেছিল কোন মানুষই শুধু একজনের সম্পত্তি নয়, হতে পারে না।
অথচ এই রাত্রিই একদিন রেগে গিয়ে বাবা-মাকে বলেছিল, আমি কি তোমাদের সম্পত্তি নাকি, যে যেমনটা চাইবে তেমনই করতে হবে। আমি কারো প্রপার্টি নই।
রাতুলের বেলায় ঠিক সেটাই করে বসেছিল। এখনো ভাবতে পারে না, রাতুল আর কাউকে এক আনা ভালোবাসাও দেবে। কারণ ওর মধ্যে এখন হারানোর ভয়টাই প্রবল।
আমি তোমাকে কালই একটা ক্যাডবেরি এনে দেবো। যা কিছু দিয়ে গেছে, কিছু ছুবি না তুই, আমি সব এনে দেব।
রাতুল সেদিন কিছুই বুঝতে পারেনি। বিভ্রান্তের মতন শুধু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছে। ওর চোখে জল এসেছিল কিনা তাও দেখেনি রাত্রি। ধীরে ধীরে সান্তনার স্বরে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছে, তুই তো কিছুই বুঝিস না, ও তোকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে এসেছিল।
কিন্তু ছিনিয়ে নেওয়ার অর্থটা রাতুল বুঝতেই পারল না। শুধু ওকে দেখে মনে হয়েছিল একটা উল্লাস আর ফুর্তির মুখে কে যেন একটা প্রকান্ড চড় কষিয়ে দিয়েছে। রাত্রি কেন যে ওর আনন্দটুকু নষ্ট করে দিতে চায় তা কেমন করে বোঝাবে রাতুলকে। শুধুই হারাবার ভয়? নাকি রাতুল আর একজনকে, যাকে ও চায় না, পছন্দ করে না, তাকে একটু ভালবাসা দিয়ে দেবে সেই আশা।
রাতুল এক সময় নিরূপায় হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। রাত্রিই ঘুম পাড়ালো। জানালার বাইরে বাতাস লাগা নিম গাছ চামরের মতো দুলছে। শব্দটা যেন প্রকৃতির দীর্ঘশ্বাসের মতো। আজ রাতে রাত্রির পক্ষে ঘুমানো অসম্ভব। গাছের ডালে ভারি একটু কিছু এসে বসল। হয় প্যাঁচা না হয় বাদুর। রাতুল অকাতরে ঘুমাচ্ছে। রাত্রি এক ফাঁকে উঠে চোরের মতো পা টিপে টিপে অন্য ঘরে গেল। আজ তার মনটা ভীষণ খারাপ। নিলয়ের কথা বড্ড বেশি মনে পড়ছে। চার মাসের লড়াই শেষ।
রাত্রি পেছন ফিরে তাকাতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। দরজার সামনে রাতুল। বড় বড় চোখ। কপালের ওপর চুল। ফুলের মতো মুখ। রাত্রি তাড়াতাড়ি সামনে গিয়ে হাঁটুমুড়ে বসে পড়ল। রাতুল তাকিয়ে আছে, যেন স্বপ্ন দেখছে।
আমার বাবা কোথায়? নেই তো!
রাত্রি দু’হাতে রাতুলকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরল।
রাতুল আবার বলল, আমার বাবা কোথায়? নেই তো! গলা ধরে এসেছে। গলা দিয়ে করুণ চিৎকারের মতো একটা শব্দ বেরুলেঅ – ‘বাবা।’
রাত্রি, রাতুলকে কোলে নিয়ে বসে পড়ল ঘরের লাল মেঝেতে। কান্না এসে গলার কাছে দলা পাকাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে কথা বলা খুবই কঠিন কাজ; তবুও রাতুলের জন্য হাসতে হবে। রাত্রি ছেলেকে বুকে চেপে ধরে বলল, তোমার বাবা বাইরে গেছে। দেখবে এবার তোমার জন্য কতকিছু নিয়ে আসবে।
ধরা ধরা গলায় রাতুল বলল, পিংকু যে বলে আমার বাবা নেই বলে আমরা নানু বাসায় থাকি। বাবা এবার যাবার সময় আমাকে কিছু বলে যায়নি। তোমাকে কিছু বলেছে কি?
বলে গেছে, রাতুল যেন লক্ষ্মী হয়ে থাকে। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করে। রাতুল স্কুলে কেউ যদি তোমাকে তোমার বাবার কথা জিজ্ঞেস করে বলবে- বাবা অফিসের কাজে বাইরে গেছে।
রাত্রি উঠে যাবে বাবছিল, হঠাৎ রাতুল মুখের দিকে তাকিয়ে বলল- ‘আমার বাবা মারা গেছে তাই না!’
রাত্রি স্বম্ভিত হয়ে গেল। এত চেষ্টা সব ব্যর্থ! রাত্রি ঘুরিয়ে ছেলেকে প্রশ্ন করল- ‘মরে যাওয়া কাকে বলে তুমি জান বাপি?’
রাতুল ঠিক জানে না। এই তো কয়েক বছর হলো পৃথিবীতে এসেছে। শুনেছে মানুষ মরে যায়। চলে যাওয়াকেই কি মরে যাওয়া বলে! কাকে বলে মা?
রত্রি আবার বিপদে পড়ল। কি উত্তর দিবে এখন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল- ‘মানুষ মরে না বাপি। ্ক জায়গা থেকে আর একজায়গায় চলে যায়।’
রাতুল সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল, ‘তাহলে চলে যাওয়াকে মরে যাওয়া বলব?’
রাত্রি অবাক হয়ে গেল। এইটুকু ছেলে কি কথা! এখন কী বলব।
রাতুল আবার বলল- তাহলে তুমি দাদু বাসায় গেলে, বলব তুমি মরে গেছ।
রাত্রির আর কোন কথা বলার ক্ষমতা নেই। এ কী! এতো অসম্ভবব ছেলে, রাত্রি উত্তর হাতড়াতে লাগল।
রাতুল বলর, তাহলে সেদিন যে আমার বেড়ালটা মরে গেল, কই সে তো চলে গেল না। বারান্দায় পড়ে রইল। আমাদের রাস্তা দিয়ে যখন মানুষকে ঢেকে নিয়ে যায়, তোমরা বল লাশ যাচ্ছে। মরে গেলেই তো লাশ হয়। তুমি আমাকে মিথ্যা কথা বলছ কেন মা?
রাতুল রাত্রির কোলে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি সব জানি, আমি সব জানি। বাবা ওই বেড়ালটার মতো মরে গেছে। তুমি এতদিন আমাকে মিথ্যে কথা বলেছো।
তোমাকে এসব কথা কে বলেছে?
শ্রাবণ কাকু।
সন্ধেবেলায় নিজের ঘরেই ছিলো রাত্রি।
আট মাস এই বাড়ি, এই ঘরের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক ছিলো না। অবশ্য সেভাবে বললে- বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো না বলা যায় না, তবে ঘরের সঙ্গে ছিলো না। এতদিন পর ফিরে এসে নিজের ঘরটাকে তার নতুন বা অচেনা মনে হয়নি। ঘর তার ঠিকই আছে, যেমন ছিলো। ঘরতো উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। কাজেই যেমন ছিলো তেমনি আছে। আসবাবপত্রও সবই সেইরকম, যেখানে যা যা ছিলো তেমনই আছে। খাট, আলমারি, হাল্কা ছোট টেবিল, আয়না। ঘরে লোক না থাকলে, বসবাস না করলে যে কোথাও ময়লা বসবে, কোথাও ছাপ ছোপ পড়বে, ধুলোর দাগ বসবে – এতো স্বাভাবিক।
নিশি যতটুকু পারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছে; তবু ঘরটা জেগে ওঠেনি। মানে রাত্রির নিত্যদিনের স্পর্শ পেলে যেমন সজীব থাকার তেমন দেখাচ্ছে না। খানিকটা বাসী বাসী, ময়লা, অসাড় দেখাচ্ছিল।
নিলয় মারা যাবার পর, রাত্রি যখন এ বাসা থেকে চলে গেল, তারপর থেকে এই ঘরে যে কোনোদিন হাত পড়ত না, নজরে আনত না কেউ- তা নয়; তবে ওই মাঝেমধ্যে একবার ঝাটপাট দেওয়া, ধুলো ঝাড়া, জানালাগুলো খুলে দেওয়া- তার বেশি কিছু নয়।
সন্ধেবেলায় বাতি জ্বালাতে গিয়ে রাত্রি দেখল- দেওয়াল বাতির দুটোই খারাপ। বাল্ব নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পাখাটা অবশ্য সামান্য শব্দ করল বিরক্তির, তারপর চলতে লাগল। এসব নিয়ে ভাবল না রাত্রি। কাল পরশু তরশু- দিন পড়ে আছে; গুছিয়ে নেবে ধীরেসুস্থে।
বাইরের জানালা খোলা। ভেতরেরটা বন্ধ। দরজা খোলা। বাইরে অন্ধকার। বৃষ্টি নেই, বাদলা বাতাস রয়েছে। ঘরের একটা বাতি জোরালেঅ নয় জ্বলছে এই।
ভাবি?
রাত্রি পায়ের শব্দ পায়নি, ডাক শুনল। তাকাল।
নিশি।
এগিয়ে এল নিশি। াক, ফিরলে শেষ পর্যন্ত। সেই কবে গিয়েছো আর এই এলে। মাসের পর মাস যায় তোমার ফেরার নাম নেই। আমার তো মনে হয় তোমার কেসটা হলো- ফিরতে চাই না আমি পার্থিব সংসারে…।
(চলমান…)
(পর্ব-৭)
ইরাও সায় দিয়েছিল
আদর বাড়ে। আদর। শব্দটা উচ্চারণেই কি যেন অর্থ ছিল। রাত্রি তখন শুধুই হেসেছে। কিন্তু এত কিছু মাথায় আসার পরও একটা কথার অর্থ সে কিছুতেই বের করতে পারছে না। কেন তার শ্বশুর শাশুড়িকে ওই কথাটা বলল- রাত্রিকে এখন কিছু বলো না।
রাত্রি কথাটা শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওর বুকের মধ্যে একটা ভারি পাথর। ‘এখন রাত্রিকে কিছু বলো না। তড়তড় করে সিড়ি দিয়ে নেমে এল রাত্রি, শাশুড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল, ডাকলো- মা
হ্যাঁ।
শুধু একটা শব্দ। কিন্তু তার চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল রাত্রি। মনে হল যেন দৃষ্টি কেমন উ™£ান্ত। আর চোখের আড়ালে মনে হয় কান্না থমকে আছে। এক্ষুণি চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসবে।
একদিন একবারও আয়নার দিকে তাকায়নি রাত্রি। কারো দিকেই তাকায়নি। এমন কি নিজের দিকেও নয়। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেছে দিনগুলো। এই প্রথম এসে দাঁড়াল আয়নার সামনে। সঙ্গে সঙ্গে যেন বুকের ভেতরটা চমকে উঠলো।
এ কে? একে তো রাত্রি চেনে না, কখনো দেখেনি। সম্পূর্ণ একজন অচেনা মানুষ যেন ওর চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। নিজেকে াহরিয়ে ফেলার জন্য হাহাকার।
একদিন ওর শুধুই মনে হচ্ছিল ওর সব কিছু হারিয়ে গেছে। কিন্তু সে ভাবনা কেমন অস্পষ্ট। এক এক সময় বিশ্বাসই হচ্ছিল না। যেন দুঃস্বপ্ন দেখছে, এখনি ঘুম ভেঙে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেরে হেসে উঠবে।
কিন্তু আয়নায় নিজেকে দেখে ওর চোখ ঠেলে জল এল।
এ কাকে দেখছে ও? সর্বাঙ্গে একটা সাদা কাপড়।
একটা দিনও নিছক একটা যন্ত্রের পুতুল হয়ে গিয়েছিল। যে যা বলেছে করে গেছে। কেউ এনে বসিয়ে দিয়ে গেলে বসেই থেকেছে। শুধু একটা অস্পষ্ট ধারণা, কি যেন চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে। কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়িয়েও চমকে উঠল। ওর মুখোমুখি যে দাঁড়িয়ে আছে তাকেও চেনে না, কোনদিন দেখেনি। তার মুখ প্রথম চোখে পড়েনি। শুধু একটা সাদা কাপড়। ক্রমশ তার মুখ স্পষ্ট হয়ে ফুঁটে উঠল। নিস্তেজ প্রাণহীন ধ্বসে পড়া জীবনের একটা মুখ। চোখের নীচে কালি, কপালের শূন্যতা। গলায় দুটি হাতে সর্বাঙ্গ জুড়ে শুধুই নিঃস্ব নিস্তব্ধতা।
ফুপিয়ে কেঁদে উঠল রাত্রি।
ওর কিছুই মনে পড়ছে না। ওকি নিজেই একে একে সব খুলে রেখেছে! নিজেই এই সাদা কাপড়খানা শরীরে জড়িয়েছে। কিছুই মনে পড়ে না। ওতো একটা যন্ত্রের পুতুল হয়ে গিয়েছিল।
না, একটু একটু করে মনে পড়ছে এখন।
এখন সমস্ত বাড়ি আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।
রাত্রির শুধু মনে পড়ছে সারা বাড়ি লোকজনে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। আর ঘরের মধ্যে দেয়ালৈ পিঠ দিয়ে মেঝেতে বসেছিল রাত্রি। ও চোখে কিছুই দেখছিল না, কানে কিছুই শুনছিল না। উঠে দাঁড়াতেও ওর কষ্ট হচ্ছিল। শরীরে কোন শক্তি নেই।
নিলয়ের বাবা বারান্দার ডেক চেয়ারে দু’হাতে চিবুক রেখে বসে আছেন গুম হয়ে। নিলয়ের মা লুটিয়ে পড়ে আছেন মেঝের উপর। মাঝে মাঝে ডুকরে কেঁদে উঠছেন। নিশির অবস্থাও একই রকম। তারপরও মাঝে মাঝে সান্তনা দিচ্ছে মা’কে, গায়ে মাথায় হাত বোলাচ্ছে। তমাল এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনের দিকে উ™£ান্তের মত তাকিয়ে ছিল রাত্রি।
আয়নার সামনে থেকে সরে এল রাত্রি। কেউ দেখতে পেলে কে কি বলে বসবে ও কিছুই জানে না। এখন ওর চারপাশ জুড়ে শুধু কি করতে আছে আর কি করতে নেই। এ ক’দিন ধরে ও শুধু একটা যন্ত্র হয়েগিয়েছিল। এখনও শুধুই একটা কর্তব্য।
ক্ষীণভাবে মনে পড়ছে গোসল করে এসে, ওর শরীরে তখন একটুও জোড় নেই, কার কাছে যেন একটা বিরুনি চাইলো। অভ্যাসবশেই হয়ত। হয়ত নিশির কাছে। সঙ্গে সঙ্গে কে যেন বলেছিল, চিরুনি নিতে নেই, আয়না দেখতে নেই।
ওই ঐটুকুই মনে আছে। কে বলেছিল তাও মনে নেই। ওর কাছে তখন বাড়ির সব মানুষগুলোই অর্থহীন।
এখন ওকে শুধুই কর্তব্য হতে হবে।
রাতুল! রাতুল কোথায় কে জানে। ওর গলার শব্দ শোনা যাচ্ছে না। সেই অনর্গল কথা বলে যাওয়া কবে থেকে যে থেমে গেছে রাত্রি জানেও না। হঠাৎ কেমন শান্ত হয়ে গেছে। কোনও প্রশ্নও করে না। হয়তো প্রশ্ন করে করে কোন উত্তর পায়নি বলে আপনা থেকেই থেমে গেছে। আত্মীয়স্বজন যারা এসেছিল, রাতুলকে হয়ত তারাই দেখেছে, গোসল করিয়েছে, খাইয়েছে।
