ভাষা আন্দোলন : প্রেক্ষিত বগুড়া
ভাষা আন্দোলন ছিল এক ঐতিহাসিক আন্দোলন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া উর্দু ভাষা আর অন্যায় শোষনের বিরুদ্ধে এ আন্দোলন ছিল গণদাবি। ভাষা আন্দোলনের একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি আছে। আছে মায়ের ভাষায় কথা বলার মতো মৌলিক অধিকার রক্ষার তীব্রতা।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এই আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও এর শুরুটা হয়েছিল অনেক আগেই। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান। দুটি অংশের মাঝে ভৌগলিক দূরত্বের মতই প্রকট হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পার্থক্য।
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ বইতে অল্প কথায় উল্লেখ করেছেন এভাবে, ‘…অর্থনৈতিক নিপীড়ন থেকে অনেক বড়ো নিপীড়ন হচ্ছে একটি জাতির ভাষা, সংস্কুতি আর ঐতিহ্যের ওপর নিপীড়ন, আর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ঠিক সেটিই শুরু করেছিল। পাকিস্তানের জ্নম হয়েছিল ১৯৪৭ সালে আর ঠিক ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা এসে ঘোষণা করলেন উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা তার প্রতিবাদ করে বিক্ষোভ শুরু করে দিল। আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিল রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার এবং আরো অনেকে। তারপরেও সেই আন্দোলনকে থামানো যায়নি, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে হয়েছিল। যেখানে আমাদের ভাষাশহীদরা প্রাণ দিয়েছিলেন, সেখানে একন আমাদের প্রিয় শহীদ মিনার, আর ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখটি শুধু বাংলাদেশের জন্যে নয়, এখন সারা পৃথিবীর মানুষের জন্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।’
মাতৃভাষাকে ঘিরে যে গণআন্দোলন হয়েছিল ১৯৫২ সালে তা শুধু ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ ছিল না। দেশের প্রতিটি প্রান্তে সেই আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে গিয়েছিল। প্রতিটি অঞ্চলে দেশব্যাপি এই আগুনের হল্কার চরম বিস্ফোরণ হয়েছিল রাজধানী ঢাকায়।
ভাষা আন্দোলনই সেই দুর্লভ পটভূমি যা বাঙালিদের এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছিল। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকসহ নানা রকমের বিভেদকে একপাশে সরিয়ে রেখে সেই মহান আন্দোলন গণমানুষকে দিয়েছিল সংহতি। মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের চরম দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিল বাংলার মানুষ। ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে সমসাময়িক বগুড়া জেলায় যেসব তৎপরতা চলে সেসব ঘটনা জাতীয় সংহতিতে ভূমিকা রাখে। স্থানীয় পর্যায়ের কর্মসচলতা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে শক্তি যোগায় দৃঢ়ভাবে। ভাষা আন্দোলনে বগুড়া জেলার মানুষের ভূমিকা সমৃদ্ধ এবং উজ্জ্বল।
উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার বলে খ্যাত বগুড়া জেলা নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণেই এখন থেকে উত্তরাঞ্চলে রাজনৈতিক তৎপরতার বিস্তার ঘটানো সহজেই সম্ভব হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সময়ে অসংখ্য প্রতিভাবান মানুষ এগিয়ে এসে শক্তিশালী করেছেন এই আন্দোলনকে। তাদের ডাকে সব শ্রেনীর মানুষ অংশ নিয়ে আন্দোলনকে প্রভাবশালী এবং প্রতিবাদমুখর করে তোলে। ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে বগুড়া জেলায় ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির একটি ধারাবাহিক রূপরেখা তুলে ধরছি।
