সোমের কৌমুদীর কবিতা:
সভ্যতা–২
স্নিগ্ধ সকাল। সময়ের ঢেউ আছড়ে পড়ে জীবন নদীর তীরে।
প্রহর নীড়ে। জীবনের রঙে রাঙা হয়ে উঠে মহাকাল।
কাঁচা রোদ। খসখসে হাতের স্পর্শে ধারালো হয়।
রঙিন ধূসরতায়। সবুজ মাঠে হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ায় বোধ।
পূর্ণিমা শেষ। তীরে পলির আস্তরণ ভেদে উঁকি দেয় সভ্যতা।
ক্লাইম্যাক্স, নাটকীয়তা। জীবনের গায়ে লেপ্টে জীবন অবশেষ।
খাঁচা
রাখালের বাঁশি। মাঠ পেরিয়ে নদীর কূল ভরা ছোপ ছোপ আচ্ছন্নতা।
দুঃখের দীনতা। মরা দেহে জেগে উঠে প্রাণ, মলিন মুখে ফোটে হাসি।
সোনালী চিল। উড়ে চলে, ডানার ছায়ায় ফ্যাঁকাসে কাশের শুভ্রতা।
মমতার মুখরতা। প্রকৃতির সজীবতায় ম্লান প্রান্তহীন আকাশের নীল।
ধুলো মেঠোপথ। মিশে যায়, নিজেকে হারায় ইট-কংক্রিটের খাঁচায়।
সুখ নিজস্বতায়। অজান্তেই ধুলোমাখা পথের পানে ফিরে চলে মনোরথ।
শহুরে ডাস্টবিন। খাবারের উচ্ছিষ্ট পেয়ে বায়স ভুলে ক্ষুধার শোক।
ক্ষুধার্ত দু’চোখ। ছলছল চেয়ে থাকে পঁচা খাবারের দিকে প্রতিদিন।
ছায়া
র্পণমোচী বৃক্ষরে বন। সঙ্গোপনে যুবতী বসন্ত লালন করে দশ মাস।
চিরহরিৎ বৃক্ষের আবাস। শীত-শরৎ-বসন্ত সবুজ, কোকিল উচাটন।।
ঝলসানো রোদের ঝাঁজ। প্রহরের তৃষ্ণা মেটায় আলো-আঁধারের দিবাকর।
ফুলে বসা মধুকর। আহত পাখির খসে পড়া পালকে সময়রে কারুকাজ।।
আলো-ছায়ার খেলা। গাছের থেকে ক্রমশ দৈর্ঘ্য বাড়ে গাছরে ছায়ার।
র্পূণতা প্রাপ্ত অহংকার। তুলতুলে কাশফুল ভুলে রিমঝিম র্বষার কলো।।
হারানোর তৃপ্তিতে সুখ। সিন্ধুর ইটে গড়ে ওঠে হৃদয়াঞ্চলে সবুজ তাজমহল।
মহল ভরা আহল। বসন্তের সকালে তবু শীতের শিশির, পরিপূর্ণতার ভুখ।।
কথা শেষের কথাগুলো
কথা শেষ হলে কথা বলতে যাওয়া কষ্টের
কথা তখন নীরবতা হয়
শব্দিত হয়েও শব্দহীন হয়,
কথাগুলো তখন শব্দ হয়েও দুঃখ হয় শব্দের।
কথা শেষ হলে কথা বলতে যাওয়া কষ্টের
কথা তখন চোখের জল হয়
চোখের জল তখন অশ্রু হয়,
অশ্রু তখন উপহাস হয় বা চিরকালীন দুঃখ হয় জীবনের।
কথা শেষ হলে কথা বলতে যাওয়া কষ্টের
কথা তখন হাসি হয়
হাসি তখন সুখ হয়,
সুখ তখন জীবন হয় বা পাথেয় হয় জীবন চলার পথের।
কথা শেষ হলে কথা বলতে যাওয়া কষ্টের
কথা তখন শোষিত হয়
কথা তখন শোষক হয়,
শোষক কথাগুলো মুক্ত হয়, হয়ে যায় আমজনতার।
ফিরে আসতেই হবে
ছুটে চলেছো । চলো। চেনা পথ! নাকি অচেনা?
ফিরে আসার পথ খোলা? নাকি না ফিরলেও ক্ষতি নেই?
ফিরে আসতেই হবে? নাকি অবিরাম সুখ এ পথ চলাতেই?
এ পথ বৃষ্টির জলে সিক্ত হয় তো?
চাঁদের আলোয় আলোকিত?
পাখির গানে থাকে কি মুখরিত?
কি! আটপৌরে জীবন চলে যেতে এ সবের দরকার কী?
হয়তো একটা জীবন পার করতে
বৃষ্টি অতি প্রয়োজনীয় নয়
পাখির গান না শুনলেও অনায়াসেই জীবন কেটে যায়
চাঁদের আলোয় জ্যোৎস্না স্নানও মৌলিক চাহিদা নয়।
তবুও কিছু থেকে যায়,
শুধু “কিন্তু”-র মাঝেই তা সীমাবদ্ধ নয়।
ভেবে দেখো, এগুলোও মৌলিক চাহিদার সাথে
একই কাতারে দাঁড়ায়।
ভাবো, ভেবে দেখো-
বৃষ্টি কখনই অপবিত্র হতে পারে না
জোছনা কখনই রুক্ষতা আনতে পারে না
পাখির গান কখনই অশালীন হতে পারে না।
দ্বিপ্রহর জীবন
নিঃসঙ্গ প্রহর একাকীকতায় মুখরিত হয়
অব্যক্ত কথার কোলাহলে পূর্ণ নীরবতার উঠোন
একাকী চাঁদের ছড়ানো জোছনা নৃত্যে মাতে
বর্গাকার মাঠের চারদিকে উল্লাস করে অদৃশ্য দর্শক।
ভোরের আলোয় আঁধারে হারানো চাঁদকে নিয়ে লেখা গান
পূর্ণতা পায়; সুরভিহীন কালির আঁচড়ে ধূসর সময়।
আদিগন্ত সবুজ প্রান্তর হয়ে যায় হৃদয়
রাখালের বাঁশির সুরে চাপা পড়ে
ক্ষেতের কান্না, কৃষকের দ্বিপ্রহর জীবনের কষ্ট।
সূর্যের তেজ নিস্তেজ হয় কৃষানির লাল শাড়ির ছোঁয়ায়
এক ঝাঁক পাখি ডানা মেলে ফের, ছুটে চলে নীলাকাশে
দ্বিপ্রহর জীবন লাল শাড়ির আঁচলে নিজেকে জড়ায়।
হরিণ
ভ্রমণ পিয়াসী মন
দরিদ্র দেহের ভার
কাঁধে নিয়ে
ছুটে বেড়ায়
সুন্দর বন।
সুরক্ষা বলয়
পদাঘাতে গত
বনের গহীন
আঁধার ঘন
বাঘের থাবায়
মুমূর্ষু জীবন,
ওপারের ছবি
ভাসায় নয়ন
নয়ন
খোঁজে ফেরে
মায়াবী হরিণ।
“হরিণ তৃষ্ণা”
গ্রীষ্মে লুকায়
বর্ষায় সিক্ত
চাতক মন।
ঋতু
সম্পর্ককে ঋতু বলা যায়!
সম্পর্কের রূপ ঋতুর মত করে
পর্যায়ক্রমে আসে, পুনরায়;
গ্রীষ্ম
বর্ষা
শীত
বসন্ত।
শরৎ ও হেমন্তও জীবনে উঁকি মারে।
মহাকাল ঋতুর মধ্য দিয়ে বয়ে যায়।
একটা সম্পর্কই ষড়ঋতু হয়ে যায়।
ভিন্ন ভিন্ন রূপে জীবনকে আগলে রাখে
ভালোবেসে ও ঘৃণায়।
রাগে
অনুরাগে
নিঃস্পৃহতায়
মায়ায়।
অনুমান ও ভুল বুঝাবুঝিও জায়গা পেতে লড়ে।
জীবনটা ঋতুর নানা রঙে হারায়।
আঁচড়
সবুজ বনের ফাঁকে হেলে পড়ে
সূর্যরশ্মি
বনসংগীতের সুর ছড়িয়ে পড়ে
এ প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
সান্ধ্যগীতি
বেজে উঠে মর্মর,
প্রকৃতির পটে আঁকা ছবি
প্রাণের স্পন্দন
জীবন্ত হয়ে উঠে
সবুজের আঁচড়।
নদীর বুকে হেলে পড়া চাঁদ
একটা ছবি
সুর তোলা বাঁশি
রাঙিয়ে দেয়
জীবন
সময়
প্রকৃতি
শিল্পের ক্যানভাসে রঙিন আঁচড়।
বিষুদবারের রাত
পাটশাক কুটে বধূ, পুঁইশাক কুটে। বধূ কচু পাতা কুটে আর সজনে পাতা কুটে। শহর থেকে আজ বিষুদবার রাতে, সপ্তাহ বাদে সোয়ামি আসবে বাটে। বধূ রান্ধে শোলকা আর সিদল ভর্তা। আজ বিষুদবার রাতে আসবে বাড়ির কর্তা।
বধূ চোখে কাজল মাখে, বধূ পায়ে আলতা মাখে। মনের যত প্রেম শাড়ির আঁচলে মেখে, দাওয়ায় দাঁড়িয়ে পথ পানে চেয়ে থাকে। আজ বিষুদবার রাতে আসছে বাড়ির কর্তা। বধূ রান্ধি রাখছে শোলকা আর সিদল ভর্তা।
অমাবস্যাতেও বিষুদবারের রাতে, বধূর ঘরে জোনাক জ্বলে উঠে।
বাবুই পাখির বাসা
কন্যা চুলায় মুড়ি ভাজে, কন্যা চুলায় খই ভাজে। কন্যা ঢেঁকিতে চিড়া বানে, কন্যা জানে সুখের মানে। কন্যা চিড়ায় মাখে খেজুর গুড়, মুখের গানের মনমাতানো সুর। সে সুর ছড়ায় সদ্য তোলা আমন ধানের মাঠে, আমন ধানের মাঠের সুখ আটকে আছে খেয়াঘাটে।
তিস্তা নদী পিছে ফেলে আমন ধানের মাঠ পেরিয়ে কন্যার বাপের বাড়ি, সেই বাড়ির চারিদিকে আম-জাম আর কাঁঠাল গাছের সারি। পূব উঠানের কোণের দিকে একটা বটের গাছ, সেই গাছের ছায়ায় মন জুড়াতে কন্যার জাগে আশ। চিড়া, মুড়ি, খইয়ের ঘ্রাণে কন্যার মুখে হাসি, বটের তলায় কে যে বাজায় সম্মোহনী বাঁশি!
অগ্রহায়ণের সাঁঝের বেলায় বাপের বাড়ির উঠান, কোণ জুড়ে গল্প-হাসি আর মায়ার টান। চিড়া-মুড়ি-খইয়ের ঘ্রাণে মুখর সবার মুখ, এ সুখের রেশে ভরবে ফের আমন ধানের মাঠের বুক।
বাপের বাড়ির কাইনচায় তালগাছে বাবুই পাখির বাসা, সেই বাসাতে ঘর বেঁধেছে কন্যার মনের স্বপ্ন-আশা।
মাচা
বধূ বাসে মাটি ভালো, বধূর হাতের ছোঁয়ায় আলো। কাইনচা বাড়ির মাচা ভরা ঝিঙে-শশার ফুল, বধূর ছোঁয়ার মায়ার প্রেমে বাঁধা ধুন্দুল। সকাল-বিকাল মৌসুমি হাওয়ায় ফুলেরা দোল খায়, মাচার সে রূপ মন কেড়ে নেয় ডাকে ইশারায়।
বধূর হাতে বেলি রূপার চুড়ি, বধূর সাথে ঝিঙে তোলে খুড়ি। দুপুর বেলার রোদে ঝিমিয়ে পড়ে পাতা, লতাটাকে শক্ত করে আগলে রাখে বাতা। পাতার ঘুম ভাঙায় চুড়ির রিনিঝিনি সুর, চুড়ির সুরে দুলে উঠে যৈবতী বাহুর কেয়ূর।
রাতের বেলা চাঁদের আলো মাচায় ঢলে পড়ে, এক পৃথিবী ভালোবাসা মাচায় বসত করে।
ধুতরা
মাঝ নিশীথের গহিন বেলায় জোছনা পড়ে ঢলে, জোছনা আসে, জোছনা নামে তিস্তা নদীর জলে। তিস্তা নদীর পশ্চিম তীরে বন্ধু বাঁধছে ঘর, সুখের চাষ করে বন্ধু সাথে বন্ধুর বর। বীজ বোনা শেষ হয়েছে এখন অপেক্ষা করে, ফসল তুলবে বন্ধু ঘরে মৌসুমি হাওয়ার পরে।