শুধু একবার মনে পড়েছে ও এসে কোলের কাছে বসেছিল, চোখ মেলে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো, কাউকে কাঁদতে দেখলে ওর চোখেও জল আসত। কখনো শব্দ করে কেঁদে উঠত। কেন তা স্পষ্ট করে জানেও না। মৃত্যু কি তা তো ওর ধারণার বাইরে। চিরকালের জন্য ওর কি হারিয়ে গেছে তাও জানে না।
রাত্রি এ অবস্থাতেই বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কান্না দেখে ওর শুধু মনে হচ্ছিল, এই বৃদ্ধ মানুষটার বড় কষ্ট।
তুমি এসো না, এসো না, আমার সামনে।
শুনে আহত হয়ে দু’পা সরে এসেছিল রাত্রি। মনে হয়েছিল, বাবা ওকেই কেন দায়ী করছেন। কিন্তু তারপরই বলে উঠলেন, তোমার দুঃখ আমি দেখতে পারবো না। আর সঙ্গে সঙ্গে রাত্রির শরীরে মনে কি এক অ™ভুত ঠান্ডা প্রলেপ পড়ল। সারা শরীর জুড়িয়ে গেল।
মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে বললেন, তোমাকে জানাতে বারণ করেছিলাম। মিথ্যে ভয় পাবে মনে করে। একটু থামলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন- আমার জন্যই হল, কেন যে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তারপর বললেন- খবর শুনছিলাম, ভাল করে শুনিনি, কোথাও কি কিছুই না, শুধু কানে গেল একটা দুর্ঘটনার খবর। নিলয় যে ঐ বাসে আসবে আমি তাও জানতাম না। তবু কেন যে ভয় পেলাম। হয়তো সেজন্যই-
রাত্রি ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। পালিয়ে এসেছিল।
এখন সব একটু একটু করে মনে পড়ে যাচ্ছে।
নিশি এসে বলল, রাতুলকে খাইয়ে দিয়েছি, তুমিও খেয়ে নাও। আর রাতুলকে এবার একটু ঘুম পাড়াও।
রাতুল কিন্তু আগের মত রাত্রির পা জড়িয়ে ধরল না। শুধু ওর একটা হাত রাত্রির হাঁটু স্পর্শ করল। ও হয়ত ভাবছে মা দূরে সরে গেছে। সত্যিই তো ও দূরে সরে গিয়েছিল।
নিশির বুদ্ধি নয়, হয়ত মা শিখিয়ে দিয়েছে। রাত্রিকে আবার কাজের মধ্যে ভুলিয়ে দিতে চাইছে। রাতুলের মধ্যে।
এখন আর ওর সামনে কোন কাজ নেই, শুধু কর্তব্য। যা করা উচিত, যা সকলে চায়। এখন আর ওর নিজস্ব বলে কিছু নেই। ওর কোন ইচ্ছে এখন আর ইচ্ছে নয়।
রাত্রির ইচ্ছেও হয় না। এই কর্তব্যগুলোই ওর ইচ্ছে হয়ে গেছে। ও তো এখন একটা যন্ত্রের পুতুল হয়ে গিয়েছে। ও জানে এখন জীবন শুধু নেই। এত বিলাসীতার মাঝেও ওর মনটা এখন দুঃখবিলাসী। তাতে ওর কিছুই যায় আসে না, ওর এখন দুঃখটাই ইচ্ছে।
মানুষ মানুষে কিভাবে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, ভেঙে যায়, আবার কেনই বা অন্য কোনো সম্পর্ক তৈরি হতে শুরু করে তা কী কেউ জানে। কোনও মানুষই বোধহয় জানে না। অভ্যাস এক ধরনের নেশা। নিলয় মারা যাবার পর রাত্রি আর ও বাসায় থাকেনি, নিজের বাবার বাড়িতে চলে এসেছে। কিন্তু এখানে এসেও ও নিস্তার পাচ্ছে না, কারণ নিলয় মারা যাবার এখনও চার মাস হয়নি, এরই মধ্যে শ্রাবণ রাতুলের পিতৃত্ব দাবি করে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছে। আর কেউ না জানুক রাত্রি জানে এখানে শ্রাবণের জয় হবে। রাতুল যে শ্রাবণের ছেলে, একথা ও নিলয়কেও জানিয়েছিল।
এতদিন যত দুশ্চিনাতা ছিল ওর ওই রাতুলকে নিয়েই। বাবা ভরসা দিয়েছে, উকিল বাবুর আইনের কচকচি যতই ওকে নিশ্চিন্ত করার চেষ্টা করুক, মাঝে মাঝেই ভয় পেয়েছে কোটের বিচার শেষ অবধি শ্রাবণকেই রাত্রির কাছ থেকে রাতুলকে ছিনিয়ে নেবার অধিকার দেবে নাতো। ওর এই নিঃস্ব শূন্য জীবনে রাতুলই একমাত্র লক্ষ্য, একমাত্র আশ্রয়।
‘আফটার অল বাবা তো’ উকিল বাবুর কথাটা ওকে সচেতন করে দিলেও মনের গভীরে গিয়ে পৌঁছালো না। রাতুলের ওপর যে শ্রাবণের কোন অধিকার থাকতে পারে ওর মন তা স্বীকার করতেও রাজি নয়। আমার শরীরের মধ্যেই ও গড়ে উঠেছে, আমার যত্নে ভালবাসায়, কত বিন্দ্রি রাত আর উৎকণ্ঠায়। রাতুল আমার সন্তান, শুধু আমারই, এমন একটা বোধ ওর সমস্ত শরীর মন আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
একেবারেই যে জানতো না তাও নয়, আগেই অনেকের কাছে শুনেছিল। তবু কথাটা নতুন করে শুনল, আর সঙ্গে সঙ্গে ভেতরটা তিক্ততায় ভরে উঠল। এই লোকটা, যার সঙ্গে রাত্রি দীর্ঘদিন কাটিয়ে এসেছে, এক ছাদের নিচে, এক বিছানায়কথাটা এখন আর মনেও পড়ে না, ধুসর অস্পষ্ট বিবর্ণ একটা ছবি, ঝড়ে জলে ধুয়ে ধুয়ে যা মুছে গেছে, যে টিকে আছে শুধু এক অসীম ঘৃণা হয়ে। আর সেই লোকটাই কিনা মাঝে মাঝে রাতুলের সঙ্গে দেখা করতে আসবে। আইনের অধিকার নিয়ে।
নিলয় বেঁচে থাকতেও শ্রাবণ ও বাসাতে গিয়েছিল, কই তখন তো একবারও বলেনি আমার ছেলে, কিন্তু এখন কেন সে রাতুলকে তার ছেলে বলে পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখতে চাচ্ছে। নিলয় থাকতে ও যখন আসতো তখন তেমন অস্বস্তি হতো না, কিন্তু এখন, সঙ্কোচ, লজ্জা, অস্বস্তি মিলে অ™ভুত একটা জড়তা ওকে পেয়ে বসেছে। লোকটার সঙ্গে আবার মুখোমুখি হওয়ার মতো অস্বস্তি আর আছে নাকি। সেজন্য একটা আতঙ্ক ছিলো।
বাবা একদিন বলল- আজ শ্রাবণের আসার কথা, রাতুলের সঙ্গে দেখা করতে আসবে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তবু রাত্রি ভয় পেয়ে বসলো। ভয় না অস্বস্তি ও নিজেও বুঝতে পারলো না।
রাতুলকে নিয়ে গেল বাবা। শ্রাবণের কাছে রাতুলকে রেখেই বাবা ফিরে এল। এসে বললো- বসার ঘরে বাবা-বেটায় যত খুশি গল্প করুক।
রাত্রি সঙ্গে সঙ্গে বাবার মুখের দিকে তাকালো। বাবা যে নির্বোধের মতো এমন একটা কাজ করে বসবে তা ও ভাবতেও পারেনি। ওই রাতুলকে ঘিরেই ওর যত ভয়। এখন আর আমার জীবনে ওই রাতুল ছাড়া কে আছে কী আছে? চোখে মুখে উম্মার ভাব ফুটিয়ে বলল, রাতুলকে তুমি ওর কাছে ছেড়ে দিয়ে চলে এলে? কেন কাছে বসে থাকতে পারলে না।
আইনমাফিক বাবা ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, হয়ত একটু আদর করবে, দুটো কথা বলবে, সে সময় সেখানে আর একজন কি বসে থাকা ভালো দেখায়। কথাই তো বলবে, বলুক না যত খুশি। একটা বড় ব্যাগ এনেছে শ্রাবণ, হয়তো রাতুলের জন্যই। কিছু উপহার-টুপহার। যদি তার মন চায় দিক না।
রাত্রি দেখলো বাবা ওর কথা শুনে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছে। হেসে বললো- রাতুলকে নিয়ে তো পালিয়ে যাবে না।
একটা সহজ কথা বাবার মাথায় ঢোকেনি বলে ও বিস্মিত না হয়ে পারল না।
বলে উঠল, রাতুলকে একা ছেড়ে দিয়ে এলে ওর কাছে, একা পেয়ে কি মন্তর পড়াবে তুমি জানো। সব কিছুর মধ্যে আতঙ্ক তো ওই একটাই। মাঝে মাঝে দেখা করতে আসবে শুনে সেজন্যই ভয় পেয়েছিল। মাকে ছেড়ে থাকার কথারাতুল ভাবতেই পারে না। বরং বাবার প্রতি ওর টান কম। কেন থাকবে সেই ভালোবাসা। নিলয় কি কোনো দিনও ওকে সেই ভালোবাসা দিতে পেরেছে, যা শ্রাবণ দিতে পারতো। কিংবা শ্রাবণও কি পারতো না…
কিন্তু কে জানে, এখন যদি ছেলের ওপর বেশি বেশি ভালোবাসা দেখাতে শুরু করে। ওই বয়েস তো শুধুই ভালোবাসা চায়, আদর পেলেই সেটাকে ভালোবাসা ভেবে বসে। আর সে ব্যাপারে শ্রাবণ কম দক্ষ নয়। রাতুলের কথা কি বলবে, রাত্রি নিজেই কি ওর ভালোবাসাকে চিনতে পেরেছিল? ওর তো সবটাই শুধু অভিনয়।
রাত্রির ভয়, শুধু ওকে জব্দ করার জন্যই হয়ত দেখা করতে আসার নামে একটু একটু করে মায়ের বিরুদ্ধে রাতুলের মন বিষিয়ে দিতে চাইবে শ্রাবণ। ওইটুকু বাচ্চা ছেলে, ও কিবা বোঝে, কি বা জানে। ভয় সেজন্যই। রাত্রি বাবার হাত ধর তুলে বললো, তুমি যাও, তুমি যাও। ওদের কাছে বসো গিয়ে।
রাতুল শ্রাবণের সঙ্গে বসে গল্প করছে, মাঝে মাঝে শব্দ করে হেসে উঠছে। হাসির কথাটা কী তা রাত্রির কাছে পৌঁছাচ্ছিল না।
শ্রাবণের উপস্থিতিটুকু ওর কাছে বিরক্তিকর মনে হচ্ছিল, চলে গেলেই যেন বেঁচে যায়। আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে। তার ওপর রাতুলের অত গল্পে মজে যাওয়া, হেসে ওঠা সে আরেক যন্ত্রণা। রাত্রি কোথায় চাইছে শ্রাবণের সঙ্গে রাতুলের দূরত্ব আরো বেড়ে থাক, তার বদলে তাকে এত কী ভাল লাগছে তার সঙ্গ। রাত্রি চেয়েছে রাতুলকে নিজর মতো করে গড়ে তুলতে; ভেতর থেকে বলে উঠতে চেয়েছে, আমিই তোর বাবা, আমিই তোর মা।
(চলমান…)
(পর্ব-৬)
আবার ওই বাবা-মা’র দিকে তাকিয়েই অনেকেই দিব্যি জোড়াতালি দিয়ে সংসার চালিয়ে যায়। তবু মনে মনে সব মেয়েই একটু বল পায় ওদের কথা ভেবে। কোথাও কোন দাঁড়াবার জায়গা না থাক বাপের বাড়ি তো আছে। সেখানে সান্তনা আছে, নিখাদ সমবেদনা আছে।
রাত্রি জানে এত সবের পরও যদি ও গিয়ে দাঁড়ায়, দুঃখ পাবে ওরা ঠিকই, তবে ভরসাও দেবে। মা সেই তেমন করেই বুজে জড়িয়ে ধরবে ছলছল চোখে, বিয়ের পর ঠিক যেভাবে বিদায় দিতে গিয়ে কেঁদে উঠে জড়িয়ে ধরেছিল। তাই সবকিছু ভাবার পরও রাত্রি গিয়ে উঠেছিল বাবা-মা’র কাছে।
বাবা একটু আধটু অভিযোগ শোনার পর বলল, দেখ রাত্রি, সব বিয়েই এরকমই। মানিয়ে নিতে হয়।
যেন রাত্রি মানিয়ে নেবার চেষ্টা করেনি।
মা’ও কাছে বসিয়ে স্তোক দেবার মত করে বললেন, প্রথম প্রথম এ রকম হয়, একটু বাচ্চাকাচ্চা হলেই দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।
বাবা-মা’র কথা শুনতে শুনতেই দেখলো শ্রাবণ আসছে। শ্রাবণকে আসতে দেখেই মনে মনে খুশি হয়েছিল রাত্রি, কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করল না। ওর আশঙ্কা ছিল শ্রাবণ হয়ত ওর খোঁজ নিতে আসবে না। তাই দূর থেকে শ্রাবণের বিব্রত মুখটা দেখে ভেতরে ভেতরে খুশি হল। কিন্তু লজ্জা আর সংকোচ ওকে তখন গ্রাস করে ফেলেছে।
শ্রাবণ বেশ রাগত স্বরেই বলল, একটা কান্ড যে করে বসো।
ব্যাস।
যেন কোথাও কিছু ঘটেনি, যেমন ছিল তেমনি আছে। আসলে শ্রাবণের মুখ বিব্রত বাবটা অন্য কারণে। কোথাও কিছু নেই। হঠাৎ অফিসে বসে কাজ করতে করতে রাত্রির ফোন পেয়ে ও বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। ফেরার পথে বলেছিল, কী যে করে সবো, আমার অফিসে একটা প্রেস্টিজ আছে না। কলিগদের কানে গেলে কী বলবে।
চাপা রাগ আসলে অন্য কারণে। স্ত্রী ফোন করে বলেছে আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি, কোথায় তাও জানাচ্ছে না, আশেপাশে অন্যরা শুনতে পাবে বলে নরম নরম তোষামুদে ভাষায় তার মানভঞ্জন করার উপায় নেই। তাই শ্রাবণকে নির্বিকারভাবে বলতে হয়েছে, বাড়ি ফিরে যাও, গিয়ে শুনব। এছাড়া আর কিইবা বলতে পাতো।
বাবা-মা’র কাছে লজ্জার মাথা খেয়ে আসতে হয়েছে, সেখানেও সেই একই উপদেশ মানিয়ে নে; মানিয়ে নে। সেই অসহায়তার মধ্যে নিরূপায় হয়েই ওকে ফিরে যাবার কথা ভাবতে হয়েছে। কিন্তু শ্রাবণের কথাটা শুনেই তিক্ততায় মনটা ভরে গেল। বুঝতে পারল ও চলে এসেছে বলে শ্রাবণের মনে বিব্রত ভাব ফোটেনি। বিব্রত হয়েছে ওর চারপাশের লোকদের কাছে পরিচ্ছন্ন ইমেজটা নষ্ট হবে এই ভয়ে।
রাত্রির কোনও মূল্য নেই ওর কাছে। থাকলেও তা একটা অংশের মত। মানুষটাকে অধিকার করে আছে অনেকে, একা রাত্রির জন্য যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে তা শুধু একটা অংশ। অথচ রাত্রি চেয়েছে গোটা মানুষটাকেই। পেয়েছে শুধু রাতের বিছানা।
মা বলেছিল সব ঠিক হয়ে যাবে, যায়নি। কোন সম্পর্কই গোটা মানুষটাকে পায় না। অথচ সম্পর্ক যাই হোক সকলেই সেই সম্পর্কের জোরে পুরো মানুষটাকে গ্রহণ করতে চায়। এর চেয়ে বড় বিড়মন্বনা মানুষের জীবনে আর কি আছে।
এতসব চিন্তার মাঝে রাতুল এসে দাঁড়িয়েছে মুখের সামনে। মা মণি আমরা নানুবাসা কবে যাচ্ছি?
