দূর পরবাস

দূর পরবাস

তাজনিন মেরিন লোপা

২৫ মে, ২০২০ , ৬:৪১ অপরাহ্ণ

শুভ জন্মদিন প্রিয়তম সুজন

লেখক ও তার স্বামী

আকাশ ভরা মেঘ, তবুও দূরে কোথাও এক টুকরো তারার হাতছানি। ওহ আমি তো তারাই ভেবেছি ; তুমি না বললে ওটা সূর্য এর রশ্মি! কোথাও এক ফোঁটা পানিতে পড়ে ছোট্ট করে আলো ছড়িয়েছে।

দূরে প্রান্তরে এক কোকিল ডেকেই যাচ্ছিল, কি তৃষ্ণাত তার স্বর! পাহাড়ের গা ডিঙ্গিয়ে, নদী পাড় হয়ে ভেসে আসছে সে তীব্র কন্ঠ। কঠিন ভালোবাসায়ও মনে কেমন এক হাহাকার দিয়ে যায়। ভেবেছিলাম বুঝি বসন্ত আসছে; আসলে তো তা না। তুমি বললে কই আর বসন্ত তাকিয়ে দেখো শীতকালই ফুরায়নি! সত্যিই তো।

অপেক্ষা, সময়,বাস্তবতা, কিছু দীর্ঘ মূহুর্তে আমরা থমকে যাই। থেমে তো যাই না। থামতে নেই। তুমিই বললে…

দেখো, থামিনি কেউ, চলছি; চালিয়ে নিচ্ছি। কখনও অদৃশ্য তারার হাতছানিতে, কখনও প্রতারিত মিষ্টি কোকিলের কন্ঠে, কখনও ভালোবাসায় ভেসে ভেসে!

তাইতো আমাদের এক একটা জন্মদিন আসে, সময় পার হয়। আমরা শুভ করার আশা রাখি।

শুভ জন্মদিন প্রিয়তম সুজন।

তাজনিন মেরিন লোপা

শুভ জন্মদিন প্রিয়তম সুজন

তাজনিন মেরিন লোপা

১৬ মে, ২০২০ , ৮:১৭ অপরাহ্ণ

করোনা সময় অস্ট্রেলিয়া: লকডাউন ও শিথিলতা

এখন পর্যন্ত আরমিডেল নিরাপদে আছে। দুটোর পরে আর নতুন কোন পজিটিভ পাওয়া যায়নি। অনেককিছুই একটু শীথিল করে দিলো। কোভিড-১৯ এর জন্য মোবাইল অ্যাপস্ বানালো। যেখানে কোভিড-১৯ উপস্থিতি নির্ণয় করাসহ আরো নানান সহযোগিতা পাওয়া যাবে। ১১ মে এর পর থেকে একদিনের জন্য বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে। যাতে করে একদিনে একই সময়ে কম সংখ্যক বাচ্চারা উপস্থিত থাকে। ২৫ মের মধ্যে সকল স্কুল খুলে দেয়ার কথা ভাবছে নিউ সাউথ ওয়েলস গভঃ। তবে বেশিরভাগ মানুষ, যে কাজগুলো সম্ভব, তারা বাসা থেকেই অফিস করবে।

রাজধানী ক্যানবেরা প্রথম দিক থেকেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। গত দুই মাসে নতুন কোন সংক্রমণ হয়নি। এখানে এখন শরৎকাল। খুব বেশি ঠাণ্ডা এখনও পড়েনি। বাইরে বেড়ানোর জন্য খুব ভালো একটা সময়। ক্যানবেরার পরিচিত, বন্ধু-বান্ধবরা তাই বাইরে বেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্কুল এখনও খোলেনি। সব অফিস খোলেনি। আর সবখানে সোস্যাল ডিসটেন্স মেনে চলছে সবাই। বাইরে বের হয়ে দেখি রাস্তায় কতশত গাড়ি; প্রামে, স্ট্রলারে করে বাচ্চাদের নিয়ে বেড়িয়েছে, কেউ আবার পরিবারের সবাই সাইকেল চালাচ্ছে; কেউ হাঁটতে বেড়িয়েছে।

মুসলিমদের রমজান মাস শুরু হয়ে গেছে। প্রাইম মিনিস্টার সবার উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা জানালেন। আর বললেন সবাই যেন বাড়িতে বাড়িতে তাদের রমজান পালন করেন। সোস্যাল গ্যাদারিং না করার জন্য। এই ইস্টারে সোস্যাল গ্যাদারিং সামলানো নিয়ে বেশ চিন্তায় ছিলো সবাই। তবে সবাই সবজায়গায় বেশ ভালো মেনে চলেছে । এক বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল, তখন জানলাম, শুধু তাজমানিয়াতে দুটো পরিবার জরিমানা দিয়েছে । তিনজন মানুষের এক পরিবারে দুজন অতিথি আসলে; প্রতিবেশি একজন সাথে সাথে পুলিশকে খবর দেয়।

পুলিশ এসে সবার জন্য পাঁচ হাজার ডলার জরিমানা করে । এর মধ্যে একজন পনেরো বছর বয়সের নিচে ছিল বলে সবাই অনেক অনুরোধ করে। কিন্তু না পুলিশের বক্তব্য ছিল, বয়স কম বলেই তো ওকে আরও ভালো করে আইন-কানুন, জানতে এবং শিখতে হবে। আমরাও সোস্যাল ডিসটেন্স মেনেই চলছি। ছোট জায়গা, ছোট কমিউনিটি বলে আরমিডেলে বাংলাদেশীদের যোগাযোগ ভালো।

উৎসবের, আয়োজনের কোন ঘাটতি নেই। এই রমজানে সেটা আরও বেড়ে যেত। তবে এ বছর সবাই সব মেনে বাসায় বাসায় দরজায় দাঁড়িয়ে ইফতার দিয়ে, খোঁজ নেয়া হচ্ছে। মসজিদে ইফতার রেখে দিয়ে সবাইকে বলা হচ্ছে, নিয়ে যাওয়ার জন্য। পরিচিত একজনের খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। দরজার সামনে দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। পুলিশ না এসে পড়ে! যাক সেরকম কিছু হয়নি। সংক্রমণ থেকে যেমন বাঁচতে হবে; তেমন যারা বেঁচে আছি সামাজিকতাও রক্ষা করতে হবে।

শপিংমলগুলোতে প্রযোজনীয় কয়েকটা সুপারস্টোর প্রথম থেকেই খোলা। ফ্যাশন হাউজ, খাবারের দোকান, অন্যান্য দোকান বন্ধ। কে এফ সি, ম্যাকডোনাল্ড, ডমিনোজ টাইপ শপে শুধু ড্রাইভ থ্রু খোলা। মানে গাড়ি ড্রাইভ করে অর্ডার দিয়ে, পে করে খাবার নিয়ে যাবে। কেউ নামবে না, ইন্টারেকশন হবে না। তাই নিরাপদ। এখনও তাই চলছে।

দেশে আমাদের সবাই। সেখানকার পরিস্থিতি শুনেই দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যাচ্ছি। কে কোথায় কী নিয়ন্ত্রণ করছে, তা কেউই বুঝতে পারছে না।  এখানে এরকম লকডাইনে ইস্টার পার হলো। সব ঠিক না হলে হয়তো ক্রিসমাসও চলে যাবে। কিন্তু আমাদের ঈদ পার হয় না। খুব খারাপ লাগে, আমরা বুঝি আসলেই পারি না।

