অনাঘ্রাতার বিবর্ণ প্রচ্ছদ
১. চেনা পায়ের দাগ
নীল মাধব,
অনাঘ্রাতা এই পথেই হেঁটে গেছে
এটাই তো রোদ্রস্নান পথ
মাধবীর স্নানের চিহ্ন পড়ে আছে
বুনোপুষ্পের ওপর।
ওই দেখো মাধব—চেনা পায়ের দাগ
ধূলির ওপর পড়ে আছে অমলিন।
ওই তো অদূরে মনপুরা কৈলাশ
ওটাই তো মাধবীর নিবাস।
নীল মাধব,
আমি কি এখানেই দাঁড়িয়ে রব চিরকাল ?
পথ চিনে দাও—আমিও যাবো মাধবী গেছে যে পথ ধরে …
নীল মাধব,
এখন বিজয়ের মাস…
বিজয় দিবসে একাই কি ফুল দেবো শহিদ মিনারে …
নীল মাধব
আমার মাধবীকে ফিরে আসতে বলো…
২. নামযজ্ঞ প্রিয়ার
নীল মাধব,
ফুল ফুটেছিল কদম বৃক্ষশাখে
বর্ষা প্রণয়ের মহামিলনের আশে
বৃষ্টিঝরা রাতে
বাঁশির কণ্ঠ নাম ধরে ডেকেছিল
নামযজ্ঞ প্রিয়ার
মানবের বাঁশির ডাক শুনে ঘরে থাকেনি মানবী আর।
বৃষ্টিঘন অগ্নিরাতের শুভ প্রহরে
মানবীর পায়ের ছাপে ছাপে
পথের কাদায় ফুটেছিল কমল
বর্ষার অবিরাম বৃষ্টিতে—
অঙ্গ ভিজে ভিজে মানবী গিয়েছিল কদম বৃক্ষতলে
ভেজা শবনম বসেছিল ভেজা অঙ্গের ভাঁজে ভাঁজে।
দেবালয়ে উঠেছিল কানাকানি
জানাজানি হয়েছিল স্বর্গকুঞ্জ মাঝে
রাধিকার অন্তর অতলে ফুটেছিল উচ্ছাসে
নাম কৃষ্ণকমল।
বৃষ্টি থামেনি সারারাত
নাম কানু বাঁশিও বেজেছে অবিরাম
অন্তরে ফুটেছিল তার নাম রাধিকা বকুল
বাঁশির কণ্ঠ নাম ধরে ডেকেছে নামযজ্ঞ প্রিয়ার
এক সময় প্রেমের মাধুরীচূর্ণে
মানবের গলা জড়িয়ে ধরেছে মানবীর দু’হাত।
নীল মাধব,
এই যে রাতভর বাঁশির কণ্ঠ ফাটানো
এই যে মানব- মানবীর স্বর্গীয় মিলন
এই যে ভালোবাসায় কমল ফুটানো
কোথায় লুকিয়ে গেছে বলো এমন ?
এখনো তো অগ্নিসন্ধ্যায় কিংবা অগ্নিরাতে
প্রিয়ার নাম ধরে বাজে বাঁশি
কেনো ছুটে আসে না মানবের ডাকে সেই মানবী
এখনো তো কদম বৃক্ষতলে বর্ষায় বৃষ্টি নামে
অঙ্গ ভেজায় মানব
কেনো মানবের ডাকে ছুটে আসে না মানবী
কেনোই বা প্রেমের পথে ফুটে না কমল
এই পরিণতির জন্য কে দায়ী?
