মাইকেল স্ট্রগফ

১৮ জুন, ২০২৩ , ৭:১৬ পূর্বাহ্ণ

কুঞ্জল রথ

হাতে ছিলো সন্ধ্যে রঙের পথ। যুগলানয়নে ছিলো কথাকরের সুর।  ভেসে থাকা অম্লজান বারবার স্রোত তুলেছিলো কেশরন্যের বনভূবনে। মিছে হৃদকম্পভার করার যে অভিনয় করেছিলাম তা ধরা পড়ে গেলো হাতে।  দেবদারুর বন থেকে মন নেমে ঈশ্বর হয়ে এলে, সে সেজেছিলো কুর্নকঞ্জনা। যে তাকে করে গিয়েছে অপারপর তা’র গীত চরণে-চরণে সাজিয়ে ঘুরছিলো । দন্তশিখর হতে নেমেছিলো যে সোমধারা তা দেখেই বিহ্বল ছিলাম।  পৃথিবীর পথ হতে আরও কিছু দূরের গ্রহণুতীর্থে যাবো বলে বাড়িয়ে ছিলাম যে হাত তাতে নেমে এসেছিলো গণকুণ্ডধার।

সে বলেছিলো, নখের শহরে আয়নার কোন ব্যবহার নেই। প্রত্যেকেই রাজা হবার মতো মিছে বাসনায় জলাঞ্জলী দেয় ধর্ম।  শিমুলের হৃদে ডুবে থাকে কর্মফল। কালচক্রে বৃদ্ধাঙ্গণ দেখে শৈশবাসূচন করে সকলেই। এখানে সম্পর্ক নেই স্বার্থের নামে।  জমিরাজের মতো সুগভীর সুনিপুন সুসস্মিত সুপ্রসন্ন জীবন এখানে পলপল করে খলকলবলিয়ে চলে।

প্রেম এখানে চুম্বকের মতো রচনা করে উমাগিরীষ পুরান। তা’রে দেখে সেখানেই মৃত্যুনন্দগীত গাইতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু সুদন্তী সুশিলা সুপ্রভা প্রভাষহীন প্রভাকরীণি আমায় বললে, পরের জন্মে হবে

কুঞ্জল রথ

মুগ্ধতা.কম

২১ জানুয়ারি, ২০২৩ , ২:৫৫ অপরাহ্ণ

শনিবারের চিঠি – বন্ধু সংখ্যা

ঘোষণা-১:

‘শনিবারের চিঠি’ বিভাগটি আগামী শনিবার প্রকাশিত হবে না। এর পরিবর্তে আগামী ১ ফেব্রুয়ারি, বুধবার মুগ্ধতা ডট কমের তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হবে।

বিশেষ এই সংখ্যার জন্য ছড়া, কবিতা, গল্প, ভ্রমণগল্প, মুগ্ধতা নিয়ে আপনার প্রত্যাশা ও পরামর্শ লিখতে পারেন নিচের মেইল ঠিকানায়।

mojnurangpur@gmail.com (সম্পাদক)

ahmedaranno16@gmail.com (সহযোগী সম্পাদক)

ঘোষণা-২:

অনলাইন ম্যাগাজিন মুগ্ধতা ডট কমের তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংক রক্তদাতা তথ্য প্রদান প্রতিযোগিতা’ ঘোষণা করা হচ্ছে। ১ ফেব্রুয়ারি, বুধবার আয়োজিত অনুষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি রক্তদাতার তথ্য প্রদানকারী ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করা হবে বিশেষভাবে। উল্লেখ্য, রক্তদাতার এতে যথাযথ সম্মতি থাকতে হবে। এছাড়া লেখক ও পৃষ্ঠপোষক সম্মাননাও থাকবে যথারীতি। অনুষ্ঠানস্থল ও সময় আমাদের ফেসবুক পেজে (মুগ্ধতা ডট কম-পেজ) জানানো হবে।

সাপ্তাহিক সংখ্যা সম্পাদনা: আহমেদ অরণ্য, অলংকরণ: রেদওয়ান শুভ

শনিবারের চিঠি - বন্ধু সংখ্যা

মুগ্ধতা.কম

২১ জানুয়ারি, ২০২৩ , ২:৫৫ অপরাহ্ণ

প্রিয় বন্ধু রকিব আর ফিরবে না আড্ডায়

বন্ধু রকিবুল ইসলামের সাথে পরিচয় ১৯৮৯ সালে। আমরা তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। প্রথম ক্লাসেই আমাদের পরিচয় হয় এবং বন্ধুত্ব হতে বেশি সময় লাগল না। বিষয়টা এমন, পরিচয় পূর্ব জনমের আর নতুন করে বন্ধুত্ব এ জনমে।

নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে ওর চুল অনেক লম্বা আর সিলকি হওয়ায় যখন সে হাঁটত তখন মনে হতো কোনো ঘোড়া লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। সামান্য বাতাসে ছন্দ মিলিয়ে লাফাত। কাব্যময় অনুভুতি হতো চোখজুড়ে। আ. কাদের স্যার ও আ. সামাদ স্যার প্রায়ই তার চুল ধরে টানতেন। খুব চাপে পড়ে সে মাঝে মাঝে কিছুটা ছোট করত।

এস এস সি পাশ করার পূর্বেই আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। আমরা তিন বন্ধু আমি রকিব ও মামুন হয়ে উঠি মরমি। মরমি ‘র’ হারিয়ে হয়ে গেছে মমি। যেন স্থির।

এইচ এস সি পাশ করার পর আমি আর মামুন কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হই আর রকিব ভর্তি হয় রংপুর সরকারি কলেজে। কলেজে আমাদের  দেখা না হলেও প্রতিদিন  বিকেলে দেখা হতো কামাল কাছনায়। সেখানে থাকত মামুন। ওর বাসার আশেপাশে আমাদের আড্ডা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। আড্ডায় মাঝে মাঝে যোগ হতো মিথি, সম্পা, ছন্দা, তিথি ও রোজী। আড্ডায় মাঝে নতুন কিছু যোগ করত চায়না ভাবি। সেই দিনগুলো ছিল অনেক মধুর।

আমাদের বন্ধুদের মধ্যে রকিব বিয়েটাও সময়ের পূর্বেই করে। তার বিয়েতে সে নিজেসহ কেউ-ই রাজি ছিল না। তার সাথে সম্পর্ক ছিল আমাদের একজন সহপাঠী রিপার। সেই রিপার বিয়ে হয়ে যাওয়ার ভয়ে ওরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিয়ের কাপড় কেনাকাটা করতে হয় বন্ধুদেরকেই। রাত বারোটায় দর্জিকে বাসা থেকে ডেকে এনে কাপড় তৈরি করে বন্ধুরাই। বন্ধুরা ওর ছিল প্রাণ। জীবনের সব ঘটনা দূর্ঘটনার রাজসাক্ষী বন্ধুরা।

এক ঈদে রকিবের পরিবার ঢাকায় ঈদ করে। ঈদের নামাজ পড়ার পর তার আর মন টিকল না। ঢাকায় বাসায় মা বাবা ভাই এবং স্ত্রীকে না বলে বাসে উঠে বসে। গন্তব্য রংপুর।

এরকম আমাদের বন্ধুদের নিয়ে হাজারো পাগলামো আছে এই বন্ধুকে ঘিরে।

মামুন বুয়েটে চাঞ্চ পাওয়ার পর যোগাযোগ অনেক কমে গেল। ব্যস্ততা আমাদের শারীরিক দূরত্ব বাড়িয়ে দিলেও মনের দূরত্ব ছিল পূর্বের মতোই।

যখন মোবাইল নেটওয়ার্ক এল। তিনজন তিন স্থানে থাকলেও যোগাযোগ হতো প্রায়ই। রকিব রংপুরে, আমি ছিলাম কুড়িগ্রামে আর মামুন ঢাকায়। একদিন মামুন ঢাকা থেকে এল কুড়িগ্রামে আমার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে নিয়ে।

বারো বছর আগে মামুন রংপুরে পলিটেকনিক্যাল কলেজ দেওয়ার পর আমাদের তিন বন্ধুর বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হলো। আমাদের শারীরিক দূরত্ব কমে গেল। আবারও প্রায়ই দেখা হতো। কথা হতো। হতো জমজমাট আড্ডা। আমার চাকরির ধরনের কারণে মামুনকে কলেজে সহযোগিতা করতে পারিনি। কিন্তু সেটা রকিব পারল। সে রেলওয়েতে কর্মরত থাকায় যেটুকু সময় পেত মামুনকে সাহায্য করেছে তার কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য। মৃত্যুর আগ মূহুর্ত পর্যন্ত রকিব সেটা করেছে।

সাধারণত ছেলেদের বন্ধুত্বে ভাটা পড়ে প্রধান দুটি কারণে। এক টাকা দুই নারী। এই প্রধান দুই কারণ আমাদের তিনজনের মাঝে বন্ধুত্বের ফাটল ধরাতে পারেনি।

সর্বশেষ:

২৩ ডিসেম্বর ২০২২ সন্ধ্যায় মামুনের ফোন পেয়ে আমি তার কলেজ রোডের নতুন স্থায়ী ক্যাম্পাসে এলাম। সেখানে মামুনের সাথে রকিবকেও পেলাম। তিন বন্ধু শেষ বারের মতো মিলিত হলাম। আমরা কি কেউ জানতাম! এটাই আমাদের শেষ সাক্ষাৎ! জানার কথাও না। আমরা তিনজনই খুব জটিল রোগে আক্রান্ত নই। বেশ কিছুক্ষণ আমাদের আড্ডা হলো। তারপর মামুন আর রকিব চলে গেল তাদের নিয়মিত খেলার স্থান বিয়াম স্কুলের মাঠে। শীতকালে ওরা নিয়মিত ব্যাটমিন্টন খেলত। আমি খেলতে কিংবা আড্ডা দিতে যেতাম মাঝে মাঝে।

২৪ ডিসেম্বর ২০২২ সন্ধ্যায় কামালের ফোন পেয়ে দেখা হলো রংপুর সিটি কর্পোরেশন মার্কেটে। এরপর পলাশ এলো সেখানে। পলাশ ঢাকা থেকে কয়েকদিন পূর্বে এসেছে।

পলাশসহ আমরা তিনজন অন্য আরো বন্ধুদের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে জিলা স্কুলের সামনে গেলাম।

তখন বাজে রাত ৯.৫০ মি। মামুনের ফোন পেলাম। রিসিভ করতেই বলল, আমি বগুড়ায় এসেছি আজ রাতে। তুই এখন রংপুর মেডিকেলে যা। ওখানে রকিবকে বন্ধু ফেমাস ও ডা. ফারুক নিয়ে গেছে । খেলতে গিয়ে পড়ে গেছে। বলে রাখি আমাদের আরেক বন্ধু ফেমাস। ব্যাপারটা খুব জটিল ভাবলাম না। খেলতে গিয়ে সামান্য দূর্ঘটনা হতেই পারে। তবুও সময় নষ্ট না করে আমি পলাশ, কামাল তিনজনে মেডিকেলে দ্রুত পৌছালাম। জিলা স্কুল থেকে মেডিকেলের দূরত্ব পাঁচ মিনিটের। এর  মধ্যে ফেমাসের আবারও ফোন। তুই দ্রুত রিপাকে খবর দে। রিপা হচ্ছে রকিবের স্ত্রী। বুঝলাম না কী এমন হলো?  ওর স্ত্রীকে আসতে হবে! আমি চলতি পথেই আবার মামুনকে ফোন দিলাম। বললাম, তুই রিপাকে মেডিকেলে আসতে বল আমরা মেডিকেলে ঢুকছি। গ্যারেজ তখন বন্ধ করার আয়োজন চলছে। গ্যারেজ পরিচিত হওয়ায় অনুরোধ করে মোটরসাইকেল রাখলাম। পলাশ আর কামাল আমার জন্য অপেক্ষা করছিল ইমার্জেন্সিতে। গ্যারেজে মোটরসাইকেল রেখে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম মেডিকেল ইমার্জেন্সির দিকে। বন্ধু হারানোর ভয় কাজ করছিল মনে মনে। কিন্তু ভয়কে পাত্তা না দিয়ে পলাশ আর কামালসহ আমরা দ্বিতীয় তলার কার্ডিয়াক ইউনিটের সামনে এলাম। ডা. ফারুক আমাদের দেখে কান্নাকাটি শুরু করল। আমাদের বুঝে উঠতে বেশ সময় লাগল। ফারুক বলেই ফেলল রকিব আর নেই। সার্জারির ডাক্তার হওয়ায় অনেক মৃত্যুই ওদের হাতে হয় কিন্তু ফারুক কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না রকিবের মৃত্যু। বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমরা সিসিইউতে ঢুকলাম। বন্ধু নিশ্চুপ শুয়ে আছে। মাথার উপর কোনো মেশিন কাজ করছে না। চিরঘুমে আমাদের বন্ধু। অবিশ্বাস নিয়ে করিডরে এলাম। কান্নাগুলো বুকের ভিতর জমাট বাঁধতে শুরু করছিল। চোখে মুখে উৎকন্ঠা ভয় ভীড় করছিল। অব্যক্ত কষ্টগুলো ঘুরছিল ব্রেনের শরীর ঘেঁষে। একে একে অনেক বন্ধু এল। কার্ডিয়াক ইউনিটের করিডোর ভর্তি হয়ে গেলো নিমিষেই। বন্ধুপ্রিয় রকিব বন্ধুর কোলেই মৃত্যুর স্বাদ নিল।

প্রিয় বন্ধু রকিব আর ফিরবে না আড্ডায় - আসহাদুজ্জামান মিলন

রবীন জাকারিয়া

২১ জানুয়ারি, ২০২৩ , ২:৫৪ অপরাহ্ণ

হাবিব মানেই বন্ধু নয়

প্রথম অধ্যায়

আমাদের স্কুলটা ছিল বেশ বড়ো৷ বিরাট খেলার মাঠ৷ বড়ো বড়ো ক্লাশরুম৷ চারিদিকে ফলের গাছ আর একদিকে একটা বিশাল পাইকর গাছ৷ এত বড়ো যে প্রায় পুরো মাঠটাকেই যেন ছায়ায় আচ্ছাদিত করেছে৷ কোনো সীমানা প্রাচীর নেই৷ সরকারি বাদে এতদাঞ্চলে যেহেতু বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয় আর নেই তাই বহু দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসে৷ আমার বাসাটা স্কুল সংলগ্ন এবং সত্যি বলতে কি আমার আর্থিক ও সামাজিক অবস্থাও অনেক সমৃদ্ধ৷ তাই কোনো সমস্যা হয়নি৷ কিন্ত ঐসব ছাত্রদের বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা ছাত্রদের কষ্টটা বেশ চোখে পড়ে৷ সেই সকালে কিছু খেয়ে পায়ে হেঁটে স্কুলে আসা৷ বিকেল অবধি না খেয়ে আবার বাড়ি ফেরা চাট্টিখানি কথা নয়৷ শিক্ষার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ ছাড়া এটা অসম্ভব৷

তখনও শিক্ষার্থী তথা শিশুদের মধ্যে সামাজিক-আর্থিক বিভাজন রচিত হয়নি বলেই হয়তো আমাদের মতো সমাজের সুবিধাভোগী শিক্ষার্থীরা একই স্কুলে এবং একই সাথে পাঠগ্রহণ করেছি৷

তবে যতই সাম্যর কথা বলি না কেন! পরিবার, পোষাক-পরিচ্ছদ, জীবনাচার এমনিতেই বিভাজন টেনে দেয় কিংবা বলা যায় শিক্ষকরাই ইনিয়ে বিনিয়ে তা অন্যদের বুঝিয়ে দেয়, “এরা তোদের প্রভু আর তোরা এদের ভৃত্য”৷

আমি খুব ডানপিটে আর মিশুক ছিলাম৷ তাই আমার বন্ধুও ছিল বেশি৷ অবশ্য ছাত্র হিসেবেও ভালো ছিলাম৷ তবে একজন ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু৷ ওর নাম হাবিব৷ যদিও হাবিব অর্থ বন্ধু৷

হাবিবের সাথে আমার বন্ধুত্বটা কিন্ত শত্রুতা দিয়ে শুরু৷ সেদিন স্কুলের পাশের বাড়ির গাছ থেকে আম চুরির প্ল্যান করছিলাম৷ চুরির সময় কে কী দায়িত্ব পালন করবে সেটা বোঝাচ্ছিলাম৷ সকলে রাজী৷ কিন্ত হাবিব বাধা দিলো৷ অন্যদেরকেও নিষেধ করল যেন এ সমস্ত অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকে৷ ওর কথা শুনে প্রচণ্ড রেগে গেলাম৷ আজ পর্যন্ত কেউ আমার কথার অবাধ্য হয়নি৷ যা বলেছি তাই শুনতে বাধ্য হয়েছে৷ আমি হলাম দলনেতা৷ অথচ এই মলিন পোষাকে আচ্ছাদিত এক গেঁয়ো ছেলে আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছে? নিজের সামন্তবাদী কুৎসিত চেহারা বেরিয়ে পড়ল৷ রাগে-অপমানে অন্ধ হয়ে ওকে ভীষণভাবে মারলাম৷ ওর নাক ফেটে রক্ত ঝরছে৷ এটা দেখে ভয় পেয়ে গেলাম৷ তাড়াতাড়ি ‘ফার্স্ট এইড’ বক্স নিয়ে এসে সকলে মিলে সেবা-শুশ্রূষা করলাম৷ সেদিন টিফিন পিরিয়ডটা এভাবেই কেটে গেল৷ আমার একদিকে প্রচণ্ড ভয় আর অন্যদিকে অপরাধবোধ জাগ্রত হলো৷

দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম ক্লাশেই শ্রেণি শিক্ষক হাবিবকে প্রশ্ন কলেন কী করে হলো? সে বললো টিউবয়েলের হ্যান্ডেল লেগে ব্যাথা পেয়েছে৷ ওর উত্তরে আমি নীরবেই কেঁদে ফেললাম৷ ছুটির পর ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম ‘সরি’৷

এরপর থেকে ওর প্রতি একটা আলাদা ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা কাজ করত৷ ক্রমে ক্রমে তা ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে রূপ নেয়৷

টিফিন পিরিয়ডে আমি বাড়িতে ভাত খেয়ে আসি৷ ওকে বহুবার চেষ্টা করেও খাওয়াতে পারিনি৷ কেননা ওর আত্মমর্যাদা ছিল প্রখর৷ নিজের সীমাবদ্ধতাকে সে মিথ্যার চাদরে না ঢেকে বরং বীরের মতো গ্রহণ করেছে৷

এর কিছুদিন পর অষ্টম শ্রেণির রেজাল্ট প্রকাশ হলো৷ সবাইকে ডিঙিয়ে হাবিব প্রথম হলো আর আমি দ্বিতীয়৷ এই প্রথমবার আমি ক্লাশ পরীক্ষায় প্রথম হতে পারলাম না৷ নবম শ্রেণিতে যথারীতি বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম৷ হাবিবও তাই৷ বাহিরে যতই গভীর বন্ধুত্ব থাকনা কেন ভেতরে ভেতরে চলতে থাকল ওর সাথে আমার তীব্র প্রতিযোগিতা৷ কে কাকে ছেড়ে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করে৷ আমাদের স্কুলের বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিগুলো ছিল খুবই সমৃদ্ধ এবং বিশাল৷ তাই সেখানে গবেষণা করতে সমস্যা হতো না৷ মনে পরে বায়োলজির স্যার ব্যাঙের এনাটমি করার পর যখন আবার ব্যাঙের পেট সেলাই করে ছেড়ে দিত৷ তখন নিজেকে ডাক্তার ডাক্তার মনে হতো৷ অবসরে নিজে একাই ল্যাবরেটরিতে ব্যাঙের বক্ষচ্ছেদ করতাম৷ এত প্রাচুর্য, বিলাসিতা, সুবিধা পাওয়ার পরও সত্য বলতে কি আমি কখনোই হাবিবকে টপকাতে পারিনি৷ দ্বিতীয় হয়েই থাকতে হয়েছে৷

মেট্রিক পরীক্ষায় হাবিব পাঁচটি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ বোর্ডে ষষ্ঠ স্টান্ড করেছিল আর আমি চারটি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ অষ্টম৷

এরপর দু’জনে ভিন্ন ভিন্ন কলেজে ভর্তি হই৷ সম্ভবত এখানেই সূচনা হয় বিত্ত দিয়ে মানুষে মানুষে বিভাজন৷ এরপর ধীরে ধীরে হাবিবের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়৷ তখনতো মুঠোফোন ছিল না!

দ্বিতীয় অধ্যায়

বায়োগ্রাফি:-

বায়োগ্রাফি আমার পরিবার: আমার পিতা কলেজ ছাত্রাবস্থায় আওয়ামী ছাত্রলীগ করতেন৷ তাই ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন৷ ৭০’র নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সকল স্বাধীনতাকামী মানুষের মতো আওয়ামী লীগের পক্ষে, স্বাধীকারের পক্ষে কাজ করেন৷ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর নিজেকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন এবং গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন৷ প্রশিক্ষণের সার্টিফিকেট পাবার পর তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য তৈরি হন৷ এমতাবস্থায় আমার দাদা তাঁর পরিবারের সকলকে নিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন৷ যুদ্ধ শেষ হলে তাঁরা পুনরায় দেশে ফিরে আসেন৷

স্বাধীন দেশে নতুন কাঠামো, নতুন স্বপ্ন আর জীবন-জীবিকাকে নব উদ্যমে ঢেলে সাজাবার অবিরাম যাত্রা—বন্ধুর পথ—যেতে হবে বহুদূর৷ পাশাপাশি দেশের বীর সন্তানদের—যাঁদের আত্মত্যাগে আজ এই স্বাধীনতা৷ তাঁদেরকে দেওয়া হলো বীরত্বের সনদ৷ বাবার যেহেতু প্রশিক্ষণের সনদ ছিল তাই তিনি পেয়ে গেলেন “বীর মুক্তিযোদ্ধার সনদ”৷

এই একটি সনদ একটি পরিবারকে কীভাবে সম্মানিত করে, কীভাবে বদলিয়ে দিতে জীবন-জীবিকা৷ তা শুধু আমরাই জানি৷ এই সনদের জন্য বাবা সরকারি চাকুরি পেলেন৷ আমরা কোটা পেলাম৷ সেই কোটায় ভালো স্কুল/কলেজ পেলাম৷ সরকারি চাকুরি পেলাম৷ মাসিক মাসোহারাসহ বিশেষ উৎসব ভাতা পেলাম৷ আমাদের সন্তানেরা দাদার সনদের দাপটে ভালো স্কুল/কলেজ পেলো৷ সরকারি চাকুরিতে কোটা পেল৷ আমার মা আমৃত্যু মাসোহারা পাচ্ছেন৷ আরো কত কী!