– কাল বাবা।
– তোমার কালটা কবে আসবে?
– তুমি জানো নিলয়, তুমি না গেলে আমিও যাবো না।
– আব্বু তুমিও চল না।
– আচ্ছা, আমরা কালই রওনা দিব, তবে একটা শর্তে।
– কিসের শর্ত?
– তোমাকে নামিয়ে দিয়ে, আমি চলে আসবো …
রাত্রি আর রাতুল দুজনেই চুপ।
চৌকাঠ ডিঙিয়ে এ বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে রাত্রি এখন ফুটকি। চার দেয়ালের ঘর নয়, ওর মনে হচ্ছে যেন একটা ছোট্ট সুন্দর দ্বীপে এসে পৌঁছেছে। চোখ শুধু সবুজ দেখছে, চোখ সমুদ্র দেখছে, সমুদ্রের ঢেউ। কোথাও কোন দেয়াল নেই, শুধু ঝড়ো বাতাসের স্পর্শ। সেখানে শুধু গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছা করে।
অনর্গল কথা বলে চলছে ও, আর হাতের কাজ সারতে সারতে মা হাসি হাসি মুখে শুনছে। যেন কত কালের কথা জমা হয়ে আছে। যেন কতকাল কথা বলতে পারেনি। মা এক ফাঁকে বললেন, যা তুই গোসল করে নে, রাতুলকে আমি গোসল করিয়ে দিচ্ছি।
– হবে, হবে।
অর্থাৎ গোসল, খাওয়ার জন্য তাড়া নেই। ফুটকি বলল, আমি তো ওসব ওখানেই সেরে আসতে পারতাম, কিন্তু তা হল আধাবেলা ছুটি কমে যেত। আসতে আসতে দুটো তিনটে বেজে যেত। সেজন্যই শ্বশুরকে দিয়ে ফোন করানো, এসে খাবো।
নিলয় বাইরে যাবার পরও দুটো দিন কাটিয়ে আসতে হয়েছে, সেটুকুতেই অধৈর্য হয়ে উঠেছিল। তবু চক্ষুলজ্জা। সেই আগে মেযন কোথাও বেড়াতে যাবার কথা থাকলেও বলে উঠতে পারতো না শাশুড়িকে। নিশি তো বলেই বসলো, কেন এতদিন যেতে পারেনি, ভাইয়া যখন ছিল। ভাইয়া যেই গেল, অমনি বাপোর বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল। তাই না?
কথাটায় বেশ একটা ইঙ্গিত আছে।
বিয়ে হয়ীন বলেই বিয়ে সম্পর্কে ওর মনে একটা স্বপ্ন আছে। কল্পনায় কি দেখে কে জানে। হয়তো বিয়েল আগে রাত্রিও স্বপ্ন দেখতো। দেখতোই তো। কিন্তু… নিশি ঠিক কি বলতে চেয়েছিল? নিলয়কে ছেড়ে রাত্রি এক মাহূর্ত থাকেত পারে না, নাকি ও থাকলে বাপের বাড়ির কথা ভুলেই থাকে? অথবা বলতে চাইলো নিলয় না থাকলে ওদের বাড়িটাই ওদের কাছে দুঃসহ? নিশিকে তাই ভাল লাগে না আজকাল। একটা কথাও সোজাভাবে বলে না।
মেয়েটা তো প্রেমফ্রেম করে কারো সাথে পালিয়ে গেলেই পারে। বিয়ে যখন হচ্ছেই না, তার নিজের পরিণতির কথা চিন্তা করেই হয়ত কথাটা বলল। দেখে তো মনে হয় এক সময় বেশ সুশ্রী ছিল, হয়ত সুন্দরীই।
প্রেম করে কাউকে বিয়ে করলেও বাড়িতে কি আপত্তি করত। কই তার সময় তো কোন রকম আপত্তি ওঠেনি। মেয়ের আগে একটি বিয়ে হয়েছিল জানার পরও তারা তাকে এ বাড়ির বউ করে এনেছিল। নিশির কথা টেনে এনে আবার কথা শুরু করেছিল রাত্রি।
মা বলল, তুই যা বাবা, গোসল করে খেয়ে নে, পরে শুনবো। রাত্রি একটু অসন্তুষ্ট হল। ভেতরে একটা চাপা ক্ষোভও যেন গুমড়ে উঠলো। ও কি খেতে এসেছে নাকি এখানে। ও তো অনেক কথা নিয়ে এসেছে উজাড় করে দেবার জন্য। কতদিনের জমা হওয়া কথা। তার মধ্যে হাসিও আছে, আনন্দও আছে, আবার কান্নাও আছে। সব কথা অবশ্য বলবে না, বলা যায় না। তবু হাল্কা হওয়া তো যায়।
কিন্তু এ বাড়ির কথা শুনলেই নিলয় কেমন যেন করত। কখনো রাগত না। কিন্তু এবার রেগে গিয়েছিল। রেগে গিয়ে বলেছিল- ঐ ভাঙাবাড়িটায় কি আছে কি? রেগে ছিল বলেই বলেছিল। অথচ রাগ তো নিয়ে এসেছিল অফিস থেকে। ওকি করে জানবে!
ওর বুকের মধ্যে ক’দিন ধরেই এ বাড়িতে আসার ইচ্ছা হচ্ছিল। বাবা-মা’কে দেখার কিংবা দু’চারদিন এসে থাকার। এক এক সময় সে হাপিয়ে ওঠে। বেশ কয়েকদিন ইচ্ছেটা চেপে রেখে শেষে একদিন বলেই ফেললো- এই শোনো, আমি ভাবছি দু’দিন ও বাড়িতে থেকে আসবো। তার উত্তরে ঐ কথা। রাত্রি মেনে নিচ্ছে কিছু একটা ঘটেছিল অফিসে। রেগে ছিল, হয়ত নিজের ওপরই।
কিন্তু কথা একবার বলে ফেললে তো আর ফেরানো যায় না। যত আদর করে ভোলাবার চেষ্টা করো, স্লেটের দাগ নয় ভিজে কাপড় বুলিয়ে মুছে দেবে। মেয়েদের কেন যে টাকা হয় না। ওরা করতে দেবে না, দিলে চাকরি করত রাত্রি। কিন্তু তাতেই বা ক’টাকা হবে। সত্যি সত্যি যদি কোনদিন ওর অনেক টাকা হয়ে যেত, এই বাড়িটাকে একেবারে বদলে দিত ও। ভেঙে ফেলে একেবারে নতুন না করে ফেলুক, ভেঙে করে সারিয়ে সুরিয়ে এমন করে দিত যে দেখে নতুন মনে হত। বারান্দা সিড়ি সব ঝকঝকে তকতকে। ঘরের লাল সিমেন্ট তুলে ফেলে টাইলস বসানো।
শ্বশুর বাড়িতে যখন মাঝে মাঝে খুব নিঃসঙ্গ লাগে, ভেতরটা কেমন কেমন গুমড়ে ওঠে। কিছু করার না থাকলে, রাতুল হয়ত ঘুমচ্ছে, রাত্রি বিছানায় শুয়ে শুয়ে এখানে চলে আসে। বাপের বাড়িতে, আর টুকরো টুকরো ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে।
এখন আমাদের সব চাই। রাত্রি শুধু হাসল। মনে মনে ভাবলো, বাবা সেই একই রকম আছে। কোন স্বপ্ন নেই, উচ্চাশা নেই, বাঁচার মত করে বাঁচার ইচ্ছেও নেই। চলে গেলেই সন্তুষ্ট, জীবন যেন শুধু চলে যাওয়া। অথচ তার মধ্যেই কী এক তৃপ্তি। রাতুলের স্কুলের সামনে বসে যাদের সঙ্গে গল্পগুজব করে তাদের অনেকের তো অনেক কিছু আছে। বাড়ি-গাড়ি, কতসব দামী দামী শাড়ি পরে আসে। কিন্তু অতৃপ্তি যায় না। দু’দশ মিনিট আড্ডা দিলেই সব বেরিয়ে আসে। রাত্রি নিজেও বুঝতে পারে না ও সুখী না অসুখী। ওদের সময়টাই বোধহয় অন্যরকম।
শ্বশুর বাড়িটাও যেন এই দু’সপ্তাহে টিভির মতই হয়ে গিয়েছিল। শব্দ আছে, কথা কানে যাচ্ছে না, ছবি আছে চোখ দেখছে না। তেমনই। শুধু আছে এটুকুই মনে আছে। ফাঁকে ফাঁকে নিলয়ের কথা হয়ত মনে পড়ছে, মনে পড়ছে না। একেবারে অন্য জগতে চলে গিয়েছিল রাত্রি। নিশির ডাকেই সম্বিত ফিরে পেল।
– নিশি! কথা আছে।
রাত্রি চোখের ইশারায় সিড়ির দিকে ইঙ্গিত করল। নিশি সপ্রশ্ন চোখে তাকাল রাত্রির দিকে, তারপর ঈষৎ ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালো। অর্থাৎ অভিযোগ, রাগ আছে, ক্ষোভ আছে, বিরক্তি আছে। আবার প্রয়োজনে কখনো কখনো দু’জনে অন্তরঙ্গ বন্ধু। একান্ত সঙ্গী। পরামর্শ দিতে হলে, সান্তনা দিতে হলে ওরা একাত্ম হয়ে যায়। অথচ তখনই আবার তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে রাগ কিংবা অভিমান।
গোপন হাসাহাসির কথা থাকলে, কিংবা লুকোনো শলাপরামর্শের জন্য ঐ একটাই জায়গা। ছাদে ওঠার সিড়ির একেবারে শেষ ধাপ। বসে গল্প করার জন্য ডাকেনি রাত্রি। শুধু একটা প্রশ্ন। নিশি বলবে কিনা জানে না। একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল। যদি জানা যায়।
সিড়ির শেষ ধাপ অবধি যেতে হল না, মাঝ পথেই দাঁড়িয়ে পড়ল রাত্রি।
– নিশি, কি হয়েছে বলতো? বাবা-মা’র মুখ কেমন থমথমে।
– বিশ্বাস করো ভাবি, কিছু জানি না। তবে একটা কথা শুনেছি- বাবা-মা কি সব বলাবলি করছিল, আমি ঢুকতেই থেমে গেল। শুধু একটা কথা কানে এসেছিল। বাবা মা’কে বলল, রাত্রিকে এখন কিছু বলো না।
এখন বুঝতে পারল কেন বাবা সেদিন ফেরার সময় বলেছিল একটা দুঃসংবাদ আছে। পরক্ষণেই মেয়ে যেন কষ্ট না পায় তাই তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে নিয়েছিল, হাসতে হাসতে বলেছিল, বেয়াই ফোন করেছিল। একটু থেমে বিরক্তভাবে বললেন, নিলয় পরশু ফিরছে। কালই ওকে যেতে বললেন। রাত্রি তার পরদিনই ফিরে এসেছিল; কিন্তু নিলয়, তাহলে কি?
রাত্রিকে রেখে যেতে এসেছিল ওর বাবা। পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। শ্বশুর হৈহৈ করে উঠলেন, বেয়াই এসেছেন, বেয়াই। শাশুড়িও ছুটে এসেছিলেন সঙ্গে নিশিও।
বাবা চলে যাওয়ার পর রাত্রি ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল ঘর গোছাতে। মাত্র পনেরো দিন ছিল না, এরই মধ্যে ঘরখানা দেখে মনে হয় যেন পনেরো মাস ছিল না। ধুলো জমেছে আসবাবপত্রে, জানারায়, দরজায়। মেঝে পরিষ্কার হয়নি কতদিন।
পরদিন খুব ভোরবেলাতে ঘুম ভাঙলো রাত্রির। ভোরবেলাতেই ঘুম ভাঙে। তবু দরজা খুলে রেখেছিল, খিল দেয়নি। কি জানি কখন ফিরবে, যদি ঘুমিয়ে পড়ে, দরজায় টোকা দিলেও শুনতে পায় না রাত্রি। সে এক বিশ্রী কান্ড। তাই রাত্রি জেগেই ছিল, আর স্বামীর জন্য জেগে থাকাই বউদের কর্তব্য।
বরং খিল খোলা থাকলে নিলয় এসে ওকে ডেকে তুলতে পারবে, কিংবা গায়ে হাত দিয়ে। এরা কেউ জানতে পারবে না রাত্রি জেগে ছিল, না ঘুমিয়ে ছিল। বিয়ের পর নিলয়কে ছেড়ে কখনও থাকেনি। দুয়েকবার যা থেকেছে সে এ বাড়িতে নয়, বাবা-মা’র কাছে গিয়েছিল বলে। এই প্রথম এ বাড়িতে। দুটো সপ্তাহ ছিল না নিলয়। না থাকলে আদর বারে। মিনা আর ইরা বলেছিল।
মিনা চোখ টিপে ইঙ্গিত করে বলেছিল- দেখিস, দেখিস, ফিরে এলে কি করে। হেসে ফেলেছিল সবাই।
মিনার স্বামীর বেশ ভাল চাকরি, কি চাকরি ঠিক জানে না রাত্রি। তবে মাঝেমধ্যে দুয়েক সপ্তাহ বাইরে যায়। ঐটুকুই ওর ঈর্ষা ছিল। বেশ মজা। রাত্রির ওরকম হলে বাপের বাড়ি যাওয়া কত সুবিধা হত।
ইরা ঠাট্টা করল মিনাকে, তাই বল, মাঝে মাঝে তাই এত খুশি খুশি দেখায় তোকে। শুনে শুনে রাত্রিরও একটু ইচ্ছে হয়েছিল স্বপ্ন দেখার। দরজার খিল খুলে রেখেছিল সে কারণে, নিলয় আসবে, এসে নিঃশব্দে রাত্রির ঘুমন্ত শরীরের পাশে বসবে, কাঁধে কিংবা গানে হাত ঠেকিয়ে ডাকবে ফিসফিস করে।
– দেখিস, দেখিস ফিরে এলে কি করে?
(চলমান…)
(পর্ব-৫)
কেউ বলেনি, এখনও জীবন আছে, ফিরে আয়।
নিলয়কে তখন কত টুকরো টুকরো কথাই না বলেছে। এইসব ছোট ছোট ব্যাপার কেন লাগে, কোথায় লাগে, আর কেন তা এত বড় হয়ে দেখা দেয় রাত্রি নিজেও বুঝতে পারে না। শ্রাবণ কফি ভালবাসে, চা একেবারেই নয়। এদিকে বাপের বাড়িতে ছোটবেলা থেকে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা রাত্রির চা না হলে চলে না। এটা এমন কিছু একটা বিপর্যয় নয়, রাত্রি নিজেও জানে।
নিজর দুঃখের প্রসঙ্গ টেনে এনে একদিন সে সব কথা নিলয়কে শোনাতে গিয়ে বলেছিল, কোথায় লাগত জানেন, এই যে আমি মনে করে রেখেছি, ওর কফিতে কতটা দুধ, ক’চামচ চিনি, ক’টার সময় ওর কোথায় কোথায় প্রোগ্রাম, অথচ ও আমার জন্য ….