বৃষ্টির কণ্ঠে মেঘবাহন বলেছিল—মানবী।
৩. গান শুনুক আর নাই শুনুক
নীল মাধব,
মুদ্রণ হবে না নতুন কোনো শিরোনাম
সম্পাদনা হবে না মাধবী
সে হাঁটতে থাকুক না হয় আগুনের ওপর
কিংবা পুষ্পে অথবা রক্তে
হাঁটুক সে নিজস্ব গতিপথে।
এই জনবহুল নগরীর দালানে কিংবা রাস্তায়—
মাধবীর অনুসন্ধান অরোরার পূর্বভাগে।
পথের সন্ধানও আজ হবে না অনুসন্ধানে।
কালের কণ্ঠ থেকে এনেছি কালের সুর।
সম্পাদনায় পুনঃ মুদ্রণ নতুন গায়েনের কণ্ঠ—
মাধবী শুনুক আর নাই শুনুক এ গান।
নীল মাধব তুলসীচন্দন নয়—তোমাকে উৎসর্গ আজ গান।
৪. একটি গানের জন্য
একটি গানের জন্যে
সুরের গীটার জাগিয়ে রাখে অযস্র রজনী
ধবল নদীর তীরে গানের জন্যে বটমূলে বসে থাকা গায়েন যেনো স্বর্গদূত।
রজনী জেগে জেগে বক্ষ করেছে ক্ষয়
গীটারে বেহাগে প্রলয় হয়নি ধূসর পথ
সুরের মূর্ছনায় খান্ খান্ হয়নি রজনী প্রহর।
গানের জন্যে সুরেন্দ্র সুরেন্দ্র বলে আর্তনাদ করেছে গায়েন
আর্তনাদে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়েছ গগন।
গানের পথ ধরে হেঁটে গেছেন নবী দাউদ
কতো তানসেন, লালন, হাছন, আব্বাস, কানাইশীল, হরলাল, করিম, মাধাই
কতো গান পাগল পথে পথে ঝরিয়েছে কণ্ঠের রক্ত।
একদিন পৃথিবী গানহীন ছিলো
উর্বর জমিন ছিলো শস্য ফলাতে বন্ধ্যা
এই ভাবে কাটে সহস্র বছর, অতঃপর একদা—
গানের কলি ফুটলো স্রষ্টার জমিনে
পর্বতের বক্ষ ফেটে জলসুর স্রোত বহে সমুদ্রের দিকে।
গানের সুরের মূর্ছনায় সমুজ্জ্বল হলো
মক্কার আঁধারী পথ।
গানের লয়ে আঁধার ধ্বংস হলো
বেথেলহামে, মথুরা, বৃন্ধাবনে,
সিন্ধুর পথ ধরে বাংলায় পৃথিবীর পথে ঘাটে।
গানের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো মসজিদের আজানে
গানের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো গীর্জার ঘণ্টায়
গানের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো মন্দিরের শঙ্খে।
তারপর, সেই গান গায়েনের কণ্ঠে এলো
দরাজ কণ্ঠে হোসেন গায়েন গাইল মানুষের গান।
গান গাইতে গাইতে তার কণ্ঠের রক্ত ঝরে পড়ে পথে।
নীল মাধব,
আমার কণ্ঠেও মানুষের ভালোবাসার গান।
নীল মাধব,
রক্ত ঝরার পথে এই কালিনেরও হবে যে অভিষেক।
৫. মাধবী বিলাস
মাধবী, তোমার ঘনকালো চুলের
আগা ছড়াচ্ছে হৈয়ঙ্গবীণ ঘ্রাণ।
আমার নিষ্প্রাণ কোলে ঝরে পড়ছে
ঘ্রাণের মাধুরীচূর্ণ।
দুপুরের স্নান শেষ করে
আমার সম্মুখে দাঁড়ানো বনজ্যোৎস্নার ছায়াদেবী তুমি।
ক্ষীরময় শরীরের কারুকাজ ভাঁজে
ঋতুবতী নদীর মোহনায় মরীচিকা ঢেউ।
চন্দ্রখোঁচা নাভীর সরোবরে ফুটেছে
এক শ’ অাট অমল নীলকমল।
আজকের এই বিজয় দিনে
তোমাকে বেশ মানিয়েছে—যেনো অপরূপ অব্রাত্য ভূমি তুমি।
ঘরের সব ক’টা বাতায়ন খুলে
দাঁড়াও দখিনের খোলা বাতায়নে