বায়োগ্রাফি হাবিবের পরিবার: হাবিবের বাবা বামপন্থী রাজনীতিক ছিলেন৷ ডাকসাইটে না হলেও নিবেদিত কর্মী ছিলেন৷ তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের জীবনকে পণ্য হিসেবে গণ্য করে পুঁজিবাদের এই নোংরা খেলা একদিন শেষ হবে৷ ভোগবাদী আর বিলাসী জীবনের মোহ ত্যাগ করে মানুষ একদিন ঠিকই উপলদ্ধি করবে শাশ্বত সত্য৷ বিশেষ করে প্রলেতারিয়েত বা মজদুর শ্রেণি৷ একদিন যখন দেখবে তাদের হাড্ডিচর্মসার দেহটা বাদে আর অবশিষ্ট নেই কিছুই৷ সেদিন বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী৷ মানুষ নিশ্চয়ই রচিত করবে এক সাম্যবাদী সমাজ৷

তিনি জানেন পাকিস্তানের দুই অংশের এ লড়াই হলো পুঁজিবাদের নোংরা কৌশল৷ মানুষের মর্যাদা, সমাজ, সম্পদ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সাধারণ মানুষের কোনো প্রবেশাধিকার না থাকা৷ তথা  চাপিয়ে দেওয়া এক অসম যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মাধ্যমে জনগণের অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে জনতার বিপ্লব৷

তাই তিনি বসে থাকেননি৷ শুধু নিজে একাই নয় বরং সমমনা ব্যক্তিদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন৷ জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছেন৷ তিনি কোন সেক্টর কমান্ডার কী বলেছেন এটা না জেনে বরং “হয় স্বাধীনতা আনবো কিংবা জীবন দেবো” এই মন্ত্রে দীক্ষা লাভ করে যুদ্ধ করেছেন৷ দেশ স্বাধীন হলে তিনি নিজের সংসার, আয়-রোজগার এসব বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন৷ কোনো সনদ পাবেন এমন চিন্তাই তাঁর ছিল না৷ বরং তাঁর রাজনৈতিক জীবনে পৈতৃকভাবে প্রাপ্ত সম্পদ জনকল্যাণমূলক কাজে দান করেন৷

তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ছিলেন জাসদের আব্দুল জলিল৷ ১৯৮১ সালে যখন উনি সমাজতন্ত্রিক দর্শন ছেড়ে ইসলামী দর্শনে বিশ্বাসী হন৷ তিনিও ইসলামী মূল্যবোধে আকৃষ্ট হন এবং আরো বেশি বেশি জনহিতকর কাজ করতে থাকেন৷ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ইয়াতীমখানা ইত্যাদি৷ এমনিভাবে একদিন তাঁর নিজের সম্পদ প্রায় শেষ হয়ে গেল৷ উপায়ান্তর না পেয়ে ঐ মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে আমৃত্যু চাকরি করেন৷ সেই সামান্য রোজগারে সন্তানদের মানুষ করেন৷ আর হাবিবদের হার না মানার জীবন সংগ্রাম শিখিয়ে দেন৷

তৃতীয় অধ্যায়

আমি এখন সচিবালয়ে কর্মরত আছি৷ ঢাকাতেই সেটলড৷ বাবা মারা গেছেন৷ মা আমার সাথে থাকেন না৷ তবে ঢাকাতেই থাকেন৷ আলাদা ফ্ল্যাটে৷ মুক্তিযোদ্ধার কোটায় মা একটা ফ্ল্যাট পেয়েছেন৷ বাবার মাসোহারাটা মা তোলেন৷ বেশ ভালোই আছেন৷ তাছাড়া এখনকার বৌমারা শাশুড়ির যে যত্ন নেয় তারচেয়ে সামর্থ থাকলে আলাদা থাকাই ভালো৷ অবশ্য মাসে মাসে আমি টাকা পাঠাই৷ ঢাকায় বর্তমানে আমার ১৪টি বাসা আছে৷ বিভিন্ন শপিং মলে গোটা দশেক দোকান আছে৷ এছাড়া আমাদের এক ছেলে৷ সে সস্ত্রীক থাকে আমেরিকায়৷ আর মেয়ে স্বামীসহ থাকে কানাডায়৷ মাশাআল্লাহ্ ওখানেও দুটি করে চারটি বাড়ি করেছি৷ রিটায়ারমেন্টের আর বছর তিনেক বাকি৷ ভাবছি অবসরের পর প্রবাসেই বাকী জীবন কাটাব৷

হয়তো মন সায় দেবে না৷ তবুও এদেশে কি আর থাকা যায়? মানুষ এত সহিংস আর অসৎ হয়ে গেছে ভাবতেই খারাপ লাগে!

পেপার খুললেই খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, দুর্নীতি ভাল্লাগে? ক’দিন আগে দেখলাম ওয়াসার এমডি’র নাকি বিদেশে ১৪টি বাড়ি৷ ভাবা যায়! এত অসৎ হয় কী করে মানুষ? আরে বাবা চুরিরওতো একটা লিমিট আছে!

আজ ব্যক্তিগত বিশেষ একটা কাজে রংপুরে যাচ্ছি৷ ঢাকা এয়ারপোর্টে বসে আছি তো আছি! বিমান লেট৷ ডমেস্টিক বিমান৷ ৫০ মিনিটের পথ৷ তোর আবার কীসের লেট? রাবিশ! দেশটা শেষ করে দিলো কিছু অসভ্যরা৷ এদের না আছে কমিটমেন্ট, না আছে দেশপ্রেম৷

অবশেষে দু’ঘন্টা পর সৈয়দপুরে নামলাম৷ গেট পেরিয়ে সামনে ট্যাক্সি, উবার খোঁজ করেও ব্যর্থ হলাম৷ গাড়ি না আনতে বলাটা ভুলই করেছি৷ একটা মাইক্রো পেলাম৷ এসি নেই৷ গাদাগাদি মানুষ৷ ১২জন না হলে ছাড়বে না৷ জনপ্রতি ৫০০/- টাকা৷ আরে ব্যাটা এই খোঁয়াড়ে ১২ জন বসবে কোথায়? নাহ্ দেশটা শেষ হয়ে গেল৷ সবাই ধান্ধাবাজ!

ঠিক করলাম এভাবে যেতে পারব না৷ তারচেয়ে একটা অটোরিক্সা রিজার্ভ করলে তো হাওয়া খেতে খেতে যাওয়া যায়! এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে বেড়িয়ে একটা টিস্টলে এককাপ চা আর সিগারেট খেতে খেতে অটোরিক্সা রিজার্ভ করে রওয়ানা দিলাম৷ লাগেজ তেমন কিছু নেই একটা একটা ট্রলি ব্যাগ আর এটাচি৷ মাঝবয়সি অটোচালক যাত্রা শুরু করলো৷ চারিদিক থেকে হাওয়া যেন ক্লান্ত শরীর মনকে শীতল করে দিলো৷ ঘুম ঘুম ভাব আসছে৷ দূর করার জন্য চালকের সাথে গল্প করতে চেষ্টা করলাম৷ কিন্ত চালক বেশ স্মার্ট উত্তরে আমাকে আশাহত করল৷ সে বলল আমরা হাইওয়ে পথ চলছি তাই কথা বলে আমার এটেইনশন নষ্ট করবেন না দয়া করে৷ অগত্যা চুপ করে গেলাম৷

এক-দেড় ঘন্টা পর আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছে অটো বিদায় দিলাম৷ প্রচন্ড ক্লান্তির কারণে রুমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে একটা লম্বা ঘুম দিলাম৷

ঘুম ভাঙল বিকেলে৷ সতেজ শরীরে এক কাপ ব্ল্যাক কফি আর একটা লেক্সাস বিস্কুটে বিকেলের নাস্তা সারলাম৷ ঠোঁটে একটা সিগারেট লাগিয়ে ডেস্কে বসে পড়লাম৷ যে জন্য আসা এখন সেই কাজটা শেষ করতে হবে৷ বেডের পাশে গেলাম এটাচীটা আনতে৷ কিন্ত একী! এটাচী কোথায়? মাথা ঘুরতে লাগল! ভয়ানক বিপদ৷ সর্বনাশ হয়ে যাবে! নিজের চাকরির৷ ক্যারিয়ারের৷ এ টাকা দিতে হবে মন্ত্রীর শ্যালককে৷ বিশাল এমাউন্টের একটি ঠিকাদারি কাজের ৩%৷ অর্থাৎ কয়েক কোটি টাকা৷ যা ঐ এটাচিতে আছে৷ এখন কী হবে? ঐ হারামজাদা অটোচালক চুরি করেছে৷ ওকে এখন কোথায় পাব? তাছাড়া এটা পুলিশকে জানানো যাবে না৷ এটা অবৈধ টাকা৷ মাথা আউলায় যাচ্ছে! বমি বমি লাগছে! আচ্ছা আমার কি হার্ট এটাক করছে? আমি কি মরে যাচ্ছি? হায় আল্লাহ্ আমি এত অসৎ কাজ, অপরাধ করে শেষে জাহান্নামী হয়ে মরছি! এত সম্পদ, এত টাকা কিছুইতো কাজে লাগবে না৷ হে আল্লাহ্ তুমি মাফ করো৷ সেই ছেলেবেলায় শেখা দু’চারটি সুরা যেগুলো এখনো মুখস্থ আছে কাঁদতে কাঁদতে সেগুলোই পড়তে থাকলাম৷

দরজায় কলিং বেলের অনবরত কর্কশ শব্দে সম্বিত ফিরে পেলাম৷ দরজা খুললাম৷ দেখলাম এক মলিন অথচ দৃঢ়চেতা অপরিচিত ব্যক্তি দাঁড়িয়ে৷ কর্কশ গলায় বললাম কী চাই? সাহায্য-টাহায্য হবে না যান৷ ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি দিয়ে বলল-

আপনি কি আকবর সাহেব? আপনি কি আজ সৈয়দপুর থেকে এসেছেন? আপনি কি কোনো কিছু হারিয়ে ফেলেছেন?

সম্মতি সূচক মাথা নাড়া দেখে বলল,  তাহলে এই নিন বলে এটাচিটা আমার হাতে তুলে দিলো৷ আমি স্তম্ভিত! মুখ দিয়ে কিছু বেরুচ্ছিল না৷ অবশেষে সম্বিত ফিরে পেয়ে বললাম, তুমি কি জানো এতে কী আছে?

সে বলল জানার ইচ্ছে না থাকার পরও শুধু ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে দেখেছি “প্রচুর টাকা” আর জীবন বৃত্তান্ত৷

এতো টাকা নিলেনা কেন?

উত্তরে বলল, কিছু মানুষের জন্ম হয়েছে শুধু নেওয়ার জন্য আর কিছু মানুষের দেবার জন্য, আমি দ্বিতীয় দলের।

কিছু মনে কোরো না তুমি কি একটু ভেতরে আসবে? সে ঢুকলে তাকে জোর করে বসালাম৷ তার ব্যক্তিত্ব, দৃঢ়চেতা আর সততার জন্য নিজে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়েও এই প্রথম একজন অতি সাধারণ মানুষ যে কিনা একটা সামান্য অটোচালক তাকে অনেকটা অনুনয়ের সুরে বললাম, তোমার সততার জন্য আমি পুরষ্কৃত করতে চাই৷ তুমি নিলে খুব খুশি হবো৷ তাছাড়া তোমার পরিবার, ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য কাজে লাগবে৷ সে প্রচণ্ডভাবে রেগে গেল৷ তারপর যা বলল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না৷

শুনুন মি. আকবর শিক্ষা আপনাদের আলোকিত না করে বরং নির্লজ্জ বানিয়েছে৷ আপনারা মানুষকে আন্ডারমাইন্ড করেন৷

আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার যোগ্যতা পরিমাপ না করে তাকে ভিক্ষুক মনে করছেন? আমার অটোটা আপনার বাবা কিনে দেয়নি যে তাকে তুমি সম্বোধন করবেন৷

দেশটা আপনার বাবার তালুক নয় আপনারা ইচ্ছেমতো বেচে দেবেন৷ আর পরিবারের এবং সন্তানের কথা বললেন না? আপনার জ্ঞাতার্থে বলছি আমাদের ছেলে বুয়েট থেকে পাশ করে এখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার৷ আমাদের মেয়ে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার৷ আর আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি বোটানিতে মাস্টার্স করে আপনাদের মত ঘুষখোর লোকদের চাহিদা মেটাতে পারেনি বলে চাকরি পায়নি৷

আমার বাবা দেশের জন্য যুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনেছিল৷ অথচ তাকে মরতে হয়েছে কীভাবে জানেন? তাঁকে জঙ্গী বানিয়ে হত্যা করে গুম করা হয়েছে৷ কী আজব তাই না? এখানে কার্ল মার্কসের নামে রাজনীতি করা যায়৷ এখানে মাও সেতুং, আব্রাহাম লিংকন, মুজিব, জিয়া, এরশাদ এমনকি মওদুদীর আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করা যাবে৷ যাবে না শুধু মুহাম্মদের নামে৷ আমার বাবা যখন সমাজতন্ত্র করেছে তা করেছে তৎকালীন তার বিশ্বাস থেকে৷ আবার যখন ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য সাংবিধানিক অধিকার বলে ইসলামী দল করেছে তখন পরিপূর্ণ ইসলামী মূল্যবোধ থেকেই৷ অথচ যে কি না জঙ্গীবাদ কিংবা রাজাকারদের ঘৃণা করত তাকেই মরতে হলো জঙ্গীর তকমা নিয়ে৷ একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সনদ৷

আমি বললাম যদি সত্যিই তোমার সন্তানেরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে থাকে তাহলে তুমি এখনো অটো চালাও কেন? এতে তোমার সন্তান ডিগনিটি নষ্ট হচ্ছে না?

সে উত্তরে বললো, না আমাদের সন্তানদের আমরা সেভাবেই তৈরি করেছি৷ তারা প্রথমে মানুষ হয়েছে৷ তারপর ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার৷ ওরা ওদের কলিগসহ মিডিয়াতেও দৃঢ়ভাবে বলতে পারে আমাদের বাবা অটোচালক৷ কারণ এটা আমার আইডেনটিটি৷ আপনারা ইউরোপ-আমেরিকার সমাজের কথা বলেন না! তারা তাদের আইডেনটিটি অস্বীকার করে না৷ যাহোক আপনি ভালো থাকুন৷ ধন্যবাদ৷ বলে লোকটি চলে যাচ্ছিল৷ হঠাৎ কী মনে করে গেটের কাছে একটু দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে রহস্যভরা হাসি দিয়ে বলল আকবর তুমি জীবনে কোনোদিনই আমাকে টপকাতে পারলে না৷ আমি হাবিব৷ গুড বাই৷

আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলতে চাচ্ছিলাম হাবিব আমার শৈশবের হাবিব৷ আমার প্রিয় বন্ধু৷

ও হাতটা তুলে আমাকে থামিয়ে দিলো৷ বলল যারা শিক্ষিত হয়েও নিজের সততা নষ্ট করে, যারা সেবা প্রদানকারীর দায়িত্ব পেয়ে গণমানুষের অধিকার লুন্ঠন করে, যারা এত রক্তের বিনিময়ের অর্জিত স্বাধীনতার চেতনা বিকিয়ে দেয় ক’আনা পয়সায় তারা কখনোই কারো বন্ধু হতে না৷

আর মনে রাখবেন হাবিব মানেই বন্ধু নয়৷

হাবিব মানেই বন্ধু নয় - রবীন জাকারিয়া

মুগ্ধতা.কম

২১ জানুয়ারি, ২০২৩ , ২:৫৩ অপরাহ্ণ

মজনুর রহমান

২১ জানুয়ারি, ২০২৩ , ২:৫৩ অপরাহ্ণ

বন্ধু বিষয়ক

বন্ধু-১

কোনো বিপ্লব চাইনি। শুধু সামান্য বিদ্রোহ ঠেকাতে চেয়েছি জীবনে। এরকম ছোটোখাটো যুদ্ধ-টুদ্ধ করতে করতে নানান উঠোন পেরিয়ে কাদের জানি বাড়ির কাছে গিয়ে পড়ি।

জামরুল গাছের নিচে আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। হাত ধরে বললেন, চলেন বটতলায় যাই। তখন দুপুরবেলা। মেঘ ও রোদ পরস্পরের সাথে খেলা করছিল। আমরা ছায়া আর বৃষ্টির যুগপৎ সম্ভাবনা নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইলাম।

বন্ধু-২

একটা নার্সিং হোমে শুয়ে তোমাদের কথা ভাবি।পৃথিবীর সমস্ত পাখি কি মরে গেছে গতকাল পর্যন্ত? কেবল একাকী একটা সারস জানালার পাশের গাছে বসে। প্রত্যেক পাখির ডানার নিচে কয়েকটা হারিয়ে যাওয়া দিন লুকোনো থাকে। সেইসব মৃত পাখির সাথে মরে যায় সেইসব দিন। তারপর অন্যদের অসুখ হলে তারা নার্সিং হোমে যায়। বসে থাকে জানালার পাশে। শুশ্রূষা পাবার বদলে তারা একা হয়ে থাকে?

একটা নার্সিং হোমে শুয়ে তোমাদের কথা ভাবি। মনে হয় পৃথিবীর বুকে আর কোনো নার্সিং হোম নেই।

বন্ধু-৩

আমাদের ঘনিষ্টতার ফাঁক দিয়ে দূরত্ব উঁকি মেরে নেয়

বন্ধু বিষয়ক

জাকির আহমদ

২১ জানুয়ারি, ২০২৩ , ২:৪০ অপরাহ্ণ

বন্ধু

আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু কাল (২০০৪) সকালে রংপুর ছেড়ে যাবে! ভুল বললাম, ও আসলে শুধু রংপুর নয় দেশটাই ছেড়ে যাবে!! অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিলাম, ঠিক আড্ডা নয়-পাশাপাশি বসে থাকা। স্মৃতি নিয়ে কথা বলা। তার সাথেতো অনেক স্মৃতি! টানা৭২ ঘন্টা কিংবা তারও বেশি সময় একসাথে থাকা, ফুটপাতে রাত কাটানো, সেতারা হোটেলে দিনেরপর দিন ভাত খাওয়া, কবিতা-উপন্যাস-নাটক লেখা, বই প্রকাশ, প্রেম-ভালোবাসা কতোকিছুর স্মৃতি!

সকালে তাকে বিদায় জানাতে ঢাকা কোচ স্টান্ডে যাবো-এমন কথা হয়ে বিদায় নিয়ে রুমে ফিরে আসি।
ওর বিদায়টা মানতে পারছিলাম না। ও না থাকলে আমি কিভাবে কী করবো!? টেনশনে আমি অস্থির। কিছুই ভাবতে পারছিলাম না।

সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গে, মোবাইলফোনে তখন রিং হচ্ছিলো, রিসিভ করেই ওর গলা শুনতে পাই-‘কিরে শেষ সময়ে তোর সাতে দেখা হবে না?’

-আমি আসছি, বলেই ফোন রেখে দৌড়।

শেষ পর্যন্ত ওর সাথে চোখাচোখি হয়েছিল, কথা হয়নি।

পরে দেখেছি মোবাইল ফোনে অনেকগুলো মিসকল!

স্মৃতিকথা - বন্ধু - জাকির আহমদ

সোহানুর রহমান শাহীন

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:২৩ অপরাহ্ণ

সাইকেল

মানুষ পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখেন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হবার পর থেকে। সে আলো গায়ে মেখে মেখে বেড়ে ওঠা শুরু হয়। সেই শুরু থেকে বাস্তবচিত্র ধারণ করে মনের ভিতর, মস্তিস্কে। তাকে কেউ কেউ স্মরণ করতে পারে আবার কেউ কেউ ভুলে যায় অনায়াসে। কেউ কেউ সময়ের হাত ধরে বদলাতে বদলাতে পূর্ব স্মৃতি মনে করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকেন। যাদের মনের মধ্যে কৃপণতা থাকে না মাঝে মাঝে তারাই স্মৃতির থলি হাতড়ায়। বের করে আনে কৈশর-শৈশব-যৌবনের বারো ভাজার খবর। বিশেষ করে শৈশবের জংধরা তালা খুলে যৌবনে হাজির করার মানুষের সংখ্যাও অনেক আছে। তবে শৈশবের চাবি হারানো তালায় তেল-মবিল না দিয়েই অনায়াসে তালা খুলে স্মৃতি মেলে ধরার দায় পড়েছে আমার। যেহেতু কিছু না হলেও শৈশব ফিরে পাবো সেই আশায়।

আমার শৈশবের স্মৃতির মধ্যে বাইসাইকেল চালানো শেখার কথা মনে পড়ে বারবার, কারণ হিসেবে এটা বলা যায় যে, বাইসাইকেল বহালতবিয়তে বিচরণ করছে কিশোর থেকে শুরু করে আশি বছর বয়সের বৃদ্ধর কাছে।

একটা সময় বাইসাইকেল চালানোর শখ মাথায় নিয়ে ঘুরছিলাম আর সব সময় ভাবছিলাম দুই চাকায় সাইকেল চলে! অনেকে আবার হাত ছেড়ে দিয়ে সাইকেল চালায় আবার লাফিয়ে লাফিয়ে সাইকেলে ওঠে, এটাও সম্ভব! তবে একটি মাত্র চাকা দিয়ে যে সাইকেল চালানো সম্ভব তা সার্কাস খেলা না দেখলে বিশ্বাস হবে না। পরে অবশ্য বিভিন্ন ইলেকট্রনিক চ্যানেলের মাধ্যমে টিভির পর্দায় দেখানো হয়েছে এক চাকার সাইকেল খেলা।

আমাদের বাসায় সাইকেল ছিল না, পরিচিত তেমন কেউ নেই যাদের কাছে সাইকেল চালানোর জন্য চেয়ে পাওয়া যাবে। আবার দুয়েকজন আছেন যারা আমাকে সাইকেল চালাতে দিতে রাজি নয়। আমি ছোট ছেলে, যদি সাইকেল চালাতে গিয়ে আমার কোনো ক্ষতি হয়ে যায়। বিমুখ হয়ে যাই পরিচিতজনের কাছে গিয়ে, আবার আবদার করি, আবার ফিরিয়ে দেন তারা। তবে কি সাইকেল চালানো শেখা হবেনা! মনে বল রেখে চেষ্টা চালাতে থাকি, হাল ছেড়ে দেবার মতো ছেলে আমি নই, সে বিশ্বাস আছে নিজের উপর।

আমাদের পাড়ায় অনেক ছেলেদের দেখা যায় তারা ছোট ছোট সাইকেল চালায় দলবেঁধে, অথচ তাদের নিজেদের সাইকেল নেই, সেটা আমি ভালো করে জানি। তাদের কাছেও চেয়েছিলাম সেই ছোট বাইসাইকেল চালানোর জন্য। তারা ভাড়ায় সাইকেল এনেছে বলে আমাকে চালাতে দিতে রাজি নয়। অনেকটা অবাক হয়ে গিয়েছি, ভাড়াতেও সাইকেল পাওয়া যায়! অনেক ভাবনার পর এক পর্যায়ে ভাড়ার সাইকেল দিয়ে বাইসাইকেল চালানো শেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের পাশের বাড়ির সমবয়সী জাকির, পাপ্পু সিরাজ রেজ্জাককে ধরে ভাড়ায় সাইকেল এনে দিতে রাজি করাই, তবে জুড়ে দেয় শর্ত। তাদের শর্ত হলো- প্রতি ঘণ্টারসাইকেল  ভাড়া তিনটাকা, তারা ভাড়ায় সাইকেল এনে দিবে কিন্তু এজন্য আমার টাকায় তাদের একঘণ্টা সাইকেল চালাতে দিতে হবে। আমি তাতেই রাজি হয়ে যাই।
যাহোক আমার বাসায় রাখা টাকা জমানোর মাটির ব্যাংক সবার অগোচরে ভেঙে টাকা নিয়ে তাদের সাথে ভাড়ায় সাইকেল নিতে যাই। রংপুর স্টেশন রোডস্থ ঘোড়াপীর মাজারের কাছে  গোলাম রসুলের সাইকেল গ্যারেজে। গোলাম রসুল দীর্ঘদিন থেকে সাইকেল ভাড়া দিয়ে আমার মতো বয়সের ছেলেদের কাছ থেকে অনেক সুনাম কুড়িয়েছেন, কারণ তিনি সবাইকে বিশ্বাস করে ভাড়ার বিনিময়ে সাইকেল চালাতে দেন। ছিপছিপে গড়নের লম্বা আর পান খেকো মানুষ গোলাম রসুল। দ্বৈত মেজাজের মানুষ। কারো সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলেন, কারো সঙ্গে দেখান নমনীয়তা। তিনিই রংপরে প্রথম ভাড়ায় চালিত সাইকেলের ব্যবসায়ী।

যা হোক সব শর্ত মেনে নিয়ে তিন ঘণ্টার জন্য সাইকেল আনা হলো। তাদের ভাগে যে একঘণ্টা দিতে চেয়েছিলাম সেটা তারা আগে চালিয়ে সাইকেল আমার হাতে তুলে দেয়। মহা আনন্দে সাইকেল হাতে নিয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাবার উপক্রম। কিন্তু প্রথমেই সাইকেলের চাকার দিকে চোখ যেতেই হতবাক! সামনের চাকা ছোট আর পিছনের চাকা সাইজে বেশ বড়, এই চাকা ছোটবড় হলে কোন্ ধরণের ক্ষতি হয় তা আমার জানা নেই। মরিচার প্রলেপে রিং দুটো অনেক মোটা আর বেশ ওজনদার মনে হয়েছে। সাইকেলের বেল তো দূরের কথা বিভিন্ন জায়গায় ওয়েল্ডিং করা হ্যান্ডেলের কানে ব্রেকের বার ও ব্রেক সু কিছুই নেই। যে কারণে ব্রেক ধরে সাইকেল থামানোর কোনো ব্যাবস্থা থাকবার কথা নয়। এবার সাইকেলের হ্যান্ডেল দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরে বিশাল এক মাঠের মাঝখানে নিয়ে তার উপর উঠতে চেষ্টা শুরু করি, এক সময় উপরে উঠে দু’পা মাটিতে স্পর্শ করে হাঁটতে থাকি, মাঝে মাঝে প্যাডেলে পা-দুখানা তুলে দেবার বৃথাচেষ্টা। আবার চেষ্টা- আবার চেষ্টা। এভাবে কিছুক্ষণ ব্যর্থ হবার পর আমাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে পাপ্পু। সাইকেলের পিছন দিকে ধরে আমাকে সাইকেল চালানো শিখতে সাহায্য করে। তার সহযোগিতা নিয়ে সিটে বসে যে বিড়ম্বনা আমাকে গ্রাস করে তা হলো- কাঠ দিয়ে তৈরি ফাটল ধরা ড্রাইভিং সিটের চিপায় আটকে চিমটি কাটতে থাকে প্যান্ট এবং… তবুও চিনচিনে ব্যথা নিয়ে প্যাডেল ঘুরাতে থাকি।
থাকি। পাপ্পু বেশ কিছুক্ষণ সাইকেল ধরে রাখার পর হাত ছেড়ে দেয়, আমি পড়ে যাবো এমন মুহূর্তে আবার ধরে রাখে, এমন ধরা ছাড়ার মধ্যে এক সময় ছেলেটি সাইকেলের পিছন থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে পিছু হটে। কাঁপাকাঁপা হাত, পায়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চালাতে থাকি সাধের বাইসাইকেল আর নান্টু ঘটক সিনেমার সেই আলোচিত গান ‘চলে আমার সাইকেল হাওয়ার বেগে উইড়া উইড়া, ঢাকা শহর দেখবো আজ দুইজনে ঘুইরা ঘুইরা, ও-হ-ও… পাবলিক ভাই সাইকেলের ব্রেক নাই’..