এখানেও অনেক কিছুই হয়। কিন্তু তা বাড়াবাড়ির আগেই নিয়ন্ত্রণের চিন্তা আসে। সিডনিতে এক অজি ভদ্রলোক এশিয়ানদের দেখে বেশ গালিগালাজ করেছিল; এশিয়ানরাই নাকি কোভিড-১৯ নিয়ে এসেছে তাই। কিন্তু এই ঘটনার আর কোন ধরণের প্রভাব পড়েনি। এরকম আরও ঘটনা ঘটেছে অনেক জায়গাতেই। কিন্তু তারপরও এখানে কেউ অসুস্থ বোধ করলে নিজেই যাচ্ছেন টেস্ট করাতে।

আমাদের বাসার বিল্ডিং এরও একজন টেস্ট করালেন। নিজেই আমাদের জানালেন। এরপর নেগেটিভ আসলো। আর আমাদের দেশে কেউ কেউ পজিটিভ আসার পরেও লুকিয়ে রাখছেন। কেউ পালিয়ে যাচ্ছে। নিজের, নিজের আপনজন কারোও কথাই ভাবছি না আমরা। পরিবারের নাকি মান-সম্মান যাবে পজিটিভ জানলে। যেখানে জান নিয়ে টানাটানি সবার সেখানে হায়! আমরা মান-সম্মান নিয়ে কতটা চিন্তিত। এর দায়ভার হয়তো আমাদেরই। কখনোও আমরা একজন আরেকজনের জন্য জান-প্রাণ দিয়ে দেই; আবার কখনোও সামান্য কারণেই কোণঠাসা করে ফেলি।

বড় অদ্ভুত আমরা। ‍ঈদে বা প্রতিমাসে, বা প্রতিদিন আমাদের নতুন পোষাক পড়া নিয়ে আমরা যতো ভাবি; লেখাপড়া, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের ভাববার সময় কম। কিন্তু আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। অস্ট্রেলিয়াতে সরকার জুলাই পর্যন্ত লকডাউন শিথিলতাসহ, সকল প্রতিষ্ঠান খোলা, বন্ধ, ও অন্যান্য বিষয়ে বেশ গঠনমূলক পরিকল্পনা করেছে। এবং তা জনগণেকে জানিয়েছে।

প্রতিদিন নিজ নিজ স্টেটের প্রিমিয়ার ও সরকারি অন্যান্য ব্যক্তিরা সংবাদ সম্মেলনে তা নিয়ে কথা বলছেন। এরপরও এখানকার মানুষগুলো নিজে থেকে খুব সাবধান থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশে শুধু এগিয়েই যাচ্ছি; যাচ্ছি তো যাচ্ছি; কীসের দিকে কোন দিকে তা কে জানে?

 

চলবে

 

তাজনিন মেরিন লোপা

জন্ম রংপুরের এক সাহিত্যানুরাগী পরিবারে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, রংপুরের জনপ্রিয় মুখ। ’যুগের আলো’ পত্রিকায় নিয়মিত লেখক হিসেবে লিখেছেন ছড়া, কবিতা, সায়েন্স ফিকশন, ছোট গল্প, লিখেছেন কলাম। ঢাকায় ‘ছোটদের কাগজ’ এ লেখক হিসাবে সক্রিয় ছিলেন। শিশু-কিশোর সাহিত্য নিয়ে ২০১৯ একুশে বইমেলায় আত্মপ্রকাশ করছেন ‘ডাইনীর ফলবাগান’, ২০২০ এ ‘অস্ট্রেলিয়ার রূপকথা’ বই নিয়ে। নৃবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  স্নাতক আর স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। বাংলাদেশে কলেরা হাসপাতালে সামাজিক গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন অনেকদিন। খুব সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল সরকার এর অনুদানে পরিচালিত ’হিপ্পি অস্ট্রেলিয়া’ নামে একটি সংস্থায় টিউটর হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। সংস্থাটি  মূলত তাদের নিজেদের কারিকুলামে কমিউনিটির ছোট শিশুদের মানসিক ও ইতিবাচক সামাজিক উন্নতির জন্য কাজ করে। বর্তমান নিবাস আরমিডেল, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া ।

 

করোনার সময় অস্ট্রেলিয়া-তাজনিন মেরিন লোপা

সুজন   দেবনাথ

১৪ মে, ২০২০ , ৫:৪১ অপরাহ্ণ

শাপোর গল্প

লেখক সুজন দেবনাথ গ্রিসের এথেন্সে বাংলাদেশ দুতাবাসের কাউন্সেলর। সেখান থেকে মুগ্ধতা ডট কমের জন্য লিখেছেন তিনি।


গ্রিসের পূব কোনায় একেবারে তুরস্কের পেটের মধ্যে একটি দ্বীপ আছে। নাম লেসবস। এই লেসবস থেকে ইংরেজি ‘লেসবিয়ান’ শব্দটি এসেছে। এই শব্দটি চালু হবার গল্পটাও অদ্ভুত। এই দ্বীপে শাপো নামে এক নারী কবি ছিলেন। তিনি ছিলেন অসীম প্রতিভার অধিকারী। সেজন্য পুরুষরা তাকে হিংসা করত। শাপো ভালবাসার কবিতা লিখতেন। পুরুষরা বলতো, সেগুলো নাকি এক মেয়ে অন্য মেয়ের প্রতি ভালোবাসার কবিতা। তারা শাপোকে বলতো লেসবসের শাপো। লেসবসের শাপো থেকে হয়ে যায় লেসবিয়ান শাপো। ইংরেজিতে এই শব্দটি নেয়া হয়েছে।

‘হেমলকের নিমন্ত্রণ’-এ এই গল্পটি আছে। সারাদিন করোনা নিয়ে আলাপ করতে করতে মন ক্লান্ত। আসুন মনকে একটু রিলিফ দেই। শাপোর ঘটনা একটুখানি পড়ি:

প্লটটা এমন – এথেন্সের গণতন্ত্রের এক নম্বর নেতা ‘পেরিক্লিস’ আর সময়ের সবচেয়ে বুদ্ধিমতী নারী ‘আসপাশিয়া’ গল্প করছে। গল্পের বিষয় গণতন্ত্রের জন্ম কীভাবে হলো সেটা। সেই গল্পের ফাঁকে আসপাশিয়া হঠাৎ শাপোর একটি কবিতা বলে।

“রক্তরাঙা মিষ্টি এক আপেল

রয়ে গেছে সবচেয়ে উঁচু ডালে

তাকে তুলতে ভুলে গেছে মালি

এখনো অনাঘ্রাত, নিবে কি তুলে?”

আসপাশিয়া মিষ্টি করে কবিতাটি বললো। এটি লিখেছেন লেসবস দ্বীপের নারী কবি শাপো। আসপাশিয়া খুবই আবেগ দিয়ে কবিতাটি বলছে। বার বার বলছে, যেন পেরিক্লিস বুঝতে পারে কবিতার এই অনাঘ্রাত আপেল আসপাশিয়া নিজে।

পেরিক্লিস বুঝার চেষ্টা করছেন। এটি একটি বিখ্যাত কবিতা। প্রেমের জন্য খুবই ভাল। যুবকদের মুখে প্রায়ই শুনা যায় কবিতাটি। তবে এই মুহূর্তে কবিতাটি  নিয়ে ভাবছেন না পেরিক্লিস। তিনি ভাবছেন কবিকে নিয়ে। এই কবিতার নারী কবি শাপোকে নিয়ে অনেক কানাঘুষা আছে। তাকে নিয়ে গুজবের শেষ নেই। মেয়েরা কিছু লিখলে সেটা নিয়ে এমনিতেই আলোচনা, সমালোচনা হয়। আর কোনো মেয়ে যদি প্রেম নিয়ে লিখে, সেটা নিয়ে পুরুষের কেমন জানি লাগে। তারা কানাঘুষা শুরু করে, কানাঘুষা থেকে তৈরি হয় গুজব। এই কথা কবি শাপো জানতো না। সে মেয়ে হয়েও প্রেমের কবিতা লিখেছে। একটা দুটা না, পুরো এক বই প্রেমের কবিতা।