বগুড়া শহরে প্রথমবারের মতো প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধের প্রতিবাদ করতে হলে এই আন্দোলনকে একটি আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়া প্রয়োজন, এটা বগুড়ার অগ্রগামী মানুষরা বুঝতে পেরেছিলেন। সেই সঙ্গে এই আন্দোলনে সব ধরনের মানুষের অংশগ্রহনের উপযোগি করা এবং তাদের অংশগ্রহন নিশ্চিত করার তাদিগটি তারা অনুভব করেছিলেন। গণমানুষের অংশ্রগহনই শুধু একটি আন্দোলনকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, এটা বিশ্বাস করে তারা প্রথমবারের মতো একটি সভার আয়োজন করেন। বিশেষ করে গণ-পরিষদে খাজা নাজিম উদ্দিনের বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে ন্যাক্কারজনক ভূমিকার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করা তখন ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছিল। তাই কবি ও অধ্যাপক আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে প্রথমবারের মতো একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয় ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। সভা পরিচালনার জায়গা হিসেবে বেছে নেওয়া হয় আযিযুল হক কলেজের প্রাঙ্গন।
১৯৪৮ সালেই বগুড়ায় ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে ব্যাপক তৎপরতা ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র ফেডারেশন ও কমিউনিস্ট পার্টি এই আন্দোলনে সরাসরি ভূমিকা পালন করে। আযিযুল হক কলেজ থেকে ছাত্র ফেডারেশনের নেতা ও সাহিত্য কর্মী মুহম্মদ আব্দুল মতীনের নেতৃত্বে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হলে সেখানে হামলা চালায় মুসলিম লীগের নেতা ও সমর্থকরা। মিছিলটি কলেজ থেকে বের হবার পরেই তারা হামলার প্রস্তুতি নিতে থাকে। মিছিলটি সাতমাথায় এলে তারা দলবেঁধে হামলা চালায়। ফলে বেশ কয়েকজন আহত হয়।
ভাষা আন্দোলনে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ একটি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ। এদিন আযিযুল হক কলেজে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয় যার উদ্দেশ্য ছিল প্রদেশব্যাপী (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ধর্মঘট পালন সফল করা। কবি আতাউর রহমানকে আহ্বায়ক করে গঠিত সেই কমিটিতে নারীদের অংশগ্রহন ছিল। গোলাম মজিউদ্দিনের বোন সালেহা খাতুন এবং ডা. মোজাফফর আহমেদের বোন রহিমা খাতুনের সেই কমিটিতে সম্পৃক্ততা ছিল। এদিন আযিযুল হক কলেজ থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করার জন্য বেরিয়ে পড়ে। এই মিছিলে প্রথম সারিতে ছিলেন ভাষাসৈনিক গাজিউল হক।
এই মিছিলকে ঘিরেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ১১ মার্চ চাত্র-জনতার মিছিল বগুড়া আযিযুল হক কলেজ থেকে বের হয়ে শহরের দিকে যাবার সময় অধ্যক্ষ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সামনে পড়ে যায়। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তখন আযিযুল হক কলেজের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। তিনি সেসময় কলেজে আসছিলেন। আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্ররা তাকে মিছিলের নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ করলে তিনি তা গ্রহণ করেন। পরে মিছিল শেষে বগুড়া জিলা স্কুলের মাঠে একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সভাপতিত্ব করেন এবং অসাধারণ এক বক্তৃতায় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। বহুভাষাবিদ এই জ্ঞানতাপসের অংশগ্রহনে বগুড়ায় চলমান ভাষা আন্দোলন নতুন গতি লাভ করে।