গানটি শেষ হতে না হতেই একদল কুকুরের আবির্ভাব হলো আমার সাইকেলের সামনে, কূল রাখি না মান রাখি অবস্থা শুরু হয়। কুকুরের গ্রুপটি দু দলে বিভক্ত হয়ে তুমুল সংঘর্ষে জড়িয়ে পরে আমার সাইকেলের সামনে, অবস্থার বেগতিক দেখে জোড়ে জোড়ে প্যাডেল চালানোর বৃথা চেষ্টায় এক সময় মুখ থুবড়ে মাটিতে পতিত হই সাইকেল সমেত। লজ্জা ও ভয় নিয়ে কোনোরকম উঠে গা থেকে ধূলা ঝাড়ছিলাম আর এদিক সেদিক তাকাচ্ছিলাম কেউ আবার দেখে ফেলে নাকি। ধুলির সাথে সব লজ্জা আর ভয়কে ঝেড়ে আবার সাইকেলে চেপে বসে চালানো শুরু করি। 

এভাবে চালাতে চালাতে সারা মাঠ ঘুরছি আর ঘুরছি। মনে হয়-‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।’ গানের সাথে চলতে থাকে আমার হাওয়াই সাইকেল। অনেক্ষণ চালানোর পর সাইকেল থেকে নামব মনে করে গতি কমাতে থাকি, কিন্তু বিধিবাম! সাইকেলে তো ব্রেকই নেই! নামতে পারি না সাইকেল থেকে, কেনো নামতে পারিনা-কিভাবে নামতে হয় তা তো জানি না। সাইকেল থেকে নামার ভাবনায় আবারো হাত কাঁপতে শুরু হয়। হাত যখন কাঁপছেই কী আর করার, আবার চালাতে শুরু করি। কিন্তু নামতে যে হবে আমাকে, পিছন ফিরে দেখি আমার স্বজনরা কেউ নেই। মহাবিপদেও চালাই সাইকেল। এক সময় মাথায় হঠাৎ বুদ্ধির উদয় হয়, যেই বুদ্ধি সেই কাজ। মাঠের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের কাছে গিয়ে সাইকেলসহ গা ঘেঁষে নামতে হবে। আর সেখানেই ঘটে আর এক বিড়ম্বনা- সাথে সাথে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে পড়ে যাই মাটিতে, তখন আমার টাকায় ভাড়া করা বাইসাইকেলটি আমারই গায়ের উপর অবস্থান করছিল। সাইকেলের নিচে থেকেও বুঝতে পারছিলাম প্যাডেলের মাথায় পা লেগে বেশ অনেক খানি জায়গা কেটে গিয়েছে। রক্ত ঝরছে কেটে যাওয়া স্থান থেকে। আঘাতের চোটে  কিছুক্ষণ পর দেখি কোত্থেকে যেন দৌড়ে এলো বন্ধুরা, তারা সাইকেলের রাহুগ্রাস থেকে আমাকে মুক্ত করে, দুজন আমার দুহাত তাদের কাধের উপর নিয়ে গাছের ছায়ায় বসায়। ক্ষতস্থানে দুর্বাঘাস চিবিয়ে লাগিয়ে দেয়। সেখানে কিছুক্ষণ চিকিৎসার পর আমাদের বাসার অদূরে রেখে তারা ভাড়ার সাইকেল নিয়ে চলে যায়। আহত আমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাসায় যাই। পরে অনেকগুলো মিথ্যা কথা বলে সে যাত্রায় বাবার কাছ থেকে রক্ষা পেলেও মা ঘটনাটি বুঝতে পেরে অনেক শাসিয়েছিল এবং সাধারণ ক্ষমা করে সাবধান করে দিয়েছিলেন। এতো কিছুর পরও মাঝে মাঝে ভাড়ার সাইকেল চালিয়ে বাইসাইকেল চালানো শিখেছিলাম আমি…

সাইকেল - সোহানুর রহমান শাহীন

মাসুম মোরশেদ

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:২৩ অপরাহ্ণ

আমার ছেলেবেলা 

ছোটবেলা মানে কী?

– সারাদিন মার্বেল খেলা।

হ্যাঁ, আমার ছেলেবেলা ছিল মার্বেলময়।

ছালেক মার্কেট থেকে কেনা লন্ড্রা ইংলিশ হাফপ্যান্ট। তার ডানে-বামে ইয়াবড় পকেট।হাঁটলে ঝুনঝুন করে মার্বেল বাজে। বেল্ট ছিল না। কালো শিঁকাই (মোটা কালো সুতা) কোমরে থাকতো। তাতে প্যান্ট আটকাতাম।দৌড়ালে দু’হাত প্যান্টের দু’পকেট ঢুকিয়ে চেপে ধরে দম বন্ধ করে দৌড়াতাম। তারপরও কখনও প্যান্ট খুলে মাটিতে পড়তো মার্বেলের ভারে। দ্রুত এদিক-সেদিক চেয়ে ফিক করে হেসে কায়দা করে সেটি তুলে আবার দৌড়।

খেলায় হাত চালু ছিল। ব্রেন ছিল সার্প। খুব কৌশলী ছিলাম। ফলে কেউ পারতো না।  সেরা ছিলাম। তখনই বুঝেছিলাম, হাত নয় মাথা দিয়ে খেলতে হয়।

সারাদিন খেলতাম। নাওয়া-খাওয়া ভুলে শুধু মার্বেল আর মার্বেল। মার্বেলের টোক্কা, টাকুর, ইঞ্চি, টু-টাচ, হাফবেল, পুট, গাঁড়া কতশত যে খেলা!

সারাদিন খেলি। লাভ করি প্রচুর। একটা দুটো করে সারাদিনে ত্রিশ চল্লিশ বা তারও বেশি। টাকায় দশটি মার্বেল পাওয়া যেত। বিক্রি করি তৎক্ষণাৎ। দিনে দুই-চারটাকা অনায়াসে লাভ হতো। তা দিয়ে মুড়ি, চানাচুর কিনে খেতাম। বেশি লাভ হলে পাড়ার মোড়ে গণি মিয়ার হোটেলের পরোটা। হেব্বি জমত সেদিন।

দোয়ানী বিড়ির খোলান, ডাড়ার পাড়, গাবার ছমছলের বিশালখুলিবাড়ি, নয়ার দিঘির পাড়, ময়জার খুলি পাড়ার সর্বত্র-পাড়াময় আমি আর মার্বেল। 
জাপানি, চায়নিজ, জলজলিয়া বেলজিয়াম মার্বেল। ছোট মার্বেলকে বলতাম বিচ্ছু মার্বেল। নিয়মিত ছোটদের সাথে, বড়দের সাথে খেলেছিলাম।

যেদিন সোনার চাঁদ বিড়ির কাজ বন্ধ সেদিন ধুমসে খেলা। দোয়ানীটারির অনেকেই তখন সোনার চাঁদ বিড়ির কারিগর। আমি আজিজ (ভরসা) বিড়ির কারিগর। আজিজ বিড়ির কাজ বন্ধ থাকে শুক্রবার। সেদিন পাড়া জুড়ে ছোটদের মার্বেল খেলা, মাটিতে দাগ টেনে ছক্কা খেলা কিংবা বোর্ডের সাপ-লুডুতে বাজি আর বড়দের মধ্যে যারা উঠতি বয়সের তারা তাস পিটায়।
টাকার খেলা। বাজি। জুয়া।
মধ্য বয়সীরা স্প্রেটট্রাম আর মুরুব্বীরা মেরিস টুয়েন্টি নাইন।

শুক্রবার যেন চাঁদরাত। সারাসপ্তাহ টাকা-পয়সা জমায় সবাই মার্বেল, ছক্কা, তাস খেলার জন্য।

আমরা ছোটরা সবাই প্রতিদিন স্কুলে যাই। কিন্তু পড়াশোনা করি না। নিয়মিত স্যারদের বেতের মার খাই, কানমলা খাই-খুব ভাল লাগে। বরং স্যারের মার না খেলে ভাল লাগে না। আর পড়াশোনা করে শুধু লিটন, মেহেদী, রানারা। আমি পরীক্ষার আগের রাত ভোর পর্যন্ত পড়ে পগারপাড়।

মার্বেল খেলায় আমার সমকক্ষ মাত্র একজন ছিল পাড়ায়। একসাথে পড়তামও। ফিরোজ কবির ভুট্টু। ভুট্টু নামে সবাই ডাকি। সেয়ানা প্লেয়ার! ধূর্ত!

লেখাপড়ায় সে ডাব্বা খেত। ভুট্টু ছিল বাপের একছেলে, ডানপিটে। সে ফুটবলেও চৌকষ ছিল। ফলে তার নামডাক ছিল বেশ। আমিও ফুটবল খেলতাম। গোলকিপার। তবে চলনসই।

কতশত কথা মনে পড়ছে, সেসব দিন যদি আবার ফিরে পেতাম!

আমার ছেলেবেলা - মাসুম মোরশেদ

প্রমথ রায়

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:২৩ অপরাহ্ণ

আমার এলেবেলে শৈশব

আমার শৈশবের কথা বলতে গেলে প্রথমে মনে পড়ে কোনো কালবৈশাখি ঝড়ে আমি আমার মায়ের কোলে মানুষের ঘরের পিছনের চালার নিচে। আমরা অতি দরিদ্র হওয়ায় আমাদের খড়ের ঘর দিয়ে বৃষ্টির জল পড়ত ও খুটি নড়বড়ে হওয়ায় যেকোনো সময় ঘর উড়ে যেতে পারে। গিয়েছিলোও দুবার। ছোটোবেলায় ঝড় আসলেই আমি খাটের নিচে লুকাতাম যাতে ঘর পড়লেও কিছুটা নিরাপদ থাকা যায়। শৈশবের বৃষ্টিতে আমার অনেক স্মৃতি। এই বৃষ্টির দিনে ভিজতে ভিজতে আমার সাঁতার শিখি। সাঁতার শিখতে গিয়ে পুকুরের জল গিয়ে মায়ের কাছে মাইর খাই। আমি কখনো মাছ মারতে পারতাম না। এক বৃষ্টির দিনে দুটি রুই মাছসহ অনেক মাছ পেলাম। বর্ষাকালে আমরা বন্ধুরা মিলে কলার গাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে বৃষ্টির পানিতে ভেসে বেড়াতাম। খুব ছোটোবেলায় আমাদের ছাতা ছিলো না। মানকচু বা কলার পাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতাম। কখনো কখনো প্লাস্টিকের বস্তা উল্টিয়ে মাথায় দিতাম। পরে আসলো বাঁশ পাতা দিয়ে বাঁশের তৈরি ছাতা।

আমরা শৈশবে বন্ধুরা মিলে কলার পাতা দিয়ে ঘর বানাতাম। আবার কখনো কখনো মাটি দিয়ে পাকা ঘর বানাতাম আর রাজমিস্ত্রি হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। আবার কখনো বন্ধুরা মিলে পরিকল্পনা করতাম কেউ হব বাসের ড্রাইভার, কেউ হেল্পার, কেউ কন্ডাক্টর।

আমাদের খুব শৈশবের খেলা ছিলো কাঠাল পাতা দিয়ে নইয়া খেলা। পরে ম্যাচের প্যাকেট দিয়ে খেলতাম। পরে মার্বেল ও পয়সা খেলা শুরু করলাম। একবার কয়েকজন মিলে একটি ফুটবল কিনলাম। পরে ঝগড়া লেগে সে বল কেটে ফেলে ফুটবল খেলার ইতি টালাম। ক্রিকেট খেলতে খেলতে যুবক হয়ে গেলাম।

আমাদের শৈশবে টিভি নাই বললেই চলে। আমাদের পাড়ায় একজন রিকন্ডিশন্ড টিভি কিনল। প্রতি শুক্রবার বিকাল ৩ টায় বিটিভিতে বাংলা ছায়াছবি দেখার জন্য আমরা পাড়া থেকে পাড়ায় ঘুরতাম। তখন জনপ্রিয় সিরিয়াল ছিলো, আলিবাবা চল্লিশ চোর, সিন্দাবাদ, আলিফ লায়লা, ভারতীয় জয় হনুমান। এগুলো দেখার জন্য রাতে রাতে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরতাম।

শৈশবে আমার ফল চুরির করার অভিজ্ঞতা ছিলো না। আমাদের পাড়ায় এক ছেলে গরুর রাখাল হয়ে কাজ করতে এল। সে আমাদেরকে নিয়ে টিম বানাল এবং আমরা রাতে মানুষের ফলমূল চুরি করা শুরু করলাম। মানুষ ধান কেটে জমিতে শুকোতে দেয়, সেগুলো দিয়ে ভাপা পিঠা খেতাম। আমাদের এই দলটি যাত্রাগান দেখা ও ভিসিআর দেখায় ছিলাম নিয়মিত। এগুলোতে চলতো জুয়া খেলা। আমিও খেলতাম। বেশ লাভও করেছিলাম। 

খুব শৈশবে আমরা সুপারির খোলোস দিয়ে গাড়ি টানতাম। পরে বাঁশের মুড়া গোল করে চাকা বানিয়ে গাড়ি চালাতাম। এরপর ভ্যানের বিয়ারিং দিয়ে গাড়ি বানিয়ে চালাতাম। আমি মানুষের সাইকেল দিয়ে একাই একাই সাইকেল চালানো শিখি। প্রথমে ফ্রকের ভিতরে পা ঢুকিয়ে,  যেটাকে বলে ‘হাফ প্যাডেল’। পরে আস্তে আস্তে সিটে চড়ে। সিটে চড়ে চালাতে গিয়ে আমি দুবার এক্সিডেন্ট করি। গিয়ারের কাটা পায়ে ঢুকে যায়।

আমার শৈশবে আমার বাবা একবার একটা রিকন্ডিশন্ড রেডিও কিনেছিল। তখনও টিভি আসেনি।  তাই রেডিওটি আমাদের পরিবারে বেশ সমীহ ছিল। একদিন এটা আমি নস্ট করে ফেললাম। এটার জন্য আমার বাবা আমাকে মারতে উদ্যোত হওয়ার আমি দিলাম দৌড়। আমার বাবাও আমার পিছু পিছু দৌড়ায়। ঐদিন দেখেছি বাবার রাগ।

আমরা পড়াশুনা করেছি কেরোসিনের ল্যাম্প দিয়ে। পরে পেয়েছি হারিকেন। আমার পড়াশোনা শুরু খ্রিষ্টান মিশনারি পরিচালিত ফিডার স্কুলে। বাঁশের টংয়ে বসে মদনমোহন তর্কালংকার রচিত গোলাপি রংয়ের ‘প্রভাতি’ বই পড়তাম। পরে পড়লাম গণ সংগঠন স্কুলে। এখানে পড়েছি মাদুরে বসে। ভালো ছাত্র হওয়ায় দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে দূরের একটি সংগঠন স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করে দিলো। দূরে হওয়ায় এক সপ্তাহ স্কুলে গিয়ে আর গেলাম না। তারপর দুএকটি স্কুল ঘুরে চতুর্থ শ্রেণি না পড়ে ঐ বছরে বাড়ির কাছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। এ স্কুলে আবার শিক্ষকের পাকা চুল তুলে দিতে হতো। এতগুলো ক্লাস ডিঙিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে সবগুলো বিষয়ে ফেল করলাম। ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমি এতটাই বোকা ছিলাম, স্কুল পালিয়ে আসতে গিয়ে আমার বই রেখে অন্যের বই নিয়ে আসতাম। পরে বই ফেরত দিতে গিয়ে স্যারের কাছে মার খেতাম। পরীক্ষায় নকল আনতে গিয়ে স্যারের সামনে ধরা পড়তাম। পরে ষষ্ঠ শ্রেণিতে সবগুলো বিষয়ে ফেল করে দিনাজপুরে খ্রিস্টান বোর্ডিং এ পড়তে গেলাম। ওখানে আবার আমার বন্ধু তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ায় আমাকেও তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করাল। বোর্ডিং এ আবার খাওয়াতো গমের ভাত, যা আমার একদম সহ্য হয় না। ফেব্রুয়ারি মাসে ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসে আর গেলাম না। আমার বাবা রাগ হয়ে আমার পড়াশুনা বন্ধ করতে চাইল। আমি নিজে আর এক গণসংঠন বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেলাম। আমাকে আর পিছু ফিরতে হয়নি। আমি সামনের দিকে এগুতে থাকলাম আর আমার শৈশবগুলো হারিয়ে কৈশোর,  যৌবন ও ত্রিশোর্ধে পৌঁছে গেছে।

আমার এলেবেলে শৈশব - প্রমথ রায়

মুগ্ধতা.কম

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:২২ অপরাহ্ণ

শান্ত কিন্তু দুষ্টমির শৈশব 

এক. কানে ছোলা বুট ঢুকানো:

আমাদের অনেকের জীবনের শৈশবটা দুষ্টুমিতে ভরা। আমার শৈশব কেটেছে অতি শান্ত ভদ্র ছেলে হিসেবে। আব্বা ছিলো অনেক রাগী। তখন আমরা দুই বোন আর আমি। তাই ভিতরে ভিতরে দুষ্ট মিষ্ট ভরা থাকলেও প্রকাশ হতো না বললেই চলে। আমার বয়স তখন তিন কিংবা চার। রমজান মাসের ইফতারে প্রতিদিন থাকত ছোলা। একদিন আমার মেজ বোন আর আমি শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছোলা ঢুকানোর খেলায় মেতে ছিলাম। 

আমার বোন কানে ঢুকিয়ে বের করতে পারলেও আমি পারলাম না। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে। ছোলা কানের পানি পেয়ে বড় হওয়ায় আর বের করতে পারছিলাম না। কানে ব্যাথা-বেদনা শুরু হওয়ায় বাবা-মাকে জানাতে বাধ্য হলাম। বাবা মায়ের টেনশনে সেকি অবস্থা। কানে বেশ কিছুক্ষণ ঢুকে থাকার কারণে কানের ভিতরে ধীরে ধীরে ফুলে আরো বড় হয়ে উঠেছিলো ছোলা। ব্যথাও বাড়ছিল।  অনেক চেষ্টার পরও বের করতে পারায় হাসপাতালে নিয়ে অজ্ঞান করে ছোলা বের করেছিলো ডাক্তার। সামান্য বড় হয়ে শুনেছিলাম সেই তুলকালাম ঘটনা। আশ্চর্য বিষয় হলো আমার ছেলে এইরকমই ঘটনা ঘটালো। তবে আমার মতো ছোলা ঢুকায়নি। কানে ঢুকিয়েছিলো একটি পুথি। ভয় উৎকন্ঠা নিয়ে চিমটা দিয়ে বের করতে সক্ষম হয়েছি। ছেলে ফারিহান খুব সামান্যই ব্যাথা পেয়েছে। মহান আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছেন বড় দূর্ঘটনা থেকে। আলহামদুলিল্লাহ। 

দুই. হারিয়ে যাওয়ার গল্প:

এবার বলি শৈশবে আমার হারিয়ে যাওয়ার গল্প। আমার বয়স তখন দুই কি তিন। আমরা সবে মাত্র তাজহাটের বাসায় উঠেছি। একদিন এক লোকের পিছনে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুদূর চলে গিয়েছিলাম। তখন এলাকায় বাড়িঘর ছিলো খুবই কম। আমাকে এক মহিলা পেয়ে চিনে ফেলে এবং বাসায় পৌঁছে দেয়। আব্বা নাকি শার্ট প্যান্ট পড়ে মোটরসাইকেল বের করছিল আমাকে খোঁজার উদ্দেশ্যে। তাতেই বোঝা যাচ্ছিল আমাকে হারানো নিয়ে বাসায় বেশ হৈচৈ হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার মেয়েও ছোট বেলায় এভাবেই হারিয়ে গিয়েছিল।  হয়তো পৃথিবীতে কিছু ঘটনা এভাবেই ঘুরে ফিরে আসে। আমাদের মেয়ে আসফি হারিয়ে যাওয়ার সময় বয়স ছিলো দুই/তিন বছর। তখন শাড়ি পড়া মহিলা দেখলেই তাকে মা করে ডাকত। যেমন আসফির মায়ের স্কুলের সব ম্যাডামসহ তার নানি, খালাকেও মা বলেই ডাকত। যদিও সেই মা ডাকা অতি অল্পদিন স্থায়ী ছিল।

