নির্বাচিত কবিতা
মানুষটা
পাখির পরে পাখি সাজাতে সাজাতে মানুষটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে-
একদিকে সাজিয়ে রাখছে অন্যদিকে উড়ে যাচ্ছে,
দেখতে ভালো লাগছে অথচ বড়ো ক্লান্ত লাগছে,
মানুষটা সুস্থ হয়ে উঠতে চাইছে, ওদিকে পাখিগুলো থাকছে না।
আগে মেঘ সাজাতে গেলেও ভেঙে পড়ত,
ঘরের দুয়ারে আগত ফেরিওয়ালাকেও আটকে রাখা যেত না
একদিকে সদাই করলে অন্যদিকে দোকানি পালিয়ে যেত-
নানাদিকে চেষ্টা করে কিছুই যখন করতে পারা যাচ্ছে না
তখন মানুষটা অশ্রু সাজাতে বসছে।
ব্যক্তিত্ব ফেটে পড়া
কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ব্যক্তিত্ব ফেটে গেছে। সকালের নরম রোদে এই ঘটনা ঘটে। অন্য দশদিনের মতোই মন দিয়ে সংসার করছিলাম। সংসার করা শেষে অফিসে যাচ্ছিলাম। অফিসে যাবার পথে রাস্তায় হাঁটছিলাম। মাঝে মধ্যে রিকসার সাথে দরদাম করছিলাম। তারপর বাসে ঝুলে অফিসে পৌঁছেছিলাম। বসের রুমে যাবার পথে দেখি ফেটে বেরিয়ে আছে ব্যক্তিত্ব। টসটসে ডালিমের মতো আকর্ষণীয় কিন্তু চৌচির। কখন ফেটেছে বুঝতে পারি না। সংসারে রাস্তায় বাসে নাকি অফিসে ফেটেছে তাও জানি না। এমনকি সেই সকালে রোদও ছিল বড় নরম।
এরপর ফেটে পড়া ব্যক্তিত্ব নিয়েই আমি বসের রুমে যেতে থাকি।
জাদুকর
একদিন এক জাদুর আসরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। জাদুকর একটা ফুঁ দিয়ে আমার হাতে থাকা গোলাপকে কাঁটা বানিয়ে দিলো। প্রথম প্রথম খুব মুগ্ধ হলাম। আশ্চর্য, একটা ফুঁয়েই আস্ত গোলাপ কাঁটা! এরপর সেই আসরেই দম বন্ধ হয়ে জাদুকর মরে গেলো। গোলাপ ফিরিয়ে আনার মন্ত্র আর জানা হলো না। শহরসুদ্ধ মানুষ আমার দিকে করুণার চোখে তাকায়, আহা, লোকটার বুকের মধ্যে কাঁটা!
সাতটি বছর, মরে যাওয়া জাদুকর আমার কাছেই ঋণী।
এই শহরে-৫
এই শহরের কুয়াশারা ঢের হয়েছে অনেক জমা,
হঠাৎ আমায় ডেকে পাঠায় এক টিকেটে দুই সিনেমা
মারবেলে আর কী বা ছিল ঘুরে ঘুরে একই ছায়া,
ফের দিয়েছে চায়ের দোকান টাউন হলের বকুল ভায়া।
আসতে হবে জ্যাম গলিয়ে মনদমোহন আবার পড়া
এই শহরের কিশোরীরা আবার দেখো কাটছে ছড়া,
জুতোর ফিতে বাঁধতে গিয়ে আড়চোখে সে তাকাচ্ছে ফের
আবার চলো ঘুরে আসি ভ্রমণ-গমন হলোই তো ঢের।
বাবার জ্বর
১
যদিও বাবা সেদিন মদ-টদ খেয়ে এসে আম্মাকে মেরেছেন। আমরা কেঁদেছি বলে আমাদেরও থাপ্পড়ে লাল করেছেন। যদিও তাঁর চিৎকারে সেদিন সমস্ত পাড়া ঘেন্নায় ছি ছি করে উঠেছিল। তবুও সেদিন বাবার গায়ে জ্বর ছিল। আমরা বাবার জ্বর নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম।
২
