ফিরে দেখা
রতন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নদীর দিকে। ঠিক এখানেই তো নদী ছিল।এখন যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা একটা সরু লেইসফিতার মতো খাল। এখানেই তো নদীটা ছিল। নৌকা চলতো।মাঝিরা নৌকা নিয়ে এখানে মাছ মারতো। সেই মাছের বেশীর ভাগই বিক্রি হয়ে যেত নৌকাতেই।
আশেপাশের মানুষের সাথে রতনও কতদিন এখান থেকে মাছ কিনে নিয়ে গেছে।
ট্যাংরা মাছ সূর্যের আলোয় কেমন চকমক করতো। একটা হলুদ আভা,যেন হলুদ সোনা। সাত মিশাল মাছের সাথে একটা- দুটা খলসে মাছও আসতো। চট করে মাছগুলো আলাদা করে হরলিক্সের কাঁচের বোতলে রেখে দিত রতন। কি সুন্দর রঙীন মাছগুলো। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। খাবার দেয়া হতো,মুড়ি,খইল কিন্তু কিছুই মুখে নিত না। তিনদিনের বেশী একটাও বাঁচে নি।
সেই নদী আজ খাল হয়ে গেছে।
আজ সাতাশ বছর পর রতন তাকিয়ে থাকে ছোটবেলার নদীর দিকে। নদীর উপর একটা সরু ব্রীজ হয়েছে। একটা রিকসার বেশী পার হতে পারে না। রতন ব্রীজ পার হয়ে মুন্সির চালকলের দিকে যায়।ছেলেবেলায় এ চালকল চালু ছিল। সকাল ৭ টায় সাইরেন বাজতো।শ্রমিকরা পড়িমরি করে ছুটতো কাজে।
এখন সেটা পরিত্যক্ত।
পাশে বড়বড় দালান উঠেছে। উপজেলায় এখন সাততলা বিল্ডিং। রতন অবাক হয়ে পরিবর্তন দেখে।
সাতাশ বছর আসলে কমতো না।
বৈকুন্ঠপুর যখন ছাড়ে তখন রতনের বয়স তের,চোদ্দ। বৈকুন্ঠপুর বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। বাবা বেঁচে ছিলেন।
বড় ভাই করিম চাচার মুদি দোকানে কর্মচারী।
বড় বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে বিরামপুর।
পড়াশুনায় মন ছিল। মা বলতো রতন বড় হয়ে ডাক্তার হবে। রতনের নানী বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছিল।
নানীর হাঁপানি ছিল। শ্বাসকষ্ট উঠলো,ডাক্তারের কাছে যাবার মতো টাকা না থাকায় কষ্ট পেয়ে মরে গেল। ডাঙায় তোলা মাছের মতো ছটফট করতে করতে।
ডাক্তার হওয়া হয়নি রতনের।
বাবা কাজ করতো আমজাদ কাফ্রিয়ার কাপড়ের দোকানে।
একদিন রাতে দোকান থেকে এসে ভাত খেয়ে সবে এক খিলি পান মুখে দিয়েছে ওমনি দুম করে চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন। সেই যে পড়লেন আর উঠে দাঁড়ালেন না।
বাবার মৃত্যুর পর অকূল সাগরে পড়ে রতনের মা। বড় ছেলে একা আর কতটুকু করবে।
রতন কাজ করতে চলে গেল গাজীপুর।
বহুজাতিক এক জুতা ফ্যাক্টরির এমডির বাসায় কাজ। এমডির বাসায় সাংসারিক কাজে সহায়তা করা।
এমডির দুই ছেলে তন্ময় আর সঞ্জয়।
তন্ময়ের সমবয়সি হবে রতন।
তন্ময় এর স্কুলে যাওয়া আর পড়া দেখে রতনের মনেও ইচ্ছে জাগে।
এমডির স্ত্রী শিল্পি তা দেখে পাশের এক স্কুলে রতনকে ভর্তি করায় দেয়।