একদিন বাসায় আসা এক শাড়ি পড়া মহিলার পিছে পিছে আসফি অনেক দূর পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। সেই মহিলা অবশ্য খেয়ালই করেনি। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর সেই মহিলাকে হারিয়ে ফেলে আসফি। একা হয়ে যাওয়ায় এক বাসার সামনে কান্না করতে থাকে। কান্না করার সময় সেই বাসার এক মহিলা সেটা খেয়াল করে, আর বুঝতে পারে এটা মিলন ভাইয়ের মেয়ে। দ্রুততার সাথে সেই বাড়ির বউ মা আমাদের বাসায় দিয়ে যায়। মজার ব্যপার হচ্ছে আমি যখন ছোট বেলায় হারিয়ে গিয়েছিলাম। আমি যখন হারিয়ে গিয়েছিলাম তখন সেই বাড়ির বউ আমাকে একই ভাবে পেয়ে আমাকে বাসায় দিয়ে গিয়েছিল। আমার মেয়েকে বাড়িতে পৌঁছে দেয় সেই বউ এর ছেলের বউ।
আরও কাকতালীয় ঘটনা হলো আসফির মাও হারিয়ে গিয়েছিল ছোট বেলায়। তবে আসফির মায়ের হারিয়ে যাওয়ার গল্প অনেক বেদনাময়। আসফির মায়ের নামটা জানিয়ে রাখলে গল্প বলতে সুবিধা হবে। নাম সুচনা। সুচনার বয়স তখন দুই আড়াই বছর হবে। ওরা তখন নাটোর জেলায় পুলিশ কোয়ার্টারে থাকত। একদিন সুচনারা নানা ওদের বাসায় বেড়াতে এসেছিল। কয়েকদিন থাকার পর সকালের দিকে কুড়িগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সবারই মন খারাপ সুচনার মা তার বাবাকে বিদায় দিয়ে সুচনার ছোট বোনকে নিয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে। আর এদিকে সুচনা নানার পিছু নেয়। কিন্তু নানা খেয়াল করে না। একসময় কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে যায় সে। পাহারারত সিপাইও খেয়াল করে না।
একা একা এক কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে গ্রামে ঢুকে যায়। এক স্কুল ছাত্র তাকে রাস্তায় কান্না করতে দেখে জিজ্ঞেস করেও বাবা মায়ের নাম বলতে পারে না। সে সুচনাকে বাসায় নিয়ে যায়। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল শুরু হয়। এক মেয়ে পাওয়া গেছে এই খবর আসে পাশে ছড়িয়ে যায়।
সেই গ্রামে পুলিশের এক কনস্টেবল  দুপুরে খেতে এসেছিলেন বাসায়। তার কানেও চলে আসে খবরটা। তিনি দ্রুত যান সেই ছেলের বাসায়। থানায় হৈ চৈ উঠেছে দারোগা স্যারের মেয়ে হারিয়েছে।
তিনি সুচনাকে দেখেই চিনতে পারেন যে এটি ফজল দারোগার মেয়ে। আমার শশুরের বাবার নাম আবুল ফজল।সেই কনস্টেবল সাথে সাথে তার স্যারের মেয়েকে নিয়ে কোয়ার্টারে বুঝিয়ে দেয়। এদিকে বড় মেয়েকে অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে আসফির নানি অজ্ঞান প্রায়। সেই কনস্টেবল বড় মেয়ে সুচনাকে বুঝিয়ে দিয়ে আরেক নতুন পৃথিবী ফিরে পেয়েছিল ওরা। আরও অতি আশ্চর্যজনক হলো আমাদের ছেলেও ছোট বেলায় হারিয়ে গিয়েছিল। ওদের মা ও খালার সাথে মার্কেটে শপিং করার সময় হঠাৎ খুঁজে পাচ্ছিল না ফারিহানকে। আশেপাশে খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেল এক লোকের কোলে। এভাবে শৈশব গুলো আনন্দ বেদনার মিশ্রিত হয়ে বেড়ে উঠি আমরা। বড় হলেই শৈশবের ঘটনাগুলো দিয়ে গল্প তৈরি হয়।

শান্ত কিন্তু দুষ্টমির শৈশব - আসহাদুজ্জামান মিলন

মুগ্ধতা.কম

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:২২ অপরাহ্ণ

শৈশবের স্মৃতি

আমার সোনার হরিণ চাই, আমার সোনার হরিণ চাই, হ্যাঁ সেই সোনার হরিণ আমার আনন্দের শৈশব, স্নেহ-মমতা ও পবিত্রতার অনাবিল প্রশান্তির ক্ষণ ক্ষণ প্রতিটা ক্ষণের নিশ্চিন্ত মাধুর্যময় সময়। আহ্ যদি চাইলেই পেতাম, হাত বাড়ালেই ফিরে আসতো, তবে কেমন হতো, বলো তো? বলছি আমি… আসে না ফিরে, যায় যে সময় চলে তাই তো স্মৃতিতে ভরে থাকে বুক, চোখে থাকে শৈশবের কত না অভিজ্ঞতার সাধের – ভালোবাসার শৈশব।

আসলে এটাই চিরন্তন নিয়ম – সময় নদীর স্রোতের মতো বয়ে যায়, সময় করে না কারো জন্য অপেক্ষা, সময় দিয়ে যায় এক এক ধাপের অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানের ভাণ্ডার আর আমরা এগিয়ে যাই শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রবীণ থেকে বৃদ্ধকালে। জ্ঞান সঞ্চরণে যা পেয়েছি তা থাক নিজের করে, প্রবীণের পথে আরো বেশি অগ্রসর হতে হতে একদিন বিদায়ী ঘন্টা বাজবে তার আগে সুযোগ এল শৈশবের মুঠোবন্দী স্মৃতিচারণে নিজেকে দাঁড় করানো।

আমার শৈশব বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্নের মুখোমুখি ছিল সবসময়ই। তা হলো সবার বাবা আছে আমার কেন বাবা নেই? হ্যাঁ আমার ছোটবেলায় বাবা না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন এই দুঃখটা শত হাসি-আনন্দ, দুষ্টুমীর মধ্যে দিয়েও আমায় একটা সময় একাকিত্বের হৃদয়ে নিশ্চুপ করে রাখত। তবে হ্যাঁ বাবা না থাকলেও আর্থিক কোনো কষ্ট ছিল না, স্বাচ্ছন্দ্যেই মা আমাদের মানুষ করার চেষ্টা করেছেন, বাকিটা আল্লাহর দয়া।

মৃত্যু অবধারিত, চিরন্তন যাত্রাপথ….. তবে আজ প্রবীণতম মানুষের মাপকাঠিতে এসেও মনটা খুঁজে  কোথাও… সেই আপন জনদের কাছে পেলে, কাছে পেলে স্কুলের খেলার সাথী ভুলে যাই বয়স হয়েছে। পেছনে ফিরে যাই সেই সহজ-সরল, অবোধ মধুর শৈশবে। মানুষ যত বড় সফলতা বা পূর্ণতার পথ খুঁজে পাক একটা সময় সে একাকী মুহূর্তে বা নাতি-পুতিনের শৈশবকালে নিজেকে দাঁড় করিয়ে গোপনে অনুভব করে যেন এক তীক্ষ্ণ হাহাকার। ভালোবাসা পেতে চায়, সেই যে বাবা- মা, পরিবারের সকলের স্নেহ মমতায় নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চায়। দেবার কিচ্ছু থাকে না তখন, থাকে শুধু নেবার সমস্ত হিসাব-নিকাশের উর্ধ্বে প্রাপ্তি আর প্রাপ্তি।

আজ আমার বসত একদম একাকী, নিঃসঙ্গ নীরবতায় ঢেকে থাকে জীবনের আঙ্গিনা তাই আমি বারবার ফিরে যাই আমার ছোট্ট বেলায়…..ছোট্ট মেয়ে, মা- বোনদের আদরে আদরে দিন কেটে যাওয়া যদিও একটি ভাই আমার সাত বছরের ছোট কিন্তু হলে হবে কী, আমারি আহ্লাদী বেশি, প্রাপ্তিও বেশি। বাড়ির গল্প বাকি থাক। বন্ধু মহলেও কি যে পবিত্র আর নিগূঢ় ভালোবাসার বন্ধন গড়ে ওঠে তা বলার অবকাশ রাখে না। জীবন বৈচিত্র্যময়তায় আর যাই হোক শৈশবের সম্পর্ক আর স্মৃতিতে কোনো নেতিবাচক জিজ্ঞাসার প্রশ্ন থাকে না, থাকে না স্বার্থপরতা আর কুটিল মনোভাব। বলি তবে ছোট্ট একটি ঘটনা – আমি ছোট্ট বেলায় পড়তাম পুলিশ লাইন প্রাইমারি স্কুলে ছেলে – মেয়ে একত্রে। টিচাররা ছিল দারুণ রাগী। আমরা দুটো মেয়ে আর তিনটে ছেলে ছিলাম ভীষণ বন্ধু আর বাকি সকলের সঙ্গেই ছিল সুসম্পর্ক মানে দারুণ সুন্দর মেলবন্ধন। আমরা একসঙ্গে খেলতাম, এমনকি রান্নাপাটি এবাড়ি, ওবাড়ি ইট দিয়ে ভাগ করে আলাদা চিহ্ন নির্ধারণ করতাম। ক্লাশে একদিন ইতিহাস স্যার একই সঙ্গে ৫ কি ৬ পাতা পড়া মুখস্ত করতে দিয়েছিল। আমরা বারণ করলেও স্যার টেবিলে লম্বা চিকন কঞ্চি  দিয়ে একটা জোড়ে শব্দ করে – কালকেই পড়া চাই বলে চলে গেল। সাব্বির ছিল প্রথম, মমিন দ্বিতীয় আর আমি তৃতীয়, বরাবরই এমনই রেজাল্ট। কখনো কখনো মমিন আর আমার মধ্যে পাল্টাপাল্টি হতো রেজাল্ট। সাব্বির ছিল একটু প্রতিবন্ধী মানে একটি পা ছোট তাই স্বাভাবিক হাঁটাচলা ছিল না কিন্তু সেটা আমাদের সম্পর্কে কোনোই বাঁধা ছিল না। আমরা সকলে ওকে খুব ভালোবাসতাম, সবসময়ই প্রথম হতো। এবার পড়া কী হবে সে প্রসঙ্গ বলি – সকলে ঠিক করলাম কেউ পড়ে আসব না। পরদিন স্যার এলেন, পেছন থেকে পড়া ধরছেন, যেই হৃদয় স্যার পড়া হয় নি বলতেই ওকে বেঞ্চে হাঁটু ভাজ করে ( লিনডাউন যেটাকে বলে৷ ) দাঁড়াতে বলে চেয়ারে বসে বললেন পড়া যাদের হয়েছে তারা বসে থাকো বাকি সকলে বেঞ্চে লিনডাউন হও। আমরা সকলে তাই হলাম। স্যার উঠলেন এখনও শিউরে ওঠে শরীর। পেছন থেকে শুরু করলেন মারা। হাত বাড়িয়ে দিলে তিনি এক এক করে সকলকে সেই চিকন কঞ্চি দিয়ে হাতের তালায় মারা শুরু করলেন। সত্যি বলতে কি এই মার আমি কখনো পাইনি। ছেলেদের প্রথম বেঞ্চ বাকি। মেয়েদের প্রথম বেঞ্চে এলো, আমি কিনারে অন্যপাশ থেকে মারতে মারতে আমার কাছে এলো, সাব্বির, মমিন অন্যরা সকলে তাকিয়ে আছে। আমি হাত বের করলাম কঞ্চির পাঁচটা মার খেলাম জীবনের প্রথম। সকলের হাতে লাল দাগ হয়ে গেছে, চোখে পানি। আমার পাশেই একটু ফাঁক দিয়ে ছেলেদের লাইন শুরু। সবশেষে এলো সাব্বির, সেই বন্ধুটি বেঞ্চের উপরে ওভাবে থাকতেই পারছিল না, খুব কষ্ট হচ্ছিল। ওকে ২ টা মেরেছে তিনবারের পর সাব্বির পড়ে যায়। আমি জবা ছুটে যাই অন্যান্য ছেলেরা ওকে ধরে একটা বেঞ্চে শুইয়ে দেয়। আমরা খুব হৈ-হুল্লোড় শুরু করে দেই, স্যার চলে যান। স্যারদের রুমে ঢুকে আমি হেড স্যারকে বলে পানির গ্লাস আর জগ আনি, মমিন পানি খাইয়ে দেয় সাব্বিরকে অতঃপর আমরা সকলে পানি খাই আর দারুণ হৈচৈ শুরু হয় ক্লাসে। হেড স্যার হৈচৈ শুনে ক্লাসে আসেন। সাব্বিরকে দেখেন আর সবকথা শোনেন। শেষ ক্লাসের ছুটি হলে আমরা সকলে হেড স্যারের রুমে যাই আবারো। স্যার আমাদের দেখে বললেন – তোমরা যাও আমি ব্যাপারটা দেখব। মমিন সাব্বিরকে নিয়ে যায় রিক্সায়, আমরাও চলে যাই বাসায়। পরদিন স্কুল যেতে পারি নি, জ্বর এসেছিল। আগের সময় পুলিশ লাইন স্কুল ছিল দারুণ কড়াকড়ি। তারপর থেকে আর ঐ স্যারকে দেখি নি। ঘটনাটি দুঃখের ছিল কিন্তু আমরাও ঐ চতুর্থ শ্রেণি থেকে সেদিন শিখেছিলাম অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে।

এমনি অনেক ছোট্ট ছোট্ট ঘটনা জড়ানো হাসি আনন্দে ভরা ছিল ভালোলাগার শৈশব। জানি না সেই বন্ধুরা / সহপাঠীরা আজ কোথায় কেমন আছে, কী করছে…….।

আরও কত স্মৃতি….. কিন্তু সকলের লেখার সুযোগ রাখতে হবে তাই এতটুকুতেই থাক স্মৃতি কথা। আজ চোখে পানি আসে সেদিনের কথা মনে করে যে, মা – বাবারা কত দুঃশ্চিন্তা নিয়ে দিন পাড় করে থাকে সন্তানদের নিয়ে, নিজেরা কষ্ট করে আমাদের বড় করেছে।

আজ আমরা প্রবীণ, চারদিকে শুধু কৃত্রিমতা, জীবন কী তা হারে হারে বুঝতে পারছি বলে দুঃশ্চিন্তাহীন-আদর-সোহাগে ভরা শৈশব সামনে এসে দাঁড়ায়। শৈশব তুমি জীবন পাতায় এক স্বর্ণখণ্ড। যা জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে সারাজীবন।

শৈশবের স্মৃতি - হেলেন আরা সিডনী

ডা.ফেরদৌস রহমান পলাশ

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:২২ অপরাহ্ণ

রাধাবল্লভ পাঠশালা

নানাবাড়ি থেকে রাজুর পাঠশালার দূরুত্ব পাঁচ মিনিটের। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাতের বাম বরাবর কিছুদূর গিয়ে ডানে মোচড় নিলেই মোড়, সেই মোড়ে রমজান মামার দোকান। সেখানে বিক্রি হয় বিস্কুট, চকলেটসহ গৃহস্থালি জিনিস। তারপর বামের রাস্তার মোড়ে রাধাবল্লভ পাঠশালা। সকাল হলেই এক ঝক্কিঝামেলা। কিছুতেই স্কুলে যাবে না রাজু। অথচ এমন না যে স্কুলে খুব চাপ, স্যারেরা পড়ো রে বলেই ডুব দেয়। কে কী পড়ল সেসব নিয়ে মাথাব্যথা নাই। তারপরও স্কুল যেতে হবে শুনলেই জ্বর, মাথাব্যথা।

অন্য দিগন্ত পড়া না পারলেও স্কুলকে না নেই। ঠিক নয়টায় হাজির রাজুর নানাবাড়িতে। দিগন্ত আসার পরও বিছানা ছেড়ে উঠতে মন চায় না রাজুর। নানি এসে বলে, ওঠ সোনা, দিগন্ত সেই কখন থেকে বসে আছে, যা পাঠশালায় যা, তোর নানা তোকে চারআনা পয়সা দিবে। পয়সার লোভেই হোক আর দিগন্তের সঙ্গ পাবার আশায়ই হোক রাজু স্কুলে রওনা দেয়। হাফ বিল্ডিং এর এই পাঠশালা শুরু হয় হেডস্যারের হাতের ঘন্টির শব্দে। পড়াশোনা বলতে একটু নামতা পড়া আর টিফিনে চালতা খাওয়া। হজমি খেয়ে পানি খেতে ভালো লাগত বলেই স্কুলকে একদম না বলা হয়নি রাজুর। স্কুলের সামনে রাজবাড়ি। সবাই বলত যাদু মিয়ার বাড়ি। তো সে কোন যাদু তা তো আর জানত না, জানার চেষ্টাও করেনি কখনও তারপরও বাড়িটা টানত তাকে। দিগন্তকে সাথে নিয়ে সুযোগ পেলেই রাজবাড়ির গেটে। বড় লোহার দরজা, সবসময়ই বন্ধ। সেখানে লোকজন থাকত কিন্তু কারা থাকত তা কখনই চোখে পড়েনি,আসলেই চোখে পড়েনি। এই যে কেউ বা কারা সেখানে বাস করে কিন্তু তাদের ঠিক দেখা যায় না, এটাই এক রহস্য মনে হতো। স্কুলের গেটে বিক্রি হতো কাঁচা খেজুর। সেসসবও যে পয়সা দিয়ে কিনে খাওয়া হতো একসময়, এখনকার ছেলেদের বললে বিশ্বাসই করবে না। এখন বার্গার, হটডগের স্বাদ পাওয়া শিশুদের হজমি, কাঁচা খেজুর ভালো লাগবে না এটাই স্বাভাবিক।
আজ টিকা দিতে স্কুলে আসবে সরকারি লোকজন । আগে থেকে বলেনি স্যারেরা, বললে শতকরা  পঞ্চাশজন অনুপস্থিত থাকবে, এটা নিশ্চিত। প্রথম ক্লাস শেষ হয়ে দিগন্ত সবে উঠে দাঁড়িয়েছে বাথরুম করার জন্য। প্রতিটি ক্লাস শেষে দিগন্তের বাথরুমের কথা বলে বাইরে যাওয়া রুটিন। ঠিক তখনি হেডস্যার সাথে স্কুলের অন্য শিক্ষকরা দুম করে ক্লাসরুমে উপস্থিত। জানলার গ্রিল ছিল না, দিগন্ত চট করে জানলা টপকে চলে যাবে বলে আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছিল তখনি দপ্তরি নিখিল দা জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসতে থাকে। পালানোর পথ বন্ধ। বিড়বিড় করে কী যেন বলে লাইনে দাঁড়ায় সে ইশারায় কাছে ডাকে রাজুকেও। চিৎকার করে কান্না করার ইচ্ছেটা ঢোক গিলে দমন করে রাজু। পাশের লাইনে দাঁড়িয়ে লিসা তার দিকে তাকিয়ে আছে চোখ বড়বড় করে, যদিও সে ভয় পেয়েছে বোঝা যায় তারপরও একদম ভেঙে পরেনি বোঝাই যায়। দিগন্ত ফিসফিস করে বলে আজ না আসলেই ভালো হতো, কেন যে আসলাম আর তোকেও নিয়ে আসলাম। ভয় পাস না। একটা পিঁপড়া কামড়ের মতো মনে হবে। এসব আমি জানি। চল আগা। তবুও টিকার সূঁচটার দিকে ঘুরেফিরে চোখ চলে যাচ্ছে।
ঠিকাদারের সামনে যখন সে দাঁড়িয়ে তখন রীতিমতো কাঁপছে রাজু।
তার কাঁপন দেখে হরেন স্যার বললো, আরে গাধা কাঁপিস ক্যান? তোকে পিঁপড়া কখনও কামড়ায় নাই? লিসার টিকা দেওয়া শেষ, সে তাকিয়ে আছে। শত  চেষ্টা করেও কান্নাটা আটকিয়ে রাখা গেল না। ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিলো রাজু। টিকা শেষেও কান্না চলল যতটা না ব্যাথার কারণে তারচেয়েও বেশি লিসার সামনে কেঁদে ফেলার কারণে। বাড়ি ফেরার সারাটা পথ জুড়ে রাজু একটা কথাও বলল না। দিগন্ত লাল আইসক্রিম সাধল হজমি দিয়ে খাওয়ার জন্য, তাও খেল না সে। লিসার সাথে আগামীকাল কেমন করে এ মুখ দেখাবে সে চিন্তাতেই তার মন আরও খারাপ হতে শুরু করল।
লিসা থাকে রংপুর রেডিও সেন্টার স্টাফ কলোনিতে। বাম গালে টোল পড়া লিসার পাশে বসার জন্য ক্লাসের ছেলেদের প্রতিযোগিতা চলে।
দুপুরে রাজুর জ্বর এল শরীর কাঁপিয়ে।  নানি পাউরুটি আর দুধ নিয়ে সাধাসাধি করল বহুক্ষণ কিন্তু একদম খিদে নাই রাজুর। নানি বলত জ্বর আসলে বাঙালিকে খেতে হয় রুটি আর বিহারিদের  ভাত। দিগন্ত বিকালে এসেছিল, বলল মন খারাপ করিস না। কেঁদে ফেলেছিস তো কী হইছে। চল, জিনিস আনছি বলে চোখ টিপে দিলো। ম্যাজিশিয়ানের মতো পকেট থেকে বের করে দেখালো স্টার সিগারেট।
নাহ্ যাব না আজ বাইরে বলেও  কোনও জোরাজুরিই কাজে লাগল না। দিগন্ত প্রায় টেনে নিয়ে গেল বাইরে। নানাবাড়ির পূর্বদিকে লরেন্স ভাইদের বাসা। এখনও কমপ্লিট হয়নি। সেখানে বিকালে কেউ থাকে না, সেইসময় দিগন্ত সেখানে গিয়ে সিগারেটে টান দিয়ে আসে। ইটের উপর বসে দুজনে সিগারেটে টান দেয়। একটু পরই দমকা কাশি আসে রাজুর, চোখে পানি চলে আসে কাশতে-কাশতে। দিগন্ত হাসতে থাকে রাজুর অবস্থা দেখে। নিয়মিত হওয়ার কারণে একটা ভারিক্কি ভাব এসেছে ওর মাঝে। মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, রুনু পিসি হারমোনিয়ামে গলা সাধতে বসেছে। দিগন্তের দিদিমা নিশ্চয়ই এ সময় জ্বালিয়েছে ধূপ। দুজনে বাড়ির দিকে রওনা দেয়, আগামীকাল স্কুলে যেতে হবে। লিসা কী আগামীকাল পাঠশালায় আসবে?

রাধাবল্লভ পাঠশালা

রবীন জাকারিয়া

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:২১ অপরাহ্ণ

বট গাছের ভূত

আমার বাড়ির চারদিকে মোট ছয়টি স্কুল৷ গাদাগাদি৷ ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়৷ ২টি উচ্চ বিদ্যালয়৷ উচ্চ বিদ্যালয় দুটির একটি বয়েজ অন্যটি গার্লস৷ আমার বোধগম্য হয় না যে সরকারের নির্দিষ্ট ক্যাচমেন্ট এলাকার নিয়ম থাকার পরেও এমন গাদাগাদি ছয়টি স্কুল কীভাবে অনুমোদন পেয়েছিল৷ এদেশে সবই সম্ভব৷ 

আমাদের শিক্ষা জীবন শুরু হয় বাড়ির আঙিনায় অবস্থিত মুনসীপাড়া কেরামতিয়া প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ে৷ উপমহাদেশের নামকরা ধর্মপ্রচারক, রাজনীতিক ও পীর সাহেব মাওলানা কেরামত আলী জৌনপুরী ভারত থেকে এদেশে এসেছিলেন ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে৷ তিনি মুনসীপাড়ায় বিয়ে করেন এবং শশুর বাড়িতেই আমৃত্যু অবস্থান করেন৷ মুনসীপাড়া কেরামতিয়া জামে মসজিদ -যেখানে পীর সাহেবের সস্ত্রীক মাজার আছে-সেই কর্তৃপক্ষের অবদানে ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথমে এটি শুরু হয় মাদরাসা শিক্ষা কেন্দ্র দিয়ে৷ পরবর্তীতে এটি প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়৷ তাই তাঁর নামানুসারে স্কুলটির নামকরন করা হয় কেরামতিয়া ৷ আর মসজিদ থেকে স্কুল পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ হয় মাদরাসা রোড৷ শুধু তাই নয় এ স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য যে আবাসন ছিল৷ পরবর্তীতে সেখানেই নারী শিক্ষা উন্নয়নের জন্য নির্মাণ করা হয় মুনসীপাড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়৷ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এ স্কুল দু’টি পরিদর্শন করতে এসেছিলেন৷ কেরামতিয়া স্কুল সেসময় রংপুরের অন্যতম ভালো স্কুলের একটি ছিল৷ উপড়ে টিনের দোচালা পাকা লম্বা কাঠামো৷ প্রতি ক্ল্যাশের জন্য আলাদা আলাদা বড় বড় কক্ষ৷ একাডেমিক ভবন, ল্যাবরেটরি আর প্রধান শিক্ষকের বিল্ডিংটা ছিল ছাদ পেটানো৷ সামনে বিশাল মাঠ৷ চারিদিকে প্রাচীন ফলের গাছ৷ আম৷ জাম৷ লিচু৷ কাঁঠাল৷ কত কি৷ মাঠের দুদিকে দুটি অতি পুরাতন গাছ ছিল৷ একটি পাইকর গাছ কিন্ত সকলে বট গাছ বলত৷ অন্যটি ছিল লম্বা কদম গাছ৷ কদম গাছ এত বড় আর ডালপালা ছড়ায় তা কখনো দেখিনি৷ এ গাছ দুটিকে সকলে ভূতুরে বলত৷ এখানে নাকি ভূত আছে৷ গাছের কোঠরে বিষধর সাপের আবাসস্থল৷ 

কদম গাছটির ঠিক নিচে প্রখ্যাত লেখক, গবেষক ও সমাজ সংস্কারক মৌলভী খেরাজ আলী অত্র এলাকার মানুষের জ্ঞান ও শিক্ষা উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন “খাতুনিয়া সার্কুলেটিং লাইব্রেরি”৷ সে সময় এই লাইব্রেরি সমাজ উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে৷ বিখ্যাত সব লোকেদের আনাগোনা আর মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়৷ এখানে বই পড়তে আসতেন রংপুর মুনসীপাড়ার পুত্রবধু, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির (ঘাদানিক) নেতা শহিদ জননী জাহানারা ইমাম৷

স্কুলের কোনো প্রাচীর নেই৷ পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে পাকা রাস্তা৷ পুরো স্কুরের চারিদিকে প্রশস্ত ড্রেন যেন প্রাচীরের গুরুত্ব কমিয়েছে৷

কেরামতিয়া স্কুলের মাঠ রংপুরের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, নাটক ও খেলাধুলার কেন্দ্রবিন্দু সর্বদা৷ সব সময় মাঠে মানুষের আনাগোনা৷ কেউ খেলছে৷ কেউ নিজের গামছা পেতে রেডিওতে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ কিংবা কোন পথিক গাছের নিচে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে৷ নব উদ্যম তৈরির আশায়৷ প্রচণ্ড গরমকালে রাতের বেলাতেও নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবণিতা মাঠে হাঁটাহাঁটি করে৷

আমরা সব বন্ধু রাতের খাওয়া শেষে মাঠের এককোণে আড্ডা দেই৷ ধুমপান করি৷ কলেজে কোন মেয়ের সাথে ইটিশপিটিশ চলছে৷ কিংবা কাকে ভালো লাগে এইসব৷ চলে রাত ১২-১টা পর্যন্ত৷ স্কুলের নাইট গার্ডের নাম আবুল৷ সে সকলের কাছে পরিচিত আবুল ভাই নামে৷ ভীতু প্রকৃতির মানুষ৷ সহজ-সরল৷ আমরা আড্ডা মারলে সে খুশি হয়৷ গল্প করে৷ তার বেশির ভাগ গল্পই চাপা৷ ভূত-প্রেতের৷ সে বলতে থাকে এই বট গাছে প্রেতাত্মা থাকে৷ তাকে বহুদিন দেখা দিয়েছে৷ কথা বলেছে৷ সে যেন কখনো তার কথার অবাধ্য না হয়৷  কথামতো চললে তাকে সোনার ড্যাগ (হাঁড়ি) দেবে৷ গাছের গোড়ায় শাবল দিয়ে দুই চাপ মাটি তুললেই সে সোনা পাবে৷ আর বেয়াদবি করলে ঘাড় মটকাবে৷ আমি বললাম সোনাগুলো নিচ্ছ না কেন? সে বলল না! লোভ করা যাবে না৷ ও একদিন নিজে থেকেই দেবে৷ সেই আশাতে আছি৷ গাঁজাখুড়ি কাহিনি৷ কিন্ত মুখে বলি না৷ কী দরকার? বরং খুশি রাখলে ওকে দিয়ে সিগারেট আনার কাজটা করানো যায়৷ সেটাই ভাল৷ Win-win conditoin.