১৯৪৮ সালের ২৯ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের বগুড়া সফরকে কেন্দ্র করে অবাঙালি জেলা প্রশাসক আবদুল মজিদের হঠকারিতায় এক প্রচণ্ড ছাত্রবিক্ষোভ হয়। ছাত্রনেতা গোলাম রহমান এই বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন। নভেম্বর-ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত এসব বিক্ষোভে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও শাহ আজীজপন্থী সরকার সমর্থক ছাত্রদল ব্যাপক বাধা দিতে থাকে। এদের আক্রমণে মারাত্মকভাবে আহত হন জননেতা মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের পুত্র এস,এম নুরুল আলম, গোলাম মোঃ মহিউদ্দিন, আবুল ফজল সিদ্দিকী ও নূর মোহাম্মদ খান।
১৯৪৮ সালের আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে আরো যাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় তারা হলেন আতিউর রহমান, অধ্যাপক গোলাম রসুল, মুহাম্মদ আব্দুল মতিন, অধ্যাপক আবুল খায়ের, অধ্যাপক পৃত্থিশ দত্ত, আতাউর রহমান, গাজিউল হক, গোলাম মহিউদ্দিন, জালাল উদ্দিন আকবর বুটু, নাজির হোসেন, সাত্তার, তরিকুল খান, নুরুল হোসেন মোল্লা, ইবনে মিজান, শ্যামাপদ সেন ও কবিরাজ মতিয়ার রহমান।
ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনকারীদের মধ্যে আরো আছেন কবি রোস্তাম আলী কর্ণপুরী, মোশাররফ হোসেন মন্ডল, অ্যাড. হারুন-উর-রশিদ, কমরেড মোখলেসুর রহমান, আব্দুর রহিম সওদাগর মতিন, সাদেক আলী আহমদ, ডা. ননী গোপাল দেবদাস. এ.কে মুজিবুর রহমান, ডা. এনামুল হক, ডা. সি.এম ইদরিস, ডা. আজিজুল হক, আলী আহমদ ও দূর্গাদাস মুখার্জী।
১৯৯১ সালে কবি জিএম হারূন ‘স্মৃতিতে জল পড়ে টুপটাপ’ শিরোনামের একটি স্মৃতিকথার সংকলন সম্পাদনা করেন। ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন সেখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উল্লেখ করেন। স্মৃতিতে জল পড়ে টুপটাপ বইটি এখন দুর্লভ। তাই পাঠকের জন্যে সেখান থেকে ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনের লেখার কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি-
‘‘.. আজকে বগুড়ায় যে ক্যান্টনমেন্টটি স্থাপন করা হয়েছে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ’৫২র পর পরই। মুসলিম লীগের বুকে বগুড়াই প্রথম ছুরির আঘাত করে। যুক্তফ্রন্ট গড়বার প্রথম পরীক্ষা হয় বগুড়াতেই এবং তা বিপুল সাফল্য লাভ করে। সর্বদলীয় কর্মী শিবিরের প্রথম পদক্ষেপও বগুড়াতেই। অবশ্য ঐ সর্বদলীয় কর্মী শিবিরে যুবলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, বিড়ি শ্রমিক, আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, কৃষক সমিতিকে নিয়েই সর্বদলীয় কর্মী শিবির গড়ে ওঠে। এর পরে ঢাকায়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে, মুসলিম লীগ বিরোধী সংগ্রমা বগুড়াই প্রথম সূচনা করেছে।