নিলয় শুধু হেসে চুপ করে গেলেও ভাল ছিল, তার বদলে ও বলে উঠল, আসলে রাত্রি, তুমি আগে থেকেই তোমার ভালবাসার মানুষকে, তার সবকিছুকে অপছন্দ করে ফেলেছো। সে কারণেই ছোটখাটো জিনিসগুলো বড় হয়ে দেখা দিত।
কথাটা হঠাৎ যেন একটা নাড়া দিল রাত্রিকে। ঠিক এভাবে ও কোনদিনও ভেবে দেখেনি। খুঁজে দেখার চেষ্টা করল ঠিক কবে থেকে ও শ্রাবণকে অপছন্দ করতে শুরু করেছিল। ভালবাসার পর মানুষটাকেই কী ও অপছন্দ করতে শুরু করেছিল, নাকি ওর ওপর অধিকার খাটাতে চাইতো সেই ব্যাপারটাকেই ও পছন্দ করতে পারতো না। শ্রাবণকে রাত্রি এখন আর তেমন সহ্য করতে পারে না, না পারারই কথা, কারণ এখন ওর মনে হয় এই লোকটা ওর স্বপ্নই ভেঙে দেয়নি, জীবনটাই নষ্ট করতে চেয়েছিল। কিন্তু এখনকার ব্যাপারটা পুরোটাই ভদ্রতা।
তখন রাত্রির মধ্যে আর কী বা ছিল, শুধু নিঃসঙ্গতা ছাড়া।
না, তখন আর বাবা-মা বলত না তুই ভুল করছিস। স্পষ্ট করে ওরা না বললেও, মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারত ওরা বলতে চাইছে, তুই ভুল করেছিলি, এখন বুঝতে পারছিস তো! জীবনে এর চেয়ে আর বড় লজ্জা কি হতে পারে। কী ভুলই না করেছিল ও।
তখন ওর যে কী হয়েছিল কে জানে। শ্রাবণের নেশায় পড়ে গিয়েছিল হয়ত। মানুষটাকে আদৌ চিনতে পারেনি। নাকি নিজেকেই চিনতে পারেনি! বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব সকলেই বারণ করেছিল। কারও কথা কানে নেয়নি। মনে হয়েছে ওর চারপাশের সকলেই শত্রু।
শেষ অবধি বাবা বলেছিল, যা ভাল বুঝিস।
কত কি রঙিন স্বপ্ন দেখেছিল। বিয়েটা যে শেষ অবধি এভাবে, এত সহজে ভেঙে যাবে কল্পনাও করিনি। এক ছাদের নিচে না থাকলে কোন মানুষকেই চেনা যায় না। যত দিন না ডিভোর্স হয়ে গেছে, রাত্রির মনে হয়েছে ওকে কে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। তখন শুধুই রাগ আর ক্ষোভ তীব্র ঘৃণা। জালে আটকে যাওয়া পাখির মত ছটফঠটানি। কেমন একটা অনিশ্চয়তা আর ভয়। কোন দিক থেকে অচেনা একটা জটিলতা এসে দেখা দেবে সেই আতঙ্ক। ছাড়া পাওয়ার জন্য কি অধৈর্য ব্যাগ্রতা। এক একটা দিন যেন এক একটা বছর। যেন কতকাল রাত্রি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পায়নি। অথচ ওদের বিয়েটা এক মাসও টেকেনি।
বাবার কথাটা কানে গেল- যাঃ সব পিছুটান শেষ।
দূরে দাঁড়ানো শ্রাবণের দিকে একবারেই চোখ পড়েছিল, দ্বিতীয়বার ফিরে তাকায়নি রাত্রি। তখন ওর মনে শুধুই ঘৃণা। একটু আগে পর্যন্ত ছিল একটা দুর্বোধ আতঙ্ক। শেষ মুহূর্তে না কোনও আইনের ফাঁকে সব ভেস্তে দেয় ওই লোকটা। কিন্তু উকিল ভদ্রলোক যেই হেসে হেসে বললেন, শুনলে তো, ডিভোর্স হয়ে গেল, অমনি এক দমকা উজ্জ্বল আনন্দ ওর বুকের মধ্যে তুবড়ি জ্বালিয়েই কেমন নি®প্রভ হয়ে গেল।
হঠাৎ রাত্রির নিজেকে বড় বেশি নিঃশ্ব মনে হল। ক্রোধ আর ঘৃণা সামনে এতদিন একটা লক্ষ্য এনে রেখেছিল। ওই লোকটার হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে। অথচ সঙ্গে সঙ্গে মনে হল সামনে আর যেন কোনও লক্ষ্য নেই। শুধুই শূন্যতা। বাবার কথাটাই শুধু কানে বাজছে; যাঃ আর কোন পিছুটান রইল না।
রাত্রি ভেবেছিল ক্রোধ, ক্ষোভ আর ঘৃণা থেকে ও একেবারে মুক্তি পেয়ে যাবে, ছেড়ে আসার পর শ্রাবণের কাছ থেকে একেবারে ছাড়া পেয়ে গেল। যেন সঙ্গে সঙ্গে মানুষটাই পৃথিবী থেকে উবে যাবে, কোনওদিন আর রাত্রির চোখের সামনে পড়বে না, এ রকম একটা ধারণা ছিল।
বাবা ফিরতে ফিরতে পাশে বসা রাত্রিকে বলেছিল- আবার মুখ ভার করে আছিস কেন? প্রাণ খুলে হেসে ওঠ। তোর তো উচিত ছিল ওই কোর্ট রুমেই হেসে হেসে কথা বলা, দ্যাখানো দ্যাট ইউ আর এ ফ্রি ওম্যান্য। স্বাধীন-সুখী। মুখের মত জবাব হত, ওই হাসি।
রাত্রি চুপ করেই ছিল, কোন কথা বলেনি।
বাড়িতে ফিরে বাবা বলেছে, মনে কর আজ থেকেই তোর জীবন শুরু, আগের জীবনটা শুধুই একটা দুঃস্বপ্ন। আমি তোর আবার বিয়ে দেব। আর আমার সেই গরীব বাবা আবার আমার বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। এখন আমি নিলয়ের বউ। এবং সুখী। আর সেটা রাতুলের কারণেই। ওর দিকে তাকিয়ে একটাই কথা মনে হয়, আমার ছেলে, আমার রক্তমাংস দিয়ে গড়া। ও চিরকাল আমারই থাকবে।
বাবাকে অনেক অপমান সইতে হয়েছে, অনেক কষ্ট পেয়েছে। মা হয়ত আরও বেশি, শুধু তার একটি ভুলের জন্য। মাঝে মাঝেই নিজের দুঃখের কথা, কষ্টের কথা, কোনও অসহ্য ঘটনার কথা এই এক জায়গাতেই ও উজার করতে পারে। নিলয়ের কাছে। এখানেই শুধু কেঁদে হাল্কা হতে পারে। সান্তনা পায় সঙ্গে উপদেশও। এই নিলয়ের কারণেই শ্রাবণ আবার এ বাসায় আসতে শুরু করেছে। এটা নিলয়ের উদারতা নাকি অন্য কিছু রাত্রি তা এখনও জানে না।
নিলয় ফিরেছিল বেশ রাত করেই। রাত্রি জানতো নিলয় দেরি করেই ফিরবে। বিশেষ দিনগুলোতে নিলয়ের এই দেরী করে ফেরা ওর দিক থেকে খারাপই লাগে, কারণ বাড়িতে থাকলে নিলয় দেখতে পেত। সারাক্ষণ ও দূরে দূরে থাকে। রাতুল ডেকে কোনও কথা বললেও দূর থেকে উত্তর দেয়। স্বাভাবিকতা দেখানোর জন্য কোনও না কোনও কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে।
প্রথম প্রথম শ্রাবণকে কি ভয়ই না পেত। ভয় ঠিক শ্রাবণকে নয়, রাতুলকে। ওইটুকু বাচ্চা ছেলেও কী বোঝে। কোনটা আসল ভালবাসা আর কোনটা নকল ভালবাসা তা বোঝার বয়স কী ওর। কথাটা মনে আসতেই হেসে উঠল। বয়সের কথা ভাবছে কেন, মানুষ চেনা কি এতই সহজ? রাত্রির তো যথেষ্ট বয়স হয়েছিল, বুদ্ধিসুদ্ধিও কম নয়, তাহলে ওই বা কেন শ্রাবণকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। সেসব দিনের কথা মনে পড়লেই লজ্জায় অনুশোচনায় নিজের মধ্যেই নিজে মুষড়ে পড়ে।
সবচেয়ে ভাল বন্ধু, সেই স্কুল থেকে কলেজ অবধি, কনা আরও কে কে বলেছিল, তুই কী পাগল হয়ে গেছিস, ওকে ওই লোকটাকে তোর এত পছন্দ? বিয়ে করবি?
ও তখন প্রেমে অন্ধ। মানুষ যে প্রেমে অন্ধ হয় তা ও নিজের জীবন দিয়েই বুঝতে পেরেছে। শ্রাবণের কোনও কিছুই ওর খারাপ লাগত না। কেন যে লাগেনি, নিজেই জানে না। সে সময় ওর ভেতর থেকে সব যুক্তিবুদ্ধি যে উবে গিয়েছিল তাই নয়, ভদ্রতা কর্তব্যবোধ এ সবও হয়ত ছিল না। তা না হলে বাবা-মা’র সাথে ওভাবে কথা বলত।
রাত্রি তখন শ্রাবণের প্রেমে পাগল। আর কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবতেই পারে না। মা বাধা দেওয়ার ফলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলেছিল, কেন, খারাপটা কী দেখলে তোমরা? বাবাকে বলে দিও তোমাদের মত না থাকলে আমি বেরিয়ে গিয়েই ওকে বিয়ে করব।
ব্যাস এ কথার পর আর কোনও কথাই খাটে না।
তবুও বাবা পিঠে স্নেহের হাত রেখে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন। স্নেহের হাতটাকে তখন রাত্রির কাছে বিছুটি মনে হচ্ছে। স্নেহ না ছাই, এসব বাবার পলিসি। মত বদলানোর চেষ্টা। তাই গলার স্বর ঝাঁ ঝাঁ । – যুক্তি দিয়ে বলোনা কী খারাপটা দেখলে ওর মধ্যে।
বাবা তখন বলেছিল, সব কি যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায়। ওকে দেখলেই আমার মনে হয় তুই ওখানে সুখী হতে পারবি না। শুধু মুখ দেখেই মনে হয়েছে।
ঠিক যেন বাবাকে অপমান করার জন্যই অট্টহাসি হেসে উঠেছিল রাত্রি। হাসতে হাসতেই বলেছিল, শুনলে মা, শুধু মুখ দেখেই মনে হয়েছে। সেই বাবার কথাটাই ফলে গিয়েছিল বলে, রাত্ররি বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠত। কলেজের বন্ধুরা শ্রাবণকে বিয়ে করতে নিষেধ করেছিল বলে তাদেরকেও রাত্রি অপছন্দ করা শুরু করেছিল। ভেবেছিল, স্রেফ হিংসে। শ্রাবণকে বিয়ে করাই ওরা সহ্য করতে পারছে না। এ সমস্ত কথাই ও দিনে দিনে নিলয়কে বলেছিল। নিলয় সবই জানে।
মানুষে মানুষে সম্পর্ক জিনিসটা বড় অ™ভুত। এক একজনের সঙ্গে সম্পর্ক মানে একজন মানুষের ছোট ছোট অনেকগুলো অংশ। টুকরো টুকরো ভাবে কেউ বাবার, কেউ মায়ের, কখনও স্বামীর কিংবা স্ত্রীর, কখনও সন্তানের কখনও বন্ধু, কখনও সহকর্মীর। আরও কত রকমের সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্কগুলো থেকেই একজন মানুষের এক এক টুকরো পৃথক চরিত্র বেরিয়ে আসে। তার কোন একটিকে নিয়ে মানুষটাকে বিচার করা যায় না। সম্পর্ক যত গাঢ় আর অন্তরঙ্গ হোকনা কেন গোটা মানুষটার ওপর আমাদের কোনও অধিকার নেই। সেই সম্পর্কটুকুর বাইরে তার আলাদা একটা অস্তিত্ব থাকে, কিন্তু কেউ সেটা মনে রাখে না। সেই অস্তিত্ব আসলে একজন মানুষের আরও অনেক টুকরো টুকরো অংশ।
রাত্রি নিজেও এসব কথা মাঝে মাঝে ভাবে, বুঝতেও পারে। মুশকিল হল এই যে, কেউই সে কথা বোযে না। সম্পর্ক যাই হোক না কেন সে গোটা মানুষটাকেই নিজের করে নিতে চায়। যেন তার নিজস্ব সম্পত্তি। আমার মতো তোমার এই সম্পর্কের বাইরে তোমার আর কোনও অস্তিত্ব থাকতে পারবে না।
নিলয় তো সবই জানে। কিন্তু সেও কেন রাত্রির সব অস্তিত্ব গ্রাস করে একা ওর সম্পত্তি ভাবতে বসেছে। তাই কি খবরের কাগজ পড়তে পড়তে ঠাট্টা করে বলেছিল সেই ছোট শব্দটি ‘ও’।
যা যেখানে আছে সব পড়ে থাক, ভুল করে থাকা অসুখী জীবনটার মতই। ওর বাবা-মা’র সব আপত্তি, সব যুক্তি যখন রাত্রি উড়িয়ে দিয়েছে তখন বাধ্য হয়েই ওরা এ বিয়েতে রাজি হয়েছিল। আর বিয়ের পরতো বাবা-মা দুজনেই খুশি হয়েছিল। রাত্রি তখনই ভেবে নিয়েছিল ওর একটাই কর্তব্য। শ্রাবণ আর ও যে সঙ্গী হতে পারবে সেটা প্রমাণ করে বাবা-মা’কে সুখী করা। কিন্তু শেষ অবধি পারল না। এমনকি ভেতরের যন্ত্রণা চেপে রেখে এক ছাদের নিচে কাটিয়ে সুখী জীবনের অভিনয় দিয়ে বাবাকে মাকে সুখী করে তুলবে তারও উপায় রইল না। মাত্র এক মাসের মাথায় তারা দুজন একেবারেই আলাদা হয়ে গেল।
আত্মসম্মানে লাগছিল। তবুও রাত্রি রান্নাঘর থেকে বেররিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রাতুলের সামনেই শ্রাবণকে বলে বসলো- তোমার কাছে আমার একটাই রিকোয়েস্ট, এ বাড়িতে তুমি আর কখনও এসো না।
নিস্তরঙ্গ পুকুরে ঢিল পড়লেও তরঙ্গ ওঠে বইকি। তবে সেই তরঙ্গের স্থায়িত্ব আর কতটুকু? দশ সেকেন্ড, বিশ সেকেন্ড, বড় জোড় এক মিনিট! এ তরঙ্গ বড় মৃদু, শক্তিহীন। দুর্বল বৃত্তাকার ঢেউ হয়তো এক সময় কাঁপতে কাঁপতে পাড়ে এসে পৌঁছায়, কিন্তু তখন তার অস্তিত্বই অনুভব করা কঠিন। স্থির পুকুরের দিকে তাকিয়ে কে তখন বলবে, একটু আগে ঢিল পড়েছিল এখানে।
শ্রাবণের আগমন রাত্রির কাছে অনেকটাই এই গোত্রেরই। শ্রাবণকে নিয়ে এখন সে তেমন একটা ভাবে না। সে ভাবে তার স্বামী, সংসার, ছেলের কথা। তার সময় কাটছে এদের ভাবনাতেই। সময়কে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পার করছে সময়। অথবা সময় কাটছে না।
তাতেই বা রাত্রির কি এল গেল? সময়তো আর সত্যি সত্যি নিশ্চল, অনড় এক পাহাড় নয়, যেমন ভাবেই হোক সে ঠিক গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে যাবে।
যাচ্ছেও তো। একেকজন লোক আছে যাদের হঠাৎ মনে হয় পরম আশ্রয়। নিলয় ঠিক সেরকমই। সেই সময়ের কষ্টের কথাগুলো ও যখন নিলয়কে বলতো, সহানুভূতি, সমবেদনা সব তখন ওর কাছ থেকেই পেত।
বুকের মধ্যে এই অশান্তি আর কষ্ট চাপা রাত্রির কোনও কোনও নির্জন দুপুর সেসব কথা মনে পড়িয়ে দিয়েই ওর চোখে পানি এসে যেত। এমন একটা স্বপ্রসঙ্গের দিন ওর জন্য অপেক্ষা করে আছে কোনও দিন কল্পনা করেনি। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল যেন, প্রেম ভালবাসা ছাড়াও যে পার্থিব জীবনে আরও কত কী আছে, তার কিছুই তখন চোখে পড়েনি। রাত্রি তখন ভালবাসার অন্ধ গলিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। শ্রাবণকেও ভাল করে বুঝে ওঠার মত দৃষ্টি ছিল না।
ছোট ছোট ঘটনা, একটুকরো বাঁকা কথা, সামান্য তাচ্ছিল্য মেয়েদের মনে কখন কী যে জ্বালা ধরিয়ে দেয়, নিজের কাছেই নিজেকে ছোট করে দেয় তা বোঝার মত বোধশক্তি শ্রাবণের ছিল কিনা সন্দেহ হয় রাত্রির।
শ্রাবণের কি দোষ দেবে, বিয়ের পর মাত্র এই কটা দিন এর মধ্যেই ওকে কেন সব ছিঁড়ে ফেলে বেরিয়ে আসতে হল তা কি কেউ বুঝবে? অন্য কাউকেও বোঝাতে পারবে! যার বুকের মধ্যে জ্বালা সেই বোঝে, আর সকলেই উপদেশ দেন, মানিয়ে নে, মানিয়ে নে, যেমন রাত্রি নিজেই মানিয়ে নিতে চায়নি।
মদ খেলে মাতলামি করতে করতে বাড়ি ফিরে বউকে ধরে পেটালেই লোকে সেই অসহায় বউটার জন্যই সহানুভূতি জানায়, কষ্ট পায়, সাহস জুগিয়ে বলে, আছিস কেন; বেরিয়ে যা। শারীরিক নির্যাতনই যেন একমাত্র নির্যাতন। আগুনে পোড়া খুব কষ্টের, কিন্তু মনের ভেতরের আগুন যখন কাউকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে থাকে, তার কষ্ট বাইরের কেউ টের পায় না। বোঝেও না হয়ত।
সেই অসহ্য দাহ থেকে মুক্তি পাবার জন্যই তো রাত্রি সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আশা করেছিল জ্বালাটা একদিন নিবে যাবে, নেবেনি।
– আমাকে যদি তোমার এত অসহ্য লাগে তা হলে তখন বিয়ে করার জন্য পাগল হয়েছিলে কেন?