শাপোর কবিতার বই প্রকাশের সাথে সাথেই শুরু হলো আক্রমণ। একটি মেয়ে প্রেমের কবিতা লিখেছে। মেয়েরা প্রেমের কবিতা কেন লিখবে? প্রেমের কবিতা লিখবে পুরুষেরা। পুরুষেরা মেয়েদের দেখে প্রেমের কবিতা লিখবে। প্রেমের কবিতা শুধুই মেয়েদের উদ্দেশ্যে লেখা হয়। তো কবি শাপো প্রেমের কবিতা লিখেছে, মানে সে মেয়েদের উদ্দেশ্যেই লিখেছে। তার মানে তার কবিতা হলো মেয়ের প্রতি মেয়ের প্রেম। ছিঃ ছিঃ, শাপো এত খারাপ? সে মেয়ে হয়ে মেয়েদের উদ্দেশ্যে প্রেমের কবিতা লিখে? সে মেয়েদের ভালোবাসে? কেউ জানতে চাইল না, শাপো কার জন্য এই কবিতা লিখেছে। সবাই বললো, কবি শাপো ছেলেদের ভালোবাসে না, সে মেয়েদের ভালোবাসে। কবি শাপোর যেখানে বাড়ি, সেই দ্বীপের নাম লেসবস। লেসবস দ্বীপের নাম থেকে মেয়ের সাথে মেয়ের প্রেম বিষয়টির নাম দিল লেসবিয়ান।

ব্যাপারটা ভাবতেই মাথা ধরে যাচ্ছে পেরিক্লিসের। মানুষ এত খারাপ?  তারা মেয়েদের কবিতাও লিখতেও দিবে না। মেয়েরা কবিতা লিখলেই গ্রিসে নিন্দা হয়। সেই ভয়ে আজ পর্যন্ত গ্রিসে কোন মহিলা কবি নেই। ভদ্র মেয়েরা কবিতা থেকে দূরে থাকে। তারা কবিতাকে ভয় পায়।

আসপাশিয়ার মনে হয় এই ভয় নেই। সে কি সুন্দর করে এ কবিতা আবৃত্তি করছে। পেরিক্লিস যখন শাপোকে নিয়ে ভাবছিল, সেই ফাঁকেও আরো একবার কবিতাটি আবৃত্তি করে ফেলেছে।

আসপাশিয়া বললো, কবিতার অনাঘ্রাত আপেল কে জানেন?

‘কে?’

‘এথেন্স। আপনার ভালোবাসার এথেন্স। আমি জানি আপনি এথেন্সকে পাগলের মতো ভালোবাসেন। গণতন্ত্রকে তার চেয়ে বেশি ভালোবাসেন।’ কথা মিথ্যা নয়। পেরিক্লিস এথেন্স আর গণতন্ত্রকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন। পেরিক্লিস এবার গণতন্ত্র নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। তিনি বুঝতে পারছেন এই মেয়ে তাকে নাচাচ্ছে।  কিন্তু কেন যেন নাচতে তার ভালো লাগছে।

আকাশে অনেক তারা। পেরিক্লিস জানালা দিয়ে আকাশে তাকিয়ে আছেন। রাতটা বড়ো সুন্দর। একটু আগেই আসপাশিয়া এই রাতকে বলেছে ‘গণতন্ত্রের চাদরের উপর নির্ঘুম রাত’।

একটি মেয়ে খাবার দিয়ে গেছে। ভুট্টার স্যুপ আর ছাগলের পা। হাল্কা মশলা দিয়ে ছাগলের পা কড়া করে ভাজা। এই খাবারের নাম পাইদাকি। আসপাশিয়ার খুব প্রিয় খাবার। সে নিজে আজ অনেক মমতা দিয়ে রেঁধেছে। পেরিক্লিস ভুট্টার স্যুপ দিয়ে পাইদাকি খাচ্ছেন।

খাওয়া শেষ হলে আসপাশিয়া বললো, গণতন্ত্রের গল্প ভুলে যেতে নাহি দেবো। বলুন, আপনার দাদু কীভাবে গণতন্ত্র আবিষ্কার করলেন।
পেরিক্লিস আবার বক্তৃতার মতো করে শুরু করলেন -গণতন্ত্র আবিষ্কার কথা…।

[ যারা বেশি জানতে চায় তাদের জন্য বলছি – শাপো সক্রেটিসের আগের প্রজন্মের নারী। তার মৃত্যু হয় খ্রি.পূ. ৫৭০ অব্দে, আর সক্রেটিসের জন্ম খ্রি.পূ. ৪৬৯ অব্দে। সক্রেটিস আর আসপাশীয়া এক বয়সের লোক। তবে সক্রেটিস আসপাশিয়াকে তার গুরু বা শিক্ষিকা বলতেন। ]

সব পাঠকের জন্য শুভকামনা। আমরা করোনাকে জয় করব। সেই সাথে নিজের অমানবিক আচরণকে জয় করব। পরমাণু তত্ত্বের জনক গ্রিক দার্শনিক ডিমোক্রিটাস বলতেন,

‘নিজের কাছে জিততে পারাই জীবনের সবচেয়ে বড় জয়।’

 

সক্রেটিসের শহর থেকে-শাপোর গল্প

সুজন   দেবনাথ

৮ মে, ২০২০ , ৯:০৯ অপরাহ্ণ

সক্রেটিসের নগরে রবীন্দ্রনাথ [ প্রথম পর্ব]

লেখক সুজন দেবনাথ গ্রিসের এথেন্সে বাংলাদেশ দুতাবাসের কাউন্সেলর। সেখান থেকে মুগ্ধতা ডট কমের জন্য লিখেছেন তিনি।


[১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ একটানা ছয় মাস ইউরোপের কয়েকটি দেশে ভ্রমণ করেন। সেই ভ্রমণ ছিলো একই সাথে সফল এবং বিতর্কিত। ইতালীতে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনীর অতিথি হয়েছিলেন বলে একদিকে কবির সমালোচনা হয়েছে, আর অন্যদিকে ইউরোপের প্রতিটি নগরে হাজারো মানুষ ছুটে এসেছে তাকে এক নজর দেখতে। সব মিলিয়ে ভ্রমণটি ছিলো রোমাঞ্চে ঘেরা। কিন্ত সেই রোমাঞ্চিত ভ্রমণের তেমন বিস্তারিত বিবরণ কোথাও নেই। এই না থাকা নিয়ে কবির নিজের আক্ষেপ ছিলো, শেষ জীবনেও তিনি এটি নিয়ে আফসোস করেছিলেন। ১৯৪১ সালে ৬ এপ্রিল তিনি লিখেছিলেন, ‘এই আশ্চর্য ইতিহাসটিকে লিপিবদ্ধ করিবার জন্য বাইরের সাক্ষ্যর প্রয়োজন আছে’। আবার এই আক্ষেপের কথা ভ্রমণসঙ্গী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ও তার স্ত্রীকে কবি লিখেছেন, ‘যা কোথাও প্রকাশ পেলো না তার দাম খুব বেশি।’ তো এই ‘যা কোথাও প্রকাশ পেলো না’, তার কিছু অংশ বের করতে চেষ্টা করেছি। সেই ভ্রমণে কবি এথেন্সে এসেছিলেন ১৯২৬ সালের ২৫ নভেম্বর। ছিলেন মাত্র নয় ঘণ্টা। আমি এথেন্সে এসে চেষ্টা করেছি সেই ভ্রমণের খুঁটিনাটি বের করতে। সেই সময়ের এথেন্সের পত্রিকা, গ্রিক ভাষায় প্রকাশিত কয়েকটি নিবন্ধ, কবির পত্রাবলী আর জীবনী ঘেঁটে গল্পের ঢঙে বলতে চেয়েছি রবীন্দ্রনাথের এথেন্স ভ্রমণ। ]