এইসব আন্দোলনের বাস্তব ভিত্তি রচনা করেছিলেন বগুড়ার বিড়ি শ্রমিক ভায়েরা। বগুড়ার বিড়ি শ্রমিক একটি দুর্ধর্ষ শাসকবিরোধী সংগঠন ছিল। আজ আমি এই স্মৃতি সাধনায় তাঁদের সবার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। শ্রদ্ধা জানাই মরহুম আকবর হোসেন আকন্দ, মরহুম আলিম মোখতার, মরহুম ডা. ইসহাক উদ্দিন, মরহুম সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী, মরহুম নজিবর রহমান (দর্জী বিজ্ঞান কলেজের প্রতিষ্ঠাতা), মরহুম সিরাজ উদ্দীন (আটাপাড়া), মরহুম সমির উদ্দীন মণ্ডল, মরহুম নসির উদ্দীন মণ্ডল, ডা. ননীগোপাল দেবদাস, ডা. আশুতোষ দত্ত, মরহুম ফজলার রহমান সরকার (ফুলবাড়ী), কবিরাজ আবদুল আজিজ ভীষগরতœ, সুবোধ লাহিড়ী, মরহুম আবদুল লতিফ সরকার, আবদুস শহীদ (বৃন্দাবনপাড়া), কবি আতাউর রহমান, মরহুম সৈয়দ কোব্বাদ হোসেন, শাহ আলম, জালাল উদ্দীন আকবর, গাজীউল হক, আবু মোহাম্মদ, মোজহারুল ইসলাম, প্রণব চৌধুরী, ইকবাল হোসেন, মশাররফ হোসেন মণ্ডল, মোখলেসুর রহমান, হারুনর রশীদ, শ্যামাপদ সেন, পিযূষ রায় এবং আরো অনেককে। এখানে মহিলাদের মধ্যে বিশেষভাবে আমি দু’জন মহিলার নাম উল্লেখ করছি- ১ম জন হলো মরহুম ইব্রাহিম মোখতার (খানবাহাদুর) সায়েবের কন্যা (আমি নাম ভুলে গেছি। যদিও তিনি আমার ক্লঅস ফ্রেণ্ডের মা) আর একজন ওকিমন বেওয়া। এদের সবার প্রতি আমার অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।’’
ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনের এই লেখায় ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় অনেক মানুষের নাম উঠে এসেছে। উঠে এসেছে সেসময়ের দুর্বার আন্দোলেন অনেক খন্ডচিত্র। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে যে অপূর্ব কর্মসচলতা গড়ে ওঠে ১৯৪৯ সালে এসে সেই সচলতাকে বাধা দেবার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে শাসকগোষ্ঠী।
এবছরের প্রথমদিকে আযিযুল হক কলেজের ছাত্র-শিক্ষকরা, বিড়ি শ্রমিক এবং সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা মিছিল করে নিয়মিত বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় স্কুল পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রীরাও। ১৭ এপ্রিল আযিযুল হক কলেজ থেকে একটি বড়ো আকারের বিক্ষোভ মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করতে বের হয়। এদিন পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে ছাত্র ধর্মঘট পালন করা হয়। এর মূল কারণ ছিল, শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও ছাত্র বহিষ্কার। সেদিন বগুড়ার রাজপথ কাঁপিয়ে বিক্ষোভ মিছিল চলতে থাকলে দ্বিতীবারের মতো মুসলীম লীগ ও অবাঙালিার মিছিলের ওপর লাঠিসোটা হামলা চালায়। মিছিলে অংশ নেওয়া শিক্ষক-ছাত্র-শ্রমিকসহ স্কুলের কিশোরীরা পর্যন্ত অত্যাচারের শিকার হন। মিছিলের নেতা আবদুস শহীদ ও ভিএম স্কুলের ছাত্রীনেত্রী সালেহা বেগমসহ কয়েকজন মিছিলকারী মারাত্মক আহত হন।
১৯৫০ সাল বগুড়ায় ভাষা আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যাবার পক্ষে খুবই দূরহ হয়ে ওঠে। শাসকগোষ্ঠীর দোসররা নানা ভাবে এই আন্দোলনকে দমানোর চেষ্টা করে। আন্দোলন যাতে দানা বেধে উঠতে না পারে সে জন্যে তারা পুলিশ ও গোয়েন্দাবাহিনীকে লেলিয়ে দেয় আন্দোলনকারীদের ওপর। গ্রেফতার হন অসংখ্য ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-শিল্পী-সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। কঠোর দমন-পীড়নের ফলে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী মানুষদের সাথে সাধারণ জনগনের যোগাযোগ অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