পাড়ায় আমাদের Immidiat senior ব্যাচটা খুব ভয়ংকর৷ গুন্ডামি, টেন্ডারবাজি, নেশা করা, মাস্তানিসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যে করে না৷ এদের জন্য প্রায় সময় পাড়ায়-পাড়ায় মারামারি লেগে থাকত৷ বাড়িতে বাড়িতে পুলিশ রেইড করত৷ অগত্যা আমাদেরকেও শহর ছেড়ে পালাতে হতো৷ বিশ্রী৷ কিন্ত কিছু বলা যাবে না৷ ওদের ব্যাচের একটা ভাই ছিল৷ নাম শরিফুল৷ কোরআনে হাফেজ৷ পাড়ার ছোট একটা মসজিদে ইমামতি করায়৷ সময় পেলে শরিফুল ভাই স্বাভাবিকভাবেই ন্যাংটাকালের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবে এটাই নিয়ম৷ কিন্ত ওর বন্ধুরা এতই খারাপ যে কোল্ড ড্রিংকসের নাম করে সুকৌশলে তাকে মদ খাওয়ায় দিত৷ তারপর ওকে একা ছেড়ে দিত৷ মদ খেলে মানুষ গালিগালাজ করে৷ বেশি কথা বলে৷ কিংবা বাড়িতে চলে যায়৷ কিন্ত শরিফুল ভাই মদ খেলে স্কুলে ছাদে কিংবা গাছের ডালে অথবা সারারাত ধরে ড্রেনে পানি ছেঁকত৷ 
প্রতিদিনের মতো সেদিনও আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম মাঠে৷ আবুল ভাই বানানো গল্প বলে যাচ্ছে৷ শুনছি৷ একটা সময় সবাই বাড়ি চলে গেল৷ শুধু আমি, আমার বন্ধু রবু আর আবুল ভাই রয়ে গেলাম৷ বিদ্যুৎ চলে গেছে৷ প্রচণ্ড গরমে ঘুম আসবে না বলে থেকে গেলাম৷ বিদ্যুৎ নেই৷ দোকান পাট বন্ধ৷ অমাবশ্যা কিংবা পূর্ণিমার হিসেব করা হয়নি কখনো৷ কিন্ত আজ খুব অন্ধকার৷ কিছুই দেখা যাচ্ছেনা৷ কোথাও কেউ নেই নেই৷ কখনো ভূত-প্রেত বিশ্বাস করিনি৷ তাই আবুল ভাইয়ের গল্পকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছি৷ কিন্ত এখন ভয় করছে৷ কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়৷ আসলে হবে যেখানে অন্ধকার হয় সেখানে ভূতের ভয়৷ আমি নিশ্চিত মুখে যতই বলি না কেন৷ কোনো বাঁশবাগানে, অশ্বত্থ গাছ, পুরোনো বট গাছের নিচে নিকষ অন্ধকারে ভূতের ভয় পাবে না এমন লোক নেই৷ 
আবুল ভাইকে গল্প থামাতে বললাম রাগী গলায়৷ দূরে বটগাছটার নিচে যে ড্রেন আছে, সেখানে হালকা আলো প্রতিফলন হচ্ছে৷ সবকিছু আবছা আবছা৷ আমরা তিনজন চুপ! তাকিয়ে আছি বট গাছের দিকে৷ দেখলাম ড্রেনের পানি থেকে কী যেন একটা উঠে এল৷ বটগাছটার নিচে দাঁড়াল৷ প্রায় অদৃশ্য মূর্তিটার কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না শুধু উপরের দিকে সাদাটে আভা৷ সেখান থেকে মাঝে মাঝে তারার মতো আলো চমকাচ্ছে৷ মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে৷ হার্ট বিট বেড়ে গেছে৷ কান্না পাচ্ছে৷ কাঁদতে পারছি না৷ অশরীরিটা হঠাৎ জড়ানো কন্ঠে হাঁক দিলো, “আবুল তোরা এদিকে আয়”৷ ভয়ে নিজেদের মুখ চাওয়া-চাউয়ি করলাম৷ আর রক্ষে নেই৷ আবার আদেশ করা হলো, “কি রে এখনো আসলি না যে?”
আবুল ভাই ধপাস করে পড়ে গেল৷ কাঁপতে লাগল৷ মুখে ফ্যানা৷ ওরতো মৃগীরোগ আছে বলে জানতাম না৷ ও মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে৷ লুঙ্গি স্থানচ্যুত৷ ছিঃ নোংরা৷ শরীরটাও ভালো ভাবে পরিষ্কার করে না৷ মায়া লাগছে৷ ভয় লাগছে৷ হঠাৎ মনে হলো এ অবস্থায় মৃগীরোগিকে চামড়া পোড়া বা চামড়ার স্যান্ডেল নাকে শুঁকাতে হয়৷ সবার পায়ে স্পঞ্জ৷ চামড়া নেই৷ স্পঞ্জের স্যান্ডেলই নাকে ধরলাম৷ কিছুক্ষণ পর ও ঠিক হলো৷ বললো তোরা যা৷ দেখা কর৷ বেয়াদবি করিস না৷ ঘাড় মটকাবে৷ আর শোন সাথে লোহা কিংবা দেশলাই রাখ৷ ক্ষতি করতে পারবে না৷ বললাম আমাদের ও দুটোর কোনোটাই নেই৷ তাহলে কী হবে? সে তার গোছা থেকে দুটি চাবি খুলে দুজনের হাতে দিয়ে বললো আল্লাহ্ ভরসা৷

শক্তহাতে চাবি হাতে আধমরা ভয়ে দুজন হাঁটতে থাকলাম অশরীরির দিকে৷ চাবি নিয়ে কেন জানি একটু সাহস পেলাম৷ কিন্ত রবু ভয়ে কাঁপতে থাকায় চাবিটা হারিয়ে ফেলল৷ কাছাকাছি প্রায় এসেছি৷ এমন সময় বন্ধু রবু চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেল৷ কাটা কলাগাছের মতো৷ যেন ধুপ করে পড়ে চুপ৷ লুঙ্গিতে পেচ্ছাব করে দিয়েছে৷ আকারে ছোট্ট বন্ধুটি দিগম্বর হয়ে যেভাবে পড়ে আছে, যেন ছোট খোকা এইমাত্র বিছানায় হিসু করে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ ওর বুকটা নাড়লাম৷ কোনো শব্দ নেই৷ ভয়েই শেষে মরে গেল কি না? আচ্ছা রবুর ঘাড়টা মটকালো না-তো? বুক ঢিপ ঢিপ করছে৷ আয়াতুল কুরশি পড়তে থাকলাম৷ বুকে ফুঁ দিলাম৷  যতটা দূরত্ব রেখে অশরীরির কাছাকাছি যাওয়া যায়৷ অশরীরি বলল, “এত রাতে তোরা এখানে কেন?” কী উত্তর দেব ভাবতেই মাথায় বিদ্যূত খেলে গেল৷ আরেকটু কাছে গেলাম৷ আবছা আলোয় দেখতে পেলাম সাদা লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি খুলে মাথায় বেঁধে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন৷ তার মাথায় বাঁধা পাঞ্জাবির বোতামে হালকা আলোর রিফ্লেকশন তারার মতো জ্বলছে৷ সাহস করে আরো একটু কাছে গিয়ে দেখলাম অশরীরি আর কেউ নয় আমাদের মাতাল শরিফুল ভাই৷

বট গাছের ভূত

মুগ্ধতা.কম

৭ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:০৫ অপরাহ্ণ

শনিবারের চিঠি

‘শনিবারের চিঠি’তে এবার প্রকাশিত হলো ‘চিঠি’ সংখ্যা। পাঠক ও লেখকদের লেখায় সংখ্যাটিতে সাধারণ চিঠি যেমন এসেছে তেমনই এসেছে ঐতিহাসিক চিঠি। আবার নিজের স্মৃতিসঞ্চিত চিঠিও এসেছে একাধিক। সবগুলো চিঠিরই যথাযথ সাহিত্যমূল্য থাকবে এমন দাবি আমরা করছি না, তবে সঞ্চয়মূল্য নিশ্চয়ই আছে ব্যক্তির নিজের কাছে। আসুন উপভোগ করি বিশেষ এই সংখ্যাটি।

আমাদের আগামী সংখ্যার বিষয় হবে ‘শৈশব’। আপনার বা যে কারো শৈশব থেকে তুলে আনুন মজার বা বিষাদের কাহিনি, লিখে পাঠিয়ে দিন নিচের মেইলগুলোর যে কোনো একটিতে।

লেখা পাঠাবেন যে দুটি মেইলে-

mojnurangpur@gmail.com (সম্পাদক)

ahmedaranno16@gmail.com (সহযোগী সম্পাদক)

সাপ্তাহিক সংখ্যা সম্পাদনা: আহমেদ অরণ্য, অলংকরণ: রেদওয়ান শুভ

শনিবারের চিঠি - চিঠি সংখ্যা

ডা.ফেরদৌস রহমান পলাশ

৭ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:০০ অপরাহ্ণ

চিঠি, যুগে যুগে

চিঠির কথা মনে আছে? হলুদ খাম, দুই টাকা। এই তো বিশ -একুশ বছর আগেও খবর নেবার মাধ্যম ছিল এই চিঠি। রংপুর থেকে ঢাকা চিঠি যেতে সময় লাগত প্রায় ৩/৪ দিন, এর মধ্যে সরকারি ছুটির দিন পড়লে আরও একদিন যোগ হতো। টেলিফোন ছিল হাতে গোনা কয়েকজনের বাসায়। এখন প্রতিমুহূর্ত যোগাযোগ মোবাইল বা ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে। সবাই কত কাছের। অথচ আগে কত প্রতীক্ষার ছিল এ চিঠি। খামে কেউ ভরে দিত বকুল ফুল, কেউ বা গোলাপের পাপড়ি। প্রেমিক-প্রেমিকাকে, ভাই-বোনকে, ছেলে-বাবাকে আর সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টাকা চাহিয়া-চিঠি লিখত। দুপুরবেলা হোস্টেলে ছেলে- মেয়েরা অপেক্ষায় থাকত ডাকপিওনের। সে সময় ছিল পত্রমিতালি। একটা হিট সিনেমাও ছিল, হঠাৎ বৃষ্টি। চিঠি নিয়ে রচিত হয়েছে কত গান কবিতা। তেমনি একটা কবিতা, হেলাল হাফিজের-

“এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিও

এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালীর তাল পাখাটা

খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিও।

ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত

ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিও।

কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে

কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে

পত্র দিও, পত্র দিও।”

চিঠি লিখতে ক্লান্তি ছিল না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের । সব মিলিয়ে কয়েক হাজার চিঠি লিখেছিলেন তিনি। এত বেশি চিঠি আর কোনো লেখক- কবি লিখেছিলেন কি না জানি না। তবে একদিনে সবচেয়ে বেশি চিঠি লিখেছিলেন শার্ল বোদলেয়ার৷ তার এসব চিঠি কোনো প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে না, মায়ের কাছে নালিশ করে লেখা হয় এগুলো। চিঠি লিখতে গিয়ে শেষের কয়েকটা চিঠি পোস্ট করার জন্য টাকা না থাকায় বেয়ারিং পোস্ট করেন। সাত নম্বর চিঠি লেখার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সাতদিন শুয়ে থাকেন। 

চিঠি লিখতে চাইলেই যেমন লেখা যায় না, আবার সবাইকে ভালো চিঠি লেখাও হয় না। এ বিষয়ে ইন্দিরা দেবীকে রবীন্দ্রনাথের উক্তিটি উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারলাম না, “যদি কোনো লেখকের সব চেয়ে ভালো লেখা তার চিঠিতেই দেখা দেয় তা হলে এই বুঝতে হবে যে, যাকে চিঠি লেখা হচ্ছে তারও একটি চিঠি লেখাবার ক্ষমতা আছে।”

সৈয়দ শামসুল হকের সাথে যখন আনোয়ারা সৈয়দের বিয়ে হয় তখন সৈয়দ হক মোটামুটি পরিচিত সাহিত্য অঙ্গনে। ছোটগল্পের বই ‘তাস’ পেয়েছে বাংলা একাডেমির পুরস্কার, ১৯৬৬ সালে। অনেকেই মনে করে সৈয়দ হকের সংস্পর্শেই আনোয়ারা ম্যাডামের লেখা শুরু, আসলে তা নয়। আনোয়ারা ম্যাডাম লিখতেন ছেলেবেলা থেকেই, পেয়েছিলেন পুরস্কারও। পরে মেডিকেলে পড়ার ঠ্যালায় লেখালেখি কিছুদিন বন্ধ ছিল। সে সময় তিনি পড়তেন বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস। তাদের পরিচয়, প্রেম কিন্তু বেশ রোমান্টিক। আনোয়ারা ১৯৬০ সালের আগষ্ট মাসের সংখ্যা ‘সচিত্র সন্ধানী’তে পড়েন ছোটগল্প ‘তিন পয়সার জ্যোছনা’, লেখক সৈয়দ শামসুল হক। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে ফেলেন। সিদ্ধান্ত নেন তার বই আরো পড়তে হবে, কিন্তু তার তেমন বই বাজারে পেলেন না। সৈয়দ হক তখন নিয়মিত লিখতেন চিত্রালী পত্রিকায়। সেখান থেকে ঠিকানা জোগাড় করে চিঠি লিখে ফেললেন আগষ্ট মাসের এক তপ্ত দুপুরে। সম্বোধন কী করেছিলেন জানি না তবে বিষয়বস্তু মোটামুটি এরকম-

…..

“আমি মেডিকেলে পড়ি। আপনার লেখা আমার ভালো লেগেছে। সাহিত্যের বই পড়া আমার অভ্যাস,নেশাও বলতে পারেন। নিৎসে, বোদলেয়ার,বুদ্ধদেব বসুর লেখা আমি পড়েছি। রবীন্দ্রনাথের লেখা অতটা পড়া হয় নি তবে পশ্চিমবঙ্গের অনেক লেখকের লেখা পড়েছি এবং এখনো পড়ছি । 

ইতি

আনোয়ারা।

এই চিঠি লেখার দুমাস পর চিঠি এল-

সুচরিতাসু,

আপনার চিঠির উত্তরে একটা চিঠি দিয়েছিলাম। মনে হয় সেটা আপনার হাতে পৌঁছায়নি।সেই জন্য এই দ্বিতীয় চিঠি দিলাম। আপনার চিঠি পেয়ে খুব খুশি হয়েছি। মেডিকেলের ছাত্রছাত্রীরা সাহিত্য নিয়ে এত আগ্রহী জানা ছিল না। আপনি সেই ভুল ভাঙালেন।

চিঠির নিচে ক্যালিগ্রাফির মতো একটা স্বাক্ষর, কিন্তু পড়া যায়: সৈয়দ শামসুল হক। পরবর্তীতে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। 

বুদ্ধদেব গুহের চিঠি নিয়ে বিখ্যাত বই ‘অবরোহী’। দীর্ঘকাল পর অযর্মার (জি, এমনই বিদঘুটে নাম) সাথে  ঝুমরি-তিলাইয়া স্টেশনে দেখা হয়ে যায় তার প্রাক্তন ছাত্রী যোজনগন্ধার। তারপর দুজন দুজনকে লিখে চলে পত্র। ঠিক প্রেমপত্র না, অন্যস্বাদের সেতুবন্ধন।  পত্রে প্রকৃতি, ঈশ্বর বিশ্বাস, আর মানুষ। কত বিচিত্র ধরনের যে মানুষ আছে! একটা মানুষ মরে যায় সাথে নিয়ে যায় একটা গোটা জীবন উপন্যাস। পুরা বইটি চিঠির আদান প্রদান। যদিও বুদ্ধদেব গুহ একে ঠিক উপন্যাস বলতে রাজি না তারপরও বহুল নন্দিত এ উপন্যাস পড়লে আপনি অনুভব করবেন প্রেমের গভীরতা আর পাওনা হিসেবে অনেক অনেক বইয়ের রেফারেন্স, কোটেশন, যা বুদ্ধদেবের বইয়ে সচরাচর থাকেই। বইটি উৎসর্গ করেছেন আমাদের দেশের কবি ও সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিনকে। এটাও একটা ঘটনা বটে। 

‘একাত্তরের চিঠি’ একটু দুর্লভ চিঠির সংকলন। মুক্তিযোদ্ধাদের সেসব চিঠি পড়লে চোখে পানি চলে আসে এখনও। 

তবে ব্যতিক্রম বিনয় মজুমদার। চিঠি নিয়ে হতাশ হয়েই কি না তিনি লিখেছিলেন-

“আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে,

তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে,

চিঠি লিখব না।

আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।“

প্রেমের গভীরতা বোঝাতে একসময় নিজের রক্ত দিয়ে চিঠি লেখার কথাও শোনা যেত তবে সে রক্ত মুরগির বলে প্রেমিকার বাতিল করে দেবারও নজির আছে। 

এখন হয়তো পোস্ট অফিসে চিঠি পোস্ট করা হয় না। সরকারি ডাকঘরগুলো ব্যাংকিং কার্যক্রমে ঝুঁকছে। দাপ্তরিক কিছু কাজে তারা আছে। তবুও চিঠির আদান-প্রদান হয়তো এখনো বন্ধ হয়নি। সুকান্তের সেই বিখ্যাত কবিতা রানার ছুটেছে রানার- হয়তো এযুগে সম্ভব না তবুও চিঠির আদান-প্রদান চলছে, চলবেই। অন্তত এর আবেদনটি অনন্ত। 

চিঠি, যুগে যুগে - ফেরদৌস রহমান পলাশ 

মুগ্ধতা.কম

৭ জানুয়ারি, ২০২৩ , ২:৫৪ অপরাহ্ণ

পুত্রকে লেখা ভূদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠি

[ভূমিকা: চিঠিটি ভূদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলকাতার বাসভবন থেকে

সংগ্রহ করেন অধ্যাপক ও গবেষক শাহজাহান মিয়া। ভূদেব বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের বিক্রমপুরের

সন্তান ছিলেন। ভারত ভাগের আগেই চলে যান কলকাতায়। তাঁর বিভিন্ন লেখা কলকাতার জাতীয়

পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এমন কয়েকটি লেখা পড়ার সুযোগ হয়েছে। কচুরিপানা

নিয়ে  তাঁর একটি গবেষণাপত্রও পড়ার সুযোগ হয়েছিল। তিনি কেমন মানুষ ছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায় পুত্রকে লেখা চিঠি থেকে। পুত্র চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ও একজন গবেষক এবং সরকারি

কর্মকর্তা হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে

২০০৮ সালে সরোজিনী বসু স্বর্ণপদকে ভূষিত করে।]

চিত্ত,

বাংলামতে কাল ছিল আমার ৮২-তম জন্মদিন। ৩রা অগ্রহায়ণ, ইংরেজি মতে জন্ম ছিল পরশু

১৮.১১.৬৭। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো চক্ষে আর দেখিতে পারিব না। কয়েক দিনের মধ্যে আমার

চোখের আলো নিভে যাবে। তাই আজ উইল লিখিয়া যাইতেছি।

মৃত্যু কবে আসিবে জানি না। মৃত্যুকে ভয় করি না। ভয় করি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি পর্বকে। এই

পর্বে কত কি যে ঘটতে পারে ভাবতে গিয়ে অশান্তি বোধ করি। কাল থেকে পায়ের পাতা বেশী

রকম ফুলছে। ইহা কি জীবনের শেষ পর্বের সূচনা?

জীবনে কোন খেদ নাই। কোনদিন কাহারো অনিষ্ট করি নাই। জনগণের সেবা করিতে চেষ্টা

করিয়াছি। এখন কিছুই করিতে পারি না। আমার মরাই ভাল। দীর্ঘকাল যদি ভূগি কোন ঘুমের

অসুধ দিয়া আমাকে মারিয়া ফেলিয়ো।

জীবনে অনাড়ম্বর দরিদ্র ছিলাম। মৃত্যুর পর আমার শবে ফুল সাজাইয়া শব খাটে স্থাপন করিয়া

আমার জীবনের আদর্শ নষ্ট করিও না। একখানা সবচেয়ে কম দামের খাটালিতে আমার শব শ্মশানে

নিয়ে যাবে। সম্ভব হইলে বিদ্যুতের চুল্লীতে আমার দেহ ভষ্ম করিবে। মরার উপরে খাড়ার ঘার মত

শ্মশানে চিতার উপর আমার মাথার খুলি বাঁশের আঘাতে ভাঙ্গিয়া বর্বরতার পরিচয় দিও না।

মনের বাইরে স্বর্গ নাই। আমাকে স্বর্গে পাঠইবার জন্য কোন মন্ত্র পড়িও না। আমার শ্রাদ্ধ করিও

না। তোমার মন খুশীর জন্য সত্য দরিদ্রকে সাহায্য করিতে পার। ব্রহ্মময় জগতে আমি বুদবুদ মাত্র।

মৃত্যুর পর আমি ব্রহ্মে মিশিয়া যাইব। মৃত হিন্দুকে স্বর্গে পাঠাইবার জন্য ব্রাহ্মণ ভোজন করান

হয়। আমি স্বর্গ মানি না। সুতরাং ব্রাহ্মণ ভোজন অনাবশ্যক। আমার মৃত্যুতে যদি আনন্দ

প্রকাশের জন্য ভোজ দিতে চাও আমি কেন তাতে বাধা দিব?