জ্বরগ্রস্ত পিতা আর বৃষ্টিভেজা গ্রামকে বাড়িতে রেখে রঙিন শহরে চলে এসেছি। এই শহরে আমি বহুদিন বৃষ্টিতে ভিজেছি। তবু পরীক্ষায় না আসা মুখস্থ রচনার মতো শহর আমাকে বারবার গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। শহর আমার মুখস্থ ‘বর্ষাকাল’, গ্রাম হলো আব্বার জ্বর।
আব্বার সাইকেল
আমার আব্বার একটা হিরো বাইসাইকেল ছিলো। হিরো সাইকেল আর এভারেডি টর্চ থাকা তখন মর্যাদার ব্যাপার ছিলো। আব্বার মতো মর্যাদায় উঠতে গিয়ে আমি অবশ্য রাস্তায় পড়ে যেতাম। কেননা অত উঁচু মর্যাদার উপর থেকে প্যাডেল ধরা যেত না। ফলে মর্যাদাসহ উল্টে থাকতাম। তখন লোকেরা ধরাধরি করে মর্যাদার ভিতর থেকে আমাকে উদ্ধার করতো। আব্বা পরে একটা চড় দিয়ে বলতো, অত বড় সাইকেল তুই চালাতে পারিস? তোকে আরও বড় হওয়া লাগবে না?
মা
বেনোজলে ভেসে গেছে সমস্তটা ক্ষেত
এইবারও থেকে গেল সব ধার-দেনা
জঠরে যাতনা বড় কী যে হবে কেনা
দরোজাতে ঝুলে আছে অভাবের প্রেত।
বাবার ব্যবসা আর বোনেদের পাঠ
পড়েছে কঠিন দায়ে চলেই না আর
ছিঁড়েছে গায়ের জামা-কঠিন সংসার
বেনোজলে সুখ গেছে, চুকিয়েছে পাট।
এসেছে মায়ের চিঠি, বাবা ভালো আছি
সবকিছু ঠিক আছে খুব বাঁচা বাঁচি,
চাকুরি জোটেনি বলে হয়ো না হতাশ
খুব যদি ব্যথা বাজে দেখিও আকাশ,
কিছু টাকা পাঠালাম যতটুকু ছিলো
বাঁচতে বাঁচাতে শিখো, খুব থেকো ভালো।
টেলিফোন
আপনাকে বলা হচ্ছে না
আপনি ভুল করে বৃষ্টি ফেলে গেছেন আমাদের বাড়িতে,
ফেরত দেবো দেবো করেও ওদিকে যাওয়া হচ্ছে না।
বাড়িতে অনেক কাজ,
পোষা মেঘগুলো বাচ্চা দিতে শুরু করেছে
গ্রাম থেকে অসুস্থ ঝড়েরা আসে ডাক্তার দেখাতে
দুটো অসুস্থ নদী বিছানায় পড়ে আছে
তাদের সবাইকে সামলাতে হয় একা।
এদিকে আমাদের বুড়ো পাহাড়টা প্রতিবেশীর চাঁদকে আছাড় মেরেছে
সেই প্রতিবেশী মামলা করেছে
মামলার কাজে মাঝে মাঝে আকাশে ছুটতে হয়।
তবু সময় করে আপনার বৃষ্টিকে নাওয়া-খাওয়া করাচ্ছি
উঠানে ছেড়ে দিলে ওরা মেঘের বাচ্চাদের সাথে খেলে,
দেখতে বড় ভালো লাগে
একেক সময় মনে হয়, রেখে দিই।
উপহার
তার হাতে চাঁদ সূর্যসহ একটা আকাশ তুলে দেবো বলে আকাশে আকাশে ঘুরি। সামান্য একটা আকাশ ছাড়া আমার কাছে আর কিছুই চায়নি সে। প্রতিটি বিষণ্ন বিকেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে আমাকে ডাকে। তাকে আকাশ দেবো বলে আমি আকাশে আকাশে ঘুরি।
রান্নাঘর
রান্নার সামগ্রী নিয়ে একদম ভাববেন না,
আপনার দরজায় হাজির হয়েছি আমি
আমার ভেতরে খুঁজে দেখুন-
লবণ আছে দুই চোখের ভেতরে
বুকের বাম দিকে ছুরি, চাকু এইসব,
পেটের দিকটায় রাখা আছে থালা আর বাটি।
হাতের আঙুলে কাঁটাচামুচ সাজানো, দেখুন
মুখের ভেতরে আছে ফুড কালার।
আরও কিছু লাগবে?