এবার গাও বিজয়ের গান।
পরনে সবুজ শাড়ি—
লাল পাড়, লাল আঁচল,
লাল বেসিয়ার ব্লাউজ।
কপালে গাঢ় লাল টিপ্
মাথায় নীল রঙের স্কার্প
রাঙা পায়ে হলুদ চপল
দু’ হাতে লাল বেলোয়ারি চুড়ি
অনন্য বিলাস সমগ্রের তুমিই মাধবী।
বিলাসগুলো ধরে রাখো মাধবী ধরে রাখো
ওগুলো নয় সোকেজে সাজিয়ে রাখা খেলনা, টি পট, কাপ পিরিচ, চীনা মাটির প্লেট।
ওগুলো নয় দরজা—জানালার রঙিন পর্দা
ওগুলো তোমার গাঢ় শ্যামল বরণ
শরীরে বসন্ত ধরে রাখার বৈভব।
মাধবী ,
তোমার চুলের হৈয়ঙ্গবীণ ঘ্রাণে খুঁজে পাবে— স্বাধীনতার স্বাদ।
সবুজ রঙে খুঁজে পাবে—আমন মৌসুমের ধানের ক্ষেত, সবুজ বনভূমি।
লাল রঙে খুঁজে পাবে—ফাগুনের আগুন, প্রতিদিনের সূর্যোদয়।
হলুদ রঙে খুঁজে পাবে—চিরহরিৎ জীবনের বেলাভূমি।
নীল রঙে খুঁজে পাবে—সমুদ্রের গভীরতা, উদার নীলিমা।
মাধবী ,
হাতের চুড়ির ঝঙ্কারে খুঁজে পাবে—জীবনের জয়গান।
পায়ের চপলে খুঁজে পাবে—পথ চলার গতি।
শাড়ির লাল পাড়, লাল আঁচল—ভালোবাসার উঠোন।
মাধবী বিলাস সমগ্রে তোমাকে বেশ মানিয়েছে, ধরে রাখো বিলাস সমগ্র।
মাধবী,
অঘ্রাত সুন্দর আর সৌন্দর্যের কটিদেশ ধরে— অনায়াশে পথ চলতে পারো।
৬. লাল শাড়ি লাল টিপ্
মাধবী ,
লাল শাড়িতে তোমাকে বেশ মানিয়েছে।
কপালে লাল টিপ্
ওটুকু বিলাস ধরে রেখো
লাল শাড়িতে খুঁজে পাবে
ফাগুনের আগুন।
লাল টিপে খুঁজে পাবে
জীবনের সূর্যোদয়।
মাধবী ওটুকু বিলাস রঙ
ধরে রেখো যতনে
লাল রঙে জীবনের আল্পনা
টিকে রবে গোধূলি লগনে।
লাল শাড়ি লাল টিপ্
তোমাকে বেশ মানিয়েছে
সকালের স্নান শেষের মনরঙা ক্ষণে
বিলাসটুকু ধরে রেখো
মাধবী ধরে রেখো যতনে।
মাধবী ,
লাল শাড়ি, লাল টিপ্
খুলে ফেলো না আর
ওটুকু বিলাসে—
বিজয়কে খুঁজে পাবে বারবার।
৭. সুবর্ণচ্ছটার অক্ষর
বর্ণমালার মাস,
সুবর্ণচ্ছটার অক্ষর হয়ে
মাধবীকে ফিরে আসতে বলো …
নীল মাধব সন্ধান দে, নীল মাধব সন্ধান দে…
পৃথিবীর জমিনে মানুষের অনেক চাওয়ার থাকে
আমার চাওয়া মাধবী ফসল ভালোবাসা।
আমার সুপ্রভাত— শুভ যাচ্ছে না, তবুও—
সুপ্রভাতের শুভ শুভেচ্ছা পাঠাবো
মাধবীর শুভ জন্মদিনে।
নীল মাধব,
নষ্ট ভোরের কষ্টগুলো
বুকের ভেতর কষ্ট ভীষণ।
বুকের ভেতর বাড়ছে দহন
দহনগুলো যায় না সহন।
শহিদ বেদীর কাছাকাছি
এই যে আমি দাঁড়িয়ে অাছি।
তাহার কথা বলছে না যে—
বাংলাভাষার বর্ণগুলো
মাধব,
মাধবীকে আমার কাছে অাসতে বলো।
বর্ণমালার শহিদমাসে—
মাধবীকে সুবর্ণচ্ছটার অক্ষর হয়ে ফিরে আসতে বলো।
৮. মধ্যরাতের প্রথম প্রহরে
আজ মধ্যরাতের প্রথম প্রহরে
সবাই ফুল দিতে যাবে শহিদ মিনার
মিনারের শীর্ষচূড়ার ওপরে
অখণ্ড আকাশে নক্ষত্র জ্বলবে
শহিদ নক্ষত্রগুলো তাকিয়ে রবে
বেদীমূলের দিকে
কারা অর্ঘ দিচ্ছে তাদের
গণনায় সবাই থাকবে