১৯২৬  সালের ২৫ নভেম্বর।

খুব সকালে এজিয়ান সাগরের গাঢ় কুয়াশা কেটে চলছে জাহাজ ‘এমপারোর ট্রাজান’। রোমের সম্রাট ট্রাজানের নামে এই জাহাজের নাম। জাহাজটি ইস্তাম্বুল নগর থেকে এথেন্সের দিকে চলছে। গন্তব্য এথেন্সের পিরাউস বন্দর। ঘন কুয়াশার ভেতর মর্মর সাগর আর এজিয়ান সাগরের বিশাল জলরাশি পার হয়ে জাহাজটি খুব সকালে এথেন্সের পিরাউস বন্দরের কাছাকাছি পৌঁছল। দূরে থেকে একটা লাইট হাইজের বাতি একটু একটু দেখা যাচ্ছে। এমনিতে এইসব জাহাজ যাত্রার তেমন কোন বিশেষত্ব নেই। সপ্তাহে তিন দিন ইস্তাম্বুল থেকে জাহাজ আসে এথেন্সে। কিন্তু আজকের এই জাহাজ ‘এমপারোর ট্রাজান’ এর আলাদা মাহাত্ম্য আছে। এই জাহাজে করে এথেন্সে আসছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী দ্যা গ্রেট টেগোর। নোবেল জয়ের পর ইউরোপে তিনি এখন সেলিব্রেটি। ইউরোপের যেখানেই যান, মিডিয়ায় শোর ওঠে – ‘শুনেছ, টেগোর আসছেন শহরে’।
জাহাজ এগিয়ে চলছে। কবি প্রতিদিনই ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যা ত্যাগ করেন। প্রভাত সূর্যের সাক্ষাৎ না করে দিন শুরু করেন না। পয়ষট্টি বছর বয়সেও এই নিয়মের কোন ব্যত্যয় নেই। আজও খুব সকালেই জাহাজের প্রথম শ্রেণীর কেবিন থেকে বের হলেন রবীন্দ্রনাথ। ঘন কুয়াশায় সূর্য দেখা যাচ্ছে না। শুধু একটা লালচে ঊষার আভা ভেসে উঠেছে পূব আকাশে। সেই আভাতেই সাগরের বুকে ছোট ছোট দ্বীপ দেখা যাচ্ছে।

অগাধ জলরাশির মধ্যে পাহাড়ের মত ভেসে আছে এক একটা দ্বীপ। কবি বুঝলেন, তিনি গ্রীসের খুব কাছে এসে পড়েছেন। দার্শনিক পেল্টো সাগরের বুকে গ্রীসের এই দ্বীপগুলো দেখে বলেছিলেন, ‘বিশাল পুকুরের মাঝে যেন কতগুলো ব্যাঙ ভেসে আছে’। এতোদিন গ্রীসের এই দ্বীপগুলো ছিলো কবির দূরের বন্ধু। প্রতিবার ইউরোপে যাবার সময় জাহাজ থেকে ইতালির আগে গ্রিসের এই দ্বীপগুলো নজরে আসতো। বামদিকে ক্রীট দ্বীপের পাহাড়গুলো দেখলেই তিনি অনুমান করতেন, তাঁর জাহাজ ইউরোপে পৌঁছে গেছে। আজ আর অনুমান নয়, সত্যিই এই দ্বীপগুলো তাঁর অনেক কাছে। স্বপ্নের গ্রীস খুব নিকটে চলে এসেছে।

কবির মনে পড়লো অনেক দিন আগে দ্বিতীয়বার ইউরোপ যাত্রার সময় এই দ্বীপগুলো দেখতে দেখতে মৃণালিনী দেবীর কথা অনেক মনে পড়ছিলো। মৃণালিনী তখন মাত্র সতের বছরের কিশোরী। আর সেই সতের বছরেই দুটি সন্তানের জননী। সেবার স্ত্রী-সন্তানদের একা রেখে ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর বন্ধু লোকেন পালিতের সাথে বিলেত যাচ্ছিলেন তিনি। যাত্রার পথে তার কেবলই মৃণালিনীর কথা মনে পড়ছিলো। জাহাজ থেকে মৃণালিনীকে লিখেছিলেন,

‘ভাই ছোট গিন্নী,

…… আমরা, ধরতে গেলে পরশু থেকে য়ুরোপে পৌঁচেছি। মাঝে মাঝে দূর থেকে য়ুরোপের ডাঙ্গা দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের জাহাজটা এখন ডানদিকে গ্রীস আর বাঁ দিকে একটা দ্বীপের মাঝখান দিয়ে চলেছে। দ্বীপটা খুব কাছে দেখাচ্ছে – কতগুলো পাহাড়, তাঁর মাঝে মাঝে বাড়ি, এক জায়গায় খুব একটা মস্ত সহর – দূরবীন দিয়ে তাঁর বাড়িগুলো বেশ স্পষ্ট দেখতে পেলুম – সমুদ্রের ঠিক ধারেই নীল পাহাড়ের কোলের মধ্যে শাদা সহরটি বেশ দেখাচ্ছে। তোমার দেখতে ইচ্ছে করছে না ছুটকি? তোমাকেও একদিন এই পথ দিয়ে আসতে হবে তা জান?’

না, মৃণালিনী কোনদিন এইপথ দিয়ে আসেন নি। ইউরোপ দেখার সাধ পূর্ণ হবার আগেই সেই চিরবিরহিনী চলে গেছে কবিকে একা রেখে। সেই সময় কবি তাকে ‘ছোট গিন্নী’ বলতেন। চিঠি লিখতেন ‘ভাই ছোট গিন্নী’ বলে। ঠাকুর বাড়ির ছোট বউ বলে আদর করে ডাকতেন ‘ছুটি’। চিঠিতে লিখতেন ‘ভাই ছুটি’। সেই ‘ছুটি’ অনেক বছর আগেই ছুটি নিয়ে চলে গেছে তাকে ছেড়ে। আজ আবার গ্রীসের এই দ্বীপগুলো দেখে কবির সেই চিঠির কথা মনে পড়লো। মনটা ভীষণ বিষণ্ণ হয়ে গেলো। এখন অমন একটা চিঠি লেখার মত একজন মানুষও তাঁর নেই। জীবনের কিছু দুঃখ কখনও শেষ হয় না, কিছু ক্ষত কোনদিনই পূরণ হয় না। তিনি কেবিনে ফিরে গেলেন। কলম হাতে নিলেন।