মস্তিষ্কের ডানে আছে রান্নার রেসিপি
আপনার চুলাটি সাজানো আছে বুকের ভেতর,
শুধু আগুন হাতে এগিয়ে আসুন
আমাকে কাটুন, থরে থরে সাজানো আছি আমি
দরকারি জিনিসটি নিন,
আমাকে রেঁধে ফেলুন ঝটপট।
ভয়
রাত বাড়ে আর বাড়ে আমার
বুড়ো হবার ভয়
চক্ষু আমার আটকে রাখে
হাজার রকম ক্ষয়।
একটা ক্ষয়ে তারা ফোটে
অন্যটাতে জ্বর
আকাশজুড়ে ফুটছে এখন
মুহুর্মুহু ঝড়।
ঝড়ের পরে ঝড়ের আগে
নয়ন ভেজায় কে
ওই যে দেখো আকাশ থেকে
খবর এসেছে।
ফেরিঅলা
সাইকেলে করে সমুদ্র এসেছে
লবণের ফেরিঅলা,
আমাদের লবণ লাগবে কি না
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জানতে চায়।
আজকাল ফেরিঅলার উপদ্রব বেড়েছে,
মেঘ আসছে পানি বেচতে
চাঁদ আসছে আলো নিয়ে,
যখন তখন বাড়ির কাছে এসে হাঁক ছাড়ে।
গতকাল এক মরুভূমি এসেছিল বালু বেচতে
মাকে জিজ্ঞেস করলাম লাগবে কি না,
মা জানালেন, এগুলো হাইব্রিড বালু
চোখে দিলে ব্যথা বেশি হয়।
মন খারাপ
প্রখর রোদেও দুপুরের যানজটের ভেতর থেকে
বেরিয়ে আসছে একেকটা মন খারাপ,
ওরা কী করে পারে কে জানে।
এত ব্যস্ততা এতটা ছোটাছুটি
তবু ঘাস থেকে শিশির খসলেই
ভেঙে যাচ্ছে চোখের সামনে আয়না,
দোকান বন্ধ করছি শাটারের শব্দ
বাইরে গাড়ির হর্ণ, পাশের দোকানে আইটেম গান
সব ছাপিয়ে মড়াৎ করে উঠছে অতীত ভাঙার শব্দ।
হাতের ভেতরে স্থির হয়ে আছে সংসারের বরফ
তবু ছলকে উঠছে চোখের তরল, কোথাও মা কাঁদছে
কোথাও স্ত্রী হাঁপাচ্ছে, সন্তান বাবা বলে দৌড়াচ্ছে-
ওরা কী করে এতটা পারে কে জানে
কাউকে বলে কয়ে আসে না, বিদায় নিয়ে যায় না
এক ফাঁকে ঘরে ঢুকে ভাঙা কাচ মুখে পুরে নেয়।
ঋণ
ঋণ বলতে আমি অর্থঋণকেই বোঝাচ্ছি
এর পাশে বৃষ্টির দিকে সিথান করে শোবো এমন ঋণ নাই।
একেকটা সিথানের নিচে জমে আছে দেনার খাতা,
গন্ধ আসছে পুড়ে যাচ্ছে চুলসহ মাথা
দরোজার কড়া নড়ছে
কেঁপে উঠছে দেনাদার হৃৎপিণ্ড-
এসবই আক্ষরিক ঋণের শব্দ ঘোড়ার ক্ষুরের মতো।
এছাড়া বৃষ্টির কাছে আমি কিছু ধার করি নি
যার জন্যে ভিখারির মতো হাত পেতে রইবো জানালার পাশে।
মহৎ কবিতা
একটা মহৎ কবিতা রাস্তায় পড়ে আছে
দেহের বিভিন্ন অংশ খুঁটে খেয়ে গেছে কারা,
গড়ানো রক্ত শুকিয়ে মানচিত্রের মত হয়েছে
দেহ থেকে অচেনা গন্ধ বাতাসে ছড়াচ্ছে।
সকালে পুলিশ এসে দেহটাকে নিয়ে গেল
রক্তের জায়গাটাকে ঘিরে দিয়ে গেল,
বলে গেল কাটা দেহটা আবার কাটা হবে
যে মরেছে তার দেহেই লেখা আছে মৃত্যুর কারণ,
তখন আমরা জানলাম, মহৎ কবিতা মরে গেছে,
কেন মরেছে সেটা পুলিশ আমাদের জানিয়ে দেবে।
তারুণদের শুভেচ্ছা বার্তা
তরুণদের মনে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা বোধের জায়গাটা সবসময়ই তুঙ্গে থাকে। নির্মোহ এই ভালোবাসা জানিয়ে সাজানো হয়েছে তারুণ্যের শুভেচ্ছা বার্তা।
যার কবিতা পড়ে অবাক হই, তাঁর নাম কবি মজনুর রহমান!