এই কথাটাতো রাত্রির নিজেরও প্রশ্ন, নিজেই নিজেকে করেছে বহুবার। কিন্তু শ্রাবণের কাছ থেকে প্রশ্নটা আসতেই রাগে ফেটে পড়ে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিল, কারণ তখন জানতাম না তুমি এত নিচ।
রাত্রি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল এ বিয়ে ভেঙ্গে যাবে, ভেঙ্গে ফেলাই উচিত। তবু একটা সঙ্কোচ, একটা লজ্জা ছিল। কেন সঙ্কোচ, কেন লজ্জা তা হয়ত শ্রাবণও জানতো। তাই হয়ত ওর বিশ্বাস গড়ে উঠেছে, নতুন বউ, বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে ফিরে যাবার সাহসই হবে না। কারণ এখন আর ওর ফিরে যাবার কোনও ঠিকানা নেই। এক এক সময়ে অবশ্য রাত্রি নিজেরই সন্দেহ হয়েছে, শ্রাবণের এই উদাসীন শান্ত ব্যবহারের মধ্যে আসলে রাত্রির কাছ থেকে ছাড়া পাবার একট আগ্রহ লুকিয়ে নেই তো? এই বাড়িটাকে ও কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিল না। ওরাও কী ভেবেছে রাত্রিকে এ বাড়িতে মানায় না।
রাত্রি এতদিন তার বাবা-মা’র কথা চিন্তা করেই বেরিয়ে আসতে পারেনি। কিন্তু যখন আর সহ্য করতে পারছিল না, তাই বেরিয়ে এসেছিল ও বাড়ি থেকে।
ইচ্ছে করলে শ্রাবণের জন্য একটা ছোট্ট চিঠি রেখে দিয়ে আসতে পারত, কিন্তু সেটা করেনি। বাইরে এসে ফোনের দোকান থেকে ফোন করেছিল। রিসিভারটা মুখের কাছে এনে, দোকানের লোকটাকে দেখে নিয়ে রাত্রি বলল- আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি, ফিরে যাওয়ার আর প্রশ্ন ওঠে না।
ও প্রান্তে শ্রাবণ কয়েক সেকেন্ড একেবারে চুপ। এরকম একটা কথা হঠাৎ শুনতে হবে হয়ত ভাবেনি। তারপর শান্ত গলা- কি পাগলামী করছ।
রাত্রি বলল- আমি বাড়ি থেকে ফোন করছি না, বেরিয়ে এসে রাস্তার বুথ থেকে ফোন করছি। আবার কয়েক সেকেন্ড চুপ। তারপর শ্রাবণের গলা। বাড়ি ফিরে যাও, অফিস থেকে ফিরে সব শুনবো।
উত্তরোত্তর রাগ করছিল রাত্রির, অসহায় লাগছিল, কারণ এই সরল কথাটা ও কিছুতেই শ্রাবণকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। রাত্রি নিজেকে সংযত করল, ও একটুও রাগবে না। ধীরে ধীরে বলল, ভুল আমারই। বন্ধুরা, সবাই বারণ করেছিল শুনিনি, বাবা-মা’র কিরকম আপত্তি ছিল তাও তুমি জানো।
শ্রাবণের কণ্ঠস্বর বিব্রত। বলল, অফিস থেকে কথা বলা অসুবিধে, তুমি ফিরে যাও, সব শুনবো তখন।
রাগের মধ্যেও রাত্রির হাসি পেল। লোকটা মানে শ্রাবণ ভাবছে এরপরও আগেরমত ধানাইপানাই করে ওকে শান্ত করা যাবে। রাত্রি এবার গলায় একটু রূঢ়তা আনল। বলল, অত সময় নেই, আমি বাবার বাড়িতে যাচ্ছি না; কোন মুখে যাবো। কিন্তু যেখানেই যাই তোমার কাছে ফিরে আসবো না। তোমার কাছে একটাই রিকোয়েস্ট, তুমি আমার খোঁজ করবে না। আমি চাই না, বাবা-মা জানুক … এখনই … কষ্ট পাবে।
ওপ্রান্ত এবোরে চুপ।
রাত্রি বলল, কী কথা দিচ্ছ তো?
কোনও উত্তর শোনা গেল না। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে রিসিভার নামিয়ে রাখর রাত্রি। আর সঙ্গে সঙ্গে মনে হল ওর চতুর্দিকে শুধু একটা বিরাট শূন্যতা। এতক্ষণ তার আভাসটুকুও পায়নি। কারণ মাথার মধ্যে এতক্ষণ একটাই চিন্তা ঘুরছে। একটাই দুশ্চিন্তা। বাবা-মা। একবার মনে হয়েছিল সটান বাবা-মা’র কাছে ফিরে যাবে। মেয়েদের কাছে ফিরে যাবার জায়গা তো একটাই। সকলে।ি যায়। সংসার ভেঙ্গে গেলে আর কোথায়ই বা যাবে।
(চলমান…)
(পর্ব-৪)
কিন্তু উকিল ভদ্রলোক যেই হেসে হেসে বললেন, শুনলে তো, ডিভোর্স হয়ে গেল, অমনি এক দমকা উজ্জ্বল আনন্দ ওর বুকের মধ্যে তুবড়ি জ্বালিয়েই কেমন নিপ্রভ হয়ে গেল।
হঠাৎ রাত্রির নিজেকে বড় বেশি নিঃশ্ব মনে হল। ক্রোধ আর ঘৃণা সামনে এতদিন একটা লক্ষ্য এনে রেখেছিল। ওই লোকটার হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে। অথচ সঙ্গে সঙ্গে মনে হল সামনে আর যেন কোনও লক্ষ্য নেই। শুধুই শূন্যতা। বাবার কথাটাই শুধু কানে বাজছে; যাঃ আর কোন পিছুটান রইল না।
রাত্রি ভেবেছিল ক্রোধ, ক্ষোভ আর ঘৃণা থেকে ও একেবারে মুক্তি পেয়ে যাবে, ছেড়ে আসার পর শ্রাবণের কাছ থেকে একেবারে ছাড়া পেয়ে গেল। যেন সঙ্গে সঙ্গে মানুষটাই পৃথিবী থেকে উবে যাবে, কোনওদিন আর রাত্রির চোখের সামনে পড়বে না, এ রকম একটা ধারণা ছিল।
বাবা ফিরতে ফিরতে পাশে বসা রাত্রিকে বলেছিল- আবার মুখ ভার করে আছিস কেন? প্রাণ খুলে হেসে ওঠ। তোর তো উচিত ছিল ওই কোর্ট রুমেই হেসে হেসে কথা বলা, দ্যাখানো দ্যাট ইউ আর এ ফ্রি ওম্যান্য। স্বাধীন-সুখী। মুখের মত জবাব হত, ওই হাসি।
রাত্রি চুপ করেই ছিল, কোন কথা বলেনি।
বাড়িতে ফিরে বাবা বলেছে, মনে কর আজ থেকেই তোর জীবন শুরু, আগের জীবনটা শুধুই একটা দুঃস্বপ্ন। আমি তোর আবার বিয়ে দেব। আর আমার সেই গরীব বাবা আবার আমার বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। এখন আমি নিলয়ের বউ। এবং সুখী। আর সেটা রাতুলের কারণেই। ওর দিকে তাকিয়ে একটাই কথা মনে হয়, আমার ছেলে, আমার রক্তমাংস দিয়ে গড়া। ও চিরকাল আমারই থাকবে।
বাবাকে অনেক অপমান সইতে হয়েছে, অনেক কষ্ট পেয়েছে। মা হয়ত আরও বেশি, শুধু তার একটি ভুলের জন্য। মাঝে মাঝেই নিজের দুঃখের কথা, কষ্টের কথা, কোনও অসহ্য ঘটনার কথা এই এক জায়গাতেই ও উজার করতে পারে। নিলয়ের কাছে। এখানেই শুধু কেঁদে হাল্কা হতে পারে। সান্তনা পায় সঙ্গে উপদেশও। এই নিলয়ের কারণেই শ্রাবণ আবার এ বাসায় আসতে শুরু করেছে। এটা নিলয়ের উদারতা নাকি অন্য কিছু রাত্রি তা এখনও জানে না।
নিলয় ফিরেছিল বেশ রাত করেই। রাত্রি জানতো নিলয় দেরি করেই ফিরবে। বিশেষ দিনগুলোতে নিলয়ের এই দেরী করে ফেরা ওর দিক থেকে খারাপই লাগে, কারণ বাড়িতে থাকলে নিলয় দেখতে পেত। সারাক্ষণ ও দূরে দূরে থাকে। রাতুল ডেকে কোনও কথা বললেও দূর থেকে উত্তর দেয়। স্বাভাবিকতা দেখানোর জন্য কোনও না কোনও কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে।
প্রথম প্রথম শ্রাবণকে কি ভয়ই না পেত। ভয় ঠিক শ্রাবণকে নয়, রাতুলকে। ওইটুকু বাচ্চা ছেলেও কী বোঝে। কোনটা আসল ভালবাসা আর কোনটা নকল ভালবাসা তা বোঝার বয়স কী ওর। কথাটা মনে আসতেই হেসে উঠল। বয়সের কথা ভাবছে কেন, মানুষ চেনা কি এতই সহজ? রাত্রির তো যথেষ্ট বয়স হয়েছিল, বুদ্ধিসুদ্ধিও কম নয়, তাহলে ওই বা কেন শ্রাবণকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। সেসব দিনের কথা মনে পড়লেই লজ্জায় অনুশোচনায় নিজের মধ্যেই নিজে মুষড়ে পড়ে।
সবচেয়ে ভাল বন্ধু, সেই স্কুল থেকে কলেজ অবধি, কনা আরও কে কে বলেছিল, তুই কী পাগল হয়ে গেছিস, ওকে ওই লোকটাকে তোর এত পছন্দ? বিয়ে করবি?