কবির শরীর তেমন সুস্থ নয়। দীর্ঘ ভ্রমণে ভীষণ ক্লান্ত। কিছুদিন আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। একটানা ছয় মাসের উপরে হয়ে গেলো – ইউরোপের এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরছেন আর বক্তৃতা করেছেন। ইউরোপ-আমেরিকায় তাঁর বক্তৃতার কদর আছে আর এ থেকে বেশ দু’পয়সা আয় হয়। শান্তিনিকেতনের বিপুল খরচ যোগাড় করার জন্য এই টাকাটা ভীষণ প্রয়োজন। এটা টের পেয়ে পশ্চিমের কিছু পত্রিকা ক’বছর আগে তাকে ‘ডলার কামানো বক্তা’ বলে গালি দিয়ে নানান কথা লিখেছে। কিন্তু সেই পত্রিকায়ালারা তো আর জানে না – কবি এই ডলার দিয়ে কী করছেন। পশ্চিমের গুণীরা যেখানে একবার নোবেল প্রাইজ পেলে, সেই টাকা দিয়ে বেশ আরামেই জীবন কাটায়, সেখানে এই বাঙ্গালী কবি তাঁর সব কিছু দিয়ে শান্তি নিকেতন চালাচ্ছেন। শিক্ষার জন্য ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দেশ থেকে দেশে ছুটে যাচ্ছেন। এজন্য মিডিয়ার সমালোচনা গায়ে মাখলে চলবে না। কিন্তু যেটা গায়ে মাখতে হয়, সেটা হলো – টাকার ফাঁদে ফেলে দুষ্ট লোকদের মন্দ অভিসন্ধি। এবারের ইউরোপ ভ্রমণটা শুরুই হয়েছিলো ওইরকম একটি অভিসন্ধি দিয়ে। কূটচাল দিয়ে ইতালির একনায়ক বেনিতো মুসোলিনী আমন্ত্রণ করেছিলো কবিকে।

মুসোলিনী ভীষণ ধুরন্ধর মানুষ। সে চেয়েছিলো রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে নিজের পাল্লা ভারী করতে। তখনো কবি মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদী চরিত্রের কথা ভালো করে জানতেন না। ইতালি যাবার নিমন্ত্রণ নিয়ে এলো কবির পরিচিত ইতালিয়ান অধ্যাপক ফর্মিকি। সংস্কৃত ভাষা আর বৌদ্ধ সাহিত্যের অধ্যাপক এই ফর্মিকি। তিনি লাল-ভোল দিয়ে ১৯২৬ সালের মে মাসে কবিকে নিয়ে গেলেন ইতালীতে। সেখানে শান্তিবাদী কবি সাদা মনে মুসোলিনীর অকুণ্ঠ প্রশংসা করলেন। ইতালীর ফ্যাসিস্ট পত্রিকাগুলোতে সেই খবর প্রকাশিত হলো উল্লাসের সাথে। তারা লিখলো, দেখো, এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী দ্যা গ্রেট টেগোর সমর্থন করে মুসোলিনীকে। তবে অচিরেই কবি টের পেলেন মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদী রূপ। তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হলেন মানুষের শঠতা দেখে। অধ্যাপক ফর্মিকি তাকে ঠকিয়েছে, মুসোলিনী সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাকে মঞ্চে তুলেছে। টের পেয়েই কবি ইতালি ত্যাগ করলেন। কিন্তু ভুল করে ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করার জন্য কবির মনে তীব্র অন্তর্জ্বালা শুরু হলো। সুইজারল্যান্ডে গিয়ে দেখা হলো রমাঁ রলাঁর সাথে। তাঁর কাছে ফ্যাসিজমের ভয়ংকর আগ্রাসনের কথা শুনলেন। অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। ভীষণ মনোবেদনা নিয়ে যখন ভিয়েনা পৌঁছলেন, তখন তিনি গুরুতর অসুস্থ। লন্ডনে চিকিৎসা নিলেন। চিকিৎসার পর প্রথম বক্তৃতায়ই ফ্যাসিবাদকে পৃথিবীর অভিশাপ বলে সমালোচনা করলেন। এরপর নরওয়ে, ডেনমার্ক, জার্মানি, হাঙ্গেরি, যুগোস্লাভিয়া, রোমানিয়া থেকে ইস্তাম্বুল (কনস্টান্টিনোপল) হয়ে এখন এথেন্সের পথে। এই দীর্ঘ ভ্রমণ, অসুস্থ শরীর আর বিধ্বস্ত মন নিয়ে কবি চলেছেন সক্রেটিসের নগরে।

গ্রীসের সুন্দর দ্বীপগুলো দেখে বেশ ভালো লাগলো। আবার পরক্ষণেই মৃণালিনীকে লিখা চিঠির কথা মনে পড়লো। আনন্দ আর বিষাদ নিয়ে অসুস্থ কবি কলম হাতে নিলেন। গত কয়েক মাসে তেমন কিছু লিখেননি তিনি। মুসোলিনীর চক্রান্ত তার কলমকে থামিয়ে দিয়েছিলো। এখন এথেন্সের জ্ঞানের দেবী এথিনা মনে হয় তাকে বর দিলেন। ৬৫ বছরের রবীন্দ্রনাথের মনে প্রথমে বিষাদের কথাই মনে হলো। মনে হলো, জীবনের সকল পাওয়া আর না-পাওয়া সবই মরীচিকা, সবই মিছে। তিনি লিখলেন,

‘ক্ষত যত ক্ষতি যত – মিছে হতে মিছে,

নিমেষের কুশাঙ্কুর পড়ে রবে নীচে

কী হল না, কী পেলে না,   কে তব শোধে নি দেনা

সে সকলই মরীচিকা মিলাইবে পিছে

মিছে হতে মিছে’

ততক্ষণে সূর্য উঠে গেছে। জাহাজ এথেন্সের কাছে চলে এসেছে। সকালের সূর্যের সাথে কবি জাহাজে বসে দেখলেন সুন্দরী এথেন্সকে। মুগ্ধ হয়ে তাকালেন পাহাড়-সাগর-দ্বীপ ছুঁয়ে দাড়ানো জ্ঞান প্রসবিনী রাজধানীটির দিকে। জ্ঞানের দেবী এথিনার শহর এথেন্স – দেবীর মতই সুন্দর। এ এক অপরূপ ছবি। কবি লিখলেন,

‘এই-যে হেরিলে চোখে অপরূপ ছবি

অরুণ গগনতলে প্রভাতের রবি-

এই তো পরম দান   সফল করিল প্রাণ,

সত্যের আনন্দরূপ এই তো জাগিছে

ক্ষত যত ক্ষতি যত – মিছে হতে মিছে’

চিরকাল সত্যের সন্ধান করা কবি এথেন্সকে প্রথম দেখেই সত্যের আনন্দরূপ টের পেলেন। জ্ঞানের নগরী তাকে সত্যের সন্ধান দিলো। লেখাটি শেষ করে বেশ প্রসন্ন হলেন রবীন্দ্রনাথ।

জাহাজে কবির সাথে আছেন ছেলে রথীন্দ্রনাথ আর পুত্রবধূ প্রতীমা দেবী। প্রতিমাকে কবি অত্যন্ত স্নেহ করেন। ঠাকুর পরিবারের প্রথা ভেঙে বিধবা প্রতিমার সাথে ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। এই পুত্রবধূই এখন কবির সংসারের কর্ত্রী। রথী-প্রতিমা দম্পতি নিঃসন্তান। কিছুদিন আগে একটি মেয়েকে দত্তক নিয়েছেন তারা। কবি নিজেই এই নতুন নাতনীটির নাম দিয়েছেন নন্দিনী। নন্দিনীর বয়স এখন তিন বছরের একটু বেশী। নন্দিনীও কবির সাথে এবারের জাহাজে আছে।

কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ কাজের মানুষ। সব কিছুতেই ভীষণ প্রাকটিকাল তিনি। এই ভ্রমণে তিনি সঙ্গে এনেছেন শান্তিনিকেতনের শিক্ষক গৌরগোপাল ঘোষকে। কবি এবং কবিপুত্র দুজনেই চান বাংলার কৃষকদের মধ্যে সমবায় সমিতি চালু করতে। গ্রামের মানুষদের ঋণদানের জন্য তারা অল্পপূঁজির আলাদা এক ধরনের ব্যাংক বানাবেন। সমবায় সমিতি বিষয়ে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভের জন্য রথী এবার গৌরগোপাল ঘোষকে ইউরোপে নিয়ে এসেছেন। পুত্রের এই বিচক্ষণতায় কবি খুশি হয়েছেন।