দিনে স্কুলের সময়টুকুবাদে রতন সংসারের কাজ করে জান লাগিয়ে।
সময়ের নৌকায় দুলতে-দুলতে এসএসসি পাশ করে রতন। এরপর আর পড়া হয়নি।
এমডি চলে গেলেন বদলি হয়ে চট্টগ্রাম।
এতদিনে রতন এমডির বাসার বাবুর্চির কাছে দেশী-বিদেশী সব রান্না শিখে নেয়।
চাকরি নেয় গুলশানের এক চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে। প্রথমে বাবুর্চির সহকারী পরে হেড বাবুর্চি।
ঢাকায় চাইনিজ হোটেলের অভাব নাই তাই চাকরিও অনেক।
বিয়ে করেছিল এক গার্মেন্টস কর্মীকে বিয়ে টিকে নাই।
এরপর নিয়মিত এক বাড়িতে যাতায়াত। নিত্যনতুন মেয়েদের সংস্পর্শ।
মা যে কদিন বেঁচে ছিলেন নিয়মিত টাকা পাঠিয়ে গেছে রতন।
কতদিন বলেছে, ঢাকায় আসো মা- ব্যাটা একসাথে থাকি।
মায়ের সেই এককথা, নারে বাবা নিজ ভিটে ছেড়ে কোথাও যাবনা।
মা মারা যান সাত বছর আগে তখন এসে দুদিন ছিল। এরপর আর আসা হয়নি।
মা ছিল ঘুড়ির নাটাই।সুতা কেটে গেলে ঘুড়িকে আর ফিরিয়ে আনা যায় না।
সাতাশবছরে কত পরিবর্তন।
মুন্সির চালকলের পিছনে এক জঙল ছিল। দিনেরবেলাতেও কেমন অন্ধকার হয়ে থাকতো। ওপাশটা কেউ সহজে যেত না।
একবার এক লোক গাছ কাটতে গিয়েছিল,গাছের গায়ে একটা কোপ দেবার সঙ্গে -সঙ্গে নাকমুখদিয়ে রক্ত আসা শুরু হয়। তারপর নাকি আর বাঁচে নি।
সেইথেকে জঙল বেড়ে উঠেছে অবাধ্য সন্তানের মতো।
একদিন এই জঙলে মনির সাথে এসেছিল রতন।
মনি হ্যাংলাপাতলা দুরন্ত মেয়ে। পাশের বাড়ির,দুবছরের ছোট।
বাড়িতে কি এক কারনে বকা দেবার জন্য দুঃখে রতন মুন্সির জঙ্গলের দিকে রওনা দেয়।
পিঁছুনেয় মনি।
ভয় দেখিয়ে, ধমক দিয়েও বিদায় না করতে পারায় সঙ্গে নেয়।
সারাদিন সে জঙ্গলে তারা ঘুরে বেড়িয়েছে। খিদে পেলে আতা গাছের ফল খেয়েছে। তারপর সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে পিটুনি খেয়েছে।
আজ সব স্মৃতি চোখে ভেসে ওঠে রতনের। বাসায় আসতে – আসতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয় রতনের।
ভাবী বললো মনি এসেছে। চমকে উঠে রতন।
বসার ঘরে সোফার এককোনে মাথা নিচু করে বসে আছে মনি।
মনির বিয়ে হয়েছে একই এলাকার সাজেদের সাথে।
এসব জানা ছিল রতনের।
সাজেদদের পারিবারিক ব্যবসা আছে। ওদের পছন্দের বিয়ে।
দূরে থেকেও এসব খবর কানে এসেছিল রতনের। কথা শুরু হয় দূরত্বের পর্দা সরিয়ে।
জানা যায় পরনারী আর নেশায় আসক্ত সাজেদ। সংসার জীবনে সুখি না মনি। মনির যাবার সময় হয়ে যায়। চোখে-চোখ রেখে মনি বলে,সেদিন মুন্সির জঙ্গলে আমাকে আদর করেছিলেন মনে আছে রতন ভাই? এরকম আনন্দদায়ক অনুভূতি আর কখনও আমার হয়নি। রতনের চকিতে মনে পড়ে যায় সেই দিনের কথা। যে দিনের কথা ইচ্ছে করেই ভুলে গিয়েছিল রতন।