গল্প

রবীন জাকারিয়া

৭ জানুয়ারি, ২০২৩ , ১:৪৬ অপরাহ্ণ

মৌলভির চিঠি

আমার দাদু মৌলভি আলীম সরদার নামজাদা বামপন্থী পলিটিশিয়ান এবং সংস্কৃতি কর্মী৷ এলাকায় তাঁর প্রভার আর ক্ষমতা অকল্পনীয়৷ তাঁর কথাই শেষ কথা৷ বিচার, শালিস সবই তাঁর মর্জিতে৷ বরখেলাফ করলে কী ভয়াবহ ঘটনা কপালে জুটবে সেটা সকলের জানা৷ তাই কেউ টুশব্দটিও করে না৷ দাদু সমাজতান্ত্রিক দল করতেন৷ বলা যায় প্রভাবশালী নেতা৷ অন্যদিকে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে তাঁর বিচরণ তাঁকে নিয়ে গেছে এলাকার শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে৷ স্থানীয় স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, ইয়াতিমখানা, মসজিদসহ সকল প্রতিষ্ঠানের সভাপতি৷ অবহেলিত ও নির্যাতিত নারীদের জন্য নারী পুনর্বাসন সেন্টার নামে একটি আশ্রম আছে৷ অবশ্য সেই আশ্রমে কেন যেন প্রায়শঃই নির্যাতিত নারীরা আত্মহত্যা করে! দাদুকে এসব সামলাতে বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকতে হয়৷ তাছাড়া জনসেবা৷ এলাকার মানুষের খোঁজ খবর নেওয়া৷ তাই বাড়িতে সব সময় দর্শনার্থীদের ভীড়৷ 

আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিল যে দাদুর নামের সামনে মৌলভি টাইটেলটা কেন? তিনিতো কোনোদিনও টুপি পাঞ্জাবি পরতেন না৷ এমনকি দাড়িও ছিল না৷ তিনি নিয়মিত নামাজও পড়তেন না৷ বরং ধর্মবিরোধী অবস্থান ছিল তাঁর৷ কিন্ত মৌলভি হলেন কেন? অনেক পরে জেনেছি যে ঐ সময় মুসলিম ব্যক্তিদের নামের সামনে মৌলভী লেখা হতো৷ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামেও মৌলভী টাইটেল ছিল৷

দাদু কঠোর চীনপন্থী সমাজন্ত্রী ছিলেন৷ তাই তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও নিজ দেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে নিরলস কাজ করেছেন৷

৭০ এর নির্বাচনে সারা বাংলাদেশে ১৬২ আসনের মাঝে দুইটি আসনে আওয়ামীলীগ পরাজিত হয়। একটি হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আরেকটি ময়মনসিংহ সেন্ট্রাল।

পার্বত্য চট্টগ্রামে জয়লাভ করেন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় ও ময়মনসিংহে পিডিপির নুরুল আমিন।

এই দুজনের বিজয়ে দাদুর অবদান ছিল৷ তিনি তাদের নির্বাচনী প্রচারে নিরলসভাবে কাজ করেছেন৷ 

এরপর দেশ স্বাধীন হলে তিনি আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হন৷ 

দাদু নিজে উচ্চ শিক্ষিত হলেও তাঁর কোনো সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করতে পারেননি৷ বরং প্রত্যেকে হয়েছে একেকটা সুবিধাবাদী আর ক্ষমতালিপ্সু মানুষ৷ 

দাদু পলিটিকস বোধ হয় বেশ ভালই জানতেন৷ যার কারণে তিনি যেমন জীবদ্দশায় সর্বদা PGP (Present Government Party) করতেন৷ ঠিক তেমনি তাঁর সন্তানেরা৷

আমাদের বাড়িতে আলেয়া নামক এক বয়স্ক গৃহকর্মী থাকেন৷ মানসিক প্রতিবন্ধী৷ দাদুর যৌবনকাল থেকেই তিনি আছেন৷ আমি তাকে আলেয়া দাদি বলে ডাকি৷ দিদি বললে আমার নিজের দিদি রাগ করেন৷ তাই দাদি বলি৷ মাঝে মাঝে যখন ওনার মাথা ঠান্ডা বা ঠিক থাকে তখন গল্প বলেন৷ আদর করেন৷ বেশ উপভোগ করি৷ কিন্ত মাথা বিগড়ে গেলে তখন হাতে একটা কাগজ নিয়ে সকলকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলতে থাকবে “এই দ্যাখ মৌলভি আমাকে চিঠি লিখেছে”৷ মৌলভীর চিঠি মানে তার স্বামীর প্রেমপত্র৷ এলাকার এমন কোনো মানুষ নেই যে তার এই প্রেমপত্রের কথা জানে না৷ শুধু তাই নয় রাস্তা-ঘাট কিংবা মোড়ের রিক্সাচালক পর্যন্ত জানে৷ আমাদের সমাজে যা হয় পাগল দেখলে সহানুভূতির চেয়ে ক্ষেপাতে পারলে আনন্দ পাই৷ তার সাথে প্রতিদিন তাই ঘটত৷ দিনশেষে এক টুকরো ছেঁড়া কাগজ নিয়ে আলেয়া দাদি ঘরে বসে কাঁদতেন৷ আমার খারাপ লাগতো ভীষণ৷ কিন্ত কিছু করতে পারতাম না৷ আমিতো ছোট তাই৷

আমি একটা জিনিষ দেখে অবাক হতাম৷ দাদুকে নিয়ে যে যাই বলুক৷ কিন্ত মানুষটা আসলে মহান৷ না হলে একজন গৃহকর্মীর জন্য এত ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ থাকে? যখন যা চাচ্ছে তাই এনে দেয়৷ কেউ বাধা দিলে বলে “পাগল মানুষ একটা আবদার করেছে দিয়ে দাও, আমরা বিনির্মাণ করবো এক সাম্যবাদি সমাজ৷ যেখানে থাকবে না কোন শ্রেণি বৈষম্য”৷ দাদুর কথা কেউ ফেলতে পারে না৷ 

দিদিকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম উনি কীভাবে পাগল হলেন? এমনকি ওনার একটা ছেলে সেও পাগল৷ বিষয়টা কী? দিদি বললেন যদিও তুই ছোট মানুষ সব বুঝবি না৷ তবুও বলি শোন্ আলেয়ার বিয়ে দেওয়া হয়েছিল এক মৌলভির সাথে৷ পাশের মসজিদের খাদেম ছিল৷ এরপর ওর ছেলেটা পেটে আসে৷ এমন সময় ওর স্বামী ওকে রেখে পালিয়ে যায়৷ এই দুঃখে ও আস্তে আস্তে মানসিক ভারসাম্য হারাতে থাকে৷ ও কোনো কিছু না বলে হঠাৎ হঠাৎ করে নিখোঁজ হতো৷ পেটে সন্তান অন্যদিকে এভাবে শরীরের উপর টর্চারের কারণে প্রসব জটিলতা সৃষ্টি হয়৷ উপায়ান্তর না থাকায় ডাক্তার সাত মাসেই তার বাচ্চাকে প্রসব করাতে বাধ্য হয়৷ অপ্রাপ্ত শিশু৷ বাঁচা মরা অবস্থা৷ মা পাগলি৷ ঠিকভাবে দুধ পায় না৷ মায়ের সঠিক যত্নের অভাব৷ সব মিলিয়ে দেখা গেল ছেলেটাও প্রতিবন্ধী৷ পাগল৷ একদিকে স্বামীর শোক৷ অন্যদিকে ছেলের এমন অবস্থা দেখে আলেয়া একেবারেই পাগলি হয়ে গেল৷

একদিন হঠাৎ করেই দীর্ঘ আয়ুর দাদু মারা গেলেন৷ তাঁর বয়স হয়েছিল ১০২ বছর৷ বাড়িতে শোকের ছায়া৷ পরিবারের মাথার ছাতাটা ভেঙে গেল৷ সময় সব ক্ষত মুছে দেয়৷ জীবন নতুন করে সাজে৷ পরিবর্তন হয় নেতৃত্বে৷ এখন আমার বড় বাবা হলেন পরিবারের নেতা৷ তাঁর আনুগত্যে কারো অসন্তোষ নেই৷ আবারো সব কিছু ঠিক ঠাক৷ 

ক’দিন আগে বড়বাবা কিছু লেবার লাগিয়েছে দাদুর ঘরটাকে পরিস্কার করবে বলে৷ অপ্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র, ফার্নিচার পুড়িয়ে ফেলে ঘরটাকে বসবাস উপযোগী করা হবে৷ লেবার-মিস্ত্রি বাড়িতে কাজ করলে আমার ভালো লাগে৷ আমি দাঁড়িয়ে থেকে দেখি৷ অনেক সময় পুরোনা কোনো খেলনা, মার্বেল কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়া পিচ দিয়ে বানানো নিজের হাতুরি দেখলে খুশি হই৷ ওগুলো আবার সংরক্ষণ করি৷ এমন সময় দেখলাম লাল কাপড়ে মোড়ানো একটা মোটা খাতা৷ আমি ওটাকে নিজের কাছে রাখলাম৷ ওটা আসলে ডায়েরি৷ দাদুর ডায়েরি৷ নিজের ঘরে লুকিয়ে রাখলাম৷ রাতে পড়তে লাগলাম৷ মজা লাগছিল৷ দাদু কত স্মৃতিকথা লিখে রেখেছেন৷ যেন গল্পের বই৷ একটা নেশা চেপে বসল৷ প্রতিদিন রাতে একটু একটু করে পড়ি৷ কত অজানা আর ভয়ংকর কাহিনি জেনে গেলাম৷ তা বাড়ির কাউকে শেয়ার করলাম না৷

এর বেশ কিছুদিন পর একদিন ঝড়ের রাতে আলেয়া দাদি মারা গেলেন৷ চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা দাদিকে দেখে মনে হচ্ছে যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন৷ বুকের উপরে রাখা একটি হাতে শক্ত করে ধরে আছেন এক টুকরো কাগজ৷ যেটাকে তিনি সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন স্বামীর প্রেমপত্র বা মৌলভির চিঠি হিসেবে৷ আর এই মৌলভির চিঠিটা আর কারো নয় বরং বিশ্বাসঘাতক আমার দাদুর৷

মৌলভির চিঠি