কবির সাথে আরও আছেন বিশ্বভারতীর কর্মসচিব বিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ এবং তার স্ত্রী রাণী মহলানবিশ। এই দম্পতি কবির এবারের ইউরোপ ভ্রমণের সব সময়ের সঙ্গী। ভ্রমণের সব রকম ব্যবস্থার দায়িত্ব কর্মপটু প্রশান্তচন্দ্রের উপর। আর বিদেশ বিভূঁইয়ে কবির চলমান সংসারের দায়িত্ব রাণীর। এই দম্পতিকে কবি বড়ো ভালোবাসেন। সেই কিশোর বয়স থেকেই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ রবীন্দ্র অনুরাগী। বিশ্বভারতীর শুরু হতেই তিনি কবির সাথে আছেন।

লেখাটা শেষ করে জলের উপর সূর্যের খেলা দেখছিলেন কবি। প্রতিমা দেবী কেবিনে ঢুকলেন। বললেন, বাবা, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই নাকি জাহাজ ভীড়বে। আপনাকে স্বাগত জানাতে অনেকে চলে আসার আগেই সকালের খাবার শেষ না করলে কিন্তু মুসকিল হবে। সকালের খাবার খেয়ে ঔষধ খেতে হবে।

কবি বললেন, হুম, তোমার যখন হুকুম – কী আর করব! রথী উঠেছে?

হুম, সে আর প্রশান্ত বাবু তৈরি হচ্ছে। আপনি বললেই হাজির হবে।

জাহাজের ক্যান্টিনে সকলে মিলে নাস্তা করছেন। কবি বললেন, দেখো, কী অপূর্ব এথেন্স। বড়ো সাধ ছিলো এথেন্স ভালো করে ঘুরে দেখার। পার্থেনন দেখবো, প্লেটোর একাডেমির জায়গাটা দেখতেও খুব ইচ্ছে করে। এবার মনে হয় সেসব দেখা হলো না।

কবির গ্রোগ্রাম ঠিক করেন প্রশান্তচন্দ্র। তিনি বললেন, হুম গুরুদেব। শুধু শুধু জাহাজটা ইস্তাম্বুলে এক দিন দাঁড়িয়ে রইলো।

– জাহাজের আর কী দোষ, বলো। কুয়াশা আর আমাদের অদৃষ্ট। না হলে, আমার আসার দিনই কুয়াশায় জাহাজ আটকে থাকবে কেন। ইস্তাম্বুলের জলের উপর মিছে মিছে কেটে গেল একটা দিন।

রাণী বললো, দুই দিনের সফর কেটে হয়ে গেল কয়েক ঘণ্টার। সব আশা মাটি হলো।

কবি হালকা স্বরে বললেন, ‘মিছে হতে মিছে’।

প্রতিমা বললো, বাবা, নতুন গান নাকি! আগে শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না।

কবি মৃদু হাসলেন, একটু আগেই লিখলাম। সুন্দরী এথেন্স আমার হাতে কলম তুলে দিয়েছে। এথেন্স মায়া জানে। কিন্তু শুধু মায়া দিয়েই তো হবে না। প্রশান্ত, আজকের প্রোগামের কি করলে?

প্রশান্তচন্দ্র উত্তর করলেন, গুরুদেব, যাত্রার বিলম্বের জন্য গতকালের সকল প্রোগ্রাম বাতিল করতে হয়েছে। গতকাল রাতে আপনার সম্মানে ডিনারের আয়োজন করেছিলো গ্রীসের সাহিত্য পরিষদ। এখন সেটাকে আজকের লাঞ্চ করতে হয়েছে। লাঞ্চের স্থান আগেরটাই আছে। হোটেল গ্রেট ব্রিটেন। আর গ্রীক সরকার কিভাবে পুরস্কার তুলে দেবে সেটা এখনো ফাইনাল হয়নি।

– পুরস্কারটার নাম যেন কী?

হেসে উঠলেন প্রশান্তচন্দ্র। গত কয়েক বছর যেখানেই যাচ্ছেন, সবাই পুরস্কার দিচ্ছেন কবিকে। তাই এখন আর অত ঘটা করে নাম মনে রাখার গরজ নেই কবির। প্রশান্তচন্দ্র ডায়েরী চেক করে বললেন, পুরস্কারের নাম ‘কমান্ডার অফ দ্যা অর্ডার অফ দ্যা রিডিমার’। গুরুদেব, এটা কিন্তু গ্রীসের সবচেয়ে বড় বেসামরিক পদক। এখানকার প্রেসিডেন্ট নিজ হাতে এই পদক তুলে দেন। গতকাল সব আয়োজন ছিলো। জাহাজ সময়মত না আসায় সেই প্রোগ্রাম ভেস্তে গেলো। এখন দেখি – নতুন কি ব্যবস্থা করেছে? কিছু না হলে ব্রিটিশ এম্বাসির মাধ্যমে কোলকাতা পাঠিয়ে দিতে বলবো।

আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে কবি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, এই পদক কি সক্রেটিস বা প্লেটো পেয়েছে?

সবাই হো হো হেসে উঠলো। কবি মাঝে মাঝেই এমন রসিকতা করেন। সক্রেটিসের সময় গ্রীস নামে কোন দেশই ছিলো না। সেই দেশের আবার পদক হবে কি করে!

কবি বললেন, এথেন্সের পার্থেননটা কিন্তু অবশ্যই দেখবো। সেটা কিন্তু মিস করো না। শতবার পুরস্কার নেয়ার চেয়ে একবার পার্থেনন দেখার দাম অনেক বেশি।

কবি যখন একথা বলছিলেন, জাহাজ ভীড়ার শব্দ শুনা গেলো। এথেন্সের পিরাউস বন্দরে নোঙর করলো ‘এমপারোর ট্রাজান’।

কবি মুগ্ধ হয়ে দেখলেন এথেন্সের মাটি। এই মাটিতে একদিন আলো জন্ম নিয়েছিলো। ইউরোপের সকল আলোর জন্ম হয়েছিলো এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে।

গণতন্ত্র, দর্শন, থিয়েটার, চিকিৎসা – পশ্চিমের সব কিছু এই নগরী থেকেই শুরু হয়েছে। বিস্ময় নিয়ে দেখছিলেন কবি।

২.

পিরাউস বন্দরে অনেক ভোর থেকে গ্রিসের কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকরা বসে আছে কবিকে স্বাগত জানাতে। অনেকেই গতকাল থেকে অপেক্ষা করছে। জাহাজ মাত্র নোঙর করেছে। বন্দরের লোকেরা বললো, প্লিস, এখন কেউ জাহাজে উঠবেন না। আমরা বলা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন প্লিস। কিন্তু কবি সাহিত্যিকরা তো মুক্ত প্রজাতির প্রাণী। ওইসব বাধা নিষেধ তারা মানেন নাকি। জাহাজে উঠতে না পেরে ছোট নৌকা জোগাড় করে ফেললো। সেই নৌকায় কয়েকজন পৌছে গেলো জাহাজে। দুই দিন ধরে তারা বন্দরে অপেক্ষা করছে। গতকাল আসার কথা ছিলো কবির। তাদের আর দেরী সইছিলো না।
টেগোর নামটি এখন সারা ইউরোপ জুড়ে এক সেনসেশান।