ও তখন প্রেমে অন্ধ। মানুষ যে প্রেমে অন্ধ হয় তা ও নিজের জীবন দিয়েই বুঝতে পেরেছে। শ্রাবণের কোনও কিছুই ওর খারাপ লাগত না। কেন যে লাগেনি, নিজেই জানে না। সে সময় ওর ভেতর থেকে সব যুক্তিবুদ্ধি যে উবে গিয়েছিল তাই নয়, ভদ্রতা কর্তব্যবোধ এ সবও হয়ত ছিল না। তা না হলে বাবা-মা’র সাথে ওভাবে কথা বলত।
রাত্রি তখন শ্রাবণের প্রেমে পাগল। আর কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবতেই পারে না। মা বাধা দেওয়ার ফলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলেছিল, কেন, খারাপটা কী দেখলে তোমরা? বাবাকে বলে দিও তোমাদের মত না থাকলে আমি বেরিয়ে গিয়েই ওকে বিয়ে করব।
ব্যাস এ কথার পর আর কোনও কথাই খাটে না।
তবুও বাবা পিঠে স্নেহের হাত রেখে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন। স্নেহের হাতটাকে তখন রাত্রির কাছে বিছুটি মনে হচ্ছে। স্নেহ না ছাই, এসব বাবার পলিসি। মত বদলানোর চেষ্টা। তাই গলার স্বর ঝাঁ ঝাঁ । – যুক্তি দিয়ে বলোনা কী খারাপটা দেখলে ওর মধ্যে।
বাবা তখন বলেছিল, সব কি যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায়। ওকে দেখলেই আমার মনে হয় তুই ওখানে সুখী হতে পারবি না। শুধু মুখ দেখেই মনে হয়েছে।
ঠিক যেন বাবাকে অপমান করার জন্যই অট্টহাসি হেসে উঠেছিল রাত্রি। হাসতে হাসতেই বলেছিল, শুনলে মা, শুধু মুখ দেখেই মনে হয়েছে। সেই বাবার কথাটাই ফলে গিয়েছিল বলে, রাত্ররি বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠত। কলেজের বন্ধুরা শ্রাবণকে বিয়ে করতে নিষেধ করেছিল বলে তাদেরকেও রাত্রি অপছন্দ করা শুরু করেছিল। ভেবেছিল, স্রেফ হিংসে। শ্রাবণকে বিয়ে করাই ওরা সহ্য করতে পারছে না। এ সমস্ত কথাই ও দিনে দিনে নিলয়কে বলেছিল। নিলয় সবই জানে।
মানুষে মানুষে সম্পর্ক জিনিসটা বড় অ™ভুত। এক একজনের সঙ্গে সম্পর্ক মানে একজন মানুষের ছোট ছোট অনেকগুলো অংশ। টুকরো টুকরো ভাবে কেউ বাবার, কেউ মায়ের, কখনও স্বামীর কিংবা স্ত্রীর, কখনও সন্তানের কখনও বন্ধু, কখনও সহকর্মীর। আরও কত রকমের সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্কগুলো থেকেই একজন মানুষের এক এক টুকরো পৃথক চরিত্র বেরিয়ে আসে। তার কোন একটিকে নিয়ে মানুষটাকে বিচার করা যায় না। সম্পর্ক যত গাঢ় আর অন্তরঙ্গ হোকনা কেন গোটা মানুষটার ওপর আমাদের কোনও অধিকার নেই। সেই সম্পর্কটুকুর বাইরে তার আলাদা একটা অস্তিত্ব থাকে, কিন্তু কেউ সেটা মনে রাখে না। সেই অস্তিত্ব আসলে একজন মানুষের আরও অনেক টুকরো টুকরো অংশ।
রাত্রি নিজেও এসব কথা মাঝে মাঝে ভাবে, বুঝতেও পারে। মুশকিল হল এই যে, কেউই সে কথা বোযে না। সম্পর্ক যাই হোক না কেন সে গোটা মানুষটাকেই নিজের করে নিতে চায়। যেন তার নিজস্ব সম্পত্তি। আমার মতো তোমার এই সম্পর্কের বাইরে তোমার আর কোনও অস্তিত্ব থাকতে পারবে না।
নিলয় তো সবই জানে। কিন্তু সেও কেন রাত্রির সব অস্তিত্ব গ্রাস করে একা ওর সম্পত্তি ভাবতে বসেছে। তাই কি খবরের কাগজ পড়তে পড়তে ঠাট্টা করে বলেছিল সেই ছোট শব্দটি ‘ও’।
যা যেখানে আছে সব পড়ে থাক, ভুল করে থাকা অসুখী জীবনটার মতই। ওর বাবা-মা’র সব আপত্তি, সব যুক্তি যখন রাত্রি উড়িয়ে দিয়েছে তখন বাধ্য হয়েই ওরা এ বিয়েতে রাজি হয়েছিল। আর বিয়ের পরতো বাবা-মা দুজনেই খুশি হয়েছিল। রাত্রি তখনই ভেবে নিয়েছিল ওর একটাই কর্তব্য। শ্রাবণ আর ও যে সঙ্গী হতে পারবে সেটা প্রমাণ করে বাবা-মা’কে সুখী করা। কিন্তু শেষ অবধি পারল না। এমনকি ভেতরের যন্ত্রণা চেপে রেখে এক ছাদের নিচে কাটিয়ে সুখী জীবনের অভিনয় দিয়ে বাবাকে মাকে সুখী করে তুলবে তারও উপায় রইল না। মাত্র এক মাসের মাথায় তারা দুজন একেবারেই আলাদা হয়ে গেল।
আত্মসম্মানে লাগছিল। তবুও রাত্রি রান্নাঘর থেকে বেররিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রাতুলের সামনেই শ্রাবণকে বলে বসলো- তোমার কাছে আমার একটাই রিকোয়েস্ট, এ বাড়িতে তুমি আর কখনও এসো না।
নিস্তরঙ্গ পুকুরে ঢিল পড়লেও তরঙ্গ ওঠে বইকি। তবে সেই তরঙ্গের স্থায়িত্ব আর কতটুকু? দশ সেকেন্ড, বিশ সেকেন্ড, বড় জোড় এক মিনিট! এ তরঙ্গ বড় মৃদু, শক্তিহীন। দুর্বল বৃত্তাকার ঢেউ হয়তো এক সময় কাঁপতে কাঁপতে পাড়ে এসে পৌঁছায়, কিন্তু তখন তার অস্তিত্বই অনুভব করা কঠিন। স্থির পুকুরের দিকে তাকিয়ে কে তখন বলবে, একটু আগে ঢিল পড়েছিল এখানে।
শ্রাবণের আগমন রাত্রির কাছে অনেকটাই এই গোত্রেরই। শ্রাবণকে নিয়ে এখন সে তেমন একটা ভাবে না। সে ভাবে তার স্বামী, সংসার, ছেলের কথা। তার সময় কাটছে এদের ভাবনাতেই। সময়কে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পার করছে সময়। অথবা সময় কাটছে না।
তাতেই বা রাত্রির কি এল গেল? সময়তো আর সত্যি সত্যি নিশ্চল, অনড় এক পাহাড় নয়, যেমন ভাবেই হোক সে ঠিক গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে যাবে।
যাচ্ছেও তো। একেকজন লোক আছে যাদের হঠাৎ মনে হয় পরম আশ্রয়। নিলয় ঠিক সেরকমই। সেই সময়ের কষ্টের কথাগুলো ও যখন নিলয়কে বলতো, সহানুভূতি, সমবেদনা সব তখন ওর কাছ থেকেই পেত।
বুকের মধ্যে এই অশান্তি আর কষ্ট চাপা রাত্রির কোনও কোনও নির্জন দুপুর সেসব কথা মনে পড়িয়ে দিয়েই ওর চোখে পানি এসে যেত। এমন একটা স্বপ্রসঙ্গের দিন ওর জন্য অপেক্ষা করে আছে কোনও দিন কল্পনা করেনি। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল যেন, প্রেম ভালবাসা ছাড়াও যে পার্থিব জীবনে আরও কত কী আছে, তার কিছুই তখন চোখে পড়েনি। রাত্রি তখন ভালবাসার অন্ধ গলিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। শ্রাবণকেও ভাল করে বুঝে ওঠার মত দৃষ্টি ছিল না।
ছোট ছোট ঘটনা, একটুকরো বাঁকা কথা, সামান্য তাচ্ছিল্য মেয়েদের মনে কখন কী যে জ্বালা ধরিয়ে দেয়, নিজের কাছেই নিজেকে ছোট করে দেয় তা বোঝার মত বোধশক্তি শ্রাবণের ছিল কিনা সন্দেহ হয় রাত্রির।
শ্রাবণের কি দোষ দেবে, বিয়ের পর মাত্র এই কটা দিন এর মধ্যেই ওকে কেন সব ছিঁড়ে ফেলে বেরিয়ে আসতে হল তা কি কেউ বুঝবে? অন্য কাউকেও বোঝাতে পারবে! যার বুকের মধ্যে জ্বালা সেই বোঝে, আর সকলেই উপদেশ দেন, মানিয়ে নে, মানিয়ে নে, যেমন রাত্রি নিজেই মানিয়ে নিতে চায়নি।
মদ খেলে মাতলামি করতে করতে বাড়ি ফিরে বউকে ধরে পেটালেই লোকে সেই অসহায় বউটার জন্যই সহানুভূতি জানায়, কষ্ট পায়, সাহস জুগিয়ে বলে, আছিস কেন; বেরিয়ে যা। শারীরিক নির্যাতনই যেন একমাত্র নির্যাতন। আগুনে পোড়া খুব কষ্টের, কিন্তু মনের ভেতরের আগুন যখন কাউকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে থাকে, তার কষ্ট বাইরের কেউ টের পায় না। বোঝেও না হয়ত।
সেই অসহ্য দাহ থেকে মুক্তি পাবার জন্যই তো রাত্রি সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আশা করেছিল জ্বালাটা একদিন নিবে যাবে, নেবেনি।
– আমাকে যদি তোমার এত অসহ্য লাগে তা হলে তখন বিয়ে করার জন্য পাগল হয়েছিলে কেন?
এই কথাটাতো রাত্রির নিজেরও প্রশ্ন, নিজেই নিজেকে করেছে বহুবার। কিন্তু শ্রাবণের কাছ থেকে প্রশ্নটা আসতেই রাগে ফেটে পড়ে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিল, কারণ তখন জানতাম না তুমি এত নিচ।
রাত্রি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল এ বিয়ে ভেঙ্গে যাবে, ভেঙ্গে ফেলাই উচিত। তবু একটা সঙ্কোচ, একটা লজ্জা ছিল। কেন সঙ্কোচ, কেন লজ্জা তা হয়ত শ্রাবণও জানতো। তাই হয়ত ওর বিশ্বাস গড়ে উঠেছে, নতুন বউ, বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে ফিরে যাবার সাহসই হবে না। কারণ এখন আর ওর ফিরে যাবার কোনও ঠিকানা নেই। এক এক সময়ে অবশ্য রাত্রি নিজেরই সন্দেহ হয়েছে, শ্রাবণের এই উদাসীন শান্ত ব্যবহারের মধ্যে আসলে রাত্রির কাছ থেকে ছাড়া পাবার একট আগ্রহ লুকিয়ে নেই তো? এই বাড়িটাকে ও কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিল না। ওরাও কী ভেবেছে রাত্রিকে এ বাড়িতে মানায় না।
রাত্রি এতদিন তার বাবা-মা’র কথা চিন্তা করেই বেরিয়ে আসতে পারেনি। কিন্তু যখন আর সহ্য করতে পারছিল না, তাই বেরিয়ে এসেছিল ও বাড়ি থেকে।
ইচ্ছে করলে শ্রাবণের জন্য একটা ছোট্ট চিঠি রেখে দিয়ে আসতে পারত, কিন্তু সেটা করেনি। বাইরে এসে ফোনের দোকান থেকে ফোন করেছিল। রিসিভারটা মুখের কাছে এনে, দোকানের লোকটাকে দেখে নিয়ে রাত্রি বলল- আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি, ফিরে যাওয়ার আর প্রশ্ন ওঠে না।
ও প্রান্তে শ্রাবণ কয়েক সেকেন্ড একেবারে চুপ। এরকম একটা কথা হঠাৎ শুনতে হবে হয়ত ভাবেনি। তারপর শান্ত গলা- কি পাগলামী করছ।
রাত্রি বলল- আমি বাড়ি থেকে ফোন করছি না, বেরিয়ে এসে রাস্তার বুথ থেকে ফোন করছি। আবার কয়েক সেকেন্ড চুপ। তারপর শ্রাবণের গলা। বাড়ি ফিরে যাও, অফিস থেকে ফিরে সব শুনবো।
উত্তরোত্তর রাগ করছিল রাত্রির, অসহায় লাগছিল, কারণ এই সরল কথাটা ও কিছুতেই শ্রাবণকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। রাত্রি নিজেকে সংযত করল, ও একটুও রাগবে না। ধীরে ধীরে বলল, ভুল আমারই। বন্ধুরা, সবাই বারণ করেছিল শুনিনি, বাবা-মা’র কিরকম আপত্তি ছিল তাও তুমি জানো।
শ্রাবণের কণ্ঠস্বর বিব্রত। বলল, অফিস থেকে কথা বলা অসুবিধে, তুমি ফিরে যাও, সব শুনবো তখন।
রাগের মধ্যেও রাত্রির হাসি পেল। লোকটা মানে শ্রাবণ ভাবছে এরপরও আগেরমত ধানাইপানাই করে ওকে শান্ত করা যাবে। রাত্রি এবার গলায় একটু রূঢ়তা আনল। বলল, অত সময় নেই, আমি বাবার বাড়িতে যাচ্ছি না; কোন মুখে যাবো। কিন্তু যেখানেই যাই তোমার কাছে ফিরে আসবো না। তোমার কাছে একটাই রিকোয়েস্ট, তুমি আমার খোঁজ করবে না। আমি চাই না, বাবা-মা জানুক … এখনই … কষ্ট পাবে।
ওপ্রান্ত এবোরে চুপ।
রাত্রি বলল, কী কথা দিচ্ছ তো?
কোনও উত্তর শোনা গেল না। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে রিসিভার নামিয়ে রাখর রাত্রি। আর সঙ্গে সঙ্গে মনে হল ওর চতুর্দিকে শুধু একটা বিরাট শূন্যতা। এতক্ষণ তার আভাসটুকুও পায়নি। কারণ মাথার মধ্যে এতক্ষণ একটাই চিন্তা ঘুরছে। একটাই দুশ্চিন্তা। বাবা-মা। একবার মনে হয়েছিল সটান বাবা-মা’র কাছে ফিরে যাবে। মেয়েদের কাছে ফিরে যাবার জায়গা তো একটাই।
(চলমান…)
(পর্ব-৩)
সেন্টের শিশিটা নিয়ে নেড়েচেড়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল- কোথায় পেলে? ভাইয়া কিনে দিয়েছে?
রাগ চাপতে হয়েছিল রাত্রিকে- না, বাপের বাড়ি থেকে এনেছিলাম, বিয়েতে দিয়েছিল।
একটু হেসে মিথ্যে করে বলতে হয়েছিল, ভুলে গিয়েছিলাম। আজ হঠাৎ পেয়ে গেলাম।
নিশি বিশ্বাস করেনি বোধহয়। ভেবেছিল ওর ভাই ভালবেসে কিনে দিয়েছে। রাগ সে কারণেই। বিদেশী? খুব দাম তাই না? একটু থেমে বলেছিল, তবে আজকাল চেনার উপায় নেই, এত জাল বেরিয়েছে এসব।
মনে মনে রাত্রি তখন বলছে, আমার বাপের বাড়ি থেকে দেয়া জাল তো হবেই। ড্রেসিং টেবিলে দুতিনটে সেন্টের শিশি পড়েই থাকতো, কিন্তু তার পর থেকে নিশি মাঝে মাঝেই এসে বলতো, তোমার সেই বিদেশীটা কই!