শুভ জন্মদিন প্রিয় কবি
মিকদাদ মুগ্ধ
ভাই,
জীবন,দর্শন আর মৃত্যু যখন কালো অক্ষর হয়ে সাদা কাগজে হাসে-
আমি তখন মজনুর রহমানকে পড়তে পারি।
অনিরুদ্ধ সরকার প্রথম
মজনুর ভাই আপনাকে শুভ জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
আপনি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা_ আর আপনার বায়স্কোপ এর নেশায় আমায় ছাড়ে না।
আহসান লাবিব
‘ম” তে মিষ্টি ‘ম’ তে মুগ্ধতা!ভাবছেন এমন দুই “ম’কই পাবেন!
এই রহস্যের সমাধানে আপনার দারস্থ হতে হবে অন্য আর এক ‘ম’এর কাছে!
‘ম’তেই নাম তার!হুম
ঠিকই ধরেছেন তিনি আমাদের মজনুর ভাই!
খুবই সাধারণ একজন অথচ অসাধারণ!সিম্পেলের মধ্যে গর্জিয়াসের যেন চলন্ত উদাহরণ!
জন্মতারিখে বলতে চাই সুখে থাকুন মজনুর ভাই!অবশ্য আপনি না চাইলে ও সুখ আপনাকে ছাড়বে না!আপনি যে নিজেই অনেকগুলোর মুখের হাসির কারণ!
তানভির তাকি
বইবাড়ির সৌজন্যে যাদের সাথে পরিচয় হবার পর সম্পর্ক গভীর হয়েছে তাদের অন্যতম কবি ও সম্পাদক মজনুর রহমান ভাই। কবির আন্তরিকতা, স্নেহ এবং খুব অল্প সময়ের মাঝেই ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছি। এতে যেমন লেখালেখির বিষয়ে সুবিধা হয়েছে তেমনই বড় ভাই হিসেবে আবদার করবার অধিকারও অর্জন হয়েছে।
স্বকীয়তা এবং বৈচিত্র্যময় লেখা যেমন সুনিপুণ অবয়বে ফুটিয়ে তুলেন তেমনিভাবে কবিতার গভীরতা মুগ্ধ করে পাঠকমন কে। সেজন্য তিনি অন্যদের চেয়ে আলাদা। বেমানান বায়স্কোপ তারই প্রতিফলন।বইতে বইমেলায় খুঁজে না পেলেও বইবাড়িতে গিয়ে ঠিকই খুঁজে পেয়েছিলাম।
কবিতার পাশাপাশি কোনকিছুর নাম, শ্লোগান দেয়ার বিষয়ে তিনি খুব পটু। সেইসাথে সম্পদনার কাজটাও খুব ধৈর্য আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে স্বচ্ছতার সাথে করে থাকেন।
ব্যক্তি মজনুর রহমান খুব মিশুক মনের মানুষ। তাই ওনার অগ্রজ এবং অনুজরা খুব পছন্দ করে থাকেন।এটাও একটা সফলতা মানুষের জীবনে।
কবি মজনুর রহমান ভাইয়ের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি। জন্মদিনের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো। আরো সুন্দর সুন্দর কবিতা উপহারের মাধ্যমে বেঁচে থাকুন আমাদের মাঝে।
মুহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহ্