প্রবন্ধ

প্রবন্ধ

মুগ্ধতা.কম

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ , ১১:৩৪ অপরাহ্ণ

নারী এবং ভাষা আন্দোলন 

ফেব্রুয়ারি মাস- ভাষার মাস ৷ বাঙালির ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায়  আন্দোলনের মাস ৷ মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে কত কবি কবিতা রচনা করে বিখ্যাত হয়েছেন ৷ প্রবন্ধ লিখে নন্দিত হয়েছেন, পুরষ্কৃত হয়েছেন ৷ `মোদের গরব ,মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা ! তোমার কোলে তোমার বলে কতই শান্তি ভালোবাসা ৷’ ‘ আমার এমন মধুর বাঙলা ভাষা, ভায়ের বোনের আদর মাখা , মায়ের বুকের ভালোবাসা ৷ ‘ বাঙলায় কথা বলতে পারা, লিখতে পারি বলেই মধুর শব্দমালা কলমের খোঁচায় ,কাগজের পাতায় আটকাতে পেরেছি ৷ এও কি কম গৌরবের ! 

বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের ইতিহাসে ভাষার আন্দোলন শুধু এদেশেই হয়েছে ৷ আর কোনো দেশে মায়ের মুখের ভাষা নিয়ে আন্দোলন হয়নি ৷ একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন, উজ্জ্বল বাতিঘর ৷’ ৫২-র ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম স্ফূরণ ভাষা ও মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষার লড়াই ৷ ১৯৪৭ শেষের দিকে  করাচিতে একটি শিক্ষা সম্মেলন হয় ৷ ওই সম্মেলনে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে  উর্দূকে গ্রহণের সুপারিশ করা হয় ৷ এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকায় বিক্ষোভ হয় ৷ 

মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সৃষ্টির পানি অনেক দূর গড়ালেও ভাষা আন্দোলনে নারীর অবদান বরাবব়ই খুব বড় করে লেখা হয় না ৷ নারীর অর্জন গৌণ, পার্শ্বচরিত্রের ভূমিকায় থেকেছে সবসময় ৷ অথচ কবির ভাষায় ,” কোনোকালে একা হয়নিক জয়ী পুরুষের তরবারী , শক্তি দিয়েছে সাহস দিয়েছে বিজয়লক্ষী নারী৷” নারী সবসময় বিজয়িনীর ভূমিকায় ছিল এবং আছে যেমন তেভাগা থেকে ব্রিটিশ বিরোধী, ভাষা থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে গণজাগরণ মঞ্চ সবগুলোতেই নারীর  অংশগ্রহণ ছিল দুর্বার ৷  

মহান ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ৷ মাতৃভাষা রক্ষায় আন্দোলন শুরু হয় ‘৪৮ সালে আর শেষ হয় ‘৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ৷ ‘৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয় ৷ পাক- ভারত বিভক্তির পরপরই মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে নারীদের জন্য সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা সহজসাধ্য বিষয় ছিল না ৷ কারণ প্রথমত, রক্ষনশীল সমাজ , নারীকে কোনঠাসা করে রাখার অপচেষ্টা দ্বিতীয়ত, নারী শিক্ষা ৷ 

তবে ভাষা আন্দোলন শুরুর প্রেক্ষাপট নারীকে এগিয়ে যাবার সাহস যোগায় ৷ ভাষা আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ, শিক্ষায় নারীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে ৷ নারীরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে ছাত্রদের সহযোদ্ধা হিসাবে পাশে ছিলেন ৷ পাকিস্তান পুলিশের তাক করা বন্দুক নারীদের পিছপা করতে পারেনি ৷ মিছিলে আহতদের  সেবাদান , বাড়ি বাড়ি গিয়ে আর্থিক সহায়তা সংগ্রহে নারীরাই এগিয়ে, নিজেদের অলংকার বিক্রয়ের অর্থ সহায়তা ফান্ডে জমাদান করেন নারীরা,  শ্লোগান সম্বলিত পোস্টার নারীদের হাতেই লিখিত হয় , আহত ভাইদের নিজেদের কাছে রেখে চিকিৎসাসেবা নারীরাই প্রদান করে ৷ জীবনের মায়া , ঝুঁকির তোয়াক্কা করেনি নারীরা ৷ পরিনামে জেল খেটেছে, সংসার তছনছ হয়েছে ,শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন নারীরা ৷ দেশের বিভিন্ন জেলাসমূহ যেমন ঢাকা , রাজশাহী, খুলনা, সাতক্ষীরা, টাঙ্গাইল , সিলেট, চট্টগ্রাম, বগুড়া , নারায়নগঞ্জ জেলার নারীরা একত্রিত হয়ে অসীম দৃঢ়তা ও সাহস নিয়ে এই আন্দোলনে একাত্নতা ঘোষণা করেন ৷ 

আন্দোলন শুরুর দিকে ৩১ শে জানুয়ারি ১৯৪৮  ঢাকার বার লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সভায় ছাত্রীদের পক্ষে ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন বলেন, ‘বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি স্বীকার করিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন হলে মেয়েরা তাদের রক্ত বিসর্জন দেবে ৷’ একজন ছাত্রীর এমন সাহসী উচ্চারণ কর্মীদের মাঝে উদ্দীপনা জাগাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে ৷ 

বাঙালি জাতির কৃষ্টি – সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখার জন্য ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তমদ্দুন মজলিস’ গঠিত হয় ৷ সংগঠন প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তির পর একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয় ৷ এটি ছিল সে সময়কার একটি সাহসী ও উদ্যমী পদক্ষেপ ৷ এই কর্মসুচী সে সময় বাংলা ভাষাভাষী ভাবধারার মানুষের মধ্যে আশার কুসুম প্রস্ফুটিত হয়েছিল ৷ 

নারীদের অনেকেই এর সদস্যভুক্ত হন ৷ তম্মধ্যে ভাষাসৈনিক প্রফেসর চেমন আরা এবং তার ছোট বোন মমতাজ ছিলেন সক্রিয় কর্মী ৷ পোস্টার, ব্যানার বানানোসহ বিভিন্ন কাজে তাঁরা বড়দের সহযোগিতা করতেন ৷ তমদ্দুন মজলিসের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জেবুন্নিসা বেগম, দৌলতুন্নেছা বেগম , আনোয়ারা বেগম মজলিসে আসতেন এবং ভাষার দাবিতে সোচ্চার ভূমিকা রাখতেন  ৷ 

বাংলা ভাষার দাবিতে একনিষ্ঠ এবং দুঃসাহসী কর্মীবাহিনী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওমেন হলের ছাত্রীরা ৷তাদের মধ্যে সুফিয়া খাতুন, সামসুননাহার , রওশন আরা বাচ্চু , সারা তৈফুর, কাজী আমিনা, মাহফিল আরা , খোরশেদী খানম , হালিমা খাতুন, রানু মুখার্জী, আফসারী খানম , সানজিদা খাতুন, সৈয়দা লুৎফুন্নেসা খাতুন, জোবেদা খাতুন, বেগম জাহানারা মতিন , রাবেয়া খাতুন, মিসেস কাজী মোতাহার হোসেন , সৈয়দা শাহরে বানু চৌধুরী , দৌলতুন্নেছা বেগম সহ আরো অনেক নাম না জানা নারী ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন ৷ সে সময় ওমেন স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সহসভাপতি ছিলেন ডঃ শাফিয়া খাতুন ৷ ১৯৫০ – ৫১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ওমেন হল ইউনিয়নের জি এস এবং  পরে ভিপি নির্বাচিত হন ৷ তাঁদের সক্রিয় আন্দোলনে আজ আমরা আমাদের মায়ের মধুর ভাষায় কথা বলতে পারছি ৷ 

বেগম সুফিয়া কামাল ,নাদিরা চৌধুরী, নুরজাহান মুরশিদ , ডঃ শাফিয়া খাতুন মিছিলে নেতৃত্ব দেন। পুলিশি হামলার তোয়াক্কা না করে ২১ ফেব্রুয়ারির ঐ দিনে স্কুল কলেজ পড়ুয়া  মেয়েরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আমতলায় সভায় যোগ দেয়ার জন্য পায়ে হেঁটে এসেছিলেন ৷ ছিলেন মিছিলের সম্মুখভাগে ৷ মিছিলে ব্যবহৃত পোস্টার , ব্যানার প্রস্তুতে মেয়েরাই দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেদিন ৷ এই আন্দোলনো ভাষাসৈনিক নারীরা অংশগ্রহণ করে প্রমাণ করেছেন নারী কেবল অন্ত:পুরবাসিনী বা ঘটনার অসহায় দর্শকমাত্র নন , আত্নমর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দ্রোহী হয়ে ওঠাও তার পক্ষে অসম্ভব কাজ নয় ৷ এই সময়ে নারীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে জীবন বাজী রেখে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন , পুলিশী নির্যাতন সহ্য করেছিলেন ৷ তাঁদের মধ্যে ড: হালিমা খাতুন, প্রতিভা মৎসুদ্দী, সুফিয়া আহম্মেদ, রওশন আরা বাচ্চু, রানী ভট্টাচার্য, সোফিয়া খানের ভুমিকা ছিল অন্যতম ৷ 

সে সময়কার সামাজিক প্রেক্ষাপট এত সহজ ছিল না ৷ নারী ছিল ভিন্ন গ্রহের মানুষ ৷ বহিরাঙ্গনে নারী পুরুষের একত্রে আলাপচারিতা অকল্পনীয় ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের পশ্চাদ অনুসরণ করে শ্রেণিতে প্রবেশ এবং ক্লাস শেষে কমনরুম বন্দী অবস্থায় দিনশেষ করতে হতো ৷ সেই অবস্থান থেকে নারীরা উদ্বুদ্ধ হয়ে মেয়েদের সংগঠিত করে ছেলেদের সম্মুখভাগে মিছিলের নেতৃত্বে আসা সত্যিই  দুঃসাহসিক ! 

ভাষা আন্দোলনের ফলাফল পেতে আমাদের অনেক ত্যাগ, অনেক রক্ত ঝরাতে হয়েছে ৷ রাজপথ রক্তাক্ত হয়েছে ৷ অনেক মা – বোন হারিয়েছে রক্তের ধন ৷ ভাষা আন্দোলন নারীদের মুক্তির পথ দেখিয়েছে ৷ বাঙালি নারীদের আজকের অবস্থানে আসার পিছনে এই ভাষা আন্দোলন ৷ ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে দায়িত্ব নিয়ে জানাতে হবে আমাদের৷ নারীর অবদান ইতিহাসবেত্তাদের উন্মোচন করতে হবে ৷ তাহলে আগামি প্রজন্ম জানবে তাদের স্বজাতি বোনদের গৌরব গাঁথা ইতিহাস ৷  নারীরা  উৎসাহিত হবে, উদ্দীপ্ত হবে সংগ্রামী উদ্দীপনায় ৷ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় যেসব অসমসাহসী নারী যোদ্ধা আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন সেসব ভাষাজয়িতাদের প্রতি জানাই আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ৷ ২১ শে ফেব্রুয়ারি শোকের মাস, ভাষাশহীদদের চেতনায় দৃপ্ত হওয়ার মাস, সংগ্রামী সাহসে বলীয়ান হওয়ার মাস ৷ এই মাসে তাদের জানাই আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ৷ 

নারী এবং ভাষা আন্দোলন

মুগ্ধতা.কম

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ , ১২:৪৪ পূর্বাহ্ণ

প্রাণের মাতৃভাষা

এক.

ধরি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি যদি বলতেন, পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলা ভাষা চালু করতে হবে, তারা কি মানতেন? এটা কি তাদের অস্তিত্বে আঘাত হতো না?

আসলে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা চেয়েছিলেন বাঙালিদের অস্তিত্বে আঘাত করতে এবং আজীবন দাবিয়ে রাখতে। তারা ইতিহাস থেকে পাঠ নিয়েছে এবং  জেনেছে কিভাবে একটা জাতিকে দাবিয়ে রাখা যায়।তাই তারা ভাষা ও সংস্কৃতিতে আঘাত করতে তৎপর ছিল। তারা জেনেবুঝে সে কাজটি শুরু করেছিল। তাদের অন্য আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল, তা হলো যে কোন মূল্যে উর্দুভাষাটাকে বাঙালীদের ওপর জোর করে চাপিয়ে উর্দুভাষী সংখ্যাটাকে বিশ্বে বড় করে দেখাতে এবং সেই অনুযায়ী অন্য ভাষাভাষীদের প্রভাবিত করতে। 

দুই.

হাইস্কুল পড়ুয়া আমার ছেলে-মেয়ে ফটর-ফটর করে দু’চার লাইন হিন্দি ভাষার বাক্য অনায়াসেই বলতে পারে। কারণ তারা তাদের অবসর সময়ে বাসার এন্ড্রোয়েড ফোনে, টিভিতে, কম্পিউটারে হিন্দি ছবি, বিভিন্ন সিরিয়াল নাটক কিংবা নাচ-গানের চটকদারি বিভিন্ন শো দেখে থাকে। সেখান থেকে সুন্দর ডায়লগ শুনতে-শুনতে একটা আবেশি চার্জ কাজ করে ওদের ভেতর।

সোজা কথা, সেসব বিষয়ে তারা তাৎক্ষণিকভাবে একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। এই ঘোর থেকে তারা কখনও হিন্দিতে বিভিন্ন শব্দ বা বাক্য বলে থাকে। কিন্তু এই ভাষায় কী তারা তাদের মনের ভাব সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে পারবে?

তিন.

১৯৯৬ সালে ঢাকায় ছিলাম। টিকে থাকতে সেখানকার স্থানীয় ভাষা কতকটা আত্মস্ত হয়েছিল। যখন আমার প্রাণের রংপুর শহরে, আমার নাড়িপোতা জায়গা হারাগাছে আসতাম, কী যে শান্তি পেতাম তা প্রকাশের নয়। শান্তিটা আমার হারাগাছি ভাষার জন্য, রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার জন্য। মায়ের এই ভাষা আহা, কী সুমধুর! মন ভরে যেত।

চার.

একটা অনিবার্য লড়াই-সংগ্রাম করতে রফিক শফিক জব্বার বরকতসহ আরও নাম না জানা অনেকে শহিদ হয়েছেন। আরও অনেকের রক্ত গেছে। আরও অনেকের অন্যান্য অনেককিছু ত্যাগ করতে হয়েছিল বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে।

ভাষার জন্য আর কোন রাষ্ট্রে এমন ঘটনা খুব কি আছে? 

এমন ইতিহাস হয়ত কিছু আছে, কোন কোন দেশের আছে। কিন্তু আমাদের মতো কি তারা ফুঁসে উঠেছিল? এতো রক্ত কি তাদের গেছে?

পাঁচ.

আমরা তাঁদের কখনও ভুলব না। ভুলব না। ভুলব না। কোন বাঙালীর তা ঠিক হবে না। রাষ্ট্রসহ আমাদের সবার উচিত হবে সর্বত্র বাংলা ভাষা চালু করা, ব্যবহার করার।

শেষ করছি সেইসব ভাষা শহিদদের এবং যাঁদের রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে বাংলা ভাষা আর সেই কাঙ্খিত স্বাধীনতা পেয়েছি, তাঁদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম এবং বিনম্র শ্রদ্ধা।

প্রাণের মাতৃভাষা

প্রমথ রায়

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ , ১২:৪৪ পূর্বাহ্ণ

মাতৃভাষার প্রতি অনীহা এবং আমাদের স্মার্ট হওয়ার অপচেষ্টা

আমি কিছুদিন আগে একটি সাহিত্য অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে এক  আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। সাথে ছিলো তাঁর সহধর্মিনী ও ৮/৯ বছরের কন্যা। মেয়েটিকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে ইংরেজিতে করতে হচ্ছে। সে একটি নৃত্য দিলো সেটাও আবার ইংরেজি গানের সাথে। সে ঢাকায় একটি ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়ে। তাঁর সহধর্মিনীর কাছে যখন অনুষ্ঠান সম্পর্কে অনুভূতি জানতে চাওয়া হলো, তখন তিনি অর্ধেক বাংলায় এবং অর্ধেক ইংরেজিতে অনুভূতি প্রকাশ করলেন। অথচ আইনজীবী প্রমিত বাংলা উচ্চারণে সাবলীল ও মাধুর্যতায় কবিতা আবৃত্তি ও আলোচনা করলেন। এতে হয়তোবা তাঁদেরকেও দোষ দেওয়া যাবে না। তাঁদের সামাজিক মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে তাদেরকে হয়তোবা এভাবে অভ্যস্ত হতে হয়। আমার ধারণা আমাদের সমাজের অধিকাংশ উচ্চ শ্রেণির পরিবারগুলোতে এরকম চর্চা হয়।

আমি ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে ইংরেজি শব্দ বা শব্দমালা ব্যবহার করি। না করলে মনে হয়, হয়তোবা আমি উন্নতির অগ্রযাত্রায় এগুতে পারছি না। আমাদের সমাজে ইংরেজি পারাটাকে একটু অগ্রগামীই মনে করা হয়।

আমি নিজে ইংরেজি শিখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। এটা করতে গিয়ে আমাকে ইংরেজির চর্চা করতে হয়। শিক্ষার্থীরা যাতে ইংরেজিতে ভালো করে এ জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাই।

অথচ আমি যখন গ্রামে থাকি, তখন ইংরেজিতো দূরের কথা প্রমিত বাংলাও ব্যবহার করি না। এতে আমার কোনো রকমের সমস্যা হয় না। অর্থাৎ প্রয়োজনে আমাদের ইংরেজি শিখতে হচ্ছে, কিন্তু কখনো কখনো আমরা সামাজিক অবস্থান বজায় রাখতে গিয়ে অপ্রয়োজনে ইংরেজি বলছি; যা নিশ্চয় কাম্য নয়।

এখন আমরা প্রত্যেকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টিকটক বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করছি। এসব করতে গিয়ে কখনো কখনো আমরা ভিডিও বা ছবির সাথে হিন্দি গান ব্যবহার করছি। অথচ আমাদের বাংলাভাষায় রয়েছে অনেক সমৃদ্ধ গান। আমরা সকলে চঞ্চল চৌধুরী ও শাওনের কণ্ঠে গাওয়া ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ এবং হাওয়া চলচ্চিত্রের ‘তুমি বন্ধু কালা পাখি’ গান দুটির জনপ্রিয়তা জানি। তাই জনপ্রিয়তার জন্য আমাদের হিন্দি গানের আশ্রয় নিতে হবে এমন নয়।

ইংরেজি শেখা আমাদের দক্ষতা আবেগ নয়। আমরা অন্যসব বিষয় পড়াশুনা করে যেমন ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করি। ইংরেজিও ঠিক এরকম। কিন্তু বাংলা এরকম নয়। বাংলায় আমাদের আবেগ জড়িত। রয়েছে ভালোবাসার টান। বাংলায় আমরা যেমন মধুর করে কথা বলতে পারি, অন্যভাষায় তেমন সম্ভব নয়। সুন্দর করে বাংলা বলতে পারা শিল্প। কেউ যদি সুন্দর বাংলায় কথা বলে, আর যদি কেউ বুঝতে না পারে; আমার বিশ্বাস বাংলা স্বর শুনে সে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাবে। ভালোমতো বাংলা একজন বাঙালি যতটা স্মার্ট হতে পারে, অন্যভাষায় তা সম্ভব নয়। তাইতো বলতে হয়, তোমার কথায় কথা বলি পাখির গানের মতো’। ফুল, পাখি, নদী, নৌকা সবই যেন বাঙালির প্রাণের ভাষায় কথা বলে।

মাতৃভাষার প্রতি অনীহা এবং আমাদের স্মার্ট হওয়ার অপচেষ্টা

মুগ্ধতা.কম

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ , ১২:৪৪ পূর্বাহ্ণ

ভাষা আন্দোলন : প্রেক্ষিত বগুড়া

ভাষা আন্দোলন ছিল এক ঐতিহাসিক আন্দোলন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া উর্দু ভাষা আর অন্যায় শোষনের বিরুদ্ধে এ আন্দোলন ছিল গণদাবি। ভাষা আন্দোলনের একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি আছে। আছে মায়ের ভাষায় কথা বলার মতো মৌলিক অধিকার রক্ষার তীব্রতা।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এই আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও এর শুরুটা হয়েছিল অনেক আগেই। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান। দুটি অংশের মাঝে ভৌগলিক দূরত্বের মতই প্রকট হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পার্থক্য।

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ বইতে অল্প কথায় উল্লেখ করেছেন এভাবে, ‘…অর্থনৈতিক নিপীড়ন থেকে অনেক বড়ো নিপীড়ন হচ্ছে একটি জাতির ভাষা, সংস্কুতি আর ঐতিহ্যের ওপর নিপীড়ন, আর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ঠিক সেটিই শুরু করেছিল। পাকিস্তানের জ্নম হয়েছিল ১৯৪৭ সালে আর ঠিক ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা এসে ঘোষণা করলেন উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা তার প্রতিবাদ করে বিক্ষোভ শুরু করে দিল। আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিল রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার এবং আরো অনেকে। তারপরেও সেই আন্দোলনকে থামানো যায়নি, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে হয়েছিল। যেখানে আমাদের ভাষাশহীদরা প্রাণ দিয়েছিলেন, সেখানে একন আমাদের প্রিয় শহীদ মিনার, আর ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখটি শুধু বাংলাদেশের জন্যে নয়, এখন সারা পৃথিবীর মানুষের জন্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।’

মাতৃভাষাকে ঘিরে যে গণআন্দোলন হয়েছিল ১৯৫২ সালে তা শুধু ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ ছিল না। দেশের প্রতিটি প্রান্তে সেই আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে গিয়েছিল। প্রতিটি অঞ্চলে দেশব্যাপি এই আগুনের হল্কার চরম বিস্ফোরণ হয়েছিল রাজধানী ঢাকায়।

ভাষা আন্দোলনই সেই দুর্লভ পটভূমি যা বাঙালিদের এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছিল। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকসহ নানা রকমের বিভেদকে একপাশে সরিয়ে রেখে সেই মহান আন্দোলন গণমানুষকে দিয়েছিল সংহতি। মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের চরম দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিল বাংলার মানুষ। ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে সমসাময়িক বগুড়া জেলায় যেসব তৎপরতা চলে সেসব ঘটনা জাতীয় সংহতিতে ভূমিকা রাখে। স্থানীয় পর্যায়ের কর্মসচলতা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে শক্তি যোগায় দৃঢ়ভাবে। ভাষা আন্দোলনে বগুড়া জেলার মানুষের ভূমিকা সমৃদ্ধ এবং উজ্জ্বল।

উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার বলে খ্যাত বগুড়া জেলা নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণেই এখন থেকে উত্তরাঞ্চলে রাজনৈতিক তৎপরতার বিস্তার ঘটানো সহজেই সম্ভব হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সময়ে অসংখ্য প্রতিভাবান মানুষ এগিয়ে এসে শক্তিশালী করেছেন এই আন্দোলনকে। তাদের ডাকে সব শ্রেনীর মানুষ অংশ নিয়ে আন্দোলনকে প্রভাবশালী এবং প্রতিবাদমুখর করে তোলে। ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে বগুড়া জেলায় ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির একটি ধারাবাহিক রূপরেখা তুলে ধরছি।

বগুড়া শহরে প্রথমবারের মতো প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধের প্রতিবাদ করতে হলে এই আন্দোলনকে একটি আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়া প্রয়োজন, এটা বগুড়ার অগ্রগামী মানুষরা বুঝতে পেরেছিলেন। সেই সঙ্গে এই আন্দোলনে সব ধরনের মানুষের অংশগ্রহনের উপযোগি করা এবং তাদের অংশগ্রহন নিশ্চিত করার তাদিগটি তারা অনুভব করেছিলেন। গণমানুষের অংশ্রগহনই শুধু একটি আন্দোলনকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, এটা বিশ্বাস করে তারা প্রথমবারের মতো একটি সভার আয়োজন করেন। বিশেষ করে গণ-পরিষদে খাজা নাজিম উদ্দিনের বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে ন্যাক্কারজনক ভূমিকার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করা তখন ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছিল। তাই কবি ও অধ্যাপক আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে প্রথমবারের মতো একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয় ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। সভা পরিচালনার জায়গা হিসেবে বেছে নেওয়া হয় আযিযুল হক কলেজের প্রাঙ্গন।

১৯৪৮ সালেই বগুড়ায় ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে ব্যাপক তৎপরতা ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র ফেডারেশন ও কমিউনিস্ট পার্টি এই আন্দোলনে সরাসরি ভূমিকা পালন করে। আযিযুল হক কলেজ থেকে ছাত্র ফেডারেশনের নেতা ও সাহিত্য কর্মী মুহম্মদ আব্দুল মতীনের নেতৃত্বে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হলে সেখানে হামলা চালায় মুসলিম লীগের নেতা ও সমর্থকরা। মিছিলটি কলেজ থেকে বের হবার পরেই তারা হামলার প্রস্তুতি নিতে থাকে। মিছিলটি সাতমাথায় এলে তারা দলবেঁধে হামলা চালায়। ফলে বেশ কয়েকজন আহত হয়।

ভাষা আন্দোলনে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ একটি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ। এদিন আযিযুল হক কলেজে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয় যার উদ্দেশ্য ছিল প্রদেশব্যাপী (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ধর্মঘট পালন সফল করা। কবি আতাউর রহমানকে আহ্বায়ক করে গঠিত সেই কমিটিতে নারীদের অংশগ্রহন ছিল। গোলাম মজিউদ্দিনের বোন সালেহা খাতুন এবং ডা. মোজাফফর আহমেদের বোন রহিমা খাতুনের সেই কমিটিতে সম্পৃক্ততা ছিল। এদিন আযিযুল হক কলেজ থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করার জন্য বেরিয়ে পড়ে। এই মিছিলে প্রথম সারিতে ছিলেন ভাষাসৈনিক গাজিউল হক।

এই মিছিলকে ঘিরেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ১১ মার্চ চাত্র-জনতার মিছিল বগুড়া আযিযুল হক কলেজ থেকে বের হয়ে শহরের দিকে যাবার সময় অধ্যক্ষ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সামনে পড়ে যায়। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তখন আযিযুল হক কলেজের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। তিনি সেসময় কলেজে আসছিলেন। আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্ররা তাকে মিছিলের নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ করলে তিনি তা গ্রহণ করেন। পরে মিছিল শেষে বগুড়া জিলা স্কুলের মাঠে একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সভাপতিত্ব করেন এবং অসাধারণ এক বক্তৃতায় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। বহুভাষাবিদ এই জ্ঞানতাপসের অংশগ্রহনে বগুড়ায় চলমান ভাষা আন্দোলন নতুন গতি লাভ করে।

১৯৪৮ সালের ২৯ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের বগুড়া সফরকে কেন্দ্র করে অবাঙালি জেলা প্রশাসক আবদুল মজিদের হঠকারিতায় এক প্রচণ্ড ছাত্রবিক্ষোভ হয়। ছাত্রনেতা গোলাম রহমান এই বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন। নভেম্বর-ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত এসব বিক্ষোভে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও শাহ আজীজপন্থী সরকার সমর্থক ছাত্রদল ব্যাপক বাধা দিতে থাকে। এদের আক্রমণে মারাত্মকভাবে আহত হন জননেতা মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের পুত্র এস,এম নুরুল আলম, গোলাম মোঃ মহিউদ্দিন, আবুল ফজল সিদ্দিকী ও নূর মোহাম্মদ খান।

১৯৪৮ সালের আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে আরো যাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় তারা হলেন আতিউর রহমান, অধ্যাপক গোলাম রসুল, মুহাম্মদ আব্দুল মতিন, অধ্যাপক আবুল খায়ের, অধ্যাপক পৃত্থিশ দত্ত, আতাউর রহমান, গাজিউল হক, গোলাম মহিউদ্দিন, জালাল উদ্দিন আকবর বুটু, নাজির হোসেন, সাত্তার, তরিকুল খান, নুরুল হোসেন মোল্লা, ইবনে মিজান, শ্যামাপদ সেন ও কবিরাজ মতিয়ার রহমান।

ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনকারীদের মধ্যে আরো আছেন কবি রোস্তাম আলী কর্ণপুরী, মোশাররফ হোসেন মন্ডল, অ্যাড. হারুন-উর-রশিদ, কমরেড মোখলেসুর রহমান, আব্দুর রহিম সওদাগর মতিন, সাদেক আলী আহমদ, ডা. ননী গোপাল দেবদাস. এ.কে মুজিবুর রহমান, ডা. এনামুল হক, ডা. সি.এম ইদরিস, ডা. আজিজুল হক, আলী আহমদ ও দূর্গাদাস মুখার্জী।

১৯৯১ সালে কবি জিএম হারূন ‘স্মৃতিতে জল পড়ে টুপটাপ’ শিরোনামের একটি স্মৃতিকথার সংকলন সম্পাদনা করেন। ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন সেখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উল্লেখ করেন। স্মৃতিতে জল পড়ে টুপটাপ বইটি এখন দুর্লভ। তাই পাঠকের জন্যে সেখান থেকে ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনের লেখার কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি-

‘‘.. আজকে বগুড়ায় যে ক্যান্টনমেন্টটি স্থাপন করা হয়েছে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ’৫২র পর পরই। মুসলিম লীগের বুকে বগুড়াই প্রথম ছুরির আঘাত করে। যুক্তফ্রন্ট গড়বার প্রথম পরীক্ষা হয় বগুড়াতেই এবং তা বিপুল সাফল্য লাভ করে। সর্বদলীয় কর্মী শিবিরের প্রথম পদক্ষেপও বগুড়াতেই। অবশ্য ঐ সর্বদলীয় কর্মী শিবিরে যুবলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, বিড়ি শ্রমিক, আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, কৃষক সমিতিকে নিয়েই সর্বদলীয় কর্মী শিবির গড়ে ওঠে। এর পরে ঢাকায়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে, মুসলিম লীগ বিরোধী সংগ্রমা বগুড়াই প্রথম সূচনা করেছে।

এইসব আন্দোলনের বাস্তব ভিত্তি রচনা করেছিলেন বগুড়ার বিড়ি শ্রমিক ভায়েরা। বগুড়ার বিড়ি শ্রমিক একটি দুর্ধর্ষ শাসকবিরোধী সংগঠন ছিল। আজ আমি এই স্মৃতি সাধনায় তাঁদের সবার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। শ্রদ্ধা জানাই মরহুম আকবর হোসেন আকন্দ, মরহুম আলিম মোখতার, মরহুম ডা. ইসহাক উদ্দিন, মরহুম সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী, মরহুম নজিবর রহমান (দর্জী বিজ্ঞান কলেজের প্রতিষ্ঠাতা), মরহুম সিরাজ উদ্দীন (আটাপাড়া), মরহুম সমির উদ্দীন মণ্ডল, মরহুম নসির উদ্দীন মণ্ডল, ডা. ননীগোপাল দেবদাস, ডা. আশুতোষ দত্ত, মরহুম ফজলার রহমান সরকার (ফুলবাড়ী), কবিরাজ আবদুল আজিজ ভীষগরতœ, সুবোধ লাহিড়ী, মরহুম আবদুল লতিফ সরকার, আবদুস শহীদ (বৃন্দাবনপাড়া), কবি আতাউর রহমান, মরহুম সৈয়দ কোব্বাদ হোসেন, শাহ আলম, জালাল উদ্দীন আকবর, গাজীউল হক, আবু মোহাম্মদ, মোজহারুল ইসলাম, প্রণব চৌধুরী, ইকবাল হোসেন, মশাররফ হোসেন মণ্ডল, মোখলেসুর রহমান, হারুনর রশীদ, শ্যামাপদ সেন, পিযূষ রায় এবং আরো অনেককে। এখানে মহিলাদের মধ্যে বিশেষভাবে আমি দু’জন মহিলার নাম উল্লেখ করছি- ১ম জন হলো মরহুম ইব্রাহিম মোখতার (খানবাহাদুর) সায়েবের কন্যা (আমি নাম ভুলে গেছি। যদিও তিনি আমার ক্লঅস ফ্রেণ্ডের মা) আর একজন ওকিমন বেওয়া। এদের সবার প্রতি আমার অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।’’

ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনের এই লেখায় ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় অনেক মানুষের নাম উঠে এসেছে। উঠে এসেছে সেসময়ের দুর্বার আন্দোলেন অনেক খন্ডচিত্র। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে যে অপূর্ব কর্মসচলতা গড়ে ওঠে ১৯৪৯ সালে এসে সেই সচলতাকে বাধা দেবার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে শাসকগোষ্ঠী।

এবছরের প্রথমদিকে আযিযুল হক কলেজের ছাত্র-শিক্ষকরা, বিড়ি শ্রমিক এবং সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা মিছিল করে নিয়মিত বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় স্কুল পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রীরাও। ১৭ এপ্রিল আযিযুল হক কলেজ থেকে একটি বড়ো আকারের বিক্ষোভ মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করতে বের হয়। এদিন পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে ছাত্র ধর্মঘট পালন করা হয়। এর মূল কারণ ছিল, শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও ছাত্র বহিষ্কার। সেদিন বগুড়ার রাজপথ কাঁপিয়ে বিক্ষোভ মিছিল চলতে থাকলে দ্বিতীবারের মতো মুসলীম লীগ ও অবাঙালিার মিছিলের ওপর লাঠিসোটা হামলা চালায়। মিছিলে অংশ নেওয়া শিক্ষক-ছাত্র-শ্রমিকসহ স্কুলের কিশোরীরা পর্যন্ত অত্যাচারের শিকার হন। মিছিলের নেতা আবদুস শহীদ ও ভিএম স্কুলের ছাত্রীনেত্রী সালেহা বেগমসহ কয়েকজন মিছিলকারী মারাত্মক আহত হন।

১৯৫০ সাল বগুড়ায় ভাষা আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যাবার পক্ষে খুবই দূরহ হয়ে ওঠে। শাসকগোষ্ঠীর দোসররা নানা ভাবে এই আন্দোলনকে দমানোর চেষ্টা করে। আন্দোলন যাতে দানা বেধে উঠতে না পারে সে জন্যে তারা পুলিশ ও গোয়েন্দাবাহিনীকে লেলিয়ে দেয় আন্দোলনকারীদের ওপর। গ্রেফতার হন অসংখ্য ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-শিল্পী-সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। কঠোর দমন-পীড়নের ফলে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী মানুষদের সাথে সাধারণ জনগনের যোগাযোগ অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

১৯৫১ সালের মাঝামাঝি এই অবস্থা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়। কমিউনিস্ট পার্টি একটি ‘কন্ট্রাক্ট কমিটি’ তৈরি করে এর মাধ্যমে আন্দোলনকে সংগঠিত করার চেষ্টা করে। এই কমিটির কাজ ছিল, আন্দোলনকে একটি সর্বদলীয় আন্দোলনের রূপ দেওয়া এবং একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা। এই কমিটির মাধ্যমেই জননেতা মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে আন্দোলনকে গতিশীল করে তোলা হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৫২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়।

১৭ ফেব্রুয়ারি বগুড়ার থানা রোডে (বর্তমান কবি নজরুল ইসলাম সড়ক) ছাত্রনেতা আবদুস শহীদের পতিা আবদুল ওহাব ভলিফার ক্রিতল বাসার নিচতলার হলঘরে বিপুলসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিনিধি সভায় প্রবীণ রাজনীতিবিদ মজির উদ্দিন আহমেদকে সভাপতি, কৃষক নেদা আবদুল আজীজ কবিরাজ ভিষকরতœ-কে সহ-সভাপতি এবং ছাত্রনেতা গোলাম মহিউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি, বগুড়া শাখা গঠন করা হয়।

কমিটির তালিকা উদ্ধৃত করছি। তালিকাটিতে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহনকারীদের ব্যাপকতা ও সংহতি আন্তরিকভাবে ফুটে উঠেছে।

সভাপতি: অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক ‘নিশান’ পত্রিকার প্রবীণ সম্পাদক-সাংবাদিক, জননেতা (যিনি পরে যুক্তফ্রন্ট দলীয় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন) মজির উদ্দিন আহমেদ।

সম্পাদক: গোলাম মহিউদ্দিন।

অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন শেখ মহিউদ্দিন, শেখ হারুনুর রশীদ, ছমির উদ্দিন মণ্ডল, এ.কে মজিবুর রহমান (পরে এমপি হয়েছিলেন), কবিরাজ শেখ আবুদল আজিজ, সিরাজুল ইসলাম, আবদুস শহীদ, নুরুল হোসেন মোল্লা ( তৎকালীন বগুড়া উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক), মোটরশ্রমিক নেতা সুবোধ লাহিড়ী, আবদুর রহিম সওদাগর মতিন, বিড়ি শ্রমিক নেতা শাহ আহমেদ হোসেন, রিকশা শ্রমিক নেতা মোখলেসুর রহমান, কৃষক নেতা ফজলুর রহমান, তমদ্দুন মজলিসের কবি-সাহিত্যিক খোন্দকার রোস্তম আলী কর্ণপুরি, লুৎফর রহমান সরকার (পরে গভর্নর হয়েছিলেন, তখন ছাত্রাবস্থা), কৃষক প্রজাপার্টির নেতা কবিরাজ মোফাজ্জল বারী।

এই কমিটি গঠন হবার পর পরই বগুড়ায় ভাষা আন্দোলন বেগবান হয়। ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি এই কমিটির আহ্বানে জিলা স্কুল ময়দানে বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মিছিলে গুলিবর্ষণে হতাহতের ঘটনা জানামাত্র বগুড়ায় দিনব্যাপী হরতাল পালিত হয়। পরের দিনও হরতাল ও বিক্ষোভ প্রদর্শন চলতে থাকে। সেদিন থেকে টানা ১৮ দিন বগুড়ার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করা হয়।

এরপর ধারাবাহিকভাবে এই আন্দোলন চলতে থাকে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাংলাভাষাকে স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত বগুড়া ভাষা আন্দোলনের গতি উজ্জ্বলতর হয়ে উজ্জীবীত থেকেছে।

তথ্যসূত্র:

১.ভাষা আন্দোলনে বগুড়া (আজিজার রহমান তাজ সম্পাদিত)

২.মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস (ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল)

৩.স্মৃতিতে জল পড়ে টুপটাপ (জি এম হারূন সম্পাদিত)

৪.বাংলাপিডিয়া

৫.উইকিপিডিয়া-মুক্তবিশ্বকোষ

৬.বিভিন্ন ওয়েব ও ব্লগ সাইট

লেখক: ছড়াকার, সংবাদকর্মী, বগুড়া লেখক চক্র-এর সাধারণ সম্পাদক

ভাষা আন্দোলন প্রেক্ষিত বগুড়া - আমির খসরু সেলিম