নিশীথের গহিন বেলায় জোছনা ছড়ায় আলো, ভালোগুলো হয় আরও ভালো – কালোও হয় ভালো। জোছনা আর মনের টানে মন থাকে না ঘরে, শূন্যতা সুখের প্রেমে মিশে অশ্রু হয়ে ঝরে। কষ্ট আরো গাঢ় হয়ে তৃপ্তি ডেকে আনে, বাঁচার সাধ দ্বিগুণ বাড়ে এমন মায়ার টানে।
চাঁদের আলোয় বন্ধুর বাড়ির পথ চিনতে হয় না ভুল, পথের দু’ধারে সারি সারি গাছে ফুটেছে ধুতরা ফুল।
বেনারসি
গীত গায় ভাবি, গীত গায় দাদি। মেন্দি মাখে মামি আর মেন্দি মাখে নানি। শ্যাম বরণ কন্যা লাজে মরে যায়, মেন্দি মাখে মায়ে কন্যার গায়।
কন্যার চোখ ভরা মায়া, সেই মায়ার নাই কায়া। চোখের তারায় ভেসে উঠে ফুল বাগানের ছবি, বিয়ান বেলার রোদের ছায়ায় তারই প্রতিচ্ছবি। কন্যার গায়ে জড়িয়ে আজ ছোঁয়ার ভালোবাসা, বিয়ান বেলার রোদ ছড়ায় থোরা থোরা আশা।
কন্যার স্বপ্ন-আশা ও বুকের মায়া চোখের তারায় নাচে, মুখের হাসি চোখের ভাষায় চোখের তারায় হাসে। মেন্দি সব কন্যার গায় খুঁজে পায় সুখ, সুখের জলে শীতল হয় কন্যার দুরুদুরু বুক।
এক পৃথিবী ভালোবাসা দুচোখে নাচে পাশাপাশি, শ্যাম বরণ কন্যা কাল গায়ে জড়াবে লাল বেনারসি।
হাঁটা
আমি প্রতিনিয়ত হাঁটছি-
হাঁটতে শেখার পর থেকে হাঁটছি।
আমার হাঁটার প্রতিটি পদতল পড়ে
পিতার রেখে যাওয়া পদতল চিহ্নে।
পিতা আর আমি একই পথের যাত্রী।
হাঁটার পথে, পিতার পদতলের শেষ চিহ্নে
নিজের পদতল রেখে–
উল্লাসে গাই জীবনের জয়গান।
অতঃপর দুরন্ত গতিতে হাঁটতে গিয়ে
পৌঁছাতে দিগন্তের সুন্দর গ্রাম, দৃশ্যমান;
মাঝপথে যাই মূর্ছা —
আর মুদিত নয়নে দেখি,
আমার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পুত্র আমার
সেই গ্রামে পৌঁছে ব্যস্ত, পেতে নতুন দিগন্তের দিশা।
খুঁজে পাই
প্রাতে সূর্যের আলোর ডাকাডাকি
তার মাঝে শুনতে পাই তোমার বাণী,
কর্দমাক্ত পথের উপর যান্ত্রিক সভ্যতার নিপীড়ন
ব্যথার দগ্ধে দগ্ধ মৃত্তিকার ক্রন্দন;
সেখানে পেয়েছি তোমার দেখা
আর ক্রন্দনে মিশে আছে তোমার কথা।
রেল লাইনের পাশের ঝুপড়ি ঘরে
কোন অষ্টাদশী তরুণীর কৃত্রিম প্রেমের অকৃত্রিম আদরে
খুঁজে পেয়েছি তোমার দেখা,
তরুণীর কষ্টে ভরা হৃদয়ে বেঁধেছ বাসা।
আমার না দেখা প্রেমিকার প্রতীক্ষিত নয়নে
তুমি দিয়েছ দেখা গোপনে,
আর ডাস্টবিনে খাবারের জন্যে—
কুকুরের সাথে যুদ্ধরত শিশুদের মাঝে
তোমার পুনর্জন্ম দেখেছি প্রকাশ্যে।
কিন্তু, তোমাকে পাই নি খুঁজে—
এসি রুমের ভিতরের সাহিত্য আসরে।
কিংবা সু-সজ্জিত ঘরের নরম বিছানায়
দেহ এলিয়ে দেয়া আমার বিলাসী সত্ত্বায়;
নজরুল, আমি কখনোই খুঁজে পাইনি তোমায়।