দূর পরবাস

দূর পরবাস

তাজনিন মেরিন লোপা

২৫ মে, ২০২০ , ৬:৪১ অপরাহ্ণ

শুভ জন্মদিন প্রিয়তম সুজন

লেখক ও তার স্বামী

আকাশ ভরা মেঘ, তবুও দূরে কোথাও এক টুকরো তারার হাতছানি। ওহ আমি তো তারাই ভেবেছি ; তুমি না বললে ওটা সূর্য এর রশ্মি! কোথাও এক ফোঁটা পানিতে পড়ে ছোট্ট করে আলো ছড়িয়েছে।

দূরে প্রান্তরে এক কোকিল ডেকেই যাচ্ছিল, কি তৃষ্ণাত তার স্বর! পাহাড়ের গা ডিঙ্গিয়ে, নদী পাড় হয়ে ভেসে আসছে সে তীব্র কন্ঠ। কঠিন ভালোবাসায়ও মনে কেমন এক হাহাকার দিয়ে যায়। ভেবেছিলাম বুঝি বসন্ত আসছে; আসলে তো তা না। তুমি বললে কই আর বসন্ত তাকিয়ে দেখো শীতকালই ফুরায়নি! সত্যিই তো।

অপেক্ষা, সময়,বাস্তবতা, কিছু দীর্ঘ মূহুর্তে আমরা থমকে যাই। থেমে তো যাই না। থামতে নেই। তুমিই বললে…

দেখো, থামিনি কেউ, চলছি; চালিয়ে নিচ্ছি। কখনও অদৃশ্য তারার হাতছানিতে, কখনও প্রতারিত মিষ্টি কোকিলের কন্ঠে, কখনও ভালোবাসায় ভেসে ভেসে!

তাইতো আমাদের এক একটা জন্মদিন আসে, সময় পার হয়। আমরা শুভ করার আশা রাখি।

শুভ জন্মদিন প্রিয়তম সুজন।

তাজনিন মেরিন লোপা

শুভ জন্মদিন প্রিয়তম সুজন

তাজনিন মেরিন লোপা

১৬ মে, ২০২০ , ৮:১৭ অপরাহ্ণ

করোনা সময় অস্ট্রেলিয়া: লকডাউন ও শিথিলতা

এখন পর্যন্ত আরমিডেল নিরাপদে আছে। দুটোর পরে আর নতুন কোন পজিটিভ পাওয়া যায়নি। অনেককিছুই একটু শীথিল করে দিলো। কোভিড-১৯ এর জন্য মোবাইল অ্যাপস্ বানালো। যেখানে কোভিড-১৯ উপস্থিতি নির্ণয় করাসহ আরো নানান সহযোগিতা পাওয়া যাবে। ১১ মে এর পর থেকে একদিনের জন্য বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে। যাতে করে একদিনে একই সময়ে কম সংখ্যক বাচ্চারা উপস্থিত থাকে। ২৫ মের মধ্যে সকল স্কুল খুলে দেয়ার কথা ভাবছে নিউ সাউথ ওয়েলস গভঃ। তবে বেশিরভাগ মানুষ, যে কাজগুলো সম্ভব, তারা বাসা থেকেই অফিস করবে।

রাজধানী ক্যানবেরা প্রথম দিক থেকেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। গত দুই মাসে নতুন কোন সংক্রমণ হয়নি। এখানে এখন শরৎকাল। খুব বেশি ঠাণ্ডা এখনও পড়েনি। বাইরে বেড়ানোর জন্য খুব ভালো একটা সময়। ক্যানবেরার পরিচিত, বন্ধু-বান্ধবরা তাই বাইরে বেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্কুল এখনও খোলেনি। সব অফিস খোলেনি। আর সবখানে সোস্যাল ডিসটেন্স মেনে চলছে সবাই। বাইরে বের হয়ে দেখি রাস্তায় কতশত গাড়ি; প্রামে, স্ট্রলারে করে বাচ্চাদের নিয়ে বেড়িয়েছে, কেউ আবার পরিবারের সবাই সাইকেল চালাচ্ছে; কেউ হাঁটতে বেড়িয়েছে।

মুসলিমদের রমজান মাস শুরু হয়ে গেছে। প্রাইম মিনিস্টার সবার উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা জানালেন। আর বললেন সবাই যেন বাড়িতে বাড়িতে তাদের রমজান পালন করেন। সোস্যাল গ্যাদারিং না করার জন্য। এই ইস্টারে সোস্যাল গ্যাদারিং সামলানো নিয়ে বেশ চিন্তায় ছিলো সবাই। তবে সবাই সবজায়গায় বেশ ভালো মেনে চলেছে । এক বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল, তখন জানলাম, শুধু তাজমানিয়াতে দুটো পরিবার জরিমানা দিয়েছে । তিনজন মানুষের এক পরিবারে দুজন অতিথি আসলে; প্রতিবেশি একজন সাথে সাথে পুলিশকে খবর দেয়।

পুলিশ এসে সবার জন্য পাঁচ হাজার ডলার জরিমানা করে । এর মধ্যে একজন পনেরো বছর বয়সের নিচে ছিল বলে সবাই অনেক অনুরোধ করে। কিন্তু না পুলিশের বক্তব্য ছিল, বয়স কম বলেই তো ওকে আরও ভালো করে আইন-কানুন, জানতে এবং শিখতে হবে। আমরাও সোস্যাল ডিসটেন্স মেনেই চলছি। ছোট জায়গা, ছোট কমিউনিটি বলে আরমিডেলে বাংলাদেশীদের যোগাযোগ ভালো।

উৎসবের, আয়োজনের কোন ঘাটতি নেই। এই রমজানে সেটা আরও বেড়ে যেত। তবে এ বছর সবাই সব মেনে বাসায় বাসায় দরজায় দাঁড়িয়ে ইফতার দিয়ে, খোঁজ নেয়া হচ্ছে। মসজিদে ইফতার রেখে দিয়ে সবাইকে বলা হচ্ছে, নিয়ে যাওয়ার জন্য। পরিচিত একজনের খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। দরজার সামনে দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। পুলিশ না এসে পড়ে! যাক সেরকম কিছু হয়নি। সংক্রমণ থেকে যেমন বাঁচতে হবে; তেমন যারা বেঁচে আছি সামাজিকতাও রক্ষা করতে হবে।

শপিংমলগুলোতে প্রযোজনীয় কয়েকটা সুপারস্টোর প্রথম থেকেই খোলা। ফ্যাশন হাউজ, খাবারের দোকান, অন্যান্য দোকান বন্ধ। কে এফ সি, ম্যাকডোনাল্ড, ডমিনোজ টাইপ শপে শুধু ড্রাইভ থ্রু খোলা। মানে গাড়ি ড্রাইভ করে অর্ডার দিয়ে, পে করে খাবার নিয়ে যাবে। কেউ নামবে না, ইন্টারেকশন হবে না। তাই নিরাপদ। এখনও তাই চলছে।

দেশে আমাদের সবাই। সেখানকার পরিস্থিতি শুনেই দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যাচ্ছি। কে কোথায় কী নিয়ন্ত্রণ করছে, তা কেউই বুঝতে পারছে না।  এখানে এরকম লকডাইনে ইস্টার পার হলো। সব ঠিক না হলে হয়তো ক্রিসমাসও চলে যাবে। কিন্তু আমাদের ঈদ পার হয় না। খুব খারাপ লাগে, আমরা বুঝি আসলেই পারি না।

এখানেও অনেক কিছুই হয়। কিন্তু তা বাড়াবাড়ির আগেই নিয়ন্ত্রণের চিন্তা আসে। সিডনিতে এক অজি ভদ্রলোক এশিয়ানদের দেখে বেশ গালিগালাজ করেছিল; এশিয়ানরাই নাকি কোভিড-১৯ নিয়ে এসেছে তাই। কিন্তু এই ঘটনার আর কোন ধরণের প্রভাব পড়েনি। এরকম আরও ঘটনা ঘটেছে অনেক জায়গাতেই। কিন্তু তারপরও এখানে কেউ অসুস্থ বোধ করলে নিজেই যাচ্ছেন টেস্ট করাতে।

আমাদের বাসার বিল্ডিং এরও একজন টেস্ট করালেন। নিজেই আমাদের জানালেন। এরপর নেগেটিভ আসলো। আর আমাদের দেশে কেউ কেউ পজিটিভ আসার পরেও লুকিয়ে রাখছেন। কেউ পালিয়ে যাচ্ছে। নিজের, নিজের আপনজন কারোও কথাই ভাবছি না আমরা। পরিবারের নাকি মান-সম্মান যাবে পজিটিভ জানলে। যেখানে জান নিয়ে টানাটানি সবার সেখানে হায়! আমরা মান-সম্মান নিয়ে কতটা চিন্তিত। এর দায়ভার হয়তো আমাদেরই। কখনোও আমরা একজন আরেকজনের জন্য জান-প্রাণ দিয়ে দেই; আবার কখনোও সামান্য কারণেই কোণঠাসা করে ফেলি।

বড় অদ্ভুত আমরা। ‍ঈদে বা প্রতিমাসে, বা প্রতিদিন আমাদের নতুন পোষাক পড়া নিয়ে আমরা যতো ভাবি; লেখাপড়া, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের ভাববার সময় কম। কিন্তু আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। অস্ট্রেলিয়াতে সরকার জুলাই পর্যন্ত লকডাউন শিথিলতাসহ, সকল প্রতিষ্ঠান খোলা, বন্ধ, ও অন্যান্য বিষয়ে বেশ গঠনমূলক পরিকল্পনা করেছে। এবং তা জনগণেকে জানিয়েছে।

প্রতিদিন নিজ নিজ স্টেটের প্রিমিয়ার ও সরকারি অন্যান্য ব্যক্তিরা সংবাদ সম্মেলনে তা নিয়ে কথা বলছেন। এরপরও এখানকার মানুষগুলো নিজে থেকে খুব সাবধান থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশে শুধু এগিয়েই যাচ্ছি; যাচ্ছি তো যাচ্ছি; কীসের দিকে কোন দিকে তা কে জানে?

 

চলবে

 

তাজনিন মেরিন লোপা

জন্ম রংপুরের এক সাহিত্যানুরাগী পরিবারে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, রংপুরের জনপ্রিয় মুখ। ’যুগের আলো’ পত্রিকায় নিয়মিত লেখক হিসেবে লিখেছেন ছড়া, কবিতা, সায়েন্স ফিকশন, ছোট গল্প, লিখেছেন কলাম। ঢাকায় ‘ছোটদের কাগজ’ এ লেখক হিসাবে সক্রিয় ছিলেন। শিশু-কিশোর সাহিত্য নিয়ে ২০১৯ একুশে বইমেলায় আত্মপ্রকাশ করছেন ‘ডাইনীর ফলবাগান’, ২০২০ এ ‘অস্ট্রেলিয়ার রূপকথা’ বই নিয়ে। নৃবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  স্নাতক আর স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। বাংলাদেশে কলেরা হাসপাতালে সামাজিক গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন অনেকদিন। খুব সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল সরকার এর অনুদানে পরিচালিত ’হিপ্পি অস্ট্রেলিয়া’ নামে একটি সংস্থায় টিউটর হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। সংস্থাটি  মূলত তাদের নিজেদের কারিকুলামে কমিউনিটির ছোট শিশুদের মানসিক ও ইতিবাচক সামাজিক উন্নতির জন্য কাজ করে। বর্তমান নিবাস আরমিডেল, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া ।

 

করোনার সময় অস্ট্রেলিয়া-তাজনিন মেরিন লোপা

সুজন   দেবনাথ

১৪ মে, ২০২০ , ৫:৪১ অপরাহ্ণ

শাপোর গল্প

লেখক সুজন দেবনাথ গ্রিসের এথেন্সে বাংলাদেশ দুতাবাসের কাউন্সেলর। সেখান থেকে মুগ্ধতা ডট কমের জন্য লিখেছেন তিনি।


গ্রিসের পূব কোনায় একেবারে তুরস্কের পেটের মধ্যে একটি দ্বীপ আছে। নাম লেসবস। এই লেসবস থেকে ইংরেজি ‘লেসবিয়ান’ শব্দটি এসেছে। এই শব্দটি চালু হবার গল্পটাও অদ্ভুত। এই দ্বীপে শাপো নামে এক নারী কবি ছিলেন। তিনি ছিলেন অসীম প্রতিভার অধিকারী। সেজন্য পুরুষরা তাকে হিংসা করত। শাপো ভালবাসার কবিতা লিখতেন। পুরুষরা বলতো, সেগুলো নাকি এক মেয়ে অন্য মেয়ের প্রতি ভালোবাসার কবিতা। তারা শাপোকে বলতো লেসবসের শাপো। লেসবসের শাপো থেকে হয়ে যায় লেসবিয়ান শাপো। ইংরেজিতে এই শব্দটি নেয়া হয়েছে।

‘হেমলকের নিমন্ত্রণ’-এ এই গল্পটি আছে। সারাদিন করোনা নিয়ে আলাপ করতে করতে মন ক্লান্ত। আসুন মনকে একটু রিলিফ দেই। শাপোর ঘটনা একটুখানি পড়ি:

প্লটটা এমন – এথেন্সের গণতন্ত্রের এক নম্বর নেতা ‘পেরিক্লিস’ আর সময়ের সবচেয়ে বুদ্ধিমতী নারী ‘আসপাশিয়া’ গল্প করছে। গল্পের বিষয় গণতন্ত্রের জন্ম কীভাবে হলো সেটা। সেই গল্পের ফাঁকে আসপাশিয়া হঠাৎ শাপোর একটি কবিতা বলে।

“রক্তরাঙা মিষ্টি এক আপেল

রয়ে গেছে সবচেয়ে উঁচু ডালে

তাকে তুলতে ভুলে গেছে মালি

এখনো অনাঘ্রাত, নিবে কি তুলে?”

আসপাশিয়া মিষ্টি করে কবিতাটি বললো। এটি লিখেছেন লেসবস দ্বীপের নারী কবি শাপো। আসপাশিয়া খুবই আবেগ দিয়ে কবিতাটি বলছে। বার বার বলছে, যেন পেরিক্লিস বুঝতে পারে কবিতার এই অনাঘ্রাত আপেল আসপাশিয়া নিজে।

পেরিক্লিস বুঝার চেষ্টা করছেন। এটি একটি বিখ্যাত কবিতা। প্রেমের জন্য খুবই ভাল। যুবকদের মুখে প্রায়ই শুনা যায় কবিতাটি। তবে এই মুহূর্তে কবিতাটি  নিয়ে ভাবছেন না পেরিক্লিস। তিনি ভাবছেন কবিকে নিয়ে। এই কবিতার নারী কবি শাপোকে নিয়ে অনেক কানাঘুষা আছে। তাকে নিয়ে গুজবের শেষ নেই। মেয়েরা কিছু লিখলে সেটা নিয়ে এমনিতেই আলোচনা, সমালোচনা হয়। আর কোনো মেয়ে যদি প্রেম নিয়ে লিখে, সেটা নিয়ে পুরুষের কেমন জানি লাগে। তারা কানাঘুষা শুরু করে, কানাঘুষা থেকে তৈরি হয় গুজব। এই কথা কবি শাপো জানতো না। সে মেয়ে হয়েও প্রেমের কবিতা লিখেছে। একটা দুটা না, পুরো এক বই প্রেমের কবিতা।

শাপোর কবিতার বই প্রকাশের সাথে সাথেই শুরু হলো আক্রমণ। একটি মেয়ে প্রেমের কবিতা লিখেছে। মেয়েরা প্রেমের কবিতা কেন লিখবে? প্রেমের কবিতা লিখবে পুরুষেরা। পুরুষেরা মেয়েদের দেখে প্রেমের কবিতা লিখবে। প্রেমের কবিতা শুধুই মেয়েদের উদ্দেশ্যে লেখা হয়। তো কবি শাপো প্রেমের কবিতা লিখেছে, মানে সে মেয়েদের উদ্দেশ্যেই লিখেছে। তার মানে তার কবিতা হলো মেয়ের প্রতি মেয়ের প্রেম। ছিঃ ছিঃ, শাপো এত খারাপ? সে মেয়ে হয়ে মেয়েদের উদ্দেশ্যে প্রেমের কবিতা লিখে? সে মেয়েদের ভালোবাসে? কেউ জানতে চাইল না, শাপো কার জন্য এই কবিতা লিখেছে। সবাই বললো, কবি শাপো ছেলেদের ভালোবাসে না, সে মেয়েদের ভালোবাসে। কবি শাপোর যেখানে বাড়ি, সেই দ্বীপের নাম লেসবস। লেসবস দ্বীপের নাম থেকে মেয়ের সাথে মেয়ের প্রেম বিষয়টির নাম দিল লেসবিয়ান।

ব্যাপারটা ভাবতেই মাথা ধরে যাচ্ছে পেরিক্লিসের। মানুষ এত খারাপ?  তারা মেয়েদের কবিতাও লিখতেও দিবে না। মেয়েরা কবিতা লিখলেই গ্রিসে নিন্দা হয়। সেই ভয়ে আজ পর্যন্ত গ্রিসে কোন মহিলা কবি নেই। ভদ্র মেয়েরা কবিতা থেকে দূরে থাকে। তারা কবিতাকে ভয় পায়।

আসপাশিয়ার মনে হয় এই ভয় নেই। সে কি সুন্দর করে এ কবিতা আবৃত্তি করছে। পেরিক্লিস যখন শাপোকে নিয়ে ভাবছিল, সেই ফাঁকেও আরো একবার কবিতাটি আবৃত্তি করে ফেলেছে।

আসপাশিয়া বললো, কবিতার অনাঘ্রাত আপেল কে জানেন?

‘কে?’