আমার তিনটি বীমা আছে। মৃত্যুর পর তাহা হইতে আনুকে দিবে পাঁচশত টাকা। তাহার

বিবাহে অন্য মেয়েদের মত গয়না ও যৌতুক দিতে পারি নাই।

আজ আমার নাতিনী এগার জন আর নাতি সাত জন। বাকি টাকা হইতে প্রত্যেক মেয়েকে দিবে

পঞ্চাশ টাকা করিয়া। নাতনীদের প্রত্যেককে দিবে পঁচিশ টাকা করিয়া। আর যে নাতিরা চাকরি

করে না তাদেরও পঁচিশ টাকা করিয়া দিবে। হেন ও রাধারমণকে কিছু দিও।

ইতি

ভূদেব বন্দ্যোপাধ্যায়

২০/১১/৬৭

পুত্রকে লেখা ভূদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠি

মুগ্ধতা.কম

৭ জানুয়ারি, ২০২৩ , ২:৫৪ অপরাহ্ণ

আমার যত চিঠি

কবি নূরুল ইসলাম কাব্যবিনোদ অসুস্থ হয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেশ কিছু দিন শয্যাশায়ী ছিলেন, সেই সময় আমার ডায়েরিতে তাঁর ছন্দে লেখা একটি চিঠি।

নাট্যকার এমদাদুল হক ফারুককে সভাপতি আর আমাকে সাধারণ সম্পাদক করে রংপুর মেডিকেলের কিছু সংখ্যক নাট্যানুরাগীকে নিয়ে গঠন করা হয় ‘সৌখিন শিল্পী গোষ্ঠী’। নাট্যকার এমদাদুল হক ফারুকের রচনা ও নির্দেশনায় রংপুর টাউন হলে মঞ্চস্থ হয় এই দলের নাটক “আর নয় বিগ্রহ”। সেই নাট্যানুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আশির্বাণী পাঠ করেন বর্ষীয়ান ছান্দসিক কবি নূরুল ইসলাম কাব্যবিনোদ।

রংপুরের একজন স্বনামধন্য কবি, ‘কবিসভা’র প্রতিষ্ঠাতা, ত্রৈমাসিক ‘নতুন সাহিত্য’- এর সম্পাদক মহফিল হকের উপদেশবাণী। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ বেতারের একজন কর্মকর্তা, উদার মনের নিরহংকার গুণী ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন সাদা মনের মানুষ।

কবি নূরুল ইসলাম কাব্যবিনোদ-এঁর আরেকটি আশীর্বাদ বাণী।

সৈয়দপুর থেকে কবি আমিরুজ্জামানের পাঠানো চিঠি।

ভাওয়াইয়া শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, সংগঠক ও সংগীত পরিচালক এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমানের চিঠি।

কবি গীতিকার, প্রকৌশলী আলহাজ খন্দকার মো.সাইদুর রহমান (প্রয়াত) -এঁর চিঠি ।

আমার স্নেহাস্পদ ভাতিজা সাংবাদিক মোতাহারুল ইসলাম দুলু ঢাকার জাতীয় দৈনিক প্রথমে দৈনিক আজাদ, দৈনিক খবর, মাসিক ছায়াছন্দ, মাসিক চিত্র বাংলায় আগ্রহ সহকারে আমার অপক্ক হাতের লেখা ভুল ভ্রান্তি সংশোধন করে ছেপে দিত। সে লৌকিক পৃথিবীতে নেই, পরোলোকের গুলিস্তায়। আল্লাহ যেন ওপারে তাকে ভালো রাখেন। আমিন।

১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে কবি মোফাজ্জল হোসেন রনী দৈনিক দাবানলে তাঁর লেখা ছাপানোর জন্য সাহিত্য সম্পাদকের কাছে একটি অতীব পরিচ্ছন্ন চিঠি।

চিঠিটি নওগাঁর আত্রাই থেকে লেখা। চিঠির প্রেরক আমার ভাগ্নে, বাংলাদেশ বেতার রংপুরের একজন ভাওয়াইয়া গানের শিল্পী। আমার অনেক ভাওয়াইয়া গেয়েছে, পরবর্তীতে নজরুল সংগীতের শিল্পী হয়। বর্তমানে রাজশাহী বেতারে। ব্যক্তিগত জীবনে অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার।

চিঠি খানি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জানকী বল্লভ মহন্তের। দৈনিক দাবানলে এক সময় নিয়মিত ফিচার লিখতেন। তার পাশাপাশি মাসিক সমাজ দর্পনে লেখা অব্যাহত ছিল। তাঁর বিদেহী আমার শান্তি কামনা করছি ।

প্রতি শুত্রুবার তারাগঞ্জ থেকে অভিযাত্রিকে আসতেন কবি রেজাউল করিম। তিনি চাকরি করতেন পুলিশ বাহিনীতে। একজন সরল নম্র ভদ্র সাদা মনের মানুষ। এখন তিনি কোথায় আছেন জানি না।

একজন গুণী গীতিকার, শিল্পী, সংগঠক ও অভিনেতা এমাদউদ্দিন আহমেদ। তাঁর দীর্ঘায়ু আর সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।

আব্দুর রাজ্জাক বাংলাদেশ বেতারের একজন স্টাফ আর্টিস্ট (বাঁশী) ও সুরকার। আমার অনেক আধুনিক ও ছড়া গানের সুর করেছেন। তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি।

আমার যত চিঠি

মাসুম মোরশেদ

৭ জানুয়ারি, ২০২৩ , ২:০৭ অপরাহ্ণ

আকাশের ঠিকানায় দুটি চিঠি

১.

সখী,

পুরনো বই ঘাটতে তোমাকে লেখা অনেক পুরনো একটা চিঠি পেলাম। যেটা আর তোমাকে দেয়া হয়নি সেসময়। বইয়ের ভিতর রেখেছিলাম। হয়ত কোন কারণে বইটি আর পড়া হয়নি। তাই সেখানে থেকে গেছে। বুকসেল্ফ ঝাড়তে ফসকে একটা বই পড়ে গিয়েছিল। চিঠিটি সেখানে ছিল। মেলতেই কত কী মনে পড়ল। সেটি রুদ্ধশ্বাসে পড়লাম। কেঁদে কেঁদে লিখেছিলাম বেশ বুঝতে পারছি। সে সময় চিঠিটা তোমার হাতে পড়েনি। সেটাই ভাল হয়েছে। পড়ছি আর আনমনে কত কী ভাবছি। কত কী মনে পড়ছে! পোড়া স্মৃতি সব। জানি না কেমন আছো? নিশ্চয় ভাল আছো।

এই দেখো, আকাশটা ডাকছে। আবারও চোখ দু’টো ভিজছে। আজও সেদিনের মতো অঝোরে আকাশটা ভেঙ্গে ঝড়ুক। আমার চোখ বৃষ্টির আড়ালেই থাকুক।

তোমারও কি বৃষ্টি চাই? না বোধহয়।

ভালো থাকো।

ইতি

সুজন।

২.

সুহৃদ,

তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে মনোকষ্ট আমিও পেয়েছি। বুকে আমারও চিনচিনে ব্যথা। এ ব্যথা অশরীরি। জানি, তোমাকে ফিরিয়ে দেয়া এ আমার অযথা বাড়াবাড়ি। কিন্তু এতটুকু বাড়াবাড়ি আমার সাজে। এ আমার অধিকারের মধ্যে পড়ে।

তুমি উজার করে কী কী দিতে, আমি জানি।তুমি দিয়ে সুখ খোঁজ, আমি না নিয়ে খুঁজি।বরং সে-ই ভাল না দিয়ে-না নিয়ে যতটা ভাল থাকা যায়। সামান্য দেয়া-নেয়ার হিসেব কষে এত আলো, এত রঙ কেন ফিকে করবে?

দেখো, তোমার চারপাশ বসন্তের আবহ! সবকিছু রঙিন। সর্বত্র কলি, মুকুল, ফুল। ক’দিন পর সব আরও রাঙা হবে। ম ম করবে! কী সব মুখর কলতান! আ হা, কী সব স্বপ্ন রচবে তুমি নতুন সাথী নিয়ে!

তোমার স্বপ্নগুলো সত্যি হোক-এই শুভ কামনা নিরন্তর।

ভাল থাকো।

ইতি

মনপোড়া৷

আকাশের ঠিকানায় দুটি চিঠি

শিস খন্দকার

৭ জানুয়ারি, ২০২৩ , ২:০৬ অপরাহ্ণ

চারু সমীপেষু 

চারু,

শরীরটা আজ কিছুটা দুর্বল লাগছে। উদ্বিগ্নচিত্তে ভাবছো—’কেন? কী হলো আবার!’ উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। জানো নারীদের এই উদ্বিগ্ন হওয়া স্বভাবটা আমার ভীষণ অসহ্য। কিন্তু তোমার চেহারার উদ্বিগ্ন দৃশ্য সাধারণ নারীদের চেহারার উদ্বিগ্ন দৃশ্য হতে ভিন্ন, যা আমার প্রিয়! ভাবছো—’এ কেমন ভালোবাসা? প্রিয় মানুষের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারা যার প্রিয়, সে কী করে ভালোবাসতে পারে!’ তোমার এমন ভাবনা স্বাভাবিক, কিন্তু ভুল। আমি খুব ভালো করেই অবগত, তুমি আমার সমুখে সবচেয়ে কম উপস্থাপন করো আমার ভালোলাগার বিষয়াদি। যেমন—তোমার মধ্যরাতের নিদ্রারত দেহ, যা আজও দেখা হয়নি। অথচ এ দৃশ্যও আমার ভীষণ প্রিয়। 

স্বচ্ছ ঠাণ্ডা পানি ভর্তি একট গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দু’চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে পান করো। অতঃপর দুচোখ খুলে উপরে চেয়ে ঐ নিঃশ্বাসেই বল—’তোমাকেই ভালোবাসি’। দেখবে ভালোবাসার একটি অন্য অর্থ খুঁজে পাবে তোমার হৃৎপিণ্ড। যে অর্থটি পৃথিবীর কোনো অভিধানে নেই! তোমার বুক শেলফে কি কোনো অভিধান আছে? নাকি বুক শেলফই নেই? 

গত বর্ষায় যে মেহগনি বৃক্ষটি লাগিয়েছিলাম, সেটি বেড়ে উঠছে। দেখবে বেড়ে উঠতে উঠতে একদিন বৃক্ষটি কাঠ হয়ে গেছে। লালচে কিংবা কালচে সার কাঠ। কোনও এক বসন্তে কাঠগুলো উপহার স্বরূপ তোমাকে পাঠাবো; সেদিন তোমার জন্মদিন হবে! জানো, বসন্তে যাদের জন্ম, তারা আমার প্রিয় মানুষ হয়। যেমন—তুমি, তুমি এবং তুমি। মনে রাখবে, ‘তুমি’ ব্যতীত বসন্তে কেউ জন্মেনি! শুনেছি, প্রিয় মানুষকে কাঠ উপহার দিলে তা বুক শেলফ হয়ে যায়। দাম্পত্য কোলাহলে যদি কখনও দু-একটি সন্তান দিতে পারি, ঐ বুক শেলফে রেখে দিও তাদের। দেখবে, কোনও একদিন অভিধান হয়ে তারা তোমায় ভালোবাসার অর্থ শেখাবে! 

‘রক্ত’ শব্দটি শুনলে শরীর কেমন শিউরে ওঠে আমার। জানি, তোমারও। কিন্তু যখন তুমি দেখবে, ‘রক্ত’—নায়িকা পরীমণি অভিনীত একটি বাংলা চলচ্চিত্র। যেখানে রক্তের চেয়ে নায়িকার স্তনের দৃশ্য অধিকতর গুরুত্ববহ। তখন তুমি শিউরে উঠবে না। আমিও উঠি না। 

গত বিকেলে একজন রূপবতী তরুণীর মায়ের একমাত্র ভাইয়ের একমাত্র ছেলের স্ত্রী একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেছেন। প্রসবকালে তার দুই ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন পড়েছিল। সেই রূপবতী তরুণী দিয়েছিলেন এক ব্যাগ। একটি বিয়োগাত্মক তথ্য, তরুণী তার মামাতো ভাইয়ের প্রাক্তন প্রেমিকা ছিলো। বলা চলে, তরুণী তার শত্রুকে এক ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন। কিন্তু আরও এক ব্যাগ রক্ত প্রয়োজন। কে দিবেন? উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই, অবশিষ্ট এক ব্যাগ রক্ত দিয়েছিলাম আমি এবং ঐ রূপবতী তরুণীর জন্ম বসন্তে নয়। 

বৃষ্টি নামলো। শেষ বিকেলের অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিতে খোলা ছাদে ফেলে আসা ডায়েরির অমীমাংসিত ভেজা কবিতাটির যতটুকু মুগ্ধতা ছিলো, দিলেম তোমাকে এবেলা। কেমন আছো? সমূহ দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ভালো থেকো। তুমি ভালো থাকলেই ভালো থাকি আমি। জানো—বৃষ্টি, কবিতা এবং তুমি—আমার তিনটি ভালোলাগা পাখির নাম। যারা প্রতিবারেই আমার কাছে আসে নবরূপে বিস্ময়ের বাতাবরণ নিয়ে! ‘বাতাবরণ’ শব্দের অর্থ জানো? ফিরতি পত্রে উত্তর দিও। শরীরটা দুর্বল লাগছে। আজ তাড়াতাড়ি ঘুমাবো।

—অরুণ

চারু সমীপেষু

প্রমথ রায়

৭ জানুয়ারি, ২০২৩ , ২:০৬ অপরাহ্ণ

আমার চিঠিবেলা

চিঠি যোগাযোগের সুপ্রাচীন মাধ্যম। চিঠি সম্পর্কে মূলতঃ আমি জানতে পারি হাইস্কুলে পড়ার সময়। বাংলা ২য় পত্রের সিলেবাসে চিঠি পড়তে হতো। আমি হলুদ খামের ভিতরে প্রথম চিঠি পাঠাই হাইস্কুলে থাকার সময়ে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় কুইজের উত্তর। সেই পত্রিকায় সঠিক উত্তরদাতাদের নাম ঠিকানা ছাপা হতো। তাদের মধ্যে সুন্দর নামের মেয়েদের সাথে পত্রমিতালি করার জন্য চিঠি লিখতাম। কিন্তু কারো উত্তর আসেনি। আবার এই পত্রিকা থেকে আমার নাম ঠিকানা সংগ্রহ করে ময়মনসিংহের একটি গারো মেয়ে পত্রমিতালি করার জন্য আমাকে চিঠি লিখে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তিনি আমার বয়সে বড় হওয়ায় আমি দিদি সম্বোধন করে চিঠি লিখি। তাঁর সাথে ভাইবোন হিসেবে প্রায় পাঁচ বছর চিঠিতে যোগাযোগ ছিলো। ঢাকায় একবার দেখাও হয়েছিলো। পরে মোবাইল আসার পরে কিছুদিন মোবাইলে যোগাযোগ ছিলো। এখন ফেসবুক বন্ধুতালিকায় থাকলেও যোগাযোগ হয় না। তার প্রথম ও দ্বিতীয় চিঠির ছবি নিম্ন দেয়া হলো।

২.

আমার সবচেয়ে বেশি চিঠির যোগাযোগ হতো আমার ছোটো খালা অরিতা মাসির সাথে। আমার মাসি আর আমি প্রায় কাছাকাছি বয়সের। আমার নানা নানী তাঁর জন্মানোর দুবছরের মধ্যে মারা যান। পরে আমাদের সংসারে আসে। কিন্তু দারিদ্র্যের কারনে তার অনেক কষ্ট হচ্ছিল। পরে খ্রীস্টান মিশনারীরা তাকে নিয়ে গিয়ে সৈয়দপুর মিশনে রাখেন। এ খবর আমরা প্রায় দশ বছর পর পাই এবং তার সাথে দেখা করতে যাই। পরে সে নাটোরের একটি মিশন বোর্ডিং এ যায়। সেখানে আর দেখা করতে যাওয়া সম্ভব হয় না। পরে চিঠিতে যোগাযোগ হতো। সেখান থেকে তার আমার মাকে লেখা একটি চিঠি দেয়া হলো।

৩.

সে ২০০১ সালে এসএসসি পাশ করে ২০০২ সালে যশোরে একটি খ্রিস্টান মিশনারী হাসপাতালে নার্সিং পড়তে যায়। আমি ২০০৩ সালে এসএসসি পাশ করে ঢাকায় নটরডেম কলেজে পড়তে যাই। নটরডেম কলেজের ছাত্রাবাস মার্টিন হলে আমি থাকতাম। এখানে আমার সবচেয়ে বেশি চিঠি আসতো। সবচেয়ে চিঠি পেতাম আমার বাবা-মা আর ছোট খালার কাছ থেকে। আমার বাবা-মা অবশ্য চিঠি লিখতে পারতো না। অন্যের কাছ থেকে লিখে নিতো। বেশিরভাগ চিঠি সমেশ দাদু (প্রতিবেশি) লিখে দিতো। আমার ঐ কলমি দিদিও লিখতো। আমার হাইস্কুল বন্ধুদের মধ্যে আশিদুল আর লালবাবু নিয়মিত লিখতো। লালবাবুর চিঠির খামে একবার প্রদীপ লিখেছিল আর দীপক কলেজে ভর্তির তথ্য চেয়ে লিখেছিলো।

৪.

২০০৪ সালে বন্যাকালীন বাবা মায়ের পাঠানো চিঠি।

৫.

মার্টিন হলে পাঠানো ছোট খালার চিঠি। চিঠির খামে প্রায় টাকা পাঠাতো সেটাও এ চিঠিতে লেখা আছে।

৬.

মার্টিন হলে দিদির পাঠানো চিঠি। একই খামে তার এলাকার এক বড় ভাই থাকে তাঁর চিঠিও ছিলো। পরে বড় ভাই আমাকে বেশ স্নেহ করতো।

৭.

মার্টিন হলে পাঠানো হাইস্কুল বন্ধু লালবাবু চিঠি

৮.

মার্টিন হলে পাঠানো হাইস্কুল বন্ধু আশিদুলের চিঠি

৯.

মার্টিন হলে থাকতে আমি এদের সকলের সাথে চিঠিতে যোগাযোগ করতাম। এদের কারো চিঠি সংরক্ষণ করতে পারিনি। মা বাবাকে যেসব চিঠি লিখতাম সেগুলো তাঁরা সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। এখানে থাকতেও আরও অনেক মেয়েকে পত্রমিতালী করার জন্য লিখতাম কিন্তু কারও উত্তর পাইনি। একবার ছুটিতে এসে এক মেয়েকে খুব পছন্দ হলো। ভাবও হয়েছিলো। কিন্তু মনের কথা বলতে পারিনি। আমার হলের এক বন্ধুর প্রেমিকা দিনাজপুরের এক ছাত্রী হোস্টেলে থাকতো। সেও সেখানে থাকতো। তাকে শুধু একটি বাক্য লিখলাম। ‘তোমার মধুর মুখের হাসি আমাকে মুগ্ধ করেছে।’ ইতি- পি। সে পি দিয়ে আমাকেই ধারণা করেছিলো এবং আমার একজন ক্লাসমেটকে বলেছিলো আমাকে জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু আমি সত্য স্বীকার করতে সাহস পাইনি।

১০.

মার্টিন হল থেকে আমার বাবা মাকে লেখা চিঠি। এসময় বন্যার কারণে আমাদের কলেজে কোমর পানি জমেছিলো।

১১.

ঢাকা থেকে ফিরে আসার পর দুজন কলেজ বন্ধু যোগাযোগ করতো। একজন বিনয় টুডু। আমি হলে একবার মারাত্মক অসুস্থ হয়েছিলাম। বিনয় আমাকে অনেক সেবা শুশ্রূষা করেছিলো। অন্যজন সুবাস মারান্ডী। আমাদের পর পর রোল ছিলো। প্রতিযোগিতা করে পড়তাম। সে আমাকে বেয়াই বলে ডাকতো। দুজনের বাড়ী রাজশাহী। পরবর্তীতে দুজনের সাথে দেখা হয়। বিনয়ের সাথে বেশ কয়েকবার দেখা হয়।

১২.

কলেজ বন্ধু বিনয়ের পাঠানো চিঠি।

১৩.

কলেজ বন্ধু সুবাসের পাঠানো চিঠি।

১৪.

তারপর ২০০৬ সালে আর একটি মেয়ে পত্রমিতালি করার জন্য চিঠি লিখে। সে ঠিকানা পেয়েছে তাঁর এক বান্ধবীর কাছ থেকে। তার বান্ধবী পেয়েছে আমার এক মার্টিন হল বন্ধুর ডাইরি থেকে। শুনেছি পরে তার বান্ধবী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এ মেয়েটির চিঠির উত্তর দেই এবং প্রায় এক বছর তার চিঠির অপেক্ষা করি। কিন্তু কোনো উত্তর আসে না। পরে আমি মোবাইল নাম্বারসহ সর্বশেষ চিঠি লিখি ২০০৭ সালে। পরে একদিন সে কল দেয়। পরে আরও বেশ কয়েকটি চিঠি আদান-প্রদান হয়। তবে ডাকবাক্সে নয়, বরং কুরিয়ার সার্ভিসে।

.

তার পাঠানো প্রথম চিঠি। সেসময় জিৎ এর ‘সাথী’ চলচ্চিত্রটি বেশ জনপ্রিয় ছিলো। সে চলচ্চিত্রের গান, ও বন্ধু তুমি শুনতে কি পাও’ চিঠিতে লেখা আছে।

১৫.

একবার ঢাকায় প্রোগ্রাম করতে গিয়ে রূপা নামে একটি মেয়েকে আমার ভালো লেগেছিলো। পরে মেয়েটিকে চিঠি দেই কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি।

অনেকদিন পর একটি মেয়ের উত্তর পেয়েছিলাম। এসব চিঠি তার জন্য কতটা ক্ষতিকর বা তার পরিবার এসব পছন্দ করে না, সেসব লিখে উত্তর দেয়। তারপর থেকে আমি আর কোনো মেয়েকে চিঠি লিখিনি। সেই মেয়েটির চিঠি নিম্নে দেয়া হলো।

১৬.

অন্যের চিঠি নিয়ে আমার মজার ৩টি অভিজ্ঞতা রয়েছে।

১। মার্টিন হলে থাকতে আমার এক বন্ধু তার প্রেমিকাকে ৭০০ পৃষ্টার একটি চিঠি লিখে।

২। মার্টিন হলে থাকতে আমি একটি নাইট স্কুলে পড়াতাম। সেখা

আমার চিঠিবেলা

ফজলে রাব্বী

৭ জানুয়ারি, ২০২৩ , ১:৪৯ অপরাহ্ণ

দূরপ্রাচ্যের প্রেমিকাকে

প্রিয় দূর প্রাচ্যের প্রেমিকা,

জানি প্রতিত্তরে কোনো চিঠি আসবে না, তাই জিজ্ঞেস করছি না কেমন আছেন। আর জানতে না চেয়ে কোন মুখেই বা বলি আমি কেমন আছি।

কখনো যাব না ভেবেও গত সপ্তাহে আপনাদের গলিতে গিয়েছিলাম দীর্ঘদিন পর। হাজারী-নাগের বইয়ের পৃষ্ঠায় আর কখনো শিউলি এক্সপোর্ট করব না যে ব্যালকনিতে, সে ব্যালকনি ধ্বংস হয়ে যাক। তাতে আমার কী! এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল অথচ পুরোনো ব্যালকনিটা দেখতে না পেরে ক্যান যে  মন খারাপ লাগল বুঝলাম না। এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে এভাবে ভেঙে ফেলা অবশ্যই পাপ। আমি এর  তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। চাইলে আপনিও আমার সাথে একাত্বতা ঘোষণা করতে পারেন। কোনো বৈশাখের ঝড়ে স্কাই ভিউয়ের লিচু গাছটা উপড়ে গেলে হয়তো এই অস্বাভাবিক দুঃখবোধটা আবার কাজ করতে পারে। সে করুক!