গ্রিক কবিদের কাছেও তিনি এক রহস্য। গ্রিকরা তো জানতোই না যে বাংলা নামে একটা ভাষা আছে, একটা ভূখণ্ড আছে। তারা শুধু জানতো – গ্রিক বীর আলেকজান্ডার পারস্য জয় করে ভারতেও আক্রমণ করেছিলো। ভারতে কিছু অংশ জয়ও করেছিলো আলেকজান্ডার। কিন্তু গঙ্গারীডয় নামে এক নদীর তীর থেকে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন। সেই গঙ্গারিডয় আসলে গঙ্গা নদী। সেই নদীর অপর পাড়েই বাংলা। ইতিহাসের জনক হিরোডটাসের লেখা থেকে গ্রিকরা সেই দেশ সম্পর্কে জেনেছিলো। হিরোডোটাস লিখেছিলো – ওই দূরে ইন্ডিয়া নামে এক দেশ আছে, সেখানের মানুষ সব বর্বর, তারা কালো জাদু জানে, তাদের রঙ কালো, এমনকি সেখানের পুরুষদের শুক্রানুও নাকি কালো।

হিরোডোটাসের এই অদ্ভুত তথ্যের বাইরে ভারতবর্ষ সম্পর্কে গ্রিকরা শুধু দুইটা নতুন তথ্য জানতো। এক – এখন ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ শাসন করে, সেখানের অসভ্য মানুষদের সভ্য করছে। দুই, ভারতবর্ষে নাকি প্রাচীনকালেও কিছু জ্ঞানী মানুষ ছিলো, যাদের বলা হয় ঋষি। জার্মানরা ইদানিং সংস্কৃত ভাষায় আগ্রহ দেখাচ্ছে। অনেক জার্মান পণ্ডিত সংস্কৃত থেকে সেই ঋষিদের জ্ঞানের কথা ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করেছে। সেখান থেকে গ্রিকরা জেনেছে, প্রাচীন ঋষিরা বনে থাকতো, তাদের লম্বা লম্বা দাড়ি, তারা ঈশ্বরের সাধনা করত।

এই জ্ঞান নিয়ে গ্রিক কবি সাহিত্যিকরা একদিন শুনলো, সেই বর্বর দেশের বাংলা ভাষার এক কবি সাহিত্যে নোবেল পেয়ে গেছে। তারা তো তাজ্জব! সারা ইউরোপের সাথে সাথে গ্রিকরাও খোঁজ নিতে শুরু করলো – কে এই কবি। তারা শুনল – এই কবির নাম টেগোর। পত্রিকায় ছবি দেখলো – লম্বা চুল, কাঁচা-পাকা দাঁড়ির এক সুপুরুষ। তারা ভাবলো, আরে, এই তো সেই প্রাচীন ভারতের ঋষি। সেই একই রকম চুল-দাড়ি। তারা কবিতা পড়ল।

‘দ্যা সং অফারিংস’ বা গীতাঞ্জলী। সেখানেও ঈশ্বরের প্রেমের কথা। তাহলে তো রবীন্দ্রনাথ আর কেউ নয়। সেই প্রাচীন ঋষি। সেই রহস্য ঘেরা পুরুষ। তাকে নিয়ে তখন ইউরোপের ঘাটে-মাঠে আলোচনা। তার পোশাক দেখলো। লম্বা আলখাল্লা, কেমন এক জোব্বা-জাব্বার মত। একেবারে চার্চের পাদ্রীর উপর। দেখেছো মুখখানা কেমন যীশুর মত। আবার অনেকে ধর্মের দিকে গেলো না। তারা বললো, রবীন্দ্রনাথে চেহারা আসলে তলস্টয়ের মতো। সব মিলিয়ে টেগোর ইউরোপে একটা বিশেষ ব্রান্ড। সেই টেগোর গ্রিসে আসছেন! তার জাহাজ এখন এথেন্সের বন্দরে। গ্রিসের সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের তর সইবে কী করে। তারা নৌকা করে কাছে এসে জাহাজে উঠে গেলো।

দেশের খ্যাতিমান লোকদের এমন আচরণ নাবিকরা আগে দেখেনি। তারা জাহাজে খবর দিল। নাবিকেরা তাদের নিয়ে গেল প্রথম শ্রেণীর ডাইনিং হলে। কবি মাত্র নাস্তা শেষ করেছেন। কবি সাহিত্যিকরা তুমুল করতালী দিয়ে উচ্চস্বরে সেই ডাইনিং হলেই প্রথমবার কবিকে স্বাগত জানালো। তরুণ কবি রিনা আফগারী কবির হাতে তুলে দিলো একটি জলপাই শাখা। রীনা বললেন, মহান কবিকে এথেন্সে স্বাগত। জলপাই আমাদের গ্রিসের মঙ্গলের প্রতীক। এথেন্সের দেবী এথিনা আর দেবতা এপোলোর দুজনের হাতেই এই জলপাই শাখা থাকতো। এথেন্সে প্রথমে আসলে আমরা সবাইকে জলপাই শাখা দিয়েই স্বাগত জানাই।

কবি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে জলপাইয়ের কচি পাতা দেখতে লাগলেন। এরপর গ্রীসের সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবিকে স্বাগত জানালেন। তিনি ফরাসী ভাষায় কথা বলছিলেন। কবি স্মিত হাস্যে বললেন, কেউ কি আমাকে একটু ইংরেজী করে দেবেন।

এতোদিনে জনসভার বক্তৃতার মত করে কথা বলাটা বেশ ভালোই শিখে ফেলেছেন কবি। তিনি সমাগত সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের বললেন, আমি আপনাদের মাঝে এথেন্সে এসেছি। কী যে আনন্দ হচ্ছে। আমার সামনে আলোর নগরী এথেন্স। বিশ্বাস হচ্ছে না। ছোটবেলা থেকে ভেবেছি এখানে আসব। আজ সেই আশা পূরণ হচ্ছে। এই ভোরের শীত সহ্য করে আমাকে গ্রহণ করার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। অন্তর থেকে ধন্যবাদ।

এরপর কবিকে অবাক করে দিয়ে সেই ডাইনিং হলেই সাংবাদিকরা শুরু করলো প্রশ্ন। গ্রিসের মানুষের কাণ্ডজ্ঞান ইউরোপের অন্য দেশের থেকে আলাদা। নিয়মের অতো বাড়াবাড়ি মনে হয় এখানে নেই। যার যা ভালো লাগছে, করে ফেলছে। ডাইনিং হলেই প্রশ্ন করা শুরু করেছে। কবি দেখলেন, সত্যি সত্যিই জাহাজের ডাইনিং হলটা তার প্রেস কনফারেন্স রুম হয়ে গেছে। জাহাজের অফিসার অসহায়। অন্য যাত্রীদের অসুবিধা করে এখানেই সাংবাদিকরা টেগোরকে জেঁকে ধরেছে। নাবিকরা বাধা দিতে পারছে না। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করে যাচ্ছে –

টেগোর আপনি গ্রীসে কেন এসেছেন? টেগোর, আপনার ভাষার সাথে গ্রিসের কি কোন মিল আছে? টেগোর, আপনি কি ঋষি? আচ্ছা, প্রথম এশিয়ান হিসেবে নোবেল পেয়ে সেদিন আপনার কেমন লেগেছিলো?

