স্কুলে একদিন
হিন্দুধর্মে বর্ষাকে বলা হয় ইন্দ্রদেবের আশীর্বাদ।আবার এই আশীর্বাদ অনেকক্ষেত্রে অভিশাপও বটে।
কারো কারো কাছে বর্ষা মানে আকাশের কান্না,কারো কারো কাছে বর্ষা মানে কবিগুরুর বাদল দিনের প্রথম কদমফুল অথবা শ্রাবণের গান, কারো কারো কাছে বর্ষা মানেই বিরহ, অঞ্জনের আমি বৃষ্টি দেখেছি, কারো কারো কাছে বর্ষা মানে, মাটিতে মাদুর পেতে চুলা থেকে নামিয়ে কব্জি ডুবিয়ে গরম গরম খিঁচুড়ি গোগ্রাসে গিলে উদরপূর্তি করা।
আমার কাছে বর্ষার সংজ্ঞা একেক বয়সে একেক রকম ছিলো। যখন কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়তাম, আমার কাছে আষাঢ় আর শ্রাবণ মাস ছিলো ঘুমানোর মাস। আমি বজ্রপাত বা এর শব্দ প্রচণ্ড ভয় পাই। সেক্ষেত্রে এটা একটা সুবিধা ছিলো, বাসা থেকে স্কুল যাওয়ার জন্য জোর করতো না আমাকে। আমি সারাদিন ঘুমাতাম, নয়তো দাদুর সাথে লুডু খেলতাম।
আবার যখন হাইস্কুলে উঠলাম, তখন বর্ষা আমার কাছে প্রথম প্রেম। আমি বৃষ্টির গানের প্রেমে পরলাম। বৃষ্টি নিয়ে দুই এক লাইন কবিতা লিখতাম খাতায়। পরে নিজেই পড়তাম আর হাসতাম। সে কবিতা অবশ্য কাউকে দ্যাখানোর মতো ছিলো না।ওই কবিতা লেখা খাতাগুলো কাগজ বিক্রেতার ট্যাঁকে ঢুকতো পরবর্তীতে।
যদি আমাকে বর্ষা নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে বলা হয় সেক্ষেত্রে একটা ঘটনাই মাথায় আসে আমার।
আমার স্কুলজীবনের মজার বলবো নাকি বাজে বলবো,এ নিয়ে নিজের সাথেই তর্ক করেছি বহুবার। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারিনি আজও। অবশ্য একটা ব্যাপার নিশ্চিত, আজকের দিনে ঘরে বসে যতই আমি বর্ষা নিয়ে স্মৃতিচারণা করছি, ঠিক ততই নস্টালজিক হয়ে পড়ছি।
তো যাইহোক স্মৃতিচারণে ফিরি, আড়াইবছর আগের শ্রাবণ মাস। আমি তখন সদ্য দশম শ্রেণিতে ওঠা ছাত্র। ওই যা হয় আরকি, সবে ক্লাস টেনে উঠেছি। আমরাই স্কুলে সিনিয়র। দাপটটাই আলাদা। যাইহোক, সেদিন কী বার ছিলো তা মনে নাই। তবে জোর বৃষ্টি নামছিলো এইটা বলতে পারি।
মায়ের জোরাজুরিতে অনিচ্ছা সত্তেও স্কুলে পা দিলাম ওইদিন গা ভিজিয়ে। স্বাভাবিকভাবে ক্লাস শুরু হয়নি। আমাদের দশম শ্রেণিতে, আমার শাখা ছিলো মেঘনা।
সবাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি।
হুট করে আমরা মেঘনা শাখার সব ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নিলাম আজকে মাঠে ফুটবল খেলবো। এই বৃষ্টিতেই। ক্লাস হচ্ছেনা, প্রিন্সিপাল তেমন কিছু বলবে না।
এক বন্ধুকে বলা হলো, অফিস থেকে ফুটবল নিয়ে আয়। ও দৌড়ে ফুটবল আনলো। প্রথমে সবাই উৎসাহ নিয়ে ফুটবল খেলতে চাইলেও আমরা হাতেগোনা কয়েকজন ফুটবল খেলতে নামলাম।বোঝাই যায়, বাকিরা গা ভেজাতে চায় না। মা বাপের বাধ্য সন্তান। যাইহোক ক্লাসের বারান্দা থেকে দিলাম ঝাঁপ মাঠে। যেই ঝাঁপ দিলাম, ওমা!পড়াৎ করে একটা শব্দ হলো। খুব ভালোভাবে বুঝতে পারলাম, আমার স্কুল ড্রেসের প্যান্টের পিছনের অংশের ব্যবচ্ছেদ হয়ে গ্যাছে। আমি সেই যে মাটিতে বসে পরলাম। আর উঠিনা! ওইযে প্রবাদ আছে না?