এ তো গেল আপনার এলাকার খবর।

শিউলি আর বকুলের তালিকায় আমি আরও একটা ফুল যোগ করেছি।

না, কাঠগোলাপ না।

হাসনাহেনা ! ঠিক কী কারণে জানি না। উঠোনে চার পাঁচটা হাসনাহেনার ডাল পুঁতেছিলাম দুবছর হলো। এবারই প্রথম ঘামাচির মতো থুকথুক করে এত ফুল ফুটেছে। হাসনাহেনার কী যে দারুণ ঘ্রাণ! আর হবেই না বা কেন! হাসনাহেনা শব্দটি এসেছে জাপানি ভাষার শব্দ থেকে।

জাপান?

হ্যাঁ দূর প্রাচ্যের দেশ।

দূঊঊঊর প্রাচ্য!

সিক্সটি ওয়ান মিউচু্য়্যালে থেকেও এতটা দূরত্ব আপনার ‘জাপানি’ নামকে সার্থক করেছে।

ফিফটি সিক্সয়ের পর অনেকদিন দেখতে পারিনি কতদূর এগোল! এখন পাচ্ছি। এ অবশ্য আপনারই করুণা। সে কারণে একটা ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য।

এত্তবড় থ্যাঙ্কিউউ…

সে যাই হোক, একটা চিঠি লেখার সুযোগ পেয়ে বেশি বেশিই বলে ফেলছি হয়তো। এবারে শেষ করা উচিত।

ভালো থাকতে বললেই যদি ভালো থাকা যেত তাহলে অবশ্যই বলতাম ভালো থাকতে।

ইতি

আপনার প্রাক্তন প্রেমিক

দূরপ্রাচ্যের প্রেমিকাকে

মুগ্ধতা.কম

৭ জানুয়ারি, ২০২৩ , ১:৪৮ অপরাহ্ণ

কাজল ভাইয়ের চিঠি

সানু দুলাভাইয়ের প্রিয় বন্ধু কাজল ভাই আজ পৃথিবীতে নেই। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাষ্টার্স পাশ করে উপজেলা সমাজসেবা অফিসার হিসেবে নরসিংদীতে জয়েন করেছিলেন। ১৯৯৯ সালে স্বপ্না আপার বিয়ের দু’দিন আগেই তিনি ঢাকা থেকে আমাদের গ্রামের বাড়িতে বিয়ে বাড়ি সাজাতে এসেছিলেন। সৃজনশীল এই মানুষটি অনেক সুন্দর কবিতা লিখতেন। তার সাথে আমার অনেক চিঠি আদান-প্রদান হতো কবিতার মাধ্যমে। আমি তখন রংপুর, কারমাইকেল কলেজে গণিত নিয়ে অনার্সে পড়ি। আর্মি অফিসার হওয়ার জন্য ৪৭ তম বি এম এ পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তিনি এটি জানতে পারেন। সেই প্রেক্ষিতে এই চিঠিখানা লিখেছিলেন।

কাজল ভাইয়ের চিঠি

কামরুন নাহার রেনু

৭ জানুয়ারি, ২০২৩ , ১:৪৮ অপরাহ্ণ

ভালো থেকো মৃন্ময় 

মৃন্ময়,

বৈরি প্রকৃতির মাঝে তোমায় ঘিরে লিখতে যেয়ে থেমে যাচ্ছে প্রিয় শব্দের উল্লাস। জানি, ভালো নেই তুমি। আমাদের চেনা বিকেলের স্বপ্ন কাতর দিনগুলো ডায়রির পাতায় পায়চারী করছে, অথচ তুমি আমি এখন ভিন্ন পৃথিবীর বাসিন্দা, ভাবতে পারো, বুকের ভেতর জিইয়ে রাখা স্বপ্নগুলো কেমন উপহাস করছে আমাদের! অথচ, এই আমরা পঞ্জিকায় দিনগুনে কত কাব্য লিখে গেছি ভৈরবী সকালের গাঁয়। কত বিকেল ছুঁয়ে গেছে আমাদের স্বপ্নীল চোখের আল বেয়ে, যেখানে আমাদের আগামী দিনের সমস্ত হিসেব লেখা, কিছু বেহিসেবি অনুরাগে কতবার ফিরে গেছি আত্ম নির্বাসনে! আবার ফিরে এসেছি তোমার আহ্লাদী চোখের নির্মোহ আহবানে, আচ্ছা মৃন্ময় যদি এমন হয়, —হারিয়ে গেলাম আমি, বুকের বাম অলিন্দে জমিয়ে রাখা কথাগুলো ভেসে গেলো বাতাসে, ডায়েরির পাতায় জন্মাল না কোনো নতুন স্বপ্নের বীজ। ভোরের শীতল হাওয়ায় গা ভাসিয়ে চলে গেলাম আমি তোমায় ছেড়ে, আমার রেখে যাওয়া দোলনচাঁপায় তোমার দীর্ঘশ্বাস মেখে রেখে দিও বিকেলের বেলকনিতে।. ..

আর যদি এ যাত্রায় বেঁচে যাই আমরা, সত্যি বলছি— ভালোবাসার গভীরতা তোমায় ঠিক বুঝিয়ে দেবো।

আমি ভালো নেই মৃন্ময়। তুমি ভালো থেকো—

ইতি
তোমার. ..

ভালো থেকো মৃন্ময়

মুগ্ধতা.কম

৭ জানুয়ারি, ২০২৩ , ১:৪৮ অপরাহ্ণ

শাশুড়িকে লেখা চিঠি 

আম্মা,

আমি আপনাদের ভালোবেসেছি। জানি,এ কথাটা আপনার এবং আপনার সন্তানদের পক্ষে বিশ্বাস করা অসম্ভব। কারণ আপনার শৈশব।

শৈশব সৎ মা আর সৎ ভাইবোনের সংসারের পরিবেশ আপনাকে ভালোবাসা, বিশ্বাস, শেয়ারিং এসব শেখায় নি।

বরং ঈর্ষা, ভাগ বাটোয়ারা, হাম হাম, তুম তুম, ম্যা ম্যা তু তু,শিখিয়েছে।

বাবাকে দেখেছেন আপনার ভাগের ভালোবাসা অন্যকে দিতে। দুই মাকে দেখেছেন কি করে স্বামীকে নিজের কাছে ছলে বলে কৌশলে রাখতে হয় তাই করতে।

এইসব পলিটিক্স থেকে আপনি বের হতে পারেননি আজো।

মা,আপনিতো শিক্ষিত মানুষ। আপনি শিক্ষক। কী করে এই শিক্ষা নিজ সন্তানকে দিলেন?

কেন শিক্ষার আলো দিয়ে নিজের ভেতরের শৈশবের সেই ভাগিয়ারী স্বার্থপরতার অন্ধকার দূর করতে পারলেন না?

কেন মা,

আপনি শুধু আপনার সন্তানের মা হলেন?

কেন শাশুড়িও হতে পারলেন না?

কেন সব সময় সতীন টাইপ মনোভাব নিয়ে বেঁচে আছেন? আম্মা,আজ হয়ত একের পর এক সংসার ভেঙ্গে ছেলেকে নিজের কাছে রেখে আনন্দ পাচ্ছেন!নিজেকে সুখী ভাবছেন,জয়ী মনে করছেন। আসলে কি আপনি জয়ী মা?

আপনার ছেলেটা আজ কিছু করেনা।আপনি করতে দেন না।

আরেক ছেলে আপনার চালাকিটা স্বভাবে পেয়েছে।কিংবা আপনার স্বার্থপরতা রপ্ত করে নিজের ভালো থাকাটা নিশ্চিত করে স্ত্রী সন্তান নিয়ে আপনার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। তাই তার সংসার অক্ষত আজো। আপনি ভাঙতে পারেননি।

আমি ওর বুদ্ধির তারিফ করি।

মা, কিন্তু আপনার এই বোকা ছেলেটা যে অন্যের উপার্জনের টাকার দয়ায় জীবন নির্বাহ করছে,ননিজের যোগ্যতা থাকার পর কর্মহীন হচ্ছে বারবার। শুধু আপনার কারণে! আপনার কি একটি বারও খারাপ লাগে না?

জানেন মা, ওর বন্ধুমহলে ও যখন বলে -দোস্ত, আমার জন্য একটা কাজ দেখ না!

কিংবা আত্মীয়দের কাছে, চাচা মামাদের কাছে বা চাচাতো মামাতো ভাইদের কাছে বলে চাকরির সুপারিশের কথা আমার লজ্জা লাগে, আমি ছোটো হয়ে যাই।

আপনি কেন হন না মা?

নিজ স্বার্থে কেন ছেলেটার জীবন নষ্ট করছেন?

কেন আপনি আমার কাছ থেকে আমার স্বামীকে আলাদা করেছেন? কেন তার সন্তানকে পিতার কাছ থেকে আলাদা করেছেন?

কেন দ্বিতীয় বউটিকেও আপনি সংসার করতে দিলেন না? এভাবে আর কতজনের ঘর ভাঙবেন। আপনার বাবার করা অপরাধের সাজা আপনি কাকে দিচ্ছেন? 

কেউ আপনার মায়ের স্বামী কেড়েছে বলে কি আপনি ছেলের বউয়ের স্বামী কেড়ে নেবেন?

কেউ আপনার বাবার ভাগ কেড়েছে বলে কি আপনি আপনার নাতি নাতনির বাবাকে আলাদা করবেন? 

আম্মা,নিজের বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন যে,আপনার ছেলের বউদের অপরাধ কী? আমার অপরাধ কী? কোনো দিন আমি আপনাকে কিছু বলেছি?

আম্মা, নিজের শৈশবের প্রতিশোধ প্রতিহিংসায় আপনি শুধু পরের মেয়েদেরকে নয়, নিজের সন্তানকেও পুড়ছেন। তার জীবনটাও নষ্ট করছেন!

আজ এত বছর পর এই বয়সে এসে খুব বেশি কি করবে আপনার সন্তান? অন্য সহোদরের  কেয়ারটেকার হয়ে জীবন কাটাবে? মা হয়ে এতটা বৈষম্য কি করে করলেন?আপনার এই মা ভক্ত ছেলে সেটা না বুঝলেও মৃত্যুর পর একদিন এর জবাব কিন্তু উপরওয়ালা চাইবেন?

সন্তানের কাছ থেকে, স্ত্রীর কাছ থেকে স্বামীকে আলাদা করার দায় থেকে বিধাতাও মুক্তি দেবেন না।

আম্মা, হাদিস কোরানের কথা বলে আমি ব্যর্থ হয়েছি।

বড় মসজিদের হুজুরের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম, আপনি, আপনার ছেলে আল্লাহ, হুজুর হাদিস কিছুইতো মানেন না।

লোক দেখানো মাঝেমধ্যে নামাজ পড়েন।

আমি খুব কষ্ট পাই যখন জোর করে ঠেলেও আপনার ছেলেকে জুমার নামাজে মসজিদে পাঠাতে পারিনা।

আম্মা, মা না হোক, স্বাভাবিক শাশুড়ি হউন। ছেলের বউয়ের সাথে ঝগড়া করুন, গালি দিন। কিন্তু সংসার ভাঙার এই খেলা থেকে বেড়িয়ে আসুন।

মা,আপনার ছেলেটাকে অন্য ছেলেটার কাছে, আত্মীয় স্বজনের কাছে,বন্ধু বান্ধবের কাছে আর ছোটো করবেন না।তার মাতৃভক্তির সুযোগ নেবেন না।

ওর কি সংসার করতে মন চায় না? না হলে কি বারবার ভালোবাসতো? ভালোবেসে বিয়ে করতো? ব্যভিচারের মতো গোনাহর দিকে মা হয়ে ছেলেকে ঠেলে দেওয়ার গোনাহ করতে পারেন না।

জেদ, হিংসা,অহংকার মায়েদের জন্য না। মা তো ত্যাগ করার জন্য। আপনি কি কিছু ত্যাগ করেছেন এই ছেলেটার জন্য? বরং সে ত্যাগ করেছে আপনার জন্য!এখনো করেই চলেছে!

মনে আছে আম্মা,আমি সাজলে আপনার ছেলে খুশি হয়, কিন্তু আপনি অখুশি হন। তাই আমার সাজ আপনার ছেলে আর পছন্দ করেনা।

সেদিন ওর জন্মদিনে, আপনি কি বাগড়াটাই না দিলেন। স্ত্রী চেয়ে আপনার ছেলের জীবনে কি অন্য আত্মীয়া মহিলার হক বেশি?

আবার অসুস্থ আমাকে নিতে আসতে না দিয়ে আপনি তাকে আপনার ভাগনা বউয়ের ডেলিভারিতে পাঠালেন। অথচ আপনার ভাগনাসহ সবাই ছিল সেখানে।

তারপর প্রতি ঈদে আপনি আমার কাছ থেকে ওকে আলাদা করতেন। আমাদের একান্ত সময়গুলিতে আপনি ঢুকে পরতেন মাঝখানে। 

এসব কি একজন মায়ের কাজ?

আম্মা, আপনার ছেলেকে বলেছিলাম, আপনার কাউন্সিলিং করাতে। আপনার চিকিৎসা দরকার। কিন্তু, সে তো আমার কথা শোনার মানুষ না। উল্টো আমাকেই উত্তম মধ্যম দিয়ে দিলো। এতে অবশ্য আপনি বেশ খুশি।

মা,

আপনি একদিন তো চলে যাবেন পৃথিবী ছেড়ে, এটা মানেন তো? তাই যদি হয়, তবে আপনার চলে যাবার পর আপনার অলস ছেলেটাকে কে দেখে রাখবে?কে ভালোবাসবে?

সবাই ভালোবেসে আসে না। কেউ কেউ প্রয়োজনে বা বিপদে পড়ে আসে। তারা ভালোবাসে না।

আপনি শিক্ষিত মানুষ, এবারে অন্তত বুঝুন। আপনি যে বুঝবেন না, আমি তাও জানি।

ভালো থাকবেন মা। আমার স্বামীকে ভালো রাখবেন।আমি অনেক ভালোবাসি তাকে।

ছোটো মুখে আজ একটা বড় কথা বলি মা। আপনার ছেলেকে আমি বেশি ভালোবাসি। কখনো প্রাকটিকাল পরীক্ষা হলে আপনি হেরে যাবেন।

সন্তান মরলে শোক চিহ্ন থাকে না। আলাদা কোনো নাম হয় না। স্বামী মরলে তার নাম হয় বিধবা। আপনি জানেন। আর শোক চিহ্ন সাদা কাপড়। যদিও আপনি সাদা কাপড় পরেন না।

আমি হলে পরতাম। সাদা কাপড়।

স্বামীর দাম নিশ্চই সন্তানের চেয়ে বেশি।

এখনো জেদ,অহংকার বা ইগো আছে আপনার,এসব নিয়েই যদি বাঁচেন,ছেলের প্রতি ভালোবাসা যদি আপনার স্বার্থপরতা না হয়, যদি সাহস থাকে তবে ভালোবাসার পরিক্ষা দিন আমার সাথে।

আল্লাহ আপনাকে হেদায়েত করুক, বুঝবার তৌফিক দান করুক।আমিন।

ইতি 

আপনার ছেলের তৃতীয় বউ।

শাশুড়িকে লেখা চিঠি

মুগ্ধতা.কম

৭ জানুয়ারি, ২০২৩ , ১:৪৭ অপরাহ্ণ

চিঠি

প্রিয় কবিসাব,

প্রথমেই সালাম ও শরতের শিউলির শুভেচ্ছা নিবেদন করলাম। 

অর্ধ- ভাঙ্গা হৃদয় নিয়ে আমি আবারও আপনার কদমে হাজির! এতে হয়তো আপনি বিস্মিত! বিশ্বাস করুন- আপনার মুখে সেদিন “ভুলে যাও” কথাটি শ্রবণমাত্রই যেন বিনা মেঘের বজ্রপাতে আমার মস্তক খন্ড-বিখন্ড হয়ে গিয়েছিল। কী ভুল হয়েছে আমার? নিজেকে প্রশ্ন করেছি বারবার। কিন্তু কোনো উত্তর না পেয়ে শুধু পেয়েছি স্মৃতি দগ্ধ জালা, অগ্নিস্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছি কত স্মৃতির ঢালা। নিরীহ নেত্রের প্রতিটি অশ্রুকণা প্রতিনিয়ত শুধায়- ” আর কত পোড়াবে আমায়.? আমিও তো একটা মানুষ নাকি!” 

বিশ্বাস করুন, ঐ বসন্তে যখন আপনার পিতার দেওয়া নীল শাড়িটি উপহার পেয়েছিলাম তখনই প্রথম ভাবির মুখে শুনেছিলাম আপনার নামটি। অতঃপর সাধনা- আপনাকে একবার দেখব। প্রায় দেড় বছর সাধনার পর শ্রাবণের এক নিরাক পড়া প্রকৃতির উত্তপ্ত রৌদ্রশিখায় আপনার জলন্ত লাবণ্য দর্শনে আমি আপনাকে মনের মানুষ ভেবেছিলাম। পড়েও ছিলাম আপনার লেখা কয়েকখানা কবিতা। এরপর থেকে এমন কোনো রাত নেই, যে রাতে আপনার বইয়ের কবিতা আমি পড়িনি! প্রথম সাক্ষাতে আপনি আমাকে ‘বিজয়িনী’ নাম দিয়ে বলেছিলেন- “শোনো, বিজয়িনী, তুমিই হয়তো আমার কবিতার শব্দমালা। কারণ, তোমার অনুপস্থিতিতে আমার কবিতারা শব্দহীনতায় আক্রান্ত হয়ে নিষ্প্রাণ হয়ে যায়! আর নিষ্প্রাণ মানেই তো অস্তিত্বহীন আর আমার কবিতার অস্তিত্বহীনতা মানেই তো আমি এক প্রকারের জিন্দা লাশ! “

এভাবে ভালোবাসা এত গভীরতার পরেও বেলাশেষে ফ্যামিলির চাপে আমার হাতটি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন!

তবুও আমি বিশ্বাস করি, আপনি কবি! আপনি চাইলে সাধনা আর তপস্যা দ্বারা পাথরকে ফুলরূপে ফোটাতে সক্ষম! শুনুন,আজকে আমি আগের মতো ভালোবাসা চাইতে আসিনি, কারণ আমি জানি আমার ক্ষেত্রে আপনার ভালোবাসা পাওয়ার স্বপ্ন দেখা আর বামন হয়ে চন্দ্র পাওয়ার স্বপ্ন দেখা সমান কথা! আপনি আমাকে চেনেন হয়তো বেশিদিন হয়নি, তবে আমি আপনাকে দু’বছর ধরে চিনি। এ যেন দুই শতাব্দীর সাধনা! 

আজ হয়তো আপনার প্রশ্ন যে, আমাকে আপনি চান না! এমতাবস্থায় আপনাকে আমি ভুলে যাই না কেন? প্রত্যুত্তরে বলব- আপনি তো এক অনন্য ব্যাক্তিত্ব, কবি মানুষ। তাই আজ থেকে দুবছর পূর্বে রোপণকৃত একটা শেফার্ডস বৃক্ষকে আপনি অনুভূতির নেত্র দ্বারা দর্শন করিয়েন, ঐ বৃক্ষটির গজানো শাখা-প্রশাখা ও শিকড়ের গভীরতা নিয়ে একটু ভাবিয়েন। কোনো বিপদশঙ্কুল সরঞ্জাম ছাড়া ঐ বৃক্ষটিকে এক টান মেরে উপরে ফেলতে পারেন কিনা চেষ্টা করে দেখবেন।

যদি সফল হন তাহলে ধরে নিয়েন আমিও আপনাকে ভুলতে যেভাবেই হোক সফল হব বলে কথা দিয়ে গেলাম। আর যদি ব্যর্থ হন তাহলে ধরে নিয়েন আপনাকে ভুলতে আমিও ব্যর্থ…! এতে ক্ষমার অযোগ্য হলেও কিছু করার নেই! 

ইতি- 

আপনার কবিতার বিজয়িনী।

চিঠি

রবীন জাকারিয়া

৭ জানুয়ারি, ২০২৩ , ১:৪৬ অপরাহ্ণ

মৌলভির চিঠি

আমার দাদু মৌলভি আলীম সরদার নামজাদা বামপন্থী পলিটিশিয়ান এবং সংস্কৃতি কর্মী৷ এলাকায় তাঁর প্রভার আর ক্ষমতা অকল্পনীয়৷ তাঁর কথাই শেষ কথা৷ বিচার, শালিস সবই তাঁর মর্জিতে৷ বরখেলাফ করলে কী ভয়াবহ ঘটনা কপালে জুটবে সেটা সকলের জানা৷ তাই কেউ টুশব্দটিও করে না৷ দাদু সমাজতান্ত্রিক দল করতেন৷ বলা যায় প্রভাবশালী নেতা৷ অন্যদিকে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে তাঁর বিচরণ তাঁকে নিয়ে গেছে এলাকার শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে৷ স্থানীয় স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, ইয়াতিমখানা, মসজিদসহ সকল প্রতিষ্ঠানের সভাপতি৷ অবহেলিত ও নির্যাতিত নারীদের জন্য নারী পুনর্বাসন সেন্টার নামে একটি আশ্রম আছে৷ অবশ্য সেই আশ্রমে কেন যেন প্রায়শঃই নির্যাতিত নারীরা আত্মহত্যা করে! দাদুকে এসব সামলাতে বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকতে হয়৷ তাছাড়া জনসেবা৷ এলাকার মানুষের খোঁজ খবর নেওয়া৷ তাই বাড়িতে সব সময় দর্শনার্থীদের ভীড়৷ 

আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিল যে দাদুর নামের সামনে মৌলভি টাইটেলটা কেন? তিনিতো কোনোদিনও টুপি পাঞ্জাবি পরতেন না৷ এমনকি দাড়িও ছিল না৷ তিনি নিয়মিত নামাজও পড়তেন না৷ বরং ধর্মবিরোধী অবস্থান ছিল তাঁর৷ কিন্ত মৌলভি হলেন কেন? অনেক পরে জেনেছি যে ঐ সময় মুসলিম ব্যক্তিদের নামের সামনে মৌলভী লেখা হতো৷ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামেও মৌলভী টাইটেল ছিল৷

দাদু কঠোর চীনপন্থী সমাজন্ত্রী ছিলেন৷ তাই তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও নিজ দেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে নিরলস কাজ করেছেন৷

৭০ এর নির্বাচনে সারা বাংলাদেশে ১৬২ আসনের মাঝে দুইটি আসনে আওয়ামীলীগ পরাজিত হয়। একটি হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আরেকটি ময়মনসিংহ সেন্ট্রাল।

পার্বত্য চট্টগ্রামে জয়লাভ করেন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় ও ময়মনসিংহে পিডিপির নুরুল আমিন।

এই দুজনের বিজয়ে দাদুর অবদান ছিল৷ তিনি তাদের নির্বাচনী প্রচারে নিরলসভাবে কাজ করেছেন৷ 

এরপর দেশ স্বাধীন হলে তিনি আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হন৷ 

দাদু নিজে উচ্চ শিক্ষিত হলেও তাঁর কোনো সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করতে পারেননি৷ বরং প্রত্যেকে হয়েছে একেকটা সুবিধাবাদী আর ক্ষমতালিপ্সু মানুষ৷ 

দাদু পলিটিকস বোধ হয় বেশ ভালই জানতেন৷ যার কারণে তিনি যেমন জীবদ্দশায় সর্বদা PGP (Present Government Party) করতেন৷ ঠিক তেমনি তাঁর সন্তানেরা৷

আমাদের বাড়িতে আলেয়া নামক এক বয়স্ক গৃহকর্মী থাকেন৷ মানসিক প্রতিবন্ধী৷ দাদুর যৌবনকাল থেকেই তিনি আছেন৷ আমি তাকে আলেয়া দাদি বলে ডাকি৷ দিদি বললে আমার নিজের দিদি রাগ করেন৷ তাই দাদি বলি৷ মাঝে মাঝে যখন ওনার মাথা ঠান্ডা বা ঠিক থাকে তখন গল্প বলেন৷ আদর করেন৷ বেশ উপভোগ করি৷ কিন্ত মাথা বিগড়ে গেলে তখন হাতে একটা কাগজ নিয়ে সকলকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলতে থাকবে “এই দ্যাখ মৌলভি আমাকে চিঠি লিখেছে”৷ মৌলভীর চিঠি মানে তার স্বামীর প্রেমপত্র৷ এলাকার এমন কোনো মানুষ নেই যে তার এই প্রেমপত্রের কথা জানে না৷ শুধু তাই নয় রাস্তা-ঘাট কিংবা মোড়ের রিক্সাচালক পর্যন্ত জানে৷ আমাদের সমাজে যা হয় পাগল দেখলে সহানুভূতির চেয়ে ক্ষেপাতে পারলে আনন্দ পাই৷ তার সাথে প্রতিদিন তাই ঘটত৷ দিনশেষে এক টুকরো ছেঁড়া কাগজ নিয়ে আলেয়া দাদি ঘরে বসে কাঁদতেন৷ আমার খারাপ লাগতো ভীষণ৷ কিন্ত কিছু করতে পারতাম না৷ আমিতো ছোট তাই৷