কবি দেখলেন – বিপদ। কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দিবেন। তিনি কোনটারই উত্তর দিলেন না। নিজের মত করে বললেন, আমি চাই সারা পৃথিবীর মানুষ এক সুরে সুন্দরের কথা বলবে, মানুষে মানুষে কোন ভেদ থাকবে না। সেই ঐক্যের খোঁজেই আমি দেশ থেকে দেশে ছুটে যাই, সেজন্যেই ইউরোপে এসেছিলাম, এখন গ্রিসে এসেছি। এখানে আমার দীর্ঘ সময় থাকার ইচ্ছা ছিলো। এই প্রাচীন আলোর নগরীটি আমি অনেক ভালোবাসি। কিন্তু আমি ক্লান্ত। টানা ছয় মাস ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বিধ্বস্ত। ডাক্তার সাহেব বিশ্রামের হুকুম করেছেন। তাই আমি এথেন্সে থাকতে পারছি না। দেশে ফিরে যাচ্ছি। তবে আমি আবার আসব এথেন্সে। গ্রিসের ডেলফিতে তো একটা বসন্ত উৎসব হয়। আমার অনেক ইচ্ছা সেই উৎসবে যাবার।

সাংবাদিকরা টুকিটাকি প্রশ্ন করে যেতে লাগলো। তারা মুসোলিনীর নিমন্ত্রণের কথা জিজ্ঞেস করলেন। কবি বুঝলেন, উগ্রবাদী মুসোলিনীর সাথে তার অনুষ্ঠানের খবর এখানেও পৌছে গেছে। কবি ভুল করে ফেলেছেন, সেই একনায়ক শাসকের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে। তারপর যেখানেই যাচ্ছেন, সেই ভুল নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। সব দেশেই কিছু সাংবাদিক আশ্চর্য রকমের বিতর্কজীবি। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিতর্ক বের করাই তাদের কাজ। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে নিশ্বাস নিয়ে বললেন, ইতালীয়ানরা একটা স্লোগান প্রিয় জাতি। ওরা হুজুগে মেতে উঠেছে। একদিন এই হুজুগ থেমে যাবে।

সাংবাদিকদের সাথে প্রশ্নের সময় প্রশান্তচন্দ্র আর রথীন্দ্রনাথ সাহিত্য সমিতির নেতাদের সাথে কথা বলে কবির আজকের দিনের প্রোগ্রাম ঠিক করলেন। আজ বিকেলেই জাহাজ আবার ছেড়ে যাবে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার উদ্দেশ্যে।

কবি উত্তর দিয়ে চলছেন। এখনকার বিষয় ইউরোপ বনাম এশিয়া। তিনি বলছেন, ইউরোপ পৃথিবীকে অনেক কিছু দিয়েছে। কিন্ত অন্তরের সৌন্দর্য পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধের মানুষের চেয়ে পূর্বের মানুষের বেশী। এশীয়াতে আলাদা রকম প্রাণ আছে। আমি চাই, পৃথিবীর সব মানুষের আত্মা এশিয়ানদের মত হোক।

কিন্তু কবি, আমরা তো জানি, তোমাদের এশিয়ায় বিজ্ঞানের আলো নেই, সেখানে সব অন্ধ বিশ্বাস।

একটু হাসলেন রবীন্দ্রনাথ। মনে মনে বললেন, এইতো তোমার লাইনে আসছো। তোমরা যে আমাদের অজ্ঞান ভাবো, সেটা বলতে তোমার সময় লাগল। হেসে কবি বললেন, ইউরোপ শুধু বাইরের দিক দেখে, অন্তরে দেখে না। ইউরোপের শরীর আছে, আত্মা নেই। কিন্তু আত্মা ছাড়া কি শরীর বাঁচে? তাই বিজ্ঞানের যেমন দরকার, অন্তরের উপলব্ধিও দরকার। ইউরোপ সব কিছুকে যান্ত্রিক করে ফেলেছে। ইউরোপ দয়া ও প্রেমের সুন্দর ভাবকে দূর করে দিতে চায়। কিন্তু এই এথেন্স সেরকম না। এখানে একদিন সক্রেটিস, প্লেটোরা অন্তরের আলো খুঁজে বেরিয়েছে। আমি এথেন্সকে ভালোবাসি।

কবি রাজনীতি নিয়ে প্রশ্নের উত্তর করলেন না। শুধু বললেন, আমি তো কবি, রাজনীতি বুঝি না।

সাংবাদিকরা তবু ছাড়ে না। তারা মহাত্মা গান্ধীর কথা জিজ্ঞেস করলো। গান্ধীর আন্দোলনের খবর এই সুদূর গ্রীসের মানুষরাও রাখে। কবি বললেন, গান্ধী আর আমি এক দেশের লোক কিন্তু আমরা এক মানুষ নই। তিনি রাজনীতির লোক, আর আমি কবি। রাজনীতির কথা আমার মাথায় বেশীক্ষণ থাকে না।

– আপনি গ্রিস নিয়ে কী ভাবেন?

কবি যেন এই প্রশ্নটার আশায়ই ছিলেন। তিনি জানতেন এই প্রশ্ন আসবেই। তিনি বললেন, আমি চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই – একটা প্রাচীন নগর এথেন্স, এখানের রাজপথে অনেক মহৎ মানুষ হাঁটছে। তারা নিজেকে জানার কথা বলেছে, ভালো জীবনের কথা বলেছে। তারা শহর জুড়ে সুন্দর বড় বড় মূর্তি আর মন্দির করেছে। গ্রিসের নাটক-ট্রাজেডির কথাই ধরো। কী চমৎকার সৃষ্টি। আমি গ্রিক নাট্টকার এস্কিলাস আর লোকিয়ানুসকে অনেক পছন্দ করি। এস্কিলাস বলেন, আমি ঈশ্বরকে দেখেছি আর লোকিয়ানুস বলেন, আমি ঈশ্বরকে দেখিনি, কারণ ঈশ্বর নিজেই তাকে কখনও দেখেনি। এস্কিয়াস জীবন গড়তে চেয়েছে, আর লোকিয়ানুস ধ্বংসকামী।

একজন জিজ্ঞেস করলো, আর সফোক্লিস?

কবি বললেন, তিনি উপরের দুই জনের মত অতো উঁচু নয়। কিন্তু আরেক নাট্টকার ইউরিপিডিস ছিলেন যুক্তিবাদী। তবে তার যুক্তি ছিলো অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে।

ততক্ষণে জাহাজের সিঁড়ি লেগে গেছে। মানুষ নামতে উঠতে শুরু করেছে। কোথা থেকে যেন আর এক ঝাঁক মানুষ ছুটে এলো ডাইনিং হলে। তারা হতাশ হয়েছে, তাদের আগেই আর একদল আগেই কবির সাক্ষাৎকার নিয়ে ফেলছে। তারাও যোগ দিলো। কেউ কেউ কবির স্কেচ আঁকা শুরু করলো।
এতো ভীড়ে ক্লান্ত কবির তখন হাঁসফাঁশ করছেন।

এবার প্রশান্তচন্দ্র এগিয়ে এলেন। তিনি সাংবাদিকদের বললেন, জাহাজ থেকে নামার সময় হয়েছে। এবার কবিকে একটু সময় দিন। আমরা তৈরি হয়ে আসি।

 

সুজন দেবনাথ

লেখক ও কূটনীতিক। বর্তমানে এথেন্সে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর। এথেন্সের ক্ল্যাসিকাল সময়ে সক্রেটিস, প্লেটো, হেরোডটাস, সফোক্লিসদের নিয়ে সাহিত্য, থিয়েটার, ইতিহাস, দর্শন, গণতন্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্রসহ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্মকথা বিষয়ে তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘হেমলকের নিমন্ত্রণ’। তিনি অব্যয় অনিন্দ্য নামে লেখালেখি শুরু করেন। এই নামে তার কবিতার বই ‘ বই খারাপের উঠোন’ এবং গল্পের বই ‘কীর্তিনাশা’। তার রচনা ও পরিচালনায় ২০১৮ সালে গ্রিসে নির্মিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম ইংরেজি গান ‘ মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে’।

 

সক্রেটিসের নগরে রবীন্দ্রনাথ