গণনায় আমি থাকবো না।
আজকের মধ্যরাতের প্রথম প্রহরে
নবীন প্রবীণ পদ্যকারেরা—
বিজয়ের রক্তগাঁথায় লেখবে নতুন পদ্য
শহিদ শ্রদ্ধাঞ্জলির ফুলের পাপড়ি শরীরে—লেখা হবে একেকটি নতুন কাব্য
গণনায় পদ্যকারেরা থাকবে
গণনায় আমি থাকবো না।
আমার শূন্য চরণ বিজয় ছুঁবে না
আমার শূন্য চরণ ছুঁবে না—রাজপথের স্লোগান সিক্ত ধূলি
আমার শূন্য চরণ অমলিন চিহ্ন
এঁকে দেবে না শহিদ মিনারের মূল বেদীতে।
স্যমন্তিকাও ফুল দিতে যাবে শহিদ মিনার
তার শূন্য চরণ পূর্ণ হবে—কপালে পড়বে মহান বিজয়
তার বাজু অার কটিদেশ ছুঁবে জয়টীকা
তার লাল শাড়ির সবুজ পাড়ে লেখা হবে—
বিজয় দিবস
স্যমন্তিকা বিজয়ী।
আজ মধ্যরাতের প্রথম প্রহরে
আমার মলিন শার্টের কলারব্যাপী
লেখা হবে—পরাজিত কবি।
শহিদ নক্ষত্রগুলো তাকিয়ে রবে
শহিদ মিনারের দিকে—
কারা পুষ্পমাল্য দিচ্ছে তাদের
গণনায় স্যমন্তিকা থাকবে
গণনায় আমি থাকবো না।
আজ মধ্যরাতের প্রথম প্রহরে
শহিদ মিনার সবাই যাবে
স্যমন্তিকা যাবে
আমি যাবো না ।
৯. পুনর্বার মিলিত হবো সম্পর্কে
পদ্মার বুক চিড়ে খুঁজে পাইনি শ্যামের গকুল।
পদ্মার
ঢেউ-জলে মিশে আছে
শূন্য হৃদয়ের না—পাওয়ার বিলাপ—বিষণ্নতা
মিশে আছে
মানুষের বসত না—ভাঙার
আকুতি।
যমুনার বুক চিড়ে পাইনি শ্যাম—পিরিতের বাঁশি।
যমুনার
ঢেউ—জলে মিশে আছে
গলায় অাঁচল বেঁধে প্রণয় বিসর্জনের কাহিনি
মিশে আছে
মানুষের মন না—ভাঙার
মিনতি।
অরণ্যের বৈকুণ্ঠ পথে যে নিত্য হেঁটেছে নিঃসঙ্গ বলরাম—সে তো বিদগ্ধ ঋষি।
হে অগ্নিশিখা মনে করো,
তুমি আরেক ভদ্রা
আমি আরেক নিঃসঙ্গ বলরাম—নেই শস্যক্ষেত্রের ব্রজধাম
বৃন্দাবনসন্ধ্যায় মনে জেগেছে সমুদ্রের ঢেউ।
করতোয়ার বলরামঘাটে বলরাম বলরাম বলরাম বলে ডাকেনি কেউ।
ভদ্রা!
বৈষ্ণবভোরে শঙ্খ বাজিয়ে সংক্রান্তিতে আসিও তুমি
বারুণীর অষ্টমীস্নান দেখতে যাবো খারু—যমুনেশ্বরীর স্রোতমোহনার শেখেরহাটে।
মানুষের কণ্ঠে মিলন-বিচ্ছেদের ধূলির সঙ্গীত শুনে— হাত ধরাধরি করে,
মানুষের কাছে পৌঁছে দেবো মানুষের ভালোবাসার গান
তারপর, অন্তর্গত শষ্পভূমির ঘ্রাণ শরীরে মেখে
আমরা পুনর্বার মিলিত হবো বঁধু সম্পর্কে বাঙালির মাটিখচা বৈশাখ উৎসবে।
১০. তবুও উৎসর্গ
নীল মাধব,
মুদ্রণ হবে না নতুন কোনো শিরোনাম
খোঁজ নেবো না মাধবীর
সে হাঁটতে থাকুক আগুনের ওপর
সে হাঁটতে থাকুক পুষ্পের ওপর
কিংবা আমার বুকের ওপর।
পান করুক না হয় অামার রক্ত—
পথের সন্ধানে অনুসন্ধানী হবো না।
নীল মাধব,
রঙগন রঙগানো রঙিন রঙগিনী অঙ্গে
মন রঙাচ্ছে কঙ্কাবতী বনে—কলঙ্ক বসন্তে।
আমি বিবর্ণঃ
মাধবী এখন বহুগামীতার পথে…
কালেরকণ্ঠ থেকে কেড়ে এনেছি চারণ কণ্ঠ
পুনঃমুদ্রিত আমার কণ্ঠ
মাধবী শুনুক আর নাই শুনুক গান
তবুও উৎসর্গ হবে …
.
কবি
রংপুর