আমি একটা জিনিষ দেখে অবাক হতাম৷ দাদুকে নিয়ে যে যাই বলুক৷ কিন্ত মানুষটা আসলে মহান৷ না হলে একজন গৃহকর্মীর জন্য এত ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ থাকে? যখন যা চাচ্ছে তাই এনে দেয়৷ কেউ বাধা দিলে বলে “পাগল মানুষ একটা আবদার করেছে দিয়ে দাও, আমরা বিনির্মাণ করবো এক সাম্যবাদি সমাজ৷ যেখানে থাকবে না কোন শ্রেণি বৈষম্য”৷ দাদুর কথা কেউ ফেলতে পারে না৷ 

দিদিকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম উনি কীভাবে পাগল হলেন? এমনকি ওনার একটা ছেলে সেও পাগল৷ বিষয়টা কী? দিদি বললেন যদিও তুই ছোট মানুষ সব বুঝবি না৷ তবুও বলি শোন্ আলেয়ার বিয়ে দেওয়া হয়েছিল এক মৌলভির সাথে৷ পাশের মসজিদের খাদেম ছিল৷ এরপর ওর ছেলেটা পেটে আসে৷ এমন সময় ওর স্বামী ওকে রেখে পালিয়ে যায়৷ এই দুঃখে ও আস্তে আস্তে মানসিক ভারসাম্য হারাতে থাকে৷ ও কোনো কিছু না বলে হঠাৎ হঠাৎ করে নিখোঁজ হতো৷ পেটে সন্তান অন্যদিকে এভাবে শরীরের উপর টর্চারের কারণে প্রসব জটিলতা সৃষ্টি হয়৷ উপায়ান্তর না থাকায় ডাক্তার সাত মাসেই তার বাচ্চাকে প্রসব করাতে বাধ্য হয়৷ অপ্রাপ্ত শিশু৷ বাঁচা মরা অবস্থা৷ মা পাগলি৷ ঠিকভাবে দুধ পায় না৷ মায়ের সঠিক যত্নের অভাব৷ সব মিলিয়ে দেখা গেল ছেলেটাও প্রতিবন্ধী৷ পাগল৷ একদিকে স্বামীর শোক৷ অন্যদিকে ছেলের এমন অবস্থা দেখে আলেয়া একেবারেই পাগলি হয়ে গেল৷

একদিন হঠাৎ করেই দীর্ঘ আয়ুর দাদু মারা গেলেন৷ তাঁর বয়স হয়েছিল ১০২ বছর৷ বাড়িতে শোকের ছায়া৷ পরিবারের মাথার ছাতাটা ভেঙে গেল৷ সময় সব ক্ষত মুছে দেয়৷ জীবন নতুন করে সাজে৷ পরিবর্তন হয় নেতৃত্বে৷ এখন আমার বড় বাবা হলেন পরিবারের নেতা৷ তাঁর আনুগত্যে কারো অসন্তোষ নেই৷ আবারো সব কিছু ঠিক ঠাক৷ 

ক’দিন আগে বড়বাবা কিছু লেবার লাগিয়েছে দাদুর ঘরটাকে পরিস্কার করবে বলে৷ অপ্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র, ফার্নিচার পুড়িয়ে ফেলে ঘরটাকে বসবাস উপযোগী করা হবে৷ লেবার-মিস্ত্রি বাড়িতে কাজ করলে আমার ভালো লাগে৷ আমি দাঁড়িয়ে থেকে দেখি৷ অনেক সময় পুরোনা কোনো খেলনা, মার্বেল কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়া পিচ দিয়ে বানানো নিজের হাতুরি দেখলে খুশি হই৷ ওগুলো আবার সংরক্ষণ করি৷ এমন সময় দেখলাম লাল কাপড়ে মোড়ানো একটা মোটা খাতা৷ আমি ওটাকে নিজের কাছে রাখলাম৷ ওটা আসলে ডায়েরি৷ দাদুর ডায়েরি৷ নিজের ঘরে লুকিয়ে রাখলাম৷ রাতে পড়তে লাগলাম৷ মজা লাগছিল৷ দাদু কত স্মৃতিকথা লিখে রেখেছেন৷ যেন গল্পের বই৷ একটা নেশা চেপে বসল৷ প্রতিদিন রাতে একটু একটু করে পড়ি৷ কত অজানা আর ভয়ংকর কাহিনি জেনে গেলাম৷ তা বাড়ির কাউকে শেয়ার করলাম না৷

এর বেশ কিছুদিন পর একদিন ঝড়ের রাতে আলেয়া দাদি মারা গেলেন৷ চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা দাদিকে দেখে মনে হচ্ছে যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন৷ বুকের উপরে রাখা একটি হাতে শক্ত করে ধরে আছেন এক টুকরো কাগজ৷ যেটাকে তিনি সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন স্বামীর প্রেমপত্র বা মৌলভির চিঠি হিসেবে৷ আর এই মৌলভির চিঠিটা আর কারো নয় বরং বিশ্বাসঘাতক আমার দাদুর৷

মৌলভির চিঠি

আবু হানিফ জাকারিয়া

৭ জানুয়ারি, ২০২৩ , ১:৪৬ অপরাহ্ণ

মধ্যবয়সীর চিঠি

কতদিন ধরে প্রতীক্ষায় আছি

একটি নীল খামের জন্য, নয়তো একটি সাদা খাম

নিদেনপক্ষে ডাকবিভাগের একটি হলুদ খাম।

আসবে আসবে করে কত সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা

দিন, মাস, বছর এমনকি যুগও কেটে গেল।

আমার প্রতীক্ষার অবসান হলো না

হলো না আমার সুখানুভূতির স্বাদ নেওয়া,

খাম খুলে সেই চিঠির গন্ধ নেওয়া-

লুকিয়ে লুকিয়ে পড়া, ভিতরে ভিতরে তাড়িত হওয়া

সুখের আবেশে আর কল্পনায় হারিয়ে যাওয়া।

এখন আর প্রতীক্ষা করি না-

তবুও ক্লান্ত দুপুরে ডোরবেলটা বাজলে

চকিত হয়ে যাই, অজান্তেই প্রত্যাশার পারদ বেড়ে যায়।

গেট খুলে দেখি ভিক্ষুক নয়ত নতুন সাহায্যপ্রার্থী।

ডাকপিয়ন আর আসে না নীল, সাদা বা হলুদ খাম নিয়ে।

চিঠি আর আসবে না জানি-

সেই প্রত্যাশাও আর করি না এখন।

হঠাৎ ডোরবেল বেজে উঠল আবারও, 

ভাবলাম কোনো সাহায্যপ্রার্থী নয়ত ভিক্ষুক

না এবার সত্যি সত্যি সাদা খাম হাতে কেউ,

কুরিয়ারম্যান দিলো ব্যাংকের পাঠানো এক চিঠি

এ যে মধ্যবিত্তের লোনের কিস্তির ফিরিস্তি।

মধ্যবয়সীর চিঠি

শাহেদুজ্জামান লিংকন

৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ , ৩:০২ অপরাহ্ণ

সদৃশ

হবিউল্লাহ পর্ব

গলাটা খুসখুস করে শ্বাসে টান পড়ার পূর্বাভাস দেয়। স্পঞ্জে পানি ঢুকলে যেমন করে- বুকে; ফুসফুসের মধ্যে তেমন একটা শব্দের অনুভূতি। হবিউল্লাহ সচল ডান হাতটা বালিশের তলায় ঢুকিয়ে ইনহেলারটা খোঁজে। জায়গা মতো না পেয়ে ক্ষোভ ঝাড়ে তার স্ত্রীর উপর। হারামজাদী মাগি মোক মারি ফেলার জন্যে উঠিপড়ি নাগিছে। তোর কোন ইয়ার ভিতরত থুছিস। যাকে উদ্দেশ্য করে বলা সে ঘরে নেই বলে গালটা দিয়ে কোনো মজা পায় না হবিউল্লাহ। তা না হলে আরো কিছুক্ষণ চলতো। মাথাটা কাত করতেই দেখতে পায় বিছানার এককোণে পড়ে আছে ইনহেলারটা। সেটা হবিউল্লাহর হাতের নাগালের বাইরে। তাও ভালো যে ডানপাশেই আছে। নিশ্চল শরীরটাকে বিছানা-সংলগ্ন খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে কাত করতে দু’হাতের উপর ভর দিয়ে পাছাটা ছেঁচরিয়ে কোনোমতে সফল হয় সে। বুকের মধ্যে বাঁশির মতো শব্দ হতে থাকে। ডান হাতটা বাড়িয়ে ইনহেলারটা ছোঁয়ার চেষ্টা করে। অস্থিতিস্থাপক হাতের তালু বিছানায় ঠেকিয়ে আঙ্গুলগুলোকে রাবারের মতো বাড়াতে চেষ্টা করে। এদিকে বুকের টানটা বাড়তে থাকে। ইনহেলারটা একসময় ধরা দেয়। পাফ নিলে কষ্টটা কমে।

হবিউল্লাহর স্ত্রী আছিয়া সালাম সর্দারের বাড়ি থেকে ফেরে হাতে একশো টাকার দশটা নোট নিয়ে। টাকাটা সর্দারের ছেলে রতনের হাতে পাঠিয়েছে তার মেয়ে জীবন্নেছা। ঘরে ফিরে দেখতে পায় হবিউল্লাহ খুঁটিতে হেলান দিয়ে ঘন ঘন শ্বাস ছাড়ছে। আবারও উঠচেলো? হবিউল্লাহ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আছিয়ার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকানোর চেষ্টা করে। এই মুহূর্তে গাল দেওয়া যাচ্ছে না তাই চোখ দু’টিই ভরসা। কিন্তু সে চোখে ক্রোধের পরিবর্তে ফুটে ওঠে অসহায়ত্ব। স্বামীকে খুশি করার উদ্দেশ্যে আছিয়া বলে, রতনের হাতোত একহাজার টাকা পাঠাইছে। চান রাইতোত আসপে। তোমার জন্যে বোলে সোন্দর একটা পাঞ্জাবী কিনছে। শেষোক্ত কথাটা বাড়িয়েই বলে আছিয়া। তবে একদিকে ভাবলে কথাটা মিথ্যে নয়। জীবন্নেছা বাড়ি ফিরলে বাবার জন্য পাঞ্জাবী আর মায়ের জন্য শাড়ি তো আনবেই। আছিয়া সবসময় চেষ্টা করে মেয়েকে হবিউল্লাহর ক্রুর সন্দেহ থেকে রক্ষা করতে । হবিউল্লাহ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না কী করে জীবন্নেছা এতো ঘন ঘন টাকা পাঠায়। এতো টাকা সে কোথায় পায়? তাই সে এমন একটা সন্দেহ করে বসে যা বাপ হয়ে মেয়ের প্রতি কেউ করে না। কথাটা মনে মনে সে রাখে না। ঝেড়ে শুনিয়ে দেয় আছিয়াকে।

–           ফির টাকা পাঠাইছে? 

–           হয়। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে আছিয়া।

–           কোটে পায় উয়া এতো টাকা? বেইশ্যাগিরি করে? হবিউল্লাহর কণ্ঠস্বর উঁচু হতে থাকে।

–           থুক্কু থুক্কু। তোমার আরো যতো কথা। গারমেন্টত চাকরি করে না জীবন্নেছা?

–           থো তোর চাকরি। আর মানুষ বুঝি গারমেন্টত চাকরি করে না। হারেছ না চাকরি করে গারমেন্টত। তা উয়ার বউ-ছাওয়ার টিকা শ্যাও ক্যা?

হবিউল্লাহকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বাইরে চলে আসে আছিয়া। হবিউল্লাহ তখন আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকে। তার দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পারার কারণ যে তার মেয়ে জীবন্নেছা তা সে মেনে নিলেও মনে নিতে পারে না। মেয়ের উপার্জনের টাকায় কেনা চালের ভাত তার পেটপূর্তি করতে পারলেও মনপূর্তি করতে পারে না কোনোদিন। ভাতগুলো ধান হয়ে বুকের ভিতরে খচখচ করতে থাকে। একবার সে ভাবে- খাবে না মেয়ের উপার্জনের টাকা। কিন্তু নিমকহারাম উদর সে কথা মানতে চায় না। মেয়ের গীবত গাইতে গাইতেই সে একসময় বলে ওঠে, আনেক তো চাইরটা ভাত। প্যাটটা চো চো করেছোল।

হবিউল্লাহ প্রায়ই আছিয়াকে পরামর্শ দেয়- জীবন্নেছাক বাড়ি ডাকাও। বিয়া-শাদী দিয়া সোয়ামীর বাড়িত পাটে দে। আছিয়া বলে, বিয়াও দিলে খাইমেন কী? সোয়ামীর বাড়িত থাকলে কী আর হামাক টাকা-পাইসা দিবার পাইবে? মেয়ের উপর নির্ভর করা ছাড়া আর কোনো পথ খুঁজে পায় না আছিয়া। হবিউল্লাহ বলে, ভিক্ষা করি খামো। তেপথির মাথাত মোক শুতি থুয়া তুই ভিক্ষা চাবু। মোক দেকলে তো কতজনে ভিক্ষা দিবে। ভিক্ষার কথা শুনে জিহবা কাটে আছিয়া। থুক্কু থুক্কু কী কন এইল্লা। হামার চৌদ্দ গুষ্টিত কাও ভিক্ষা করে নাই। হবিউল্লাহ  তখন বলে, ওর জমিদারের বেটি তোর বেটির কামাই কি সারাজীবন খাবু? বিয়াও দিবু না? আছিয়া তখন হাসে। সেটা তকন দেখা যাইবে। না হয় দুইজনে বিষ খায়া মরমো। মৃত্যুর কথা শুনতেই কতোগুলো দৃশ্যপট ঘুরপাক খায় হবিউল্লাহর চোখের সামনে।

একাত্তরে যুদ্ধের সময় যখন পাকি বাহিনী হামলা করলো তাদের গায়ে তখন হবিউল্লাহরা বাড়ির সকলে আঙ্গিনায় বসে ভাত খাচ্ছিলো। হঠাৎ শুরু হলো গোলাগুলি। ছাৎ করে একটা গুলি হবিউল্লাহর কানের পাশ দিয়ে চলে গিয়ে ফুটো করে দিলো টিনের বেড়া। মাথাটা কাত না করলেই মরছিল সে। তারপর সবাই মাটিতে শুয়ে পড়লো।

আর একবার কী যেন একটা বিষয় চিন্তা করতে করতে সে হাঁটছিল বড় রাস্তা ধরে। সাথে ছিল নজু মিয়া। পিছনেই আসছিল একটা দানব ট্রাক। নজু মিয়া সেদিন টেনে না ধরলে ট্রাকের তলায় পিষ্ট হয়ে তার হাড়-হাড্ডি কিছুই খুঁজে পাওয়া যেতো না।

এরপর হবিউল্লাহর মনে পড়ে তিন বছর আগের ঘটনাটা। শামছুল মণ্ডলের বাড়িতে তখন কারেন্ট নেয়ার কাজ চলছিল। এ তল্লাটে শামছুল মণ্ডলের বাড়িতেই প্রথম বিদ্যুতের আগমন। শামছুল মণ্ডলের পক্ষে এটা ছিল মামুলি ব্যাপার। তারপরেও তার বাড়িতে কারেন্ট আসলো অনেক দেরিতে। লোকজন বলতো এটাও একটা চাল। শামছুল মণ্ডল বাড়ি পাকা করতে সময় নিয়েছিল এক বছর। একসাথে এতোগুলো টাকার উৎস কোথায় তা সম্বন্ধে যাতে কেউ সন্দেহ না করে তাই এমন উপায় অবলম্বন। শামছুল মণ্ডল চাকরি করতো জেলা প্রশাসকের অফিসে। অনেক ফাইল তার হাত দিয়ে পার হয়। আর ফাইল পার করার জন্য টেবিলের তল দিয়ে কিছু কচকচে নোট উড়ে এসে পড়ে তার পকেটে। কারো কাজ হয়, কারো হয় না। যাদের কাজ হয় না তারা টাকা ফেরত চাইলে ‘পরের বার হবে, আমি থাকতে চিন্তা কি’ বলার অজুহাতে সময় অতিবাহিত করে সে। একসময় ধার করে নেয়া কিংবা জমি-জমা বিক্রি করে দেওয়া টাকাটা পানিতে চলে গেলে সর্বশান্ত লোকগুলো সরকারের লোক শামছুল ম-লের সাথে পেরে ওঠে না। তখন কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে বিচার চাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। কিন্তু এলাকার লোকজনের কাছে ‘শোনা কথা’ ছাড়া কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকায় তলে তলে বাড়তে থাকে শামছুল মণ্ডলের প্রতিপত্তি ও প্রভাব।

উপজেলা সদর থেকে আসা মিস্ত্রি বিদ্যুতের লাইন ঠিক করছিল শামছুল মণ্ডলের বাড়িতে। গ্রামের উৎসুক ছেলে-মেয়েরা দল বাঁধিয়েছিল সেখানে। যেখানে একটা মোটরসাইকেল দেখলে সবাই পিছনে পিছনে দৌড়াতে শুরু করে সেখানে কারেন্ট আরেক বিস্ময়! বাচ্চাদের দলে মিশে গিয়েছিল হবিউল্লাহও। কারেন্টের মিস্ত্রি টেস্টার দিয়ে চেক করছিল বিদ্যুত আসছে কিনা। একসময় মিস্ত্রি নাস্তা করতে গেলে অতি উৎসাহী হবিউল্লাহ একটা তার ছুঁয়ে দেখতেই শক খেলো। তৎক্ষণাৎ ঝটকিয়ে হাত সরিয়ে নিলো সে। ওরে বাপো চিন্নিত করি উঠিলরে। পাশে বসে পেপার পড়ছিল শামছুল মণ্ডল। হবিউল্লাহর চিৎকার শুনে চশমার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগলো- হলো কী? পাশে থাকা অবোধ বালক-বালিকার দল আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে নালিশ জানালো- ওমা হাত দিছলো। পাশে পড়ে থাকা একটা বাঁশের খুঁটা হবিউল্লাহর দিকে ছুঁড়ে মেরেছিল শামছুল ম-ল। মরির আসছিস এটে কনা? মইরবার আর জাগা পাইস না? সেই খুঁটা ঘুরে ঘুরে এসে সরাসরি লাগলো হবিউল্লাহর পিঠে। ডানহাতে চেপে ধরা বাহাত সরিয়ে নিয়ে দু’হাতেই এবার সে চেপে ধরলো কোমর। ককিয়ে উঠলো সে। বসে পড়লো মাটিতে। তারপর মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগলো। মরনু রে মুই মরনু। ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত শামছুল মণ্ডল। তারপর হবিউল্লাহকে নিয়ে যাওয়া হলো উপজেলা সদর হাসপাতালে। সেখানকার ডাক্তার সবকিছু শুনে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে বললো, রোগীকে রংপুর মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া লাগবে। শামছুল মণ্ডলের বেশ কিছু টাকা গচ্ছা গেল সেখানে। কিন্তু হবিউল্লাহর কোনো উন্নতি হলো না। শরীরের নিম্নাংশ অকেজো হয়ে গেল। আর হাঁপানী রোগটা তাকে উপহার দিয়ে গেছে পরলোকগত পিতা।

পিঠের সেই আঘাতের সাথে পায়ের কী সম্পর্ক তা আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেনি হবিউল্লাহ। মাঝে মাঝে সে ডাক্তারকেই গাল দিয়ে বসে, চ্যাটের ডাক্তার এইল্লা। খালি গরিব মাইনষার টাকাগুলা মারি খায়। কিন্তু ডাক্তার নয়, তার বেশির ভাগ টাকা গেছে কোর্ট-কাচারিতে। সমুন্ধির কথা শুনে সে কেস করেছিল শামছুল মণ্ডলের বিরুদ্ধে। কোর্টের টাকা যোগাতে ধানী জমিটুকু বেচে দিতে হয়েছিল। তারপর সেই টাকা তুলে দিয়েছিল সমুন্ধি ছাবের আলীর হাতে। ছাবের আলী তাকে আশ্বস্ত করেছিল- দুলাভাই চিন্তা করবেন না। শামছুল মণ্ডলক এবার দেখি ছাড়মো। শেষ পর্যন্ত শামছুল মণ্ডলের কিছুই করা গেল না। টাকা শেষ হয়ে গেলে ছাবের আলীরও আর দেখা মিললো না। সে যে তিন বছর থেকে বিছানায় পড়ে আছে একটাবারও যদি তাকে দেখতে আসে নিমকহারাম ছাবের আলী। হবিউল্লাহ ভাবে একবার যদি সে হেঁটে গিয়ে ধরতে পারতো ছাবের আলীর গলাটা। নিরুপায় হয়ে তাই সে প্রায়ই উড়ন্ত গাল ছুঁড়ে দেয় ছাবের আলীর উদ্দেশ্যে- চুদির ভাই মাইনষার পাছা মারা বুদ্ধি দিয়া বেড়ায়। অথচ ওইসব টাকা যদি সে নিজের চিকিৎসার পিছনে ব্যয় করতো তাহলে এতোদিনে দিব্যি ভালো হয়ে যেতো বলে তার বিশ্বাস।

সমুন্ধির কথা ভাবতে গিয়ে নিজের মেয়েদের কথা মনে পড়তেই হবিউল্লাহর মনের আগুনে ঘি পড়ে । তার বড় তিন তিনটা মেয়ে যাদের সে বিয়ে দিয়েছে হাড়-ভাঙ্গা পরিশ্রমের টাকায়, তারা বুড়ো বাপের কথা ভুলেই গেছে। এমন নিমকহারাম মেয়ের সে জন্মদাতা ভাবতেই একেকবার নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বসে হবিউল্লাহ। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তারা আর আসতেই চায় না। আসলেও বেশিক্ষণ থাকে না। কাজের অজুহাত দেখায়। হবিউল্লাহ তখন চেঁচিয়ে বলে, যা যা তোর ফির পোরধান মন্ত্রীর সাথে জরুরী মিটিং আছে। বাবার কথার অন্তর্নিহিত গুরুত্বের কথা ভেবে সময় নষ্ট না করে মেয়েরা ফিরে যায় প্রতিদিন পেটানো স্বামীর ঘরে। তখন ছোট মেয়ে জীবন্নেছাকে পূজা করতে ইচ্ছে হয় হবিউল্লাহর। জীবন্নেছাকে নিয়ে বিপরীতমুখী দুই ভাবনার  স্রোতকে এক করতে গিয়েও পারে না সে।

পুরনো এসব কথা ভাবতে ভাবতে মাথাটা ধরে আসে হবিউল্লাহর। পেটের ভিতরে খিদাটা চাড়া দিয়ে উঠলে সে হাঁক ছাড়ে- কোটে গেলুরে আছিয়া? তুই ওজা আছিস দেখি কি মোক খাবার দিবু না? আছিয়া ঘরে ফেরে আরো কিছুক্ষণ পর। আছিয়া এক জব্বর খবর নিয়ে এসেছে। খবরটা শুনছেন? হবিউল্লাহ খেই খুঁজে পায় না। কীসের খবর জিজ্ঞাসা করলে আছিয়া জানায়- আইজ বিয়ানবেলা লেপটিন যাবার ধরিয়া শামছুল মণ্ডল বেলে উল্টি পড়ি গেছলো। তারপর থাকি হাত-পা নড়ের পায় না। একনা আগোত মাইক্রোত করি অংপুর নিয়া গেল। খবরটা শুনে হবিউল্লাহর মনটা খারাপ হলো না খুশি হলো তা স্বামীর  মুখ দেখে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না আছিয়া। আর সেটা জা