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। হঠাৎ ক্লাসের বেল পরলো। মানে ক্লাস শুরু হবে। বৃষ্টি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। আমি মাঠেই বসে আছি।একটা সুবিধা ছিলো, জুনিয়ররা প্রায় বাঘের মতোই ভয় পেতো আমাকে। সেক্ষেত্রে হাসাহাসির সাহসটা অন্তত তারা করে নাই। কিন্তু আমার হারামজাদা বন্ধুর দল, সে সুযোগ ছাড়বে ক্যানো?ওদের মুখে হাসি আর থামে না।
এদিকে আমাদের শ্রেণিশিক্ষক ও রসায়নের শিক্ষক ফেরদাউস স্যার মেয়েদেরকে কমনরুম থেকে নিয়ে ক্লাসে আসছে। মহা মুসিবত। আমি স্কুল ড্রেসের শার্ট দিয়ে, পিছনটা ঢেকে কোনোমতে ভোঁ দৌড় দিলাম ক্লাসে। একেবারে পিছনের বেঞ্চে। সাথে আদনান নামে আমার এক বন্ধু ছিলো। ওরও প্যান্টের অবস্থা যাচ্ছেতাই হয়ে গ্যাছে। স্যার ক্লাসে ঢুকলো। সবাই চুপ। ফেরদৌস স্যার ক্লাসে ঢোকা মানেই, একটা চুল পরলেও তার শব্দ শোনা যাবে।
স্যার ক্লাস আসলো, ডেস্কে হাজিরা খাতা খুলে
রোল ডাকা শুরু করলো।
রোল ডাকার সময় কোনোমতে দাঁড়াইতে পারছি।একটু পর আবার সেই কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা।
হুট করে স্যারের তলব,”অনিরুদ্ধ সামনে আয়,আদনাদ তুইও আয়!”
একটা ইঁদুড় যখন ফাঁদে পড়ে, কিংবা একটা অপরাধী যখন পুলিশের কাছে ধরা পড়ে ঠিক তখন তাদের অনুভূতিটা যেমন হয়, আমারও নিজেকে একটা ইঁদুড় আর অপরাধী থেকে কম কিছু মনে হচ্ছিলোনা সেসময়।
স্যারকে বললাম,”স্যার যাইতে পারবোনা। প্যান্টে সমস্যা।”
কথাটা বলা শেষও হয়নি, ক্লাসের সব মেয়ে দেখি মুখে হাত চেপে ধরলো। আমি আড়চোখে খেয়াল করলাম। স্যারও দেখি হাসে। কী এক জ্বালা!
পরে অবশ্য পিছনের দরজা দিয়ে আবাসিকে যেয়ে, প্যান্ট চেঞ্জ করতে পারছিলাম। এক জুনিয়রের অতিরিক্ত একটা প্যান্ট ছিলো। ওই ঘটনার পর আমি পাঁচদিন স্কুল যাই নাই। ভাগ্য ভালো ধীরে ধীরে এই ব্যাপারটা নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামায়নি।
প্রেমিকাকে নিয়ে যদি বৃষ্টি দেখতে পারতাম, আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি তাহলে হয়তো নিজের এই লজ্জার কথা স্মৃতিচারণ হিসেবে চালায় দিতাম না।
আমার স্কুলজীবনে প্রায়ই প্যান্ট ফাটতো। আর এর ওর প্যান্ট দিয়ে চালায় দিতাম। এখনও বাসায় ৩টা স্কুল ড্রেসের প্যান্ট আছে আমার। যার কোনোটাই আমার না।
এখন অবশ্য এই ঘটনা মনে পরলে আমিও হাসি, স্কুলে থাকলে হয়তো লজ্জা পেতাম। অন্তত এটা বলতে পারি, যতদিন স্কুলের মাঠে বৃষ্টির সাথে একাকার হয়ে ক্লাস টেনের টগবগে কিশোরের দল ফুটবল খেলবে, ততদিন আমার এই সোনালি বিব্রতকর সুন্দর স্মৃতি আমাকে নাড়া দিতে থাকবে।