মাহাবুবা লাভীন এর একগুচ্ছ কবিতা
ব্যবচ্ছেদ
আপনাকে একটু দুঃখ দেখালে আপনি নির্দ্বিধায় ঢুকে যাবেন আমার অন্দরমহলে
যেন আমার অন্দরমহলের সদর দরজায় নেই কোনো প্রহরী
দরজা খোলা
প্রবেশাধিকার রয়েছে সকলের
তারপর
তারপর আপনি ব্যবচ্ছেদ করবেন আমার সংসার
আমার যাপিত জীবন
আমার দাম্পত্য
খুঁটে খুঁটে ব্যবচ্ছেদ করবেন সংসারের খুঁটিনাটি
আমার চাল ডাল নুন আর তরকারির নিত্য বাজারদর
আপনি বড় বড় অক্ষরে লিখে ঘোষণা করবেন
এই মেয়েটি অসুখী
দাম্পত্য কলহে মেয়েটির জীবন অতিষ্ঠ
তারপর
তারপর আপনি একটা বাঁকা হাসিসমেত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবেন-
‘সংসার সুখী হয় রমনীর গুণে’
হায়, আমি তখন গুণহীন মানহীন রমন অযোগ্য এক রমনী
আমার চোখের ভাষা থেকে আপনি নোনাজলের গল্প বুনবেন
আমার বিষন্ন মুখ দেখে লিখবেন ঘোর অমাবস্যার গল্প
আমার দীর্ঘশ্বাস শুনে গাঢ় শীতের
কোনো কঙ্কালসার আমলকি বন থেকে তুলে আনবেন পাতা ঝরার গল্প
অথচ
আমি যদি আমার এক টুকরো আনন্দ দেখাই
আপনি নিশ্চিত কলম থামিয়ে দেবেন
আপনার বোধ হয়ে পড়বে দ্বিধান্বিত
আপনি কূল খুঁজে পাবেন না তার
কী করে পাবেন
আমি তো আনন্দ কুড়োই সামান্য একটা ফুলের শরীর থেকে
পাখিদের ভাষা থেকে
নদীর কলতান থেকে তুলে আনি আনন্দ
একটা প্রজাপতির নাচন থেকে তুলে আনি আনন্দ
শনশন করে বয়ে যাওয়া বাতাস থেকে আমি জোগাড় করি তুমুল আনন্দ
এত ছোট ছোট মুহূর্ত থেকে আমি আনন্দ কুড়াই
আপনি তল খুঁজে পাবেন না তার
দুঃখকে ব্যবচ্ছেদ করে জানা যায় অনেককিছু
আনন্দকে ব্যবচ্ছেদ করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়…
_____________________________
আশাভঙ্গ
ঘাস হয়ে জন্মাবো জেনে
কি আনন্দ পেয়েছিল সে
পায়ে পায়ে দলে যাবে বলে
আহা!
আর এদিকে অপরুপ ঘাসফুল হয়ে ফুটে আছি
তার চোখে পড়ার আগে
_______________________________
ভিনদেশী দুই পাখি
ধরো, আমাদের কোনো পরিচয় নেই
আমরা দু’জন অনেক দূরের কেউ
কোনদিন কেউ শ্বাস ছুঁইনি কারোর
চোখের ভেতর কেউ পুষিনি কারোর অভিমান
আঙুল ভাঁজে কেউ লিখিনি অন্যকারোর নাম
কেউ চিনি না কারোর পায়ের আওয়াজ
পাঁজর খুলে কেউ দেখিনি দুঃখ সেথায় কেমন
কেউ জানি না হস্তরেখায় কার কী লেখা আছে!
ঠিক দু’জনের ভাগ্যরেখা কোন দিকে যে গেছে
তবু চলো একটা সকাল আমরা দু’জন একই সাথে হাঁটি
হাঁটতে হাঁটতে সকাল গড়াক, দুপুর গড়াক
গড়িয়ে বিকেল সন্ধ্যা নামুক
সন্ধ্যাটুকু মিলিয়ে গেলে রাতের কাছে থামি
আমরা দু’জন আকাশঢাকা তারার সাথে জাগি
তারার কাছে গড়িয়ে আসা সকাল নিয়ে বলি
দুপুর নিয়ে বলি,
মিলিয়ে যাওয়া সন্ধ্যা নিয়ে বলি
তারার কাছে গোপন ব্যথার সবক’টা দোর খুলি
জানুক তারা আমরা নাহয় খুব অচেনা, ভিনদেশী দুই পাখি
আমরা তবু আজ এখানে একইসাথে আছি
এই এতটা এসেছি হেঁটে সঙ্গে করে বিশ্বাসী দুই আঁখি…
____________________________
একটুখানি বদলে যেতে ইচ্ছে করে
আমার একটু বদলে যেতে ইচ্ছে করে
ইচ্ছে করে গুছিয়ে নিতে খুব নিজেকে
ভয় হয়
খুব ভয় হয়
যদি এই আমিটা বিপুলরকম বদলে যাই
যদি হাসতে গিয়ে থমকে দাঁড়াই
কথা মাপি ফিতের দাগে
পাঁজর ভাঙার শব্দ লুকোই অট্টহাসে
যদি কারুর দুঃখ ছুঁতে আঙুল বাধে
ভয় হয়
খুব ভয় হয় এসব নিয়ে
আমার একটু বদলে যেতে ইচ্ছে করে
খুব সামান্যই বদলে যেতে ইচ্ছে করে
এই যে ধরুন
ইচ্ছে করে অগোছালো চুলগুলোকে গুছিয়ে রাখি চুলের ফিতেয়
ভয় হয়
চুলের ফাঁকে বুলিয়ে দেয়া আঙুলগুলো
এবার যদি হারিয়ে ফেলি
খুব ভয় হয়
ইচ্ছে করে একটুখানি বদলে নিতে খুব নিজেকে
ইচ্ছে করে ঘর সংসার গুছিয়ে রাখি
কিন্তু যদি লকারভরে গুছিয়ে ফেলি
মান অভিমান, খুনসুটি আর অট্টহাসি…