১৯৫১ সালের মাঝামাঝি এই অবস্থা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়। কমিউনিস্ট পার্টি একটি ‘কন্ট্রাক্ট কমিটি’ তৈরি করে এর মাধ্যমে আন্দোলনকে সংগঠিত করার চেষ্টা করে। এই কমিটির কাজ ছিল, আন্দোলনকে একটি সর্বদলীয় আন্দোলনের রূপ দেওয়া এবং একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা। এই কমিটির মাধ্যমেই জননেতা মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে আন্দোলনকে গতিশীল করে তোলা হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৫২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়।
১৭ ফেব্রুয়ারি বগুড়ার থানা রোডে (বর্তমান কবি নজরুল ইসলাম সড়ক) ছাত্রনেতা আবদুস শহীদের পতিা আবদুল ওহাব ভলিফার ক্রিতল বাসার নিচতলার হলঘরে বিপুলসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিনিধি সভায় প্রবীণ রাজনীতিবিদ মজির উদ্দিন আহমেদকে সভাপতি, কৃষক নেদা আবদুল আজীজ কবিরাজ ভিষকরতœ-কে সহ-সভাপতি এবং ছাত্রনেতা গোলাম মহিউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি, বগুড়া শাখা গঠন করা হয়।
কমিটির তালিকা উদ্ধৃত করছি। তালিকাটিতে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহনকারীদের ব্যাপকতা ও সংহতি আন্তরিকভাবে ফুটে উঠেছে।
সভাপতি: অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক ‘নিশান’ পত্রিকার প্রবীণ সম্পাদক-সাংবাদিক, জননেতা (যিনি পরে যুক্তফ্রন্ট দলীয় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন) মজির উদ্দিন আহমেদ।
সম্পাদক: গোলাম মহিউদ্দিন।
অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন শেখ মহিউদ্দিন, শেখ হারুনুর রশীদ, ছমির উদ্দিন মণ্ডল, এ.কে মজিবুর রহমান (পরে এমপি হয়েছিলেন), কবিরাজ শেখ আবুদল আজিজ, সিরাজুল ইসলাম, আবদুস শহীদ, নুরুল হোসেন মোল্লা ( তৎকালীন বগুড়া উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক), মোটরশ্রমিক নেতা সুবোধ লাহিড়ী, আবদুর রহিম সওদাগর মতিন, বিড়ি শ্রমিক নেতা শাহ আহমেদ হোসেন, রিকশা শ্রমিক নেতা মোখলেসুর রহমান, কৃষক নেতা ফজলুর রহমান, তমদ্দুন মজলিসের কবি-সাহিত্যিক খোন্দকার রোস্তম আলী কর্ণপুরি, লুৎফর রহমান সরকার (পরে গভর্নর হয়েছিলেন, তখন ছাত্রাবস্থা), কৃষক প্রজাপার্টির নেতা কবিরাজ মোফাজ্জল বারী।
এই কমিটি গঠন হবার পর পরই বগুড়ায় ভাষা আন্দোলন বেগবান হয়। ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি এই কমিটির আহ্বানে জিলা স্কুল ময়দানে বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মিছিলে গুলিবর্ষণে হতাহতের ঘটনা জানামাত্র বগুড়ায় দিনব্যাপী হরতাল পালিত হয়। পরের দিনও হরতাল ও বিক্ষোভ প্রদর্শন চলতে থাকে। সেদিন থেকে টানা ১৮ দিন বগুড়ার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করা হয়।
এরপর ধারাবাহিকভাবে এই আন্দোলন চলতে থাকে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাংলাভাষাকে স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত বগুড়া ভাষা আন্দোলনের গতি উজ্জ্বলতর হয়ে উজ্জীবীত থেকেছে।
–
তথ্যসূত্র:
১.ভাষা আন্দোলনে বগুড়া (আজিজার রহমান তাজ সম্পাদিত)
২.মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস (ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল)
৩.স্মৃতিতে জল পড়ে টুপটাপ (জি এম হারূন সম্পাদিত)
৪.বাংলাপিডিয়া
৫.উইকিপিডিয়া-মুক্তবিশ্বকোষ
৬.বিভিন্ন ওয়েব ও ব্লগ সাইট
লেখক: ছড়াকার, সংবাদকর্মী, বগুড়া লেখক চক্র-এর সাধারণ সম্পাদক