‘এথেন্স। আপনার ভালোবাসার এথেন্স। আমি জানি আপনি এথেন্সকে পাগলের মতো ভালোবাসেন। গণতন্ত্রকে তার চেয়ে বেশি ভালোবাসেন।’ কথা মিথ্যা নয়। পেরিক্লিস এথেন্স আর গণতন্ত্রকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন। পেরিক্লিস এবার গণতন্ত্র নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। তিনি বুঝতে পারছেন এই মেয়ে তাকে নাচাচ্ছে।  কিন্তু কেন যেন নাচতে তার ভালো লাগছে।

আকাশে অনেক তারা। পেরিক্লিস জানালা দিয়ে আকাশে তাকিয়ে আছেন। রাতটা বড়ো সুন্দর। একটু আগেই আসপাশিয়া এই রাতকে বলেছে ‘গণতন্ত্রের চাদরের উপর নির্ঘুম রাত’।

একটি মেয়ে খাবার দিয়ে গেছে। ভুট্টার স্যুপ আর ছাগলের পা। হাল্কা মশলা দিয়ে ছাগলের পা কড়া করে ভাজা। এই খাবারের নাম পাইদাকি। আসপাশিয়ার খুব প্রিয় খাবার। সে নিজে আজ অনেক মমতা দিয়ে রেঁধেছে। পেরিক্লিস ভুট্টার স্যুপ দিয়ে পাইদাকি খাচ্ছেন।

খাওয়া শেষ হলে আসপাশিয়া বললো, গণতন্ত্রের গল্প ভুলে যেতে নাহি দেবো। বলুন, আপনার দাদু কীভাবে গণতন্ত্র আবিষ্কার করলেন।
পেরিক্লিস আবার বক্তৃতার মতো করে শুরু করলেন -গণতন্ত্র আবিষ্কার কথা…।

[ যারা বেশি জানতে চায় তাদের জন্য বলছি – শাপো সক্রেটিসের আগের প্রজন্মের নারী। তার মৃত্যু হয় খ্রি.পূ. ৫৭০ অব্দে, আর সক্রেটিসের জন্ম খ্রি.পূ. ৪৬৯ অব্দে। সক্রেটিস আর আসপাশীয়া এক বয়সের লোক। তবে সক্রেটিস আসপাশিয়াকে তার গুরু বা শিক্ষিকা বলতেন। ]

সব পাঠকের জন্য শুভকামনা। আমরা করোনাকে জয় করব। সেই সাথে নিজের অমানবিক আচরণকে জয় করব। পরমাণু তত্ত্বের জনক গ্রিক দার্শনিক ডিমোক্রিটাস বলতেন,

‘নিজের কাছে জিততে পারাই জীবনের সবচেয়ে বড় জয়।’

 

সক্রেটিসের শহর থেকে-শাপোর গল্প

সুজন   দেবনাথ

৮ মে, ২০২০ , ৯:০৯ অপরাহ্ণ

সক্রেটিসের নগরে রবীন্দ্রনাথ [ প্রথম পর্ব]

লেখক সুজন দেবনাথ গ্রিসের এথেন্সে বাংলাদেশ দুতাবাসের কাউন্সেলর। সেখান থেকে মুগ্ধতা ডট কমের জন্য লিখেছেন তিনি।


[১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ একটানা ছয় মাস ইউরোপের কয়েকটি দেশে ভ্রমণ করেন। সেই ভ্রমণ ছিলো একই সাথে সফল এবং বিতর্কিত। ইতালীতে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনীর অতিথি হয়েছিলেন বলে একদিকে কবির সমালোচনা হয়েছে, আর অন্যদিকে ইউরোপের প্রতিটি নগরে হাজারো মানুষ ছুটে এসেছে তাকে এক নজর দেখতে। সব মিলিয়ে ভ্রমণটি ছিলো রোমাঞ্চে ঘেরা। কিন্ত সেই রোমাঞ্চিত ভ্রমণের তেমন বিস্তারিত বিবরণ কোথাও নেই। এই না থাকা নিয়ে কবির নিজের আক্ষেপ ছিলো, শেষ জীবনেও তিনি এটি নিয়ে আফসোস করেছিলেন। ১৯৪১ সালে ৬ এপ্রিল তিনি লিখেছিলেন, ‘এই আশ্চর্য ইতিহাসটিকে লিপিবদ্ধ করিবার জন্য বাইরের সাক্ষ্যর প্রয়োজন আছে’। আবার এই আক্ষেপের কথা ভ্রমণসঙ্গী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ও তার স্ত্রীকে কবি লিখেছেন, ‘যা কোথাও প্রকাশ পেলো না তার দাম খুব বেশি।’ তো এই ‘যা কোথাও প্রকাশ পেলো না’, তার কিছু অংশ বের করতে চেষ্টা করেছি। সেই ভ্রমণে কবি এথেন্সে এসেছিলেন ১৯২৬ সালের ২৫ নভেম্বর। ছিলেন মাত্র নয় ঘণ্টা। আমি এথেন্সে এসে চেষ্টা করেছি সেই ভ্রমণের খুঁটিনাটি বের করতে। সেই সময়ের এথেন্সের পত্রিকা, গ্রিক ভাষায় প্রকাশিত কয়েকটি নিবন্ধ, কবির পত্রাবলী আর জীবনী ঘেঁটে গল্পের ঢঙে বলতে চেয়েছি রবীন্দ্রনাথের এথেন্স ভ্রমণ। ]

১৯২৬  সালের ২৫ নভেম্বর।

খুব সকালে এজিয়ান সাগরের গাঢ় কুয়াশা কেটে চলছে জাহাজ ‘এমপারোর ট্রাজান’। রোমের সম্রাট ট্রাজানের নামে এই জাহাজের নাম। জাহাজটি ইস্তাম্বুল নগর থেকে এথেন্সের দিকে চলছে। গন্তব্য এথেন্সের পিরাউস বন্দর। ঘন কুয়াশার ভেতর মর্মর সাগর আর এজিয়ান সাগরের বিশাল জলরাশি পার হয়ে জাহাজটি খুব সকালে এথেন্সের পিরাউস বন্দরের কাছাকাছি পৌঁছল। দূরে থেকে একটা লাইট হাইজের বাতি একটু একটু দেখা যাচ্ছে। এমনিতে এইসব জাহাজ যাত্রার তেমন কোন বিশেষত্ব নেই। সপ্তাহে তিন দিন ইস্তাম্বুল থেকে জাহাজ আসে এথেন্সে। কিন্তু আজকের এই জাহাজ ‘এমপারোর ট্রাজান’ এর আলাদা মাহাত্ম্য আছে। এই জাহাজে করে এথেন্সে আসছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী দ্যা গ্রেট টেগোর। নোবেল জয়ের পর ইউরোপে তিনি এখন সেলিব্রেটি। ইউরোপের যেখানেই যান, মিডিয়ায় শোর ওঠে – ‘শুনেছ, টেগোর আসছেন শহরে’।
জাহাজ এগিয়ে চলছে। কবি প্রতিদিনই ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যা ত্যাগ করেন। প্রভাত সূর্যের সাক্ষাৎ না করে দিন শুরু করেন না। পয়ষট্টি বছর বয়সেও এই নিয়মের কোন ব্যত্যয় নেই। আজও খুব সকালেই জাহাজের প্রথম শ্রেণীর কেবিন থেকে বের হলেন রবীন্দ্রনাথ। ঘন কুয়াশায় সূর্য দেখা যাচ্ছে না। শুধু একটা লালচে ঊষার আভা ভেসে উঠেছে পূব আকাশে। সেই আভাতেই সাগরের বুকে ছোট ছোট দ্বীপ দেখা যাচ্ছে।

অগাধ জলরাশির মধ্যে পাহাড়ের মত ভেসে আছে এক একটা দ্বীপ। কবি বুঝলেন, তিনি গ্রীসের খুব কাছে এসে পড়েছেন। দার্শনিক পেল্টো সাগরের বুকে গ্রীসের এই দ্বীপগুলো দেখে বলেছিলেন, ‘বিশাল পুকুরের মাঝে যেন কতগুলো ব্যাঙ ভেসে আছে’। এতোদিন গ্রীসের এই দ্বীপগুলো ছিলো কবির দূরের বন্ধু। প্রতিবার ইউরোপে যাবার সময় জাহাজ থেকে ইতালির আগে গ্রিসের এই দ্বীপগুলো নজরে আসতো। বামদিকে ক্রীট দ্বীপের পাহাড়গুলো দেখলেই তিনি অনুমান করতেন, তাঁর জাহাজ ইউরোপে পৌঁছে গেছে। আজ আর অনুমান নয়, সত্যিই এই দ্বীপগুলো তাঁর অনেক কাছে। স্বপ্নের গ্রীস খুব নিকটে চলে এসেছে।

কবির মনে পড়লো অনেক দিন আগে দ্বিতীয়বার ইউরোপ যাত্রার সময় এই দ্বীপগুলো দেখতে দেখতে মৃণালিনী দেবীর কথা অনেক মনে পড়ছিলো। মৃণালিনী তখন মাত্র সতের বছরের কিশোরী। আর সেই সতের বছরেই দুটি সন্তানের জননী। সেবার স্ত্রী-সন্তানদের একা রেখে ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর বন্ধু লোকেন পালিতের সাথে বিলেত যাচ্ছিলেন তিনি। যাত্রার পথে তার কেবলই মৃণালিনীর কথা মনে পড়ছিলো। জাহাজ থেকে মৃণালিনীকে লিখেছিলেন,

‘ভাই ছোট গিন্নী,

…… আমরা, ধরতে গেলে পরশু থেকে য়ুরোপে পৌঁচেছি। মাঝে মাঝে দূর থেকে য়ুরোপের ডাঙ্গা দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের জাহাজটা এখন ডানদিকে গ্রীস আর বাঁ দিকে একটা দ্বীপের মাঝখান দিয়ে চলেছে। দ্বীপটা খুব কাছে দেখাচ্ছে – কতগুলো পাহাড়, তাঁর মাঝে মাঝে বাড়ি, এক জায়গায় খুব একটা মস্ত সহর – দূরবীন দিয়ে তাঁর বাড়িগুলো বেশ স্পষ্ট দেখতে পেলুম – সমুদ্রের ঠিক ধারেই নীল পাহাড়ের কোলের মধ্যে শাদা সহরটি বেশ দেখাচ্ছে। তোমার দেখতে ইচ্ছে করছে না ছুটকি? তোমাকেও একদিন এই পথ দিয়ে আসতে হবে তা জান?’

না, মৃণালিনী কোনদিন এইপথ দিয়ে আসেন নি। ইউরোপ দেখার সাধ পূর্ণ হবার আগেই সেই চিরবিরহিনী চলে গেছে কবিকে একা রেখে। সেই সময় কবি তাকে ‘ছোট গিন্নী’ বলতেন। চিঠি লিখতেন ‘ভাই ছোট গিন্নী’ বলে। ঠাকুর বাড়ির ছোট বউ বলে আদর করে ডাকতেন ‘ছুটি’। চিঠিতে লিখতেন ‘ভাই ছুটি’। সেই ‘ছুটি’ অনেক বছর আগেই ছুটি নিয়ে চলে গেছে তাকে ছেড়ে। আজ আবার গ্রীসের এই দ্বীপগুলো দেখে কবির সেই চিঠির কথা মনে পড়লো। মনটা ভীষণ বিষণ্ণ হয়ে গেলো। এখন অমন একটা চিঠি লেখার মত একজন মানুষও তাঁর নেই। জীবনের কিছু দুঃখ কখনও শেষ হয় না, কিছু ক্ষত কোনদিনই পূরণ হয় না। তিনি কেবিনে ফিরে গেলেন। কলম হাতে নিলেন।

কবির শরীর তেমন সুস্থ নয়। দীর্ঘ ভ্রমণে ভীষণ ক্লান্ত। কিছুদিন আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। একটানা ছয় মাসের উপরে হয়ে গেলো – ইউরোপের এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরছেন আর বক্তৃতা করেছেন। ইউরোপ-আমেরিকায় তাঁর বক্তৃতার কদর আছে আর এ থেকে বেশ দু’পয়সা আয় হয়। শান্তিনিকেতনের বিপুল খরচ যোগাড় করার জন্য এই টাকাটা ভীষণ প্রয়োজন। এটা টের পেয়ে পশ্চিমের কিছু পত্রিকা ক’বছর আগে তাকে ‘ডলার কামানো বক্তা’ বলে গালি দিয়ে নানান কথা লিখেছে। কিন্তু সেই পত্রিকায়ালারা তো আর জানে না – কবি এই ডলার দিয়ে কী করছেন। পশ্চিমের গুণীরা যেখানে একবার নোবেল প্রাইজ পেলে, সেই টাকা দিয়ে বেশ আরামেই জীবন কাটায়, সেখানে এই বাঙ্গালী কবি তাঁর সব কিছু দিয়ে শান্তি নিকেতন চালাচ্ছেন। শিক্ষার জন্য ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দেশ থেকে দেশে ছুটে যাচ্ছেন। এজন্য মিডিয়ার সমালোচনা গায়ে মাখলে চলবে না। কিন্তু যেটা গায়ে মাখতে হয়, সেটা হলো – টাকার ফাঁদে ফেলে দুষ্ট লোকদের মন্দ অভিসন্ধি। এবারের ইউরোপ ভ্রমণটা শুরুই হয়েছিলো ওইরকম একটি অভিসন্ধি দিয়ে। কূটচাল দিয়ে ইতালির একনায়ক বেনিতো মুসোলিনী আমন্ত্রণ করেছিলো কবিকে।

মুসোলিনী ভীষণ ধুরন্ধর মানুষ। সে চেয়েছিলো রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে নিজের পাল্লা ভারী করতে। তখনো কবি মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদী চরিত্রের কথা ভালো করে জানতেন না। ইতালি যাবার নিমন্ত্রণ নিয়ে এলো কবির পরিচিত ইতালিয়ান অধ্যাপক ফর্মিকি। সংস্কৃত ভাষা আর বৌদ্ধ সাহিত্যের অধ্যাপক এই ফর্মিকি। তিনি লাল-ভোল দিয়ে ১৯২৬ সালের মে মাসে কবিকে নিয়ে গেলেন ইতালীতে। সেখানে শান্তিবাদী কবি সাদা মনে মুসোলিনীর অকুণ্ঠ প্রশংসা করলেন। ইতালীর ফ্যাসিস্ট পত্রিকাগুলোতে সেই খবর প্রকাশিত হলো উল্লাসের সাথে। তারা লিখলো, দেখো, এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী দ্যা গ্রেট টেগোর সমর্থন করে মুসোলিনীকে। তবে অচিরেই কবি টের পেলেন মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদী রূপ। তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হলেন মানুষের শঠতা দেখে। অধ্যাপক ফর্মিকি তাকে ঠকিয়েছে, মুসোলিনী সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাকে মঞ্চে তুলেছে। টের পেয়েই কবি ইতালি ত্যাগ করলেন। কিন্তু ভুল করে ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করার জন্য কবির মনে তীব্র অন্তর্জ্বালা শুরু হলো। সুইজারল্যান্ডে গিয়ে দেখা হলো রমাঁ রলাঁর সাথে। তাঁর কাছে ফ্যাসিজমের ভয়ংকর আগ্রাসনের কথা শুনলেন। অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। ভীষণ মনোবেদনা নিয়ে যখন ভিয়েনা পৌঁছলেন, তখন তিনি গুরুতর অসুস্থ। লন্ডনে চিকিৎসা নিলেন। চিকিৎসার পর প্রথম বক্তৃতায়ই ফ্যাসিবাদকে পৃথিবীর অভিশাপ বলে সমালোচনা করলেন। এরপর নরওয়ে, ডেনমার্ক, জার্মানি, হাঙ্গেরি, যুগোস্লাভিয়া, রোমানিয়া থেকে ইস্তাম্বুল (কনস্টান্টিনোপল) হয়ে এখন এথেন্সের পথে। এই দীর্ঘ ভ্রমণ, অসুস্থ শরীর আর বিধ্বস্ত মন নিয়ে কবি চলেছেন সক্রেটিসের নগরে।

গ্রীসের সুন্দর দ্বীপগুলো দেখে বেশ ভালো লাগলো। আবার পরক্ষণেই মৃণালিনীকে লিখা চিঠির কথা মনে পড়লো। আনন্দ আর বিষাদ নিয়ে অসুস্থ কবি কলম হাতে নিলেন। গত কয়েক মাসে তেমন কিছু লিখেননি তিনি। মুসোলিনীর চক্রান্ত তার কলমকে থামিয়ে দিয়েছিলো। এখন এথেন্সের জ্ঞানের দেবী এথিনা মনে হয় তাকে বর দিলেন। ৬৫ বছরের রবীন্দ্রনাথের মনে প্রথমে বিষাদের কথাই মনে হলো। মনে হলো, জীবনের সকল পাওয়া আর না-পাওয়া সবই মরীচিকা, সবই মিছে। তিনি লিখলেন,

‘ক্ষত যত ক্ষতি যত – মিছে হতে মিছে,

নিমেষের কুশাঙ্কুর পড়ে রবে নীচে

কী হল না, কী পেলে না,   কে তব শোধে নি দেনা

সে সকলই মরীচিকা মিলাইবে পিছে

মিছে হতে মিছে’

ততক্ষণে সূর্য উঠে গেছে। জাহাজ এথেন্সের কাছে চলে এসেছে। সকালের সূর্যের সাথে কবি জাহাজে বসে দেখলেন সুন্দরী এথেন্সকে। মুগ্ধ হয়ে তাকালেন পাহাড়-সাগর-দ্বীপ ছুঁয়ে দাড়ানো জ্ঞান প্রসবিনী রাজধানীটির দিকে। জ্ঞানের দেবী এথিনার শহর এথেন্স – দেবীর মতই সুন্দর। এ এক অপরূপ ছবি। কবি লিখলেন,

‘এই-যে হেরিলে চোখে অপরূপ ছবি

অরুণ গগনতলে প্রভাতের রবি-

এই তো পরম দান   সফল করিল প্রাণ,

সত্যের আনন্দরূপ এই তো জাগিছে

ক্ষত যত ক্ষতি যত – মিছে হতে মিছে’

চিরকাল সত্যের সন্ধান করা কবি এথেন্সকে প্রথম দেখেই সত্যের আনন্দরূপ টের পেলেন। জ্ঞানের নগরী তাকে সত্যের সন্ধান দিলো। লেখাটি শেষ করে বেশ প্রসন্ন হলেন রবীন্দ্রনাথ।

জাহাজে কবির সাথে আছেন ছেলে রথীন্দ্রনাথ আর পুত্রবধূ প্রতীমা দেবী। প্রতিমাকে কবি অত্যন্ত স্নেহ করেন। ঠাকুর পরিবারের প্রথা ভেঙে বিধবা প্রতিমার সাথে ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। এই পুত্রবধূই এখন কবির সংসারের কর্ত্রী। রথী-প্রতিমা দম্পতি নিঃসন্তান। কিছুদিন আগে একটি মেয়েকে দত্তক নিয়েছেন তারা। কবি নিজেই এই নতুন নাতনীটির নাম দিয়েছেন নন্দিনী। নন্দিনীর বয়স এখন তিন বছরের একটু বেশী। নন্দিনীও কবির সাথে এবারের জাহাজে আছে।

কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ কাজের মানুষ। সব কিছুতেই ভীষণ প্রাকটিকাল তিনি। এই ভ্রমণে তিনি সঙ্গে এনেছেন শান্তিনিকেতনের শিক্ষক গৌরগোপাল ঘোষকে। কবি এবং কবিপুত্র দুজনেই চান বাংলার কৃষকদের মধ্যে সমবায় সমিতি চালু করতে। গ্রামের মানুষদের ঋণদানের জন্য তারা অল্পপূঁজির আলাদা এক ধরনের ব্যাংক বানাবেন। সমবায় সমিতি বিষয়ে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভের জন্য রথী এবার গৌরগোপাল ঘোষকে ইউরোপে নিয়ে এসেছেন। পুত্রের এই বিচক্ষণতায় কবি খুশি হয়েছেন।

কবির সাথে আরও আছেন বিশ্বভারতীর কর্মসচিব বিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ এবং তার স্ত্রী রাণী মহলানবিশ। এই দম্পতি কবির এবারের ইউরোপ ভ্রমণের সব সময়ের সঙ্গী। ভ্রমণের সব রকম ব্যবস্থার দায়িত্ব কর্মপটু প্রশান্তচন্দ্রের উপর। আর বিদেশ বিভূঁইয়ে কবির চলমান সংসারের দায়িত্ব রাণীর। এই দম্পতিকে কবি বড়ো ভালোবাসেন। সেই কিশোর বয়স থেকেই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ রবীন্দ্র অনুরাগী। বিশ্বভারতীর শুরু হতেই তিনি কবির সাথে আছেন।

লেখাটা শেষ করে জলের উপর সূর্যের খেলা দেখছিলেন কবি। প্রতিমা দেবী কেবিনে ঢুকলেন। বললেন, বাবা, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই নাকি জাহাজ ভীড়বে। আপনাকে স্বাগত জানাতে অনেকে চলে আসার আগেই সকালের খাবার শেষ না করলে কিন্তু মুসকিল হবে। সকালের খাবার খেয়ে ঔষধ খেতে হবে।

কবি বললেন, হুম, তোমার যখন হুকুম – কী আর করব! রথী উঠেছে?