দিতে হত। ঢেলে নিয়েছিল কোন শিশিতে, নাকি যথেচ্ছ ব্যবহার করেছিল, হঠাৎ একদিন ফেরত দিয়ে গেল, তলানি একটুখানি পড়ে আছে। দেখেই অবাক হয়ে ও নিশির মুখের দিকে তাকিয়েছিল, তারপর বেশ রাগের গলায় বলেছিল, ওটা আর ফেরত দিচ্ছ কেন, তুমিই নিয়ে নাও।
নেয়নি, ঠিক করে শব্দ হল, ওটা নিশির রাগ, টেবিলে রেখে চলে গিয়েছিল সে। আর রাত্রির চোখে তখন জল এসে গিয়েছিল। মনে পড়ে গেছে হাত খালি হওয়া, বাবার চোখেও যেন জল এসে গিয়েছিল, মার্কেটিং করতে গিয়ে মা-মেয়ে সব টাকা খরচ করে এসেছে শুনে। তখনও কত কি বাকি, বিয়ের রাতটাও।
এখন রাত্রি নিশির ব্যবহার পছন্দ করে না ঠিকই, দুজনের মাঝখানে একটা দূরত্ব গড়ে উঠছে। মাঝে মাঝে নিশির জন্য রাত্রির মায়া হয়। ও তো একটা সাধারণ মেয়ে, না রূপ না গুণ। চেষ্টা করলেও চাকরি পাবে কোথায়। যথেষ্ট বয়স হয়ে গেছে। জীবনটা কাটাবে কিভাবে? নিশি আগে ক্যাসেট ছেড়ে গান শুনতো, আজকাল শোনে না। সবকিছুই যেন ওর কাছে বিষাদ হয়ে গেছে।
রাত্রি হঠাৎ একটা স্বপ্ন দেখতে চাইলো। ওর অনেক টাকা হয়েছে। অনেক টাকা। আঃ সত্যি সত্যি যদি তা হত, ও মনে মনে ভাবলো, তা হলে আর টাকার জন্য নিশির বিয়ে আটকাবে না। ওর বিয়ের জন্য যা লাগে রাত্রি দিয়ে দেবে। নিশির জন্য মায়া, নাকি নিজেই পরিত্রাণ চাইলো? বিয়ে দিতে পারলে একটু নিশ্চিন্ত হওয়া। শাশুড়ি একদিন বলেছিল, তোমাদের কোন চিন্তা নেই, শ্বশুরের না হয় বয়স হয়েছে তোমরা তো একটু চেষ্টা করতে পারো।
যেন দোষ রাত্রির। দেখতে তো পাচ্ছে ছেলেকে নিয়ে ও কি রকম নাজেহাল। নিলয়কে যে অফিস যাওয়ার সময় নিজের হাতে খেতে দিবে তারও উপায় নেই। রান্নার লোকের ওপর ছেড়ে দিয়ে ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যেতে হয়। আর নিলয় ন’টার মধ্যে অফিস, ফেরে ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যার পর।
দুয়েকবার বিজ্ঞাপন দিয়েছিল নিশির জন্য। কিছুই তো হলো না। কখনো পছন্দ হয় না, কখনো টাকা পয়সায় আটকায়। দুয়েকজায়গায় নিশি কিংবা শাশুড়ির আপত্তি।
নিশির বিয়ে দিতে পারলে ও নিজেই তো নিস্তার পেত। বিয়ের পর সব মেয়েরই ভেতর একটা স্বপ্ন থাকে, স্বামী পুত্র নিয়ে একটা পৃথক সংসার। রাত্রিরও ছিল। ভেবেছিল কোন একদিন নিলয়কে নিয়ে অন্যত্র উঠে যেতে পারবে। এখন আর ভাবে না। আর্থিক অসুবিধে নেই, কিন্তু জেনে গেছে নিলয় কোনদিনও এই সস্তা ভাড়ার বাড়িটা ছেড়ে যেতে চাইবেনা। রাত্রি নিজেও বোধহয় কেমন একটা মায়ায় জড়িয়ে গেছে। কিংবা মায়া নয়, অভ্যাস।
প্রথম যেদিন নিলয়ের বেতনের টাকা রাত্রির সামনেই শ্বাশুড়ির হাতে তুলে দিয়েছিল সেদিন বুকের কোণে একটু খিচ করে লেগেছিল ঠিকই, তবু মনকে সান্তনা দিয়ে বলেছিল, আমি তো তখন নতুন বউ, এতদিনতো মাকেই দিয়ে এসেছে, হয়তো লজ্জা। ভেবেছিল কোন একদিন বলবে, কিংবা নিলয়ই ওর হাতে তুলে দিয়ে বলবে, যা লাগে মাকে দিয়ে দিও।
বলেনি, স্বামীর উপার্জনের টাকাটা রাখার অধিকারটুকু না থাকলে ভিতরে ভিতরে নিজেকে কত ছোট লাগে ওরা বোধহয় বোঝে না। আর সেজন্যই রাতুলকে গোসল করাতে গিয়ে সাবান ফুরিয়ে গেছে দেখে নিশিকে ডেকে নতুন সাবান চাইতে হয়। প্রথম প্রথম চাইতেও লজ্জা হত, শ্বাশুড়ি না বলে বসে, এইতো সেদিন বের করে দিলাম একটা। সে কথা ওরা বলেনি কোনদিন, তবু একটা আশঙ্কা ছিলই। তাই চাইতে ভয় পেত, এখন আর পায় না। এখন আর ওসব ভাবে না। ও জেনে গেছে এই বাড়িটাই ওর বর্তমান, এটাই ওর ভবিষ্যৎ।
রাত্রি জানে নিলয় এ সময় বাড়ি ফিরবে না। বেশ রাত করেই ফিরবে, এবং কিছু একটা অজুহাতও দেখাবে। সেটা বিশ্বাসযোগ্য না ঠেকলেও রাত্রির ভ্রু কুচকে উঠবে না, আবার ঠোঁটে একটা অবিশ্বাসের মৃদু হাসিও ঝিলিক দিয়ে যাবে না।
আসলে এই একটি দিন রত্রির কাছে বড় অস্বস্তিকর। সমস্ত ব্যাপারটাকে নিলয় যদি স্বাভাবিক করে নিতে পারতো তাহলে অস্বস্তি থাকতো না। কিন্তু নিলয়ের এই ইচ্ছাকৃত অনুপস্থিতি শুধুই যে অস্বস্তিকর তাও নয়। নিলয় থাকলে ওকে কেমন একটা জড়তা যেন পেয়ে বসে। নিজেকে ঠিক তেমন স্বাধীন মনে হয় না।
দরজার বেল শুনেই বুঝতে পেরেছিল, শ্রাবণ।
বসো, পাঠিয়ে দিচ্ছি।
রাতুলকে ডেকে নিয়ে রান্নাঘরে চলে এসেছে। এ সময়ে কাজের মেয়েটা থাকে না। তাই চা নিজেই বানাতে হয়। নিলয় চা পছন্দ করে, কফি একেবারেই নয়। রাত্রি নিজেও চায়ের ভক্ত, তবে খুব শীত পড়লে কখনও সখনও যে কফি খায় না তাও নয়। একটা ছোট প্যাকেট কফি এনে রাখে মাঝে মাঝে, নিলয়ের হয়তো চোখেও পড়েছে। কী ভেবেছে কে জানে।
না, ওটা মাসকাবারি বাজারের লিস্ট করার সয়ম ও ইচ্ছে করেই লেখে না। কেন লেখে না সেটা ওর কাছে রহস্য। ‘কফি’ শব্দটা দেখলেই কি নিলয় অবাক হবে? কিছু প্রশ্ন করবে? আর করলেই বা! শুনে নিশ্চয়ই মুখ গোমড়া করবে না। তবু ওই ছোট একটা প্যাকেট ও নিজেই কিনে আনে। সকালেই নিলয়কে বলেছে, আজ শ্রাবণের আসার কথা।
খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলে নিলয় শুধুই বলল- ও।
রাত্রি তখনই রান্নাঘরে এসে দেখে নিয়েছে খোলা প্যাকেটে কতটা কফির গুড়া আছে। আছে। দুধ? হ্যাঁ, তাও। রান্নাঘরে স্টোভ জ্বেলে দুধ গরম করতে করতে শ্রাবণ আর রাতুলের অস্পষ্ট গলার স্বর শুনতে পাচ্ছিল ও। ওরা এখন সামনের ছোট্ট গ্রীল বারান্দায় বসে মশগুল হয়ে গল্প করছে। কী এত গল্প করে কে জানে।
এখন আর তেমন ভয় হয় না। প্রথম প্রথম একদিকে লজ্জা আর সংকোচ, আরেকদিকে ভয়। এই রাতুলকে নিয়েই। ভেতরে ভেতরে একটা চাপা রাগও কী ছিল না।
কফির কাপটা শ্রাবণের সামনে নামিয়ে রাখতেই শ্রাবণ রাত্রির দিকে মুখ তুলে এক পলক তাকিয়ে কফির কাপটার দিকে চোখ নামিয়ে বলল, বসো।
– আসছি। বলেই রাত্রি সরে গেল, যেন ওদিক কোনও সাংসারিক কাজ পড়ে আছে। অথচ একেবারে যে বসার ইচ্ছা হল না তাও নয়।
মাকে চলে যেতে দেখে রাতুল বলে উঠলো, বসো না মা।
– আসছি, আসছি। ফিরে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল রাত্রি। কিছু একটা কাজ নিয়ে নিজেকে তো ব্যস্ত রাখতে হবে, তা না হলে ওখানে গিয়ে না বসার কোনও যুক্তি থাকে না। তাই দড়িতে টাঙানো জামা-কাপড় তুলে এনে ইস্ত্রি করতে শুরু করবে কিনা ভাবল।
একবার মনে হল শ্রাবণ নিশ্চয়ই সোজা অফিস থেকে এখানে চলে এসেছে। ওকে কী একটা ওমলেট করে দেবে? কী আশ্চর্য, এটা তো সাধারণ ভদ্রতা, এতক্ষণ ওর মনে হয়নি কেন। এর আগে যখন এসেছে কফির সঙ্গে যে কিছুই দেয়নি তা তো নয়। তবে?
ওই যে সকালে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে শ্রাবণের আসার কথা শুনে নিলয় মুখ না তুলেই শুধু একটা ছোট্ট ‘ও’ বলেছিল সেটাই কী ওর মাথায় সারাদিন ঘুরছে? ওকে সঙ্কোচে টেনে রেখেছে! প্রথম প্রথম শ্রাবণ যখন আসত, নিলয় বাড়িতে থাকলে রাত্রির বড় অস্বস্তি হত। কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারতো না। কিন্তু আজ সে না থাকলেও সকালবেলায় তার নিতান্ত উদাসীন ও উপেক্ষার একটা ছোট্ট ‘ও’ শব্দ রাত্রির হাতে পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিচ্ছে কেন। নাকি ওই ছোট্ট ‘ও’ শব্দটার আড়ালে অন্য কোন অর্থ আছে! না, থাকার কথা নয়। আসলে সবই হয়ত ওর নিজেরই মনগড়া সন্দেহ।
নিলয় ভাল করেই জানে যে এখন ওর জীবনে শ্রাবণের কোন অস্তিত্ব নেই। ওর আর শ্রাবণের মধ্যে যে ক’টা বছরের তিক্ত সম্পর্ক ছিল তাও আজ রাত্রি প্রায় ভুলে যেতে বসেছে। কিন্তু এমন একটা দিন ছিল, এই সেদিনও যখন ছোট ছোট দুয়েকটা ঘটনা বা কথা মনে পড়ে গেলেই রাত্রির সারা শরীর কিড়বিড় করে উঠত, অক্ষম রাগে জ্বলে উঠত ওর ভেতরটা। সে সময় এই নিলয়ই সান্তনা হয়ে এসে হাজির হল। রাত্রি সান্তনা খুঁজছিল, না শ্রোতা, ওর ঠিক মনে নেই।
কত ছোট ছোট কথা এক এক সময় কত বড় হয়ে দেখা দেয়। একটা মানুষের পছন্দ-অপছন্দ আরেকজনের যদি ভাল না লাগে, একটু একটু করে গোটা মানুষটাকেই দূরে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। হয়তো একটু একটু করে নিজেই সরে আসে। এমন কী প্রচন্ড ভালবাসার মানুষের কাছ থেকেও।
রাত্রির সেদিনের বিষণ্ন বিবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়েই কী নিলয় কোন সমবেদনা বোধ করেছিল, করুণা করে এগিয়ে এসেছিল। না, রাত্রির যদ্দুর মনে পড়ে ও তখন ভেঙ্গে পড়া চেহারাটায় শিরদাড় সোজা করে মুখে হাসি আনতে পেরেছে। তবে ভেতরে ভেতরে বোধহয় নিজেকে নিঃস্ব ভাবতে শুরু করেছে। শিশু বয়সের রাতুলের দিকে তাকিয়ে যেমন উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা, তেমনই বড় বেশি অসহায়।
রাত্রির হয়ত এক একদিন ইচ্ছে হত একজন কেউ ওর পাশে এসে দাঁড়াক। অকৃত্রিম কোনও বন্ধু, একখানা বাড়ানো হাত যার নাম সহায়। যার কাছে অকপটে মনের সমস্ত দুঃখের কথা বলা যায়। পিঠে হাত রেখে কেউ সান্তনা দেক তা চায়নি, শুধুই চেয়েছে অসীম ধৈর্য নিয়ে ওর সব কথা কেউ শুনুক। একজন কাউকে তো মানুষের বিশেষ করে দুঃখী মানুষের সব কথা বলতে ইচ্ছা করে। সব কথা শুনে কেউ বলুক তুমি কিছু ভুল করোনি।
আর সকলেই শুধু একটা কথা শুনিয়েছে, তুই ভুল করছিস, ভুল করছিস। এখনও সময় আছে ফিরে যা।
কেউ বলেনি, এখনও জীবন আছে, ফিরে আয়।
নিলয়কে তখন কত টুকরো টুকরো কথাই না বলেছে। এইসব ছোট ছোট ব্যাপার কেন লাগে, কোথায় লাগে, আর কেন তা এত বড় হয়ে দেখা দেয় রাত্রি নিজেও বুঝতে পারে না। শ্রাবণ কফি ভালবাসে, চা একেবারেই নয়। এদিকে বাপের বাড়িতে ছোটবেলা থেকে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা রাত্রির চা না হলে চলে না। এটা এমন কিছু একটা বিপর্যয় নয়, রাত্রি নিজেও জানে।
নিজর দুঃখের প্রসঙ্গ টেনে এনে একদিন সে সব কথা নিলয়কে শোনাতে গিয়ে বলেছিল, কোথায় লাগত জানেন, এই যে আমি মনে করে রেখেছি, ওর কফিতে কতটা দুধ, ক’চামচ চিনি, ক’টার সময় ওর কোথায় কোথায় প্রোগ্রাম, অথচ ও আমার জন্য ….
নিলয় শুধু হেসে চুপ করে গেলেও ভাল ছিল, তার বদলে ও বলে উঠল, আসলে রাত্রি, তুমি আগে থেকেই তোমার ভালবাসার মানুষকে, তার সবকিছুকে অপছন্দ করে ফেলেছো। সে কারণেই ছোটখাটো জিনিসগুলো বড় হয়ে দেখা দিত।
কথাটা হঠাৎ যেন একটা নাড়া দিল রাত্রিকে। ঠিক এভাবে ও কোনদিনও ভেবে দেখেনি। খুঁজে দেখার চেষ্টা করল ঠিক কবে থেকে ও শ্রাবণকে অপছন্দ করতে শুরু করেছিল। ভালবাসার পর মানুষটাকেই কী ও অপছন্দ করতে শুরু করেছিল, নাকি ওর ওপর অধিকার খাটাতে চাইতো সেই ব্যাপারটাকেই ও পছন্দ করতে পারতো না। শ্রাবণকে রাত্রি এখন আর তেমন সহ্য করতে পারে না, না পারারই কথা, কারণ এখন ওর মনে হয় এই লোকটা ওর স্বপ্নই ভেঙে দেয়নি, জীবনটাই নষ্ট করতে চেয়েছিল। কিন্তু এখনকার ব্যাপারটা পুরোটাই ভদ্রতা।
তখন রাত্রির মধ্যে আর কী বা ছিল, শুধু নিঃসঙ্গতা ছাড়া।
না, তখন আর বাবা-মা বলত না তুই ভুল করছিস। স্পষ্ট করে ওরা না বললেও, মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারত ওরা বলতে চাইছে, তুই ভুল করেছিলি, এখন বুঝতে পারছিস তো! জীবনে এর চেয়ে আর বড় লজ্জা কি হতে পারে। কী ভুলই না করেছিল ও।
তখন ওর যে কী হয়েছিল কে জানে। শ্রাবণের নেশায় পড়ে গিয়েছিল হয়ত। মানুষটাকে আদৌ চিনতে পারেনি। নাকি নিজেকেই চিনতে পারেনি! বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব সকলেই বারণ করেছিল। কারও কথা কানে নেয়নি। মনে হয়েছে ওর চারপাশের সকলেই শত্রু।
শেষ অবধি বাবা বলেছিল, যা ভাল বুঝিস।
কত কি রঙিন স্বপ্ন দেখেছিল। বিয়েটা যে শেষ অবধি এভাবে, এত সহজে ভেঙে যাবে কল্পনাও করিনি। এক ছাদের নিচে না থাকলে কোন মানুষকেই চেনা যায় না। যত দিন না ডিভোর্স হয়ে গেছে, রাত্রির মনে হয়েছে ওকে কে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। তখন শুধুই রাগ আর ক্ষোভ তীব্র ঘৃণা। জালে আটকে যাওয়া পাখির মত ছটফঠটানি। কেমন একটা অনিশ্চয়তা আর ভয়। কোন দিক থেকে অচেনা একটা জটিলতা এসে দেখা দেবে সেই আতঙ্ক। ছাড়া পাওয়ার জন্য কি অধৈর্য ব্যাগ্রতা। এক একটা দিন যেন এক একটা বছর। যেন কতকাল রাত্রি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পায়নি। অথচ ওদের বিয়েটা এক মাসও টেকেনি।
বাবার কথাটা কানে গেল- যাঃ সব পিছুটান শেষ।
দূরে দাঁড়ানো শ্রাবণের দিকে একবারেই চোখ পড়েছিল, দ্বিতীয়বার ফিরে তাকায়নি রাত্রি। তখন ওর মনে শুধুই ঘৃণা। একটু আগে পর্যন্ত ছিল একটা দুর্বোধ আতঙ্ক। শেষ মুহূর্তে না কোনও আইনের ফাঁকে সব ভেস্তে দেয় ওই লোকটা।
(চলমান…)
(পর্ব-২)
ভাগ্যিস চলে গেছে, পিংকুকে আদর করতে গেলে না জানি খালাটা কী বলে বসত। মুখচোখ দেখলেই বোঝা যায় না। রাত্রি তবু বলল- খারাপ ভাবছিস কেন, হয়তো স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে আত্মীয়স্বনের বাড়িতে ঘাপটি মেরে আছে।
মীনা হাসল- দ্যাখ রাত্রি, ঐ বাচ্চাকে ফেলে কেউ রাগ দেখাতে যায় না। সঙ্গে নিয়ে যেত। কথাটা মিথ্যা নয়। রহস্যতো ঐখানেই। তাছাড়া পিংকুর মাকে দেখে কেমন একটা সন্দেহ সন্দেহ ওদের সকলেরই।
কিন্তু ঘটনাটা রাত্রিকে ভীষণ ভাবিয়ে তুলল, নাড়া দিল। ফেরার পথে ওযে রাতুলের হাত ছেড়ে দিয়েছিল, খেয়ালই ছিল না। রাতুল এমনিতেই হাত ধরতে দেয় না ঐ বয়সের ছেলেদের ঐ এক দোষ, ভাবে খুব বড় হয়ে গেছি। তবু জোড় করে হাত ধরেই স্কুল ছুটির ভিড় থেকেই বেরিয়ে আসতে হয়, রাস্তা পার হওয়ার সময়ও।
মন কি বস্তু, অপরের ছেলের কথা ভাবতে গিয়ে নিজের ছেলেকে ভুলে গিয়েছিল। হাত না ধরেই রাস্তা পার হয়েছে। ভাগ্যিস কিছু একটা ঘটে যায়নি। আতঙ্কের সময়টুকু পার হয়ে এসে বুকের ভেতরটা আতঙ্কে কেঁপে উঠল।
বাড়ি ফিরে এসেও কথাটা মাথার মধ্যে ঘুরছে তো ঘুরছেই। না, বাড়িতে কাউকে বলবে না। বললে বড় জোর তমালকে বলতো। নিলয়ের ছোট ভাই, সে চাকরি পেয়ে চলে গেছে বেশ কিছুকাল। বড় একটা আসেও না। ঐ একমাত্র রাত্রির দুঃখ বুঝত। শ্বশুড়-শাশুড়ি কিংবা রবিনকেও বলবে না। নিলয়কে তো নয়ই। বললে যেন নিজেই ছোট হয়ে যাবে। আর নিলয়কে বললে হয়ত বলে বসবে, তোমরা মেয়েরা সব পারো। কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠবে শুনলে। অথচ একথাই তো মীনা বলেছে মেয়েরা দেখছি সব পারে। তখন নিজেও সাঁয় দিয়েছে।
কথাটা মিথ্যা নয়, বলার মতই। কারণ পিংকুর মায়ের মত একজনই পেরেছে। খবর সেটাই। ছেলেরা যে এরকম কান্ড হামেশাই করছে, বউ ছেলেকে ফেলে রেখে অণ্যত্র সংসার বাঁধছে, সুতরাং সেটা আর খবর হবে কি করে। ছেলেরা যে সব পারে সেটা আর মুখ ফুটে বলতে হয় না।
জুতো দেখতে পেয় বুঝল শ্বশুর এখনও বেরোননি। কবে কখন বেরোবেন তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। সরকারি চাকরিতো। গরমে ঘেমে এসেছে রাত্রি। এসেই পাখাটা জোড়ে চালিয়ে দিল, রাতুলকে বললো, এখানে দাঁড়া। কি ভাগ্য, কারেন্ট আছে।
ছোট্ট একটা কথা, যখন সমস্ত জীবনটাই বিস্বাদ করে দেয়। এখন ওসব বিশেষ শুনতে হয় না, কিন্তু মনে পড়ে যায়। সেই প্রথম প্রথম। এমনই গরম, পাখা ঘুরছিল। শ্বশুড় কাকে শুনিয়ে কে জানে বারান্দা থেকে বলছিলেন তোমাদের কি চব্বিশ ঘণ্টাই পাখা লাগে!
রত্রি ভয়ে ভয়ে পাখা বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পাশের ঘর থেকে তমালের গলা শুনেছিল। হয়তো রাত্রির পক্ষ নিয়ে। পাখা যখন আছে, গরম লাগলে তো চালাবেই।
চালাতে তো বারন করছি না। একটু অসহায় শুনিয়েছিল শ্বশুড়ের কণ্ঠ। বলেছিলেন গত মাসের বিলটা দেখেছিস!
নিলয়ের ছোটভাই তমাল তখনও বেকার, কিন্তু ন্যায়-অন্যায়ে তার গলার জোর বেশি ছিল। নিলয়ের বেতন তখনো খুব একটা বলার মত নয়। নিলয় তখন তার বেতনের টাকাটা তার মা’র হাতে তুলে দিত। কত বেতন, হাতে কত পায় এসব কিছুই জানতো না রাত্রি।
ও পরে জেনেছে। শ্বশুড়ের বেতন যে তেমন নয় তাও জানে। তবু কথাটা তীর হয়ে বিঁধে আছে- তোমাদের কি চব্বিশ ঘণ্টাই পাখা লাগে! এখন আর এসব কথা শুনতে হয় না। তমাল আর বেকার নেই, নিলয়ের উন্নতি হয়েছে চাকরিতে।
তমাল মাসে মাসে কিছু পাঠায় কিনা জানার উপায় নেই। কি করেই বা পাঠাবে। নিজেরটা চালাতে পারলেই যথেষ্ট। বেতন কত তাও বলেনি তমাল, এড়িয়ে গিয়ে হেসে বলেছিল, চায়ের দোকান ছাড়া বসার জায়গা ছিল না, এখন একটা বসার চেয়ার পাবো তাই যথেষ্ট। তার আবার বেতন!
হেসে ফেলেছিল রাত্রি। বুঝেছিল ওটা মুখ ফুটে বলার মত নয়। তা হোক চাকরিতো। কিন্তু পিংকুর মায়ের ঘটনাটা কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছিল না। ছেলেটার জন্য মায়া হচ্ছিল।
রাতুলকে গোসল করাতে করাতে আবার সেই চিন্তাটাই মাথার মধ্যে ঘুরছে ফিরছে। রাতুলের গায়ে পানি দিয়ে সোপ-কেস খুলে দেখে পাতলা এক চিলতে সাবান পড়ে আছে, নতুন সাবান রাখা হয়নি। হয়তো নিলয়ই শেষ করে দিয়ে গেছে। গোসল করতে গেলে সোপ কেসে সাবান শেষ, কি শ্যাম্পুর শিশিতে তলানি পড়ে থাকলে বিরক্তি লাগে। মনে হয় আগে যে ব্যবহার করেছে সে নতুন একটা সাবান কিংবা নতুন একটা শ্যাম্পুর শিশি রেখে যায়নি কেন? বিরক্তির সঙ্গেই সেজন্য রাত্রি চেচিয়ে ডাকলো, নিশি একটা সাবান দিয়ে যাবে।
– নিশি, আবার ডাকলো সাড়া না পেয়ে।
একটু পরেই সাবানের প্যাকেট খুলতে খুলতে এল নিশি, দিয়ে চলে গেল বেশ বিরক্তির সঙ্গে। নিশি, এ বাড়ির ছোট মেয়ে, রাত্রির ননদ।
নিশির এই এক দোষ, সাড়া দেয় না। শুনলো কি শুনলো না তা জানার উপায় নেই। অথচ বেশ শুনতে পেয়েছে, সাবানটা এনেও দিল। সাড়া দিতে কি অসুবিধে কে জানে। আসলে বিরক্তি। কাজ করতে হচ্ছে বলে নয়। বিয়ে হচ্ছে না বলে।
বিয়ের আগে বাবা-মা বেশ ভয় পেয়েছিল। অবিবাহিত ননদ আছে শুনলে মেয়ের বাবা-মা আঁতকে উঠবেই। রাত্রিরও ভয় ছিল, কিন্তু উপায় ছিল না বলেই রাজি হয়েছিল ওরা। রাত্রিও আপত্তি করেনি।
বিয়ের পর কিন্তু নিশিকে ওর ভালই লেগেছিল। সব সময় কাছে কাছে ঘুরতো। রাত্রিও বেশ খুশি, একটা সঙ্গী তো গল্পগুজব করা যায়। বিয়েতে পাওয়া দু’চারটা শাড়ি, সেন্ট, ক্রিম সবই ও ব্যবহার করতে দেয় নিশিকে। অথচ দিনে দিনে কেমন একটা দূরত্ব তৈরি করে ফেলল মেয়েটা। বোধহয় ঐ একটাই কারণ, বিয়ে। কিন্তু সেটা তো রাত্রির দোষ নয়, কেন বোঝে না।
এই বয়েসের মেয়েদের নিয়ে সত্যি বড় সমস্যা। রাত্রিকে নিয়েই ওর বাবা-মা কি কম দুর্ভাবনায় ছিল। নিশি ছোটবেলায় দেখতে খুব ভাল ছিল। যত বয়স হচ্ছে তত দেখতে জানি কেমন হচ্ছে। এত সাজগোজ সত্বেও। দোষের মধ্যে রংটা একটু চাপা। ওখানেই ওর হার, ওখানেই রাত্রির জয়।
শ্বশুরের রিটায়ার করতে দেরি নেই। কি আছে না আছে একদিন আভাসে জানিয়েও দিয়েছেন ছেলেদের। সবকিছু কেটে কুটেনিয়ে যা হাতে পেতেন তা থেকে নাকি আর জমানো সম্ভব ছিল না। ভরসা একমাত্র পেনশন। কিছু হাবেভাবে বোঝা যায় ভরসা একমাত্র নিলয়।
রাত্রির এখানেই আপত্তি, এখানেই আতঙ্ক। ও এখন এ বাড়ি থেকে ছিটকে বেরিয়ে যেতে পারলেই যেন নিশ্চিন্ত। শ্বশুর একদিন রাতে খাওয়ার সময়, ছেলেদের সঙ্গে খেতে বসতেন, ওইটুকুই দেখা সাক্ষাৎ, কথা বলা, দুঃখে হেসে বলেছিলেন- এক সময় চাইলেই ঘুষ খেতে পারতাম, অনেকেই নিত, নিইনি। স্টুপিড ছিলাম তো। ছেলেরা চুপ করে ছিল। কোন কথা বলেনি।
রাত্রির ভাল লেগেছিল। বাঃ মানুষটা সৎ। অর্থ চিন্তায় এখন নিজেকে নামিয়ে আনতে চাইছে, হতাশায় স্টুপিড ভাবছে নিজেকে। বুকের মধ্যে একটা কষ্ট কষ্ট ভাব এসেছিল রাত্রির। শ্বশুরের জন্য মায়া হয়।
বলেছিলেন সেদিনই, ছেলেরা কিছু বললো না দেখে নিজেই ব্যাখ্যা দিলেন। গভর্মেন্ট যখন চায় লোকে ডিজঅনেস্ট হোক… পেনশন তো আধা মাইনে, লোকটা চলবে কি করে তা তো ভাবে না।
নিলয় সায় দিয়ে বলেছিল, জিনিসের দামতো বেড়েই চলছে। আর বেকার তমাল হেসে উঠে বলেছিল, চাকরি একবার পাই, ঘুষ নেয়া কাকে বলে দেখিয়ে দেব।
সবাই হেসে উঠেছে। হাসির কথা হলেও রাত্রি হাসতে পারেনি। শুধু নিশি টিপ্পনী কেটে বলেছিল, সব চাকরিতেই কি ঘুষ আছে, তোর যেমন বুদ্ধি!
নিশি বড় একটা হাসে না। হাসির কোন কথা হলে হেসে ওঠাও যেন অপরাধ। মেয়েটা কেমন যেন দিনে দিনে বদলে যাচ্ছে। বাড়িতে থেকেও নিজের অস্তিত্ব মুছে ফেলতে চায়। বিয়েটাই কি মেয়েদের সব, রাত্রি বুঝতে পারে না।
বাড়িটাও অদ্ভুত। সব ব্যাপারেই এক ধরনের গা ছেড়ে দেয়া অবস্থা। এক সময় নিশির বিয়ের চেষ্টা অবশ্য হয়েছিল। কিন্তু আজকাল কত কি পড়া যায়, করা যায়। কিছু একটা করলেও তো পারে। চাকরি? চাকরি আর পাবে কোথায়, কে দেবে! সেজন্যই সবাই ভাবে বিয়েটাই একমাত্র গন্তব্য। সাধারণ মেয়েদের সামনে আর কি বা পথ আছে। যথেষ্ট টাকা থাকলে হয়ত একটা বিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু তার পরের জীবনও সেই অন্ধকারে লাফ দেয়া। কতরকমই তো দেখছে শুনছে। রাত্রির নিজের জীবনই বা কী! সুখী না অসুখী নিজেই বুঝতে পারে না।
রাতুলকে খাওয়াতে বসিয়ে নিশির কথা মনে এল। একটু রাগ এবং একটু বিরক্তি ছিল। রাতুলকে গোসল করার সময় ডেকে সাড়া পায়নি বলে। সাবানটা দিয়ে গেল এমন অবহেলার সঙ্গে যেন বাড়ির লোক নয়, রাত্রির সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই।
অথচ এক সময় কত ভালবাসতো দুজন দুজনকে।
বিয়ের পর প্রথম প্রথম নিশির আব্দার ওর কসমেটিকসে ভাগ বসাতো। কিছু মনে করত না রাত্রি। দুচারটে শাড়ি পরতেও দিয়েছে, একেবারে দিয়ে দিয়েছে উপহার পাওয়া কয়েকটা ভাল শাড়ি। ও নিজেই দিয়ে দিয়েছিল নাকি শ্বাশুড়ি হাসতে হাসতে বলেছিল বলে, তা অবশ্য মনে নেই।
প্রথম রাগ সেই সেন্টের শিশি নিয়ে। সেন্টের শিশিতো টেবিলের ওপর থাকতো। সিনেমা যাওয়ার আগে সেজেগুঁজে এসে, তখন সাজতো, নিশি ওখান থেকে সেন্ট নিত। রাত্রি কিছু মনে করত না। কিন্তু একটা সেন্ট ছিল, আড়ালে আড়ালে রাখতো রাত্রি। দামি সেন্ট। বিয়ের বাজার করতে গিয়েও নিজেই কিনেছিল। তখন অনেক খরচ হয়ে গিয়েছিল, বাবা একটু হাতটান শুরু করেছে, দামী কিছু কিনলেই মা বিরক্ত হচ্ছে। বাবার কাছে ধমক খাওয়ার ভয়ে, তবু জেদাজেদী করে রাত্রি কিনেছিল ওটা, নিউমার্কেট থেকে, বেশ দামী।
ও জানত, একবার ফুরিয়ে গেলে আর কেনা যাবে না। লুকিয়ে লুকিয়ে কৃপণের মত কদাচিৎ ব্যবহার করত, নিলয়ের সঙ্গে সিনেমা যাওয়ার সময়।
তারপর ধরা পড়ে গেল হঠাৎ। নিশি দেখতে পেয়েই ছুটে এল, দেখি দেখি।
(চলমান…)