হুম, সে আর প্রশান্ত বাবু তৈরি হচ্ছে। আপনি বললেই হাজির হবে।

জাহাজের ক্যান্টিনে সকলে মিলে নাস্তা করছেন। কবি বললেন, দেখো, কী অপূর্ব এথেন্স। বড়ো সাধ ছিলো এথেন্স ভালো করে ঘুরে দেখার। পার্থেনন দেখবো, প্লেটোর একাডেমির জায়গাটা দেখতেও খুব ইচ্ছে করে। এবার মনে হয় সেসব দেখা হলো না।

কবির গ্রোগ্রাম ঠিক করেন প্রশান্তচন্দ্র। তিনি বললেন, হুম গুরুদেব। শুধু শুধু জাহাজটা ইস্তাম্বুলে এক দিন দাঁড়িয়ে রইলো।

– জাহাজের আর কী দোষ, বলো। কুয়াশা আর আমাদের অদৃষ্ট। না হলে, আমার আসার দিনই কুয়াশায় জাহাজ আটকে থাকবে কেন। ইস্তাম্বুলের জলের উপর মিছে মিছে কেটে গেল একটা দিন।

রাণী বললো, দুই দিনের সফর কেটে হয়ে গেল কয়েক ঘণ্টার। সব আশা মাটি হলো।

কবি হালকা স্বরে বললেন, ‘মিছে হতে মিছে’।

প্রতিমা বললো, বাবা, নতুন গান নাকি! আগে শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না।

কবি মৃদু হাসলেন, একটু আগেই লিখলাম। সুন্দরী এথেন্স আমার হাতে কলম তুলে দিয়েছে। এথেন্স মায়া জানে। কিন্তু শুধু মায়া দিয়েই তো হবে না। প্রশান্ত, আজকের প্রোগামের কি করলে?

প্রশান্তচন্দ্র উত্তর করলেন, গুরুদেব, যাত্রার বিলম্বের জন্য গতকালের সকল প্রোগ্রাম বাতিল করতে হয়েছে। গতকাল রাতে আপনার সম্মানে ডিনারের আয়োজন করেছিলো গ্রীসের সাহিত্য পরিষদ। এখন সেটাকে আজকের লাঞ্চ করতে হয়েছে। লাঞ্চের স্থান আগেরটাই আছে। হোটেল গ্রেট ব্রিটেন। আর গ্রীক সরকার কিভাবে পুরস্কার তুলে দেবে সেটা এখনো ফাইনাল হয়নি।

– পুরস্কারটার নাম যেন কী?

হেসে উঠলেন প্রশান্তচন্দ্র। গত কয়েক বছর যেখানেই যাচ্ছেন, সবাই পুরস্কার দিচ্ছেন কবিকে। তাই এখন আর অত ঘটা করে নাম মনে রাখার গরজ নেই কবির। প্রশান্তচন্দ্র ডায়েরী চেক করে বললেন, পুরস্কারের নাম ‘কমান্ডার অফ দ্যা অর্ডার অফ দ্যা রিডিমার’। গুরুদেব, এটা কিন্তু গ্রীসের সবচেয়ে বড় বেসামরিক পদক। এখানকার প্রেসিডেন্ট নিজ হাতে এই পদক তুলে দেন। গতকাল সব আয়োজন ছিলো। জাহাজ সময়মত না আসায় সেই প্রোগ্রাম ভেস্তে গেলো। এখন দেখি – নতুন কি ব্যবস্থা করেছে? কিছু না হলে ব্রিটিশ এম্বাসির মাধ্যমে কোলকাতা পাঠিয়ে দিতে বলবো।

আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে কবি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, এই পদক কি সক্রেটিস বা প্লেটো পেয়েছে?

সবাই হো হো হেসে উঠলো। কবি মাঝে মাঝেই এমন রসিকতা করেন। সক্রেটিসের সময় গ্রীস নামে কোন দেশই ছিলো না। সেই দেশের আবার পদক হবে কি করে!

কবি বললেন, এথেন্সের পার্থেননটা কিন্তু অবশ্যই দেখবো। সেটা কিন্তু মিস করো না। শতবার পুরস্কার নেয়ার চেয়ে একবার পার্থেনন দেখার দাম অনেক বেশি।

কবি যখন একথা বলছিলেন, জাহাজ ভীড়ার শব্দ শুনা গেলো। এথেন্সের পিরাউস বন্দরে নোঙর করলো ‘এমপারোর ট্রাজান’।

কবি মুগ্ধ হয়ে দেখলেন এথেন্সের মাটি। এই মাটিতে একদিন আলো জন্ম নিয়েছিলো। ইউরোপের সকল আলোর জন্ম হয়েছিলো এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে।

গণতন্ত্র, দর্শন, থিয়েটার, চিকিৎসা – পশ্চিমের সব কিছু এই নগরী থেকেই শুরু হয়েছে। বিস্ময় নিয়ে দেখছিলেন কবি।

২.

পিরাউস বন্দরে অনেক ভোর থেকে গ্রিসের কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকরা বসে আছে কবিকে স্বাগত জানাতে। অনেকেই গতকাল থেকে অপেক্ষা করছে। জাহাজ মাত্র নোঙর করেছে। বন্দরের লোকেরা বললো, প্লিস, এখন কেউ জাহাজে উঠবেন না। আমরা বলা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন প্লিস। কিন্তু কবি সাহিত্যিকরা তো মুক্ত প্রজাতির প্রাণী। ওইসব বাধা নিষেধ তারা মানেন নাকি। জাহাজে উঠতে না পেরে ছোট নৌকা জোগাড় করে ফেললো। সেই নৌকায় কয়েকজন পৌছে গেলো জাহাজে। দুই দিন ধরে তারা বন্দরে অপেক্ষা করছে। গতকাল আসার কথা ছিলো কবির। তাদের আর দেরী সইছিলো না।
টেগোর নামটি এখন সারা ইউরোপ জুড়ে এক সেনসেশান।

গ্রিক কবিদের কাছেও তিনি এক রহস্য। গ্রিকরা তো জানতোই না যে বাংলা নামে একটা ভাষা আছে, একটা ভূখণ্ড আছে। তারা শুধু জানতো – গ্রিক বীর আলেকজান্ডার পারস্য জয় করে ভারতেও আক্রমণ করেছিলো। ভারতে কিছু অংশ জয়ও করেছিলো আলেকজান্ডার। কিন্তু গঙ্গারীডয় নামে এক নদীর তীর থেকে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন। সেই গঙ্গারিডয় আসলে গঙ্গা নদী। সেই নদীর অপর পাড়েই বাংলা। ইতিহাসের জনক হিরোডটাসের লেখা থেকে গ্রিকরা সেই দেশ সম্পর্কে জেনেছিলো। হিরোডোটাস লিখেছিলো – ওই দূরে ইন্ডিয়া নামে এক দেশ আছে, সেখানের মানুষ সব বর্বর, তারা কালো জাদু জানে, তাদের রঙ কালো, এমনকি সেখানের পুরুষদের শুক্রানুও নাকি কালো।

হিরোডোটাসের এই অদ্ভুত তথ্যের বাইরে ভারতবর্ষ সম্পর্কে গ্রিকরা শুধু দুইটা নতুন তথ্য জানতো। এক – এখন ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ শাসন করে, সেখানের অসভ্য মানুষদের সভ্য করছে। দুই, ভারতবর্ষে নাকি প্রাচীনকালেও কিছু জ্ঞানী মানুষ ছিলো, যাদের বলা হয় ঋষি। জার্মানরা ইদানিং সংস্কৃত ভাষায় আগ্রহ দেখাচ্ছে। অনেক জার্মান পণ্ডিত সংস্কৃত থেকে সেই ঋষিদের জ্ঞানের কথা ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করেছে। সেখান থেকে গ্রিকরা জেনেছে, প্রাচীন ঋষিরা বনে থাকতো, তাদের লম্বা লম্বা দাড়ি, তারা ঈশ্বরের সাধনা করত।

এই জ্ঞান নিয়ে গ্রিক কবি সাহিত্যিকরা একদিন শুনলো, সেই বর্বর দেশের বাংলা ভাষার এক কবি সাহিত্যে নোবেল পেয়ে গেছে। তারা তো তাজ্জব! সারা ইউরোপের সাথে সাথে গ্রিকরাও খোঁজ নিতে শুরু করলো – কে এই কবি। তারা শুনল – এই কবির নাম টেগোর। পত্রিকায় ছবি দেখলো – লম্বা চুল, কাঁচা-পাকা দাঁড়ির এক সুপুরুষ। তারা ভাবলো, আরে, এই তো সেই প্রাচীন ভারতের ঋষি। সেই একই রকম চুল-দাড়ি। তারা কবিতা পড়ল।

‘দ্যা সং অফারিংস’ বা গীতাঞ্জলী। সেখানেও ঈশ্বরের প্রেমের কথা। তাহলে তো রবীন্দ্রনাথ আর কেউ নয়। সেই প্রাচীন ঋষি। সেই রহস্য ঘেরা পুরুষ। তাকে নিয়ে তখন ইউরোপের ঘাটে-মাঠে আলোচনা। তার পোশাক দেখলো। লম্বা আলখাল্লা, কেমন এক জোব্বা-জাব্বার মত। একেবারে চার্চের পাদ্রীর উপর। দেখেছো মুখখানা কেমন যীশুর মত। আবার অনেকে ধর্মের দিকে গেলো না। তারা বললো, রবীন্দ্রনাথে চেহারা আসলে তলস্টয়ের মতো। সব মিলিয়ে টেগোর ইউরোপে একটা বিশেষ ব্রান্ড। সেই টেগোর গ্রিসে আসছেন! তার জাহাজ এখন এথেন্সের বন্দরে। গ্রিসের সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের তর সইবে কী করে। তারা নৌকা করে কাছে এসে জাহাজে উঠে গেলো।

দেশের খ্যাতিমান লোকদের এমন আচরণ নাবিকরা আগে দেখেনি। তারা জাহাজে খবর দিল। নাবিকেরা তাদের নিয়ে গেল প্রথম শ্রেণীর ডাইনিং হলে। কবি মাত্র নাস্তা শেষ করেছেন। কবি সাহিত্যিকরা তুমুল করতালী দিয়ে উচ্চস্বরে সেই ডাইনিং হলেই প্রথমবার কবিকে স্বাগত জানালো। তরুণ কবি রিনা আফগারী কবির হাতে তুলে দিলো একটি জলপাই শাখা। রীনা বললেন, মহান কবিকে এথেন্সে স্বাগত। জলপাই আমাদের গ্রিসের মঙ্গলের প্রতীক। এথেন্সের দেবী এথিনা আর দেবতা এপোলোর দুজনের হাতেই এই জলপাই শাখা থাকতো। এথেন্সে প্রথমে আসলে আমরা সবাইকে জলপাই শাখা দিয়েই স্বাগত জানাই।

কবি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে জলপাইয়ের কচি পাতা দেখতে লাগলেন। এরপর গ্রীসের সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবিকে স্বাগত জানালেন। তিনি ফরাসী ভাষায় কথা বলছিলেন। কবি স্মিত হাস্যে বললেন, কেউ কি আমাকে একটু ইংরেজী করে দেবেন।

এতোদিনে জনসভার বক্তৃতার মত করে কথা বলাটা বেশ ভালোই শিখে ফেলেছেন কবি। তিনি সমাগত সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের বললেন, আমি আপনাদের মাঝে এথেন্সে এসেছি। কী যে আনন্দ হচ্ছে। আমার সামনে আলোর নগরী এথেন্স। বিশ্বাস হচ্ছে না। ছোটবেলা থেকে ভেবেছি এখানে আসব। আজ সেই আশা পূরণ হচ্ছে। এই ভোরের শীত সহ্য করে আমাকে গ্রহণ করার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। অন্তর থেকে ধন্যবাদ।

এরপর কবিকে অবাক করে দিয়ে সেই ডাইনিং হলেই সাংবাদিকরা শুরু করলো প্রশ্ন। গ্রিসের মানুষের কাণ্ডজ্ঞান ইউরোপের অন্য দেশের থেকে আলাদা। নিয়মের অতো বাড়াবাড়ি মনে হয় এখানে নেই। যার যা ভালো লাগছে, করে ফেলছে। ডাইনিং হলেই প্রশ্ন করা শুরু করেছে। কবি দেখলেন, সত্যি সত্যিই জাহাজের ডাইনিং হলটা তার প্রেস কনফারেন্স রুম হয়ে গেছে। জাহাজের অফিসার অসহায়। অন্য যাত্রীদের অসুবিধা করে এখানেই সাংবাদিকরা টেগোরকে জেঁকে ধরেছে। নাবিকরা বাধা দিতে পারছে না। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করে যাচ্ছে –

টেগোর আপনি গ্রীসে কেন এসেছেন? টেগোর, আপনার ভাষার সাথে গ্রিসের কি কোন মিল আছে? টেগোর, আপনি কি ঋষি? আচ্ছা, প্রথম এশিয়ান হিসেবে নোবেল পেয়ে সেদিন আপনার কেমন লেগেছিলো?

কবি দেখলেন – বিপদ। কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দিবেন। তিনি কোনটারই উত্তর দিলেন না। নিজের মত করে বললেন, আমি চাই সারা পৃথিবীর মানুষ এক সুরে সুন্দরের কথা বলবে, মানুষে মানুষে কোন ভেদ থাকবে না। সেই ঐক্যের খোঁজেই আমি দেশ থেকে দেশে ছুটে যাই, সেজন্যেই ইউরোপে এসেছিলাম, এখন গ্রিসে এসেছি। এখানে আমার দীর্ঘ সময় থাকার ইচ্ছা ছিলো। এই প্রাচীন আলোর নগরীটি আমি অনেক ভালোবাসি। কিন্তু আমি ক্লান্ত। টানা ছয় মাস ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বিধ্বস্ত। ডাক্তার সাহেব বিশ্রামের হুকুম করেছেন। তাই আমি এথেন্সে থাকতে পারছি না। দেশে ফিরে যাচ্ছি। তবে আমি আবার আসব এথেন্সে। গ্রিসের ডেলফিতে তো একটা বসন্ত উৎসব হয়। আমার অনেক ইচ্ছা সেই উৎসবে যাবার।

সাংবাদিকরা টুকিটাকি প্রশ্ন করে যেতে লাগলো। তারা মুসোলিনীর নিমন্ত্রণের কথা জিজ্ঞেস করলেন। কবি বুঝলেন, উগ্রবাদী মুসোলিনীর সাথে তার অনুষ্ঠানের খবর এখানেও পৌছে গেছে। কবি ভুল করে ফেলেছেন, সেই একনায়ক শাসকের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে। তারপর যেখানেই যাচ্ছেন, সেই ভুল নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। সব দেশেই কিছু সাংবাদিক আশ্চর্য রকমের বিতর্কজীবি। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিতর্ক বের করাই তাদের কাজ। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে নিশ্বাস নিয়ে বললেন, ইতালীয়ানরা একটা স্লোগান প্রিয় জাতি। ওরা হুজুগে মেতে উঠেছে। একদিন এই হুজুগ থেমে যাবে।

সাংবাদিকদের সাথে প্রশ্নের সময় প্রশান্তচন্দ্র আর রথীন্দ্রনাথ সাহিত্য সমিতির নেতাদের সাথে কথা বলে কবির আজকের দিনের প্রোগ্রাম ঠিক করলেন। আজ বিকেলেই জাহাজ আবার ছেড়ে যাবে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার উদ্দেশ্যে।

কবি উত্তর দিয়ে চলছেন। এখনকার বিষয় ইউরোপ বনাম এশিয়া। তিনি বলছেন, ইউরোপ পৃথিবীকে অনেক কিছু দিয়েছে। কিন্ত অন্তরের সৌন্দর্য পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধের মানুষের চেয়ে পূর্বের মানুষের বেশী। এশীয়াতে আলাদা রকম প্রাণ আছে। আমি চাই, পৃথিবীর সব মানুষের আত্মা এশিয়ানদের মত হোক।

কিন্তু কবি, আমরা তো জানি, তোমাদের এশিয়ায় বিজ্ঞানের আলো নেই, সেখানে সব অন্ধ বিশ্বাস।

একটু হাসলেন রবীন্দ্রনাথ। মনে মনে বললেন, এইতো তোমার লাইনে আসছো। তোমরা যে আমাদের অজ্ঞান ভাবো, সেটা বলতে তোমার সময় লাগল। হেসে কবি বললেন, ইউরোপ শুধু বাইরের দিক দেখে, অন্তরে দেখে না। ইউরোপের শরীর আছে, আত্মা নেই। কিন্তু আত্মা ছাড়া কি শরীর বাঁচে? তাই বিজ্ঞানের যেমন দরকার, অন্তরের উপলব্ধিও দরকার। ইউরোপ সব কিছুকে যান্ত্রিক করে ফেলেছে। ইউরোপ দয়া ও প্রেমের সুন্দর ভাবকে দূর করে দিতে চায়। কিন্তু এই এথেন্স সেরকম না। এখানে একদিন সক্রেটিস, প্লেটোরা অন্তরের আলো খুঁজে বেরিয়েছে। আমি এথেন্সকে ভালোবাসি।

কবি রাজনীতি নিয়ে প্রশ্নের উত্তর করলেন না। শুধু বললেন, আমি তো কবি, রাজনীতি বুঝি না।

সাংবাদিকরা তবু ছাড়ে না। তারা মহাত্মা গান্ধীর কথা জিজ্ঞেস করলো। গান্ধীর আন্দোলনের খবর এই সুদূর গ্রীসের মানুষরাও রাখে। কবি বললেন, গান্ধী আর আমি এক দেশের লোক কিন্তু আমরা এক মানুষ নই। তিনি রাজনীতির লোক, আর আমি কবি। রাজনীতির কথা আমার মাথায় বেশীক্ষণ থাকে না।

– আপনি গ্রিস নিয়ে কী ভাবেন?

কবি যেন এই প্রশ্নটার আশায়ই ছিলেন। তিনি জানতেন এই প্রশ্ন আসবেই। তিনি বললেন, আমি চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই – একটা প্রাচীন নগর এথেন্স, এখানের রাজপথে অনেক মহৎ মানুষ হাঁটছে। তারা নিজেকে জানার কথা বলেছে, ভালো জীবনের কথা বলেছে। তারা শহর জুড়ে সুন্দর বড় বড় মূর্তি আর মন্দির করেছে। গ্রিসের নাটক-ট্রাজেডির কথাই ধরো। কী চমৎকার সৃষ্টি। আমি গ্রিক নাট্টকার এস্কিলাস আর লোকিয়ানুসকে অনেক পছন্দ করি। এস্কিলাস বলেন, আমি ঈশ্বরকে দেখেছি আর লোকিয়ানুস বলেন, আমি ঈশ্বরকে দেখিনি, কারণ ঈশ্বর নিজেই তাকে কখনও দেখেনি। এস্কিয়াস জীবন গড়তে চেয়েছে, আর লোকিয়ানুস ধ্বংসকামী।

একজন জিজ্ঞেস করলো, আর সফোক্লিস?

কবি বললেন, তিনি উপরের দুই জনের মত অতো উঁচু নয়। কিন্তু আরেক নাট্টকার ইউরিপিডিস ছিলেন যুক্তিবাদী। তবে তার যুক্তি ছিলো অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে।

ততক্ষণে জাহাজের সিঁড়ি লেগে গেছে। মানুষ নামতে উঠতে শুরু করেছে। কোথা থেকে যেন আর এক ঝাঁক মানুষ ছুটে এলো ডাইনিং হলে। তারা হতাশ হয়েছে, তাদের আগেই আর একদল আগেই কবির সাক্ষাৎকার নিয়ে ফেলছে। তারাও যোগ দিলো। কেউ কেউ কবির স্কেচ আঁকা শুরু করলো।
এতো ভীড়ে ক্লান্ত কবির তখন হাঁসফাঁশ করছেন।

এবার প্রশান্তচন্দ্র এগিয়ে এলেন। তিনি সাংবাদিকদের বললেন, জাহাজ থেকে নামার সময় হয়েছে। এবার কবিকে একটু সময় দিন। আমরা তৈরি হয়ে আসি।

 

সুজন দেবনাথ

লেখক ও কূটনীতিক। বর্তমানে এথেন্সে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর। এথেন্সের ক্ল্যাসিকাল সময়ে সক্রেটিস, প্লেটো, হেরোডটাস, সফোক্লিসদের নিয়ে সাহিত্য, থিয়েটার, ইতিহাস, দর্শন, গণতন্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্রসহ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্মকথা বিষয়ে তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘হেমলকের নিমন্ত্রণ’। তিনি অব্যয় অনিন্দ্য নামে লেখালেখি শুরু করেন। এই নামে তার কবিতার বই ‘ বই খারাপের উঠোন’ এবং গল্পের বই ‘কীর্তিনাশা’। তার রচনা ও পরিচালনায় ২০১৮ সালে গ্রিসে নির্মিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম ইংরেজি গান ‘ মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে’।

 

সক্রেটিসের নগরে রবীন্দ্রনাথ

সুজন   দেবনাথ

২৩ এপ্রিল, ২০২০ , ৪:৫৫ অপরাহ্ণ

সক্রেটিসের শহর থেকে ৩

লেখক সুজন দেবনাথ গ্রিসের এথেন্সে বাংলাদেশ দুতাবাসের কাউন্সেলর। সেখান থেকে মুগ্ধতা ডট কমের জন্য লিখেছেন তিনি।


গতকাল গ্রিসের এক প্রফেসরের সাথে কথা হচ্ছিল। বিষয় – গ্রিস কিভাবে করোনা ঠেকাতে সফল হচ্ছে। প্রফেসর সাহেব মজা করে বললেন, ‘আমরা তো হাজার বছর ধরে মহামারি চিনি। আমরা জানি কি করতে হয়’। কথাটা মিথ্যা না। গ্রিক সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত দুটি বই – হোমারের ‘ইলিয়াদ’ আর সফোক্লিসের ‘রাজা ইডিপাস’ দুটোই শুরু হয়েছে মহামারি দিয়ে। তাই গ্রিকরা পিচ্চিকাল থেকেই জানে – মহামারি কত খারাপ জিনিস।

» কিন্তু গ্রিকরা হাজার বছর ধরে মহামারির কথা জানলেও, করোনার কথা কি জানে? করোনা একেবারে নতুন জিনিস। এটা নিয়ে কেউই কিছুই জানে না। তা সত্ত্বেও গ্রিস এখন পর্যন্ত খুবই সফল। ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত গ্রিসে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২২২৪ জন, মারা গেছেন ১০৮ জন। গত দুই দিনে ১৫ জন করে নতুন আক্রান্ত হয়েছে।  যেখানে ইউরোপের ধনী দেশগুলোতে দেড় লাখের উপরে করে আক্রান্ত, সেখানে গ্রিস অবশ্যই অনেক অনেক সফল। তো এবার দেখি – এই সফলতার কারণ কি?

» করোনা মোকাবেলায় গ্রিসের সাধারণ এপ্রোচ অন্যান্য দেশের মতোই। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টায় টিভিতে দুইজন লোক আসেন। একজন হলেন – হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা সংক্রামক রোগের প্রফেসর মি. সতিরিস। তিনি খুবই মিষ্টি ভাষায় করোনার আপডেট বলেন। কতজন আক্রান্ত, কতজন মারা গেলো এসব জানান। তারপর ছোট ছোট বাক্যে অনুরোধ করেন, ‘আপনার মা-বাবাকে বাঁচান, দাদা-দাদীকে বাঁচান, প্লিস আমাদের কথা শুনুন’। এটা করুন, ওটা করবেন না এসব।  প্রফেসরের কথা শেষ হলে মাইক্রোফোন নেন সিভিল প্রটেকশান ও ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট এর ডেপুটি মন্ত্রী। তিনি কড়া করে বলেন, ‘অবস্থা খুব খারাপ, আপনারা অবশ্যই ঘরে থাকুন’। এভাবে একজন নরম আর একজন গরমে জনগণকে ব্রিফ করেন। মানুষ ওনাদের কথায় ভরসা পায়। বিশেষ করে প্রফেসর সাহেবের একটা আন্তরিক ও সিনসিয়ার ভঙ্গি আছে, যেটি তাকে খুবই জনপ্রিয় করে তুলেছে। গ্রিসের আলফা টিভির এক জরিপে এই প্রফেসর সতিরিস এখন গ্রিসের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি। মানুষ ওনার কথা শুনছে।

» করোনা পরস্থিতিকে গ্রিক সরকার একেবারে প্রথম থেকেই খুব সিরিয়াসলি নিয়েছে। টানা ১০ বছর ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে ছিলো গ্রিস। সেই সংকটের প্রথম দিকে অর্থনীতির পণ্ডিতদের কথা সরকার শোনে নি। সেই না শোনার মাসুল পুরো গ্রিক জাতি দশ বছর ধরে দিয়েছে। তখন গ্রিক সরকার ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আর আইএমএফ এর সাথে টাকার জন্য প্রায় যুদ্ধ করেছে। তাই তারা বুঝেছে – বিপদে পড়লে বিশেষজ্ঞদের কথা শোনা জরুরি। করোনা পরিস্থিতিতে তারা বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি টিম করেছে। যে টিমের হলেন প্রধান হার্ভার্ড থেকে থেকে পাশ করা মিষ্টভাষী প্রফেসর সতিরিস। তিনিই প্রতিদিন সন্ধ্যায় ব্রিফ করেন।

» গ্রিকরা জানে তারা গরীব। দশ বছর ধরে বাজেট কাটতে কাটতে সব সেক্টরের মতো স্বাস্থ্যখাতও খুবই দুর্বল। তাই তারা প্রথম থেকেই প্রতিরোধের দিকে গিয়েছে। জানুয়ারিতেই এয়ারপোর্টে স্ক্রিনিং শুরু করেছে। চীন থেকে আসা ফ্লাইটগুলোকে পরীক্ষা করা শুরু করেছে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে কার্নিভাল অনুষ্ঠান বাতিল করেছে। স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে ১০ মার্চ থেকে। ২৩ মার্চ থেকে লকড-ডাউন। খুব কড়া লকড-ডাউন। বাইরে বের হবার আগে কেন যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে সেটা লিখে একটা নম্বরে SMS করে তারপর বের হতে হবে। বিনা প্রয়োজনে বাইরে ধরলে ১৫০ ইউরো জরিমানা। একটি গাড়িতে ড্রাইভারের সাথে মাত্র একজন, মানে গাড়িতে ২ জনের বেশি চলতে পারবে না। বিনা অনুমতিতে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা অফিস খুললে অনেক বড় টাকার জরিমানা। রেস্টুরেন্ট বন্ধ, শুধু হোম ডেলিভারি চালু।

» সকল সরকারী অফিস বন্ধ, শুধু চালু আছে একটা ডিজিটাল গভর্নেন্স পোর্টাল। জরুরি সিদ্ধান্তের জন্য মন্ত্রীদের মোবাইলে ডিজিটাল সিগনেচার দিয়েছে। এই অনলাইন ডিজিটাল পোর্টালে তারা চিকিৎসা ব্যবস্থা যুক্ত করেছে। কে কোথায় আক্রান্ত হচ্ছে, কোথায় কি যন্ত্রপাতি আছে, সেটা ডিজিটাল উপায়ে খুব সহজেই পাওয়া যাচ্ছে। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারছে। প্রত্যেকের ট্যাক্স নম্বরের সাথে মেডিকেল সিস্টেম যুক্ত করেছে। তাই ডাক্তারের কাছে না গিয়েও ডাক্তারকে মোবাইলে জানালেই ডাক্তার অনলাইনে প্রেসক্রিপশন আপলোড করে দিতে পারছে। ডাক্তারের ফি ট্যাক্স নম্বর থেকে অটো কেটে যায়। ঔষধের দোকানে ট্যাক্স নম্বর দিলেই দোকানদার অনলাইন প্রেসক্রিপশন দেখে ঔষধ দিয়ে দিতে পারে, ঔষধের দামও ট্যাক্স নম্বর থেকে যায়। এই অনলাইন ব্যবস্থা চিকিৎসাকে দ্রুত করেছে। দ্রুত খবর পাচ্ছে, দ্রুত কোয়ারেন্টাইন হচ্ছে, প্রয়োজনে দ্রুত হাসপাতালে নিতে পারছে। গ্রিক সরকার বলছে, এই অনলাইন প্লাটফর্ম তাদের ডিজিটাল ওডিসি। মহাকবি হোমারের ওডিসিতে যেমন নায়ক ওডিসিয়াস দীর্ঘ কষ্টের পর ইথাকা দ্বীপে ফিরতে পেরেছিল, তেমনি এই ডিজিটাল পথে তারা করোনা মোকাবেলা করবে।

» গ্রিসে সরকার সফল, কারণ মানুষ ঘরে থাকছে। মানুষ কেন মানছে? টানা ১০ বছর অর্থনৈতিক সংকটে তারা দেখেছে, সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি না করলে, জীবনে কী ভয়াবহ দুর্যোগ আসতে পারে। বাড়ি, গাড়ি, চাকরি সব কয়েক মাসেই নাই হয়ে যেতে পারে। তাই মানুষও বিশেষজ্ঞদের কথা মন থেকেই মানছে। গ্রিকরা অর্থোডক্স খ্রিস্টান, খুবই গোঁড়া। তাদের প্রধান উৎসব ইস্টার সানডে। তাদের বিশ্বাস এই সানডেতে যিশু পূর্নজন্ম নিয়েছে। খুব ঘটা করে তারা ইস্টার পালন করে। কিন্তু এবছর ইস্টার পালন করছে ঘরোয়াভাবে। সরকারকে সাহায্য করছে এখানকার পাদ্রীরা।চার্চের পাদ্রীরা ঘোষণা দিয়ে মানুষকে চার্চে না আসতে অনুরোধ করছে। মানুষ সে কথা শুনছে।

» করোনা মোকাবিলায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গ্রিক মডেল প্রশংসিত হচ্ছে। তবে এই গ্রিক মডেলের সবচেয়ে বড় দিকটি মানবিকতা। এখানে কোন ডাক্তারকে বাড়ি ছেড়ে দিতে নোটিশ দেয় না তার বাড়িওয়ালা। কোন রোগীকে চিকিৎসার জন্য একের পর এক হাসপাতালে ঘুরতে হয় না। কেউ মারা গেলে তাকে কবর দিতে কেউ বাধা দেয় না। মানবতার হাত ধরে গ্রিসের নতুন ওডিসি সফল হোক, মানুষের ওডিসি সফল হোক। ওডিসিয়াসের মতোই সব বাধা দূর করে পৃথিবী ফিরে যাক আগের দিনগুলোতে।
……………… ………………

এথেন্স, ১৮ এপ্রিল

সুজন দেবনাথ

লেখক ও কূটনীতিক। বর্তমানে এথেন্সে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর। এথেন্সের ক্ল্যাসিকাল সময়ে সক্রেটিস, প্লেটো, হেরোডটাস, সফোক্লিসদের নিয়ে সাহিত্য, থিয়েটার, ইতিহাস, দর্শন, গণতন্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্রসহ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্মকথা বিষয়ে তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘হেমলকের নিমন্ত্রণ’। তিনি অব্যয় অনিন্দ্য নামে লেখালেখি শুরু করেন। এই নামে তার কবিতার বই ‘ বই খারাপের উঠোন’ এবং গল্পের বই ‘কীর্তিনাশা’। তার রচনা ও পরিচালনায় ২০১৮ সালে গ্রিসে নির্মিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম ইংরেজি গান ‘ মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে’।

 

সক্রেটিসের শহর থেকে-৩

তাজনিন মেরিন লোপা

২২ এপ্রিল, ২০২০ , ৪:১৬ অপরাহ্ণ

করোনা সময়ে অস্ট্রেলিয়া-২

রাতে মেইল পেলাম অফিসের একজনের ব্লাড টেস্ট করতে দিয়েছে । আল্লাহর রহমতে দুদিন পরেই রেজাল্ট আসলো। নেগেটিভ । একসময় মনে হতো আমরা বাংলাদেশের মানুষ প্যানিক্ড, আতঙ্কগ্রস্ত । ব্যাপারটা তা না হলে কি আর অস্ট্রেলিয়ার নানান জায়গায় টয়লেট টিস্যু নিয়ে মারামারি কাড়াকাড়ি হয় ! আর্মিডেলেও এর প্রভাব পড়লো। কোন সুপারমলে, শপে কোন ধরণের টিস্যু নাই । আপাতত টিস্যু নিয়ে আমাদের চিন্তা নাই । টিস্যু তো আর খাওয়ার জন্য না । আর আমাদের বাঙ্গালীর ‘বদনা’ তো আছেই ।

বাংলাদেশ থেকে আসার সময় কয়েকজন কাঁথা, বালিশের সাথে বদনা নিয়ে এসেছিলেন । সেটা নিয়ে কি ভীষণ হাসাহাসি করেছি! এয়ারপোর্টে আরেকজনের ল্যগেজ থেকে বদনা বের হওয়ার পর খুব মুশকিল হয়েছিল । এনারা তো বদনা চিনেন না । কাজেই গুরুত্বও বুঝেন না । এই নিয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক দেরি হয়েছিল তার । পরে অবশ্য বদনা সহই ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো । অজি বন্ধুদের যখন বদনার ব্যবহার শেখানো দারকার ভাবছি, তখন একটু দুশ্চিন্তায় পড়লাম আমরাই দু’সপ্তাহ পর । স্টকের টিস্যু শেষের পথে । শুনলাম ‘কোলস’ সুপারশপে সকাল ৮ টায় লাইনে দাঁড়ালে টিস্যু কিনতে পাওয়া যায় ।

একদিন দুলাভাই, আরেকদিন ভাগনে বেচারা বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলো; নাহ্ টিস্যু তো না ’হোয়াইট ডায়মন্ড’ শেষ। অবশ্য একটু বেশি দাম আর পরিমাণে কম হলেও পরের সপ্তাহে উলিজ সুপারশপে কাঙ্খিত হোয়াইট ডায়মন্ড পাওয়া গেল। এর পরের দু’সপ্তাহ পর টিস্যুর বাজার একটু স্বাভাবিক হলো ।

মার্চের শুরুর দিকেই সুপারশপগুলোতে নিয়ম করে ফেললো, একজন একটার বেশি পণ্য নিতে পারবেন না । এই অবস্থাতেই বাজারে চাল, আটার তাক খালি । কিছু সময় কিছু জিনিস পাওয়া যায়, কিছু সময় নাই । এদিকে অস্ট্রেলিয়ার গভ: এর পক্ষ থেকে প্রতিদিন নানান ব্রিফিং দিয়েই যাচ্ছেন । নিশ্চিত করছেন কৃষক সমিতিসহ নানান জায়গা থেকে যে, খাবার ও অন্যান্য সব কিছু সাপ্লাই নিশ্চিত করা হবে । কাজেই কেউ প্রয়োজনের বেশি স্টক না করার জন্য ।

এখানকার নিয়ম আর সংস্কৃতি যে যার মতো থাকবে । বাচ্চারা আঠারো বছর হলে নিজের মতো আলাদা থাকবে । বিয়ে করা না করা নিজেদের সিদ্ধান্ত । তবে পরিবারের দায়িত্ব ভালোবাসা অটুট থাকে । এটা তারা পারিবারিক, সামাজিকভাবেই শিখে থাকে। সময়মতো বিয়ে করে, চার/পাঁচজন বাচ্চা নিয়ে সংসারী বাবা-মা যেমন আছে, অবিবাহিত বাবা-মাও আছে । আছে অবিবাহিত বয়স্ক মানুষও । সবাই স্বনির্ভর । বয়স্ক মানুষ, যাদের সিনিয়র বলা হয় এখানে; ওনাদের জন্য বেশ কষ্ট হয়ে গেল । বাজার করার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, এরপর প্রয়োজনীয় জিনিসের তাক খালি । তাঁদের জন্য সুপারশপে আলাদা একঘন্টা সময় বেঁধে দেয়া হলো ।

অস্ট্রেলিয়া বিশাল দেশ, তাই তার একেকটা স্টেট এর নিয়ম কানুন আলাদা । লকডাউন, সংক্রমণ পরিস্থিতি, চিকিৎসা সুবিধা, বিধিনিষেধেও অনেক পার্থক্য । প্রথমেই লকডাউন হলো ভিক্টোরিয়া । তখনও আমাদের স্কুল, কলেজ, অফিস চলছে শঙ্কা নিয়েই । এপ্রিলের প্রথম দিকে নিউ সাউথ ওয়েলস লকডাউন করলো । প্রয়োজনীয় বাজার, অফিসের কাজ, যাঁদের শারীরিক পরিস্থিতিতে হাঁটতে হবে, যেমন : ডায়বেটিস বা এরকম কিছু, জরুরি অবস্থা ছাড়া কেউ বাইরে ঘোরাঘুরি করলেই এগারো হাজার ডলার জরিমানা । মেলবোর্ন থেকে নির্দশনা আসলো বাসা থেকে অফিস করতে হবে । সপ্তাহে দু/একদিন অফিসে যাওয়ার জন্য কাজ, সময়, একই সময়ে দুজনের বেশি অফিসে যেতে পারবে না ।

আমাদের সবাই বাংলাদেশে। আমার ছেলেটার বাবাও । যা শঙ্কা করা হচ্ছিল, সেরকম অনেক কিছুই ঘটে যাচ্ছে প্রায়দিন । খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে সবারই । আমরা এখানে ভালো আছি; কিন্তু ভালো থেকেও যেন শান্তি, স্থিরতা নেই বাংলাদেশের চিন্তায় । এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু প্রতিদিনের কাজ আমাদের করতে হচ্ছে । আর মনে হচ্ছে এই বন্দী হওয়াটা সবাই একসাথে থেকে বন্দী হতে পারলে হয়তো একটু স্থিরতা থাকতো । যাই হোক একসাথেতো আছি ।
নতুন নতুন নিয়মের সাথে অভ্যস্ত হওয়া; খুব অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবী, আশপাশ বদলে যাওয়া দেখাটা আসলে এতোটা সহজ না ।

ওষুধ কিনতে গেছি একদিন । শপের বাইরে বেশ বড় লাইন; সবাই প্রায় সিনিয়র । খরগোশের মতো বিভ্রান্তি নিয়ে মাথা ঢুকাতেই কাস্টমার কেয়ারের একটা মেয়ে হেসে বললেন; আসতে পারবে, এটি প্রেসক্রিপশনের লাইন । খুব সাধারণ কিছু ওষুধ ছাড়া বাকি সকল ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া দেয় না । এমনকি ডক্টর সংখ্যাও লিখে দেয় । অস্ট্রেলিয়ায় শীত আসছে। আসছে ‘ফ্লু’ এর জন্য বসন্তকাল । গত বছরও সারা অস্ট্রেলিয়ায় মানুষ মারা গিয়েছে ‘ফ্লু’ তে আক্রান্ত হয়ে । ‘ফ্লু’ আর কোভিড-১৯ এর লক্ষণগুলো একই । তাই এবারের ফ্লু ভ্যাকসিন সময়টা আগেই শুরু করে দিয়েছে । সাথে অনেক ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করে দিচ্ছে ।

ফার্মেসিগুলো এখানে সুপারশপের মতই । পারফিউম, সাবান, লোশন ধরণের কসমেটিকস সহ অনেক শুকনো খাবার, বাচ্চাদের খাবার থাকে । এতো বড় একটা এরিয়াতে ভিড় হওয়ার এটাও একটা কারণ । আমার প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে কাউন্টারে দিলাম । মেয়েটি হেসে বললো, একটু পিছিয়ে দাগের পেছনে দাঁড়াও । দেখলাম ওহ আসলেই তো দাগ দেয়া । একটু অপ্রস্তুত লাগলো । বললাম, সবই নতুন তো, আমরা সবাই অভ্যস্ত হতে পারছি না । সেও স্বীকার করলো ।

আমার বোন গেছে কে-মার্ট শপে । এটাতে যাবতীয় কাপড়, খেলনা, ইলেকট্রনিক্স থাকে । সুপারশপে ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর কাশি এলো । এখন মাথায় নানান চিন্তা; কাশি দিলে আশেপাশে মানুষ না দৌড় দেয় ভয়ে । সে নিজেই তাই এক দৌড় দিয়ে চলে গেল বাথরুমে। গ্রীষ্মকাল ছাড়া বাকি সময় আমি বাইরে বের হলেই আমার হাঁচি আসে । এমনিতে হাঁচি কনুইয়ের মধ্যেই দেই। কিন্তু এখন এমন হলেই আড়াল খুঁজি, বসে পড়ি, সরে গিয়ে হাঁচি দেই ! কি যে শঙ্কায় পৃথিবী আছে । আল্লাহর কাছে শুকরিয়া বেঁচে আছি, সুস্থ আছি, ভালো আছি ।

লকডাউনের মাসখানেক পর আজকে সবাই একটু বেড়িয়েছি নানান সময়ে । অনেক মানুষই বের হতে পেরে খুশি । কাউকে কেমন আছো জিজ্ঞেস করলে বলছে, ‘বোরিং’। বাস্তবতা । সবাই একটু হালকা মানে একটু রিলাক্স ছিলাম । রাতে জানলাম, এখানকার সরকারী সার্ভিস অফিস; যেখান থেকে ড্রাইভিং, গাড়ির কাজসহ ,কমিউনিটির নানান সার্ভিস দেয়; সেখানে দুজনের পজিটিভ পেয়েছে । আর উনিশজন কোয়ারাইন্টাইনে । ওখানে একজন প্রেগনেন্ট মেয়ে আছে । আমি গেলেই ওর সাথে দেখা হতো । আর আমার ওরকম সময়টার কথা মনে হতো । জানি না ওর কথা, কেমন আছে !

চলবে

 

তাজনিন মেরিন লোপা

জন্ম রংপুরের এক সাহিত্যানুরাগী পরিবারে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, রংপুরের জনপ্রিয় মুখ। ’যুগের আলো’ পত্রিকায় নিয়মিত লেখক হিসেবে লিখেছেন ছড়া, কবিতা, সায়েন্স ফিকশন, ছোট গল্প, লিখেছেন কলাম। ঢাকায় ‘ছোটদের কাগজ’ এ লেখক হিসাবে সক্রিয় ছিলেন। শিশু-কিশোর সাহিত্য নিয়ে ২০১৯ একুশে বইমেলায় আত্মপ্রকাশ করছেন ‘ডাইনীর ফলবাগান’, ২০২০ এ ‘অস্ট্রেলিয়ার রূপকথা’ বই নিয়ে।  নৃবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  স্নাতক আর স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। বাংলাদেশে কলেরা হাসপাতালে সামাজিক গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন অনেকদিন। খুব সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল সরকার এর অনুদানে পরিচালিত ’হিপ্পি অস্ট্রেলিয়া’ নামে একটি সংস্থায় টিউটর হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। সংস্থাটি  মূলত তাদের নিজেদের কারিকুলামে কমিউনিটির ছোট শিশুদের মানসিক ও ইতিবাচক সামাজিক উন্নতির জন্য কাজ করে। বর্তমান নিবাস আরমিডেল, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া ।

 

করোনা সময়ে অস্ট্রেলিয়া-২

তাজনিন মেরিন লোপা

১৩ এপ্রিল, ২০২০ , ৭:৩২ পূর্বাহ্ণ

করোনা সময় অস্ট্রেলিয়া

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ট্যাম্ওরথে ট্রেনিং ছিল আমাদের আরেকটা অফিসে । ট্যামওরথ আরমিডেল থেকে প্রায় ১১০ কি. মি দূরে ।

অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যান্ড এর এ্যাডমিনিসট্রেটিভ সিটি । কাজেই মানুষ আর গাড়িতে গিজ গিজ করে ।

৩১৪ কি.মি এড়িয়াতে প্রায় ৬২ হাজার লোকের বাস ।

বেশ অন্যরকম একটা ভাব ছিল ট্রেনিং নিয়ে; এটা ছিল একরকম ”লেডিস ডে আউট”। আমরা বাংলাদেশের মেয়রা তো নিজেরা গাড়ি চালিয়ে অনেক দূর যাচ্ছি; এরকম অভিজ্ঞতা পাই না । দেখি মুভিতে ।

আমরা এই প্রজেক্টে চারজন টিউটর, দুজন কোঅর ডিনেটর; সবাই ভদ্রমহিলা । তিনজন বাংলাদেশী, দুজন অজি, একজন কলোম্বিয়ান ।

বাংলাদেশী সাহসী আপু অফিসের গাড়ি চালানোর দায়িত্ব নিলো ।

হাইওয়ে পার হয়ে যাওয়ার সময় কোন এক মুভির দৃশ্যই মনে হচ্ছিল । অবশ্য এতোকিছুর মাঝেও আমাদের চিন্তা ছিল, ট্রেনিং সময়মতো শেষ করে সময়মতো ফেরা । বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্য । দেখশোনার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করতে হয়েছে যদিও । এখানে অবশ্য বিকল্প ব্যবস্থা মানে বাচ্চার মা বিকল্প বাবার, বাবা মায়ের । এছাড়া যারা নাগরিক নন, তারা বিশাল অংকের টাকা দিয়ে বেবিসিটারের কাছে রাখতে পারেন ।

আমার সাড়ে তিন বছরের বাচ্চার জন্য অবশ্য আমার বোন-দুলাভাই আছেন । শুধু আমাকে ছাড়া সে খাবারটা খায় না! এছাড়া আর কোন ঝামেলা নেই ।

সে যাই হোক ট্রেনিং শেষের তৃপ্তি নিয়ে ফেরা হলো । কিন্তু তার একদিন পরেই আমরা জানলাম, ট্যামওরথে একজন করোনা পজেটিভ পাওয়া গেছে । সেখানে সব লকডাউন । অস্ট্রেলিয়া এক মহাদেশ, আর তার নিজের দেশেরই ৬ টা স্টেট । একেকটা স্টেট একেকটা দেশের সমান বা তারচেয়েও বড় । সময় এবং আবহাওয়ার দিক থেকেও আলাদা । অস্ট্রেলিয়া সরকার তখনোও আর্ন্তজাতিক যাতায়াত সহ সকল লকডাউন নিয়ে ভাবছেন ।

সোমবার আমাদের অফিসিয়াল টিউটর ট্রেনিং থাকে । বাচ্চাকে সকালে প্রিস্কুলে দিয়ে অফিস গেলাম । ঘন্টাখানেক পরেই স্কুল থেকে ফোন । নাবহান বমি করেছে, শরীরের তাপমাত্রা ঠিক আছে। এখন খেলছে, কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতেও সামান্য অসুস্থতাকেও সবাই গুরুত্বের সাথে দেখছে । এর আগেও আমার ছেলের একবার এরকম হয়েছে: কারণ সকালে সে প্রায় কিছুই খায় না । কিন্তু ঐসময় স্কুল থেকে নিয়ে আসতে হয়নি ।

স্কুলে লাঞ্জ বক্স দেই নানান খাবার দিয়ে; তবে সে কিছুই খায় না প্রায় । স্কুলের নিজেদের বাস থাকলেও ওই মুহূর্তে সার্ভিস পাওয়া যাবে না । কিভাবে বাচ্চাকে আনি সেটা একটা দুশ্চিন্তা । দুলাভাই ইউনিভার্সটিতে, এসে ওকে নিতে সময় লাগবে । আর কাউকে অনুরোধ করলেই তো হবে না, বেবেসিটও লাগবে । এদিকে শরীর খারাপ নিয়ে সবার উদ্বিগনতা; যদিও জানি তার এটা সাধারণ ঘটনা ।

মনে পড়লো, আমার বান্ধবীর ছেলেও ওই প্রিস্কুলেই । তার গাড়িতে বেবেসিটও আছে । ফোন দিলাম, আল্লাহ্ র রহমতে সে ছেলেকে দিয়েই গাড়ি স্টার্ট দেয়ার সময় আমার কল দেখে আগে রিসিভ করেছে । স্কুলে বলতেই ওর কাছে বাচ্চা দিয়ে দিলো । বাচ্চাকে পেয়ে সেও আমাকে ফোন দিলো, চিন্তা করো না, নাবহান ভালো আছে, আমি ওকে নিয়ে আসছি অফিসে । কোঅরডিনেটর বাসায় চলে আসার পরামর্শ দিলেন, কারণ ওর বিশ্রাম জরুরি । দুপুরের দিকে প্রিস্কুল থেকে সুপারভাইজার বেক ফোন করলো । নাবহানের খোঁজ নেয়ার জন্য ।

করোনা পরিস্থিতির কারণে আগামী ৪৮ ঘন্টা একটু খেয়াল রাখতে আর স্কুলে বা বাইরে না যেতে । বেক ভীষণ ভালো আর আন্তরিক । কিন্তু কেন জানি আমার একটু হিউমেলিয়েশন, অস্বস্তি লগলো, মন আরও খারাপ করলো । ছেলেটার বাবা দেশে । এই পরিস্থিতি এমনিতেও খারাপ লাগাটা বেশিই হয়, কিছু না হলেও অসহায় লাগে মাঝে মাঝে । মনে হলো সারা পৃথিবীর করোনা পজিটিভ মানুষগুলোর কতটা অসহায় অনুভূতি পার করছে ।

এমনকি আমাদের যাদের ঠান্ডা, হাঁচি, কাশি, এলার্জি বা অন্য সমস্যা আছে; তারাও কি ভয়ঙ্কর সময় পার করছি । একটু গলা ব্যাথা, হাঁচি, কাশি হলেই আশেপাশের মানুষজন ভয়ে অস্থির হয়ে যাচ্ছে । নিজেদের ভয় তো আছেই ।  সবই ঠিক আছে জানি, কিন্তু পরের সাতদিন সবার মাঝে একটা আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা কাজ করেছে ।

চলবে

 

তাজনিন মেরিন লোপা

জন্ম রংপুরের এক সাহিত্যানুরাগী পরিবারে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, রংপুরের জনপ্রিয় মুখ। ’যুগের আলো’ পত্রিকায় নিয়মিত লেখক হিসেবে লিখেছেন ছড়া, কবিতা, সায়েন্স ফিকশন, ছোট গল্প, লিখেছেন কলাম। ঢাকায় ‘ছোটদের কাগজ’ এ লেখক হিসাবে সক্রিয় ছিলেন। শিশু-কিশোর সাহিত্য নিয়ে ২০১৯ একুশে বইমেলায় আত্মপ্রকাশ করছেন ‘ডাইনীর ফলবাগান’, ২০২০ এ ‘অস্ট্রেলিয়ার রূপকথা’ বই নিয়ে।  নৃবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  স্নাতক আর স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। বাংলাদেশে কলেরা হাসপাতালে সামাজিক গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন অনেকদিন। খুব সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল সরকার এর অনুদানে পরিচালিত ’হিপ্পি অস্ট্রেলিয়া’ নামে একটি সংস্থায় টিউটর হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। সংস্থাটি  মূলত তাদের নিজেদের কারিকুলামে কমিউনিটির ছোট শিশুদের মানসিক ও ইতিবাচক সামাজিক উন্নতির জন্য কাজ করে। বর্তমান নিবাস আরমিডেল, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া ।

 

করোনার সময় অস্ট্রেলিয়া

মুগ্ধতা.কম

১২ এপ্রিল, ২০২০ , ৫:৫৬ অপরাহ্ণ

দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ হিলিং

রাজিয়া সুলতানা আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি লেখক। তিনি সেখানকার ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে পরিবারসহ বসবাস করছেন এবং সেখানে শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িত। বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের দুঃসহ সময়ে লকডাউনে থাকাকালীন তিনি লিখছেন তাঁর সেইসব অভিজ্ঞতার কথা।


সেদিন আমাদের ব্যাকইয়ার্ডে প্রথম ড্যাফোডিলটাকে সূর্যের আলোয় হাসতে দেখে বোস্টনের জরুরি বিভাগের ডাক্তার এলিজাবেথ মিচেলের মতো আমারও মনে হয়েছিল পৃথিবীতে বসন্ত এসে গেছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় –‘বসন্ত এসেছে দ্বারে।

পাতায় পাতায় একি শিহরণ নতুনের অভিসারে।‘  ইয়েস, নতুনের অভিসার এ যে!  কিন্তু সংশয়, আশঙ্কা আতংক কমছিল না। এরপর নিউ ইয়র্কে হাজার হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে শুরু করলে প্রতিদিন বুকে পাথরের ভার জমা হতে থাকে। যদিও বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই।

এক বিকেলে মেয়েকে বললাম – ‘ভয়াবহ এক রোগে আক্রান্ত পৃথিবী।‘

মেয়ে বলল –‘রোগ নয় আম্মু, ব্যাধি, বিশৃঙ্খলা (disorder)।‘

মেয়ের রেস্পন্সটা ভালো লাগল। জিজ্ঞেস করলাম –‘ভয় করছে না তোমার?’ মেয়ে  বলল – ‘Who doesn’t fear death? But the world is healing.’ মেয়ে পড়ছে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি নিয়ে। মাস্টার্সের প্রথম বছরে। আসছে ফল ( Fall) সেমিস্টার থেকে সে সরাসরি পিএইচডি ডিগ্রির অধীনে চলে যাবে। মাস্টার্সের প্রথম বছরের প্রার্থীদের মধ্য থেকে প্রফেসরদের প্রথম ‘পিক’ ছিল ও।

নতুনদের চিন্তাভাবনাকে গুরুত্ব দিতেই হবে। তাই আরো আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম –‘কী রকম?’ সে বলল –‘ আমরা সবাই শুধু ছুটছি আর ছুটছি। সময় যেন নেই কারও। প্রিয়জনদের কাছে পাই না আমরা।

তুমি কি ভেবেছিলে এই রমজানে আমি বাড়িতে থাকব?

করোনা না এলে আমি থাকতাম ক্যাম্পাসে।

সামারেও তো কোর্স করছি।

চারবছর পর এবার বাড়িতে একসঙ্গে রোজা করতে পারব আমরা।

তুমি এই সময়টা আমাকে মিস করো বলেছিলে। আমিও করি। সেই সুযোগ এসে গেল। এখন আমরা হোম কোয়ারেন্টিনে। একসঙ্গে কতকাজ করছি আমরা। সেই সুযোগটা এসে গেল।

অ্যাডাম আমাকে পেয়ে খুশি। আমারও ভালো লাগছে। আব্বুও খুশি।

বাইরে কিছু করতে না পারলেও ঘরে কোয়ালিটি সময় পার করছি আমরা। একসঙ্গে সবজি  বাগান করব এবার ভাবতে ভালো লাগছে।

মানুষ  লকডাউনে থাকায় শপিং মল, সিনেপ্লেস, স্কুল কলেজ, সব বন্ধ; তাতে পৃথিবী শুশ্রুশা পাচ্ছে।

প্রকৃতিরও তো ব্রেক প্রয়োজন।  আমরা শুধু নিয়েই যাই, দেয়ার কথা ভাবি না। দেখো, আমরা গাছপালা কেটে বন উজাড় করে দিচ্ছি। এ জন্য বন্যা হচ্ছে। মানুষ মরছে। নগরায়ন, শিল্পায়নের জন্য কত আবাদী জমি নষ্ট করে ফেলছি। বায়ূ দূষিত করে ফেলেছি। এসিড রেইন হচ্ছে। অ্যান্টার্কটিকায় পৃথিবীর বরফ গলে যাচ্ছে। আমরা আমাদের পৃথিবীটাকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছি।

আমি কী ভাবছি জানো, যদি যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যেত। যদি সবাই সবার মঙ্গল চাইতাম আমরা। তাহলে পৃথিবীর সব মানুষ খেয়ে পরে বাঁচত। ডাইভার্সিটি বজায় রেখে যদি একটা আম্ব্রেলার নীচে সবগুলো দেশ নিজেদের এক মানবজাতি হিসেবে সরকার গঠন করত -তাহলে মানবতা রক্ষার জন্য মানুষে মানুষে বিভেদের প্রাচীরগুলো উঠে যেত; ভালোবাসাই যদি আমাদের কাজ হতো, তাহলে ঘৃণার কাজগুলো থেকে মানুষ সরে আসত। এত হানাহানি, মারামারি, খুনাখুনি হতো না।

একটা সাউন্ড সোশাল সিস্টেম চালু করার জন্য যা যা করা দরকার- আমরা তা বুঝি কিন্তু মানুষ সমষ্টিগত চিন্তা থেকে সরে এসে বারবার ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে মরিয়া হয়ে ওঠে। অথচ শেষ পর্যন্ত কী লাভ হয় বলো? পৃথিবী ছেড়ে তো একদিন চলে যেতেই হয়।  এই অহেতুক প্রতিযোগিতায় মানুষ সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়। এই রেসের ঘোড়ার লাগামটা যদি আমার হাতে থাকত, দেখতে আমি পৃথিবীটা সুন্দর একটা জায়গা বানিয়ে ফেলতাম। বছরে দুইবার লকডাউনের নিয়ম চালু করতাম।

সেই সময়টাতে মানুষ যেমন অবসর পেত, তেমনি পৃথিবীও জুড়াতো। পল্যুশন দূর করার জন্য এটা চমৎকার একটা ব্যবস্থা হতো। এখন যেমন হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ভূ-কম্পন কমে গেছে। ভারতে দূর থেকে তাজমহল, ঝলমলে তারাভরা আকাশ, শুকতারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মানুষ। কলকারখানায় ভারি শিল্প উৎপাদন বন্ধ এখন, যানবহনের জ্যাম নেই, তাই রাস্তাঘাটে  ধূলিকণা উড়ছে কম।

বিশ্বাস করতে পারো এখন ২০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে থাকা তারাদের খোঁজ মিলছে! এর বৈজ্ঞানিক কারণ জানো তো? এ যেন আমাদের স্বপ্নের সেই পৃথিবী যাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম। ওহ! ভাবতে খারাপ লাগছে -লকডাউন শেষ হয়ে গেলে আমাদের পৃথিবীটা আর জুড়াতে পারবে না। আবার দূষণ শুরু হয়ে যাবে। প্রকৃতির ওপর আবার নির্যাতন শুরু হয়ে যাবে।  করোনায় মানুষ মরছে, আরো মরবে।

All these have been overdue,  ammu. It sounds bad but we are paying now for what we have done to our world. This is our earth; we did not take care of it on time. Now, nature itself is dressing us down, reprimanding us. That is how it is. Tough love, who won’t say? Can we really deny that? Let us not worry about death. Let us stay locked down. There is a way to escape Corona if we do everything right. Today or tomorrow doctors and scientists will come up with its vaccine but if we do not learn how to behave to save our own earth, there will be something new in future, some other kind of virus or germ to destroy us. We will be dumb not to learn from our mistakes.’

আমি নীরব শ্রোতা। আত্মজার কথাগুলো শুনে গেলাম শুধু আর ভাবলাম এদের মতো, এই নতুনদের মতো কেন চিন্তা করতে, পৃথিবীটাকে ভালোবাসতে শিখি না আমরা?

 

রাজিয়া সুলতানা

কবি, লেখক ও অনুবাদক।

জন্ম গাইবান্ধা জেলার সৈকতপাড়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে তিনি অনার্স ডিগ্রি নেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। সেখানে তিনি গণিত ও অন্যান্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনশেষে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন। ভালোবেসে ভালো নেই তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন (২০১৫)। দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থের নাম হারপুনে গেঁথেছি চাঁদ (২০১৬) । সম্প্রতি ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ইংরেজিতে অনূদিত বাংলা কবিতার সংকলন পোয়েটিকস অব গ্রীন ডেল্টা য় তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। এছাড়া তার অনূদিত আরও দুটো বই-‘ইশিগুরো তিনটি বড় গল্প’ এবং স্লোভেনীয় কবি গ্লোরজানা ভিবারের নির্বাচিত কবিতাগ্রন্থ In Proximity of Silence এর অনুবাদ ‘নৈ:শব্দ্যের কাছাকাছি’। এই গ্রন্থটি স্লোভেনিয়া থেকে প্রকাশিত হয়।

 

করোনার দিনগুলো: দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ হিলিং

মুগ্ধতা.কম

১২ এপ্রিল, ২০২০ , ৬:৪৮ পূর্বাহ্ণ

শুভ জন্মদিন বড় আপা: মমতার বন্ধন

মধ্যবিত্তের চাল-নুন, জামা, জুতা, ঘড়ি, সবকিছু নিয়েই হৃদয়স্পর্শি গল্প আছে। এসব গল্পই হয়ে ওঠে সিনেমা-উপন্যাসের জীবনছোঁয়া উপাখ্যান।

মহান দারিদ্র্য আর নিখাদ ভালবাসার স্বর্ণালী চাদরে ঢাকা সংসারের সুখ দুঃখ এখনও এক অশ্রুসজল অভিব্যক্তির জন্ম দেয়, জেগে ওঠে ভালবাসা ও অনুভূতির হাজার দোয়ার। উচ্চমাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষার আগ পর্যন্ত আমার কোন ঘড়ি ছিলোনা। ক্লাসে দু’একজনের হাতে হাত-ঘড়ি। তখন হাত ঘড়ি মানে বিশাল স্ট্যাটাস।

মনে আছে আব্বার ঘড়ি হাতে দিয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম।

বড় আপা (বড় বুবু) কেবল প্রাইমারি স্কুলে চাকরি পেয়েছেন। বেতন সাকুল্যে ৯০০ টাকা। পিটিআই ট্রেনিং করছেন ঝিনেদাতে।

লেখক ও তার বড় আপা

লেখক ও তার বড় আপা

আমি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ হোস্টেলে। সামনে টেস্ট পরীক্ষা। আপা চিঠি লিখলেন ঝিনেদা যাওয়ার জন্য।

খুব উচ্ছ্বাস নিয়ে এক বিকেলে আপার সাথে দেখা করতে গেলাম ঝিনেদা। কত কি যে রান্না করেছেন আপা।

ঝিনেদা থেকে আসার সময় আপা আমার হাতে কিছু টাকা গভীর মমতায় ধরিয়ে দিয়ে আড়ষ্ঠ ও কাঁপা কন্ঠে বললেন ‘ একটা ঘড়ি কিনে নিস’ আর কিছু বলতে পারলেন না, শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলেন।

শেষে শুধু বললেন ‘ভালভাবে পড়াশুনা করিস’।

দারিদ্র্যেরগৌরব আর মধ্যবিত্ত আবেগ মেশানো ছোট ভায়ের জন্য বড় বোনের ভালবাসাটুকু রক্তকনিকায় অদৃশ্য এক তুফান এনে দিলো।

আমি আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম স্বর্গীয় এক অনুভুতিতে।

আপা তার চোখের জল আর নিবিড় আদর দিয়ে দায়িত্ববোধ ও ভালবাসার অনির্বান এক প্রদ্বীপ জ্বেলে দিলেন অন্তরে।

অব্যক্ত এক উচ্ছ্বাস নিয়ে কুষ্টিয়া এসে জীবনের প্রথম ঘড়ি কিনলাম ২৭০ টাকা দিয়ে।

ঘড়িটা পরেছিলাম অনেকদিন।

আমাদের সাত ভাই-বোনের মধ্যে বড় আপা দ্বিতীয়।

মেয়েরা জন্মগতভাবে বোধহয় ধৈর্যশীলা ও মমতাময়ী হয়।

আপা খুব অল্প বয়সেই নিম্ন মধ্যবিত্তের চেতনা ধারণ করে হয়ে উঠলেন ছোট চার ভায়ের জন্য অপরিহার্য একজন।

জোর করে মাথায় তেল দিয়ে দেওয়া, শীতের ধুলা ধুসরিত মুখে, শুষ্ক ঠোটে ক্রিম লাগিয়ে দেওয়া, ময়লা জামা-গেঞ্জি ধুয়ে দেওয়া থেকে কত কীনা করতেন আপা।

দুরন্তপনায় মমতাময়ী বকুনি এখনও কানে বাজে।

একবার তুহিনের সাথে মারামারি ঠেকাতে গিয়ে আপার কপাল কেটে গেলো, রাগ করলেন না আপা।

বোনের সম্ভ্রম-মর্যাদা রক্ষার জন্য সব ভাইই বোধহয় জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত।

১৯৮৫ সাল। আপা দশম শ্রেণিতে। আমি ক্লাস সেভেনে। বখাটের উৎপাতে চরম নিরাপত্তাহীনতা চারিদিকে।

বড় ভাই কুষ্টিয়াতে।

আমিই তখন দুই বোনের পুলিশিং এর দায়িত্বে।

একসাথে স্কুলে যাই। কোথাও বেরুলে আপা আমাকে সঙ্গে নেয়।

বখাটেদের উৎপাত প্রতিহত করার সাহস সঞ্চয় করতে থাকি মনে মনে।

প্রয়াত সাইফুল ভাই ছোট্ট একটা চাকু আর সাইকেলের চেইন দিয়েছিলেন আমাকে নিরাপত্তার জন্য।

কিভাবে চাকু কোমরে লুকিয়ে রাখতে হবে, কিভাবে বখাটেকে চাকু মারতে হবে তাও শিখিয়েছিলেন। খুব গোপনে কোমরে সাইকেলের চেইন বাধা শুরু করেছিলাম।

আপা জানতোনা ছোট্ট জুয়েলের বুকের ভিতর সাহসের এমন বারুদ তৈরি হয়েছে তার সম্ভ্রম-সম্মান রক্ষার জন্য।

সত্যিই সেদিন পণ করেছিলাম আপাকে কেউ কিছু বললে খুন করে ফেলবো চাকু দিয়ে। যাহোক আল্লাহ হেফাজত করেছেন সবাইকে।

আপার বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখলেও হঠাৎ একদিন শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ে এসে জানতে পারলাম রাতে আপার বিয়ে।

ছেলে এলাকারই। মংলা পোর্টে চাকরি করে।

আমার বুকের ভিতর সেদিনের হাহাকারের কথা মনে করলে এখনও ধমনীত ঝড় উঠে।

আপা তখন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ে।

আব্বা বলতেন বড় ভাই ভাল চাকরি পাবে, আমাদের অভাব দুর হবে। পাকা ঘর হবে। এর পর মহা ধুমধামে আপার বিয়ে হবে।

যাহোক বিকেলে শুরু হয়ে গেলো বিয়ের অস্বচ্ছল কেনাকাটা।

আমি আমার খেলার সাথিদের নিয়ে কলা গাছ সংগ্রহ করে রাতেই বানিয়ে ফেললাম একটা বিয়ের গেট।

রাত দশটার মধ্যেই বিয়ের আনুষ্ঠিকতা শেষ হলো।

আকস্মিক মৃত্যুর মতই আমরা আপাকে আমাদের সংসার থেকে হারিয়ে ফেললাম।

এসএসসিতে ফার্ষ্ট ডিভিশন পাওয়া মেধাবী আপার লেখাপড়া আর এগুলোনা।

বিয়ের পরে অবশ্য আপা উচ্চমাধ্যমিক পাস করলেন।

আপা চলে গেলেন দুলাভায়ের মংলা পোর্টের বাসায়। আমাদের কাছে অনেকটা বহুদুর নির্বাসনের মত।

কিছুদিন পর অবশ্য প্রাইমারি স্কুলে চাকরি হওয়ার সুবাদে আবার গ্রামে চলে আসলেন।

এর পর থেকে বড় আপা আমাদের এক পরম নির্ভরতার নাম, ভালবাসা আর উৎসাহের নাম।

কত গল্প , কত স্মৃতি আপাকে নিয়ে।

আপাকে না বলে কোন কাজই হয়না আমাদের। আপার সাথে মোবাইলে কথা বলতে হয় হাতে সময় নিয়ে। কথা শেষ হয়না।

আপার নাতি হয়েছে, আমরা দাদু হয়েছি।

সময় বয়ে গেছে বহুদুর।

কিন্তু আমাদের বিনাসুতোর বন্ধনটা অটুট আগের মতই।

সময় হলে হঠাৎ আপার বাসায় যায়, আপা নিবিড় আদরে পাসে দাঁড়িয়ে ডালের বড়ি দিয়ে রান্না করা তরকারি তুলে দিতে দিতে আমার ছোটবেলার দুরন্তপনার দু’একটা গল্পও বলে ফেলেন। ছোটবেলার মত গভীর মমতায় মাথায় হাত রাখেন। আমি নিরবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি বড় বোনের নিখাদ ভালবাসায়।

ধমনীতে বয়ে যাওয়া সহোদর রক্তের অদৃশ্য মিলন, আর মাতৃজঠরের উষ্ণতা অনুভব করি একসাথে, একাকার হয়ে যায় অন্তরের সব কান্না-হাসি , জীবনের সব গান, স্বপ্ন-ভালবাসা….. আজ বড় আপার জন্মদিন। মায়ামমতায় জড়াজড়ি করে কেটে যাক জীবনের প্রতিক্ষণ।

 

রওশন জামাল জুয়েল
আর্মিডেল,অষ্ট্রেলিয়া।

 

শুভ জন্মদিন বড় আপা: মমতার বন্ধন

মুগ্ধতা.কম

৪ এপ্রিল, ২০২০ , ৫:৫৯ অপরাহ্ণ

যেন এক গডোর প্রতীক্ষায়

রাজিয়া সুলতানা আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি লেখক। তিনি সেখানকার ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে পরিবারসহ বসবাস করছেন এবং সেখানে শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িত। বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের দুঃসহ সময়ে লকডাউনে থাকাকালীন তিনি লিখছেন তাঁর সেইসব অভিজ্ঞতার কথা।


পুরো পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখার আগে করোনা কীভাবে বদলে দিল আমাদের জীবন -আজ সেই  বিষয়ে বলব- করোনা তখন প্রথম চীনে, উহানদের ওপর হামলে পড়েছে। তখন প্রথম শুনি ‘কোয়ারেন্টিন’। আহা  কি দারুণ শুনতে! কি ফ্যান্সি একটা শব্দ।

লকডাউন শুনেছি বহু আগেই। মাসে একবার দু’বার করে লকডাউনের ড্রিল হয় এখন অ্যামেরিকার স্কুলগুলোতে। স্কুল শুটারদের ঠেকাতে বা পরাস্ত করতে এই মেক বিলিভের দুনিয়ায় আমাদের মানে টিচার আর স্টুডেন্টদের ফিল্মি ফিল্মি অভিনয়-  বাস্তবতা।

স্কুলে ইনট্রুডার যদি ঢুকেই পড়ে তাহলে কী করণীয় – এই ভাবনায় ভাবনাগুলো সাজিয়ে বাস্তব একটা চিত্র তুলে ধরা এবং সেইমতন অ্যাকশনে যাওয়া। কিন্তু করোনার থেকে বাঁচতে যে লকডাউন আর স্কুলশুটার এর হাত থেকে বাঁচার জন্য যে লকডাউন -এই দুই লকডাউনের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক সেকথা আমি ভালো করেই জানি।

যখন করোনার মত অভূতপূর্ব বা আনপ্রেসিডেন্টেড কিছু ঘটে যায়,  তখন চারটা স্তরে মানুষের হুঁশ হয় বা চারটা স্তরে সে রিঅ্যাক্ট করে -এইটা শিখেছিলাম হেলথ সার্ভিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ক্লাসগুলো নেয়ার সময়। মনে পড়ে গেল আমাদের সেই প্রফেসরের কথা।

তখন ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে পড়ি।

আমার বড়মামা ড. আর কে মোল্লা তখন সেখানে প্রিন্টিং ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। আরেক বাংলাদেশি প্রফেসর ড.   নূরুল আমিন পড়াতেন অ্যাকাউন্টিং বিভাগে। তাঁরই মাধ্যমে পরিচয় ঘটে প্রফেসর ব্র্যায়ান উইলিয়ামসের সঙ্গে।

রেড ইন্ডিয়ান আর আফ্রিকান অ্যামেরিক্যান রক্ত-বীজের মিশ্রণে উৎপন্ন এই মানববৃক্ষ। আমার  ডিগ্রির জন্য তাঁর ক্লাসে হেলথ সার্ভিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বেশ কিছু কোর্স করতে হয়। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! নিজ দেশে মৃত্যু লেখা ছিল না তাঁর কপালে।

এক গ্রীষ্মে ইংল্যান্ডে ছুটি কাটাতে গিয়ে  সেখানে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। এইডস বিষয়ে পড়াতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন সেই চারটি স্তরের কথা। অবিশ্বাস্যরকম কিছু যখন ঘটে যায়, তখন প্রথমে মানুষ তা অস্বীকার করে। ভাবে- এ রকম একটা রোগ?  নাহ-হতেই পারে না। হি ইজ ইন টোটাল ডিন্যায়াল দেন। ইম্পসিবল! তার এ রোগ হতেই পারে না।

কীভাবে সম্ভব? কীভাবে ঘটে গেছে তা সেই কারণ যখন জানতে পারে- এরপর ধীরে ধীরে সে কনভিন্সড  হতে থাকে। ভাবে, রোগটা তার দেহে বাসা বেঁধেছে। সিম্পটম দেখা দিয়েছে। আর অস্বীকার করে লাভ নেই। তখন সে মেনে নেয়।

এরপর চলে ইনফরমেশন সংগ্রহ আর মানসিক প্রস্তুতি। কোথায়  যেতে হবে, কী করতে হবে, চিকিৎসা কী? এইসব নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে যায়। সবশেষ স্তরে সে চিকিৎসা গ্রহণ করে রোগ থেকে বাঁচার জন্য। করোনার আবির্ভাবে ও আক্রমণে আমরাও একইরকম আচরণ শুরু করে দিই।

অচেনা একটা বীজাণুর প্রকোপে যখন চীনে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে তখনও আমরা প্রতিদিনের স্বাভাবিক নিয়মে চলছিলাম। কেউ বিশ্বাসই করতে পারি নি যে করোনা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।

তৃতীয়বিশ্ব, প্রথমবিশ্ব একইরকম আচরণ করতে লাগল। ওদের হয়েছে। আমাদের হবে না। উই অল অয়্যার ইন ডিন্যায়াল। হোয়েন ফাইনালি ইট স্যাংক ইন, তখন দেরি হয়ে গেছে। সাধ্যমত সবই করা হচ্ছে, সময়টা মিস হয়ে গেছে শুধু।

করোনার বিরুদ্ধে শুরু হলো যুদ্ধ ঘোষণা।

কারও কারও রেটোরিক  স্পিচের উন্মাদনা আমাদের জন্য হাসির খোরাকও যোগালো। কীরকম যুদ্ধ যে এটা তা মাথায় ঢুকল   আরও পরে। আমাদের সো-কল্ড লিডার ট্রাম্পও গায়ের জোরে কথা বলতে লাগলেন।

মানুষের জীবনের  চেয়ে দেশের অর্থনীতির ব্যাপারেই দেখা গেল তার যত উদ্বেগ। অনেক বোঝানোর পর তবেই টনক নড়ল তার। হায়! এখন চলছে প্রতীক্ষা। এ যেন কোনও এক গডোর জন্য প্রতীক্ষা আমাদের।  ভাগ্যের পরিহাস নাকি কর্মের ফল ভোগ করতে আজ আমাদের এই করুণ, অসহায় পরিণতি! অদ্ভুত এক সময়! উদ্ভট এক অনুভূতি!

We all are waiting for Godot in the weirdest point in time in the hope that something will happen. We want to get this pandemic over with. Thoughts are passing our mind – is it really going to happen, are we going to die? If that happens, happens. Let’s get done with this. Is it going to happen that we will outdo death? Will we? Who knows!  A  puzzling, weird feeling but we all know how it feels like.

 

রাজিয়া সুলতানা

কবি, লেখক ও অনুবাদক।

জন্ম গাইবান্ধা জেলার সৈকতপাড়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে তিনি অনার্স ডিগ্রি নেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। সেখানে তিনি গণিত ও অন্যান্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনশেষে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন। ভালোবেসে ভালো নেই তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন (২০১৫)। দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থের নাম হারপুনে গেঁথেছি চাঁদ (২০১৬) । সম্প্রতি ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ইংরেজিতে অনূদিত বাংলা কবিতার সংকলন পোয়েটিকস অব গ্রীন ডেল্টা য় তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। এছাড়া তার অনূদিত আরও দুটো বই-‘ইশিগুরো তিনটি বড় গল্প’ এবং স্লোভেনীয় কবি গ্লোরজানা ভিবারের নির্বাচিত কবিতাগ্রন্থ In Proximity of Silence এর অনুবাদ ‘নৈ:শব্দ্যের কাছাকাছি’। এই গ্রন্থটি স্লোভেনিয়া থেকে প্রকাশিত হয়।

 

যেন এক গডোর প্রতীক্ষায়

মুগ্ধতা.কম

২ এপ্রিল, ২০২০ , ৭:৪৩ অপরাহ্ণ

তবুও ভুল হয়ে যায়

রাজিয়া সুলতানা আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি লেখক। তিনি সেখানকার ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে পরিবারসহ বসবাস করছেন এবং সেখানে শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িত। বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের দুঃসহ সময়ে লকডাউনে থাকাকালীন তিনি লিখছেন তাঁর সেইসব অভিজ্ঞতার কথা।


চৌদ্দদিন কোয়ারেন্টিনে থাকার পর বাড়ি এসেছে মেয়ে গতকাল।

‘চৌদ্দদিন কম্প্লিট করে এসেছি। কোথাও বের হইনি।’ ঘরে পা দিয়েই এই বলে ওর বাবার কাছে ছুটে আসে আগে মেয়ে। বাবাও জড়িয়ে নিয়ে হাগ দেয় মেয়েকে। অথচ আগেই বলে রেখেছিলাম মেয়ে বাড়ি এলে এবার হাগ দিতে পারবে না কেউ।

বাবা স্নেহের টানে ‘না’ বলতে পারে নি।

মেয়ে আমার কাছে দৌড়ে এলে আমি কিছুটা দূরে সরে গিয়ে বলি-‘পরে দেব, মা।’ এরপর সে দৌড়ে যায় বাবুইয়ের কাছে।

একটা হাগ তার চাই ছোটভাইয়ের কাছ থেকে।

আমি চিৎকার করে থামিয়ে দিই-‘আজ নয়, আজ নয়, মা, ওকে ছুঁয়ো না।’

বোনের সাথে হাগ করতে না পারলেও তার জন্য আলাদা রুম গুছিয়ে দিচ্ছে বাবুই

বাবুইকে পুরোটা মাস অনেক যত্ন করে কোয়ারেন্টিনে রেখেছি। ওর খাওয়া দাওয়ার বিশেষ যত্ন নিচ্ছি। মা হিসেবে এটাই এখন আমার প্রথম আর প্রধান কাজ। আবেগের বশে আমি তা ভেস্তে যেতে দিতে পারি না।

এতটুকুও রিস্ক নিচ্ছি না।

কিন্তু চোখে পানি এসে গিয়েছিল তখন।

করোনা কীভাবে আমাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে মাত্র কয়েক সপ্তাহেই ভাবতে অবাক লাগছে। করোনা পরবর্তী জীবনের কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে।

সবকিছু এলোমেলো করে দিতে এসেছে করোনা। কিন্তু কেন? The unprecedented eruption of the virus has changed our life for ever that we did not anticipate or could not imagine before. Who could have thought a microscopic virus, a germ will be so powerful that it would break the normal cycle of life? Normal behavior of life? The trust? Love?

The way of our life? Corona is going to take its toll on world economy-it is just matter of time. One thing for sure though -we have to recheck and keep on checking the way we treat our habits and values from now on.

We hope we learn to live a better life, keep us from self destruction so that nature won’t take revenge on us, it won’t feel pity for us and most importantly, we won’t suffer.

ফিরছি, যেখানে শুরু করেছিলাম। মেয়েকে বোঝালাম-বললাম কয়েকদিন ঘরের মধ্যে বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে আমাদের থেকে। মনে রাখতে হবে সে কথা। অন্যদিকে মেয়ে বাড়ি আসার আগে আগে চলছিল ওর জন্য কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্হা।

আলাদা রুম নেই বলে মেয়ের শোবার ব্যবস্হা করা হলো লিভিংরুমের এক কোণে এয়ার -স্প্রিং ম্যাট্রেস বিছিয়ে।

সকালে মেয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হলো। গতরাতে মায়ের কাছে একটা হাগ চেয়েছিল সে। মা তাকে রিফিউজ করেছে। ভাইয়ের কাছেও পায় নি। মা তাকে থামিয়ে দিয়েছে।

আমি কবে থেকে এমন নিষ্ঠুর হতে শিখে গেছি! হায় করোনা! কী শেখালে তুমি আমাদের?

 

রাজিয়া সুলতানা

কবি, লেখক ও অনুবাদক।

জন্ম গাইবান্ধা জেলার সৈকতপাড়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে তিনি অনার্স ডিগ্রি নেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। সেখানে তিনি গণিত ও অন্যান্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনশেষে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন। ভালোবেসে ভালো নেই তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন (২০১৫)। দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থের নাম হারপুনে গেঁথেছি চাঁদ (২০১৬) । সম্প্রতি ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ইংরেজিতে অনূদিত বাংলা কবিতার সংকলন পোয়েটিকস অব গ্রীন ডেল্টা য় তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। এছাড়া তার অনূদিত আরও দুটো বই-‘ইশিগুরো তিনটি বড় গল্প’ এবং স্লোভেনীয় কবি গ্লোরজানা ভিবারের নির্বাচিত কবিতাগ্রন্থ In Proximity of Silence এর অনুবাদ ‘নৈ:শব্দ্যের কাছাকাছি’। এই গ্রন্থটি স্লোভেনিয়া থেকে প্রকাশিত হয়।

 

তবুও ভুল হয়ে যায়-রাজিয়া সুলতানা

সুজন   দেবনাথ

১ এপ্রিল, ২০২০ , ৭:৩৫ পূর্বাহ্ণ

সক্রেটিসের শহর থেকে ২

লেখক সুজন দেবনাথ গ্রিসের এথেন্সে বাংলাদেশ দুতাবাসের কাউন্সেলর। সেখান থেকে মুগ্ধতা ডট কমের জন্য লিখেছেন তিনি।


করোনার সময় প্রবীণদের যত্ন নিন, তাদের সময় দিন

আমার বাবা-মায়ের বয়স ষাটের আশে-পাশে। শ্বশুর-শাশুড়ি সত্তরের কোঠায়। করোনার এই সময়ে আমি বা আমার স্ত্রী কেউই তাদের কাছে নেই। ফোন করে খোঁজ নেয়া ছাড়া তাদের জন্য আমাদের আর কিছুই করার নেই। তাদের জন্য বিধাতা আছেন।

আসুন, করোনার সময়টাকে আমরা একটা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করি। এই সময় আমরা আমাদের পরিবারের প্রবীণদের একটু সময় দেই। তাদেরকে একটু যত্ন নেই। করোনাতে প্রবীনরাই সবচেয়ে বেশি রিস্কে আছেন। তাই তাদের আলাদা যত্ন দরকার। তাদের মন ভালো রাখা দরকার। তাদের মনে সাহস রাখা খুবই জরুরী।

আমার এক গ্রিক বন্ধু আছে, নাম ইসিয়াস জেনিস। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। নিঃসন্তান। করোনার জন্য লকড ডাউনের পরে সে ফোন দিলো, বন্ধু, বিপদে আছি।

আমি বললাম – কী বিপদ, করোনা ধরছে?

বললো, করোনা কোন সমস্যা না। সারাদিন বউয়ের সাথে এক ঘরে থাকাটা করোনার থেকে অনেক বড় সমস্যা!

বুঝলাম, বেচারা মজা করছে।

বললাম, বাড়িতে কে কে আছে?

বললো, সেটাই তো টেনশান। বাড়িতে বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি চার প্রবীণ।

আমি বললাম, এক কাজ করো – চারজনকে জোকস বলতে শুরু করো। চারজনকে প্রতিদিন তুমি চারটা, তোমার বউ চারটা জোকস বলবে। দুই ঘণ্টা পর পর একটা করে জোকস বললে দিন কেটে যাবে।

তিন দিন পরে ইলিয়াস জানালো, বন্ধু, জোকসের আইডিয়াটা দারুণ কাজ করছে। বাড়ির চারজন বয়স্কই অনেক অনেক খুশি। তাদের মধ্যে জোস চলে এসেছে।

ইলিয়াসের বউ বললো, আমার শাশুড়ি যে এতো রসিক, সেটা আমি জানতামই না। আমি আর কি জোকস বলবো, এখন উনিই আমাকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় জোকস বলেন। আমাকে খুশি রাখতে উনি সারাদিন চেষ্টা করছেন। এটা-ওটা রান্নাও করছেন।

ইলিয়াস বললো, বউয়ের সাথে সারাদিন থাকতে এখন আর সমস্যা নাই। চারজন বুড়ো-বুড়িকে আমার বউ নিজের বাচ্চার মতো সময় দিচ্ছে। ঘরের পরিবেশই বদলে গেছে। পরিবারে পার্টি পার্টি ভাব।এখন আমার বাবা-মা এমন আনন্দে আছে যে – শত করোনাও তাদের কিছু করতে পারবে না। মনে হচ্ছে – আমরা সেই ছোটবেলায় ফিরে গেছি।

ইলিয়াসের ফোনটা রেখে আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম। কয়েকটা মাত্র জোকস চারজন প্রবীণ মানুষের জীবনকে বদলে দিয়েছে। তাহলে – আমরা কি পারি না – একটু বেশি সময় দিয়ে আমাদের পরিবারের বয়স্কদের ভালো রাখতে। আমরা একটু বেশি সময় দিলে, একটু মজা করে কথা বললেন, ওনারা সাহস পাবেন। করোনা মোকাবেলার ভরসা পাবেন।

আসুন, প্রবীণদের সময় দেই। তাদের ইমপরটেন্স দেই। সারাদিন ফেইসবুকে করোনা নিয়ে আহাজারি না দেখে, বাবা-মা, দাদা-দাদীকে দুটো মিষ্টি কথা বলি। ভরসার কথা বলি। একটু লেবুর শরবৎ করে দেই।

তবে, সাবধান, প্রবীণদের মধ্যে ভয় ছড়ানো যাবে না। সচেতন করতে হবে, কিন্তু ভয় যেন না দেখাই। তরুণদের সময় এসেছে প্রমাণ করার – আমরা আমাদের সিনিয়রদের ভালবাসি।

একদিন করোনা ঠিকই চলে যাবে। ভ্যাকসিন চলে আসবে। এই সুযোগে বাবাকে খুশি করার চেষ্টাটা যদি আমাদের অভ্যাস হয়ে যায়, সেটা সারাজীবন আমাদের সুখে রাখবে। যেটা মনে মনে বলি, লজ্জার মাথা খেয়ে বাবাকে একবার বলে ফেলি, লাভ ইউ বাবা। সাহস করে শ্বশুরকে একটা জোকস বলে ফেলি। যে মজার ভিডিও বন্ধুদের পাঠাচ্ছি, সেগুলো তাদেরও পাঠিয়ে দেই।

আমরা আমাদের বাবা-মা, দাদা-দাদীকে ভালোবাসি – প্রবীণদের ভালোবাসি – এটা প্রমাণ করাই হোক করোনার সময়ের আমাদের শিক্ষা।

২১ মার্চ, এথেন্স

 

 

সক্রেটিসের শহর থেকে ২

সুজন   দেবনাথ

৩০ মার্চ, ২০২০ , ৬:৪২ পূর্বাহ্ণ

সক্রেটিসের শহর থেকে

লেখক সুজন দেবনাথ গ্রিসের এথেন্সে বাংলাদেশ দুতাবাসের কাউন্সেলর। সেখান থেকে মুগ্ধতা ডট কমের জন্য লিখেছেন তিনি।


লক-ডাউন নিয়ে সারা পৃথিবীতেই খুব যন্ত্রণা। কী করা যাবে আর কী যাবে না -সেটা বুঝতে জান খারাপ। অবস্থা এমন – ঘরে বাচ্চার খাবার নাই, বাইরে পুলিশ। কী করা! আসুন দেখি – ইউরোপে বিশেষ করে গ্রিসে কিভাবে লক-ডাউন এপ্লাই করা হচ্ছেঃ

১. গ্রিসে লক-ডাউনে আপনি বাইরে যেতে পারবেন, শুধু  চারটি কারণেঃ (i) খাবার ও ঔষধ কিনতে, (ii) কাউকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে, (iii) বয়স্ক বা শিশুর কোন প্রয়োজনে তাদের সাথে বের হতে, (iv) পোষাপ্রাণীকে হাঁটাতে নেয়ার দরকার হলে (পোষা প্রাণীর হাগু হবার জন্য হাঁটানোর দরকার আছে)। এই চার প্রয়োজনের বাইরে বের হলে, পুলিশ ধরলে সাথে সাথে ১৫০ ইউরো জরিমানা। যে কোন প্রয়োজনে বাইরে গেলে অবশ্যই আইডি কার্ড সাথে নিতে হবে।

২. মনে হচ্ছে – খুবই সহজ নিয়ম। আড্ডা মারতে বের হলাম, আর পুলিশ ধরলে মিথ্যা বলে দিলাম – খাবার কিনতে যাচ্ছি। এই চালাকি ঠেকাতে তিনটি ব্যবস্থাঃ (i) বাইরে বের হবার আগে কেন যাচ্ছেন, কোথায় যাচ্ছেন সেটা লিখে একটা নম্বরে SMS করে তারপর বের হতে হবে। গ্রিসের জন্য এই নম্বর-১৩০৩৩। SMS ফ্রি। মোবাইল কোম্পানি এই নম্বরে SMS এর জন্য ফি নিতে পারবে না। যে মোবাইল থেকে SMS করা হচ্ছে সেটি সাথে নিয়ে বের হতে হবে। (ii) SMS করতে না  চাইলে – সরকারের একটা ফর্ম আছে, সেই ফর্মে নাম, আইডি, বাসার ঠিকানা, বাইরে কোথায়, কখন, কেন যাচ্ছেন – এসব লিখতে হয়। ফর্ম অনলাইনে দেয়া আছে। ফর্মটি পূরণ করে নিজের সাইনসহ সাথে নিয়ে বাইরে বের হতে হবে। (iii) এগুলোও যদি করতে না চান, তাহলে সাদা কাগজে আপনার নাম, আইডি, ঠিকানা আর বাইরে কোথায়, কখন, কেন যাচ্ছেন সেটি লিখে, নিজে সাইন করে সাথে নিয়ে বাইরে বের হতে হবে।

৩. যেসব দোকান বা অফিস খোলা, তাদের জন্য ফর্ম আছে। ফর্মে দোকান বা অফিসের নাম, ঠিকানা আর কাজের সময় লেখা আছে। অফিস প্রধান বা দোকানের মালিক এই ফর্ম পুরণ করে সই দিয়ে প্রত্যেক কর্মচারীকে দিবেন। কর্মচারীরা এই ফর্ম সাথে নিয়ে কাজের জন্য বের হতে পারবে। অফিস প্রধান বা দোকান মালিক নিজের জন্য এই ফর্ম নিজেই সই করে সাথে রাখবেন।

৪. পুলিশ কী করে? পুলিশ রাস্তায় কাউকে পেলে তার আইডির সাথে SMS অথবা উপরের ফর্ম বা সাদা কাগজ মিলিয়ে দেখে। ডকুমেন্টস ঠিক থাকলে বাইরে কতক্ষণ থাকবে তার একটা আনুমানিক সময় বলে দিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। ডকুমেন্ট না থাকলে সাথে সাথে আড়াইশ ইউরো জরিমানা। সাথে সাথে আদায়। সাথে টাকা না থাকলে, একাউন্ট থেকে কেটে নেবে, একাউন্ট না থাকলে আইডি কার্ডের সাথে জরিমানা লিখে নেয়, পরে জরিমানার চিঠি চলে আসে।

পুলিশ কখনোই কারো গায়ে হাত তোলে না। কোন সমস্যা হলে মাটিতে বসিয়ে দেয়, বা হাত উপরে রেখে দাঁড় করিয়ে চেক করে। দরকার হলে গ্রেফতার করতে পারে। এর বেশি কিছু করলে, পুলিশের নামে অভিযোগ করার ব্যবস্থা আছে।

৫. সুপার মার্কেট বা মুদি দোকানগুলো কী করে? সেখানে এক মিটার পরে পরে লাল দাগ দেয়া আছে। এই দাগের মধ্যে শুধু একজন থাকবে। দোকানে এক সাথে কতজন ঢুকতে পারবে সেটা নির্দিষ্ট করা আছে। সেজন্য দোকানের বাইরে লম্বা লাইন দিয়ে লোকজন দাইয়ে থাকে। একজন বের হলে আর একজন ঢুকতে পারে। দোকানে যে কোন পন্য আপনি যত খুশি কিনতে পারবেন না। দোকান মালিক যদি মনে করে, সে কেনার জন্য লিমিট ঠিক করে দিতে পারবে। যেমন, এখানে অনেক সুপার মার্কেটে একসাথে অনেক রুটি কিনতে দেয় না। ২/৩ টার বেশি কিনতে গেলে ম্যানেজার ভদ্রভাবে বলে – প্লিস অন্যকে কিনতে দিন।

৬. যে কোন প্রয়োজনে একসাথে দুই জনের বেশি বের হওয়া যাবে না।একটি গাড়িতে ড্রাইভারের সাথে মাত্র একজন, মানে মোট ২ জন চলতে পারবে। মানে গাড়িতেও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

৭. বিনা অনুমতিতে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা অফিস খুললে অনেক বড় টাকার জরিমানা। রেস্টুরেন্ট বন্ধ, শুধু হোম ডেলিভারি চালু। তবে অবশ্যই আগে যাদের হোম ডেলিভারির লাইসেন্স আছে, সেই রেস্টুরেন্টগুলোই হোম ডেলিভারি করতে পারপবে। বড় বড় সুপার মার্কেটের হোম ডেলিভারি চালু আছে।

এভাবে গ্রিসে গত সপ্তাহ থেকে লক-ডাউন কার্যকর করা হয়েছে।  মহামারী নিয়ে এথেন্সের চেয়ে পুরনো অভিজ্ঞতা কারো নেই। আড়াই হাজার বছর আগে সক্রেটিসের জীবিতকালে ভয়াবহ প্লেগে এথেন্সের তিন ভাগের একভাগ মানুষ মারা গিয়েছিল। মারা গিয়েছিলো তাদের গণতন্ত্রের এক নম্বর নেতা পেরিক্লিস। গ্রিক সাহিত্যে হোমার আর সফোক্লিস খুব করুণভাবেই মহামারীর কথা লিখেছেন। তাই মহামারী নিয়ে গ্রিকরা সচেতন। এরা ভয় পায়নি, কিন্তু খুবই সচেতন। এখন পর্যন্ত সফলই বলতে হবে। গতকাল (২৬ মার্চ) রাত পর্যন্ত গ্রিসে করোনা আক্রান্ত ৮৯২ জন, মারা গেছেন ২৭ জন। পাশের ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স এমনকি ধনী জার্মানির সাথে তুলনা করলেও গরীব গ্রিস এখন পর্যন্ত সফল।

বাংলাদেশেও ছুটিতে কাজ হয়েছে। মানুষ সচেতন হচ্ছে। আমরা এই ভয় কাটিয়ে উঠব শিঘ্রই। সেই দিনটির আশায় আছি, যেদিন – পাশের মানুষটির নিশ্বাঃস ছুঁয়ে নির্ভয়ে একটা হাসি দিতে পারবো।

২৭ মার্চ, এথেন্স, গ্রিস।

 

সক্রেটিসের শহর থেকে সুজন দেবনাথ

মুগ্ধতা.কম

২৯ মার্চ, ২০২০ , ১২:৫৮ অপরাহ্ণ

করোনার দিনগুলো ২

রাজিয়া সুলতানা আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি লেখক। তিনি সেখানকার ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে পরিবারসহ বসবাস করছেন এবং সেখানে শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িত। বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের দুঃসহ সময়ে লকডাউনে থাকাকালীন তিনি লিখছেন তাঁর সেইসব অভিজ্ঞতার কথা।


রাত্রি গভীর। পাখিদের শিষে সেই মগ্নতা। আরেকটা দিন আসছে। আরেকটা ভোর। শুনছি বাঁচার জন্য বড় বড় স্টেটের কিছু মানুষ আমাদের মতো কম জনবসতিপূর্ণ স্টেটগুলোতে আসছে। বাঁচার চেষ্টা কার না থাকে? মৃত্যুভয়? কিন্তু যে ভাইরাস বাহন পেলে এক উৎস থেকে আরেক আশ্রয়ে মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় তাকে কে রোধ করবে?

ভয় পাচ্ছি কি? তাই বা কেন? তাই বা না কেন? সাবধানের মার নেই? উঁহু! রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-‘মারেরও সাবধান নেই!’ কী কথা রে বাবা!

আবার লৌহে মাহফুজে যদি পৃথিবীর সমস্ত প্রাণ একদিনে জমা হয়ে থেকে থাকে, ওগুলোর ভাগ্যও কি লেখা হয়ে যায় নি একই সময়ে! আশ্চর্য এই জীবন! এ লিভিং মিরাকল! কেউ আস্তিক আবার কেউ নাস্তিক আমরা। দু’দলই আবার নিজ নিজ বিশ্বাসে অনড়। একজন বলছে আগে বিশ্বাস তারপর যুক্তি। আরেকজন বলছে আগে যুক্তি তারপর বিশ্বাস। আহা! হৃদপিণ্ডে এই যে ধুকপুকানি – এই পাল্সটাই জীবন। মহাজীবন। কেমন করে এসে এই দেহের খাঁচায় ধরা দিয়েছে!

অন্যদিকে ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই। আহা স্বাধীনতা!

আহা! মোবাইলের মেমোরিভিলা গো! তোমারও দৃশ্যমান কোনো অস্তিত্ব দেখি নে! কী সব ভাবছি আবোল তাবোল !

চলুন, এই নিদারুণ করোনার দিনে একটা ইংরেজি কবিতা পড়া যাক। মা আর পুত্রের কথোপকথন- আমার লেখা।

The Boy On Quarantine।।

After fourteen days of quarantine, he came home

And said – the campus was such a boredom

I said, ‘Why didn’t you come early?’

He said -‘I didn’t want to give it to daddy if I was carrying one, I am worried about his age.’

He said – ‘I heard papa and mama are going up town like crazy dewans

What are they up to, mom?’

I said, ‘I don’t know but mama says it’s routine for her to go at least once’

‘Once? Once a day?’

I said, -Once a week, son’.

‘Where is the air-spring mattress you got for me?’

It’s in the closet, go see if it fits’

‘Where should I lay it?’

‘In the walk in closet

Just big enough to lay down for quarantine’

 

‘I want to pray

And say all the things I want to say to God’

‘What are they?’

I want say to God, I don’t mind to die

But I want to be safe’

 

‘What do you mean?’

‘Do you remember I said once I didn’t believe in God?

Now, I have changed my mind

Do you want to know why?’

 

‘Tell me.’

I knew God was always there and has been, He is.’

‘What do you mean?’

‘I mean I was being clever

God knows that

I had doubt before – the question where did He come from

I asked Him one day and He didn’t answer

I thought if He can’t answer my question why is He the God then?

It didn’t make sense to me

But I have given it a thought

Hard and long

Finally I thought God is God

Who is going to bail Him out

Who does not need any bond!’

‘Son, what do you mean?’

‘I mean He is all in all

And He is my rock ‘n roll.

Son, the mattress is ready, would you go on lie down?’

‘I will mom but you must believe me.’

‘Why is that important?

‘Cz, I need a witness.’

‘What for?’

‘Oh! You don’t get it! it’s my peace of mind.’

 

রাজিয়া সুলতানা

কবি, লেখক ও অনুবাদক।

জন্ম গাইবান্ধা জেলার সৈকতপাড়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে তিনি অনার্স ডিগ্রি নেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। সেখানে তিনি গণিত ও অন্যান্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনশেষে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন। ভালোবেসে ভালো নেই তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন (২০১৫)। দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থের নাম হারপুনে গেঁথেছি চাঁদ (২০১৬) । সম্প্রতি ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ইংরেজিতে অনূদিত বাংলা কবিতার সংকলন পোয়েটিকস অব গ্রীন ডেল্টা য় তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। এছাড়া তার অনূদিত আরও দুটো বই-‘ইশিগুরো তিনটি বড় গল্প’ এবং স্লোভেনীয় কবি গ্লোরজানা ভিবারের নির্বাচিত কবিতাগ্রন্থ In Proximity of Silence এর অনুবাদ ‘নৈ:শব্দ্যের কাছাকাছি’। এই গ্রন্থটি স্লোভেনিয়া থেকে প্রকাশিত হয়।

 

আমেরিকার চিঠি

মুগ্ধতা.কম

২৮ মার্চ, ২০২০ , ৪:১১ পূর্বাহ্ণ

করোনার দিনগুলো ১

রাজিয়া সুলতানা আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি লেখক। তিনি সেখানকার ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে পরিবারসহ বসবাস করছেন এবং সেখানে শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িত। বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের দুঃসহ সময়ে লকডাউনে থাকাকালীন তিনি লিখছেন তাঁর সেইসব অভিজ্ঞতার কথা।


মেয়ে ক্যাম্পাস থেকে বাড়ি ফেরার কথা শনিবারে। কিন্তু এখন সে ভয় পাচ্ছে। বলছে -‘আম্মু, মঙ্গলবারে আসি যদি তাইলে আমার বাইরে যাওয়ার ১৪ দিন পূরণ হবে। গ্রোসারি করতে বাইরে গিয়েছিলাম। আব্বুর জন্য চিন্তা হয় বেশি। কারণ, আব্বুর বয়স। তাই মঙ্গলবার আসব। গাড়িতে যথেষ্ট পরিমাণে গ্যাস আছে। গ্যাস নেয়ার জন্য পথে থামতে হবে না।’

মেয়ে এও জানালো যে আমরা একসঙ্গে এবার নিয়মিত নামাজ কালাম পড়ব। আমি বললাম-‘এই সময়টাতে তোমাদের বাংলাও শেখাব আমি। তোমাকে আর বাবুইকে। রান্না কিছু শিখতে চেয়েছিলে, তাও শেখাব।’ মেয়ে শুনে খুশি। বলল-‘গ্রোসারি শেষ হয়ে এলে অনলাইনে অর্ডার দিতে হবে যেন আব্বুকে স্টোরে আর যেতে না হয়।’

এদিকে তিন বেডরুমের বাসা আমাদের। মেয়ে এলে চারজনকেই আলাদা বিছানায় ঘুমোতে হবে। সামনের বেডরুমের সামনে একটা রুম আছে ( ওয়াক ইন ক্লজেট)। সেখানে একটা এয়ার স্প্রিং ম্যাট্রেস কিনে পাতানোর ব্যবস্হা করা হচ্ছে। আমি আর এশার আব্বুকে এখনও কাজে যেতে হচ্ছে বলে এই সাবধানতা। সবাইকে আলাদা আলাদা রুমে ঘুমোতে হচ্ছে।

এশা বলল-‘ছোটমামা যা যা করছে আমাদেরকেও সেভাবে চলতে হবে। ছোটমামা বাইরে থেকে এসে বাইরেই কাপড় বদলাচ্ছে।’ আমি বললাম-‘হু, তোমার ছোটমামা পুরুষমানুষ, তাই তা করতে পারছে। তাহলে তোমার আব্বুকেই শুধু বাইরে পাঠাতে হবে।’

মেয়ে এবার ফোনে মুচকি হেসে বলল-‘ঠিক।’ এবার প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললাম-‘আজ পাপা মামা কী করেছে জানো? পাপা মাস্ক পরে বাজার করতে গেছেন মামাকে নিয়ে। মামা মাস্কের ঝামেলা নিতে পারেন না। আমি জানলাম তোমার আব্বুর কাছ থেকে। জিজ্ঞেস করলাম যখন বাজার না করাই আছে! তখন তোমার আব্বু বলল-‘মামার এটা রুটিন। থামতে পারছেন না। কী যে হবে!’

আমি বললাম-‘মামাকে থামাও। তা না হলে একজনের জন্য সবাইকে পটল তুলতে হবে। মাথা খারাপ হয়েছে নাকি মামার!’

মেয়েকে বললাম-‘তোমার আব্বুর কথা শুনবে? কাজে গিয়ে কল দিয়ে বলছে-‘সকালে একটা হাগ চেয়ে নিতে ইচ্ছে করছিল। তোমার ঘরে গিয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে মায়া হলো, আমার চাওয়াটা পুষিয়ে নিলাম। তুমি ভয়ে সরে আছ যে কারণে সেই কারণে আমারও সাবধান হওয়া প্রয়োজন। কারণ, আমাদের দুজনকেই কাজে বাইরে যেতে হচ্ছে।’

 

রাজিয়া সুলতানা

কবি, লেখক ও অনুবাদক।

জন্ম গাইবান্ধা জেলার সৈকতপাড়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে তিনি অনার্স ডিগ্রি নেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। সেখানে তিনি গণিত ও অন্যান্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনশেষে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন। ভালোবেসে ভালো নেই তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন (২০১৫)। দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থের নাম হারপুনে গেঁথেছি চাঁদ (২০১৬) । সম্প্রতি ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ইংরেজিতে অনূদিত বাংলা কবিতার সংকলন পোয়েটিকস অব গ্রীন ডেল্টা য় তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। এছাড়া তার অনূদিত আরও দুটো বই-‘ইশিগুরো তিনটি বড় গল্প’ এবং স্লোভেনীয় কবি গ্লোরজানা ভিবারের নির্বাচিত কবিতাগ্রন্থ In Proximity of Silence এর অনুবাদ ‘নৈ:শব্দ্যের কাছাকাছি’। এই গ্রন্থটি স্লোভেনিয়া থেকে প্রকাশিত হয়।

 

আমেরিকার চিঠি-করোনার দিনগুলো ১